ফটিকচাঁদ

অনুশ্রী তরফদার
ছোটগল্প
Bengali
ফটিকচাঁদ

এগারোটার মধ্যে নিজের বাড়িতে ঢুকে ফটিক হাসপাতালের কাপড়-চোপড় একটা বড় প্লাস্টিকব্যাগে ভরে মুখ বেঁধে বের করে রাখে উঠোনের এক পাশে। ভালো করে স্নান সেরে আলমারি থেকে কাচা পাজামা ফতুয়া পরে বিছানায় বসে। এই কদিনের ছবি যেন দুঃস্বপ্নের মতো ভাসতে থাকে চোখের সামনে।
খানিকবাদে কলিংবেলের শব্দে ঘোর কাটে। দরজা খুলতেই হোম ডেলিভারির ছেলেটা প্যাকেট নিয়ে দাঁড়িয়ে। দাদা নিন আপনার খাবার, শরীর ঠিক আছে তো! শুনলাম আপনি ভর্তি ছিলেন মেডিকেলে। ফটিক আস্তে আস্তে বলে ভালো আছি, তুই কোথায় শুনলি আমার কথা? ছেলেটি বলে ওই যে বুবাইদা ভজনদা ওরা বলেছে আপনার শরীর কতটা খারাপ হয়েছিল, আচ্ছা দাদা আসি এখন। অনেক বাড়িতে খাবার পৌঁছাতে হবে। ফটিক দরজা বন্ধ করে রান্নাঘর থেকে একটা থালা ধুয়ে টেবিলে বসে। হোম ডেলিভারি থেকে আসা গরম গরম মুসুর ডাল, পেঁয়াজকলি ভাজা, ফুলকপির তরকারি ও পাবদা মাছের আলু বেগুন বড়ি ও ধনেপাতা সহ পাতলা ঝোল দিয়ে পরম তৃপ্তিতে দুপুরের খাবারটা খায়। খাওয়া শেষে এঁটোকাটা গুছিয়ে মুখ ধুয়ে শোবার ঘরে যায় একটু ঘুমাতে হবে।
কি শান্তি! মন থেকে শরীর এত শান্তি যে শেষ কবে অনুভব করেছিল তা ফটিকদা মনে করতে পারছিলনা। হয়তো মা বেঁচে থাকতে এমন শান্তির দিন ছিল। আজ প্রায় এগারো দিন পরে নিজের বাড়ি নিজের ঘর নিজের বিছানায় গা এলিয়ে দিল ফটিকদা। একটু পরে দুটো ওষুধ খেয়ে মোবাইলটা হাতে নিয়ে নেট অন করল। পনেরো দিন হলো সামাজিক গণমাধ্যমে সে অসামাজিক ছিল। আজ একটু সামাজিক হতেই হবে নিজের বর্তমান অবস্থার একটা স্ট্যাটাস দিতে। ফেসবুকে গিয়ে স্ট্যাটাস লেখে-
“সাম্যবাদী অনু দেখালো রঙ্গ
আপন পরের বাস্তবের অঙ্গ”

বাবা মারা গেছেন বছর দশেক আগে তারপর পাঁচ বছর মাকে নিয়ে ফটিকদার সংসার। মা ও ছেলে একে অপরের সুখ-দুঃখের সঙ্গী হয়ে কাটিয়ে দিচ্ছিল বেশ। এরপর মাও চলে গেলেন, তাও প্রায় তিন বছর হলো। এই তিন বছর গোটা বাড়িতে মানুষ বলতে ফটিকদা একা, কাছাকাছি কিছু আত্মীয়স্বজন থাকলেও কদিন আর কার বাড়ি যাওয়া যায় বা কে এসে সঙ্গ দেয়! বর্তমান ব্যস্ত জীবনে প্রত্যেকেই সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটছে জীবন ও জীবিকার তাগিদে। এমতাবস্থায় পাড়ার ক্লাবে কিছু সময় আড্ডা বাড়তি পাওনা ও সামাজিক গণমাধ্যমে ঘোরাফেরা নিত‍্যদিনের রুটিন।

একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করলেও খুব একটা কম মাইনে পায়না ফটিক বিশ্বাস। তিন-চারজনের সংসার ডাল ভাত খেয়ে হেসে খেলে চলে যেতে পারে। কিন্তু কে শোনে কার কথা! বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজন অনেকেই ফটিকদাকে এক থেকে দুই হতে বলেছিল। কত অরুনা, বরুনা, করুনাইতো আসতে চেয়েছিল এমন নির্ঝঞ্জাট সংসারে। যেখানে শ্বশুর শাশুড়ি নেই, একটা দেওর ননদ নেই এমন বাড়ি আর কয়টা পাওয়া যায়! অনেক সম্বন্ধ এসেছিল ভালো ভালো পরিবার থেকে। কিন্তু পিতামহ ভীষ্মের ছোট সংস্করণ ফটিক বিশ্বাস কাউকে বিশ্বাস করে নিজের জীবনে আসতে অনুমতি দেয়নি। বললেই বলত, এই বেশ ভালো আছি, কোন ঝামেলা ঝঞ্ঝাট নেই নিজের মতো খাচ্ছি দাচ্ছি, রাখছি ফেলছি যা পারছি তাই করছি। অফিস, রান্না, ধোয়াকাচা সব একাই করে ফটিকদা। কোনোদিন যদি খুব অসুবিধা হয় তাহলে আছেই হোম ডেলিভারি “হাতা খুন্তি”। অর্ডার দিলে লোভনীয় সব পদ দরজায় এসে উঁকি দেয়। এইভাবেই চলছিল ফটিকচাঁদ অর্থাৎ আমাদের ফটিকদার জীবনযাপন। তবে সব “রুনাকে” অবলীলায় দূরে রাখলেও এই “রোনা”কে সযত্নে বরণ করে নিয়েছিল ফটিকদা দিন পনেরো আগে।

শ্যামনগরে ফটিকের মাসতুতো দাদার মেয়ের বিয়ের চিঠি আসতেই আনন্দে লাফিয়ে উঠেছিল ফটিকদা। বহুদিন পরে সব তুতোভাই বোনেরা এক জায়গায় হবে আনন্দ আহ্লাদ, মজা, খাওয়া-দাওয়া উফফফফ! কত কি হুল্লোড়ই না হবে। দাদার বড় মেয়ের বিয়েতে ফটিক যেতে পারেনি অফিসে ছুটি পায়নি বলে। এবার তাই আগে থেকেই ছুটির দরখাস্ত করে সাত দিনের ছুটি মঞ্জুর করেছে সে। শিলিগুড়ির সব ভাইবোনদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করতে শুরু করে দিয়েছে, কে কে যাবে! সবাই প্রায় এককথায় না করে দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে কেউ ট্রেনযাত্রা বা ভীড়ভাড়ে যেতে চাইছেনা। অনেকে আবার শ্যামনগরের দাদাকে ফোন করে বলেছে বিয়েটা কয়েক মাস পিছিয়ে দিতে। ফটিকদা কিন্তু আশায় বুক বেঁধেছে এবার সে যাবেই। তবুও সবার অরাজি মনোভাব শোনার পরেও কিন্তু কিন্তু করে শ্যামনগরের মাসতুতো দাদা অকৃপণ বলকে ফোন করে বসে। ফোনের ওপারে দাদার গলায় চরম উচ্ছ্বাস হ্যাঁরে ফটিক,
বল কি হয়েছে?
বিয়েতে আসছিস তো?
ফোন করলি যে হঠাৎ?
ফটিকের কোনো কথা বলার সুযোগই আসছেনা, অকৃপণ বল সমানে ব‍্যাটে বল পেটাচ্ছে, যেন এমসিকিউ লেবেলের ভাইভা টেস্ট নিচ্ছে ফটিকের। উত্তর দিতে দিতে পাঁচ মিনিট পর ফটিকের সুযোগ আসে কথা বলার। সে বলে, হ্যাঁ গো মেজদা মুন্নির বিয়েটা কি পিছিয়ে দিয়েছ? না না বিয়ে পিছাবো কেন রে, ওই তারিখেই বিয়ে হচ্ছে। তোকে কে বললো যে বিয়ে পিছিয়ে দিয়েছি? ফটিক আমতা আমতা করে বলে- আসলে স্বপন, তপন, উজ্জল, অতসীরা তো বলছে এই সময় ওরা যাবেনা। দুই তিন মাস পরে হলে সবাই যাওয়ার চেষ্টা করবে, তাই ভাবলাম! অহ্ এই ব্যাপার! অকৃপণ বল ওপাশ থেকে উত্তর দেয়।

