প্রেম ও দ্রোহের চিঠি

ইসরাত জাহান
পত্র সাহিত্য
Bengali
প্রেম ও দ্রোহের চিঠি

উলোট পূরাণ

প্রেমঝিরি,,

‘তোমার আমার গল্পগুলো
পথ হারাবে বসন্তের ধূলোয়….’
কত বছর আগে তুমি আমাকে লিখেছিলে এই কথাগুলো। সেদিনও এমনই বসন্তের ক্ষণ ছিল। ছিল কুয়াশার ধোঁয়াটে ইচ্ছের সমর্পণ তোমার-আমাতেই। চোখের নদীতে ডুব সাঁতারের মৌন সম্মতিতে বোহেমিয়ান মন তোমার আমার নিমগ্ন অপেক্ষার সঙ্গমে তৃপ্তি পেতে ছটফটে হা-হুতাশে উদ্বেলিত হত যখন, তখন মোহাবিষ্ট মন উড়ালিয়া ভোর গুনে-গুনে রাত খুঁজত কোকিলের পালকের ওমে। সেই ওমে খড়ের গাদার মত সোনালি সোনালি আগুনছ্বটার বিচ্ছুরণে নেশাতুর রাত হত জলপাইরঙা ভোর। অথচ সেই জলপাইরঙা ভোরে মনের ভেতর হাহাকার গোঙাতো কাছে না পাওয়ার আকুলিত বাহানায়। পাতা ঝরার দিনগুলো হারিয়ে যেত নতুন পাতা গজানোর উৎসবে মত্ত হতে। সে আয়োজনে সামিল হয়ে বৃক্ষ হত পোয়াতি।
পলাশ শিমুলের অভিমানও অভিসার হয়ে ঝরে ঝরে ফুলশয্যার বিছানা গোছাত আগুন রঙা ফুলে।
অথচ………,
আমি আছি আমার আমাতেই, তুমিও আছ তোমার তোমাতেই।
তবুও,
নির্জনের কোলাহল এখন হাপিত্যিস করে মরে ইটের পর ইটের খটখটে চামড়ার মসৃনতায়। খড়ের গাদা পুড়ে ছাই হয়েছে কবেই। সেখানে এখন পাথর-বালি-সিমেন্টের প্রলেপে গাড়ি গ্যারেজ। শহরের কোনে কোনে গাড়ি ডাকে পিপ-ক্র্যাচ-পিপ-ক্র্যাচ। কোকিলের পালকের ওমও উবে গেছে ইলেকট্রনিক হিটারের গরমে। আমাদের চোখে এখন শরীর ক্ষয়ের রেখা। মনেরও বুঝি! তাইতো এখন আর বুনো মহুয়া ঘ্রাণ উন্মাতাল ঢেউয়ে ভাসায় না নৌকা তোমার আমার হৃদয়ের জলঝিরির জলে।
কেন এমন হয়? কেন বদলে যায় সময়? কেন শরীর ক্ষয় হতে হতে মনও ক্ষয়ে যায়? কেন তোমার আমার বসন্তের রূপ বদলে হয় রূপান্তরের গান? এওকি আমাদেরই চাওয়া ছিল গোপন চেতনের গর্তে? নাকি নতুন গ্যাসের নিরেস ঘ্রাণে বসন্তের উদযাপন দেখব, ছেড়ে যাওয়ার টানে ক্রান্তি নীলিমায় ধূলোময় শহরের পিচে।
— মনঝিরি

(দুই)

