ফিরিয়ে দিও সে কোলাহল

অন্তরা দাঁ
ছোটগল্প
Bengali
ফিরিয়ে দিও সে কোলাহল

একটা একটা করে দিন চলে যায়। সকাল-দুপুর-সন্ধে, রাত্তির হয়ে আসে। একটানা, যতিচিহ্ন নেই কোথাও। একই রকম কীর্তনী ঢঙে দিনরাত্তিরের কথকতা। ছোটবেলায় বোষ্টমদের এইরকম সুরে গান গেয়ে ভিক্ষা করতে দেখেছি গাঁয়ে-গঞ্জে, কিম্বা আষাঢ় মাসের সন্ধেয় যেমন ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি’র শব্দ শোনা যায়, শুধু সেইটুকুই শোনা যায়, এই দ্রোহকালের দিনগুলোতে একই রকম অন্তরীণে’র সুর।

আমায় ডেকে যায় ভোরের আলো…

ছানা’র জলের মত ফিকে সবুজ, নীলচে নেটে’র মশারির মত আবছায়া আলো’র স্লাইড ফেলে ফেলে তারপর সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, লালচে-কমলা রঙের দোয়াত-খানা কোন দামাল শিশু একেবারে উল্টে দেয় নীল আকাশে’র খাতায়। বাগানের ঘাসে তখনও স্থির অন্ধকার লেগে থাকে। সপ্তপর্ণ ছাতিমের উন্মুখ অপেক্ষায় ভোরের দিকে চেয়ে থাকা, নিষ্কম্প। সারারাত ছায়াপথে অভিসার শেষে সমুদ্রের বুকে বিশ্রামে গেছে যত নক্ষত্র তারা’রা। আবহমান কাল ধরে জায়মান প্রকৃতি’র সংসারে এমনই ঘটে চলেছে প্রতিদিন। ঠিকঠাক ঘড়ি ধরে যেন! কোথাও কোন ছন্দপতন নেই।

সবচেয়ে আগে আসে কাগজওয়ালা, তারপর একে একে দুধওয়ালা, সবজি, মাছ, ময়লা ফেলা’র গাড়ি। তার অনেক আগে থেকে অবশ্য রাস্তা ঝাঁট দেয় একটি মেয়ে, পিঠে কুঁজ, খুঁড়িয়ে হাঁটে, দু’হাতে দুটি ঝাঁটা নিয়ে রাস্তা’র এদিক থেকে ওদিক, গত কুড়ি বছর দেখে আসছি, একইভাবে। নাম-সংকীর্তন করতে করতে সাইকেলে চেপে চলে যায় এক আউল-বাউল মানুষ। তার ঘণ্টি’র আওয়াজ শোনা যায় বহুদূর অবধি। তারপর আসে একটি অন্ধ ভিখারি তার গলা’র সুরে চমকে চমকে ওঠে হামা-টানা সকাল
“…এই পৃথিবীর পান্থশালা’য় বারে বারে আসা যাওয়া
কেহ বা হারায়, কেহ খুঁজে পায় জীবনের চাওয়া পাওয়া। ”
অনড় বসে থাকি বারান্দায়। পা সরে না। যেন অনন্তকাল ধরে বসে আছি কারো’র অপেক্ষায়। সে আসে, আমায় ছুঁয়ে দেয় ভালোবেসে, তারপর যে পথ দিয়ে এসেছিল চলে যায় সেইপথে, আমি তাকে কত ডাকি, কত করে ডাকি, সে ফিরে থাকায় না। পথের কুকুরেরা সারারাত ধূলো’র ওপর কুন্ডলী পাকিয়ে ঘুমোয়। দিনের আলো ফুটলে খুব ব্যস্তবাগীশ হয়ে গা-ঝাড়া দিয়ে কোথায় যেন চলে যায়।

