প্রক্সি
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
দয়া কর মা কোসগাই, আমরা সবাই খেটে খাই
সে অনেক দিন আগের কথা। ছত্তিশগড়ের ঘন অরণ্যের মধ্যে বয়ে যেত এক খলবলে নদী। নদীর পারে মাথা তুলে খাড়া দাঁড়িয়ে কোসগাই পাহাড়। আর সেই পাহাড়ের চুড়োয় জেগে আছে কোসগাই মাতার মন্দির। সেই নদীর নাম হসদেও। বনের নাম অজগরবাহার। সেই ঘন বনের পাশে একটি গ্রাম। গ্রামের নাম ছোটকি ছুরি।
সেই গ্রামে ছিল কয়েকঘর কাঠুরের বাস, তাদের একজন গোবিনরাম। স্থানীয় উপভাষায় ওদের বলত—লকড়হারা। গোবিনরাম খুব খাটিয়ে। রোজ ভোর ভোর ‘বাসি’ বা পান্তাভাত খেয়ে বেরিয়ে যায় কাঠ কাটতে। সারাদিন কাঠ কেটে ঘরে ফেরে সূয্যিডোবার আগে। তারপর কুয়োর জলে হাত-পা ধুয়ে খেয়েদেয়ে বিড়ি ধরিয়ে বৌয়ের কাছে সারাদিনের বিক্রিবাটার হিসেব নেয়। এবার শুতে যাবার আগে স্বামী-স্ত্রী কপালে হাত ঠেকায় আর বিড়বিড় করে প্রার্থনা করে গ্রামদেবতা ঠাকুরদেবের কাছে—‘ হে ঠাকুর! সবাইকে ভাল রেখো। তোমার দয়ায় বনের কাঠ যেন না ফুরোয় আর আমাদের কুয়োর জল যেন না শুকোয়’।
গোবিনরাম আরো দুটো কথা জুড়ে দেয়।
‘ আর ঠাকুর, আমাদের একটিই ছেলে ফেকলুরাম। তুমি তো সবই জান, ছেলেটা বড্ড আলসে। খালি খেয়েদেয়ে বিছানায় গড়িয়ে ইয়ারবন্ধুদের সাথে তাসপাশা খেলে ফক্কুড়ি করে দিন কাটায়। কতবার বলি—জোয়ান হচ্ছিস, আমার সঙ্গে জঙ্গলে চল। কোন কাঠ কাটতে হয়, কোন গাছটা ছেড়ে দিতে হয়, বনের কোনদিকে যেতে মানা—এসব সময় থাকতে শিখে নে। কী আর বলব ঠাকুর, এখনও ঠিকমত কুড়ুলের কোপ দিতে শেখেনি। আমাদের মত ঘরে কি এসব রাজার জামাইয়ের মত চালচলন মানায়? আসলে মায়ের আদরে ছেলেটা দিন দিন মহা ফেকলু হয়ে যাচ্ছে’ ।
তারপর খাটাখাটনিতে ক্লান্ত গোবিনরামের চোখের পাতা জুড়ে ঘুম নামে।
কথাটা মিথ্যে নয়। কাঠুরে বা লকড়হারা মহল্লার অন্য ছেলেপুলেগুলো বেশ খাটিয়ে, কিন্তু এ ছেলে একেবারে অন্যরকম। ছেলের মা বুধবারিন বাঈ আশা ছাড়ে নি। ও জানে যে ঠাকুরদেবের কৃপায় একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।
এইভাবেই দিন কাটছিল। ছেলের চালচলনে হতাশ গোবিনরাম ভাবল আরও খেটে কিছু পয়সা জমিয়ে একটা চাষের জমি কিনে নেবে। তাহলে আর রোজরোজ জঙ্গলে যেতে হবে না। বয়সও হচ্ছে তো! কিন্তু পূবের জঙ্গলে কাঠ ফুরিয়ে আসছে। ভাবল, যদি জ্বালানি কাঠ ছাড়া আরও কিছু শাল-সেগুনের বন থেকে কেটে এনে ছুতোরপাড়ায় বিক্রি করা যায় তবে ভাল দাম পাওয়া যাবে। কিন্তু তার জন্যে যেতে হবে আরও ঘন বনে, নদীর পশ্চিমপারের জঙ্গলে ।
কিন্তু ওদিকপানে যাওয়া! সে তো বাপ-পিতামোর সময়থেকেই মানা। গাঁওবুড়ারা তাই তো বলেন। ওদিকের জঙ্গলে নাকি এক রাক্ষস পরিবারের বাস। যারা গেছে, কেউ ফেরে নি। গোবিনরাম নিজের মনকে বোঝাল—ওসব গালগল্প, যত আলসে আর ঘরকুনো ভিতুদের তৈরি গুজব। আচ্ছা, না হয় বেশি গভীরে যাব না। কিছু দূর গিয়ে সূয্যিডোবার আগে ফিরে আসব।
যেমন ভাবা, তেমন কাজ। গোবিন চলল পশ্চিমপারে। বুধবারিন বাঈ পইপই করে মানা করেছিল। শেষে হার মেনে মাথার দিব্যি দিয়ে বলল—ফেকলু কে দদা! সূরজ ডুবনে কে পহিলে আ জাইও গ’ ।
হ্যাঁ, বৌয়ের কথা রেখেছে বটে গোবিন, আলো থাকতেই ঘরে ফিরেছে আর হাসিমুখে শুনিয়েছে দারুণ সব গাছ আর কাঠের কথা। অনেক কাঠ কেটেছে, কিন্তু এত দূর থেকে টেনে আনা মুশকিল। তাই কিছু এনে বাকি ডাঁই করে রেখে এসেছে। পরদিন কাঁওড় ঝুলিয়ে আনতে হবে। একা পারবে না, যেতে হবে গোটা পরিবারকে—মাঈ- পিলা সব্বোঝন!
ফেকলুরামের কোন উৎসাহ নেই। শেষে বাপের বকুনির চোটে উঠে কুয়োর জলে হাতমুখ ধুয়ে একথালা বাসি খেয়ে পেছন পেছন গেল বটে , কিন্তু মুখের ভাব যেন নিমপাতা চিবুচ্ছে।
এভাবে ক’দিন চলল। হাতে দু’পয়সা আসায় গোবিনরাম কোষ্টা মানে তাঁতিদের পাড়ায় পুকুরপাড়ে একটুকরো জমিও দেখে রেখেছে। তবে তাঁতিব্যাটা বড্ড দাম হাঁকছে।
গোবিনরামের মন মানে না। নেবে তো ওই জমিটাই, -আদ্দেক টাকা এখন, বাকিটা ছ’মাস পরে; কিন্তু তাঁতিব্যাটা একটু কমসম না করলে! শেষে গাঁয়ের পাঁচমাথা—মোড়ল, মোকরদম, প্যাটেল ইত্যাদি- মিলে ফয়সালা করে দিল—তাঁতি একটু নামো, গোবিন একটু ওঠো। ব্যস, গোবিনরাম আনন্দের চোটে সবাইকে বোগরাভাত, মানে খাসির মাংস ভাত, খাইয়ে দিল।
কিন্তু ও হল সেই জাতের লোক, যাদের ‘প্রাণ জায়ে পর বচন না জায়ে’। ধার শোধ করতে ও উদয়াস্ত খাটতে লাগল।
এসে গেল হেমন্তের দিন, ছ’মাস পূর্ণ হতে আর তিরিশ দিন বাকি। টাকা প্রায় শোধ হয়ে এসেছে। ব্যস, আর ক’টা দিন। ট্যাঁকে আসুক বাকিটা। তারপর পুকুরপারের ওই সোনাফলানো তাঁতির জমিটা হবে কাঠুরে মহল্লার গোবিনরামের। রাত্তিরে ভাল করে ঘুম হয় না স্বামী-স্ত্রীর।
দিনটা ছিল শনিবারের বিকেল। কাঠের সন্ধানে গোবিনরাম এসে পড়েছে বনের গহনে। কখন যে রোদ্দূর মিইয়ে গেছে ওর খেয়াল নেই। এবার যে ফিরতে হয়।
কিন্তু ফিরতে চাইলেই কি ফেরা যায়! ঝুপ করে নেমে এল অন্ধকার, ডেকে উঠল কোলিহার দল—হাজার শেয়াল। এমন অন্ধকার যে হাতের তেলো দেখা যাচ্ছে না। ঘিরে ধরছে কাঁটা ঝোপ। পথ চিনবে কেমন করে? এবার ও ভয় পেল। প্রাণপণে কুড়ুল চালিয়ে রাস্তা করে বেরোতে চাইল। তাতেও ভয় কাটে না। কখনও হোঁচট খাচ্ছে কাটা গাছের গুঁড়িতে, কখনও কাঁটাঝোপে। আটকে যাচ্ছে পাঁচহাত্তি বা হেঁটো ধুতি। কোথা থেকে একটা আঁশটে গন্ধ ওর নাকে আসছে, পচা মাছের গন্ধ।
মাছ! এখানে নদী নালা কোথায়, একটা ডোবাও তো নেই। ওর গলা শুকিয়ে আসছে।
পশ্চিমের জঙ্গল থেকে গোবিনরামের ঘরে ফেরা হল না।
গাঁয়ের লোকে বলল—গোঁয়ারের মরণ।
তাঁতি খুশি; বায়নার টাকাটা –অব বুড় গইসে!
