প্রথম প্রেম

রাজিয়া নাজমী
গল্প
Bengali
প্রথম প্রেম

ভোররাতে মেঘের গর্জনে ঘুম ভেঙে গেলেও খুব ভাল লাগছিলো মাহিরের। অনেকদিন এমন বাজ পড়ার আওয়াজ শোনেনি। তবে মেঘের হুমকির তুলনায় বৃষ্টি তেমন হল না। সকাল থেকে বৃষ্টি থেমে থেমে পড়ে, থেমেই গেলো দুপুর বেলা। রোদ তেমন উঠবে বলে মনে হচ্ছে না। আকাশ  জুড়ে ছাই রঙয়ের মেঘ মন্থর গতিতে ভেসে চলছে। মাঝে মাঝে গেঁয়ো রোধ উকি মারছে। ভাবটা যেন ভালইতো ছিলাম। এখন না আবার ঝাঁ ঝাঁ করে রোধ ছড়াতে হয়।

মাহির ঘড়ি দেখল। দুপুর দুটো বাজে। আকাশ একটু পরিষ্কার হোক তারপর জে হেইচে যাবে। ইদানীং আর জ্যাকসন হাইটস বলে না। শামার মুখে শুনে অভ্যাস হয়ে গেছে জ্যাকসন হাইটসকে ‘জে, হেইচ’ বলা। বন্ধুদের মধ্যেও এটা চল হয়ে গেছে এখন। যদিও কারো জানা নেই এই সংক্ষেপণ কোথা থেকে এলো।

শামার কথা মান্না ছাড়া কোন বন্ধুকেই বলতে পারেনি। ক্যালিফোর্নিয়াতে মাঝরাতে ফোন করে বলেছিল শামার কথা। পরদিন ভোরে ফোন করে মান্না আবার জানতে চাইলো, শামার সাথে তোর কাল কোথায় দেখা হল? কেমন আছে? না না আগে বল তোর কি অবস্থা? এটা কী করে হইলো দোস্ত …। মাহির জানতো এক মাত্র মান্নার কাছেই শামার কথা বলা যায়। কতকাল মান্নার সাথেও দেখা হয় না। বন্ধুরা সব যে যার জীবনে হারিয়ে গেছে। মিলির অপছন্দের জন্যও অনেক বন্ধুকে হারিয়েছে।

নিউইয়র্কে আসার পর বন্ধুদের মধ্যে এনামের সাথেই বেশী দেখা হয়। এনাম বাংলাদেশ থেকে আমেরিকায় এসেছে বেশ কয়েকবছর আগে। পলিটিকাল অ্যাসাইলাম নিয়ে আছে এদেশে। অড জব করে। প্রয়োজনীয় আয় করার পর বাঁকি সময় রাজনীতির আড্ডায় সময় কাটায়। নিছক সময় কাটানোর জন্য সেই পুরনো অভ্যাস ধরে রেখেছে অথবা দেশ ছেড়ে আসার জন্য এক ধরনের যন্ত্রণা থেকেই হয়ত করে।

অনেকের ভিতরেই মাহির এটা দেখেছে। দেশে যতটা না রাজনীতির সাথে জড়িত ছিল তার চেয়ে অনেক বেশী এখন জড়িত। যেন দেশের জন্য কি ভালো তা বিদেশে এসেই বুঝতে পারছে।

মাহিরের বেলায় হয়েছে তার উল্টো। দেশে সক্রিয় থেকে এখন একবারেই সরে গেছে। তবে নিউইয়র্কের বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে আবার একটু ফিরে আসতে ইচ্ছে হয়েছিল। বন্ধুরা টেনে নিয়েও গেছে মিটিঙে। বক্তা করেছে। প্রথম প্রথম ভালো লাগতো। কিন্তু একসময় এসব অর্থহীন মনে হতে লাগলো। যারা এখানে এত হৈ চৈ করছে তারা সত্যি কী দেশের কথা ভেবে করছে?