গাছ আর ফুলে’রা, পাখি আর কাঠবিড়ালি’রা আমায় ডেকে ডেকে যায়…

পাখিরা ততক্ষণে জেগে উঠেছে, শিস দিয়ে ওদের ওয়ার্ম-আপ শুরু হয়ে যায়। এবার কতরকম কালোয়াতি জুড়বে! বিচিত্র স্বরে ও সুরের স্বরগমে নরম সকাল কেঁপে কেঁপে ওঠে। কাজে বেরোতে হয় না বলে আমার এখন কোন তাড়া নেই সারাদিন। ডোরবেল বাজেনি বহুদিন তবু কান পেতে থাকি…
“দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে আছে পাড়া… ”
প্রিয় কবি’র কবিতা’র বইয়ে ধুলো’র পুরু আস্তর, হাতে নিয়ে বসে থাকি উদাসীন, লাইনগুলো এঁকেবেঁকে যায়, চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। পাশের বাড়ির ছাদে ততক্ষণে দাপাদাপি শুরু হয়ে গেছে, একটি রিটায়ার করা স্বাস্থ্যলোভী বুড়ো আর তার নাতনি’র ওয়ার্ক-আউট। জানলা খুলে একটু আদুরে টাইপ প্রতিবেশী গৃহিণী’র সহাস্য মুখ
—রান্নাবান্না হলো? আমার কত্তা’টি আজ আবার মাটন খাবার বায়না করছে! কত কাজ পড়ে আছে…
এই ধরনের কথায় সাধারণত একটি নিরালম্ব হাসি ঝুলিয়ে রাখি ঠোঁটের ডগায়। ঘর পরিষ্কার, রান্নাবাড়া’য় পৌনঃপুনিকতা’য় বড় ক্লান্তি আসে বলে নিজেকে নিজের থেকে রেহাই দিই। এটা আমার বহু পুরনো অভ্যেস। প্রয়োজন যে খুব বেশি ছিল তা নয় এই দুঃসময়ে আরও খাটিয়ে নিয়েছি নিজেকে। যেদিন যা জোটে খাই, কোনোদিন তাও না, একমুঠো চিঁড়ে-মুড়ি যাহোক। একজীবনে মানুষের এত লাগে না, যা ব্যবহার করি তার চেয়ে অনেকবেশি ছড়িয়ে ছিটিয়ে নষ্ট করি আমরা।

কু ঝিকঝিক রেলগাড়ি ডেকে যায়…

এখন রেলগাড়ি বন্ধ, খুব সকালে ঝমঝম করে দু’একটা মালগাড়ি যায় শব্দ করে, তারও ওপারে আবছা দেখা যায় আদিগন্ত ধানক্ষেত,শ্রমজীবী মানুষের বসত-ভিটে, পানা-পুকুর, ইলেকট্রিক পোল, আরও কত কী…
জানলা’র ধারে ছোট বাটি করে একটু চীনেবাদাম আর জল রাখি বলে, পাখি আর কাঠবিড়ালি’দের সংসারে আমি অনুপ্রবেশকারী’র ভূমিকা নিই মাঝে মাঝে। বাদাম রোজ রোজ না থাকলে চিনি রিপ্লেস করে পিঁপড়ে’র সারি দেখি, ওদের সংহতি দেখি, শিখি। আমায় দেখে পুটুস করে ল্যাজ নেড়ে একটা কাঠবিড়ালি’র দে দৌড়, দে দৌড়! ভাগ্যিস ওরা লেখাপড়া জানে না, টিভি দ্যাখেনা, এই তীব্র আতঙ্ক ওদের ছুঁতেই পারেনি। মারী-বিধ্বস্ত মানুষ যখন আত্মচিন্তা’য় অস্থির, গাছ আর ফুলে’রা, পাখি আর কাঠবিড়ালি, ছোটছোট প্রজাপতি, পতঙ্গ, তাদের রোজনামচায় মিশিয়ে নিচ্ছে আনন্দ, আর আমি আরও বেশি করে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ছি তা’তে।