পকেটে টাকাও রইল, জমিও হাতবদল হল না।
শুধু চোখের জল শুকোয় না বুধবারিন বাঈয়ের। মানুষটা ওকে বড্ড ভালবাসত যে।
(২)
হাঁউ মাঁউ খাঊ! মানুষের গন্ধ পাঁউ!
বুধবারিনের স্বপ্ন গেছে ভেঙে। একটা মাত্র ছেলে, এমন আলসে! এক ব্যঞ্জন, তাও নুনে কাটা? বাপকে হারিয়েও ওর কোন হেলদোল নেই। সেই কাঁথামুড়ি দিয়ে বেলা অব্দি শুয়ে থাকা। তারপর উঠে একথালা বাসি (পান্তাভাত) খেয়ে সেই যে কোথায় টো টো করতে বেরিয়ে যায় তার টিকি ছোঁয় কার সাধ্যি! হয়ত লুহারপাড়ায় বন্ধুদের সঙ্গে তাসপাশা খেলে পিদিম জ্বললে বাড়ি ফেরে, কোন কোন দিন আবার ফেরেই না।
পেটের জ্বালা বড় জ্বালা। বুধবারিন বাঈ একবেলা বাড়ি বাড়ি ঠিকে কাজ করে, আর এক বেলা অন্য কাঠুরেদের কেটে আনা কাঠের বোঝা মাথায় করে বয়ে বিক্কিরি করে চাল-নুন-তেলের জোগাড় করে। মায়ের এই হাড়ভাঙা খাটুনি দেখে যদি বা ছেলের মন গলে! কিন্তু ভবি ভোলে না।
বর্ষাকাল। বৃষ্টিতে ভিজে বুধবারিন জ্বরে পড়ল, সাতদিন শুয়ে থেকে ছাড়ল বটে, তবে গায়ে গতরের ব্যথা গেল না। খাটিয়া ছেড়ে ওঠার শক্তি নেই, কাজে যাবে কেমন করে? হাঁড়ি চড়বে কি? অগত্যা ফেকলুরাম বাপের কুড়ুল কাঁধে তুলে ব্যাজারমুখে জঙ্গলমুখো হল।
শ্রাবণমাস। বনের রঙ মায়াবী সবুজ। জংলিঘাস এখন বুকসমান উঁচু। আম-জাম-শাল-পিয়াল-অশত্থ-বয়রার পাতার ফাঁক দিয়ে রোদ ঢোকে লজ্জা লজ্জা পায়ে। বন -ইমলির গা বেয়ে তরতরিয়ে উঠে যায় কাঠবেড়ালি। পায়ের পাশ দিয়ে সরসরিয়ে চলে যায় সাপ। আচমকা ডেকে ওঠে নাম না জানা পাখি। জলে ভেজা ঘাসে ছপছপিয়ে এগোতে থাকে ফেকলুরাম।
জঙ্গল যে এত সুন্দর তা এই প্রথম চোখে পড়ল ফেকলুর। ভুলে গেল কাঠ কাটতে হবে, আঁটি বাঁধতে হবে। কাঁধের কুড়ুল রইল কাঁধে, ফেকলু সেঁধিয়ে গেল বনের আরও গভীরে। যখন চৈতন্য হল তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। ক্ষিদে পেয়েছে, মুচড়ে মুচড়ে উঠছে পেট। কুল কুল করে বয়ে চলা এক শীতল জলধারার আঁজলা ভরা জল খেয়ে ওর শরীর খানিকটা জুড়োল।
কাজ হয় নি বিশেষ, কিন্তু এবার না ফিরলেই নয়। কখন যে নেমে এল অন্ধকার, দল বেঁধে ঘরে ফিরল পাখির ঝাঁক। ফেকলু জোরে পা চালায়। বেশ খানিকক্ষণ কেটে গেল, জঙ্গল পাতলা হচ্ছে না তো। তবে কি ওকে ভুলোয় পেল? সারারাত্তির গোলকধাঁধায় ঘুরে মরতে হবে? হঠাৎ বড্ড শীত শীত করছে, মনে পড়ছে রোগাভোগা মায়ের কথা। আর বাবা? গাঁয়ের সিয়ানের দল (মাতব্বর, মুরুব্বি) যে বলে পছিমধারে না যেতে? ওখানে নাকি একজোড়া রাক্ষস-রাক্ষসী থাকে? বাবা কথা শুনল না, গেল আর ফিরল না। ও ভুল করবে না পছিমধারে যাবে না। কিন্তু এই ঘুরঘুট্টি আঁধারে কী বা পূব কী বা পছিম!
চাঁদ ডুবে গেছে, জ্বলছে নিভছে অগুনতি জোনাকি। দূরে কোথাও ফেউ ডাকছে। শ্রান্ত ক্লান্ত ফেকলু একটা বটগাছের ঝুরির আড়ালে মোটাসোটা গুঁড়িতে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল, ঘুমটা গেছে ভেঙে। হাওয়া বইছে না, তবু নাকে ঝাপটা মারছে একটা আঁশটে পচা গন্ধ, ওর গা গুলিয়ে উঠছে। ফেউয়ের ডাক থেমে গেল। দূর থেকে একটা শব্দ এগিয়ে আসছে, শুকনো পাতার ওপর পা ফেলার মচমচ শব্দ। একজোড়া পা, আসছে এদিকপানেই। ফেকলু ভয় পেয়েছে, ভীষণ ভয়। ও নিঃশ্বাস বন্ধ করে গাছের গাইয়ে সেঁটে যায়, তারপর হুড়মুড়িয়ে উঠে যায় বটগাছের মগডালে।
পায়ের শব্দ কয়েক হাত দূরে থেমেছে। কেউ যেন জোরে জোরে শ্বাস টানছে।
-হাঁউ মাঁউ খাঁউ! মানুষের গন্ধ পাঁউ!
কেউ খলখল করে হেসে উঠল। তারপর এক অদ্ভূত নাকিসুরে বলে উঠলঃ
-ওরে আমার নোলা সপসপ গিন্নি রে! স্বপন দেখছিস নাকি? এই তো সেদিন একটা কাঠুরে কে খেলি, দুটো মাসও পুরোয় নি, এর মধ্যে আবার মানুষ? কত বছর পরে বোকাটা সেদিন আমাদের তল্লাটে ঢুকেছিল, নিঘঘাৎ পথ হারিয়ে।
–আমি কক্ষনো স্বপন দেখি নে, বুঝলে মূলোদাঁতি কত্তা, আমার নাক ভুল করেনি কো। গন্ধটা খুব কাছে।
সঢ়াৎ করে জিভের ঝোলটানার আর নাক টানার শব্দ।
–বুঝেচি, বুঝেচি। গন্ধটা বটগাছের মাথায়। এই, কে রে তুই! নেমে আয় শিগগির, নাম বলচি।
এবার একটা ফ্যাঁসফেঁসে আওয়াজ কথা বলে।
–শোন রে ভালমানুষের পো! রাক্ষসরাণীর কথামত ভালয় ভালয় নেমে আয়। ওর হল দয়ার শরীর। চটপট নেমে এলে তোর মুন্ডু একটানে ধড় থেকে আলাদা করে ফেলা হবে। বেশি কষ্ট পাবি নে। আর কথা না শুনলে আমরা দুজন তোকে জ্যান্ত রেখে দুদিন ধরে একটু একটু করে খাব। ধর আজ তোর পাছার মাংস খুবলে নিলাম, কাল তোর তলপেট। তিনদিনে ছটফট করে মরবি। তাই বলচি নেমে আয়।
–নাম শিগগির। নইলে আমি ওপরে উঠে আসব, বুঝবি ঠ্যালা!
