“হত্যার পর ডাস্টবিনে ফেলে দেয়া শিশুর লাশ কুকুরে খেল”
যেদিন জাতীয় দৈনিকগুলোর পাতায় এক কলামে খবরটা ছাপা হলো সেদিনেরই ঘটনা। আলহাজ্ব আলীমুদ্দিন কাসেমি ফজরের নামাজ আদায় করে প্রতিদিনই বিছানায় গা এলিয়ে ঘন্টা খানেক ঘুমিয়ে নেন। সেদিন নিয়মের সামান্য ব্যতিক্রম হলো। তিনি বারান্দায় হকারের ফেলে দেয়া সেদিনের পেপারটা কুড়িয়ে নিলেন। লিড নিউজগুলো এড়িয়ে চোখ কেমন করে জানি ওই এক কলামের খবরটায় আটকে গেল। তার শরীরটা একটু একটু করে ঘামছে। তিনি সাধারণত সকাল বেলা গরম পানি পান করেন। এদিন গরম পানির জন্য কাউকে ডাকলেন না। নিজেই টেবিলে রাখা পানির জগ থেকে এক গ্লাস ঠা-া পানি ঢেলে সেটা ঢক ঢক করে গিলে ফেললেন। পানি কমপক্ষে তিন ঢোকে গিলতে হয় এমন কথা তার বাবা তাকে শিখিয়েছিলেন। তিনিও শিখিয়েছেন তার সন্তানদের।আজ সে নিয়ম রক্ষা হলোনা।
আলহাজ্ব আলীমুদ্দিন কাসেমি বিছানার ওপর ধপ করে বসে পড়লেন। নিজ মাথা থেকে টুপি খুলে খাটের পাশের টেবিলে রাখলেন। তারপর অস্ফুট কন্ঠে বললেন “ ইয়া রাব্বুল আল আমীন, হে পাক পরওয়ার দেগার তোমার ইচ্ছে ছাড়া কোন কিছুই ঘটেনা। একটা ছোট ছাওয়ালের শরীর কুত্তায় খালো এটাও তোমার ইচ্ছা ! নাকি ওই দুধের বাচ্চা কোন অপরাধ কইরেছিল যার শাস্তি তুমি তারে দেলা ?”
তিনি আর কিছু উচ্চারণ করতে পারলেন না। বির বির করে কি যেন বললেন তার পর কাত হয়ে শুয়ে পড়লেন বিছানায়।
একই দিন মহল্লার শেষ মাথায় একটা সোরগোল শোনা গেল। আলহাজ্ব আলীমুদ্দিন কাসেমির তন্দ্রাভাবটা কেটে যায়। চারদিকে চিৎকার চেচামেচি। মহিলাদের গলাই বেশি শোনা যাচ্ছে। তিনি তার ছেলে মেয়েদের নাম ধরে ডাকলেন,কেউ কাছে ধারে নেই। তিনি আবার শুয়ে পড়লেন। কি হয়েছে সেটা দেখার উৎসাহ পাচ্ছেন না। সকাল সকাল খবরের কাগজে এমন একটা খবর তার শরীর মন আর বিশ্বাসের জায়গাটা কেমন জানি নড়বড়ে করে দিয়েছে। একটু পরেই ঘরে ছেলে মেয়ে আর স্ত্রীর গলা পেয়ে বিছানা থেকে না উঠেই জিজ্ঞেস করলেন
– কী হয়েছে ?
স্ত্রী কুলসুম বেগম জবাব দিলেন
– কারা যেন করিমরে ধইরে নিয়ে গেল।
– কোন করিম ?
– ওই যে, কানা করিম।
আলহাজ্ব আলীমুদ্দিন কাসেমি করিমকে চিনতে পারলেন। শুধু করিম বললে চিনতে পারার কথা না। এ মহল্লায় কমপক্ষে পাঁচজন করিম আছে। এদের একজন শিক্ষক,একজন ভ্যান চালক,দুজন মুদি দোকানি আর একজন গুন্ডা পান্ডা।গুন্ডাটার নামই কানা করিম। কারা যেন একবার চোখ উঠিয়ে নিয়েছিল। সবাই ভেবেছিল এরপর অন্তত ছেলেটা ভালো হবে, না হয়নি। আগে যা করতো তাই করছে। ওর যে একটা চোখ নেই তা নিয়ে ওর কোন আক্ষেপও নেই। বরং ও “নাই” চক্ষু নিয়ে বেশ গর্ব করে। কারো সাথে সামান্য কথা কাটাকাটি হলেই বলে “এই দেখ মারামারি করতে গিয়া চোখ থুইয়া আইছি , তাও মরি নাই।”
আলহাজ্ব আলীমুদ্দিন কাসেমি বিছানায় শুয়েই নির্লিপ্তভাবে আবার প্রশ্ন করে
-কারা নিল ? কী হয়েছে ?
