ফেইক আইডি

শাপলা জাকিয়া
গল্প, পডকাস্ট
Bengali
ফেইক আইডি

কাওসার সাহেবের বয়স পঞ্চাশ। নিয়মিত ব্যায়াম আর রঙচঙা পোশাক পরে তিনি বয়সটা চল্লিশে ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করেন। হয়তো সফল হয়েও যেতেন, কিন্তু মাথার চুলগুলির জন্য পারেন না। মাথার সামনের অংশে চুল একেবারেই কমে এসেছে। মেয়েদের শাড়ীর আঁচলের মতো কয়েক গাছি লম্বা লম্বা চুল গা এলিয়ে পড়ে থাকে। বাতাস আসলে আঁচলের মতো উড়ে এলোমেলো হয়ে যেতেই মাথার তালু বেরিয়ে পড়ে। আঁচল সরে গেলে মহিলারা যেমন অপ্রস্তুত হন, চুল সরে গেলে কাওসার সাহেবও তেমনি অপ্রস্তুত বোধ করেন। পকেটে তাই সবসময় একটা কমলা রঙের ছোট চিরুনি রাখেন তিনি। সময় সুযোগ পেলেই পরম মমতায় চুলে চিরুনি চালান । মনে মনে মিনতি জানান চুলগুলিকে,

-“বাপধন! যে কয়টা চুল আছিস তোরা, থাক। আমায় ছেড়ে যাস না।”

অডিও পডকাস্ট শুনুন এখানে: 

সেদিন বাসে উঠে জানালার পাশের সিট পেয়ে খুব খুশি হয়ে বসেছিলেন তিনি। তখনও বাস ছাড়ার দেরি ছিল। ডানদিকের এক আসন সামনের সারিতে একজন সুন্দরী মহিলা এসে বসলেন। বয়স বিশও হতে পারে আবার তিরিশও হতে পারে। বলা যায় না তিরিশের বেশিও হতে পারে আজকালকার মহিলাদের বয়স চট করে ধরতে পারেন না কাওসার সাহেব। বিশে যে গেটআপ চল্লিশেও সেই গেটআপ। বোঝার উপায় নেই। বাস ছাড়ার আগে মহিলা বেশ কয়েকবার তাঁর দিকে তাকালেন। চোখাচোখি হতেই বুকের মধ্যে এক ধরনের সুখ অনুভব করেন কাওসার সাহেব। যাক এখনো মহিলা মহল তাকে লক্ষ্য করেন। কিন্তু বাসটা ছাড়তেই জানালা দিয়ে প্রবল বাতাস এসে তার চুলগুলো ভীষণভাবে এলোমেলো করে দিল। তিনি কী করবেন বুঝতে পারছিলেন না। দ্রুত উঠে জানালা লাগানোর চেষ্টা করতেই পাশের সিটে বসা চ্যাংড়া ছেলেটা বলে উঠলো,

– “কী চাচা! এই গরমের মইধ্যে জানলা লাগান ক্যা?”

তিনি নিতান্ত ভদ্রলোক। কারও সাথে রাগারাগি করে কথা বলতে পারেন না। মিনমিন করে বললেন,

-“আমার ধুলায় এলার্জি।”

বখাটে ছোকরা আরও জোর গলায় বলে,

-“তাইলে এসি বাসে উঠলেই পারেন। সাধারণ বাসে উইঠা সাধারণ পাবলিকরে কষ্ট দিবেন, এইডা তো ঠিক না।”

সামনের সেই সুন্দরী মহিলা ঘাড় ঘুরিয়ে আরেকবার কাওসার সাহেবকে দেখে নেন। সেইসাথে পাশের দুর্বিনীত ছোকরাটিকেও। কাওসার সাহেব লজ্জায় মরে যান। ছোকরাটির গালে কষে একটি চড় বসাতে ইচ্ছা করে কাওসার সাহেবের। সেটা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। তাই ইচ্ছেটা হজম করেন তিনি। হজম করতে গিয়ে রাগে বুকটা জ্বলে। মহিলার চোখ এড়িয়ে একবার সাবধানে চুলটা আঁচড়াবেন বলে মাত্র কমলা রঙের চিরুনিটা মাথায় ঠেকিয়েছেন, মহিলা চট করে পিছন ফিরে সেটা দেখে ফেললেন। শুধু দেখলেই হতো, আবার ফিক করে হাসলেন। যেন অল্প কখানা চুলের যত্ন নেয়া দেখে তার খুব হাসি পাচ্ছে। কাওসার সাহেবের আবার রাগে গা জ্বলে গেল। মানুষকে অপ্রস্তুত করতে এই মহিলা সমাজের কোন জুড়ি নাই। কারণে অকারণে ফিক ফিক হাসি। লোক সমাজে বেঁফাস মন্তব্য করতেও এদের জুড়ি নাই।

শিল্পী: রিয়া দাস

তখন কাওসার সাহেব সদ্য এফবি আইডি খুলেছেন। পুরানো দিনের যুবক যুবক একটা ছবি দিতে চেয়েছিলেন তিনি। পরে ভাবলেন বন্ধু -বান্ধব যদি হাসাহাসি করে। তাই বেছে বেছে বর্তমানের একটা ছবি দিলেন যেটাতে তাকে অনেক হ্যান্ডসাম আর অল্পবয়স্ক লাগছে বলে তার মনে হলো।

এক বন্ধুর বোন ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাতে তিনি বেশ খুশি হয়ে গেলেন। থাক, কিছু মেয়ে বন্ধু বান্ধব থাক। মহিলা বন্ধু বান্ধব আজকাল এফবিতে সবারই কম বেশি থাকে। তাতে বেশ শোভাবর্ধন হয় বলেই তার ধারণা। কী কপাল! সেই মহিলা ফ্রেন্ড হয়ে প্রোফাইল পিকচারে কমেন্ট করলেন,

– “কাওসার ভাই, আপনি দেখি চাচারও চাচা হয়ে গেছেন!”

সেই কমেন্ট নিয়ে ফাজিল পুরুষ বন্ধুগুলি তার লেগ পুলিং শুরু করলো। পরপর তিন রাত ঠিকমতো ঘুমাতে পারেননি কাওসার সাহেব। সেই আইডিতে তিনি আর ঢোকেননি। কিন্তু ফেসবুক টানতো। তাই অবশেষে খুব ভেবে চিন্তে তিনি একটা ফেইক আইডি খুললেন। অফিসে কাজের ফাঁকে ফাঁকে বা ঘুমুতে যাবার আগে আগে তিনি সেই আইডিতে ঢোকেন। তিনি আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলেন এই ফেইক আইডি তাঁকে অনেক কনফিডেন্স দিচ্ছে। কারণ এখানে কেউ তাঁর আসল পরিচয় জানে না। সুতরাং তিনি যা খুশি তাই বলতে পারেন।

সারাজীবন রাস্তাঘাটে মেয়েদের দেখে তাঁর শিস দিতে ইচ্ছে করেছে। নেহাৎ সাহসের অভাবে তিনি কোনদিন সেটা করতে পারেন নি। ফেসবুকে তিনি মেয়েদের ইচ্ছেমতো কমেন্ট করেন, কেউ কেউ তাঁকে আনফ্রেন্ড করে দেয়, বেশি ক্ষেপলে ব্লক মারে। তাতে কী? মানুষের কি অভাব নাকি ফেস বুকে। একজন তাড়ায় তিনি আরেক দরজায় গিয়ে কড়া নাড়েন।

বলতে কি, নানা কিছিমের লোকের ওয়ালে ঘুরাঘুরি করে তিনি বেশ কিছু নতুন গালিও শিখেছেন। সেগুলো মাঝে মাঝে এর, ওর কমেন্ট বক্সে গিয়ে পোস্ট করেন। ধুন্দুমার কাণ্ড বেঁধে যায়। নাও, তখন শুধু বসে বসে মজা লোটো।

অবশেষে আজ, এই পূর্ণিমার রাতে কাওসার সাহেবের মনটা আধুনিক প্রযুক্তি আর ফেসবুকের প্রতি ভক্তিতে মাখোমাখো হয়ে উঠলো। এই পঞ্চাশ বছর বয়সের টাক মাথার কাওসার সাহেবকে কোন তরুণী কি ‘লাভ ইউ‘ বলতো, যদি তাঁর একটা যুবক মার্কা ছবি দিয়ে ফেইক আইডি না থাকতো? এই বয়সে তাঁর ইনবক্স ভরে গেছে লাভ মেসেজে। প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে বারান্দায় বসে মেয়েটির সাথে ফেসবুকে প্রেমালাপ করলেন তিনি। অবশেষে সিরিয়াল দেখে ক্লান্ত হয়ে ঘুমোতে যাওয়া বৌ এর পাশে ঘুমাতে গেলেন। মনটা কেমন ফুরফুরে লাগছে তাঁর। ধুমসি বৌটাকেও মৃদু আলোয় উর্বশী মনে হচ্ছে।

কাওসার সাহেব দেখতে তেমন ভালো ছিলেন না কোনকালে। বরং একটু খারাপই বলা যায়। মলিন রং, চেহারার ছিরি ছাঁদ নেই। কখনো কোন মেয়ে তাঁকে প্রেমের কথা বলেনি। তাঁরও বলার সাহস ছিল না। নইলে পচাদেরও একজন পেঁচি জুটে যায়। তাছাড়া তাঁর আমলে মোবাইল, ফেসবুক এসব ছিল না, তাই বিড়ালের কপালে আর শিকে ছেঁড়ে নি। প্রেমিকা জোটেনি তাঁর। বৌটাও পড়লো দজ্জাল। পঞ্চাশ বছর বয়সে কাওসার সাহেব যেন প্রথমবারের মতো প্রেম করার অনুভূতি টের পাচ্ছেন। সারা পৃথিবী নতুন রূপে হঠাৎ করেই তাঁর সামনে নিজেকে মেলে ধরেছে বলে মনে হচ্ছে তাঁর। সুখে চোখ বুজে আসছে কাওসার সাহেবের। ঘুমাতে যাবার আগে আগে তিনি মনে মনে ফেস বুকের জনক মার্ক জুকারবার্গকে একটা চুমু খেয়ে নিলেন।

শাপলা জাকিয়া। লেখক ও ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক। পৈত্রিক নিবাস কুষ্টিয়া হলেও স্কুল ও কলেজ জীবন কেটেছে নারায়ণগঞ্জ শহরে। নারায়ণগঞ্জ সরকারি তোলারাম কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করেন। বর্তমান নিবাস ঢাকা। যুক্ত ছিলেন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিকতায়। দীর্ঘদিন কাজ করেছেন দৈনিক যুগান্তরে। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ- খুন...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..