গাছের মগডাল থেকে ফেকলু প্রায় পড়ে যায় আর কি! এরাই তাহলে ওর বাবাকে খেয়েছে। গাঢ় অন্ধকারেও কোথা থেকে একটা ফিনিক দেয়া আলোর রোশনিতে গাছের গোড়া বেশ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কিন্তু ও কী! ও কী! একজোড়া বিচিত্র জীব, খানিকটা মানুষের মত, আবার পুরোটা নয়। মাথায় জটা, গায়ে বড় বড় কাঁটার মত লোম, হাতে পায়ে তীক্ষ্ণ বাঁকা নখ। গায়ে একটাও সুতো নেই, তবে কোমরে আর গলায় হাড়ের মালা। ওদের একজনের চুল বেশ লম্বা, সেই বোধহয় রাক্ষসী। তার পায়ে রয়েছে একজোড়া মল, আর তার থেকেই ঠিকরে বেরোচ্ছে একরকম আলো, তাতেই গাছের গোড়ায় চারপাশ ঝলমল করছে।
ও বুঝল- উপায় নেই, নামতেই হবে। বুঝলে —ও এবার মরবে, তবে মেরে মরবে। বাবার মৃত্যুর বদলা নেবে। আর এটা ভাবতেই ওর মন থেকে সেই হাড়হিম করা ভয় চলে গেল, ঠিক জ্বর ছেড়ে যাওয়ার মত।
ভারী কুড়ুলখানা? আরে সে তো নীচেই রয়ে গেছে, গাছের গোড়ায়। রাক্ষসীর ভয়ে হাঁচোড় পাঁচোড় করে গাছে চড়ার সময় খেয়াল ছিল না। এখন উপায়? নামতে গিয়ে শেষে রাক্ষসীর সহজ শিকার হবে? কিন্তু এদিকে ও তো গাছে উঠে আসার চেষ্টা করছে। মরিয়া হয়ে যা-থাকে-কপালে ভেবে ঠাকুরদেবের নাম নিয়ে ও সরসরিয়ে নামতেই হাতে পেল কুড়ুলখানা। এদিকে রাক্ষসীও ওকে দেখতে পেয়েছে।
খলখল করে হেসে থাবা বাড়িয়ে ও এগিয়ে আসছে, পেছনে রাক্ষস। ভাঁটার মত জ্বলছে দুজোড়া চোখ। ফেকলু ভয়ে চোখ বোঁজে। রাক্ষসী ওর দিকে ঝাঁপ দিতেই হাঁটুগেড়ে বসে শক্ত মুঠোয় ধরা কুড়ুলটা ঘোরায় প্রাণপণে। একটা গরম কিছু ছিটকে লাগে ওর গায়ে। একটা আর্ত চিৎকার! এবার ও ভয়ে ভয়ে চোখ খোলে।
অবাক কান্ড! কুড়ুলের ঘায়ে উড়ে গেছে রাক্ষসীর একটা পা। কাটা পা ফেলে পালাচ্ছে রাক্ষসী, বুড়ো রাক্ষসের হাত ধরে ন্যাংচাতে ন্যাংচাতে। ফেকলু জ্ঞান হারালো।
কতক্ষণ ওভাবে পড়েছিল বলা মুশকিল। যখন চেতনা ফিরল তখন চারদিক নিস্তব্ধ, শুনশান, গাঢ় অন্ধকার।
কিন্তু বটগাছের গোড়ায় এত আলো? উঠে পড়ে ফেকলু। বটগাছের গোড়ায় গিয়ে দেখে রাক্ষসীর কাটা পায়ের মল থেকে ঠিকরে বেরোচ্ছে এক অপার্থিব দ্যুতি। তাতেই জায়গাটা আলোয় আলোময়। আবার কুড়ুল তোলে ফেকলু। কেটে বের করে নেয় সেই জাদুকরী মল। যত্ন করে হাতে তোলে যেন সাঁঝবেলার পিদিম। তারপর সেই আলোয় ধীরে ধীরে পথ চলে। বনের মধ্যে জেগে ওঠে রাস্তা। জঙ্গল ফুরোয়, গাঁয়ের সীমানা দেখা যায়।
ফেকলু যখন ঘরে পৌঁছলো তখন শুকতারা মিলিয়ে যাচ্ছে।
–কোথায় ছিলি বাপ? এ কী চেহারা হয়েছে তোর?
–ঠাকুরদেবের বর পেয়েছি মা, দেখ তোর জন্যে কী এনেছি।
এই বলে হতভম্ব মার হাতে রাক্ষসীর কাটা পায়ের মল তুলে দিয়ে বিছানায় লম্বা হয় ফেকলু, কাঁথা টেনে নেয় আর অঘোরে ঘুমোতে থাকে।
(৩)
রাজকন্যের চোখে জল,
চাই যে ওর দৈবী মল।
রাজা হাঁকেন—কোন সুজন?
আনবে খুঁজে, মরণপণ!
তা সেই এক পায়ের মল ফেকলুর বাড়িতে ভেলকি দেখিয়ে ছাড়ল। বিহানবেলা বুধবারিন বাঈ একপায়ে ওই মল পরে যেই না কুয়োর পাড়ে গেছে, অমনি কুয়োর জল খলবলিয়ে কানায় উঠে এল। ওকে আর দড়ি টেনে বালতি ডোবাতে হল না। চোখ ছানাবড়া! তবে কি ঠাকুরদেব এবার মুখ তুলে চাইলেন?
ফেকলুর ও বলিহারি! ওই এক রাতের ঘটনায় ছেলেটা যেন বদলে গেছে। বাপ-ঠাকুদ্দার কাঠুরেপেশা ছেড়ে দিয়ে মুদিদোকান খুলে বসেছে। ও আর জঙ্গলে যাবে না, ও এখন শেঠজি হবে। তার সঙ্গে ধরেছে ধানচালের ব্যবসা। ওর এখন ধূলমুঠো সোনা। যাতে হাত দেয় তাই ফলে। গাঁয়ের মাতব্বররা জানতে চান ব্যবসার পুঁজি এল কোত্থেকে? ও জোড়হাত কপালে ঠেকিয়ে বলে– ঠাকুরদেবের কিরপা!
দেখতে দেখতে ওর বাড়ির ভোল বদলে গেল। আগের অগভীর কাঁচা কুয়ো এখন শানবাঁধানো মিষ্টি জলের পাতকুয়ো। সারা বছর ভরা জল টলটল। ঘরের মাটির দেয়ালের জায়গা নিয়েছে ইঁটের পাকা গাঁথনি। বয়স কম হলে কী হবে, এখন গাঁয়ের কোন বিষয়ের ফয়সালা ফেকলুরামকে বাদ দিয়ে হয় না। ও এখন একজন কেউকেটা। বুধবারিনের বুক গর্বে ফুলে ওঠে। এই ছেলের জন্যে ওকে কম কথা শুনতে হয়েছে? আজ সুযোগ পেলেই পাড়াপড়শীদের শুনিয়ে দেয়—আমি বরাবর বলে এসেছি, ওর বাপ বিশ্বাস করেনি। আহা! আজ যদি মানুষটা থাকত!
সব তো ভালই ছিল, কিন্তু বিধাতাপুরুষ মুচকি মুচকি হাসছিলেন।
হল কি, রাজ্যের রাজকুমারীর চোখে পড়ল সেই আশ্চর্য মল।
কেমন করে? অতশত জানিনে বাপু! গাঁওবুড়াদের মুখে যা শুনেছি, তাই বলছি। বিশ্বাস করতে হয় কর, নইলে রাত্তিরে দুটো রুটি বেশি খেয়ে নিও।
এ রাজ্যের রাজার একটিই মেয়ে—বাপসোহাগি, আদরখাকি এবং দেমাকি। হবেই তো, রাজামশায় যে তাকে চোখে হারান।
বসন্তকাল। ছত্তিশগড়ে দিনের বেলায় রোদ্দূরের তাপ টের পাওয়া যায়। কিন্তু সূয্যি ঢলতেই হাওয়ায় বিদায়ী শীতের মিঠে আমেজ, গুলাবি জাড়া। বসন্তপঞ্চমী পেরিয়ে গেছে, এসেছে দেবউঠনী একাদশী। এইসময় সূর্যদেব শীতের ঘুম থেকে জেগে ওঠেন। টিকিওলা পন্ডিতেরা পুঁথি ঘেঁটে বলবেন—এ হল সূর্যের উত্তরায়ণ।
আমরা তো পন্ডিত নই, শুধু জানি যে এইদিনে নতুন গন্না বা আখ কেটে তার পূজো করতে হয়। চাষিরা এইদিনে স্থানীয় হাটবাজারে মরসুমের প্রথম গন্না বিক্কিরি করতে নিয়ে আসে। আর বিক্রিবাটা ভাল হলে বাজার থেকে বাড়ি ফেরার আগে ইয়ারদোস্তদের সঙ্গে মহুয়ার রস নিয়ে একটু আচমন সেরে নেয়। তা আমাদের ফেকলুও আজ ছুরিগাঁয়ের হাটে গণেশরামের ঠেকে জমিয়ে বসেছে।
এদিকে রাজকুমারীর পালকি আসছে। আগে পিছে পাইক-বরকন্দাজ, ঘোড়সোয়ারের দল। লোকে ভয়ে রাস্তা ছেড়ে দেয়।
কোথা থেকে আসছেন রাজকুমারী? কোসগাই পাহাড়ের দেবীমন্দির থেকে।
কেন? কেন আবার কি! পূজো দিতে।
যাবেন কোথা? ফের বোকার মত কথা।
কাজ ফুরোলে রাজপরিবারের লোকজন কোথায় যায়? রাজপ্রাসাদে।ফেরে।
কিন্তু পালকি যে থেমে গেল। বেহারাগুলো দাঁড়িয়ে পড়েছে, গামছা দিয়ে ঘাম মুচছে।
রাজকুমারীকে দেখতে পেলে?