কুলসুম বেগম এমনভাবে পান চিবুচ্ছেন যেন কিছুই হয়নি বা কানা করিমকে নিয়ে যাওয়াটা কোন ঘটনাই না।
– একটা মাইক্রো এলো,জনা সাতেক লোক নাইমলো তারপর ধইরে নিয়ে গেল।
-ওরা কারা ?
-আমি কব কেমন কইরে , সবাই যা কচ্ছে তাই কলাম।
আলহাজ্ব আলীমুদ্দিন কাসেমি সেভাবেই বিছানায় কাত হয়ে শুয়ে থাকেন। তার সাথে কথা বলায় স্ত্রীর যে কোন আগ্রহ নেই তা বুঝে নিয়েছেন। এটা আজ নতুন কিছু নয়,বেশ কবছর আগ থেকেই শুরু হয়েছে স্ত্রীর এ স্বভাব। তিনি লক্ষ্য করেছেন যখন থেকে আল্লার রাস্তায় বেশি বেশি সময় দেয়া শুরু করেছেন তখন থেকেই কুলসুম বেগমও আস্তে আস্তে তার পথ থেকে দূরে সরে যেতে শুরু করেছেন। এটা নিয়ে কাসেমি সাহেব দুঃখ পাননি বরং খুশিই হয়েছেন এই ভেবে যে দুনিয়াবী থেকে দূরে থাকার প্রধান অন্তরায়টাই তার কেটে গেছে নিজে নিজে। আল্লাহ পাকের অশেষ রহমত হিসেবেই এটাকে নিয়েছেন তিনি।
তার ঘুম আসছেনা। শুধুই এপাশ ওপাশ করছে। তিনি শংকিত হন এটা ভেবে যে, দুনিয়া থেকে আল্লার রহমত কমে যেতে শুরু করেছে কি না। ছোট একটা মেয়ে তাকে কে বা কারা হত্যা করলো,ডাস্টবিনে ফেলে দিল। এত খাওয়ার জিনিস থাকতে কুকুরের দল বাচ্চাটার দেহটাকেই কেন বেছে নিল। মৃত শরীরটার প্রতি আল্লাহ এ শাস্তি আরোপ না করলেই পারতেন। নাউজুবিল্লাহ নাউজুবিল্লাহ আলহাজ্ব আলীমুদ্দিন কাসেমি সাহেব দাঁত দিয়ে জিভে কামড় দেন। এমন ভাবনা তার মধ্যে জায়গা করে নিলে তিনি মুত্তাকিন হতে পারবেন না। আল্লাহ নারাজ হবেন।তিনি ভেবে নেন যত দোষ ওই সংবাদপত্রটার। ওখানে খবরটা না পড়লে তার ভেতর এমন চিন্তা আসতোনা। ঘরে পেপার নেয়া বন্ধ করেছিলন বহু বার। ছেলে মেয়েদের জন্য সেটা কার্যকর করতে পারেননি। ছেলে বলে “ পেপারে চাকরির সার্কুলার থাকে। পেপারই যদি না দেখতে পারি তবে এ্যাপ্লিকেশন করবো কী করে” ? মেয়ে বলে “পেপারের পড়ালেখা পাতাটা আমার নিজের লেখাপড়ায় অনেক উপকারে আসে। পেপার বন্ধ থাকলে আমার আরো দুটো প্রাইভেট মাস্টার লাগবে”। কাসেমি সাহেব ভেবে দেখলেন সবার যুক্তিই গ্রহনযোগ্য শুধু তার নিজের কোন যুক্তি নেই।তাই সিদ্ধান্ত নিলেন নিজেই পেপার পড়া বন্ধ করবেন। অনেকদিন পর আজই হাতে নিয়েছিলেন।
#
সেদিনই প্রায়ন্ধকার একটি কক্ষে কানা করিমকে হাত পিছমোড়া করে কারা যেন বেধে রাখে। হাটু গেড়ে কানা করিম বসে আছে। দুচোখ কাপড় দিয়ে বাঁধা।কেউ একজন সামনে চেয়ারে বসলেন
-নাম বল
কানা করিম কোন উত্তর দেয়না।প্রশ্নটা কাকে করেছে সেটা ও বুঝতেই পারেনি।ওকেই যে প্রশ্ন করা হয়েছে সেটা বুঝলো যখন বুকের ওপর একটা লাথি পড়ল।
-নাম বল
-করিম
-আগে পরে
করিম আবার চুপ করে থাকে প্রশ্ন বুঝতে না পেরে।
-জি
মাদারচোদ ভাত খাওনা ? করিম কি ? চৌধুরী ? হোসেন , না কি প্রধান ?
