প্রেম
বিশুর আর তার বোন ঝুমা গ্রামের বাড়িতে একটা পুরোনো ভাঙাবাড়িতে, চার বন্ধুকে ডেকে গোলা পায়রা দেখতে যেত। বিশু ভালবাসত সোমাকে। বিশুর বোন ঝুমা শিউলিতলায় শিউলিফুলের বোঁটা থেঁতলে, নখ,হাত, পা রঙীন করে তুলত। আমাদের সকলের বোন ঝুমা,পুজোবাড়ির সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠত।তারপর আমাদের বিশু, পা ঝুলিয়ে দিত। আমরা বিশুর পা ধরে ওপরে উঠতাম।বিশু আমাদের একে একে টেনে তুলে নিত ছাদে।তারপর নারকেল গাছ থেকে নারকেল পেড়ে দাঁত দিয়ে ছাড়িয়ে খেতাম। এই ভাঙা পুজোবাড়ির ভিতরে খোলা জায়গাটা অনেকটা বড় ছিল।তার ভিতরে বড় বড় আমগাছ, নারকেলগাছ,অনেকরকম ফুলের গাছও ছিল।একটা ছোটপুকুর ছিল আর ছিল আমাদের খোলামন।তখন আমাদের কোন স্মার্টফোন বা মোবাইল ছিল না।কিন্তু আনন্দ ছিল ষোলআনা।আমরা চার বন্ধু। রমেন, জীবন, বিশু আর আমি। যেখানেই যেতাম একসাথে যেতাম,একসঙ্গে থাকতাম। বিশু ছিলো আমাদের দলের অলিখিত নেতা। নেতা তো এমনি এমনি হয় না। তার কাজ,দল চালানোর কৌশল তাকে নেতা বানিয়েছিলো। একদিন দুপুর বেলায় সে আমাদের ডাক দিত তার বাঁশি বাজিয়ে। বাঁশির ডাক শুনেই মন চঞ্চল হয়ে উঠত মন। চুপি চুপি বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পুজোবাড়িতে । আমাদের মিলন অফিস ছিলো এই পুজোবাড়ি । তারপর চারজন ছুটে চলে যেতাম খোলামাঠে। সেখানে বিশু বলত, দাঁড়া কয়েকটা তাল কাঁকড়া ধরি । ভেজে খাওয়া যাবে।একথা বলেই হাত ভরে দিত বিশু, সোজা ধানের জমির গর্তে।বিশু চিৎকার করে বলত, একটা মাগুর ধরেছি। এই কথা বলেই মাথা টিপে হাত বের করতেই দেখা গেলো মাছ নয় একটা বড় কালো কেউটে সাপ। বিশু সাপটাকে সাঁ সাঁ করে ঘুরিয়ে সহজেই ছুঁড়ে দিলো দূরে। তারপর তাল কাঁকড়া ধরে ভেজে খাওয়া হলো মাঠে। ভাজার সমস্ত সরঞ্জাম বিশু লুকিয়ে রাখতো একটা পোড়ো বাড়িতে। সাঁতার কাটতে যেতাম নতুন পুকুরে। একবার ডুবে যাওয়ার হাত থেকে রেহাই পেয়েছিলাম তার প্রখর বুদ্ধির জোরে। মাথার চুল ধরে টেনে তুলেছিলো ডাঙায়। বৃষ্টি হওয়ার সময় ঈগল মেঘের বাইরে সমস্যার মোকাবেলা করে দিয়ে যায় বৃষ্টির জল খেয়ে তখন উর্বরা ফালতু চিন্তা না করে সহজে নিচের থেকে শুরু করি জেনে রাখি সত্য কথা হইছে আর পেটের নিচে কারণ
একমাত্র মা ছাড়া আমি কারো কাছে প্রিয় ছিলাম না। তবুও নীল আকাশ সমুদ্রের জল হাতছানিতে বারবার। বন্ধুরা মিলে ঠিক করলাম দীঘা যাব কলকাতা থেকে বাস ধরে কয়েক ঘন্টা পর চলে এলাম একদম দীঘা।দিঘাতে এই আমার প্রথম সমুদ্র দর্শন। সমুদ্র দেখে প্রথমে বুঝতে পারিনি আকাশের নীল সমুদ্রের নীল একাকার হয়ে গেছিল। আমি অবাক হয়ে গেলাম এই বৃহৎ সমুদ্র দেখে কত ছোট আমরাই সাগরের কাছে। তারপর লজ ভাড়া করে আমরা সব বন্ধুরা চলে গেলাম সেখানে। খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা লজের মালিক করতেন। প্রত্যেকদিন সামুদ্রিক মাছ ভেজে খেতাম আবার দুপুরে ভাত খাওয়ার সময় পেতাম। লজের মালিক বললেন এখানে এলে শুধু মাছ খাবেন বিভিন্ন রকমের মাছ খেতে ভালো লাগবে।
সমুদ্রস্নান মনে রাখার মত এই সমুদ্র স্নান করতে বারবার ভালো লাগতো বারবার ছুটে চলে যেতাম সমুদ্রের ধারে সেখানে পাথরে বসে থাকতাম আর দেখতাম ঢেউয়ের পর ঢেউ পুলিশ মানা করত এ পাথরের ফাঁকে বিষধর সাপ ও থাকে তাই তারা বলত অন্য জায়গায় বসবেন এসব জায়গায় সাধারণত কেউ বসেনা।
সন্ধ্যাবেলায় সমুদ্রের ধারে বসে ঢেউ গুনতে আর বন্ধুরা আনন্দে মউজ করতো আমি একা এক পাশে ঝাউবনের মধ্যে গিয়ে ঘুরতাম সেখানে আমার আরো ভালো লাগতো।
আমার এক বন্ধুর নাম ছিল গৌতম গৌতম এর সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে হারিয়ে যেতাম সমুদ্রের ধারে ধারে ছবি তুলতাম কত সেইসব ছবি এখনো মনের মনিকোঠায় চির অমর হয়ে আছে এখনো ভুলতে পারিনি সেই সব দিনের কথাসকলের সাথে আমি সহজভাবে মিশতে পারি না কিছু কিছু বন্ধু আমার খুব প্রিয় ছিল তারা বুঝতে আমার অন্তরে কথা আমার স্বভাব চরিত্র সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল ছিল তাই তাদের সঙ্গে আমার বেশি ভালো লাগত।
আমি দেখতে খুব স্মার্ট নই কালো দোহারা চেহারার এক অসুন্দর যুবক। আজ অব্দি আমাকে দেখে কেউ প্রেমে পড়েনি আমি কারো প্রেমে পড়িনি। আজ কিন্তু আমি প্রকৃতির এই সমুদ্রের প্রেমে পড়ে গেলাম। প্রেম যে কত মধুর একমাত্র যার হয়েছে সেই জানে।
সেখানে পরিচয় হলো এক মেয়ের সাথে তার নাম সোমা। সোমা খুব সুন্দর দেখতে কি করে আমার মত একটা কালো ছেলে প্রেমে পড়ে গেল। সোম এতটাই ভালবেসে ফেলল যে আমার সঙ্গে লজে যেতেও কুণ্ঠাবোধ করল না।
পরেরদিন সকালে এসো মা আমাকে বললো চলো সমুদ্রসৈকতে ঘুরে আসি বলল হাতটা দাও হাত ধরে আমরা দুজনে একসাথে হাঁটবো দেখবে কত লভেলিয়ে দেখবে আমরা খুব মজা পাবো তারপর আমি তার হাত ধরলাম আঙ্গুলে আঙ্গুলে সাথে ভাঁজে ভাঁজে ঢুকে গেল তারপর হৃদয় শিহরিত হতে লাগল আমি বললাম তোমার কি অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে হচ্ছে। সোমা বলল হ্যাঁ হৃদয় খুলে যাচ্ছে। আমি বললাম আমার হৃদয় ভিজে যাচ্ছে ভালোবাসায়।
কোনোদিন ভাবতে পারিনি এত সুন্দরী এক মেয়ে আমাকে ভালোবেসে ফেলবে আন্তরিক ভালোবাসা তার শেষ হয়েছে তার বাবা-মায়ের সঙ্গে তাদের অন্য জায়গায় কিন্তু সে চলে আসে আপন মনে আপন খেয়ালে সমুদ্রের ধারে সেও সমুদ্র ভালোবাসে আর এই সমুদ্র যেন আমাদের মিলন ঘটিয়েছিল।সোমা বালি নিয়ে সমুদ্রসৈকতে কি সুন্দর এক দেবী প্রতিমা তৈরি করেছিল যেটা ঢেউয়ে সে আবার ভেসে চলে গেল আমি বললাম আমাদের প্রেম এরকম হবে নাতো বালির ঘরের মতো। সোমা বলল জীবনে তো তাই জীবনে তো বাড়ির ঘরের মতো একদিন ভেবে ভেসে যাবে সব ঘর। সোমা আরও বলল তবে যতদিন বাঁচবো আনন্দ করে বাঁচবো এসব চিন্তা করে লাভ নেই এস এখন আনন্দ করি। সোমা আমাকে মানুষ করে ধরেছিল আমি মানুষ ছিলাম না আমি কারো সাথে মিশতে পারতাম না ভদ্রভাবে কথা বলতে পারতাম না কিন্তু তোমার প্রেমে পড়ার পর আমি বুঝতে পারলাম জীবন কি।সোমা বলল জীবন অদ্ভুত শিল্প যে শিল্পী এই শিল্প ফুটিয়ে তুলতে পারে সেই তো সার্থক জীবনে দুঃখ কষ্ট আছে তাকে বড় করে দেখলে হয়না তাকে ভুলে গিয়ে সব সময় আনন্দে থাকতে হয় সেই আনন্দের খোঁজে থাকতে হয় শুধু আনন্দ শুধু আনন্দ এই আনন্দের অপর নাম দেবতা বা ঈশ্বর।