ওঁদের কি কখনো দেখা যায়?
ওই তো ! চিকের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসেছে, পানপাতার মত মুখ।
দূর বোকা! ও তো রাজকুমারীর সখি, থুড়ি সহচরী। দেখ না, একটা ঘোড়সোয়ারকে ডেকে কীসব বলছে।
এবার রাজকুমারীজি কী সওয়ারি ফের চলতে শুরু করেছে, জয় রামজী কী।
কিন্তু মাঝের রাস্তাটা ছেড়ে কাঠুরে পাড়ার দিকে ঘুরল যেন?
বুঝেছি, রাজকুমারীর তেষ্টা পেয়েছে। আর এ তল্লাটে ফেকলুরামের পাতকুয়োর মত মিষ্টি জল আর কোথায় আছে?
তাই তো দেখছি।
রাজকুমারী সাঁঝবেলায় পালকি থেকে নেমে কুয়োর পাড়ে দাঁড়ালেন, সঙ্গে পঞ্চসখী।
বুধবারিন বাঈয়ের বুকে ঢেঁকির পাড় পড়ছে।
হে বাবা ঠাকুরদেব! হেই গো বাররাজা, বাররাণী! অপরাধ নিও না গো! তোমাদের থানে প্রত্যেক একাদশীতে দশটি করে পিদিম জ্বালাবো। আজ যেন রাজকুমারীর সামনে আমাদের মুখরক্ষা হয়! কোন খ্যানত না হয়। উনি রুষ্ট হলে ধনেপ্রাণে যাব।
ডানপায়ে রাক্ষসী-মল পরে ও রাজকুমারীকে জল ঢেলে দিল—আঁজলা আঁজলা। আহা কি জল! মিষ্টি জল, শীতল জল। শরীর জুড়িয়ে গেল। এমন জল তো রাজপ্রাসাদেও পায় নি। এবার রাজকুমারী ভাল করে চেয়ে দেখল বুধবারিনকে। সাদামাটা গেঁয়ো মাঝবয়সি মেয়েমানুষ। কিন্তু ওর পায়ে ঝকমক করছে একটি মল আর তার থেকে ফুটে বেরোচ্ছে এক আশ্চর্য আলো।
সসংকোচে জানাল – এটি ওর ছেলে কুড়িয়ে পেয়েছে, ঠাকুরদেবের দয়ায়। তারপর থেকেই ওদের দুঃখ ঘুচে গেছে।
ফিরে এলেন রাজকুমারী; সপ্তাহ কেটে গেল—চোখে ঘুম নেই।
রাজা ব্যাকুল। জানতে চাইলেন চোখের কোণে কালি কেন?
–দেখেছি এক পায়ের মল, অদ্ভূত বটে!
–স্যাকরার নাম বল, দশজোড়া গড়িয়ে দেব।
-না না; স্যাকরা নয়, দৈবীমল। কোসগাই পাহাড়ের কাছে অজগরবাহার বনের ধারে হসদেও নদীর পারে আছে এক গাঁও, নাম ছোটকি ছুরি। সেখানে এক কাঠুরের ঘরে জ্বলছে এক আশ্চর্য মাণিক। সেটা আমার চাই।
এই কথা!
পরেরদিন সাতসকালে মোরগডাকার আগে ছুরিগাঁয়ের লোক জেগে উঠলো ঘোড়ার খুরের শব্দে। ঢাল-তলোয়ার-বল্লমধারী দশজন সেপাই ঘুম থেকে তুলেছে ফেকলুরামকে। ওদের সঙ্গে এসেছেন একজন বুড়ো মুন্সীজি, তিনি হাসিমুখে ফেকলুরামের হাতে একটি পত্র ধরিয়ে দিয়ে বললেন— ছোটকি ছুরি গ্রাম নিবাসী রাজভক্ত প্রজা ফেকলুরাম লকড়হারা(কাঠুরে)কে রাজামহাশয়ের বিনীত অনুরোধ , উনি যেন ওনার মায়ের পায়ের আশ্চর্য মলটি রাজামহাশয়কে দেবার জন্যে পত্রবাহকের হাতে প্রদান করেন। এমন মল কাঠুরেবাড়ির থেকে রাজকুমারীর পায়ে মানাবে ভালো।
ওর মায়ের মুখে কথা সরে না। সদ্য ঘুমভাঙা ফেকলু রেগে কাঁই। এঃ! মামাবাড়ির আবদার! এ জিনিস আমাদের পরিবারে ঠাকুরদেবের কৃপায় এসেছে। চাইলেই দেওয়া যায় নাকি?
মুন্সীজির ভুরু কোঁচকাল, কিন্তু হাসিটি আরও চওড়া হল।
–শ্রীমান বোধহয় সমগ্র পত্রটি মন দিয়ে পড়েন নি। শুনুন, আমাদের রাজা অত্যন্ত উদার ও ন্যায়বান। উনি প্রজারঞ্জক, পীড়ক নন। মিনিমাগনা কিছু নেন না। এই মলের বদলে উনি আপনাকে একশ’ স্বর্ণমুদ্রা আর দুটি গ্রাম দিতে রাজি।
ফেকলু একটু অবাক হল। তবে ভেতরে ভেতরে ভাঙলেও মচকাল না।
–রাজামহাশয়ের অসীম কিরপা। হ্যাঁ, আমি লিখতে পড়তে জানিনা। পাঠশালে যাইনি। আপনাদের ফিরিয়ে দিতে আমার কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু হাতজোড় করে বলছি দেবতার কিরপায় পাওয়া এই মল আমি বিক্কিরি করব না।
— এই তবে তোমার শেষ কথা?
–হ্যাঁ।
–ভেবে দেখ, ভাল করছ কি না।
— নতুন করে ভাবার কিছু নেই।
রাজা অবাক। এক ব্যাটা জংলী গাঁয়ের লকড়হারা! সে কি না–!
মন্ত্রী বললেন—বেঁধে আনি ব্যাটাকে?
কোটাল বললেন—মুন্ডুটা ধড় থেকে আলাদা করে দিই?
-না, আমি ওসব পছন্দ করি নে। বরং ভেবে দেখ , আর একটা অমন নকল মল বানিয়ে দিলে মেয়ে আমার মেনে নেবে কি না!
রাজস্যাকরার ডাক পড়ল। তাকে নিয়ে আবার পাইক-বরকন্দাজের দল ছুটল ছুরিগাঁয়ে।ফেকলুর বাড়িতে। মল নেড়েচেড়ে দেখে স্যাকরা মাথা নাড়ল। না, ও নকল একটি বানিয়ে দিতে পারবে বটে, কিন্তু অমন দ্যুতি ঠিকরে বেরনো ? সেটা ওর কম্মো নয়। না, এ হয় না। রাজকুমারী নিঘঘাৎ ধরে ফেলবেন আসল আর নকল। রাজার লোকজন ফিরে এল।
রাজা হার মানলেন, মেয়ে শয্যা নিল। কেটে গেল পক্ষকাল। সোনার বরণ শুকিয়ে কালি।
এলেন রাজবৈদ্য; নাড়ি ধরে গম্ভীর হয়ে গেলেন। বললেন—ব্যামোর নাম হাড়মড়মড়ি-শয্যাকন্টকি। এ অসুখ হয় মনের রোগ থেকে। অতৃপ্ত ইচ্ছার পূরণ বিনা এর কোন চিকিচ্ছে নেই।
(৪)
রাজার বাড়ির ঘরজামাই,
খাই-দাই আর বগল বাজাই।
খবর গেল গাঁয়ে গায়ে, খবর ছড়িয়ে পড়ল হাটেবাজারে। ঢ্যাঁড়া পিটে জানানো হচ্ছে যে রাজামশাই পুরষ্কার ঘোষণা করেছেন।
কী সেই পুরষ্কার? না, যে রাজকুমারীর অসুখ সারিয়ে মুখে হাসি ফোটাতে পারবে তাকে রাজা জামাই করবেন, একেবারে ঘর-জামাই। কিন্তু তাকে খুঁজে আনতে হবে এমন একটা মল যার থেকে আলো ঠিকরে পরে।
রাজা যে অপুত্রক!
তাতে তোর কী?
আমার অনেক কিছু। রাজামশাই গত হলে সিংহাসনে বসবে কে?
কেন, রাণীমা!
দূর বোকা, বসবে রাজার সন্তান-সন্ততি, অর্থাৎ রাজকুমারী স্বয়ং।
তাই বুঝি! আর যদি রাজকুমারীর বিয়ে হয়?
তাতে কী? রাজকুমারী নিশ্চয়ই তাঁর সোয়ামীকে সিংহাসনে বসতে দেবেন? হিন্দুনারী বলে কতা!
বেশ বলেছ; তবে তো ঘরজামাই হওয়া ভারি মজার। ওই হাল্লারাজা শুন্ডিরাজার গল্পের মত?
আর যদি হীরকরাজার মত হয়?