এনাম বলেছিল, এখানে রাজনীতির আড্ডা ছাড়া তেমন কিছু জমে ওঠে না।

তাহলে এটা শুধুই আড্ডা তোমাদের জন্য? মাহিরের নিঃস্পৃহ জিজ্ঞাসার উত্তরে

এনাম কিছুটা বিদ্রূপ করেই বলেছিল, কারো জন্য তাই আবার কারো জন্য অন্য ফায়দা। এসেছ যখন নিজেই বুঝে নিতে পারবে।

তবে এই মিটিঙে গিয়ে একটি লাভ হয়েছে মাহিরের। পুরনো অনেক পরিচিতর সাথে বহুবছর আগে হারিয়ে যাওয়া শামাকে আবার খুঁজে পেয়েছে।এধরনের কোন মিটিঙে শামা আসতে পারে সেটা মাহির কখনই ভাবেনি।

অবাক হওয়ার পালা শেষ হতে মাহির জিজ্ঞাসা করেছিল, কবে থেকে রাজনীতির খাতায় নাম লেখালে?

শামা গালের টোল ফেলে হেসে বলল, আরে না। রাজ্য নীতি করার মত জ্ঞানী কবে ছিলাম যে করব! বন্ধুর বাড়ি গিয়েছিলাম। জোর করে টেনে নিয়ে এলো কারণ তার স্বামীও আজ গুরুত্বপূর্ণ বক্তা। অবশ্য বলেছিলে আমার খুব পরিচিত একজনও এই মিটিঙে আসবে। সেটা যে তুমি তা বুঝতে পারিনি। তুমি যে নিউ ইয়র্কে এসেছ সেটা অবশ্য শুনেছিলাম।

– তা জেনেও যোগাযোগ করলে না?

– করতে পারতাম। ইচ্ছে করেই করি নাই। ফোন করে ‘হেলো আমি শামা, চিনতে …’ এই সব বলতে ইচ্ছে করেনি।

একই শহরে আছ, দেখা যদি হওয়ার থাকে তবে এমনি হয়ে যাবে। এই যে দেখ হয়ে গেলো দেখা।

– বিষাদ কণ্ঠেই মাহির বলল, তোমার আমেরিকায় আমি থাকবো তো একটি বছর।

  – মাহির,আমাদের দেখা না হওয়ার তো কয়েক যুগ পার হয়ে গেছে। আমাদের আলাদা জীবনের পথে চলতে চলতে হঠাত দেখা হলেই হতে পারে।

মাহির মুগ্ধ চোখে দেখছিল এতগুলো বছরেও শামার গালের টোল তেমনি আছে। বয়সের ভারে বদল হলেও খুব সুন্দর বদল হয়েছে। শামা আগের চাইতে যেন আরও আকর্ষণীয়া।আগের চাইতে কথা বলার স্বভাব আরো স্পষ্ট। ভালো লাগছিলো ওর কথা বলার ঢঙ্গ।

শামা কিছু বলছিল। মাহির অন্যমনস্ক হওয়ায়ে সব শুনতে পায়নি। শেষের কথাগুলো কানে এলেও আবার শোনার জন্য বলল, আজকাল কানে কম শুনি।কি বললে আরেকবার বল।

-শামা হেসে বলল, রাস্তার গাড়ির আওয়াজও বেশি।বলছিলাম, এসব মিটিঙে জেনে বুঝে এসো।অল্পদিন এসেছ এখানে।একটু হাওয়া বুঝে নিও।সত্যি কথা বলতে এই আড্ডা, মিটিং চিৎকার চেঁচামেচি করে দেশের কী লাভ হচ্ছে জানিনা তবে কারো কারো ব্যক্তিগত লাভ অবশ্যই হচ্ছে।কেউ দেশে নেতা না হতে পারলেও এখানে তো হচ্ছে।

 -আত্মতৃপ্তি লাভ!