সোমা বলল আমরা শুধু টাকা পয়সার পিছনে ঘুরে বেড়ায় কিন্তু এই আনন্দের পিছনে যদি আমরা ঘুরে বেড়াতে পারতাম তাহলে জীবনে এত সুন্দর অনুভব হত যে জীবনকে ভালবাসতে ইচ্ছে করত কিন্তু আমরা পারি না আমরা শুধু টাকা পয়সার পিছনে ছুটে বেরিয়ে আমাদের জীবনের মূল্যবান সময়টা নষ্ট করি।সমাহার ও বলেছিল তুই কোন জাত পাত নয় মানুষই একমাত্র ধর্ম মানবতা একমাত্র ধর্ম মানুষকে ভালোবাসায় একমাত্র ধর্ম এসো আমরা ভালোবেসে মানুষকে ভালবাসতে শিখো জগতকে ভালবাসতে শিখি।তারপর আমরা বিয়ে করেছিলাম এক মন্দিরে আমি বাড়ি নিয়ে গেছিলাম তাকে আমার বাবা-মা কিন্তু কোন অমত করেননি তাকে গ্রহণ করেছিল সুন্দরভাবে আর সময় ব্যবহারে মুগ্ধ হয়েছিল বাড়ির সকলে।সোমা আমার বাড়ি পরিবেশ পাল্টে তুলেছিল সবাই তাকে ভালোবাসতো সবাইকে থেকে এসে ভালোবাসার কথাই বলতো। সুজন স্বপ্নদেখে বেশি।
গ্রীষ্ম অবকাশে বট গাছের ডালে পা ভাঁজ করে বাদুড়ঝোলা খেলতাম বিশুর নেতৃত্বে।তারপর ঝোল ঝাপটি। উঁচু ডাল থেকে লাফিয়ে পড়তাম খড়ের গাদায়। এসব খেলা বিশুর আবিষ্কার। তারপর সন্ধ্যা হলেই গ্রামের বদমাশ লোকটিকে ভয় দেখাত বিশু। সুদখোর সুরেশ মহাজন গরীবলোকের কাছে মোটাটাকা সুদ নিত। বটগাছের ডাল থেকে একদিন শুনলো, কিঁ রেঁ বেঁটা খু্বঁ তোঁ চঁলেছিস হঁনহনিয়ে। আঁয় তোঁকে গাঁছে ঝোঁলাই। সুদখোর মহাজন অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলো। তারপর থেকে ওপথে যেত না মহাজন। সাদাচুলো বুড়িকে রোজ সন্ধ্যাবেলা নিজের মুড়ি খাইয়ে আসতো অতি আদরে। বিশু বলতো, আমি তো রাতে খাবো। বুড়ির কেউ নেই, আমি আছি তো। শ্রদ্ধায় মাথা নত হত নেতার হাসিতে। একবার বন্যার সময় স্কুল যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন আমাদের নেতা। কোথাও সাঁতার জল কোথাও বুক অবধি জল। একটা সাপ বিশুর হাতে জড়িয়ে ধরেছে। বিশু এক ঝটকায় ঝেরে ফেলে দিলো সাপটা। স্কুল আমাদের যেতেই হবে। সাঁতার কাটতে কাটতে আমাদের সে কি উল্লাস। যে কোনো কঠিন কাজের সামনাসামনি বুক চিতিয়ে সমাধান করার মতো মানসিকতা বিশুর ছিলো। সে সামনে আর আমরা চলেছি তার পিছুপিছু। শেষ অবধি পৌঁছে গেলাম স্কুল। হেড মাষ্টারমশাই খুব বাহবা দিলেন স্কুলে আসার জন্য। তিনি বললেন, ইচ্ছা থাকলে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়।টিফিনের সময় ছুটি হয়ে গেলো। আসার সময় একটা নৌকো পাওয়া গেলো। মাঝি বললেন, আমার বয়স হয়েছে আমি একা অতদূর নৌকা বাইতে পারবো নি বাবু। তাছাড়া আমার এখনও খাওয়া হয় নি।বিশু সঙ্গে সঙ্গে নিজের টিফিন বের করে দিলো। আমরাও মন্ত্রমুগ্ধের মতো টিফিন বের করে দিলাম। মাঝি ভাই বললেন, এসো সবাই এক হয়ে খেয়ে লি। তারপর নৌকার কান্ডারি হলো বিশু। আর আমরা সবাই মুড়ি মাখিয়ে খেতে শুরু করলাম। মাঝি ভাই ও বিশু খেলো। ধীরে ধীরে পৌঁছে গেলাম গ্রামে। মাঝি ভাইকে পারিশ্রমিক দিয়ে বিদায় জানালাম।পরের দিন রবিবার। রঙিন সকাল। আকাশে মেঘের আনাগোনা। কাশের কারসাজি নদীর তীর জুড়ে। বন্যার জল নেমে গিয়েছে। পুজো পুজো ভাব। বিশু কাশফুলের ভিড়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে। কয়েকদিন হলো তাকে দেখা যাচ্ছে না। আমি ঘুরতে ঘুরতে পুজো বাড়ির ঠাকুর দেখতে গেলাম। সেখানে দেখি বিশু হাতে কাদা মেখে শিল্পীকে সাহায্য করছে। তিন দিন ধরে এখানেই তার ডেরা। এখন তার মনে বাজছে ঢাকের ঢ্যামকুড়াকুড়। মন মন্দিরে তার দুর্গা গ্রামদেশ ছাড়িয়ে অভাবি বাতাসে বাতাসে। পুজো বাড়িতে আমাকে দেখেও কোনো কথা না বলে হাঁটতে হাঁটতে বাইরে চলে গেলো।আমি জানি সে এখন চাল, ডাল নিয়ে সর্দার বুড়িকে রেঁধে খাওয়াবে। সে বলে, ওর যে কেউ নেই। ও খাবে কি? বিশুর বাবা বছরে একবার বাড়ি আসেন। তিনি ভারতীয় সৈন্য বিভাগে কাজ করেন। বাড়িতে এলেই বিশুর হাতে হাতখরচ বাবদ তিনি বেশ কিছু টাকা দিয়ে যান। সেই টাকা বিশু লোকের উপকারে কাজে লাগায়।বড়ো অবাক হয়ে ভাবি, ছোটো বয়সে এতবড় মন সে পেল কোথা থেকে? স্কুলের দূরত্ব অনেক বেশি হওয়ায় আমাদের চার বন্ধুর বাড়ির গার্জেনরা শলা পরামর্শ করে হোষ্টেলে থাকার কথা বললেন। দায়িত্ব নিলো বিশু। কিন্তু হেড মাষ্টারমশাই বললেন, সেশনের মাঝে হোষ্টেল পাবি না। ঘর ভাড়া নিয়ে চারজনে থাক। পরীক্ষা এসে গেছে। কাছাকাছি থাকিস তিনটি মাস। রেজাল্ট ভালো হবে।ঘুরে ঘুরে অবশেষে ভাড়া ঘর পেলাম। কিন্তু বাড়িওয়ালার পাশের প্রতিবেশি বললেন, সাবধান ওই বাড়িতে ভূত আছে। আমরা ভয় পেয়ে তিনজনে বলে উঠলাম, তাহলে অন্য ঘর দেখি চল।বিশু বললো, টাকা দেওয়া হয়ে গেছে। ভূতের বাড়িতেই থাকবো। বিশু যখন সঙ্গে আছে, ভয় কি তোদের।
একবার বাবা, কাকা আর আমরা চারবন্ধু পুরী বেড়াাতে গেলাম ।ট্রেনের সিট খুঁজে সবাই উঠে বসলাম জগন্নাথ এক্স্প্রেসে। ঠিক পরের দিন দশটার সময় পৌঁছে গেলো পুরী স্টেশনে। সেখান থেকে সোজা লজে । সেখানে একটা সুন্দর ফুলের বাগানে তারা অনেক ছবি তুললো। ঝুমা একটা ডালিয়া ফুল তুলেছে। হোটেলের মালিক ডেকে পাঠালেন ঝুমাকে ।তিনি বললেন,হাজার টাকা ফাইন দিতে হবে। যারা ফুলের মর্যাদা দিতে জানে না, গুণীজনের মান দিতে জানে না, তাদের শাস্তি হওয়ায় উচিত। ঝুমা অগতির গতি বিশুদাকে ডেকে পাঠাল। বিশু এসেই ম্যাডামকে বলল,ম্যাডাম আমাদের দলে এক বোন ভুল করেছে। ভুল তো মানুষের হয়। কিন্তু আপনি তার থেকে বড়ো ভুল করতে চলেছেন।লজের মালকিন অবাক হয়ে বললেন – কি রকম ভুল?বিশু বলল, আপনি ডালিয়াফুলের গাছে, লাল পিঁপড়ের সারি দেখেছেন?মালিক বললেন,কই না তো?বিশু বলল,আমি কিন্তু প্রথমেই দেখেছি, এবং সকালবেলা দোকান থেকে গ্যামাক্সিন পাউডার কিনে এনেছি। পিঁপড়ে মারার বিষ।
লজের মালকিন খুশি হয়ে বললেন,পিঁপড়ে দেখলে আমিও আনতাম। চারপাশে ছিটিয়ে দিন,গাছে যেন না লাগে । একবেলাতে পালিয়ে যাবে পিঁপড়ের সারি।বিশু বলল,বলুন আপনার ফাইন কতো?আপনার ক্ষতিপূরণ বাবদ।মালিক বললেন,না,না আর দিতে হবে না। ফুল যে ভালোবাসে। তার ব্যাথা বোঝে, আমি তাকে শ্রদ্ধা করি।
