প্রেমিকার নাম মেঘাগমপ্রিয়

ইসরাত জাহান
গল্প
Bengali
প্রেমিকার নাম মেঘাগমপ্রিয়
নভেম্বর চলছে। অনির সাথে আজ দেখা হবে তা জানাই ছিল। এই তো ক’দিন আগেই দেখা হয়েছিল আমাদের। তবে ক’দিন পর আর দেখা হবে না। হয়তো ক’দিন নয় বরং বহুদিন দেখা হবে না অথবা আর কখনও কোনদিন দেখা হবে না। জানি না ঠিক। তবে বুকের ভেতর কোথাও কেমন হাড় ভাঙার ব্যথা টের পাই। টের পাচ্ছিলাম বেশ কিছুদিন থেকেই। দিনভর বৃষ্টি ছিল আজ। আকাশ জুড়ে মেঘ আর মেঘ। থমথমে আঁধারের সাথে বেহায়া বাতাস কাঁপন ধরাচ্ছিল শিরায়। শহরজুড়ে মাতম ছিল কার্তিক বিদায়ে যেন অঘ্রানের বরণে। জানি, অনি ঠিক সময়েই আসবে তবুও আমিই ভিজেছিলাম আধো আধো একলা থাকার বাহানায় একটু আগেই বেরিয়ে। আমি অপেক্ষা করছিলাম হাইওয়ের ধারে টং দোকানের বেঞ্চে বসে। বৃষ্টি, টং দোকানের কম দামী চা পাতায় দিনভর জ্বাল করা দুধ নাম যার ‘মালাই চা’ আমার আধভেজা শরীরটাকে বেশ আরাম দিচ্ছিল। মনে পড়ছিল কত কি!
এই অনির সাথে আমার অদ্ভুত এক সম্পর্ক! আমরা আপনি সম্বোধনে কথা বলি। কখনও কখনও তুমি। তবে তা ক্ষুদে বার্তা বা চিঠিতেই সীমাবদ্ধ। চার বছর আগে আলাপ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যেমে হলেও সামনা সামনি দেখা হয়েছিল গেল বছর। এই নভেম্বরেই। তবে সেদিন বৃষ্টি ছিল না। আকাশটা ভীষণ রোদ ঝলমলে ছিল সেদিন। অনি এসেছিল যে গাড়িটা নিয়ে সেটা দেখে আমি বলেছিলাম,
“চমৎকার খেলনা গাড়ি তো।”
এই শুনে অনি কেমন লজ্জা পেয়েছিল তা ভেবেই এখন আমার হাসি পাচ্ছে। আসলে ওর গাড়িটা খুব ছোট। তবে গাড়িটা আমার খুব পছন্দ হয়েছিল। Toyota Vitz। কালো রঙের বলে আমি নাম দিয়েছিলাম “ব্ল্যাক প্রিন্স”।
প্রথম দেখাতেই অনি আর আমি ভীষণ স্বচ্ছন্দ ছিলাম। অনির তো কথাই ফুরোচ্ছিল না। কত কি ভাগ করেছিল আমার সাথে। অনি ভীষণ একলা ছিল এই শহরে। কখনও কখনও আমিও। মাঝে মাঝেই আমরা বেরোতাম এই শহরের অলিগলি চিনব বলে। দুজনেই শুনতাম একে অপরের কথা কিংবা কথাদের। অনি দুর্দান্ত গাড়ি চালায়। ওর সাথে দেখা করতে গেলে আমি আমার গাড়ি নিতাম না কখনোই। আমি আসলে ড্রাইভিং সিটে বসা অনির বাম পাশে বসতে পছন্দ করতাম, এখনও করি। উপভোগ করি ওর ছেলেমানুষি। আমার না থেমে করা বকরবকর, অডিওতে গান, আর আমার ডান হাত ওর বাম হাতের মুঠোয় ধরে ডান হাতে গাড়ির স্ট্রিয়ারিং অথচ মগজ কিন্তু ওর একদম স্থির। তবে অনি ভীষণ খেয়াল রাখতেন আমার। এই যেমন আমি হয়তো চুপচাপ আছি আর ওমনি অনি শুরু করেছেন কথপকথন —
“শুনছেন, মেঘাগমপ্রিয়!”
“হ্যাঁ, বলুন। শুনছি তো।”
“চুপ কেন?”
“আজ আমার মন ভালো নেই।”
“কেন?”
“জানি না!”
“জানার দরকারও নেই। বরং আপনি জীবনানন্দের হিজল তমাল নিয়ে ভাবুন।”
“যেমন……”
“ভাবুন, তারপর বর্ষার আগমনে নতুন টলটলে জোয়ারের পানি সেই হিজলতলায় পৌঁছে গেছে। হিজলের ফুলে ফুলে ডাঙার পুরো হিজলতলা যেমন ভরে উঠেছে, তেমনি স্থির পানিপৃষ্ঠের ওপর পড়া হিজল ফুলের আস্তরণ ঠেকিয়ে দিচ্ছে তপ্ত সূর্যরশ্মিকে। কল্পনা করুন, স্বচ্ছ আর বরফশীতল সেই টলটলে পানিতে পা ডুবিয়ে আপনি বসে আছেন। দারুণ মিষ্টি গন্ধে সুবাসিত হয়ে উঠেছে চারপাশ। নেচে বেড়াচ্ছে মনের সুখে জোনাকিরা। কালচে সবুজ ডাল-পাতার ফাঁকে গোল গোল বড় চোখ মেলে তাকিয়ে আছে লক্ষ্মীপ্যাঁচা !”