 -তোমার যদি নেতা কিংবা অন্য কোন ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য না থাকে তবে বরং সময়টা অন্য কাজে লাগাও।

মাহির বাঙালী অনুষ্ঠানে আর বক্তা হতে আর যায়নি। আজকাল সেই অন্য কা্জের ভাবনায় লাইব্রেরীতে অবসর সময় ব্যয় করছে।

শামার সাথে ফোনেই কথা হয় বেশি তবু মাসে দুমাসে দুই একবার দেখাও হয় অফিসে বা কোন রেস্তোরাঁয়।কথায় কথায় শামা একদিন যা বলেছিল তাতে খুব ধাক্কা লেগেছিল মাহিরের।সত্যি তো ভাল চাকরি ছাড়া কী করেছে সে!

-শামা বলেছিল, তোমার লেখার কি হল?কথা ছিলো তুমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরীতেই ফিরে যাবে। সে না করলেও ভেবেছিলাম অন্তত তোমার লেখা বই লাইব্রেরিতে থাকবে। তোমার চিন্তা ভাবনাকে এতটাই বদলে ফেললে কেন?

সেই রাতে মাহির ঘুমাতে পারে নাই।ফেলে আসা সময়কে টেনে আনতে ইচ্ছে করছিল। সকালবেলা শামাকে ফোন করে জানিয়ে দিল আজ দুপুরে একবার ওর অফিসে যাবে। শামা কিছু বলার আগেই মাহির ‘আসছি’ বলে লাইন কেটে দিলো।

ম্যানহাটন থেকে ট্রেনে করে শামার লং আইল্যান্ডের অফিসে যেতে এক ঘণ্টা লাগে।

শামা ওর অফিসের সিকুইরিটি গেটের বাইরে অপেক্ষা করছিল।মাহিরকে দেখে মৃদু রেগে বলল, কী এমন যুদ্ধ বেধে গেলো যে আজই আসতে হলো। জান তো অফিসের ভিতরে যাবার জন্য অন্তত একদিন আগে সিকুইরিটির পারমিশন লাগে।

-মাহির বলল, অসুবিধা নেই, কাছে পিঠে কোন কফি সপে চল।

কফি নিয়ে বসেই মাহির নোটবুক এগিয়ে দিয়ে বলল , কথা দিচ্ছি আমি লিখব আর তোমাকেই উৎসর্গ করব আমার প্রথম বই। ভাবছি একটা ব্রেক নিয়ে দেশেই ফিরে যাব। আমি কাল রাতে অনেক ভেবেছি…

মাহির কী ভেবেছে শামা’ র জানতে ইচ্ছে করলো না। মাহিরের ক্ষণকালের ইচ্ছে , স্বপ্ন  অনেক শুনেছে সে। বাস্তব রূপ দেখেনি।অসম্ভব মেধাবী ছিল বলেই মাহির এত ভাল রেজাল্ট করেছিল। নয়ত মাহিরের স্বভাবের কারো পক্ষে কলেজ পাস হওয়ার কথা নয়। বন্ধুদের সাথে নেশার ভিতরে ডুবে থেকেও মাহিরের রেজাল্টের কোন ক্ষতি হয়নি। ক্ষতি হয়ে গেলো অন্য ইচ্ছের, অন্য কারো।

-শামা খাতাটা বন্ধ করে দিয়ে বলল, বই লিখবে লেখ।আমাকে উৎসর্গ করার কথা বল না কারণ তুমি তা করতে পারবে না।মাহির, যা করার সাহস নেই তা শুধু মন চায় বলেই বল না। তাতে অন্যের ক্ষতি হয়। এবার চল আমি তোমাকে স্টেশনে নামিয়ে দিয়ে অফিসে ফিরে যাই।

মাহির শামাকে যতটা খুশি দেখবে ভেবেছিল তার বিন্দু মাত্র নেই বলে কিছুটা আহত কণ্ঠেই বলল, ভেবেছিলেম খুশী হবে। আমি বুঝতে পারছি এতগুলো বছরেও আমার দেওয়া আঘাত মুছে যায়নি তোমার মন থেকে।