অকৃপণ নামটা তাঁর বাবার জ্যাঠামশাইয়ের দেয়া, কে জানত এমন উদার খরচাবহুল পরিবারের অকৃপণ মনোভাব থেকে সরে গিয়ে এই ছেলে বিপরীত স্বভাবের হবে। কৃপণ বললেও কম বলা হয়। অকৃপণ এই সুবর্ণ সুযোগ কিছুতেই হাতছাড়া করবেনা যে এটা আগেই বোঝা উচিত ছিল ফটিকের। যত কম খরচা করে মেয়ের বিয়ে পার করতে পারে সেই ব্যাপারে বিন্দুমাত্র কৃপণ হবেনা অকৃপণ বল। সরকারি বিধি নিষেধ মেনে লোকজন সব মিলিয়ে একশোর মধ্যে রাখতে হবে। ছেলের বাড়ি থেকে এই জনা পঁচিশ, নিজেদের বাড়ি, আত্মীয়-স্বজন, জনা দশেক প্রতিবেশী ও ঠাকুর চাকর মিলিয়ে একশ থেকে চার-পাঁচজন বেশি হলেও হতে পারে। বাইরে থেকে যত না আসে ততই ভালো। নেহাত নিমন্ত্রন না করলেই নয় তাই সবাইকে একখানা করে চিঠি পাঠিয়েছে। একে তো শীতকাল তার উপরে এতো লোকজন, অকৃপণ মনে মনে ভাবছে ভালোই হয়েছে কিছুটা তো বাঁচবে। হোটেল বুক করতে হবেনা, চারবেলার খাবার, চা, শীতের বিছানার ভাড়া সব থেকে রেহাই পাওয়া গেল। প্রায় লাখখানেক বেঁচে যাবে, তাই মহানন্দে অকৃপণ বল মেয়ের বিয়ে এখনই দিতে চাইছে, দিচ্ছেও তাই।
ফটিকের সেই মেজদা বলল শোন ফটিক, কে আসবে কে আসবেনা তা নিয়ে আমার কোন মাথাব্যথা নেই। তোরও চিন্তা করতে হবেনা, তুই আসতে চাইলে চলে আয়। ফোনে মেজদার গ্রিন সিগন্যাল পেয়ে ব্যাগ গুছিয়ে তিস্তা-তোর্সার টিকিট কেটে নিয়ে আসলো। বাড়ি পাহারার জন্য ক্লাবের ছেলে ভজনকে বলল যাওয়া-আসা মিলে সাত দিন, একটু দেখে রাখিস ভাই। ভজন বলল ওসব নিয়ে কিছু ভেবোনা ফটিকদা, আমরা আছি, পালা করে থাকব। নিশ্চিন্ত হয়ে ফটিকদা শ‍্যামনগরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করল। বিয়ের আগের দিন সকালে ফটিকদা পৌঁছে গেল শ্যামনগরে অকৃপণদার বাড়িতে। অকৃপণদার মা মানে ফটিকের মেজোমাসী ফটিকের মায়ের বড়ো দিদি। দিব‍্যি সুস্থ শরীরে বেঁচে আছেন, বিয়েবাড়ির তদারকি করছেন। ফটিককে দেখেই আনন্দে আত্মহারা। কাছে ডেকে সব খবরাখবর নিচ্ছেন আর মাঝেমধ‍্যে তাঁর বোন অর্থাৎ ফটিকের মায়ের অসময়ে চলে যাওয়া নিয়ে কাঁদছেন। বারবার বলছেন কল্পনা আমাদের সবার ছোটবোন, অথচ সেই সবার আগে চলে গেল। প্রথম পর্ব এইভাবেই মিটলে ফটিক স্নান-টান সেরে ফ্রেশ হয়ে নিল। তার থাকার ব‍্যবস্থা হয়েছে উপরের একটা ঘরে আরও দুজনের সাথে। একটা বড়ো খাট ও একটা ছোট চৌকি রাখা সেখানে। ফটিক একা শোবে বলে চৌকিতেই তার জিনিস রেখে দখল নিয়ে রাখল। সারাদিন মেজদার সাথে বাজারঘাট এদিক ওদিক দৌড়ে বেড়ালো। বহুদিন পরে এমন কাজের মধ‍্যে থাকতে পেরে বেশ কেজো মনে হচ্ছিল নিজেকে। অকৃপণ নামের বৈপরীত্য হাওয়া ফটিককে বেশ মজা দিচ্ছিল। কোনখানে কত সস্তায় কোন জিনিসটা পাওয়া যায়, কিভাবে দামদর করতে হয় এইসব দেখছিল ফটিক। যাইহোক সাজো বিয়ে, তারপর বাসি বিয়ে বৌভাতের পর্ব শেষ হলো। এবার ফেরার পালা। মেজমাসী আবার সেই কান্নাকাটি শুরু করলেন, ফটিককে বোঝালেন- “দেখ বাবা এখনো সময় আছে, এবার নিজেকে একটু সংসারী কর। ভাইপো-ভাইঝিদের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে তুই কতদিন আইবুড়ো থাকবি? এই সংসারে পাশে থাকার জন‍্য একটা সঙ্গী প্রয়োজন। আমার কথাটা একটু ভেবে দেখিস”।
মাসীকে প্রনাম করে ফটিক বলল মাসীমা এই ঠিক আছি। মাসীর কান্নাকাটি ফটিককেও ইমোশনাল করে দিল।
সাত দিনের মাথায় ব্যাক টু পাভিলিয়ন।