-কানা করিম
-এই নাম কে রাখছে ?
-মায় রাখছে ।
-তোর মায় কানা রাখলো কেন ?
-না না মায়তো খালি করিম রাখছিল ,বন্ধুরা নাম দিছে কানা।
-কেন ?
-আমার এক চক্ষু নাই ছার।
-তোর চোখ গেল কই ?
-ছার, হেইডা সাত আট বছর আগের কথা। আমাগো খাল পাড়া আর আর উচা পাড়ায় মারামারি লাগছিল। তুমুল মারামারি চলতাছে, তয় হইল কি আমারে আট নয়জনে ঘিরা ফালাইলো। কারো হাতে চলা, কারো হাতে লোহার রড আবার কারো হতে চাক্কু। ঘুইরা দেহি আমার পিছনে কেউ নাই। আল্লার নাম নিয়া একলাই আধাঘন্টা বেবাকতেরে পিটাইছি। হেরপর আর পারি নাই।
-তারপর ?
-তারপর আবার কি ? ধইরা ফালাইলো। আর কিছু কইতে পারিনা। যহন জ্ঞাণ ফিরলো তখন হাসপাতালে। পরে মার কাছে হুনছি আমারে মারছে আবার একটা চক্ষু উঠাইয়া ফালাইছে।
সামনের প্রশ্নকর্তা এবং কানা করিম দুজনেই কিছুক্ষণ নিরব থাকে। প্রশ্নকর্তা করিমের শক্ত নার্ভ দেখে একটুকুও অবাক হয়না। যারা কখনও মারামারি করতে গিয়ে কোন অঙ্গ হারায় কিন্তু বেঁচে থাকে তারা খুব শক্ত মনের হয়।
-কানা করিমের ভাবনাটা অন্যকিছু নিয়ে। প্রশ্নটা মনে আসতেই বলে বসলো
করিম চুপ করে থাকে।প্রচন্ড জোরে একটা লাথি পড়ে বুকের ওপর। ব্যাথায় কঁকিয়ে ওঠে।
-তোর ভাইয়ের নাম বল।
-ভাই
-আরে কুত্তার বাচ্চা নাম বল,কোন ভাই? রহিম ভাই করিম ভাই ছামছু ভাই.. .. ? বল ।
-আমি তো ছার কোন নাম জানি না। সবাই তারে ভাই ডাকে আমিও ডাকি।
-ভাই তোর খেয়াল রাখে, না ?
-হ ছার ভাই আমাগো মা বাপ। হেরডা খাই, হেরডা পিন্দি।
-আর ভাইয়ের কাম করিস না ?
করিম চুপ করে থাকে।
কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর করিম প্রশ্ন করে
-ছার আমার চক্ষু খুইলা দেওন যায়না ? এক চোক্ষে তো দেখিনা। আর একটা চক্ষু আছে । হেইডায় কি আর বেশি দেখমু। ছার দয়া করেন একটু।
করিমের কথার জবাব দেয়না সামনের মানুষটা। চলে গেছে মনে হয়।
#
ক্ষুধায় পিপাশায় ঘুমিয়ে পড়েছিল মনে হয়। কারো গুতা খেয়ে সম্বিত ফিরে পায়। বুকটা ব্যাথা করছে এখনও। রাত না কি দিন বোঝাও যাচ্ছেনা। এখনও হাত পিছমোড়া করে বাঁধা,চোখ বাঁধা। ঘরে এখন একাধিক লোকের কথা শোনা যাচ্ছে।
-ওঠ
পিঠে পায়ের গুতা অনুভব করে করিম। ও উঠে দাঁড়ায়।কেউ একজন হাত ধরে টেনে নিয়ে যায়। শরীরে ঠান্ডা বাতাসের ঝাপটা লাগে। করিম ঠাওর করার চেষ্টা করে। স্পষ্ট বুঝতে পারছে ঘর থেকে বাইরে নিয়ে আসা হলো ওকে।
-গাড়িতে ওঠ
করিম বুঝতে পারছেনা গাড়িটা কোন দিকে। কাউকে প্রশ্ন করার আগেই এক ধাক্কায় গাড়ির ভেতরে নিয়ে ফেলে ওকে। এটা একটা মাইক্রোবাস সেটা বুঝতে পারে। মাথায় ওর নানা চিন্তা, এরা কারা? ওকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ? মাইক্রোবাসের ভেতরে কতজন আছে তাও বুঝতে পারছেনা। কেউ কেন কথা বলছেনা সেটাও বুঝতে পারছেনা। কিছুক্ষণ গাড়ি চলার পর কেউ একজন ওর হাতের বাঁধন খুলে দেয়।