এনামের ফোনের আওয়াজে জানলা থেকে সরে গিয়ে দরজায় তালা টেনে সিগারেটে আগুণ ধরিয়ে ট্রেন স্টেশনের দিকে হাটতে হাটতে ফিফত অ্যাভেনুয়ের জুয়েলারি দোকানের সামনে দাঁড়ালো। কাচের ভিতরে সাজিয়ে রাখা হীরার আংটিটা আজ আরেকবার দেখে নিজেকেই বলল, এই আংটিটাকে কোনদিন কাঁচের ঘেরের ভিতর থেকে আমার আনা হবে না।যাকে বলতে ইচ্ছে করে তাঁকে বলাও হবে না ‘… তুমি হ্যাঁ বল’।

জে হেইচে আসতে বিকেল চারটা বেজে গ্যালো।

সাধারণত ওরা রেস্তোরাঁয় নয়ত এক বন্ধুর ট্রাভেল এজেন্সির অফিসে বসে। তবে গত রোববার সন্ধেবেলা সেই অফিসের সামনের দেয়ালে বসেই ড্রিং করেছিল কয়েকজন মিলে। মনে হচ্ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই দিন গুলো।মাহির একটু ইতস্তত করেছিলো প্রথম।তারপর ভাবল নিকুচি করি প্রেস্টিজিয়াস চাকুরীর। ও আজ মন খুলে আড্ডা মারবে, এনজয় করবে। শামা শুনে হাসতে হাসতে বলেছিল বাহ, বয়সটাকে ছুড়ে ফেলতে পেরেছ তোমার বর্তমান প্রেস্টিজের সাথে।আমরাও সামারে মাঝে মাঝে জ়ে হেইচে শাড়ী পড়ে ঘুরে বেড়াই তবে চায়ের দোকানে আড্ডা মারি।

মিলিকে মাহির ওর এই মাতলামি পাগলামির কথা কখনই বলতে পারবে না। মিলির কাছে এটা সম্পূর্ণ নিচুস্তরের মন মানসিকতার কাজ – এতে ওর মানে বাধবে।  মিলির ঠাটটা ওর উচ্চ শিক্ষিত পরিবারকে নিয়ে। এতগুলো বছর পার হয়ে গেলো ওদের বিবাহিত জীবনের। ছেলেমেয়ে বড় হয়ে গেল তবু মিলির চিন্তা ভাবনায় কোন পরিবর্তন এলো না। সারাক্ষণ আমি অমুকের মেয়ে অমুকের বোন। মাহিরের ধন্য হয়ে যাওয়া উচিত এমন পরিবারে বিয়ে করতে পেরে। মিলির ধারনা ওর সাথে মাহিরেরে মত এত উচ্চ শিক্ষিত ছেলের বিয়ে হওয়াটাই স্বাভাবিক।ভাবটা এমন মাহির পড়াশুনা করেছে, ভাল রেজাল্ট করেছে যাতে করে মিলির মত কারো সাথে বিয়ে হতে পারে !

মাহিরের সাথে পরিচয়ের আগে মিলি কারো সাথে প্রেম করেনি। ওর বোনরা সবাই প্রেম করেই বিয়ে করেছে।বয়সে সবার বড় হয়েও মিলির বিয়ে হয়নি। মিলি দেখতে সাদামাটা তার উপরে খুব রোগা এবং পাঁচ ফুট উচ্চতায় আসতে গেলে চার ইঞ্চি উঁচু স্যান্ডেল পড়তে হয়। প্রায় ছয় ফুট উচ্চতার মাহিরের মা বোন বন্ধুরা অবাক হয়েছিল মাহিরের সিদ্ধান্তে।ওদের ধারনা মাহির ফেঁসে গিয়েছিল। সন্দেহ একরকম বিশ্বাসে পরিণত হল যখন ওদের ছেলে জন্ম নিলো বিয়ের ঠিক সাত মাসের মাথায়।