কুকথা বলিস নে! আমি যাব।
ফের বোকার মত কথা! তোর গিন্নির পায়ে অমন আলো ঠিকরে পরা মল আছে? নেই তো? চেপে বোস।
কিন্তু সবাই তো আর তোর আমার বা রামাশ্যামার মত নয়। ফেকলুরামকে ওর ইয়ারদোস্তের দল বোঝালো যে ঢের নখরা হয়েছে। এবার গিয়ে দিয়ে আয় তোর মায়ের পায়ের ওই ঝিকিমিকি মল। পাবি আদ্দেক নয়, গোটা একটা রাজত্ব আর রাজকন্যে।
ফেকলু ইতঃস্তত করছিল—মাকে কী বলে বোঝাবে?
দোস্তলোগ বলল—আরে ইয়ার, তোর মা বিয়ের পর তোর সঙ্গে রাজপ্রাসাদে থাকবে। এই হাড়ভাঙ্গা খাটনি থেকে মুক্তি পাবে, পায়ের ওপর পা তুলে বসে দাসদাসীদের হুকুম করবে। আর মলটা তো তুই জঙ্গলে গিয়ে কুড়িয়ে পেয়েছিস; তোর বাবা মাকে গড়িয়ে দেয় নি।
সেয়ানা বটে ফেকলুরাম, যেমন ভাবা তেমন কাম।
ঝিকিমিকি মল দেখে রাজকন্যের মুখে হাসি ফুটল; সব অসুখ সেরে গেল।
রাজামশাই বললেন—আমার শর্ত ভুলে যাই নি। তোমার সঙ্গেই আমার বুকের ধন লীলাকুমারীর বিয়ে দেব। আর তুমি হবে এবাড়ির ঘর- জামাই, এ রাজ্যের জামাইরাজা! তবে তোমার কোন দাবি দাওয়া থাকলে বলে ফেল।
–আমার দুটো শর্তঃ
এক, আপনার সমধিন(বেয়ান) মানে আমার মা থাকবেন রাজপ্রাসাদে, তবে অন্য মহলে।
দুই, আমার ছোটবেলার ইয়ারদোস্ত বন্ধুবান্ধব খুব বেশি নয়, এই জনা কুড়ি। ওরাও থাকবে রাজপ্রাসাদে, তবে বারমহলে। আর ওদের থাকা-খাওয়ার খরচ রাজকোষ থেকে মেটাতে হবে।
তথাস্তু, এবার তাহলে দিনক্ষণ দেখে বিয়ের আয়োজন হোক।
এই ফাঁকে আমরা ইতরজন হুঁকোয় দুটো টান দিয়ে নেই।
মিটে গেল বিয়ে; উৎসব চলল প্রায় একমাস। হ্যাঁ, দশগাঁয়ের লোক কব্জি ডুবিয়ে খেয়ে ধন্য ধন্য করল। মুখে মুখে ছড়িয়ে গেল রাজকুমারী লীলাবতী ও জামাইরাজা ফেকলুরামের গল্প। রাজা জামাই পেয়েছেন বটে! ঘরজামাই। কেমন সাদাসিদে সভ্যভব্য মাটির মানুষ। একটুও গুমোর নেই কো।
রাজা কথা রেখেছেন।
ফেকলু ও তার মায়ের স্থান হয়েছে রাজপ্রাসাদে। আর জনাবিশেক ইয়ারদোস্ত?
তারা বারবাড়িতে।
ফেকলুও অকৃতজ্ঞ নয়। রাক্ষসীপায়ের সেই মল এখন শোভা পাচ্ছে ওর বৌ লীলাকুমারীর পায়ে। অন্দরমহল ঝলমল ঝলমল, ঝকমক ঝকমক। বারমহলে গেলে ফেকলু ইয়ারদোস্তদের সঙ্গে সহজ হয়ে যায়। ঠিক যেন ছোটকি ছুরি গাঁয়ের ফেকলু লকড়হারা।
রাজার খেয়াল হয় যে বয়স হয়েছে। রাণী গত হয়েছেন। এখন জামাতাবাবাজী একটু একটু করে রাজকাজ বুঝে নিলে মেয়েজামাইয়ের হাতে রাজপাট ছেড়ে দিয়ে বাণপ্রস্থে গেলে কেমন হয়?
রাজা ভাবতে থাকেন।
দেখা গেল ফেকলুরাম গেঁয়ো, কিন্তু মাটো নয়; বেশ বুদ্ধি ধরে। অল্পদিনেই শিখে নিল রাজ্যের আমদানি ও খরচের হিসেব। রাজা ওকে রাজ্যের একটি অঞ্চলের দায়িত্বভার দিয়ে নিশ্চিন্ত হলেন। একদিন রাজা তাঁর বিশ্বস্ত চরের মুখে খবর পেলেন যে ওই এলাকার প্রজারা ফেকলুকে ওই এলাকার রাজা বা ‘ফেকলুরাজা ’ বলে ডাকে। রাজার কপালে ভাঁজ পড়ল। তারপর ভাবলেন যে আজ নয় কাল তো ওই গোটা রাজ্যের রাজা হবে, ঠিকই আছে। তবে একটু তাড়াহুড়ো করছে আর কি!
কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই এমন সব ঘটনা ঘটতে লাগল যে রাজা মহাশয়ের রাত্তিরের ঘুম কর্পূর হয়ে গেল।
দিনটি ছিল শ্রাবণমাসের পহেলা সোমবার। আগের দিন গেছে ‘আঁওলা একাদশী’ বাঃ আমলকি-একাদশীর পরব। সেদিন ছত্তিশগড়ের গাঁয়ের মেয়েরা সবাই মিলে আমলকি গাছের নীচে জড়ো হয়ে গাছের পূজো করে আর সেখানেই রান্না করে খায়। রান্না হয় ভাত-ডাল-ভাজা-শাক-আচার ও ঘরে তৈরি স্থানীয় মিষ্টি। একরকম বনভোজন আর কি। এতে ঘরের পুরষেরা বাদ পড়ে।
লীলাকুমারীও ওর সখী এবং দাসদাসীদের নিয়ে রাজার নিজস্ব উদ্যানে গিয়ে আমলকি পূজো ও বনভোজন করে এসেছে।
আর জামাইরাজা? ও কি শুদুমুদু ঘরে বসে থাকবে? ফেকলুরাম সে বান্দাই নয়। ও গেছল ওর দোস্তদের সঙ্গে আখেট বাঃ মৃগয়া করতে।
এবছর বিষ্টিবাদলা ভালই হয়েছে। মাঠে মাঠে ধানের চারা লকলকিয়ে বেড়ে উঠছে। মেয়েদের খেতের কাজকম্মো প্রায় শেষ। এখন পালাপার্বণের সময় । চারদিকে বেশ একটা উৎসব উৎসব ভাব। আবার শাওন-সোমবার পরবে মেয়েরা সবুজ শাড়ি ও সবুজ কাঁচের চুড়ি পরে দোলনায় দোলে। তাই রাজদরবারেও আজ কারো কাজে মন নেই। বেশ একটা ছুটি ছুটি ভাব। দরবারে লোকগায়কের দল সুর তুলেছে—‘রিমির ঝিমির বরষে পানি।‘’
সভাসদেরা ভাবছে আজ মহারাজ একটু তাড়াতাড়ি দরবার থেকে উঠে অন্দরমহলে গেলে পাশা ও চৌরসের ঘুঁটি সাজিয়ে বসবে।
এমন সময় দরবারের বাইরে একটা হট্টগোল। দুই দ্বারপাল আটকানোর চেষ্টা করছে একটি শণচুলো বুড়িকে।
–কী ব্যাপার?
— ও একটা পাগলি হুজুর।
কিন্তু এলোমেলো চেঁচামেচির মধ্যেও রাজার কানে গেল একটা কাকুতিমিনতির স্বর।
–বাবারা! আমাকে একবারটি ভেতরে যেতে দাও। আমি হুজুরের পায়ে পড়ব। উনি আমার নাতনিকে ফিরিয়ে দেবেন। আমার নাতনি চাই।
–আসতে দাও ওকে। আমি শুনবো বুড়িমা কী বলতে চায়।
–অপরাধ নিও না মহারাজ! তঁয় হমর দাঈ-দদা, তঁয় মোর ভগবান, হমন গরীবকে মাঈ-বাপ। হমন ডরাওথন, মাফি দেব সরকার।
— ভয় নেই, যা বলার খুলে বল। কী হয়েছে?