“চেষ্টা করছি ভাবতে।”
“মনে করতে চেষ্টা করুন কবি নজরুলের সেই পঙ্ক্তি—
“হিজল বিছানো বন পথ দিয়া
রাঙায়ে চরণ আসিবে প্রিয়া..।”
“আহা! কি চমৎকার বললেন।”
“ভাবুন, মনের ঘরবাড়ি হচ্ছে স্বর্গ। আপনার প্রিয় প্রাকৃতিক পরিবেশ দিয়ে বাড়ির পরিমন্ডল সাজানো। ঘন সবুজে আচ্ছাদিত এই বাড়ির এক পাশে আছে একটি বড়সড় পুকুর এবং অন্য পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া মাঝারি খলাটি গিয়ে মিশেছে পরম ভালোবাসায় নদীতে। নদী……..,যার শেষই হয় সমুদ্রের মোহনায়। কল্পনা করুন, আপনি সেই খালের পাড়ে একটি হিজল গাছের নীচে বসে আছেন। কেমন সুশীতল চারপাশ! মৃদুমন্দ বাতাস এসে আপনার হাত-মুখ-স্পর্শ করছে, কিশলয়ের মতো কাঁপিয়ে তুলছে মস্তকের সামনের দিতে ঝুলে থাকা ক্ষীণকায় কেশরাজিকে! আর আপনার প্রিয়তম বন্ধু আলতো স্পর্শে আপনার চুলে হাতে বুলিয়ে দিয়ে গাইছে, কবি নজরুলের সেই বিখ্যাত গান-
“মোর প্রিয়া হবে এসো রানি
দেব খোঁপায় তারার ফুল
কর্ণে দোলাব তৃতীয়া তিথির
চৈতী চাঁদের দুল…।”
“আর তখনই আমার ইন্দ্রিয় টের পাবে ঘুম ঘুম ঘোরে দূর কোথাও থেকে বাতাসে মিশে আসা তমালের ঘ্রাণ। তখন? তখন কি হবে?”
“কি আর হবে? হিজলের বন ছেড়ে কিংবা আমাকেও ছেড়ে আপনি চলে যাবেন দূরের কোন তমালের বিষাক্ত ফলের রঙিন আলাপনে।”
“কি করবেন তখন?”
“কিচ্ছু না! সময়ের যাতনার এসিড বৃষ্টিতেও যদি আপনি থাকেন অসহ্য বেদনা শুষে নিয়ে মাতাল কোন বেহাগ হয়ে, তবে আমার কি সাধ্য নিজেকে মন্দ রাখার।”
“এমন করেই সব জলাঞ্জলি দিতে হয় বুঝি!”
“জলাঞ্জলি না দিলে হৃদয় কি শূন্য হয়? যতটা শূন্যতা ততটাই যে আকুলতা হারানো সে আপনাকেই খোঁজার।
___________
(দুই)
তারপর কোন একদিন ঘুরতে বেরিয়েছি। গাড়িতে গান বাজছিল,
“সারাটা সকাল তোমায় ভেবে ছিল মন একলা যখন, আকাশের দু’পাড় ভেঙে ঝিরিঝিরি তারা এল মনে, খোলা ছাদে হঠাৎ এসে থমকে দাঁড়ালো।”
অনি হঠাৎই বলেছিল,
“মেঘাগমপ্রিয়, আপনি কি আমার প্রেমিকা হবেন?”
“প্রেমিকা?”
“প্রেমিকা! শুধুই প্রেমিকা। জঞ্জালের এই শহরে কিংবা জীবনে সকল চাওয়া ফুরোলে যখন দু’চোখ মুদবে ক্লান্তিতে তখন বুকের বাঁ পাশে শুধু আপনার নিঃশ্বাসটুকুর আওয়াজ শুনে শ্রান্তির নির্জলা আবেশে ঘুমোবো শেষ ঘুমের অন্তহীন পথিক হয়ে এটুকুই জেনে, মেঘাগমপ্রিয় নামে আমার একজন প্রেমিকা আছে। হবেন আমার সেই প্রেমিকা? বলুন হবেন?”
“এমন করে কয়ে বলে প্রেমিকা হওয়া যায় বুঝি!”
“যায় তো, মেঘাগমপ্রিয়। না বললে অনুভূতিদের অভিমান হয় যে!”
“অভিমান?”
“অভিমান! কথা’রা চায় কথা বলতে, কথা শুনতে। কথা’রা চায় কথায় কথায় হারাতে আত্মার কপাট খুলে।”
“তবে আসুন কথা বলি আমার ছোট্ট আয়োজনে।”
“সে আয়োজনে এক কাপ চা রাখবেন আপনার খোলা চুলের ঘ্রাণের পাশে। আর রাখবেন আপনাকেও আমার প্রেমিকা করে আমার বুকের বাঁ পাশে আপনার নিঃশ্বাসের আওয়াজে ভালাবাসাটুকু রেখে।”
“অনি, আপনি এত বোঝেন কেন আমাকে?”
“যেমন?”
“এই যে ঠিক যখন যেখানে যেমন করে যে সুরের কথা আমার মগজে আরাম দেয় সেটাই আপনি ঠিক গুছিয়ে রাখেন।”
“এ আর এমন কি! এটুকু বোঝা যায় তো।”
“যায়? কি করে?”