যেদিন কলকাতা থেকে ফটিকদা এসে পৌঁছালো রাতের দিকে তার শরীরটা বেশ খারাপ লাগতে শুরু করে। গলাটা কেমন ছ‍্যানছ‍্যান করছে নাকের ভেতরে জ্বলছে ও হালকা চিনচিন করে ব‍্যাথা করছে, মাথা ও সারা শরীরে ব্যথায় যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে। কপালে হাত দিয়ে দেখে বেশ গরম, ওষুধের বাক্স থেকে থার্মোমিটারটা নিয়ে বগলে চেপে আড়াই মিনিট পরে দেখে একশ দুই টেম্পারেচার। সঙ্গে সঙ্গে ওষুধের বাক্স থেকে একটা প্যারাসিটামল৬৫০ খেয়ে নেয়, তিন চার ঘন্টা পরে ব্যথা হালকা কম মনে হলেও জ্বর একই জায়গায়, সাথে কাশি ও নাক দিয়ে জল পড়া শুরু হয়ে গেছে। ফটিকদা ভাবে আসার সময় ট্রেনে ঠান্ডা লেগেছে, আর বিয়ে বাড়িতে একটু অনিয়ম হয়েছে তার থেকেই শরীরটা খারাপ করল বোধহয়। পরের দিনও একই রকম একটুও কমছে না, শেষমেষ ফটিক দা ৬ঘন্টা পর পর প্যারাসিটামল৬৫০ খেয়ে চলেছে। কিন্তু জ্বর একটু কমলেও ব্যথা কমছেনা সাথে প্রচন্ড কাশি। তিনদিন দেখার পর পাড়ার ওষুধের দোকানে গিয়ে বলে হ্যাঁ রে সুবল আমার হঠাৎ এমন জ্বর সর্দি-কাশি হল সাথে সারা শরীরের ব্যথা পরশু রাত থেকে এখন অব্দি প্রায় সাতটা প্যারাসিটামল৬৫০ খেলাম শরীরটা ঠিক হচ্ছেনা। সুবল বলে ফটিকদা তুমি তো বিয়েতে শ্যামনগর গিয়েছিলে তাইনা! ফটিকদা বলল হ্যাঁ তাতে কি? প্লিজ তুমি একটু দূরে দাঁড়াও সামনে এসোনা। আমি কিছু ওষুধ দিয়ে দিচ্ছি এগুলো নিয়ম করে খাও আর আজই টেস্ট করিয়ে নাও, ফেলে রেখোনা কিন্তু। ফটিকদা বলে আরে ওসব কিছু হয়নি, তুই খামোখা টেস্ট করতে বলিসনা ওষুধ যা দিবি দে।