–আমার তিন কুলে কেউ নেই, শুধু ওই একটা নাতনি। আকালের সময় হয়েছিল বলে নাম দুকলহীন বাঈ। সবেএগারোয় পা দিয়েছে। জঙ্গলের শুকনো কাঠকুটো কুড়িয়ে আনে, তাই বেচে দুজনের পেট চালাই। দুদিন ধরে গায়ে জ্বর। তবু কাল দিনের বেলা জঙ্গলে গেছল, বিকেলেও ফেরেনি। লোকে বলছে বনের পথে রাজার সেপাইরা ওকে ধরে নিয়ে গেছে। মহারাজ গো, ওকে ছেড়ে দাও।
রাজার মুখ রক্তবর্ণ, সভায় মৃদু গুঞ্জন।
-শোন বুড়িমা, তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে। আমার সেপাইরা এমন কাজ করোতে পারে না। গাঁয়ের লোকেরা হয়ত না বুঝে কিছু মনগড়ন্ত উল্টোপাল্টা গুজব ছড়াচ্ছে। তোমার নাতনি ওর সখিদের সঙ্গে ভিনগাঁয়ে বেড়াতে যায় নি তো? তুমি হয়তো ভুলে গেছ, মনে করে দেখ।
–নাহি মহারাজ, মাফি দেব। ওদের সঙ্গে যে মেয়েরা ছিল তারাই দেখেছে। ছয়জন ঘোড়সোয়ার, তাদের ঘোড়ার মাথায় পালক। ওর মুখ চেপে তুলে নিয়ে গেছে। অন্য মেয়েরা পালিয়ে এসেছে।
রাজার মুখ গম্ভীর। কোটালের দিকে তাকালেন।
–না হুজুর! আমার অধীন কোন চৌকিতে এমন কোন ঘটনা ঘটে নি। হলে আমি জানতে পারতাম।
–শুনলে তো বুড়িমা। যাকগে, কাল কোথাও নালিশ কর নি? কোন চৌকিতে?
–মহারাজ, ওই হুজুরের লোকজনই আমায় ভাগিয়ে দিয়েছে, নালিশ নেয় নি।
— ভাগিয়ে দিয়েছে? কে? নাম বল।
–হুজুর , করমন সিং।
মহারাজ উত্তেজিত; কড়া চোখে কোতোয়ালের দিকে তাকালেন।
-তোমার লোক ওকে ভাগিয়ে দিল, নালিশ নিল না। কারণটা জানতে পারি কি?
–মহারাজ,ওই জঙ্গল এলাকার শান্তিরক্ষা আমার এক্তিয়ারের বাইরে।
— তবে কার এলাকা ওটা?
–জামাইরাজার।
গোটা দরবার নিস্তব্ধ।
–বুড়িমা, তুমি তোমার গাঁয়ের পাশের চৌকি ছেড়ে এতদূরে রাজধানীর কাছের চৌকিতে এখন নালিশ করোতে এসেছিলে? কেন আমার জামাইরাজার কাছে যাও নি?
থরথর করে কেঁপে ওঠে বুড়ি। হেঁচকি তুলে কাঁদে। বারবার হাত জোড় করে কপালে ঠেকায় কোন অদৃশ্য দেবতার উদ্দেশে। কাঁপা কাঁপা গলায় বলে—মোলা মাফি দেব সরকার। নারাজ ঝন হবে। আমার ভুল হয়ে গেছে।
তারপর বাঁকাচোরা লাঠিটা তুলে নিয়ে ঠুকঠুক করতে করতে থেকে বেরিয়ে যায়।
রাজা অবাক। দরবারের গুনগুনানি থেমে গেছে। উৎসবের সুর কেটে গিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে একটা চাপা ভয়।
রাজা এবার মহামন্ত্রীর দিকে ফেরেন।
–একটা কথা বুঝতে পেরেও পারছি না। যেন চোখের উপরে কালো পট্টি বাঁধা রয়েছে। ঘটনাটি যে ঘটেছে তা আপনারা সবাই জানতেন? ঠিক তো?
মহামন্ত্রী নিরুত্তর।
–বুড়ির নাতনিকে কারা তুলে নিয়ে গেছে আপনি জানেন?
মহামন্ত্রী নতমুখ।
–মেয়েটি বেঁচে আছে?
মহামন্ত্রী উসখুস করতে লাগলেন।
–অপরাধীর নাম?
মহামন্ত্রী অসহায় ভাবে সেনাপতির দিকে তাকালেন।
–বুঝলাম; আপনারা জানেন কিন্তু বলবেন না। ভয়? কাকে? আমাকে তো নয়, অন্য কাউকে। কে সে?
দরবারের মেঝেতে পিঁপড়ে চলার শব্দ শোনা যায় বুঝি।
গর্জে উঠেছেন মহারাজ।
-কে সে? কে এই রাজ্যে আমার চেয়েও শক্তিধর অমিতবিক্রম? রাজাদেশের চেয়েও যার ইশারার দাম বেশি?
বিদুষকের দন্তরুচিকৌমুদী বেরিয়ে পরে— ফেকলুরাজা! জামাইরাজা!
(৫)
ও যে আমার নাটের গুরু, আমি যে ওর কেলে হাঁড়ি।
হাসিমুখে তাই সয়ে যাই গুরুমশায়ের বেতের বাড়ি।
সেদিনের দরবারের ঘটনাটি বিদুষক ঘরে ফিরে বৌয়ের কাছে ফলাও করে বলছিল আর কপালের ফেরে আমিও তখন সেখানে হাজির ছিলাম। আসলে রোজ সন্ধ্যেবেলা আমাকে ওর বাড়ি যেতে হয়, আমি যে ওর মিতান।
কবে থেকে? সেই পাঠশালায় যাবার দিন থেকে। ও ছিল বিটলে বামুন, গাঁটে গাঁটে বুদ্ধি; ও ছিল আমাদের নাটের গুরু, আর আমি ওর কেলে হাঁড়ি, মানে চেলা আর কি! ওর বুদ্ধির জোরে কতবার গুরুমশায়ের বেত খেতে খেতে বেঁচে গেছি।
আজ আমি নরসুন্দর, গোটা গাঁয়ের ক্ষৌরি করি আর দু’বিঘে নিষ্কর জমি চষি। ও কিন্তু দরবারের বিদুষক, মহারাজের বয়স্য। এক নম্বরের ফাজিল, বিটলে বুদ্ধিতে মাথা গজগজ করছে। যে কথা অনেকে মুখে আনতে সাহস করে না, তা ওর জিভের আগায়। ভাগ্যিস মহারাজ ওকে পছন্দ করেন, আশকারা দেন।
তবে ওর ঘরের হাল ফেরেনি। সেই খাপরার চাল, মাটির দেয়াল আর কাঁচা পাড়ের পাতকো। ওর বামনি, মানে আমার ভৌজি কপাল চাপড়ায়।
–দেবরজি, আপনার বন্ধুর নাকি খুব বুদ্ধি? নমুনা দেখুন। হোলির দিনে মহারাজ কল্পতরু, খুব দানধ্যান করছিলেন। জিজ্ঞেস করলেন সব ভাল তো? আমাদের ইনি ইশারা বুঝেও বুঝলেন না। হেসে বললেন সব ভাল। আর এদিকে দেখুন , দু’বছর ধরে চালে খাপরা বদলানো হয় নি। এবারের বর্ষায় অনেকগুলো ফুটো দিয়ে জল পড়েছে। হাঁড়িকুড়ি সরা ধরে ধরে লাগাতে হয়েছে।
–আরে সুকালুর মা, ভগবান তোমার জলের কষ্ট দেখে ঘরে জল পৌঁছে দিলেন সেটা বুঝলে না? বুঝলে মিতান, ভরা গ্রীষ্মে পাতকো গেছে শুকিয়ে। তা উনি রোজ দুটো কলসী –একটা মাথায়, একটা কাঁখে—নিয়ে সেই নদী থেকে জল ভরে আনতেন। দেখে কানহাইয়ালালের বড় কষ্ট হল। এই বর্ষায় ছাদ ফুটো করে ঘরের মধ্যে যত হাঁড়িকুড়ি, জালা, পাতিল, ঘড়া সব ভরে দিলেন।
— পন্ডিতজি, তোমার এ সব ফক্কুড়ি ওই রাজদরবারেই শুনিয়ে এস, তাও যদি ঘরে দুটো পয়সা আসতো।? তীজ-পরবের সময় প্রত্যেকবার ভাই এসে আমায় বাপের বাড়ি নিয়ে যায়, আমার অন্য দু’বোন ও আসে। তাদের সঙ্গে বাড়ি থেকে আসে মিষ্টি, জামাকাপড় আর পিঠেপুলি। হায় আমার কপাল!
— দেখ, তোমার বড়দি, মানে আমার দেড়শাস (শাশুড়ি)কে আমি ভাল করে চিনি। তোমার বড় জামাইবাবু হল দশগাঁয়ের বৈগা বা পুরুতঠাকুর। বোকা চাষীদের ঝাড়ফুঁক তন্ত্রমন্ত্র করে পয়সা কামাচ্ছে। ওসব আমার কম্মো নয়—যতসব লোকঠকানোর ধান্দা।
–দেখা আপনে! আমার বাপের বাড়ির সবাই ঠগ, উনি একা ধম্মপুত্তুর যুধিষ্ঠির। আরে দরবারে যাও, রাজার বয়স্য; চাইলেই কলাটা মূলোটা পোঁটলা বেঁধে দেবে। না, এসব হল উৎকোচ, কোন এক শাস্তরে নাকি লেখা আছে। আর উৎকোচ মানে নাকি পাপ? আরে যে শাস্তর পড়লে হেঁসেলে হাঁড়ি চড়ে না, তেমন সব পুঁথি না পড়লেই হয়!