এমনি কতরকম ছোটখাটো সমস্যা বিশু চুটকিতে সমাধান করে দিত তার ইয়ত্তা নাই। নুলিয়াদের সঙ্গে সমুদ্রে স্নান করতো। সে যেনো সমুদ্রের সন্তান। কত সখ্য জলের সঙ্গে। ভাসিয়ে রাখতো তাকে মায়ের আদরে। ঝুলু,মিলু জিজ্ঞেস করতো, আমরা কেন ওর মতো হতে পারি না। ম্যাডাম বলেছিলেন,ওসব মন কোটিতে গুটি। ওসব মনের তল পেতে গেলে নিজেকে রাঙিয়ে নিতে হবে ওর হৃদয় রঙে।তারপর আমরা ফিরে এসেছিলাম। আমরা প্রত্যেকে উপহার দিয়েছিলাম আমাদের প্রাণের বিশুকে। দুদিন পরে দেখলাম ও সব উপহার বিলিয়ে দিচ্ছে বায়েনপাড়ার বন্ধুদের।বিশু ও আমরা তখন, বিল্বেশ্বর উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র। আমার বন্ধু ছিল অনেক। তার মধ্যে সর্দার ছিলো বিশু। এখন যার কথা বলবো তার নাম অলক।বাড়ি তার কোমডাঙ্গা। স্কুলে যত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো তার প্রধান দায়ীত্বে থাকত আমাদের দলের প্রধান বিশু। আর কান টানলেই মাথা আসে। হাত বাড়ালেই বন্ধুদল হাজির। বিশু মানেই আমরা সবাই। আমাদের বন্ধুরা এই পরোপকারী নির্ভিক নেতার ভক্ত।
বিশু ও আমরা শীতকালে গোল হয়ে বসতাম।মাঝখানে জ্বলতো আগুন। পাতা,কাগজ কুড়িয়ে দিতাম আগুনে। আগুন নিভতো না। সেই আগুনে সেঁকে নিতাম হাত পা। আবার বাড়িতে গিয়ে মায়ের রান্নাঘরে মাটির তৈরি উনুনে সেঁকে নিতাম শীতল হাত,পা। মা সরজুগুলি,পিঠে বানাতেন। উনুনের ধারে বসে নলেন গুড়ের সঙ্গে আয়েস করে খেতাম। পায়েস খেতাম শেষ পাতে। রকমারি খাবারের সুগন্ধে মৌ মৌ করতো মায়ের হেঁসেল ঘর। পালো, বলে একরকমের খাবার মা বানাতেন যত্ন করে। সকালে উঠেই পালো খেয়ে ভুরিভোজ সারতাম। তারপর পিঠে রোদ লাগিয়ে সরব পড়া। বোঝার থেকে চিৎকার হতো বেশি। আনন্দ পেতাম সরব পড়ার প্রতিযোগিতায়। পাশের বাড়ির বন্ধুদের সরব পাঠের আওয়াজ পেলেই,ততোধিক জোরে শুরু করতাম পাঠ। স্কুলে গিয়ে তার আলোচনা হতো ক্লাসে। আরও জোরে পড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রতিযোগিতা চলতো মাসের পর মাস। বিশু বলত,কোনো দুঃখ,কষ্ট আমাদের মনে রেখাপাত করতে পারে না,কারণ জীবনের আনন্দ ছড়ানো থাকে তো ধুলো জোড়া পথে। এই ধুলো,মাটির সুগন্ধ, শরতে হিমের পরশ আমাদের ভারতবর্ষের প্রাণ।
বিশুর বোন ও ঝুমা শরতকালে হিমের পরশে সকালবেলায় শিউলিতলায় চলে যেত।সেখানে শিউলি ফুল কুড়িয়ে সাজিতে রাখত।তারপর শিউলির বোঁটা দিয়ে নেলপালিশ পরত।নখগুলো রঙীন হয়ে উঠত,মনের রঙে। রান্নাশালে বিশুর মা, ঘুঁটে পুড়িয়ে চা তৈরি করতেন উঠোনে বসে ।চায়ের গন্ধে সকালটা সুন্দর হয়ে উঠত। কদমা আর মিছরি সহযোগে জলখাবারে মুড়ি খেত ঝুমা, দুপুরে পান্তাভাত, পোস্তবাঁটা আর আমড়ার চাটনি।
ঝুমা এখন নেই কিন্তু বোনের স্মৃতি আজও বিশুকে নিয়ে যায় শরতে হিমের অপূর্ব পরশে, সোহাগি শিউলিতলায় ।
সূর্য হেলে পড়েছে পশ্চিমপাড়ে। আলপথ কোথাও জেগে আছে কোথাও জলে আধো ডোবা। কেনা আলপথ পেরিয়ে বাঁধে উঠে দেখল এদিকটায় একজন এখনও লাঙল চালাচ্ছে জমিতে।কেনা ঠিক ঠাওড় করতে পারছে না। চিৎকার করে বলল কেনা,কে গো এখনও জমিতে লাঙল দিচো।কে তুমি, ঠিক ঠাওড় করতে লারছি।
– আমি মরা গো , হাজরাদের মরা।এবার উঠব।
– ও মরাদা, একখান ট্রাকটর ডেকে জমিটা চষে দিলেই তো পারো।এত পরিশ্রম আর কেউ করে না।
– তা বটে। তবে কি জানো আমার মাটির বুকে ধরফরিয়ে ট্রাকটর চালাইতে আমি পারব না।
– কেনে, কেনে?
– আরে বাবা, মাটি তো আমাদের বুকের মত গো।আস্তে আস্তে বুক মালিশ করি যেমন, ঠিক তেমন করে জমি চষি।
মরাদা এবার জমা জলে হাত,পা ধুয়ে নিচ্ছে। মোষ দুটোর পিঠে জল দিয়ে ধুয়ে হাত বুলোতে বুলোতে বলল,চলো তোমার সঙ্গে বাড়ি যাই।
কেনা বলল, চল। কিন্তু তুমি তো সার দাও না জমিতে। কেন গো?
মরাদা বলল,দি তো। জৈব সার দিই।গোবর, পচা খড় প্রথমে দি। তারপর বৃষ্টি হলে আরও পচে।তারথেকে আর ভাল সার কী হতে পারে?
– কেনে, রাসায়নিক সার।
– ও সারে বন্ধুপোকা মরে যায়।মাটির খেতি হয় গো।
কেনা বলে,ওসব বুঝি না। তবে তোমার চাষের পদ্ধতি আমার কিন্তু বেশ লাগে। সবথেকে তোমার জমিতে ফসল ভাল হয়, তা বটে।
– আরে সেইকথাই তো বলছি গেরামের সকলে যদি গোবরসার ব্যবহার করি মাটি বাঁচবে,উর্বর হবে।
কেনা ওর পাড়ার পথে পা বাড়ালো।
মরাদা স্বপ্ন দেখে মাটিরগর্ভে কতজীবন আছে।তাদের সে বাঁচিয়ে তুলছে আর সবাইকে তার কথাটা বোঝাতে পেরেছে।
মরাদা ভাবে,কবে যে সেই স্বপ্নের দিন আসবে, কে জানে।
কমলের কথা
কমলের স্ত্রী সকলের সঙ্গে কথা বলতে ভালবাসে। তার মধ্যে সরলতা আছে। কমল বার বার তাকে সাবধান করে। বলে সংসার কিন্তু তোমার মত সরল নয়। সকলকে বিশ্বাস করবে না।কমলের স্ত্রী আদৃজা বলে, ওইরকম মন নিয়ে সমাজে চলা যায় না। ছেলেদের সঙ্গে কথা বললেই তোমার রাগ হয়। এটা কিন্তু তোমার চরিত্রগত একটা দোষ।
কমল আর কথা বাড়ায় না। দিন চলে জলের স্রোতের মত। কমল ভালোবেসে ফেলে এক বিধবা রমণী রমাকে। রমা কমলের অফিসের ক্যাশিয়ার। অনেকদিনের পরিচয়। রমা বেশ সুন্দরী। নিজে চারচাকা গাড়ি নিয়ে ড্রাইভ করে অফিসে আসে। চোখে সানগ্লাস। এই চল্লিশের কোঠায় তার দেহ টানটান। যেকোন ছেলে তার প্রেমে পড়তে বাধ্য। কিন্তু প্রেম তো বলেকয়ে আসে না। হঠাৎ আসে হুড়মুড়িয়ে। তখন কিছুই করার থাকে না। কমলের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হল না। রমার হৃদয়ে বাঁধা পড়লো তার মন। রমা তার গাড়িতে কমলকে নিয়ে অফিসফেরতা প্রথমে নিজের বাড়িতে নিয়ে যায়। গল্পগুজব করে। খাওয়া দাওয়া করে। তারপর কমল নিজের বাড়ি যায়।
কমলের স্ত্রী বলে, কয়েকমাস ধরে তোমার অফিস থেকে আসতে দেখছি দেরি হচ্ছে।
কমল বলে, হ্যাঁ একটা বন্ধুর বাড়ি যাই। তারপর খাওয়াদাওয়া করে বাড়ি আসি।
– তাহলে সন্ধ্যার খাবার বাড়িতে খাবে না তো কোনদিন।
– না সন্ধ্যার খাবারটা খেয়েই আসি। আর তাছাড়া অফিসের কাজে অনেক রাত অবধি মাঝে মাঝে কাজ পরে যায়। দু এক রাত বাড়ি না আসতেও পারি। মোবাইলে ফোন করে জানিয়ে দেব। তুমি চিন্তা কোরো না।
আদৃজা কেমন যেন হয়ে গেল এই কয়েকমাসে। আর আগের মত বাইরের লোকের সঙ্গে কথা বলে না। নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে সে।একদিন
আদৃজা বলে, তুমি সত্যি করে বলো। কাল রাতে কোথায় ছিলে?
– আমি রমার কাছে ছিলাম
– সে আবার কে?
– আমাদের অফিসের ক্যাশিয়ার
– তাহলেও ও তো মেয়ে। রাতে থাকলে কেন?