-চোখ খুলবিনা,চিৎকার করবিনা, কাউকে ডাকবিনা।
করিম চোখ বন্ধ করে শুয়েই থাকে। আরো কিছুক্ষণ গাড়ি চলার পর সেটা থামে। করিমকে টেনে উঠিয়ে বসায়।তারপর এক ধাক্কায় গাড়ি থেকে নিচে ফেলে দেয়। গাড়ির শব্দটা আস্তে আস্তে মিলিয়ে যায়। করিম চোখ বন্ধ অবস্থাতেই মাটিতে পড়ে থাকে। শুধু ঝি ঝি পোকার ডাক শোনা যায়। আশে পাশে কোন মানুষের সাড়া শব্দ পাওয়া যায়না।
কতক্ষণ এভাবে শুয়ে ছিল জানেনা। হঠাৎ করেই কানে এলো একটা গাড়ির শব্দ দূর থেকে ভেসে আসছে।মনে হয় এদিকেই আসছে গাড়িটা। শব্দটা ক্রমশঃ স্পষ্ট হচ্ছে। করিম এক ঝটকায় চোখের বাঁধনটা খুলে ফেলে। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। দুটো হেডলাইট এদিকেই এগিয়ে আসছে। করিম নিজেকে আড়াল করে। গাড়িটা ওর পঞ্চাশ গজের মধ্যেই থামে।একজন গাড়ি থেকে নেমে এলো। অস্ফুট কন্ঠে করিমের নাম ধরে ডাকলো। করিম নিজ কানেই শুনলো সে ডাক। কান খাড়া করে আবার শুনলো। হ্যাঁ, স্পষ্ট শুনেছে ডাক। ভাই ডাকছে ওকে। করিম আড়াল থেকে বাইরে বের হয়ে আসে। ওর এখন আর কোন ভয় নেই। ভাই এসে গেছে।
-ভাই এইতো এইখানে আমি।
-কই তুই ? কাছে আয়।
করিম আরো কাছে আসে। পরম মমতায় ভাইকে জড়িয়ে ধরতে যায়। অমনি খেয়াল করে ভাইয়ের পেছনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। ভুত দেখার মতো চমকে ওঠে করিম।
-ভাই এইডা কেডা ?
-ডরাইস না, আমার ভাই , আমাগো সবার বড় ভাই।
কথা শেষ হওয়ার আগেই চোখের সামনে করিম একটা আগুনের ফুলকি দেখতে পায়।একটা শব্দ কানে আসে। ভায়ের পায়ের কাছে পড়ে যায় ও। চোখে কিছুই দেখতে পায়না। একটা গাড়ি স্টার্ট করার শব্দটা কানে আসে। আস্তে আস্তে সেটাও মিলিয়ে যায়। করিম গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।
#
পরের দিন সকালে আলহাজ্ব আলীমুদ্দিন কাসেমি ভুল করেও টেবিলে রাখা সংবাদপত্রটার দিকে তাকায়না। বিছানায় কাত হয়ে ঘুমোনের চেষ্টা করে। কুলসুম বেগম ঘরে প্রবেশ করেছেন সেটা না দেখেও বেশ বুঝতে পারছেন। যতই তিনি ঘুমের ভান করুন না কেন কুলসুম বেগমও জানেন যে তিনি ঘুমোন নি।
খাটের পাশে দাঁড়িয়ে তাকে উদ্দেশ করেই বলছে
-করিমরে কারা জানি মাইরে ফালাইয়া গেছে।
আলহাজ্ব আলীমুদ্দিন কাসেমির মাথাটা দপ দপ করে ওঠে। তিনি আজ সংবাদপত্র হাতেও নেননি , তাতে কি হয়েছে। খবর কি আটকে থেকেছে। ওই শিশুটির মৃত্যু আর কানা করিমের মৃত্যু এক কথা নয় তবু তিনি ভাবার চেষ্টা করেন “ সব আল্লাহর হুকুমেই হয়েছে”। তিনি শুয়ে শুয়েই প্রার্থনা করেন আল্লাহ যেন তার গোনাহ খাতা মাফ করে দিয়ে এমন এক মৃত্যু দেন যেন লোক মুখে শোনা যায়
“ আলহাজ্ব আলীমুদ্দিন কাসেমির কত সুন্দর মৃত্যু হয়েছে ; তিনি নিশ্চয়ই জান্নাতি হবেন” আমিন। মনটা এখন তার অনেকটাই শান্ত হয়েছে। তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন।