ফুল পরাণের মাঝি

ইসরাত জাহান
ছোটগল্প
Bengali
ফুল পরাণের মাঝি
মাঝি ও মাঝি ঘরে আছ?
ঝড় তুফানের এই রাইতে দুনিয়া যেন ভাইসে যাচ্ছে। বাবলু মাঝি চৌকিতে চিৎ হয়া শুইয়া ভাইবতেছে,
:ঝড় বৃষ্টির দিন আইলেই আমগো মতন গরীবের পেটের ভাত উইঠা যায়।
মাইনষে ঘরের বাইর কম হয়, হাটবার জমেই না। মাইনষের কাম কাইজ থাকে না বইলা বাবলু মাঝির নৌকার বৈঠাও চলে না। বৈঠা না চললি যে ভাতও জুটেনা। তয় বাবলু মাঝি এতিম বইলা চইলা যায়।
সেই ছোট্ট কালে মা বাপ মইরল। চাচারা মাইরে মাইরে গিরাম ছাড়া কইরল। তারপর এ গিরাম ও গিরাম ঘুইরতি ঘুইরতি এই সানিকদিয়া গিরামে। গিরামের হাটে সালেক মিয়া বাবলুরে দেইখাই নিজের বাড়িত নিয়া আইল। ভাত খাইতে দিল। থাকার একখান ঘরও দিল।
কইল,
:আমার নৌকা আছে চাইরডা। মাছ ধরার নৌকা। জাইলেরা এই নৌকা নিয়া মাছ ধরবার যায় নদীর জলে। তুমি কি এই নৌকা বাইতে পারবা?
: হ পারুম শিখাইয়া দিইলে। বাবলু মাথা নামাইয়া কইল।
সালেক মিয়া খুশি হইল বাবলুর কতায়।
বাবলু ধইরল নৌকার বৈঠা।
সেই থেইকা বাবলু হইল বাবলু মাঝি। বাবলু মাঝির ঠোঁটে হাসির ঝলক লাগে নিজের গপ্প নিজের মনে কইতাছে ভাইবা।
ফিসফিস আওয়াজ আইসে কৈ থাইকা? বাবলু মাঝি কান খাড়া কইরা শুনবার চেষ্টা করে। ঝড় তুফান দেবার রাইতে শোঁ শোঁ শব্দ ছাড়াইয়াও কেমন জানি ফিসফিস আওয়াজ আইতাছে।
:মাঝি ও মাঝি ঘরে আছ?
:ফুলবানুর গলার আওয়াজইতো মনে হইতাছে।
:এত রাইতে ফুলবানু?
হইলোডা কি?
সালেক চাচার কিচু অয় নাই তো?
বিড়বিড় কইরা বাবলু মাঝি কতা কয় নিজের সাথে।
ফুলবানু সালেক মিয়ার ছোট
মাইয়া। বড়ই মায়াবতী।
দরজার কপাটখান খোলে বাবলু মাঝি।
ঝড় তুফানের রাইতে ডাক চমকানির আলোয় বাবলু মাঝি দেখে দাওয়াই দাঁড়ানো ফুলবানুরে। ভিইজা এক্কেরে সপসপা।
:ভিতরে আইসো ফুলবানু।
:এত কইরা ডাকি তোমারে। তুমি কি বধির হইছ মাঝি?
ফুলবানু ঘরের ভিতরে আইয়া কয়।
বাবলু মাঝি ঘাড় থাইকে গামছা খুইলা দিয়া কইল,
:নেও মাথাখান মোছ দেখি।
ফুলবানু হাত বাড়ায়ে গামছা নেয়।
বাবলু মাঝি জিগায়
:এত রাইতে তুমি আমার ঘরে কে ফুলবানু?
:কে আইবার পারিনা?
:পার, তয় এত রাইতে কেন আইসছ সেইডা কবা তো। কেউ দেখলে আমারে আস্তা রাখব না। তোমারও বদনাম হইব। আইচ্ছা কওতো কেন আইছ?
:মাঝি আমার বড় বিপদ গো মাঝি। আমারে তুমি বাঁচায় দেও মাঝি।
:মাইনে কি? বিপদ? কিসের বিপদ?
:আব্বাই কইছে আইজ বাদে কাইল আমার বিয়া।
:বিয়া?
:হ মাঝি।
:কার লগে?
:কার লগে সেইডা বড় কতা না মাঝি। কাইল আমার বিয়া হেইডাই কতা।
:হেইডা তো খুশির কতা
:খুশির কতা?  আমার বিয়া তুমি খুশি হইতাছ?
:কেন খুশি হমু না? আমার মহাজনের মাইয়ার বিয়া আমি খুশি হমু না?
:মাঝি তুমি না কইছিলা আমারে বালাবাসো?
:হ কইছিলাম। অহনও তোমারেই বালাবাসি।
:তাইলে চল আমরা পলাই যায়।
:পলাই যামু? কই যামু? কেন যামু?
:মাঝি তুমি এইসব কি কও?
:হ ঠিকই কইতাছি। শুন ফুলবানু, বালাবাসার লগে বিয়ার কুনু সম্পর্ক নাই। বালাবাসা তো মনের। তুমি যেইখানেই যাও না কেন আমি তোমারেই বালাবাসমু।
তয় পলাই যাইতে পারুম না ফুলবানু। পথে ঘাটে লাত্থি খাইতে খাইতে এইখানে আইয়া পড়ছি। তোমার আব্বায় আমারে খাইতে দিছে, শোবার ঘর দিছে। তার লগে বেইমানি করতে আমি পারুম না।
তয় এইডাতো সত্য তোমার আব্বায় আমার মতন এতিমের লগে তোমার বিয়া দিব না।
:আমি কিছু জানি না মাঝি।
আমি তোমার লগে থাকতি চাই।
:কি কও ফুলবানু? তুমি ফিরা যাও ফুলবানু। তোমার ঘরে যাও। ঝড় তুফান কইমা আইতাছে। দেবার জলও কইমাছে। তোমার আমার কতা মাইনষের কানে যাইব। তোমার বদনাম হইব ফুলবানু।
:বদনাম? আমার বদনাম হইলে তোমার কি? যারে কাছে রাখার মুরদ নাই তার কি হইব তাতে তোমার কি মাঝি?
: আমার মেলা কিছু ফুলবানু। যারে বালাবাসি তারে তো সব সব উজাড় কইরাই বালাবাসি। হেই মানুষটা জগতে সক্কলের চোউক্ষে ফুলের মতন পবিত্র থাকব হেইডাই তো আমি চাই ফুলবানু।
ফুলবানু তুমি ফিরা যাও। তয় জাইনা রাইখো, এই বাবলু মাঝি সারাজীবন তোমারে বালাবাসব। সারাজীবন।
ফুলবানু বাবলু মাঝিরে ধাক্কা দিয়া ফালাই দেয় চৌকির উপর। কয়,
:মাঝিরে তুমি আমারে রাখলা না কাছে।
হেরপর মুখে ভিজা কাপড় গুইজা ছুট দেয় নিজের ছাইড়া আওন পথ ধইরা।
ঝড় তুফানও থাইমা গেছে। দেবার জলও চইলা গেছে। বাবলু মাঝির বুকের ভিতর উইঠা আসে আরেক তুফান। চোউক্ষ ফাইটা নাইমা আসে বানের জল।
বুকের ভিতর তুফান চোউক্ষের মইধ্যে বানের জল নিয়া বাবলু মাঝি গান গায়,
“সোনা বন্ধুরে, আমি তোমার নাম লইয়া কান্দি
গগণেতে ডাকে দেয়া
আসমান হইল আন্ধিরে বন্ধু
আমি তোমার নাম লইয়া কান্দি——-“।