সুবল দু’রকম ভিটামিন, আ‍্যন্টিবায়োটিক, আ‍্যন্টিএলার্জিক ও কফসিরাপ দেয়। খাওয়ার নিয়ম খামের মধ্যে ওষুধ ভরে লিখে দেয়। ফটিকদা ওষুধ নিয়ে বাড়ি চলে আসে, শরীরে রান্না করার শক্তি নেই। হোম ডেলিভারিতে ফোন করে বলে দেয় খাবার দেওয়ার জন্য। এইভাবে দুদিন কেটে যায়, ফটিকদার শরীর খারাপ হতে থাকে সাথে পেটের সমস্যা, বমি, মাথাঘোরা, বাথরুম যাওয়ার শক্তি পর্যন্ত শরীরে অবশিষ্ট নেই। এইসময় বড় অভাব অনুভব করে একটা কাছের মানুষের, এমন কেউ নেই যে এক গ্লাস জল মুখের কাছে এগিয়ে দেয়। কোনরকমে দেয়াল ধরে ধরে বাথরুমে যেতে গিয়ে মাথা ঘুরে পড়ে যায় ফটিকদা। হাত পা কাঁপছে, বুকের মধ্যে ধরফর করছে, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে ঘরে এসে কোনরকমে মোবাইল হাতে নিয়ে ভজনের নম্বর ডায়াল করে। ভজন হ্যালো বলতেই ফটিকদা বলে এম্বুলেন্স নিয়ে আয়। কষ্ট করে দুলতে দুলতে গিয়ে দরজার ছিটকিনিটা কোনমতে খুলে বিছানায় এসে বসে।

ফটিক দা সাদা ধবধবে বিছানায় শুয়ে আছে হাতে স্যালাইন মুখে অক্সিজেন ঘরটাও একটু অন্যরকম মনে হয়। চারপাশে তারই মত অনেক সহযোদ্ধারা একইভাবে বিছানায় শুয়ে আছে। জ্ঞান ফিরতেই চারপাশে ভালো করে তাকিয়ে দেখে সে তো বাড়িতে নেই, তারপর বুঝতে পারে উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজের কোভিড কেয়ার ইউনিটে ১২নম্বর বেডে শুয়ে আছে। উঠে বসতে চায় ফটিকদা, নার্স এসে বলে করছেন কি! একদম উঠবেননা বিছানা থেকে। আপনার শরীর ভীষণ খারাপ শেষে পড়ে গিয়ে বড়োসড়ো বিপদ হতে পারে। ফটিকদা ফ্যাকাশে মুখে শান্ত চাহুনিতে চারিদিকে দেখে ও মাথাটা বালিশে রেখে চোখ বন্ধ করে।
এভাবেই একে একে এগারোটা দিন কেটে যায়। ইঞ্জেকশন, ওষুধ, অক্সিজেন, টেস্ট সব যেন হেলথ্ স্টেডিয়ামের ট্র‍্যাকে ন্যাশনাল গেমসের রিলের ইভেন্টের মত চলছে। আজ বিকেলে রিপোর্টে বোঝা যাবে কবে বাড়ি যাবে ফটিকদা। এরমধ্যে ক্রিটিকাল থেকে জেনারেল ওয়ার্ডে শিফট করেছে ফটিকদাকে। এখন সে ভালো করে হাঁটাচলা করতে পারছে খেতে পারছে ও নিজের কাজ নিজে করে নিতে পারছে তেমন কোনো শারীরিক সমস্যা নেই। শুধু মাঝে মাঝে একটু দুর্বল লাগে, ডাক্তারবাবু বলেছেন ঠিক করে খাওয়া-দাওয়া করলেই দ্রুত স্বাভাবিক হতে পারবেন আপনি। কিন্তু সেই যত্নটা করবে কে? নিজেই তো নিজেকে এমন ভীষ্ম বানিয়ে রেখেছে। সেসব চিন্তা করেই ফটিকদা মনে মনে অস্থির হয়ে পড়ছে। মেডিকেল কলেজে এমনি সব ঠিকই ছিল আর কটা দিন থাকলে ভালোই হতো, কিন্তু সে তো হবার নয়। প্রথমতঃ বাথরুম, নরক দর্শন বলে যদি কিছু থাকে তা ফটিকদা এই এগারোদিনে হাড়েহাড়ে টের পেয়েছে, দ্বিতীয়তঃ রিপোর্ট নেগেটিভ আসলে হাসপাতালের বেড দখল করে রাখার কোনো নিয়ম নেই। বিকেলে রিপোর্ট রেখে গেল সিস্টার, ফটিকদা জিজ্ঞেস করলো- ম্যাডাম কি হলো এবার ইতি না নেতি? সিস্টার বলল কাল আপনার ছুটি, বাড়ির লোককে ফোন করুন আগামী কাল দশটার মধ্যে রিলিজ দিয়ে দেব।