“মনের অন্তমিলে টুকরো টুকরো গড়মিলে।”
“অনি,”
“হ্যাঁ, বলুন না।”
“এই পথ ধরে বহুদূর গেলে যেখানে হাইওয়ে শেষ হয়েছে ঠিক তার বাম পাশ ধরে কিশোরীর চুলের অবহেলিত ফিতের মতো এক সরু পথ আছে। সে পথ ধরে এগোলেই দুই পাশে নাম জানা না জানা অনেক গাছের সমারহে জলপাই রঙা জঙ্গল। সেই জঙ্গল যেখানে শেষ হয়েছে সেখানে বয়ে গেছে সরু এক নদী। চুলে অপটু হাতে সাজানো সিঁথির মতো এঁকেবেঁকে। নদীতে ঢেউ নেই। চিরদিনের শান্ত সে নদী। দু’পাশেই জলপাই রঙা জঙ্গল। কোথাও কোথাও বড় গাছের ডাল ঝুলে নেমেছে নদীর জল ছুঁতে। অনেকটা দোলনার মতো। সে ডালে পা ছড়িয়ে দিব্যি জল ছুঁতে পারা যায়। সে নদীর নাম ‘পারুলি নদী’।”
” ‘পারুলি নদী’! নদীর নাম এত মায়াময়! ঠিক আপনার চোখের মতো। যে চোখে রোজ রোজ আমি মরি মায়ায় ডোবানো ঘোরে। আচ্ছা, নদীর জল ছুঁয়ে যে ডাল ঝুলেছে সে ডালে পা ছড়িয়ে আপনি বসে থাকবেন জলে ডুবিয়ে পা আর আমি কিনারে বসে দেখব আপনার চোখে আমার আজন্ম কিংবা আমৃত্যু সর্বনাশ। নেবেন, সেই জলপাই রঙা জংলী পথের শেষের সরু সেই নদীর কিনার ছুঁতে অথবা আপনাকেও ছুঁতে?”
“নেব, যদি হারাতে চান আপনার সকল নিয়ে আমারও অশেষে।”
__________
(তিন)
এক সকালে অনি এসেছিল আমাকে দেখতে। তারপর দুজনে হারিয়ে যাওয়ার ভান করেছিলাম পথে পথে। ঐদিন অনি শুনিয়েছিল গান—
“এখনও আকাশে মেঘ করে এলে হঠাৎ রৌদ্র উধাও হলে…অলস অবকাশ,
এখনও বাতাস উদাস হলে শিউলি পাতায় কাঁপন এলে ..দারুণ ফাগুন মাস,
সবই আছে তেমনি যা ছিল আগে, শুধু তুমি নেই….।”
“অনি”,
বলুন মেঘাগমপ্রিয়।”
“বলছি, কেন এলেন আমার শহরে?”
“আর তো মাত্র ক’টা দিন!”
” কি বলি বলুন তো! হুট করেই আমার শহরে আপনি এলেন। অযাচিত অভিনন্দন কিংবা স্বাগতম কিছুইতো জানাইনি আপনাকে।”
“তবুও কেমন থেকে যাওয়ার তাগাদায় এলোমেলো হচ্ছি আমি। সে কি আপনি বুঝতে পারছেন এতটুকুও?”
“একটু বরং বেশিই বুঝছি। কালো পিচে পা মাড়িয়ে আঙুল ছুঁয়ে আঙুলে, একটু একটু শরীর ছুঁতে ছুঁতে হৃদস্পন্দনও বুঝি মাপতে চাওয়া ইচ্ছেরা গড়াগড়ি খায় আপনার উঠোন জুড়ে!”
“আপনার চোখের দিকে তাকিয়ে ভ্রমণ করতে চাওয়া আমার ইচ্ছেরা বড় কাতর হয় আপনি আর আপনার পৃথিবীর রহস্যময়তা বুঝতে।”
“অথচ, চলে যাওয়ার উপায়ও যে এতটা কাছেই ছিল কেউ কি বুঝেছিলাম?”
“আপনি তো চাননি আমাকে।”
“তবুও কেন চলে যাবেন বলে আমার শহরের ভোরগুলো ম্রিয়মান, উত্তাপহীন দুপুর আর ক্লান্ত চোখের জ্বরে কাঁপা বিকেল হতে হতে সন্ধ্যা নামার পর অথর্ব রাত্রির ঘুনে ধরা সরে যেতে চাওয়া সময়।”
“বলেছিলাম তো! চলে যাব, দূরে যাব, ফিরে যাব, ভুলে যাব! তাও! কেমন রয়ে যাব আপনার শহরের জানজট-যানজট-ভজঘটের আমন্ত্রণে মিশে আপনার অন্তরাত্মা ছুঁয়ে।”
“অথচ আমার আপনাকেই খু-উ-ব ছুঁতে ইচ্ছে করে যে!”
“এমন আগ্রাসী ইচ্ছে’রা না পেতে পেতে চুপ করেই চুপ হবে সে কি আপনি জানবেন কখনও? নাকি আরও আরও দিন, মাস, বছর কিংবা যুগের পরে জানতে চেয়ে জানবেন, মেঘের সাথে ভাব করব বলেই চলে যেতে চাই পাহাড় চূড়ার আমন্ত্রণে। অথচ হঠাৎই রৌদ্রজ্জ্বলের এক ঝলক দেখে দ্বিধায় পড়ে যাওয়া চোখে কেবলই ভিড় করে প্রশ্ন,
মেঘ কোথায়! যে মেঘের সন্ধান পাব?”
“কি আশ্চর্য! মেঘ তো আপনার কত কাছেই আছে। অথচ দূরের ঐ মেঘেতেই যত আকর্ষণ!”