– আমি ওকে ভালবাসি।
আদৃজার মাথার ওপর আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। সি হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে বিষ খেলো। তার ছেলেরা হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে কোনওরকমে তাকে বাঁচিয়ে আনলো। কমল বললো, আমার অনেক টাকা খরচ হয়ে গেলো। তুমি বিষ খেতে গেলে কেন। আমি রমাকে ছাড়তে পারব না। ও আমাকে আরও উন্নত পথে নিয়ে যাবে। ও খারাপ মেয়ে নয়।
আদৃজা বুঝতে পারলো আর স্বামীকে ফেরানো যাবে না রমার খপ্পর থেকে। আদৃজা কমলকে বললো, তোমার মনে এই ছিলো। কেন আমার মধ্যে কি নেই যা রমার মধ্যে পাও।
কমল বললো, মন আর চিন্তার পার্থক্য।রমা আমাকে স্মার্ট করে তুলেছে। আমি এখন গাড়ি চালাতে পারি, কবিতা লিখতে পারি। কিন্তু তোমার সঙ্গে থাকলে কোনওদিন আমার প্রতিভার স্ফুরণ হত না। আমি রমাকে ভালোবাসি।
এইভাবেই সময় কাটে। শেষে কমলের বয়স বাড়ে আর বাড়ে তার শরীরের রোগ। সে আর আগের মত সবল নয়। বিছানায় সময় কাটে বেশি। অসুস্থ হয়ে পড়ে প্রচন্ড। এদিকে রমা মোবাইলে খবর নেয় কিন্তু অফিসের কাজের চাপে সে ব্যস্ত থাকে। আর সময় থাকলেও কমলের বাড়ি সে আসতে পারে না লজ্জায়। কমল এখন তার স্ত্রী আদৃজার ওপর নির্ভরশীল। আদৃজা স্বামীর সেবা করে দিনরাত। তারপর কমল একদিন সুস্থ হয় স্ত্রীর যত্নে।
কমল বলে, প্রকৃত প্রেম কি তা বুঝতে আমার অনেক সময় পেরিয়ে গেলো গো…
রমা কিন্তু হাল ছাড়ার পাত্রী নয়। এতদিন কমল কোমল কমল চিবিয়ে ছিবড়ে করে স্ত্রী দরদি হয়ে উঠবে একথা রমা মানতেই পারে নি। কমলকে ফোন করে, তোমার শরীর তো একটু সুস্থ হয়েছে, আমার সঙ্গে রাতে দেখা কোরো।
কমল ভিডিও কলটা তাড়াতাড়ি বন্ধ করলো। এখনি আদৃজা চলে আসতে পারে। শুনতে পেলে আবার অশান্তি হবে। কিন্তু না। আদৃজা আর কলহ করে না। সবটাই ছেড়ে দিয়েছে সে সময়ের হাতে। আদৃজার মনের জোর আগের থেকে অনেকগুণ বেড়ে গেছে। একটা ভীষণ ভারি বোঝা তার মাথা থেকে নেমে গেছে চিরদিনের মত। সে স্বামীকে বলে, চলো তোমার রমার সঙ্গে একদিন দেখা করি দুজনে।
– তাহলে একদিন রবিবার দেখে তিনজনে বেড়াতে যাবো মুকুটমণিপুরে। সেখানে তোমার সঙ্গে পরিচয়ও হবে আবার ঘোরাও হবে।
কমল চাইছিলো এই সুযোগে দুজনের ভিতর একটা সেতু তৈরি করতে। এই সেতু দুজনের মনের দূরত্ব কমিয়ে আনবে। মিলিয়ে দেবে মিলনসেতুর আকারে। কিন্তু একজন নারী কি কখনও ভুলেও তার স্বামীকে অপরের হাতে চিরকালের মত ছেড়ে দিতে চায়। কমল জানে না। তবু একবার ট্রাই করতে চায় তার মন।
মুকুটমণিপুরে গিয়ে স্মার্ট রমা কমলের বউকে আপন করে নেয়। আদৃজারও ভালো লেগে যায় রমাকে। সে ভাবে সত্যি রমা তো খুব ভালো মেয়ে। হয়ত বিধবা হওয়ার জন্য পরকীয়ায় বাঁধা পড়েছে। দেহেরও তো একটা দাবি আছে। আদৃজা কেমন যেন মায়ায় আচ্ছাদিত হয়ে যায় রমার আদরে আর ভালোবাসায়। তাহলে পুরুষতো বশ হবেই রমার প্রেমে। রমার প্রেম আর পারিজাত ফুলের পরশ কি একইরকম। আদৃজার নারীত্ব ফুটে ওঠে পদ্মফুলের মত।
আদৃজা ভাবে, এখন সে কি করবে। দুই সতীনের ঘর করবে, নাকি রমাকে সটান একচড় কশাবে।কিন্তু চড় মারার তো কারণ চাই। রমা তো একটাও কটু কথা বলে নি। শুধু একটা হাহাকার তার অন্তরজুড়ে, এটা আদৃজা লক্ষ্য করেছে বারবার। কমল ভাবে, নারীদের তৃতীয় নয়ন আছে। ওরা সবকিছু বুঝতে পারে তান্ত্রিক সাধকের মত।
আদৃজা খেই হারিয়ে ফেলে। মনে হয় মুকুটমণিপুরের পাহাড়ের একটা বড় পাথর ভারি হয়ে নেমে আসে তার বুকে। একটা চাপা অনুভূতি। রমা এসে সে পাথর সরিয়ে দেয়। রমা বলে, স্বামীকে চোখে চোখে আগলিয়ে রেখো। তোমাকে আমি স্মার্ট করে গড়ে তুলব। তুমি আসবে তো আমার বাড়ি।তুমি তো এমনিতেই সুন্দরী। শুধু প্রয়োজন একটু বাগানের মালির মত আদরে ক্যাকটাসের যত্ন নেওয়া।
তারপর আদৃজা এক অমোঘ আকর্ষণে রমার বাড়ি যায়। আসা যাওয়া সহজ হয়ে যায় মানুষের বিচিত্র মনের মত গতিময় আবেশে।
এখন আদৃজা স্কুটি চালায়। ডায়েট মেইনটেন করে। আদৃজার কোমর দেখে কমলের মনে হয় একটা হিলহিলে সাপ কেমন জড়িয়ে রয়েছে তার শরীরজুড়ে। কমলের ছোবল দিতে ইচ্ছে হয় আদৃজার ঠোঁট বরাবর মাঝখান দিয়ে নেমে একেবারে মাঝ নদীর গভীরতায়। রমার যত্নে সে স্বামীর চোখের মণি হয়ে উঠছে দিন দিন। আদৃজা বলে, এ তে তোমার স্বার্থ কি।আমি সুন্দরী,স্মার্ট হলে কমল তোমার হাতছাড়া হয়ে যাবে তো। প্রেম বিফলে যাবে।
রমা বলে, সবকিছুতে এখন স্বার্থ দেখলে হবে।সব প্রেম শরীর চায় না। মনের পরশেও ফুটে ওঠে আত্মার শক্তি। সে প্রেম তো আর ছেলেখেলা নয় যে ঠুনকো আঘাতে ঝরে পড়বে বাইরে।আর তাছাড়া নিজের হাতে গড়ে, দুনিয়া পাল্টে ফেলার তো একটা আলাদা আনন্দ আছে গো সুন্দরী..
কমলের লেখক বন্ধু র কথা
ছোটো থেকেই পড়তে ভালো লাগতো পড়ার বাইরের বই। বাবা,বড়দা বই এনে দিতেন প্রচুর।সংবাদপত্র আসতো নিয়মিত বাড়িতে।পড়ার একটা পরিবেশ গড়ে উঠেছিলো।ফলে লেখার ইচ্ছে হলো একদিন।স্কুলের ম্যাগাজিনে প্রথম লেখা।আমার প্রথম উপন্যাস ১৯৮৪ সালে লেখা। নামটা হলো, মিলনের পথে।
জীবনের অনুভবের প্রয়োজন আছে নিশ্চয় লেখার জন্য।যে জীবন ব্যর্থ হয়নি, কষ্ট পায় নি,অভাব বোঝে নি সে জীবন তো মরুভূমি। সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ তো বলেই গিয়েছেন এ কথা।তাই সকল ব্যথার অনুভূতি থেকে উৎসারিত হয় লেখার আলো।
বাংলা ভাষাকে উন্নত করার জন্য, সর্বপ্রথম এই ভাষাকে জানতে হবে সঠিকভাবে। ভবিষ্যত প্রজন্মকে তার মাতৃভাষার প্রতি আগ্রহী করে তুলতে হবে। বাকিটা তাদের উপরেই ন্যস্ত থাক।
ইদানিং হৃদকথন,বাংলা ক্যানভাস,সংবাদ পত্রিকা,তথ্যকেন্দ্র,আরম্ভ,শব্দসাঁকো,অক্ষরসংলাপ,আলো,কাটোয়ার কথা,ধুলামন্দির,কৃতি এখন,ইসক্রা,কবিওকবিতা,আমাদের কফি হাউস ও আরও বহু পত্র পত্রিকায় লিখি।বাংলা ক্যানভাসে শারদীয়া সংখ্যায় এবার একটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে।নামটি হলো,মধু বাঁশির দেশ।
ভবিষ্যতে ফেসবুকের প্রয়োজনীয়তা বাড়বে বলেই মনে করি।ওয়েবজিন,ই ম্যাগাজিন ক্রমশ জনপ্রিয় হচ্ছে পাঠকের কাছে।
কবিতা ভালো লিখতে গেলে পড়াশুনার প্রয়োজন আছে। জয় গোস্বামীর গোঁসাইবাগান,নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কবিতার বই ও আরও আধুনিক সব কবির কবিতা পড়া উচিত।একটা ভালো কবিতা পড়লে ভালো কবিতা লেখা যায়।
তবে একটা কথা বলি, কবিতা কিন্তু অনুভবের উপর নির্ভর করে।পড়াশোনা জানেন না এমন কবির সংখ্যা কম নয়। বলে কয়ে প্রেম হয় না আর চেষ্টা করে কবিতা হয় না। এটা প্রতিভার উপর নির্ভরশীল নয় শুধু। অনুভূতির মাধ্যমে কবিতা হয়ে যায় কখনও সখনও।কবির সংখ্যা কম। কবিতা লেখক বেশি।
লেখকের জীবনাভূতি অনন্য হওয়া চাই।পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়নের সঙ্গে পড়াশোনা করতে হয় ভালোবেসে।দায়সারা হলে ভালো লেখক হওয়া যায় না।
বর্তমানে আমি উপন্যাস লিখছি।দুটি উপন্যাস লেখার অনুরোধ এসেছে।এছাড়া গল্প,কবিতাও লিখছি সময় হলে।
ভালো লেখার সংজ্ঞা বলা কঠিন। বাজাতে বাজাতে বায়েন, গাইতে গাইতে গায়েন।লেগে থাকতে হবে। লেগে থাকলেই হবে।
ফেসবুকের লেখাই তো আধুনিক যুব সমাজ পড়ছে। তবে সব লেখা তো সফল মানের হয় না। এখন ফেসবুকে লিখে কিছু লাইক পেলেই কবি মনে করে নিজেকে।কিন্তু এত সহজ নয়। তাই লেখা চিনতে হবে। বেছে পড়তে হবে।
পরিশেষে বলি আমার সংসারজীবনের কথা।সারাজীবন মানুষরূপী, দশভূজার আদরে বাঁচি। প্রথম দশভূজা আমাদের মা। ছোট থেকে বড় করে সংসার গড়ে তুলে দেন আর এক দশভূজার হাতে। তিনি আমাদের সংসারের গৃহিণী। ঘরে আমার ঘরণী, সকাল থেকে ঘটি বাটি আর রান্নাঘরের ঝুলে তার বকম বকম চলতেই থাকে। একা সব কষ্ট বাঁধে হৃদয়ে, ছেলে আর স্বামীকে পালঙ্কে বসায়। বসে বসে তারা দেখে কেমন করে চাঁদ ওঠে,তারায় ভরে যায় আকাশ।
মাঝে অমাবস্যায় ভরে যায় দুপুর,তারা খসে পরে দুঃখের বাজার থেকে ঝুলিয়ে আনে আশার ঝুলি
সব কাজ দশভূজার হাতে ভিড় করে আসে
একে একে তারা ফোটে যখন, তখনও রান্নাঘরে খাওয়ার জোগাড়ে ব্যস্ত ঝগরাটে বউটা
বাপের বাড়ি গেলে ঘরে আঁধার ঘনায়