আমি বিপদ বুঝে কথা ঘোরাই। জিজ্ঞেস করি–আজ দরবারে কিছু নাকি হয়েছে ?
–কে বলল?
— কে আর বলবে? হাটেবাজারে পথেঘাটে লোকজনের গুজগুজ ফুসফুস।
–মিনি মাগনা কিছু হবে না। আগে ভাঙ ঘোঁট, শরবত বানিয়ে দে! নানহী দাঊয়ের মা (ছোট খোকার মা) যখন আমায় এত কথা শোনাল তখন আমিও ছাড়ছি নে। আজ থেকে আমি ঘুষ খাব। বিনা উপঢৌকন নিয়ে যদি কারও আর্জি শুনি, তবে আমিও আর দরবারের বিদুষক নই। নে শ্যালক, ভাঙের শরবত তরিবত করে দু’গ্লাস বানিয়ে নিয়ে আয়। তারপর শোনাব আজকের দরবারের বিশেষ কিসসা আর তাতে এই শর্মার বিশেষ ভূমিকা।
আমার হাতের ভাঙের শরবত, কী তার স্বাদ! যে না খেয়েছে তাকে কী আর বলব? মহাশিবরাত্তির হোক কি হোলির দিন, বন্ধুবান্ধবের মান রাখতে আমিই বানাই। এই বিটলে বামুন বলে যে সেই শরবত যদি ধানের ক্ষেতে দাঁড় করিয়ে রাখা খড় আর মাটির হাঁড়ি দিয়ে গড়া কাকতাড়ুয়ার ঠোঁটেও দু-এক ঢোক ঢেলে দেওয়া যায় তাহলে সে একটু পরে ঢুলুঢুলু চোখে তাকিয়ে ফিকফিক করে হাসবে।
সে যাকগে, মোদ্দা কথাটা হল বিদুষক মশাই ডেকে নিলেন গিন্নিকে। তারপর দু’গেলাস সিদ্ধির শরবত খেয়ে গোঁফের ফাঁকে মুচকি হেসে আজকের দরবারের ঘটনাটি রসিয়ে রসিয়ে শোনালেন।
আমাদের চোখ গোলগোল, গায়ে কাঁটা! ব্যাটা বলে কি!
জামাই রাজা! ফেকলু রাজা! তার নামে মহারাজের কাছে নালিশ?
হ্যাঁ রে, বললে পেত্যয় যাবি নে। বুড়ির সাহস আছে। আর আমি যখন ভরা দরবারে টুক করে অপরাধীর নামটা বলে দিলাম তখন মহারাজের শ্বাস আটকে যায় আর কি! আর মহামন্ত্রীর যেন ‘সাঁপ সুঁধ গয়ে’! আর কোতোয়ালের তো ‘পুঁ সরিক গইস’।
–কে বলেছিল মুখ খুলতে তোমায় ? খোকাখুকুদের কথা একবারটি ভেবেছ? সবাই যখন মুখ বুজে ছিল, তুমিও না হয়—
ভৌজির কথা শেষ হয় না, দু’হাত জোড় করে বারংবার কপালে ঠেকায় আর বিড়বিড় করে।
–শেষে কী হল বলবি তো? হেসেই ম’লি।
হবে আর কি? মহারাজ বললেন জামাইরাজাকে এত্তেলা দাও, বল দরবারে আসতে।
শান্ত্রী ফিরে এসে বলল যে উনি প্রাসাদে নেই, মৃগয়া থেকে ফেরেন নি। যুবরাণীজি বলেছেন যে আজ রাতে ফিরলে কাল অবশ্যই দরবারে পাঠিয়ে দেবেন।
কী হল, হাসছিস কেন?
কই, হাসছি না তো! আসলে একটা ব্যাপার আছে। খুব গোপন। শুধু আমি জানি আর যুবরাণীজি জানেন। তাই কাউকে বলব না। আমি না খুব দুষ্টু।
আচ্ছা ফ্যাসাদ! সিদ্ধি বোধহয় বামুনব্যাটার ব্রহ্মতালুতে গিয়ে ঠেকেছে।
ঠিক আছে, শুধু সুকালুর মাকে বলব, কানে কানে। নইলে মিতানব্যাটা শুনে ফেলবে। আর ও শুনলে গোটা বাজারের লোক জেনে যাবে। রাজদরবার জানবে, মহারাজ জানবেন। তারপর আমার মুন্ডু ঘ্যাচাং!
–আচ্ছা সুকালুর বাপ, বলো। আমাকেই বল আর বলেটলে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়।
-বলি? বলছি কি জামাইরাজাও খুব দুষ্টু। ও না কাল রাত্তিরেই ফিরে এসেছে। যুবরাণীর মহলে মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। চোখ খুব লাল। বোধহয় ফেকলুরামও মিতানের হাতে তৈরি ভাঙ খেয়েছে। হি-হি-হি!
(৬)
হাকিম নড়ে তো হুকুম নড়ে না!
মহারাজের এককথা। যখন দরবারে প্রজা নালিশ করেছে তখন উনি দু’পক্ষের কথা শুনবেন। তারপর রায় দেবেন—শাস্তি বা খালাস।
রাজ্যজুড়ে এই নিয়ে হৈচৈ। কেন?
আরে নালিশ যে খোদ জামাইরাজার নামে।
দেখবি, কিস্যু হবে না। জামাইরাজাকে কেউ দেখেনি বুড়ির নাতনিকে তুলে নিয়ে যেতে। তবে?
সখীর দল? ওরা তো দেখেছে।
কী দেখেছে? ঘোড়ায় চড়ে ধেয়ে আসা ছয় গবরু জোয়ান ওদের সংগী কাঠকুড়ুনি মেয়েটাকে জোর করে তুলে নিয়ে গেল, এই তো?
তা ওরা যদি ভরা দরবারে ছোঁড়াগুলোকে চিনে ফেলে?
চিনলেই হল? ওদের প্রাণের ভয় নেই?
আরে ওদের বাপ-মা বলবে মরার শখ হয়েছে? চেপে বসে থাক। তোরা কাউকে চিনিস না।
আরে মহারাজ ওদের দরবারে ডাকলে তো? একমাত্তর মেয়ের একটি বর। মেয়ের কথা রাখবে না বাপ? শুনেছি ও নাকি বিস্তর কান্নাকাটি করেছে। বলেছে –তুমি কেমন বাপ? রাজদরবারে দশটা ইতর লোকের সামনে জামাইকে আসামী সাজিয়ে দাঁড় করাবে? কার কথায়? না, একটা হাঘরে ন্যাতাকানি পরা বুড়ির কথায়! এতে তোমার আর তোমার মেয়ের মান-ইজ্জত বজায় থাকবে? তার চেয়েও বড় কথা। আজ নয় কাল তোমার জামাই এই সিংহাসনেই বসবে। তখন প্রজারা তাকে মানবে তো? ভেবে দেখ বাবা।
তা মেয়ে কী করতে বলছে?
বলছে ঘরের মধ্যেই দু-চারটে চড়চাপড় লাগিয়ে ব্যাপারটা মিটিয়ে নাও। দরবারে বলে দাও ওর খুব জ্বর। বলে দাও ও খুব লজ্জিত, মাপ চাইছে।
রাজা কী বলছেন?