ইসরাত জাহান। কবি। জন্ম বাংলাদেশের পাবনা জেলার ঈশ্বরদী। বর্তমান নিবাস ঢাকায়। তেরোবছর বয়স থেকে লেখালিখি শুরু। লেখা শুরু করেছিলেন দৈনিক বাংলার বাণীর মাধ্যমে। তারপর দৈনিক আজকের কাগজে নিয়মিত লেখালিখিতে ছিলেন। এরপর হঠাৎ করে বারোবছর লেখালিখি থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসন। প্রকাশিত বই: 'তোমার...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

সুমন্তদা ও সাইকোভেগাসের গল্প

সুমন্তদা ও সাইকোভেগাসের গল্প

গোয়েন্দা সুমন বাবু শুধু গোয়েন্দা নন। তিনি একাধারে বিজ্ঞানী,গোয়েন্দা বিচক্ষণ ব্যক্তি।তিনি বিভিন্ন বিষয়ে আপডেট সংবাদ…..

এই আমি

এই আমি

ছোটবেলায় একবার রবীন্দ্রনাথের সাথে দেখা হয়েছিল। মেলা-বান্নিতে ধবধবে শঙ্খসাদা তুলার দাড়িগোঁফে আবৃত মাথাঝুলানি রবীন্দ্রনাথ বিক্রি…..