“সেই তো সেই অভিশাপ। টুকরো-টুকরো, ভাসা-ভাসা দূরের ঐ মেঘ আর পাহাড়ের গায়ে গা ছুঁয়ে যখন উষ্ণ হবে আমার শরীর,
তখন আপনাকেই যে মনে পড়তে হবে, মেঘাগমপ্রিয়? ইচ্ছে করে আপনার থুথনিতে দ্বিধা থরথর আঙুলের প্রলেপে লিখে দিতে নির্জনতায় বুনো হয়ে ওঠার কাব্য।”
“সেখানে এখন বড্ড হিসেব যাপিত জীবনের।”
“তবুও না হয় ভেবে নেব একচোট
ওখানেইতো রৌদ্রজ্জ্বলের এক ঝলক। ওখানেই যে মেঘাগমপ্রিয়’র অনেক জমাট অভিমান কিংবা অভিযোগ।”
“অভিমান কিংবা অভিযোগ কোনটাই নেই।”
“নেই বুঝি! যা দেখি তা সত্য নয়,
যা সত্য তাও যে দেখা নয়।”
“অনি, চলেই যাবেন জানি। তবে
আসবেন কি আরও একবার আমার শহরে?”
“একবার? কি বলছেন! বারবার আসতেই যে হবে আপনার শহরে আপনার চোখে আমন্ত্রণের আয়োজন খুঁজতে চাওয়ার অযুহাতে।”
“অনি, কবিতা শুনবেন?”
“আপনার লেখা হলে শুনতে পারি সমস্ত মুগ্ধতা জড়ো করে!”
“আমারই লেখা। আজ সকালেই লিখেছি।”
“শোনান তবে!”
“ধূলোপড়া হতশ্রী শহরে ঘাসেরা নেই মৃত্তিকা আঁকড়ে,
পালিয়ে বেঁচেছে অস্বিস্ত্বটুকু গুটিয়ে নিয়ে।
অনিচ্ছাকৃত ধূলোর ছদ্মবেশে ডালেদের আদরের রসে ঝুলে থাকে পাতারা ঝরে যাওয়ার ভয়ে ঝিরিঝির বাতাসে হাপিত্যিস করে চাতকের মত।
ফোটাফোটা বৃষ্টির জল ধুয়ে দেয় পাতাগুলোর প্রলেপ, ফিরতে চায় তারাও নিজের সবুজে,
অথচ বৃষ্টিহীন মেঘগুলো বাষ্প হয়ে উড়ে পালায় ধূলোর অত্যাচারে।
তীব্র রোদের ঝাঁজ
সেও তো….ভিড় করা ইমারতের আনাচে-কানাচে স্থবির মনুষ্যত্ব ঝলসে খাওয়ার বাহানায়।
নিয়ন আলোকছ্বটায় লজ্জিত নক্ষত্রমন্ডল লুকায় অজানার খাঁজে,
শুন্যতায় খাঁ-খাঁ করে আকাশ-
পিচঢালা পথের পিচ আর গলে না বিগলিত অবহেলায়, বরং ভাঙে আর গুঁড়ো হয় টায়ারের চাপে,
গল্প হাঁটে অভিমানী কাব্যের নাম খুঁজে পেতে।
টয়োটা Vitz এর স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখে ছুটে চলা ইচ্ছে থমকে থামে ট্রাফিক জ্যামের লাল রঙের খপ্পরে,
তীর্থের কাক চোখের দৃষ্টি আটকে থাকে সবুজ বাতির জ্বলে ওঠা দেখবে ভেবে।
ইটের পর ইট
সিমেন্ট-বালু-খোয়া-পাথর-পানির মশলায় শুকনো কংক্রিটের এই শহরে,
কংক্রিট মন, কংক্রিট বেঁচে থাকা,
ধূলোপড়া এই শহরে ইদানিং ভীষণ একলা লাগে, ভীষণ…..একলা…..।”
“কি হল? চুপ কেন মেঘাগমপ্রিয়?”
“মানে?”
“কবিতা?”
“অনি, কবিতা তো এটুকুই ছিল।”
“উহু! আরেকটু আছে।”
“যেমন,”
” সেই একলা থাকার সময়ে চোখ পুড়ে যায় জ্বরের তাপদাহে ভীষণ, যেমন শীতার্থ কাতরতায় জড়িয়ে ধরে রাতের দীর্ঘশ্বাস।
কী নিঃসঙ্গ নির্জনে ছড়িয়ে জীবনের বৈভব…
অথচ আমি নির্জনতায় চেয়েছি অযাচিত বেসুরো বিন্যাসে।
বেসুরেও বাঁশির সুর টঙ্কার তোলে অর্ফিয়াসের,
জানো কি?
বহুদূর থেকে সেই বেসুরো টানের মায়া মায়া ঘোরে হেঁটে হেঁটে আসতেই পার চোখের সুরঙ্গ ধরে একবার..
ধোঁয়া ওঠা গরম জল তোমাকে স্নান করাবে শুদ্ধতম প্রয়াসে, আর তুমি বেদনার বসন খুলে নেমে পড়বে জলমগ্ন স্নানের বিশুদ্ধ বিমলে।
মনমগনের গহীন গহনে
কেমন খরাস্রোতের মন খারাপের বিষণ্নতার ঘ্রাণ,
মনপোড়া সে ঘ্রাণে আত্মা ভেজাতে
একবার আসবে কি ওহে মেঘাগমপ্রিয়?”
“অনি, আপনি কবিতা লিখেন?”