আর্লি বার্থ বলে যদিও ব্যাপারটা ধামাচাপা দিতে হয়েছে।

কে জানে হয়ত মিলির কথাই ঠিক মাহির ওদের পরিবারের একজন হতে চেয়েছিল বলেই মিলিকে বিয়ে করেছিল।তা না হলে হারভার্ড থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি নিয়েই এক সপ্তাহের মধ্য দেশে ফিরে মিলির সাথে দেখা হবে কেন সদ্য জয়েন করা অফিসে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মিলি ওর এক বছরের জুনিয়ার ছিল অথচ মাহির আজ মনে করতে পারেনি মিলিকে কখন দেখেছে।

পরিচয়ের ছয় মাসের মধ্যেই বিয়ে হয়ে গেলো ওদের।

মিলির যখন তখন কটূক্তির উত্তরে ইচ্ছে হলেও আসল কথাটা মিলিকে বলতে পারে না। যা হবার তা হয়ে গেছে যা ঘটার তা ঘটে গেছে। ছেলে মেয়ের মুখের দিকে তাকালে মাহির সব যন্ত্রণা ভুলে যায়।

তবে মিলির বুদ্ধির তারিফ করতেই হয়। বিয়ে করবে না এমন জেদ সে করেনি। সে দেখতে যেমন তেমন বলে যাকে তাকে সে বিয়ে করবে না সেই জেদ ছিল। তাই মেয়েলি বুদ্ধির শেষ খেলাই খেলেছিল। মিলি বুঝতে পেরেছিল মাহিয়ের মত ছেলেদের কোথায় দুর্বলতা।

মাহিরের মনে একটি অপরাধ বোধ ঢুকাতে সক্ষম হয়েছিল মিলি।মাহিরের ইচ্ছায় সারা দেওয়ার দায় তো মিলির একার নয়।এতকাল যে মেয়ে বিয়ে করেনি সে এখন এই কলঙ্ক মাথায় নিয়ে কী করে আর কাউকে বিয়ে করবে।মিলির তখন তেত্রিশ বয়স। মাহিরও তার কৃতকর্মের দায় এরাতে পারেনি।

ছেলের বয়স একবছর হতেই মেয়ের জন্ম হল। মিলির তার বয়সের দোহাই দিয়ে মাহিরকে দায়িত্বের বেড়াজালে আটকে ফেলল। স্ত্রী হিসাবে অবশ্য এটা করতেই পারে। বিবাহিত জীবনের শক্ত ভীত সন্তান ছাড়া আর কি হতে পারে। মাহিরের জীবন একটা ছাপোষা জীবনে পরিণত হল। মোটা বেতনের চাকরি, দামি বাড়ি , ব্যাঙ্কে টাকা। স্ত্রীর অদৃশ্য হুকুমে শ্বশুর বাড়ীর জন্য কর্তব্য করা।নিজের ভাইবোনদের খোজ করাটাই বরং সময়ের অভাব এখন।

মিলির অত্যাচারে জীবনকে অতিষ্ঠ লাগে মাহিরের। প্রতিটি মুহূর্তের হিসাব দিতে দিতে মিলিকে একটা সারভিলেন্স ক্যামেরা ছাড়া আর কিছু মনে হয় না এখন।

মিলির ছেলেমেয়ের জন্য লন্ডনে থাকার সিদ্ধান্তে একরকম বেঁচেই গিয়েছে সে। অন্তত কিছুদিনের জন্য মুক্তি!

এই বিয়ের বাধন সে চাইলেও ভাঙতে পারবে না।বন্ধনহীন এক বাঁধন মিলির সাথে। শামা সরাসরি না জানতে চাইলেও মাহির জানে শামা ঠিক জানতে চায় এত অল্প চেনায় বিয়ে কেন!বলা সম্ভব হয়নি সব।

ওর ভাঙাচোরা বিবাহিত জীবনের কাহিনী শুনে একদিনই রেগে গিয়ে বলেছিলো – মাথাটা বিক্রি করলে কত তে? খারাপ লেগেছিল কিন্তু জানে এর চেয়েও বেশী অপমান করার অধিকার ওর আছে।শুধু বলেছিল, এ আমার নিয়তি শামা অথবা তোমার চোখের জলের অভিশাপ।