কাকে ফোন করবে ফটিকদা, কে আছে তার বাড়ির লোক! আত্মীয়-স্বজনরা খবর পেলেও কেউ একটিবার ফোন করে বা মেডিকেল কলেজে এসে খোঁজ নেয়নি ফটিক মরে গেছে না বেঁচে আছে। তবে ক্লাবের ওই বাচ্চা ছেলেগুলো যারা সারাদিন এই দুর্যোগেও মানুষের পাশে থাকছে দৌড়াচ্ছে সেই ভজন, মিন্টু, বুবাই প্রতিদিন কেউনা কেউ এসেছে। বাইরে থেকে খোঁজ নিয়েছে, ফল জুস তাদের সাধ্যমতো সব দিয়ে গেছে।

যতক্ষণ জ্ঞান ছিল সেদিন সে শুধু ভজনকে একটা ফোন করতে পেরেছিল এটুকুই তার মনে আছে। তারমানে ভজন ও ক্লাবের ছেলেরাই তাকে উদ্ধার করে সময়মতো ভর্তি করে দিয়েছে নইলে এ যাত্রায় ফটিকচাঁদ চেন লাগানো প্লাস্টিকের প্যাকেটে মুড়ে সাহু নদীর পাড়ে গণচিতায় সামিল হতো। ছেলেগুলো এই দু’বছর ধরে ক্লাবে আড্ডা কম মেরে দিন দুপুর রাত মানুষের জন্য অতন্দ্র সেনানী হয় কাজ করে চলেছে। ফটিকদা মনে মনে বলে এরাই তো আমার নিজের লোক, এদেরকেই খবর দেব। ফোনটা নিয়ে ডায়াল করে আবার সেই ভজনকে, হ্যাঁ বল কেমন আছো ওপাশ থেকে বছর তেইশের প্রাণবন্ত ছেলেটার গলা। ফিজিক্স নিয়ে এমএসসি করছে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, ভীষণ ভালো ও পরোপকারী একটা ছেলে। ওর বন্ধুরাও খুব ভালো। নিজেদের মধ‍্যে দু-চারটা গালিগালাজ করে কথা বললেও মনটা সোনার মতো খাঁটি। ফটিক বলে ভজন আমার রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছে কাল ছুটি দেবে আমাকে তোরা নিতে আসবিনা! আরে দারুন খবর তো, আমি আর বুবাই সকাল দশটার মধ্যে পৌঁছে যাব, তুমি চিন্তা করো না দাদা এই বলে ফোনটা রেখে দেয় ভজন।

সম্পূর্ণ বাড়ি স্যানিটাইজড্ করে অতি প্রয়োজনীয় কিছু খাবার দাবার টেবিলে গুছিয়ে রেখে একটা অটো নিয়ে ফটিককে আনতে চলে যায় ভজন আর বুবাই। ফেরার সময় অটোতে ওরা জিজ্ঞেস করেছিল দুপুরের খাবার এনে দেবে কিনা! ফটিক না করে দেয়, বলে হোম ডেলিভারিতে ফোন করে দিয়েছে। ওরা সময়মতো দিয়ে যাবে।

টুকটাক লেখা ছড়া কাটার অভ্যাস ফটিকের বরাবরই ছিল সেই অভ্যাস থেকে ঐ দুলাইন স্ট্যাটাস পোস্ট করে দিয়েছিল তখন। মোবাইলটা সুইচ অফ করে বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করে, কখন যে সন্ধ্যা হয়ে গেছে খেয়ালই করেনি ফটিক বিশ্বাস। দু’তিনবার কে যেন কলিংবেল টিপতেই ঘুমটা ভেঙে যায়। তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে নেমে গরম চাদরটা জড়িয়ে দরজাটা খোলে। ওহ তোরা! আয় আয় ভেতরে আয়। হাতে একটা ফ্লাস্ক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ভজন আর বুবাই। ভজন বলল তোমার জন্য মা চা বানিয়ে দিয়েছে, চলো তিনজনে বসে গল্প করতে করতে চা খাই। চা বিস্কুট খেতে খেতে তিনজনে অনেক গল্প করল। শ্যামনগরের বিয়ে বাড়ির গল্প, হাসপাতালের অন্যান্য রোগীর অবস্থা, বর্তমান সমাজের অবস্থা, বেকারত্ব, অনলাইন ক্লাস, শিশুদের মানসিক ও দৈহিক বিকাশের বাধা হয়ে গেছে কেমন করে এই অতিমারি অনেক কিছু।