“না তো! এ আসলে আপনারই লেখা আমার হৃদয়ে আমার অনুভূতিতে।”
“দূর ছাই! কি বলেন? কিচ্ছু বুঝি না।
“সব বোঝার কি দরকার? কিছু না বোঝা থাক সুন্দরম আপনার চোখে জীবনানন্দের বেতফল হয়ে।”
_______________
(চার)
অনি একবার চিঠিও লিখেছিল আমাকে। ভার্চুয়াল চিঠি। হোয়াটসঅ্যাপে। সেদিন আমি অনিকে দেখতে গিয়েছিলাম হলুদ কামিজে নিয়ন আলোর হলুদ এক সন্ধ্যায়। দেখা করে যখন ফিরেছিলাম তখনই সেই চিঠি পেয়েছিলাম। অনি লিখেছিল,
“আজ গোধূলিরা এসেছিল এই শহরে হলুদ সন্ধ্যা হয়ে। শহর জুড়ে ছিল বর্ণিল আলোর ছটা। এ শহর প্রান্তরে প্রতিটি নিয়ন বাতিরা আলো জ্বালিয়েছিল তুমি আসবে বলে। গগনচুম্বী উড়াল সেতুগুলো ডানা মেলে দাঁড়িয়ে ছিল তোমাকে অভিবাদ জানাবে বলে। গোধূলিরা কানে কানে বলেছিল আলোর শ্রাবণ ধারায় ভরিয়ে দিতে। চুনিলাল যদি জানতে কোতোয়ালের এই চাঁদ, এই শরৎ তোমারই হবে। তবে জাদুর শহর ঢাকার রাত্রি হতো এক আরব্য উপন্যাস।
উর্দি নয় বুকের ভেতরেই বাড়ন্ত জ্যোৎস্না…
বলো কার দেখা পেলে, ও আমার নয়নের নীল মণি?
খোকন আমার, বলো তো আমাকে,কার কার দেখা পেলে?
টাট্টুঘোড়ার লাশের পাশেই পড়ে আছে এক শিশু
কালো কুকুরকে হাঁটিয়ে নিচ্ছে বদমেজাজী এক লোক
দেখেছি আগুনে একটি তরুণী জ্বলছিল দাউদাউ
একটি বালিকা আমাকে দিয়েছে রংধনু উপহার
দেখতে পেলাম একটি মানুষ আহত প্রেমের ঘায়ে
দেখতে পেলাম আরেক মানুষ আহত ঘৃণার ঘায়ে
আর নির্দয়! একি নির্দয় প্রান্তরের ঐ দূরন্ত যন্ত্রযানগুলো। হাওয়া কলের বেগে ধাবমান, মটরের কী নির্দয় শব্দ ! তাদের আগুনের ডানা গুলো, নির্বাপিত হতো তোমার আগমনে।
রাতের নিরবতা ভেঙে ঝর্ণার ফোয়ারার মতো তারা উৎসারিত হয়ে এসেছিল আজ, তোমার প্রাঙ্গণ রাঙিয়ে দেবে বলো। নগরের দেওয়াল জুড়ে লেখাছিল “ভালোবাসার গল্পরা গোধূলির শিখা হয়ে জ্বলে”। দেয়ালের সেই লেখা কবে শ্যাওলার অতলে ডুবেছে। হয়তো দেয়ালটাই আর নেই। কিন্তু ভালোবাসার গল্পরা মন থেকে মনে ফেরে, শুধু তুমি আসবে বলে। শরতের সন্ধ্যারা গোধূলির রঙে রাঙিয়েছিল হৃদয়ের এক গভীর অনুভবে। বিকেলের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে যখন যন্ত্রযানগুলো ধেয়ে চলে, এই যাদুর শহর ঢাকা যেন এক নবজাত শিশুর মতো কোলাহলে মুখর। সন্ধ্যা গোধূলির গান, মটরযানের শব্দ, চিৎকার যেন ওই দাঁড়িয়ে থাকা ধূসর গাছেদের মতো, যারা এই বিশ্বের হৃদয় থেকে জন্ম নিয়ে শহর জীবনের ঝরনার মতো অনন্ত আকাশের দিকে ধেয়ে চলেছে। পানসে প্রেমের গল্পরাও তখন ডুব দিয়ে বুদবুদ তুলে এই গল্পের পুকুরে। আজ তুমি আসবে বলে গোধূলিরাও এসেছিল আমার শহরে! হে প্রিয়তমা তোমাকে অভিবাদন।”
সেই চিঠির জবাবে আমি লিখেছিলাম,
“হেমন্তের ডাকপিওন চিঠি লিখেছিল ইরাবতীর কাছে। লিখেছিল,
“গোধূলি, সন্ধ্যারা নেমে আসে
মন খারাপের চিঠি নিয়ে; আসে হেমন্তের ডাকপিওন হয়ে।
অথচ ঝুলি ভরে থাকে কত কালের পুরোনো আর নতুন চিঠিতে।
একাকী এই নগরীর ল্যাম্পপোস্টের আলোয় ছুটে চলা ডাকপিওন ভাবে, “যাচ্ছি ভেসে বস্তুত জ্যোৎস্নায়…
ওই তো যাচ্ছে গুচ্ছগুচ্ছ তারা হাওয়ার মতন ভেসে, ধাবমান বেগে ধেয়ে..,হেমন্তের ছাতিম ফুলের সৌরভ ছড়িয়ে..।”
আরও লিখেছিল, আমাদের পাড়ার রবীন্দ্র কাকু রোজ সন্ধ্যায় আকাশ প্রদীপ জ্বালায় ফুলের সাজিতে। জিজ্ঞেস করেছিলাম,
“কার জন্য এমন আকাশ প্রদীপ জ্বালাও?”