তুমি আমায় ডেকেছিলে চুমুর নিমন্ত্রণে

মোহ,

তোমার সাথে একটি অরণ্যবাসের অনাদি ইচ্ছে আমার বহুদিনের……….
ঘুমঘুম চোখে মগ্ন মগজ থাকবে নিদ্রাহীন,
শরীর হবে যৌবনের সূর্য, আকাঙ্ক্ষা হবে আধেক চাঁদের অমল আপোষ,
দুঃখ পোকার গান হবে হৃদয়পুরের গীতল গহন মন্ময় দহন।
বুনো হতে হতে একে অপরের মন ছুঁয়ে শরীর নিংড়ে রসের সন্ধানে মাতাল হব বুনো শিকড়-বাকড়ের ঘ্রাণে ঘ্রাণে অনিকেত অশেষ।
পায়ের নীচে মুচমুচ করে জানান দেবে ঝরা শুকনো পাতা ‘আমি আছি তোমাদের মেহুল সঙ্গমের সঙ্গ দিতে।’
ছিঁড়ে ফেড়ে ইচ্ছে আর অনিচ্ছার ভিড়ে শুধু তুমি, আমি আর আমাদের প্রগলভ প্রেমের শরীর মনের ফিসফিস কথোপকথন।
তুমি সমুদ্র হবে চুমুর, আমি ঢেউ তুলে উম্মাদনা!
ঠোঁটের ভেতর ঠোঁট, নিঃশ্বাসের প্রগাঢ়তা আর চেপে রাখা আত্মবিশ্বাস তোমাতেই হারানো আমাতেই অথবা আমাতেই তোমাতে।
আলিঙ্গনের আদরে মন খারাপের আর্তনাদ শীৎকার হবে মনমগনের শরীরী কথোপকথনের আবাহনে।
অথচ …….
তুমি কেবলই কিনা ডাকলে আমায় চুমুর নিমন্ত্রণে!

—মায়া

 

(তিন)

তবুও দেখা হল

অযাচিত,

অনেকদিন পর আজ তোমাকে দেখলাম। তুমি দাঁড়িয়ে ছিলে পথের ঠিক বাম পাশে ভাবলেশহীন অথবা অপেক্ষাহীন। ট্র্যাফিক জ্যাম ছিলো না মোটেই অথচ টয়োটা করোলার ব্রেকে চেপে গেছে আমার মগজ। স্টিয়ারিং ধরা হাত দুটো কেঁপে গেছে ভূমিকম্প ছাড়াই। বাম পাশের জানালার গ্লাস নামিয়েছি ঠিক তোমাকে তিন গজ দূরে রেখে। তোমার ঠোঁটের ফাঁকে বেরোনো সিগারেটের ধোঁয়া বলে দিচ্ছিল আমাকে, ‘আমি আগের মতোই আছি’। ভালো লেগেছে তোমাকে দেখে। বুকের ভেতর কোথাও যেন কষ্টও হয়েছে। ভালোবাসার মানুষ কিছু না বলে চলে গেলে কষ্ট তো লাগবেই। হয়তো অভিমানও। তবে ভালোলাগাটুকুই ভালোবেসেছি ঐ মুহূর্তে। ইচ্ছে করছিল বাম পাশের দরজাটা খুলে দিয়ে বলি, উঠে এসো! কিন্তু হা করা মুখটা কেমন হা করেই রইল জবানহীন। আচ্ছা, এত সহজ কথা কেন বলা গেল না? কিই বা হত তাতে? না হয় আরেকবার ঘাড় ঘুরিয়ে চলে যেতে! তবুও তো তোমার চোখের সমুদ্রের তীর ঘেঁষে আমার চোখের একটু হেঁটে যাওয়া হত। অথচ আমিও কেমন ম্রিয়মান হয়ে গেছি এই শীতের রাতের ধুলো পড়া উইন্ডশিল্ডের মতো।
দুরত্ব বাড়ার সাথে সাথে কি বদলে গেছে আমারও কষ্টের রঙ? হবে হয়তো! কিছু দেখা থাকে অপ্রত্যাশিত, কিছু কথা অপ্রকাশিত। তাই বরং থাক। তুমি থাকো তোমাতেই! আমি আমাতেই।
দীর্ঘশ্বাস চেপে যায় দীর্ঘ হাইড্রলিক হর্নের অত্যাচারে। স্টিয়ারিং ধরা হাতটা শক্ত হয় আরও। জানালার নামানো গ্লাস উঠে যায়। যতদূর চোখ যায় আমিও হারাই আমার অযাচিত গন্তব্যের পথে। কানে বাজছে গান…….
‘আমি আগের ঠিকানায় আছি
সময় করে এসো একদিন
দু’জনে কিছুক্ষণ বসি পাশাপাশি…..’