আশার তারাগুলো ফুলের মত ঝরে পড়ে
লেখার কথা মাথায় আসে না। স্বার্থপর এক অসহায় লোক, অধির হয়ে শুনি, গতকাল তার বলা অমৃত বাণী, আমাকে বাঁচিয়ে রাখে, আশার আলো দেখায়। ঝগড়াটে রোগা বউটা কষ্টগুলো জমিয়ে রাখে মনের সিন্দুকে
এখন দুজনে একটা জাহাজবাড়ি কিনেছি
কল্পনার জলে তরতরিয়ে ভাসে জাহাজ
ঝগরাটে বউটা বলে, আমি গভীরতা মাপি তুমি আকাশ হও, আমি জাহাজের গতি মন্থর করি তুমি জীবনে আলো আনো অনেক প্রাণে
আমরা কি জানি সমস্ত মনজুড়ে সারাজীবন আলো হয়ে থাকে আমাদের দুই দশভূজার আশীর্বাদ ।
আমাকে একজন বয়স্ক সম্পাদক বলেছিলেন,উপন্যাস লিখতে গেলে, কয়েকটি রসের উপস্থিতির কথা জানতে হবে। তিনি বললেন,প্রেমরস,খলনায়কের উপস্থিতি, বাৎসল্য রস, খুনসুটি প্রেম,চরিত্রের বিশ্লেষণ ও সাহিত্যরস।
আমি বললাম,আমি যদি নতুন কোনো নিয়মে লিখি, আমার জীবনের অভিজ্ঞতা মিশিয়ে।
তিনি বললেন,হবে, তবে পরিষ্কার রাস্তায়,দেখানো রাস্তায় হাঁটলে গন্তব্যে পৌঁছোবে তাড়াতাড়ি। আর আচট পথে হাঁটলে পা কাঁটায় আক্রান্ত হবে।পথ নিজেকে তৈরি করে নিতে হবে।
তিনি আরও বললেন মোদ্দাকথা হচ্ছে পড়াশোনা করতে হবে।বিশ্লষণী ক্ষমতা আর প্রতিভা থাকতে হবে।আর শুধু পড়লে হবে না। প্রতিভা না থাকলে সব পড়াশোনা করা ছাত্ররা ঔপন্যাসিক হয়ে বসবে।প্রতিভা তো রাস্তাঘাটে, দোকানে কেনা যায় না,বাবা।
আমি এবার আসি, গদ্যে লেখা দীর্ঘাবয়ব বর্ণনাত্মক কথাসাহিত্যের কথায় ।আমার মনে হয়েছে, কবিতা, নাটক ও ছোটগল্পের ন্যায় উপন্যাস সাহিত্যের একটি বিশেষ শাখা। আধুনিক সাহিত্যে এটি তুলনামূলকভাবে নতুন আঙ্গিক। যিনি উপন্যাস রচনা করেন তিনি ঔপন্যাসিক।উপন্যাস লেখার নির্দিষ্ট নিয়ম বা কাঠামো নেই। তবে সচরাচর এগুলো ছোটগল্পের তুলনায় বৃহদাকার হয়ে থাকে। অধিকন্তু উপন্যাসের আখ্যানভাগ ও চরিত্রের, বিস্তার লক্ষিত হয়। হ্রস্ব দৈর্ঘ্যের উপন্যাসকে অনু-উপন্যাস বলা হয়ে থাকে। উপন্যাসে পরিবেশ, বর্ণনা, রূপরেখা, চরিত্র, সংলাপ ইত্যাদি যখন মানুষের জীবনের কাহিনীকে সুন্দর ও স্বার্থকভাবে ফুটিয়ে তুলে তার মধ্যে জীবনের কোনো অর্থ বা ভাষ্য প্রকাশ করা হয়। জীবনের এই রূপায়ণ উপন্যাসের মাধ্যমে পাঠকের কাছে বাস্তব বলে প্রতীয়মান হয়। বস্তুত, উপন্যাসের রূপ অত্যন্ত নমনীয় ও মিশ্র। তাই এর নানা রূপভেদ চোখে পড়ে।উপন্যাসের প্রধান উপাদান পাঁচটি । ঘটনা, চরিত্র,সংলাপ, ভাষা ঔপন্যাসিকের জীবন দর্শন । জীবন দর্শন, এটা একটা প্রয়োজনীয় বিষয় উপন্যাসে।
সাহিত্যের বিভিন্ন শাখার মধ্যে উপন্যাস সর্বাধুনিক এবং সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় শাখা। অষ্টাদশ শতাব্দীর ইংল্যান্ডে প্রথম আধুনিক উপন্যাস রচিত হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝিভাগে বাংলা ভাষায় প্রথম উপন্যাসের প্রবর্তন হয়। ইংরেজি ভাষায় ড্যানিয়েল ডিফো ও বাংলা ভাষায় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় উপন্যাস ধারার প্রথম সার্থক রূপকার। তারপর থেকেই বিভিন্ন দেশে এই ধারার বিচিত্র ও বহুমুখী বিস্তার লক্ষ্য করা যায়।
উপন্যাস আধুনিক কালের একটি বিশিষ্ট শিল্পরূপ। উপন্যাসের আক্ষরিক অর্থ হলো উপযুক্ত রূপে কাহিনীর উপস্থাপন। অর্থাৎ উপন্যাস হচ্ছে কাহিনি রূপে,একটি উপাদানকে বিবৃত করার বিশেষ কৌশল, পদ্ধতি বা রীতি। ‘উপন্যাস’ শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ novel-এর আভিধানিক অর্থ হলো a fictitious prose narrative or tale presenting picture of real life of the men and women portrayed. অর্থাৎ উপন্যাস হচ্ছে গদ্যে লিখিত এমন এক বিবরণ বা কাহিনি যার ভেতর দিয়ে মানব-মানবীর জীবনযাপনের বাস্তবতা প্রতিফলিত হয়ে থাকে।
ব্যুৎপত্তিগত এবং আভিধানিক অর্থ বিশ্লেষণের মাধ্যমে বলা যায়, মানব-মানবীর জীবন যাপনের বাস্তবতা অবলম্বনে যে কল্পিত উপাখ্যান পাঠকের কাছে আকর্ষণীয় করার জন্য বিশেষ বিন্যাসসহ গদ্যে লিপিবদ্ধ হয় তাই উপন্যাস। যেহেতু উপন্যাসের প্রধান উপজীব্য মানুষের জীবন তাই উপন্যাসের কাহিনি হয় বিশ্লেষণাত্মক, দীর্ঘ ও সমগ্রতাসন্ধানী।
আমি শৈশবে লিলুয়া শহরে থাকতাম।ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় বাবার ছোটভাই মারা যান।বাবা চাকরি ছেড়ে আমাদের নিয়ে চলে আসেন গ্রামের বাড়িতে।বাবার বেসরকারি ফার্মে চাকরি থাকার ফলে পেনশন ছিল না। চাষের জমিতে বন্যার কারণে ফসল পচে যেত।কাছেই অজয়নদী আর গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলে ঈশানী নদী।দুই নদীর বন্যায় ফসল নষ্ট হত বারেবারে।ফলে এই এলাকার কৃষকরা ধনী হতে পারে না।বাবা একটা মুদিখানা খুললেন।আমিও দোকানে বসতাম পড়ার ফাঁকে।তারপর বারো ক্লাস পাস করে আবার আমি চলে যাই লিলুয়া শহরে দাদার কাছে।সেখানে নরসিংহ দত্ত কলেজে ভরতি হই। গ্র্যাজুয়ের হওয়ার পরে সুরেন্দ্রনাথ ল কলেজে রাতে পড়তাম। তিনবছর ল পড়েও শেষবছরের পরীক্ষা দিতে পারি নি অর্থের অভাবে।ফলে আইন পাশ করার সার্টিফিকেট পাই নি। গৃহশিক্ষকতা করতাম রিষড়া শহরে।ট্রেনে যাওয়া আসা করতাম। তার আগে থেকেই লেখালেখির নেশা পেয়ে বসেছে ভালোভাবেই।অতিরিক্ত গল্প,উপন্যাসের বই পড়ার জন্য বন্ধুরা অপমান করত। তারা বলত,চাকরির চেষ্টা কর,তা না হলে পস্তাতে হবে।বন্ধুরা বড় অফিসার হয়েছেন আর আমি এখনও অল্পবেতনে কাজ করি।সময়ের ফাঁকে লিখি। আমার সুখদুখমাখা জীবনের কাহিনী লিখি।আমার অতীত লিখি।আমার জীবন লিখি।আমার কষ্ট লিখি।প্রেম, বিরহ,ঘৃণা সব লিখি।আমার ভুলকরা লিখি।প্রতিবাদ লিখি।এখন আমি যেখানে বাস করি সেখানে আলপথ,কাদা হয় বর্ষায়।বিদ্যুত এসেছে দশবছর আগে।আমি এই এলাকায় প্রথমে একা বাস করতাম। তারপর আরও বাড়ি হল।কাটোয়া কুড়িনম্বর ওয়ার্ডে নন্দনপাড়ার দক্ষিণ দিকে এক আরণ্যক জগতে আমার বাস।বেশ চুপচাপ,নীরব পরিবেশ। তার ফলে লেখালেখির মাধ্যমে অখন্ড অবসর কাটাতাম। লিখলে আমার হৃদয় বেশ আনন্দে থাকে।আলোভরা মনে লিখতে লিখতে হারিয়ে যাই অন্য একজগতে।সেখানে রাগ নেই,বিরহ নেই,হিংসা নেই,ঘৃণা নেই। মনের কথা লিখে হাল্কা হবার চেষ্টা করি।আমার জীবনে অনেক গল্প লুকিয়ে আছে।লেখার আগুন থেকে ফুঁ দিয়ে সরিয়ে দিয়েছি অভিমানের ছাই।লেখার মাধ্যমে, শুরু করতে চেয়েছি জীবনের প্রায় শেষ হওয়া পথ।খুলে গেছে একের পর এক আলোর গলি।লিখতে লিখতে পৌঁছে গেছি জ্যোৎস্নার বাগানে । বুঝেছি শেষ বলে কোন কথা হয় না। বারবার নতুন জামা ওঠে দেহে, ছেঁড়া, রঙচটা দূঃখবিলাস ছেড়ে।
সুখদেবের কথা
সুখদেব বাউড়ি বগলে একটা লাঠি আর হাতে একটা হেঁসো নিয়ে ঘোরে রাতদিন।ধারালো হেঁসো দিয়ে শুকনো ডালপালা কাটতে কাটতে বলে,এই হেঁসো দোব তোর গলায় বসিয়ে যেদিন সেদিন আমার শান্তি হবে।জঙ্গলে তার পাশেই ছিপ হাতে বসেছিল নাড়ু বাউড়ি। সুখদেবের একথা শুনে ভয় পেয়ে বলে ওঠে,কেনে কি করলাম আমি। সুখদেব ওকে দেখেনি এখন তাকে দেখে লাঠি বগলে হেঁসো আর জঙ্গলের শুকনো ডালপালা নিয়ে হনহন করে হাঁটা লাগাল।
সুখদেব এই শুকনো ডালপালা বাড়ির উঠোনে রাখে। তারপর তার ছেলের বউ রান্নাশালে বসে উনুনে গোঁজে শুকনো ডালপালা।
বাউড়ি হল হিন্দু জাতিগোষ্ঠীর মানুষ। এই বাউরীরা ভারতের কোনাে বহিরাগত জাতি নয়। এরা আমাদের দেশের আদিম অধিবাসী। বাঁকুড়া জেলায় বর্তমানে আনুমানিক বাউরী জাতির সংখ্যা প্রায় চার লক্ষের কাছাকাছি। পূর্ব বর্ধমান জেলার নবগ্রাম গ্রাম পঞ্চায়েতে বংশক্রমে বাউরীদের বাস আছে।
গ্রামের প্রধান সাহেব বলেন, সমগ্র জেলাব্যাপী প্রত্যেক থানাতেই এদের বসবাস রয়েছে। তবুও একটা জিনিস বিশেষভাবে লক্ষ্য করবার বিষয় এই যে, পুরুলিয়া জেলার পূর্বাংশ ও বাঁকুড়া জেলার পশ্চিমাংশের যে এলাকাটিকে পশ্চিম রাঢ়ের কেন্দ্রভূমি বলা যেতে পারে, সেই এলাকাতেই বাউরীদের ঘনবসতি গড়ে উঠেছে।
নবগ্রামে বাউড়িদের প্রাধান্য বেশি।প্রধান সাহেব তাদের খোঁজখবর নেন।এবার বন্যায় বাড়ি ভেঙে গেলে সুখদেব পাকা বাড়ি পায়।
সুখদেব নিজের মনে বিড়বিড় করে আর বলে,দোব শালাকে গলায় হেঁসো বসিয়ে।পাশে কেউ থাকলে জিজ্ঞেস করে, কাকে বসাবি রে, সুখদেব?