রবীন্দ্র কাকু সময় নিয়েছিল একটু। তারপর ভেজা গলায় বলেছিল,
“ইরাবতীর জন্য, আমি ওকে ইরা বলে ডাকতাম। বহু আগে এরকম কোন এক হেমন্তের কার্তিক মাসে আমায় ছেড়ে চলে গিয়েছিল। এই ছোট্ট শহরের অন্য প্রান্তেই তার ঘর-সংসার। কিন্তু আমি আর তার সামনে যাই না। শুধু সে যদি দেখতে পায়, তাই তার জন্য আমি ফুলের সাজির মধ্যে ছোট্ট এই আকাশ প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখি তারাদের কাছে। না, সে ফিরে আসবে না জানি। কিন্তু আমি তাকে এই আলোর চিহ্নে জানাতে চাই যে, “ভুলিনি, আমি তোমাকে ভুলিনি!”
ফিরতি চিঠিতে ইরাবতী লিখেছিল জীবনানন্দের ভাষায়,
“যদি আমি ঝরে যাই একদিন কার্তিকের নীল কুয়াশায়;
তখন আমারে যদি পাও নাকো লালশাক-ছাওয়া মাঠে খুঁজে,
ঠেস্‌ দিয়ে বসে আর থাকি নাকো যদি বুনো চালতার গায়ে,
তাহলে জানিও তুমি,
আসিয়াছে অন্ধকার মৃত্যুর আহ্বান-
যার ডাক শুনে রাঙা রৌদ্রেরো চিল আর শালিখের ভিড়।”
আর সেই চিঠি পড়ে রবীন্দ্র কাকু কিংবা তাঁর মতো তাবৎ প্রেমিকগণ কেবলই কেঁদেছিল। অথচ, বলা যেতো, “ইরাবতী, মন তো এক নদী। যে নদীর জল পুরোহিতের ছোঁয়ার মতো পবিত্র আর স্বচ্ছ। হলোই বা ঘর, থাকলোই বা সংসার! তাতে কি তুমি অচ্ছুত হলে? তুমি তো আমার পবিত্র নদী। যেখানে আমার মন সাঁতার দেবে সলতে জ্বলা সন্ধ্যের প্রার্থনা সঙ্গীতের তালে মগ্ন হয়ে।”
উহু, বলেনি সে কথা কেউ ইরাবতীকে। না রবীন্দ্র কাকু, না পৃথিবীর তাবৎ প্রেমিক। তারা যে বোকা। তারা ধরেই নেয় বা নিয়েছিল, মিলনেই প্রেমের বীজ বপন আর তাতে ফসলের ছড়াছড়ি এবং এরপর হাটবাজার। আদপে তা নয়কো যে! প্রেম যখন দাম্পত্য নামে শোভা পায় তখন যে প্রেমটাই হারিয়ে যায়। আহা! ইরাবতীর বেদন রবীন্দ্র কাকু বোঝেনি। বোঝেনি তাবৎ প্রেমিককূল। রবীন্দ্র কাকু কেবল নিজের বেদনটাই বুঝেছে। তাই তো কেবল আকাশ প্রদীপ জ্বেলে বোঝাতে চেয়েছে, “ভুলিনি, আমি ভুলিনি।”
কখনও জানতে চাওয়ার ইচ্ছেরা কড়া নেড়ে ওঠেনি, “ইরাবতী, তুমিও কি আমারই মতো প্রদীপ জ্বালাও সন্ধ্যা না হোক ভোরের শুকতারায় অশ্রুপ্রসাদ দিয়ে?”
কেন দেয়নি সে ইচ্ছে’রা মাথাচারা? তবে কি প্রেম কেবলই পাওয়া আর পেতে চাওয়াতেই সীমাবদ্ধ? তাইই যদি কেবল হবে তবে কেন না পাওয়ার কষ্টের নষ্টামিতে জন্ম জন্মান্তরে আরও একবার দেখা হবে বলেই বিলাপ করে চর পড়ে খরা জাগে ইরাবতীর বুক জুড়ে? এ প্রশ্ন থাক তবে তাবৎ প্রেমিকের তরে হেমন্ত প্রেমের চিঠি হয়ে হেমন্তের ডাকপিওন এর চিঠিটার পরের পাতাটি হয়ে।”
এরপর……
আমি আরও একটি চিঠি লিখেছিলাম যেদিন অনি বলেছিল, “মেঘাগমপ্রিয়, চলে যেতে হবে যে। এই শহর আমাকে ছাড়তে হবে।”
উহ্ বুকের ভেতর কেমন হাতুড়ি পেটাচ্ছিল যেন, সব হাড় ভেঙে কেমন আমিও যেন ভেঙে যাচ্ছিলাম। তবুও ফিরতি চিঠিতে লিখেছিলাম,
“কার্তিক অথবা তুমি,
তোমার চিঠি পেয়েছি যখন, তখন আমি ঠিক কর্ণফুলীর মাঝ বরাবর। না, জল ছুঁয়ে নয় বরং কংক্রিট ছুঁয়ে। লিখেছ, “চলে যেতে হবে যে!”