তুমি কি এখনও দাঁড়িয়েই আছ ভাবলেশহীন অথবা অপেক্ষাহীন?

— প্রীত

(চার)

শ্রেষ্ঠ প্রেমিকের প্রেমিকা আমি

প্রিয়তমেষু,

সেদিনও এমনই বসন্ত ছিল।
পলাশের রঙে তোমার আমার দু’চোখে ছিল আগুন। কৃষ্ণচুড়ার শাখায় নতুন কুড়ির আনাগোনা অথচ পাতা ঝরার মুচমুচে মৃদু আওয়াজে হৃদয় ছিল উতলা।
শহরে সেদিন মিছিল ছিল। ছিলাম সে মিছিলে তুমি আর আমিও।
সাদা শাড়ি পরে এসেছিলাম বলে তুমি বলেছিলে,
‘সাদাও তো রঙ তবু কেন মলিন তোমার চিবুক।’
‘ও তুমি বুঝবে না’ মুখে বলেছিলাম বটে তবে বুকের ভেতর কেঁপেছিল কেন যেন কিছু হারানোর আগের ব্যথায়। তুমি কি বুঝেছিলে জানি না! সাদা শার্টের বাম পাশের পকেটে ডান হাত রেখে স্মিত হেসে বলেছিলে,
‘ওরে ও বর্ণমালা, চিঠি লিখেছি তোমার কাছে। মিছিল শেষে সে চিঠি চিৎকার করে তোমাকেই শোনাব সাথে পৃথিবীকেও।’
স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত রাজপথে হঠাৎই কী যেন হলো! কালো কালো পিচগুলো লাল হল কৃষ্ণচূড়ারা ফোটার আগেই। তোমার বুকের বাঁ পাশে ভীষণ কষ্ট আর তীর বেগে বেরোনো রক্তের ফোয়ারা। শহরের মিছিল তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো রক্তের স্রোতে ভেসে। উহ্! কি ভীষণ আর্তনাদ চিৎকার বিহীন আর মলিন। তবুও তুমি আমাকেই জড়িয়ে তোমার সব লাল রঙে রাঙিয়ে দিয়েছিলে সাদা শাড়ির জমিন। কানে কানে বলেছিলে,
‘ওরে ও বর্ণমালা, আমি তো তোমাকেই ভালোবেসে বেঁচে রব তোমাতেই। শুধু তুমি রঙিন থেকো অহঙ্কারের রঙে।
এরপর…..
তোমার চোখ আমাকে আর দেখেনি, তোমার বুক আমার বুক আর কখনও ছোঁয়নি, তোমার নিঃশ্বাস আমার ঘাড়ে আর কোনদিন ওম দেয়নি।
আর সেই তোমার লেখা তোমার না পড়া চিঠি? রক্তাক্ত আর ক্ষতবিক্ষত হয়ে তবুও আত্মবিশ্বাসে অমরতার সাক্ষী হতে নাম পেয়েছে ‘বর্ণমালা’। তুমি পড়নি সে চিঠি তবে পৃথিবী পড়েছে, পড়ছে, পড়বে পৃথিবীর শেষ ক্ষণটুকুতেও।
যেখানেই থাকো জেনে রেখো আমার শ্রেষ্ঠ প্রেমিক,
আমি এখনও রঙিন চির বসন্তের রঙে চিরকালের তোমার প্রেমিকা হয়ে। ‘বর্ণমালা’ আমার নাম তোমারই দেয়া তোমার রক্তের দাম।

____বর্ণমালা

ইসরাত জাহান। কবি। জন্ম বাংলাদেশের পাবনা জেলার ঈশ্বরদী। বর্তমান নিবাস ঢাকায়। তেরোবছর বয়স থেকে লেখালিখি শুরু। লেখা শুরু করেছিলেন দৈনিক বাংলার বাণীর মাধ্যমে। তারপর দৈনিক আজকের কাগজে নিয়মিত লেখালিখিতে ছিলেন। এরপর হঠাৎ করে বারোবছর লেখালিখি থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসন। প্রকাশিত বই: 'তোমার...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