আমাকে ডেকে যায় গুরুদেবে’র গান…

এভাবে এতদিন এরকম দৌড়ে দৌড়ে যে জীবন কাটাই তার দাম নেই কানাকড়িও। আত্মগণ্ডী’র লক্ষ্মণরেখা পেরিয়ে যদি স্পর্শ করতে পারি এই মহাকালের নিমগ্নতা’কে তবেই তো মনুষ্যজন্মে’র দায়ভাগী চিন্তা’র সার্থকতা!
বেঁচে থাকতে মানুষ যা যা করে, সবই করি অন্যমনে, কোন তাড়া ছাড়াই। গরুমারা জঙ্গলে একবার একটানা ঘন্টাধ্বনি’র মত আওয়াজে বিভ্রান্ত হয়ে ভেবেছিলাম সংলগ্ন মন্দির আছে কোনো, সেটা ছিল এক বিশেষ রকম বন্য ঝিঁঝিঁ’র ডাক। সেরকমই যতিচিহ্নবিহীন দিন, একঘেয়ে, বিষন্ন।
আমি পড়ে থাকি একা, নিঃসাড়… পাশে খোলা গীতবিতান, গুরুদেবে’র গানের প্রত্যেক’টি কলি আমায় ডেকে যায় নিঃশব্দে, তবু ঠোঁটে ওঠে না, গুনগুন সুর আসে না গুঞ্জরণে।
আমি কি কষ্টে আছি? খারাপ আছি? যন্ত্রনায় আছি?এমনকিছুই কি হচ্ছে যাতে বিচলিত হতে পারে স্বাভাবিক জীবন? মারী কেড়ে নিতে পারে কত শত প্রাণ। জানি, প্রত্যেকবছর যখন অনাবৃষ্টি’র কারণে কয়েকমাইল রুক্ষ প্রান্তরে পায়ে হেঁটে জল নিয়ে আসে প্রান্তিক রমণী, তার আঁচল-ধরা শিশুকন্যা’র তেষ্টাটুকু কভার করে ফেলে দামী লেন্সে’র অনবদ্য ফ্ল্যাশ, আমরা খবর দেখতে দেখতে এসি’র টেম্পারেচার কন্ট্রোল করি। ঋণগ্রস্ত কৃষকে’র আত্মহত্যা, অভাবে’র তাড়ণায় অসহায় মা গঙ্গাবক্ষে ছুড়ে দেয় চার সন্তান, দলিত নারীকে ধর্ষন করে পুড়িয়ে দেওয়া হয়, এসব দুঃখ কবে ছোঁবে আমাদের? এককে’র যন্ত্রণা নেই? যন্ত্রণা শুধু সমষ্টি’তে? ‘করোনা ‘ নামের ভাইরাস মনুষ্যজগতকে দলেবলে নয়, নিজে’র প্রচেষ্টা’য় মাথা তুলে দাঁড়ানো’র শিক্ষা দিয়ে গেল। স্ব স্ব চিন্তায় পরিচালিত হও। প্রত্যেক মানুষের মধ্যে অনন্ত সম্ভাবনা’র বীজ। বোধ আমাকে ডেকে ডেকে যায়।

কোলাহল আমায় ডেকে ডেকে যায়…

বিকালে খোলা ছাদে হাঁটি, মোবাইল ক্যামেরায় ধরে রাখতে চাই সূর্যে’র লালিমা, সে ও ডাকে আমায়, দু’চারটে ফ্ল্যাশে’র পর রেখে দিই, মনোমত হয় না, রি-সাইকল বিনে ফেলি —
রি-সাইকলড চিন্তা’রা আমায় ডেকে ডেকে যায়…

অপেক্ষাকৃত শুনশান রাস্তা, মাস্ক-পরা বালক, বিস্ময়ে চেয়ে থাকে মাঠের দিকে, ওখানে আরও দশ-বারোজন খেলা করে, কিন্তু তা বালকে’র স্মৃতি’তে। মনে হয় যেন কবেকার তেপান্তরে’র মাঠ। অসহায় ছেলেটি গ্রীলের খাঁচায় শরীর আটকে মনে মনে ঘুরপাক খায় সেই তেপান্তরে।

দূরে বড় রাস্তায় এক -আধটা ট্রাকের আওয়াজ মনে করিয়ে দেয়, একদিন সেখানে প্রচুর গতি ছিল আজ… তার পাশে একা পড়ে থাকে খেলার মাঠ,শিশু’রা আসেনা, প্রেমিক থাকে না অপেক্ষায়, বেলা পড়ে আসা মানুষের দল ভীড় করে না গল্প-গাছা’র আশায়।শুধুই স্তব্ধতা।

আমাকে ফিরিয়ে দিও সে কোলাহল।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