প্রেমালিঙ্গম

সকাল রয়
গল্প
Bengali
প্রেমালিঙ্গম

আঁচল উঠিয়ে নিল কান্তা। দীর্ঘ সময় পাড়ি দেয়া প্রেমরূপ আজ অদৃশ্য হবে। উঠে দাঁড়িয়ে আকাশ থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে এনে নিবাসের মুখের উপর চোখ রেখে বললো।

-এবেলা তবে পথ ছাড়ি; নিবাস তুমি বাড়ি ফিরে যাও।

চোখ দু’খানা তারা করে দিয়ে রইল দাঁড়ায়ে নিবাস। মনঘরে  তখনও পাকানো ঢেউ; কেন তবে মিছি মিছি ভালোবাসা! কেন তবে কাছে আসা। অন্ধের মতো পাথরকেও বন্ধু ভাবতে যদিও দোষের কিছু নেই তবুও কি আর পাথরকে গলায় বাধা যায়?

এই গল্পটার শুরু নাইবা হলো জানা; কেননা এ গল্পের নেই যতি চিহ্নের ঠিক-ঠিকানা। এই গল্পের নায়ক, তেইশ বছর বয়সের নিবাস। বনগাঁয়ে যার বাস। দিন কেটে হেলায়-ফেলায়, রাতটা কাটে ভাবনার বাসে চড়ে; প্রহর শেষে একটু থামে সেই ভাবনারা। একটু ঘুমোয়, একটু জিরোয়; সকাল হতেই আবার তার যাত্রা শুরু। দিন কাটে কাজের ভীড়ে। কাটছিল দিন এভাবেই।

এই গল্পের নায়িকা।‘কান্তা’ নিধিরাম এর পোষ্য কন্যা। হোক সে পোষ্য। যেন প্রাণ। যেন প্রকৃতির দান। নিধিরাম কান্তা বলতে অজ্ঞান!

বয়সের নায়ে ভেসে ভেসে শেষে কুড়ি পেড়িয়ে তেইশে রাখলে পা। গা ছমছম করা দুপুরে একদিন ভোমর কানে কানে বলে গেল এইবার তবে মন মেশাও আর কারো মনের সাগরে। কান্তা অতশত ভাবে না; এটুকু বুঝে যায় সে, একদিন কারো হাত ধরতে হবে কারো ঘরে যেতে হবে, না হলে সে আর মেয়ে কেন?

একদিন চৈত্রের বৃষ্টি নেমে গেলে পাঠকেন্দ্র থেকে ফেরার পথে নিবাসের সাথে কান্তার দেখা। সে দেখাটা অবশ্যি একটা ছাতাকে কেন্দ্র করেই। কান্তাকে সে শৈশবকাল থেকেই চেনে। ভদ্রলোকের পাড়ায় ওদের বিরাট বাড়ি। সেদিন বৃষ্টিতে আধভেজা নিবাস দাঁড়িয়ে ছিল গেটের পাশেই ছাতার জন্য বাড়ি যেতে পারছে না। পকেটে টাকা নেই তাই কোন চক্রযানেই সে উঠতে পারছে না। কান্তা’র সই নিশি এসে বললো কান্তা তোর নীল ছাতাটা দে তো নিবাসকে। তারপর সেই ছাতা নিয়েই নিবাসের বাড়ি ফেরা।

ফেরত ছাতার কথা ধরে এভাবেই পরিচয় পর্ব। এরপর সবুজ কালিমন্দিরের গেটের পাশে বসে ভালোবাসাবাসি শুরু। নিবাস কিংবা কান্তা দুটো প্রাণীই যেন একই ছাঁচে গড়া। বিশ্বাস ওদের সুউচ্চ শিখরে যেন গেছে পৌছে, শুধু নির্মল বিশুদ্ধ ভালোবাসা দুজনে দুজনায় গায়ে চাদরের মতো যেন লেপ্টে থাকে। কিন্তু ঈশ্বরের খেলা সে যে এক মস্ত বড় ঘোরপাক নদী।