হ্যাঁ তাইতো, চলে যেতে হবে। চলে যেতেই হবে। অথচ তুমি যেখানে যেতে চাও আমি তো সেখানেই। তোমার চিঠি পড়ে আমার বুকের ভেতর যেমন করে কেঁপেছিল, মনে হল কংক্রিটের সেতুটাও নড়েছিল ব্যথায়। অথচ চিরচেনা, অনেক দেখা আমার শৈশবের কর্ণফুলীর সাথে এখনকার কর্ণফুলীর কোনই মিল নেই। কর্ণফুলী এখন অতি আধুনিক সাজে সুসজ্জিত। বড্ড পরিপাটি আর নিয়মের। ছেড়ে দিতে দিতে কর্ণফুলী এখন সংকুচিত। কিন্তু তাতে তার বৈরাগ্য নেই মোটেও। চাকচিক্যের বাহুল্য আর আভিজাত্য দেখাতে কার না ভালো লাগে! তাতে যদি নিজেকেও ছেড়ে দিতে হয় সেটাও বুঝি দেয়া-ই যায়! এই যে যেমন তুমি চলে যাচ্ছ অগ্রহায়নের টানে। রেখে যাচ্ছ ফুল, পাতা ঝরে পড়ার শব্দ। অথচ নিজেই কেমন উদ্ভাসিত হচ্ছ অগ্রহায়নের টানে চলে যেতে চাওয়ার সুখে নতুন গজানো কুড়ির নৈশব্দের খুশিতে। এদিকে বড্ড বোকা আমি তোমার শুরুর নীল আকাশে তুলো তুলো মেঘের ওড়াউড়ি দেখে দেখে ভেবেছিলাম, ওই বুঝি জীবনও হল রঙিন! এই বুঝি চুপচাপ বেলা গিয়ে সাঁঝবাতির আলোয় ছাতিম ফুলের ঘ্রাণে খুঁজে নেবে আমারও কানের লতিতে ঠোঁট ছোঁয়ার আনন্দ!
কেন তুমি চলে যাচ্ছ? কেনই বা যেতে হচ্ছে? যেতেই যদি হত তবে ফড়িং ওড়া দুপুরে সোনালি ধানের শিষে পাখিদের ছোট্ট পেট ভরিয়ে কৃষাণ কৃষাণীর মুখে হাসি কেন ফোটালে? মিঠে কড়া রোদে যেই খেজুরের রস এল, ওমনি কেন তুমি চলে যাওয়ার গান শোনালে? কেন যেতেই হয় ঝলমলে চকমকে আঁধারে দীপ্তি ছড়িয়ে নিজেকেই কেবল অগ্রহায়নের কাছে সঁপে দেবে বলে? তোমার জন্য এই যে এত আয়োজন— অনন্ত অপেক্ষার জল থৈ থৈ চোখের সকাল, আহ্লাদে কেঁপে ওঠা ঠোঁটের দুপুর, হারাবার ভয়ে ভীত হৃদয়ের বিকেল, আকাশবাতির ছ্বটায় উদ্বেলিত থুথনির সন্ধ্যা, কৃত্তিকা নক্ষত্রের তোমাতেই বিলীন হতে চাওয়া রাত, এসবের কোনই মূল্য নেই তোমার কাছে? নেই সে সব ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলারও সময়? তোমার সময় এখন অঘ্রানের বিষণ্ণ বিকেলের রঙশূন্য বিবর্ণ খরার মাঠে মাটির ঢিল হয়ে ছুটে চলা চুম্বক। উহ্, তুমি…… আর….. নেই…..আমাতেই! এও মেনে নিতে হবে? আচ্ছা, আমি না হয় না মেনেই মানিয়ে নিলাম। কিন্তু তুমি? কি করবে তুমি? ভুলে যাবে আমাকে?
জানি, ভুলে যেতেই চাইবে! তবুও যদি কোন সুখ না থাকা সময়ে ব্যথার তীব্রতায় আমাকেও খু…..উ….ব, খু….উ…ব মনে করতে ইচ্ছে করে, তবে আমার প্রিয় কর্ণফুলীর বুকে রেখো তোমার হৃদয়ের স্পন্দন। জীবনানন্দের হাপিত্যিস “অবসরের গান” সেই ব্যথাদের অক্ষরগুলো মনে করতেই পারো তো তখন,
“আমি সেই সুন্দরীরে দেখে লই—নুয়ে আছে নদীর এ-পারে
বিয়োবার দেরি নাই—রূপ ঝ’রে পড়ে তার—
শীত এসে নষ্ট ক’রে দিয়ে যাবে তারে;
আজো তবু ফুরায়নি বৎসরের নতুন বয়স,
মাঠে-মাঠে ঝ’রে পড়ে কাঁচা রোদ—ভাঁড়ারের রস;”
ভালো থেকো প্রিয় কার্তিক অথবা আমার তুমি। ভালো থেকো খুব।”
___________
(পাঁচ)
বৃষ্টি আরও ধরে এসেছে। নভেম্বরের বৃষ্টি যেন শীত নামাচ্ছে আমার বুকের খাঁজে খাঁজে। ঠিক তখনই অনি এল। সেই চেনা মুখ, চেনা আমার প্রিয় সেই গাড়িতেই। বৃষ্টি আর পুরোনো সময়ে হেঁটে যাওয়া উপেক্ষা করে আমি টং দোকানের ছাউনি থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠি। অনির পাশে। অনি সিটবেল্ট বেঁধে দেয়। এই কাজটি বরাবরই অনি করে। এই যত্নটা আমার খুব ভালো লাগে। অনি আমাকে একটা প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বলে,
“আপনার জন্য উপহার।”
“কেন? নতুন সাফল্যের উদযাপনে?”