জে এইচে আজ আড্ডা জমল না। এনাম পাঁচটায় চলে গ্যালো। বাসায় কি একটা ঘটেছে।ওকে বেশ চিন্তিত মনে হয়েছিল।এনাম চলে যাওয়ার পর মাহিরও আড্ডা থেকে বের হয়ে এলো।মাছ কিনবে মনে করে মাছের দোকানে গিয়ে ও ফিরে এলো। মাছ কিনলে এখনি ফিরে যেতে হবে। কেন মনে হচ্ছে শামা’র সাথে দেখা হবে। ও যেন এখানেই কোথায় আছে।শামার সাথে গত দুদিন কথাই হয়নি। ওর বাড়ীতে অতিথি আছে। বাংলাদেশ থেকে বন্ধু তার মেয়ে বউ নিয়ে বেড়াতে এসেছে।

মাহির রাস্তা পার করে সবজিমন্ডির সামনে আসতেই দেখল শামা দাড়িয়ে কার সাথে কথা বলছে।কি সাংঘাতিক ইনটুইসন বাবা।বুকের ভিতর ছমছম করে উঠল। শামা’র পাস দিয়ে হেটে গিয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে রইল।শামা ওকে দেখে চমকে গিয়েও চট  করেই সামলে নিলো ওর চমকানো ভাব।

ভদ্রলোক গল্প করেই যাচ্ছে। প্রায় দশ মিনিট পর শামা ওর কাছে এসে বলল , কখন এসেছে? ভাবতেই পারি নাই তোমার সাথে দেখা হবে এখানে।

     -কিচ্ছুক্ষণ আগে, তুমি এখানে?

      – বাড়ীর গেস্টদের বাঙ্গালির তীর্থস্থান দেখাতে। নিউ ইয়র্কে যারাই আসে তাদের এখানে আসতেই হয়। ভিজিটিং স্পটের টপ লিস্টে থাকে ‘জ্যাকসন হাইটস’। এনিও্য়ে তুমি কতক্ষণ থাকবে ?

 -যতক্ষণ তুমি থাকতে বল। তোমার গেস্টরা কোথায়?

    -ওরা ঘুরছে আশেপাশে।

   – চল বসি কোথায়।চা খাবে ?

   – আগে চল, তুমি কোথায় বসে নস্টালজিক হয়ে যাও দেখি।

   -চা আর সিঙ্গারা নিয়ে না হয় যাই সেখানে?

   -পাগল! আজ এই ছুটির দিনের সন্ধ্যায় তোমার সাথে দেয়ালে বসে চা খাব?

    -না হয় পাগলামি হলো।ভয় পাচ্ছ?

   -বাঙালিদের কথার ভয় কিছুটা হলেও নেই তোমার?

শামা জানতো মাহির এর কোন জবাব দেবে না।

 মাহির ওকে নিয়ে শাড়ী গয়নার দোকান পার হয়ে বন্ধুর অফিসের সামনে নিয়ে এলো।

 -এই, এটা আড্ডা মারার দেয়াল। উফ কি যে ভালো লাগে। পুরনো সব চোখের সামনে ভেসে ওঠে।একদিন আসবে নাকি?

   -দেখ তোমার অফিসের অনেক বাঙ্গালি পাবলিক কিন্তু আসে এখানে বাজার করতে।জাত মান ধুয়ে যাবে। বলে শামা হাসতে লাগল।

    -ধুলোয় যাক। কেয়ার করি না।আমার বন্ধুদের সাথে আমি যেখানে খুশি আড্ডা মারব তাতে কোন শালার কী আসে যায়।হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে গেলো মাহির।

   -জান গত শনিবার এখানে বসে আড্ডার পর সবাই মিলে আমার এপার্টমেন্টে গেলাম,  অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা মারলাম।সকালে উঠে দেখি ওরা মেঝেতে শুয়ে আছে চাদর বালিশ ছাড়া।খুব খারাপ লেগেছে। খুব ভাল ব্রেকফাস্ট বানিয়ে পুষিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলাম।