নির্মল ভালোবাসাকে টিকিয়ে রাখতে তার কি ঠেকা পড়েছে?  তাই কিভাবে সেটা মিশে যাবে সামাজিক যাতাকলে তারই একটা আয়োজন যেন চলে গোপনে গোপনে। যে প্রেম শরীরবৃত্তে ঘুরে সে প্রেমে থাকে তার আর্শিবাদ। সেটা ভাঙ্গার ইচ্ছা থাকে না তার, তবুও যারা এই সম্পর্ক শুরু করে তারাই কারণ ছাড়া একদিন মূলতবি করে দেয়। শরীরের সম্পর্ক বড্ড পানসে সেটা সমাজ যেমন জানে, ঈশ্বরও জানে। একটা পাপের অঙ্ক বাড়াবার জন্য ঈশ্বর সেখানে কোন বাঁধা সৃষ্টি করেন না। আর নির্মল ভালোবাসায় সবারই গা চুলকায়, ঈশ্বর তার বাইরে যাবে কেন!

চাল-চুলোহীন নিবাস তার যে নেই আবাস। যে পথে পড়ে না ফুল সে পথেই তার বাস। কোনক্রমে স্নাতকোত্তর শেষ হলো কিন্তু কর্মখালী কোন প্রতিষ্ঠানে সে ঠাঁয় পায়নি এখনও। গৃহশিক্ষক হয়ে সে এই শহরে আজও ঘুরছে। গৃহ শিক্ষকের কাছে সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়েকে সকলেই দিতে চায় না।

প্রশ্ন চারপাশে, কেন তবে ভালোবাসলি? জানিস না এ-ভালোবাসার ভবিষ্যত যে অন্ধকার। ঘর ছেড়ে কি কান্তা তোর সাথে তবে গাছতলায় কাটাবে?  এতো কিছু ভেবে ভালোবাসলে তো আর কামহীন প্রেম হবে না, তাহলে তো হিসেব কষে শরীরবৃত্তেই ঘুরে শেষে থেমে যাবে ভালোবাসার কাঠি। তবুও এ ছন্নছাড়া জীবনে প্রেম চলে না। মস্ত বড় বোকা না হলে কি আর সোনার জীবন ধ্বংসের জন্য মাতে প্রেমালিঙ্গমে।

দিন যেন ফুরায় সময়কে কাল স্বাক্ষী করে। শেষ দেখায় কান্তা বললো নিবাস, আগুনে একবার হাত দিয়ে ফেলেছো, পুরোপুরি পুড়ে যাওয়া না পর্যন্ত হাত সরিয়ে নিও না তাহলে সারাজীবন সেই যন্ত্রণায় জ্বলে যাবে। তার’চে ভেবে নাও প্রেম মরে যাচ্ছে না সেটা জ্বলছে প্রদীপের মতো। তুমি যেন অন্ধ এক অনুভূতি শূণ্য মানুষ। আজ হতে সব কিছুতেই তোমার সহ্য ক্ষমতা বেড়ে যাক। মুখের ভাষা থাকার চেয়ে যদি না থাকতো তবে উন্মাদ হয়ে ঘুরে বেড়ানো যেত নিবিঘেœ তাতে দহনটা সাতকাহনের জন্ম দিতো না। তারপর যথারীতি বিয়ে হয়ে গেলো কান্তার আর ওদিকে নিবাস কান্তার বিয়ের সানাইয়ের সুর সোনার আগেই পা তুলে নিল এ গাঁয়ের পথ থেকে।

তারপর কেটে গেল অর্ধযুগ। কান্তা পুরোনো শহর বদল করে অনেক আগেই দূরের এক মফস্বল বিরামপুরে স্বামীকে নিয়ে স্থায়ী আবাস গড়েছিলো। আবাস নিয়ে বসবাস করলেও এখনো পতি দেবতাটির বুকে মাথা রেখে কান্তা চোখ ভরে জল উঠে নিবাসের জন্য। আহ প্রেম! সুখের মাঝেও যন্ত্রণা। এতো সুখের মাঝেও কোথায় যেন কিসের কমতি। কোথায় সে মুখ নিবাসের। যদি একটিবার দেখা যেত তাকে। নিবাসকে ভুলে যেতে যেতে মনে করে ফেলে।