সুখদেব উত্তর দেয় না। একবার মুখ তুলে তাকিয়ে হাঁটা লাগায়।তার এই পাগলামির জন্য অনেকে তাকে এড়িয়ে চলে।বলা তো যায় না, কখন বেটার বিগার চাপে,একথা বলে তার পাশের বাড়ির মাধু।
সুখদেব বসে থাকার লোক নয়। সারাদিন সে টো টো করে ঘোরে।বাড়িতে সে খালি হাতে ঢোকে না।কখনও গামছায় বাঁধা চুনোমাছ বা কখনও শুকনো ডালপালা নিয়ে ঢোকে বাড়ি।
তার ছেলে আর ছেলের বউ রোজগার করে।সুখদেবের বউটা বড় বন্যায় ভেসে গিয়েছে জলে।এখন ওরা তিনজন।
সুখদেবের মনে পড়ে, সেবার বানে ঘরবাড়ি ভেঙে গেলে বটগাছের ডালে তারা ওঠে সবাই।একই ডালে সবাই থাকায় ডালটা মট করে ভেঙে পড়ে জলে।সুখদেব ছেলেকে বাঁচায় ভীষণ স্রোত থেকে কিন্তু বউটাকে বাঁচাতে পারে নি।সেইথেকে সুখদেবের মাথাটা কেমন পাক খেয়ে শুধু বানের জলের স্রোতের মত ঘুরপাক খায়। কোনকিছু সাজাতে পারে না। ঘুমোবার সময় বলে ওঠে, দোব শালার গলায় পেঁচিয়ে।
আসলে বাড়িভাঙার কারণ অতিরিক্ত ছাড়া জল। পঞ্চায়েতের বড়বাবু বলেন,ম্যানমেড ফ্ল্যাড।বুঝিয়ে বলাতে সুখদেব বুঝতে পারে।সে বড়বাবুকে বলে,লিয়ে আসতে পারেন ওকে আমার সামনে।একটা লাঠির ঘা ওর পিঠে বসালে বউ মরার দুঃখটা কমত একটুখানি।
বড়বাবু বলে,ওসব বলতে নাই সুখদেব। তোমার দুঃখ গ্রামের সবাই বোঝে।
সুখদেব ভাবে,কই বাউড়িদের ছেলেমেয়েগোলা নেকাপড়া শেখে না কেনে।সারাজেবন শালা আমাদের মত হয়ে থাকলে হবে।
মাধু বলে ছেলেমেয়েরা তার কথা শুনে গ্রামের স্কুলে পড়ে।সকলে সুখদেবকে বুঝতে লারে।ওর মনে একটা সোনার পাথর আছে।
মাধুর কথা শুনে বড়বাবু বলে, তুই তো সুখদেবকে বিয়ে করতে পারিস।তু তো বাঁজা বলে শ্বশুরঘর থেকে চলে এলি।এখন ওকে বিয়ে করে সুখে থাক।
মাধুর বলে, এ কথাটা মনে আসে নাই ত লয়,তবে পাগলাটা যদি মারে?
বড়বাবু বলেন,ও মারবে না।মুখে বড়াই করে।
তারপর মাধু ঝাঁট দিয়ে বড়বাবুর ঘর পরিষ্কার করে।বড়বাবু পেছনদিকে জড়িয়ে ধরে আদর করে।তারপর পাঁচশ টাকা গুঁজে দেয় মাধুর গতরে।
সুখদেব বাড়িতে ভাত থেকে মদ তৈরি করে।বাউড়িপাড়ার পাশ দিয়ে গেলে এই পচাভাতের গন্ধ ভুরভুর করে।
মাধু বলে কি করে হয় গো মদ?
সুখদেব বলে,তোর কি দরকার।তবে জানতে যখন চাইছিস,তবে শোন। ভাত পচে গেলে একটি বড় হাঁড়িতে বসিয়ে তা ফের ফোটানো হয় উনুনে। ওই হাঁড়ির উপরে বসানো হয় আরও একটি হাঁড়ি। পচা ভাতের বাষ্প পাইপের মাধ্যমে ফোঁটা ফোঁটা করে জমা হয় জারিকেনে বা বোতলে।
মাধু বলে, এটাই হচ্ছে চোলাই মদ বা ইথাইল অ্যালকোহল।
সুখদেব বলে,তু তো একটু নেকাপড়া জানিস। তুই বলতি পারবি কি এটা।আমি বুঝি না।ভালো লাগে খাই,বউটার মায়া গুলে খাই, ব্যাস।
মদ খেয়ে নেশার চোখে, মাধুকে আড়চোখে দেখে সুখদেব।সে বলে,আমার কাছে চালাকি লয়,দোব শালা গলায় পেঁচিয়ে।
মাধু ধরাপড়ার ভয়ে ঘরে ঢোকে আর ঘরের ফুটো দিয়ে দেখে মাধু, সুখদেব ওর বউকে খোঁজে তার বাড়ির চারপাশে।বড়মায়া হয় মাধুর। আকার ধোঁয়ার মত ভালোবাসটা গভীরে গিয়ে জলে ভেজে। সুখদেবের মনটা কখন যে মাধু ধরে ফেলে, সে জানে না।
বাউড়িপাড়ায় উনুনকে, আকা বলে।ওদের কিছু কিছু ভাষা নিজস্ব।তাদের সমাজে প্রচলিত ভাষা।আর তাদের কথায় কথা বলে আনন্দ পায় মাধুর মত মেয়েরা। বন্যাকে ওরা বান বলে,কেন কে বলে কেনে।
একদিন রাতে মাধু স্নপ্ন দেখে, সুখদেব তার ওপরে চেপে সুখের বানে ভেসে চলেছে দেহবানের জলে।মাধু ধরপর করে উঠে দেখে না স্বপ্ন নয়,তার পাশে সুখদেব হাঁপাইছে।তার ঘরের চাল খড়ের। খড়ের চাল ফুটো করে সুখদেব ঢুকে তাকে সুখের বানে ভাসিয়েছে।মাধু মনের আনন্দে সুখদেবকে জড়িয়ে ধরে। ভোরবেলায় আবার সুখদেব ঘর থেকে বেরিয়ে জঙ্গলে যায়, তালপাতার খোঁজে।সে ভাবে, ঘরের চালটা ফুটো হইছে, তালপাতা দিয়ে বেঁধে দিলেই হবে।তা না হলি বর্ষার জল ঢুকে মাধুকে ভেজাবে।বড়বাবুকে অফিসে যেতে দেখে, বানের জলের মত সাহসে সে বলে ওঠে,দোব শালাকে গলায় পেঁচিয়ে।
বড়বাবু ভয়ে তার দিকে তাকিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বিন্দু হয়ে মিলিয়ে যায়।
সোমার কথা
হাওড়া থেকে কাটোয়া নেমে, বাসে চেপে কাটোয়া- কাটোয়া বাসে চেপে কাশীরামদাসের জন্মস্থান সিঙ্গি যাওয়া যায়।
আমরা দুদিন আগে রোদের ভালবাসার আদর গায়ে মেখে সস্ত্রিক উইকেন্ডসে আমরা এসেছি এখানে ভালোবাসার টানে। বহুবছরের ঋণ মনে হয় জমা হয়ে আছে এই খোলা মাঠের মায়ায়।স্ত্রী বলল, তুমি হানিমুনে এসে কবি হয়ে গেলে। স্ত্রীর নাম সোমা, সে বলল,এটা আমার দূরে যাওয়া না হলেও আফটার অল হানিমুনে আসতে পেরে ভালো লাগছে খুব।
সোমা আমাকে বলল,সিঙ্গি হল বাংলার প্রাচীন গ্রাম। এই গ্রামেরই নদী পুকুর খাল বিল জলাশয় সব আছে। ফসল বিলাসী হওয়ার গন্ধ আছে সিঙ্গীর মাটির উর্বরতায় ফুলে ফলে ফসলের সুন্দর গ্রাম।
বাংলার সব পাখিরা কমবেশি সিঙ্গীর আকাশে বাতাসে ঘুরপাক খায়। তিনি বিখ্যাত করেছেন ইতিহাসে স্থান করে দিয়েছেন।কবি কাশীরাম দাস সংস্কৃত থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন মহাভারতের কাহিনী। এই মহাপুরুষের জন্মভিটার সংস্কার কাজ শুরু হয়েছে। আমরা দিনে তাঁর ভিটাতে দাঁড়িয়ে তাঁকে শ্রদ্ধাসংগীত শোনাতে পারি। তারপর অনেকটা হেঁটে গিয়ে দাসপাড়া পেরিয়ে গিয়ে বটবৃক্ষের তলায় দাঁড়ালাম উদাস হয়ে। এই স্থানের মাটি কপালে বুলিয়ে নিলাম একবার। সবাইকে ক্ষেত্রপালের মন্দির নিয়ে গেল। ক্ষেত্রপাল বটবৃক্ষের নিচে অবস্থিত। তারপরে রাস্তা দিয়ে গিয়ে সোজা শিব মন্দির।
এখন পাকা রাস্তা হয়ে গেছে বুড়ো শিবের মন্দির যেতে। আমি বললাম, ছোটবেলায় আমাদের কোপা গ্রামে মাটির রাস্তা ধরে ধুলোমেখে ঘরে ঢুকতাম। বর্ষাকালে এক হাঁটু কাদা হয়ে যেত। গোরুর গাড়ি ছাড়া কিছুই যান ছিল না। আর ছিল পাল্কি। গ্রামের ছেলেমেয়ের বিয়ে হলেই শুনতাম পাল্কির গান।
সোমা দেখল ও জেনে গেল যে পূর্ব বর্ধমান জেলার সিঙ্গি গ্রামে ধূমধাম করে মশাল জগদ্ধাত্রী ঠাকুরের পুজো হয়। কাশিরামদাসের জন্মস্থান এই সিঙ্গি গ্রামের বাজারে বহু বছর যাবৎ এই পুজো হয়ে আসছে। পাটকাঠির মশাল জ্বালিয়ে এই পুজো মহা সমারোহে পালন করা হয়। কথিত আছে জ্ঞানের আলো এই দেবি জগতে ছড়িয়ে দেন। তাই আলোময় মশাল জ্বালিয়ে দেবির পুজো করা হয়। ভিন্ন মতও অনেক আছে।
তবে মতবাদের ককচকচানির উর্ধ্বে উঠে সকল গ্রামবাসী এক হয়ে আনন্দে মাতোয়ারা হন এই কটা দিন।