“অনেকটা।”
প্যাকেট খুলেই আমি অবাক! Ck IN 2U পারফিউম আর কাজল! আমার ভীষণ পছন্দের। ওদিকে আমার বুকের ভেতর মহাসমুদ্রের ঢেউ, অথচ চোখে দিঘীর নিরবতা। অনি আজ বিশেষ কারণে দেখা করতে এসেছে আমার সাথে। সেই কারণের নাম ছেড়ে যাওয়া। অনি চলে যাবে আমাকে ছেড়ে, এই শহর ছেড়ে, এই শহরের সমস্ত কার্যক্রম ছেড়ে অন্য এক শহরে। যে শহরে যাবে বলে অনি পেয়েছে নাগরিক জীবনের অফুরাণ সুযোগ সুবিধা। সুযোগ ছিল দুটোই। একঃ এই শহরেই থেকে যাওয়া। তবে তার জন্য প্রাপ্তির খাতা শূন্য। দুইঃ এই শহর ছেড়ে যাওয়া। বিনিময়ে শহরের ভেতরে নাগরিক সুযোগ সুবিধা নিয়ে গড়ে ওঠা আরেক শহরের মালিকানা। অনি দ্বিতীয়টিই বেছে নিয়েছে। নেবে সেটাই তো স্বাভাবিক। আমি হলেও তাইই করতাম। অনেকদিন থেকেই অনি ভুগছিল তীব্র এক ব্যথায়। সে ব্যথার নাম ব্যর্থতা। এই নেই, ওই হয় না, এটা পারি না, ওটা আসে না, কত্ত কি! উহ্, আমি দেখেছি ওর যাতন। আমি বুঝেছি ওর একলা সময়ে আমাকে ছিল কত প্রয়োজন। ওর একলা থাকার অবসরে আমি কেবল সময় দিয়েছি খানিকটা, শুনেছি ওর কাউকে না বলা কথা, বুঝেছি ওর ঘরে ফেরার টান আর সাফল্যের উদ্ভাসিত হাসিতে ঠোঁট মাতানোর ইচ্ছে। সেই আমি কি করে ওকে আটকে থাকার দাবী করতে পারি আমাতেই? পারি না। আমারও যে সীমানা প্রাচীর বড্ড বেদনার। তাই কিছুই বলা হয়ে ওঠে না। আমি দেখেছি সাফল্যের ছ্বটায় অনির মুখে অদ্ভুত এক প্রশান্তি আর সজীবতা। হেমন্তের সন্ধ্যায় নভেম্বরের বৃষ্টি, পাশাপাশি অনি আর মেঘাগমপ্রিয় অথচ যেন যোজন যোজন দূরের।
বরাবরের মতোই আমার ডান হাত অনির বাম হাতের মুঠোয় ছিল তবে আমি ঠিক উত্তাপে জ্বলিনি বরং ভিজেছি বুকের ভেতর হওয়া রক্তপাতে। সময় বড্ড বেয়াড়া। আলাদা হতে হবার সময় ঘনালো আরও আরও বৃষ্টি নিয়ে জল থৈথৈ শহরে। আমাকে নামিয়ে অনিকে যেতে হবে বহুদূর সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে আলোয় ভরা চুড়োয়।
আমার খুব ইচ্ছে ছিল ওকে কিছু দেব। এমন কিছু যা ওকে মনে করাবে আবার কোন একলা হবার অবসরে। আমার ডান হাত ওর মুঠোতেই ছিল। আমি টেনে নিই আমার দিকে। ওর বাম হাতের তালুর উল্টোদিকে ঠোঁট ছোঁয়াই আমার সমস্ত ভেজা অনুভূতিতে ওকে ভেজাতে চেয়ে।
বললাম, ওর চোখের দিকে তাকিয়ে।
“জানি আর কখনও ফিরবেন না। ফিরলেও এই উত্তাপ ফিরবে না কখনও। তাই ভুলতে ভুলতেও এই ভেজা চুমুর শিহরন আপনাকে মনে করাবে, আমি কখনও ছিলাম আপনাতেই।”
আমি দেখেছি, অনির চোখের কোনে তখন জল চিকচিক করছিল।
আমি নেমে গিয়েছি ততক্ষণে অনির গাড়ি থেকে। ওই গাড়িটাকে আমি খুব পছন্দ করি। ওই গাড়ি আর ওই ড্রাইভার দুজনকেই আমি খুব পছন্দ করি। ভালোবাসি আমি …….! থাক বরং।
আমার ভীষণ চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছিল,
“অনি, এই শহর নাকি শুধু ব্যর্থতা দিয়েছে আপনাকে অথচ এই শহরে যে আমিও থাকি।”
বলা হয়নি কিছু। চিৎকার চুপ করে গিলেছি আজন্ম এক ব্যথায়। হেঁটে এসেছি চেনা তবু অচেনা মনে হওয়া পথ ধরে।
আমি আর পেছন ফিরে তাকাইনি। এই ভয়ে যে, নভেম্বর রেইন আসলে আমার চোখে ছিল। সেই রেইন আমি অনিকে দেখাতে চাইনি।

ইসরাত জাহান। কবি। জন্ম বাংলাদেশের পাবনা জেলার ঈশ্বরদী। বর্তমান নিবাস ঢাকায়। তেরোবছর বয়স থেকে লেখালিখি শুরু। লেখা শুরু করেছিলেন দৈনিক বাংলার বাণীর মাধ্যমে। তারপর দৈনিক আজকের কাগজে নিয়মিত লেখালিখিতে ছিলেন। এরপর হঠাৎ করে বারোবছর লেখালিখি থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসন। প্রকাশিত বই: 'তোমার...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..