অর্ধযুগ পরের এক চৈত্রের বৃষ্টিমুখর দিনে কান্তা মেয়েকে স্কুল থেকে আনতে গিয়ে দেখতে পায় মেয়ে স্কুলে নেই। অনেক আগেই ছুটি হয়ে গেছে। যাদের ছাতা ছিলো তারা সবাই চলে গেছে বৃষ্টির মাঝেই। স্কুলের দারোয়ান বলে, বৃষ্টির জন্য কান্তার মেয়ে ‘নিকুন্তলা’ স্কুলের বারান্দায় অনেকের সাথে বসে ছিলো। তারপর আর দেখেনি।

উৎকন্ঠা আর হাহাকার চেপে ধরে কান্তাকে। কোথায় গেলো নিকুন্তলা। ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে কল করে তার স্বামীকে। বড় রাস্তার মোড়ে এসেও আতি-পাতি করে খুঁজে চলে মেয়েকে। কিন্তু কিছুতেই পায় না। ওদিকে কান্তার স্বামী একটু পড় কল দিয়ে বলে, বাড়ি ফিরে এসো কান্তা বাড়িতেই।

স্বস্থির নিশ্বাস ফেলে কান্তা প্রজাপ্রতির ডানায় ভর করে বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকে। বাড়ি ফিরে বসার ঘরে নিকুন্তলার সাথে পুরোনো মুখায়বের নিবাসকে দেখে চমকে উঠে। বুকের ভেতর দ্রি-দ্রিড়িম করে ঘণ্টা বেজে উঠে। নিবাস এখানে এতো বছর পর! ঈশ্বর তাহলে তার ডাক শুনেছে, নিবাসকে তার চোখের সামনে এনে দিয়েছে। ঈশ্বর তাহলে নির্মল প্রেমিকার কথাও শোনে।

চমকের রেশ কাটার আগেই কান্তার স্বামী কান্তার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়, ইনি নিবাস বাবু, নিকুন্তলার স্কুলের টিচার এখানে নতুন জয়েন করেছেন। বৃষ্টির জন্য নিকুন্তলা বসেছিলো বলে উনি বাসায় নিয়ে এসেছেন।

সেদিন নিকুন্তলাদের বাসা থেকে বের হবার সময় কান্তা পিছু পিছু এসে বললো, এতোগুলো বছর কোথায় লুকিয়ে ছিলে? আমাকে একটিবারের জন্যও তো দেখতে এলে না, আর আজ…

মুখের কথা কেড়ে নিয়ে নিবাস বললো, আজও তোমার সাথে দেখা হতো না। কিন্তু স্কুল থেকে বের হবার সময় চোখ পড়লো নিকুন্তলার দিকে। ঠিক তোমার মুখের মতো মুখায়ব। দেখেই বুকের ভেতর ঢিবঢিব শুরু হয়ে গেলো। এতো দূরের পথ পেরিয়ে এই মফস্বল সেই ছোটবেলার কান্তা কি করে এখানে আসবে এটাই ভাবছিলাম। তারপর যখন নিকুন্তলার কাছে ওর মা’র নাম জিঞ্জেস করলাম আর পারলাম কান্তা রায়, তখন আর কোন সন্দেহ রইলো না।

আর বেশী কিছু জিঞ্জেস করবার আগেই নিবাস বললো আজ আসি আরেকদিন কথা হবে এই বলে বৃষ্টির পায়ে পা মিলিয়ে পথের ধারে অদৃশ্য হয়ে গেল নিবাস।

তারপর…

আরেকদিন কথা বলার অঙ্গিকারবদ্ধ সেই নিবাস আর কান্তার সামনে পড়েনি। আরও অর্ধযুগ ধরেই নিবাস নিখোঁজ। কোথায় হারিয়েছে সে তা কেউ বলতে পারে না। হয়তো ফুলহীন পথে। নয়তো ভাষাহীন রথের এমনি কোথাও আজ নিবাসের বাস হয়েছে।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..