পাটকাঠির বোঝা বেঁধে বড় বড় মশাল তৈরি হয়। মশালে আগুন ধরিয়ে ঢাক ঢোলের তালে তালে নাচতে থাকে ভক্তের দল। চারদিকে আলোয় আলোময় হয়ে ওঠে পুজোমন্ডপ। মশাল জ্বালিয়ে গ্রাম ঘোরে প্রতিমাসহ মশালবাহির দল। বড় সুন্দর এই দৃশ্য। সব মানুষ ভেদাভেদ ভুলে মেতে যান এই উৎসবে।
পিউ বলে,আর কোথাও এই পুজো আছে কি না জানা নেই।
কাশীরাম দাসের মহাভারত মূল মহাকাব্যের আক্ষরিক অনুবাদ নয়, ভাবানুবাদ। তিনিও
কৃত্তিবাস ওঝা এবং
মালাধর বসু’র মতো মূল গ্রন্থের কাহিনী বর্জন বা অন্য গ্রন্থ থেকে কাহিনী সংযোজন করেছেন। মহাভারতের ভীষ্ম পর্বের গীতা পর্বাধ্যায়সহ অনেক গুরুগম্ভীর দার্শনিক আলোচনা তিনি বাদ দিয়েছেন। আবার শ্রীবৎস চিন্তা, সুভদ্রা হরণের মতো বাঙালি-মানসের উপযোগী নানা কাহিনী অন্যান্য ধর্মগ্রন্থ থেকে সংযোজন করেছেন। আসলে, মহাভারতের মূলানুগ অনুবাদ নয়, কবির উদ্দেশ্য ছিল মহাভারতের নীতিকথাগুলি বাঙালি সমাজে প্রচার করা। মহাভারতে সংসার জীবন, সত্যপালন, ন্যায়ধর্মাচরণ, বীরত্ব, সতীত্ব, সত্যনিষ্ঠা, ঈশ্বরভক্তি, ধার্মিকতা, উদারতা, আত্মবিসর্জন প্রভৃতি যেসব সদগুণের কথা বলা হয়েছে এবং যা হিন্দুধর্মের মূল ভিত্তি, তা-র প্রচারই মহাভারত অনুবাদের মাধ্যমে করতে চেয়েছিলেন কাশীরাম দাস।
কাশীরাম দাস বর্ধমানের ইন্দ্রাণী পরগণার অন্তর্গত সিঙ্গি গ্রামে এক বৈষ্ণব কায়স্থ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এ গ্রাম এখনও আছে এবং এই গ্রামে কাশিরামের স্মৃতি বিজড়িত স্থানগুলি আজও বর্তমান।তাঁরা দেব উপাধিধারী কায়স্থ।তার পিতার নাম ছিল কমলাকান্ত। কবিরা ছিলেন তিন ভাই—কৃষ্ণরাম, কাশীরাম ও গদাধর।তারা প্রত্যেকেই ছিলেন কবি।অগ্রজ কৃষ্ণদাস শ্রীকৃষ্ণবিজয় এবং শ্রীমদ্ভাগবতপুরাণ অনুসরণে শ্রীকৃষ্ণবিলাস নামে কাব্য লেখেন। অনুজ গদাধর লিখেছিলেন জগন্নাথমঙ্গল বা জগৎমঙ্গল কাব্য। গদাধরের জগৎমঙ্গল কাব্যে এই বর্ণনার অনুরূপ উল্লেখ আছে। কবির অনুজ গদাধরের পুত্রের নাম নন্দরাম দাস। কাশীরাম বেদব্যাস বিরচিত সংস্কৃত মহাকাব্য মহাভারত অবলম্বনে লেখেন ভারত-পাঁচালী।কাশীরাম দাস সংস্কৃত ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন।তিনি অধুনা পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার আবাসগড় বা আসিগড় বা আওসগড়ের জমিদার বাড়ির আশ্রয়ে থেকে শিক্ষকতা করতেন।কথিত আছে, উক্ত জমিদার বাড়িতে কথক ও সংস্কৃত পণ্ডিতদের মুখে মহাভারতের কাহিনী শুনে তিনি বাংলা ভাষায় মহাভারত অনুবাদে উদ্বুদ্ধ হন গবেষকদের অনুমান, ভারত-পাঁচালী রচনা সমাপ্ত হয়েছিল ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে কিংবা সপ্তদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে। তাদের আরও অনুমান, কাশীরাম দাস সম্পূর্ণ মহাভারত অনুবাদ করে যেতে পারেননি। আদি, সভা, বন ও বিরাট – এই চার পর্ব অনুবাদের পর তাঁর মৃত্যু হলে তার জামাই অবশিষ্টাংশ অনুবাদ করেন। অন্যমতে, তার ভাইপো নন্দরাম ও অন্যান্য আত্মীয়রা মিলে অনুবাদকর্ম সমাপ্ত করেন।শান্তিপর্ব কৃষ্ণানন্দ বসু ও স্বর্গারোহণ পর্ব জয়ন্ত দাস লিখেছিলেন।
কাশীরামের নামে আঠারো পর্বে সমাপ্ত বিশাল মহাভারত প্রচলিত আছে। তবে তিনি আদি, সভা, বন ও বিরাট এ চার পর্ব রচনা করে মারা যান; পরে তাঁর পুত্র, ভ্রাতুষ্পুত্র ও অন্যান্য আত্মীয়স্বজন মিলে কাব্যখানি সমাপ্ত করেন। এটি ১৮০১-১৮০৩-এর মধ্যে শ্রীরামপুর মিশন প্রেস থেকে আংশিকভাবে প্রকাশিত হয়। তারপর ১৮৩৬ সালে জয়গোপাল তর্কালঙ্কারের সম্পাদনায় একই প্রেস থেকে সম্পূর্ণ আকারে মুদ্রিত হয়। পরবর্তীকালে আরও অনেকেই কাব্যটি সম্পাদনা করেন।
কাশীরামের পূর্বে ও পরে আরও অনেকে পূর্ণ ও খন্ডিত আকারে মহাভারত রচনা করেছেন; কিন্তু সেগুলির মধ্যে কাশীরামের গ্রন্থই শ্রেষ্ঠ। বেদব্যাসের সংস্কৃত মহাভারত ও অন্য অনেক উৎস থেকে উপাদান নিয়ে কাশীরাম প্রায় স্বাধীনভাবে বাংলা মহাভারত রচনা করেন। বাঙালির কাছে কৃত্তিবাসের রামায়ণ ও কাশীরামের মহাভারত সমান গুরুত্বপূর্ণ। উভয় কাব্য যুগ যুগ ধরে হিন্দুদের ঘরে ঘরে পঠিত হচ্ছে।
বিশুর বন্ধু বাবুলের কথা
বাবুল ছোটো থেকেই একরোখা জেদি ছেলে।কোনো ভয়ডর তার হৃদয়ে নেই।এক ডুবে সাঁতরে পুকুর পার হওয়া,গাছে ওঠা সবেতেই সে সিদ্ধহস্ত। সব বন্ধুরা তার বশ্যতা স্বীকার করে নিত অনায়াসে।তবু দেখতো বাবুল,দু একজন বন্ধু তার পিছনে নিন্দা করছে। একদিন রবি এসে বললো,জানিস বাবুল তোর নামে হিরু খুব খারাপ কথা বলে। বাবুল বললো,তোকে বিশ্বাস করে হিরু যা বলার বলেছে। তুই আবার কেন সেই কথাগুলো প্রকাশ করছিস।রবি লজ্জিত হলো, বললো,আর কখনও এরকম ভুল হবে না। তোর কাছে মস্ত শিক্ষা পেলুম।
বাবুল বাড়িতে দেখেছে, তার বাবার দাপট। বাড়িতে একটু দেরি করে ঢুকলেই তার কৈফিয়ৎ দিতে হতো হাজারটা। বাবার দুবেলা তিন ঘন্টা করে মোট ছ ঘন্টা আহ্নিকের সময় সবাইকে চুপ করে থাকতে হতো।কথা না বলে ধীরে সব কাজ সারতে হত মাকে। বাবুল পড়তে বসে হারিয়ে যেত বইয়ের ছবিতে। ওর চোখে ভেসে উঠত আমেরিকার ঝলমলে শরীর,টরেন্টোর বিলাস বহুল শহুরে আদব কায়দা। মাঝে মাঝে সে ঘুমের ঘোরে বলে উঠত, আমি যাবো, আমি যাবো, আমেরিকা,টরেন্টো। তার মা ডেকে বলতেন,কি সব বলছিস তুই। কোথায় যাবি?আমাদের ছেড়ে কোথায় যাবি তুই।
তারপর সুখে,দুখে,শোকে কেটে গেছে অনেকটা সময়। বাবুল হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষায় স্টার মার্কস পেয়ে পাশ করেছে। সবাই খুব আনন্দিত। কিন্তু বাবুলের মনে অন্য চিন্তা। সে একদিন রাতে মায়ের আলমারি খুলে সব গহনা হাতিয়ে নিলো। তারপর রাতের অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো বাবুল। তার মা সকালে উঠে দেখলেন,আলমারি হাট করে খোলা। কোথাও কিছু নেই। সোনাদানা, টাকা পয়সার থেকেও দামি তার সোনার ছেলে বাবুলও কোথায় যেনো হারিয়ে গেলো। বাবুলের মা, বাবা পরামর্শ করলেন, চুরি যাওয়ার ঘটনা চেপে যেতে হবে।
তারা একটা চিঠি পেলেন টেবিলের উপর। তাতে লেখা,
মা ও বাবা,তোমরা আমাকে ভুল বুঝো না। আমি পড়াশোনার জন্য বিদেশ চললাম। বাবা যেতে দেবেন না বলে আমি নিজেই ম্লেচ্ছ হতে যাচ্ছি। তোমাদের নেওয়া জিনিসের আমি সদ্ব্যবহার করবো। তোমরা আমার জন্য দুঃখ কোরো না। ভালো থেকো।
ইতি —তোমাদের বাবলু।