প্রায় রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত ওরা ছিল। যাওয়ার সময় বলে গেল ফটিকদা কোন সমস্যা হলেই একটা ফোন করবে শুধু, আমরা চলে আসব। ফটিকদা বলে নিশ্চয়ই রে। ভজন জিজ্ঞাসা করে ফটিকদা রাতে তোমার কাছে থাকতে হবে? তুমি একা কি পারবে? ফটিক বলে আরে আমি ভালো আছি, পারব। ওরা তাও বলে- যদি মনে হয় শরীর খারাপ লাগছে একটা ফোন করবে কিন্তু আমাকে বা বুবাইকে।আচ্ছা করব, তোরা ছাড়া আমার আর কে আছে বলতো!

ফটিক দা এখন বেশ সুস্থ, ক’দিন ধরে বাজার ঘাট করছে, রান্না করছে, অফিস অন‍্যান‍্য কাজ স্বাভাবিকভাবেই আগের মতো করছে। যথেষ্ট বিধিনিষেধ মেনে মুখে মাস্ক লাগিয়ে, স‍্যানিটাইজড্ করে একার জীবন সুরক্ষিত রাখতে তৎপর। প্রায় এক মাস তো হয়ে গেল হাসপাতাল থেকে ফিরেছে। আজ রবিবার ছুটির দিন, সকালে এককাপ ভালো করে আদা দিয়ে চা বানিয়ে খবরের কাগজটা সাথে নিয়ে ফটিকদা বারান্দাঋ চেয়ারে এসে বসলো। রাস্তার পাশেই বাড়ি, তাই চেনা মানুষের সাথে দেখা হচ্ছে বারান্দা থেকেই দুটো ভালো-মন্দ কথাও বলছে। তারপর পেপারে মনোনিবেশ করে ফটিকচাঁদ। পেপার পড়তে পড়তেই উত্তরবঙ্গ সংবাদের রবিবারের পাত্র চাই-পাত্রী চাই বিজ্ঞাপনের দিকে চোখ গেল। সারি সারি পাত্র চাই-পাত্রী চাই বিজ্ঞাপন। এতদিন এসবদিকে কোনসময়ই চোখ যায়নি। হঠাৎ এক জায়গায় মোটামুটি সাইজের একটা বিজ্ঞাপন দেখে সে। এক হোয়াটসঅ্যাপেই বিজ্ঞাপন। নম্বরটা সেভ করে রাখে মোবাইলে। তারপর রান্নাবান্না, স্নান ধান খাওয়া-দাওয়া করে একটু বিশ্রাম নেয়। বিকালের দিকে চায়ের পর্ব মিটলে মোবাইলটা হাতে নিয়ে বিজ্ঞাপনের সেই নম্বরটা হোয়াটসঅ্যাপে সার্চ করে বের করে। আস্তে আস্তে ফটিকদা টাইপ করা শুরু করে।
“কায়স্থ শিক্ষিত রুচিসম্পন্ন সাধারণ পরিবারের পাত্রী চাই। সুন্দরমনের একসাথে পথচলার জন্য একজন বন্ধু ও জীবনসঙ্গীনি চাই। বয়স ৪০ থেকে ৪৫ এর মধ্যে ও উচ্চতা ৫’ হলেই হবে। নিচে নিজের ঠিকানা ও ফোন নম্বর টাইপ করে “এন্টার” মারে।
বিজ্ঞাপনে উল্লেখিত একাউন্টে অনলাইন পেমেন্ট করে দেয় বিজ্ঞাপনের জন্য। ফোনটা অফ্ করে চোখ বন্ধ করে একটু লজ্জালজ্জা ভাব নিয়ে মিষ্টি হাসি দেয়। তারপর আস্তে করে টিভিটা চালিয়ে খবর দেখতে বসে ফটিকচাঁদ।

অনুশ্রী তরফদার। কবি ও সম্পাদক। জন্ম ভারতের পশ্চিমবঙ্গরাজ্যের শিলিগুড়ি। দ্রোহকাল নামক ছোট কাগজ সম্পাদনা করেন।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