  -শামা বলল, আর তাহলে বয়স বয়স কর না।দেখো ইয়থ কেমন ঠেলে বেরিয়ে আসে।কিন্তু মহাশয় বেশি কর না। একেকদিন উচ্ছল হওয়া যায় তবে টেনে রেখ ইচ্ছে গুলোকে। বাড়তে দিও না। বয়স নেই এখন আর অত অত্যাচার করার।

 -শামার শেষের কথা গুলোতে মিষ্টি অভিযোগর সুর ছিল। মাহির সুধু চাপা স্বরে বলল তা ঠিক।

মাহির জানে এর চেয়ে বেশি শামা বলবে না।এক সময়ের খুব কাছের হলেও এত বছরের যে দূরত্ব আছে তা যেন ক্ষণিকের জন্য শামা ভুলতে পারে না। কী জানি হয়ত সেজন্য এই শামাকে আর বেশী ভাল লাগে। এটাও কি ঠিক ভাবনা? ভাল  কী আগেও কম লাগতো!

   মাহির চা নিয়ে এসে বলল, নাও, হাটতে হাটতে খাও।তোমার গেস্টদের দেখে আসবে নাকি?

   -নাহ , এখন সময় আছে। জানো, আমার বন্ধুর বউয়ের মনে হয় স্কিজোফেনিয়া রোগ। কখন কখন একদম স্বাভাবিক থাকে। আবার আজ দুপরে ওর ধারনা আমার বাড়ীটা হাসপাতাল আর আমি ডাক্তার। বিকেলে চা দিয়াছি। ওর ধারনা আমি ঔষধ মিশিয়ে দিয়াছি। মেয়েটাই সামাল দেয় ওকে।ওরা প্রেম করে বিয়ে করেছিল। তাও আবার পালিয়ে বিয়ে। আর এখন স্বামী বলতে গেলে অচেনা এক মানুষ। কী জানি একদিকে হয়ত ভালই আছে ও। কোন দায়িত্ব নেই, ভাবনা নেই, ন্যায় অন্যায়ের হিসাব নেই, একটা শিশুর জীবন যাপন।

 -হয়ত ঠিক।তবে কষ্টটা অন্যদের। যারা ওঁকে ভালবাসে তাঁদের।

  -নাহ, ওর মনের কষ্ট আছে, তবে তার প্রকাশ আমাদের মত নয়। গতরাতে আমার সাথে কথা বলতে বলতে বলল, ওর স্বামী এখন আর ওর সাথে কথা বলে না। অনেক রাত পর্যন্ত এক বান্ধবীর সাথে কথা বলে। ও কাছে গেলে বলে,এখান থেকে যা।

   -আমি জিজ্ঞাসা করলাম তুমি তাঁকে চিনো ?

    -বলল, হ্যাঁ আমি আপা বলে ডাকি। আপা খুব ভাল। আমার জন্য অনেক কিছু নিয়ে আসে।তারপর ওঁরা দরজা বন্ধ করে গল্প করে।

ও যখন এসব বলছিল, ওর চোখে রাগ ছিল না, কেমন মলিন ছিল।আমার কেন মনে হচ্ছিল গলার স্বরে অন্যরকম অভিমান ছিল।

বিবাহিত জীবনে কত রকমের অসুখ!

শামার এই শেষ লাইন থেকে মাহির শামাকে ফিরিয়ে আনতে একেবারেই সাদামাটা উত্তরে বলল, জীবন এমনই। নানা অসুখে অসুখ আমাদের। তারপরই  বলল, জান আজ ইমাম বলছিল ওর সাথে যেতে , কিন্তু কেন মন বলছিল তুমি আছ এখানে কোথাও।

-তাই ? স্ট্রং ইন্টূইসন। আমিও ভেবেছিলাম আসব না।নিউ ইয়র্কের এত আনপ্রেডিক্টেবল ওয়েদার। আজ সারাদিন বৃষ্টি হবার সংকেত থাকলেও মেঘ করেই বসে রইলো। সুর্য উঠলোই না।আকাশটা কেমন ঝলসে যাওয়া ছাই রঙেই ঢেকে রইলো।তবু এলাম।তোমার জন্যই হয়ত টেনে এনেছে।

   -মাহির হাসল, বোঝ তা হলে?