তারপর সময়ের স্রোতে কেটে গেলো অনেকগুলো বছর। কিন্তু বাবলুর কোনো খবর পাওয়া গেলো না।
এদিকে বাবলু সোনাদানা,টাকা পয়সা নিয়ে চলে এলো কলকাতায়। সেখানে সোনাদানাগুলো সোনাপট্টিতে বিক্রি করলো। তারপর একটা ঘর ভাড়া করলো। তার সঙ্গে পার্ক স্ট্রীটের এক ইংরেজ মহিলার সঙ্গে পরিচয় হলো। পড়াশোনার জন্য সে বিদেশ যেতে চায় শুনে মহিলাটি তাকে সব রকমের সাহায্য করলেন। বাবলু সময় ঠিক করে একদিন সুইজারল্যান্ডে পাড়ি দিলো। সেদিন তার খুব আনন্দের দিন। জাহাজে তার সঙ্গে পরিচয় হলো এক ভদ্রলোকের। তিনি ব্যবসার উদ্দেশ্যে মাঝে মাঝেই কলকাতা আসেন। বাবলু বললো,আপনি আমাকে একটা কাজ দেবেন। আপনার কাজ করে দেবো। ভদ্রলোক বললেন, সুইজারল্যান্ডে তার হোটেল আছে। সেখানে তাকে একটা কাজ নিশ্চয় দেওয়া হবে।
বাবলু ভাবতে পারে নি, এত সহজে সব কাজ হয়ে যাবে। জাহাজের বাইরে পাটাতনে বসে বাবলু সমুদ্র দেখছে।এক নীল অসীম সমুদ্রের হাতছানিতে তার হৃদয় দুলে দুলে ওঠে। বাঙালী ঘরের ছেলে হলেও অন্তর তার শক্ত। এখন তার আর মায়ের মমতা কিংবা বাবার শাসন কিছুই মনে পড়ছে না। এগিয়ে যাওয়ার এক নেশায় সে মশগুল।
জাহাজ নোঙর বাঁধলো। চলে এলো অন্যদেশে,অচিনপাড়ে। জাহাজের সেই ব্যবসায়ী ভদ্রলোক বাবলুকে নিয়ে চলে এলেন নিজের বাসভূমিতে।বাবলু কাজের ছেলে।নিজের ঘরটা বুঝে নিয়ে মালপত্তর দু চারটে যা ছিলো গুছিয়ে রাখলো।প্যান্টের পকেটে টাকাগুলো রাখলো। এখন টাকাই বল, ভরসা। এখানে তো আর টাকা চলবে না। ভদ্রলোক বললেন, ব্যাংকে গিয়ে এক্সচেঞ্জ করিয়ে নেবেন। খাওয়াদাওয়ার পরে একঘুমে সকাল। তারপর কাজ আর কাজ।
এই কাজের দেশে এসে বাবলু বুঝে গেছে কাজ করতে পারলে সুইজারল্যান্ডে খাওয়ার অভাব হয় না। ব্যবসায়ী ভদ্রলোকের কাছে জেনেছে সে,কেউ কারও দাসত্ব করে না এদেশে। খাটো খাও মৌজ করো। রাতে কলেজে পড়াশোনা করে বাবলু। পড়াশোনার জন্যই এখানে আসা তার, সেকথা সে ভোলে নি।
আজ পাঁচ বছর কেটে গেলো বাবলুর স্বপ্নের মত। একটা ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রী সে হাসিল করেছে এতদিনে। আর তাকে বেশি পরিশ্রম করতে হয় না। একটা বড় কম্পানী তাকে চাকরী দিয়েছে। ফ্ল্যাট দিয়েছে। মাইনে অনেক টাকা। আর তার কোনো চিন্তাই নেই। এক বড়লোক মহিলাকে সে বিবাহ করেছে নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য।বিশাল সম্পত্তির মালকিন সেই মহিলা। একদিন গাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার সময় মহিলার আ্যক্সিডেন্ট হয়। একদম স্পট ডেথ।তখন বাবলু অফিসে ছিলো। এসেই দেখলো চারদিকে পুলিশের ভিড়। বাবলুর চোখে জল রক্ত দেখে।বড় ভালোবাসতো মহিলাটি তাকে। তার স্ত্রী আজ আর নেই। হিসেবমত বডি সৎকারের কাজকর্ম মিটে গেলে সম্পত্তির একমাত্র মালিক হলো বাবলু।
বাবলু লোভি নয়। সে এখন ভালোই রোজগার করে। তবে হাতের সম্পত্তি তো আর ফেলে দেওয়া যায় না। বাবলুর অই বাড়িতে আর ভালো লাগতো না। একটা কান্না ঘুরে বেড়াতো বাড়িটা জুড়ে। তাই সে বাড়িটা বিক্রি করে দিলো।গাড়িটাও বিক্রি করে দিলো। সব টাকা ব্যাঙ্কে গচ্ছিত করে রেখে দিলো। তারপর একটা কম বয়সী মেয়ে দেখে আবার বিয়ে করলো। বছর দুই পরে ফুটফুটে একটি মেয়ে হোলো।
দেখতে দেখতে মেয়ে দশ বছরের হয়ে গেলো।বাবলুর এবার একবার দেশের বাড়ি যাবার ইচ্ছে হলো। সবাইকে নিয়ে চলে এলো নিজের দেশ ভারতবর্ষে। দেশের মাটিতে পা দিয়েই বাবলু একমুঠো ধুলো গায়ে হাতে পায়ে মেখে নিলো। বললো,আঃ কি সুন্দর গন্ধ।পৃথিবীর কোনো পারফিউম এর থেকে সুন্দর নয়। বাবলুর দেখাদেখি মেমসাহেব আর মেয়ে ধুলো নিয়ে গন্ধ শুঁকলো।কিন্তু তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া হোলো না। হবে কি করে? তারা তো আর এই মাটির গর্ভে মানুষ হয় নি। তারপর কোলকাতা থেকে সোজা মায়ের কাছে চলে এলো বাবলু।
বাবলুকে দেখে মা কেঁদেই আকুল। মা বললেন,তোর বাবা মারা গেছেন অনেক আগেই। আমি তোকে একবার শেষ দেখা দেখবো বলে বেঁচে আছি। বাবলু বললো,এই নাও মা তোমার সব গহনা,টাকা, পয়সা সব। আমাকে ক্ষমা করে দিও মা। মা বললেন,তুই মানুষের মত মানুষ হয়েছিস। আমার আর কোনো দুঃখ নেই। তুই আমাকে কলকাতার বাড়িতে তোর ভাইয়ের কাছে রেখে যা। আর এই বাড়ি গ্রামের স্কুল গড়ার কাজে দান করে দে। তোর বাবার নামে এই স্কুলের নাম হবে, মহেন্দ্র বিদ্যাপীঠ। বাবলু বললো,তাই হবে মা। তোমার কথার অন্যথা হবে না। তারপর সেই বাড়ি আজ বিরাট বিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছে।
প্রায় ছমাস ভারতে কাটিয়ে আবার ফিরে এলো সুইজারল্যান্ডে।বৃষ্টিভেজা এই দেশে সবুজের সমারোহ।টইটম্বুর জলাধার মনে দাগ কাটে।শীতের মরশুমে জানালার কাঁচে রেখে যায় বরফের ছাপ।এদেশের বেশির ভাগ বাড়ির চাল ঢালু। বৃষ্টি বা বরফ গড়িয়ে পড়ে।কিছু ঐতিহাসিক স্থান দেখে মন জুড়িয়ে যায়। এদেশে থাকতে থাকতে বাবলুর কেমন একটা ভালোবাসা জন্মে গেছে মনে।
বাবলু সেদিন অফিসে গেছে। রাতে ফিরে এলে তার সুখের সংসারে আগুন লাগলো।বাবলু দেখলো তার স্ত্রী ও মেয়ে একসাথে এক অপরূপ সুন্দর যুবকের সাথে যৌনক্রিড়ায় মত্ত। বাবলুর মেয়ে কুড়ি বছরের। বৌ এর বয়স বিয়াল্লিশ। আর বাবলুর বয়স আটান্ন।বাবলু ভারতবর্ষের ছেলে। সেখানকার সভ্যতা তার মনে প্রাণে। এই দৃশ্য দেখার পরে সে আর বাড়ি ঢোকে নি। অন্য এক বাড়ি ভাড়া করে ছিলো কয়েকবছর। তারপর ডিভোর্স দিয়ে ছাড়াছাড়ি করে নেয় তাদের সম্পর্ক। মেয়ে থেকে যায় মায়ের কাছে। বাবলুর আর কোনো বাধা নেই। এবার সে ভারতবর্ষে বাকি জীবনটা কাটাবে শান্তিতে।ভারতবর্ষের মাটির গন্ধ সে ভুলতে পারে নি।ফোর জি বা ফাইভ জির সুবিধা, আরাম তাকে দেশের মাটির গন্ধ ভোলাতে পারে নি।
চলে এলো বর্ধমানের গাংপুরে। তার মা, বাবা কেউ আর বেঁচে নেই। ভাইরা নিজের নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত। বাবলু দশটা কাজের ছেলে রাখলো আর পাঁচটা কাজের মেয়ে। প্রায় কুড়ি বিঘে জমির উপর পুকুর,বাড়ি,বাগান। এসব দেখাশোনার জন্যই সে এত লোক রাখলো।আর নিজে অবসর কাটানোর জন্য প্রচুর পড়াশুনা করে। বিগত জীবনের কোনো মায়া তাকে আটকে রাখতে পারে না। বাবলু এখন দেখতে পায় আলোর ফুলকি। ফুলকিগুলো লাল,সবুজ,নীল হরেক রঙের আলো ছড়িয়ে নিরাকার এক মূর্তি মনে তৈরি করে। বাবলু এখন তার সাধনায় পরশ পাথরের খোঁজ করে। একদিন হয়ত তার সন্ধান পাবে…