শামার ইচ্ছে হল বলতে, বুঝতে চাই না আমি।

     -তুমি কখন ফিরবে? বাজার করবে?

    -হ্যাঁ, একটু মাছের দোকান যাব, কয়েকটা ফিলে নিয়ে ফিরব। তবে থাকতে পারি আর কিছুক্ষণ যদি তোমার অসুবিধা না হয়।

    -তোমার বউ কবে আসছে?

   -জানিয়ে আসে কবে। একটি ডুপ্লিকেট চাবি আছে কাজেই যখন ইচ্ছে চলে আসে   সব ধরনের হিসেব টিসেব দেখে আবার চলে যায়।

    -শামা, তুমি এই এক ছাদের নিচে আর কতদিন এভাবে কাটাবে?

 উত্তর না দিয়ে শামা বলল, তুমি মাছের দোকানে যাও। আমিও দেখি ওরা মা মেয়ে কি করছে।

 সন্ধ্যে নেমে গেছে। মার্কেটে ভিড় বাড়ছে।শামা রাস্তায় দাঁড়িয়ে পরিচিতদের সাথে কথা বলতে বলতে দেখল মাহির হেটে চলে যাচ্ছে। একটা ব্যাগ হাতে।বোধ হয় ওর মাছের প্যাকেট। শামার দিকে তাকিয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে ইশারায় বাই বলে চলে গেলো। শামার মনে হল বিকেল থেকে জ্যাকসন হাইটস মার্কেট অন্যরকম অনুভূতিতে ঘিরে ছিল। এত মানুষের ভিড়ে থেকেও মনে হয়নি কেউ আছে চারদিকে। পরিচিত কাউকে চোখে পড়ে নি। শুধু যেন ওরা দুজনেই ছিল।মাহিরের সাথে কথায় ও এত বিভোর হয়ে যায়। ভুলে যায় নিঃসঙ্গতার ক্লান্তিতে অসুখী জীবনেও তাঁর প্রথম প্রেমের ভালোলাগা আজ নিষিদ্ধ ভালোলাগা।

মা মেয়েকে নিয়ে শামার গাড়ি ফিরছে বাড়ির পথে।গান শুনতে শুনতে ভাবল সময় তাঁর বুকের ভিতরের নোনা যন্ত্রণা সহনীয় করে দিলোও মনের অবচেতনে মাহির  ছিল চেনা অচেনার মাঝামাঝি একজন হয়ে।কিন্তু নিয়তির অখণ্ডিত নিয়মের কারণে আবার এতকাল পরে মাহিরের সাথে হঠাৎ দেখা হওয়া কী তার প্রতি বিধাতার ভালোবাসা না পরিহাস!

শামা জানে বছর শেষে মাহির ফিরে যাবে সংসারে।শামার অনুরোধে মাহিরের লেখা বই বেরোবে।উৎসর্গে শামার নাম থাকবে না।

মাহিরের ফোন আসার কথা থাকবে। আসবে না।

পরেরদিন আসবে না

তারপরের দিন আসবে না।

আর কোনদিন দিন আসবে না। শামা জানে যা হারিয়ে গেছে তা চিরকালের জন্য গেছে।

গাড়ি বাড়ির সামনে এসে থামতেই বন্ধুর বউ বলল, শামা তুমি কী এতক্ষন কাঁদছিল? আমার মনে হল তুমি কাঁদছিলে।

রাজিয়া নাজমী। গল্পকার। জন্ম ৪ সেপ্টেম্বর, বরিশাল; বাংলাদেশ। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞান নিয়ে মাস্টার্স এবং আইন বিষয়ে ডিগ্রি নিয়ে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সনদ নেন। পেশাগত সূত্রে বর্তমানে তিনি তথ্য প্রযুক্তিবিদ হিসাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..