বেচারা। কী আর বলবে? দেখবি বলবে—বুড়িমা, তোমার ভুল হয়েছে। শুরুতে তো অমন একটা বাক্যি বলেইছে।
যা বলেছিস, গরীবের কথা কে শুনবে? গরীব কী লুগাই, জগৎ ভৌজাই ( গরীবের বৌ, দুনিয়ার বৌদি) ।
একটি তেতো মুচকি হাসি দিয়ে সবাই বাজারের থলি নিয়ে ঘরে ফিরল।
সেদিন সূয্যি পশ্চিমে উঠেছিল।
ভরা দরবারে রাজার জামাই করজোড়ে বলল—আমি জানি না। আমার এলাকায় কোন মেয়েচুরির খবর নেই। আর আমি তো আমলা একাদশীর দিন দূরের বনে সংগীসাথীদের নিয়ে মৃগয়ায় গিয়েছিলাম। তবু বুড়িমার ক্ষতি দেখে আমি আমার ব্যক্তিগত কোষ থেকে পাঁচটি স্বর্ণমুদ্রা ওকে দেব, সর্বসমক্ষে কথা দিলাম।
রাজা বললেন—কিন্তু সেই কিশোরী মেয়েটি? সে কোথায়? দুই দিবস অতিক্রান্ত। তাকে কেন উদ্ধার করা গেল না? সেনাপতি? মেয়েটিকে খুঁজে পেতে হবে। ওকে আগামীকাল দরবারে দেখতে চাই। ওর মুখ থেকে শুনব কারা ওকে অপহরণ করেছিল। তারপর রায় দেব।
কিন্তু কর্তব্যে অবহেলার জন্যে উক্ত ক্ষেত্রের দায়িত্ব জামাইরাজার থেকে নিয়ে সেনাপতি বিক্রমজিৎ সিংহকে দেওয়া হল। মনে হচ্ছে জামাইরাজার আরও শিক্ষানবিশীর প্রয়োজন আছে।
পরের দিন যা ঘটল তার জন্যে রাজ্যবাসী আদৌ প্রস্তুত ছিল না।
দরবারে সেনাপতি নিয়ে এলেন কিশোরীর নিষ্প্রাণ দেহখানি। পিঠের দিকটা যেন কোন অরণ্যচারী পশু খুবলে দিয়েছে।
কিন্তু মেয়েটির দেহ পাওয়া গিয়েছে কোন জঙ্গলে নয়, ফেকলুরাজার চ্যালাদের শিবিরের পেছনে, গর্ত খুঁড়ে মাটিতে পোঁতা।
রাজার বিশেষ গুপ্তচর বাহিনী পাকা খবর এনেছিল। প্রধান সেনাপতি রাতেই হানা দিয়ে কাজটা সেরে ফেলেছিলেন।
আর মৃত কিশোরীর দু’জন সখী শনাক্ত করল চারজন অপহরণকারীকে। দেখা গেল ওরা সবাই ছুরিকলাঁ গাঁ থেকে আসা ফেকলুর স্যাঙাৎ। সেই লোকগুলো আবার সর্বসমক্ষে কবুল করল যে ওরা যা করেছে জামাইরাজার নির্দেশেই করেছে।
দরবারে একটা মৃদু গুঞ্জন উঠেই মিলিয়ে গেল।
একদিন পরে রাজা রায় দিলেন—অপরাধী চারজনের মৃত্যুদন্ড। হেঁটোয় কন্টক, উপরে কন্টক। আর ফেকলুরাজাকে নির্বাসন। আগামী চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে ওকে এই রাজ্য ছেড়ে চলে যেতে হবে। প্রধান সেনাপতি বিক্রমজিৎ সিংহকে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে যে উনি যেন আগামীকাল দশজন অশ্বারোহী সঙ্গে নিয়ে ফেকলুরামকে সূর্য ডোবার আগে রাজ্যের সীমানার বাইরে পৌঁছে দিয়ে ফিরে এসে কার্য সম্পন্ন হওয়ার পুষ্টি করেন।
তারপর যদি ফেকলুরামকে এই রাজ্যের ত্রিসীমানায় কোথাও দেখা যায় তখন তারও মৃত্যুদন্ড হবে।
রাজকন্যে লীলাকুমারী কাঁদলেন না। জামাইরাজার যাত্রার জন্যে দাসদাসীদের সাহায্যে সিন্দুক-তোরঙ্গ গুছিয়ে দিতে লাগলেন।
নিকষকালো কৃষ্ণপক্ষের রাত। দীপ জ্বলছে লীলাকুমারীর কক্ষে। আজ যে ওদের এই প্রাসাদে শেষ রাত্তির। রাজা এইটুকু দয়া করেছেন। তবে কক্ষের বাইরে পাহারা বসেছে।
দীপ জ্বলছে আর একটি ঘরে, জেগে আছেন বিক্রমজিৎ। অপরাধী ছয়জনের মধ্যে চারজনের মৃত্যুদন্ড , কিন্তু বাকি দু’জন এখনও ধরা পড়েনি। ওরা গা ঢাকা দিয়ে কোথায় আছে? কে ওদের আশ্রয় দিয়েছে? মহারাজের কড়া হুকুম। নির্বাসিত ব্যক্তিকে সীমানার ওপারে ছেড়ে সেনাপতি দ্রুত ফিরে আসুন আর বাকি দুই অপরাধীকে খুঁজে বার করুন।
সকাল হল। আজ আর নহবতখানায় সানাই বাজে নি। মহারাজ ভোর হতেই পূজোয় বসেছেন। একমাত্র জামাইকে নির্বাসনদন্ড দিয়ে আজ তাঁর মন অশান্ত। তিনি কি ভুল করলেন? ন্যায়ের বিধান? ব্যক্তিগত সম্পর্কের কোন মূল্য নেই? কিন্তু আর কোন উপায় ছিল কি?
এই বিয়েটা? নিজের দেওয়া বচনে নিজেই বাঁধা পড়েছিলেন তাই। লীলাকুমারীও তো চেয়েছিল। মেয়ের মন বুঝতে ভুল করেন নি।
এক অজ্ঞাতকুলশীল পাত্র! ভেবেছিলেন কাঠুরের ছেলে রাজপ্রাসাদে জামাই আদর পেয়ে সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবে। কোথায় কী? উলটে এমন সব ঘটনা! তাঁরই রাজ্যে?
খালি ভুলতে পারছেন না মেয়ের চোখের দৃষ্টি। কাল যখন দরবার শেষে ওর মহলে গিয়ে রাজধর্ম পালনের দায়িত্ব বোঝাতে গেছলেন, তখন মেয়ে চুপ করেছিল। না, একটুও কাঁদে নি, প্রতিবাদ করেনি। কিন্তু এক অদ্ভূত চোখে তাঁর দিকে তাকিয়ে ছিল।
(৭)
‘বিচার তোমার না হয় যেদিন, ততকাল তুমি নহ তো স্বাধীন,
বন্দী রয়েছ অমোঘ কঠিন ন্যায়বিধানের সূত্রে’।
ইতিমধ্যে নির্বাসিত জামাইরাজাকে নিয়ে প্রধান সেনাপতি বিক্রমজিৎ সিং রাজাদেশ পালনে রওনা হয়ে গেছেন। সূর্যাস্তের আগেই বন্দীকে সীমান্তের ওপারে পৌঁছে দিতে হবে। সঙ্গে কিছু রসদবাহী শকট ও দশজন অশ্বারোহী। সেনাপতি সতর্ক। তাই যাত্রাপথটি একটু বদলে নিয়েছেন। পথটি দুর্গম, কিন্তু সময় নেবে কম।
এই যাত্রাপথ পরিবর্তনের গল্পটি কিন্তু কেউ জানে না, স্বয়ং মহারাজও নয়। পরিকল্পনাটি ছকেছেন প্রধান সেনাপতি নিজে, সাহায্য করেছেন ওঁর মুখ্য সহকারী বীরভদ্র সিং। রাজ্যের এই এলাকা বীরভদ্র চেনেন ভাল। উনিই বলেছেন যে কথাটি মহারাজের থেকেও গোপন রাখতে। কারণ, ওঁর মনের অবস্থা ভাল নয়। যদি কোন দুর্বল মুহুর্তে মেয়েকে বলে ফেলেন। আর যদি সেই মেয়ে–!বলা তো যায় না। যখন বাধাবিপত্তি আসে, দলবেঁধে আসে। কাজেই সাবধানের মার নেই।
সূর্য ডোবে ডোবে। এখনও জঙ্গল বেশ ঘন। কিন্তু বীরভদ্র আশ্বস্ত করলেন-ব্যস, ওই সামনের টিলা পেরলেই। অগত্যা, বীরভদ্র যে এলাকাটা হাতের তালুর মত জানেন।
এমন সময় ঘটল বিপত্তি।
জামাইরাজা ওরফে ফেকলুরাম হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। খানিক আগে থেকেই ওঁর গা গোলাচ্ছিল। এখন শুরু হল প্রচন্ড বমি। পেট মুচড়ে মুচড়ে উঠছে জামাইরাজার।
বিক্রমজিৎ সিংয়ের মুখ শুকিয়ে গেল। আদেশ হল সূর্যাস্তের আগে বন্দীকে সীমান্তপারের প্রতিবেশি রাজ্যে পৌঁছে দিতে হবে। এ বাবদ প্রতিবেশি রাজাকে লেখা মহারাজের পত্রটি একটি রেশমি কাপড়ে মুড়ে ওঁর কোমরবন্দে বাঁধা রয়েছে। কিন্তু বন্দি যদি ভেদবমিতে আরও অসুস্থ হয়ে পড়ে? যদি মারা যায়? সঙ্গে একজন বৈদ্যও নেই যে! বিক্রমজিৎ আর ভাবতে পারছেন না।
বীরভদ্র আশ্বাস দিলেন। খানিকক্ষণ বিশ্রাম করা যাক। জামাইরাজার চোখমুখ ভাল করে ধুইয়ে দিয়ে গাছের নীচে একটি রেশমী চাদর বিছিয়ে শুতে দেওয়া হল। বমি বন্ধ হল। ফেকলুরাম বীরভদ্র সিংয়ের দিকে চেয়ে একটু বিষণ্ণ হাসলেন।
কিন্তু দ্রুত নামছে অন্ধকার। আবার অশ্বপৃষ্ঠে যাত্রা শুরু। সীমান্ত পেরোতে হবে, যত শীঘ্র সম্ভব। হ্যাঁ, জঙ্গল শেষ হতে আর বেশি দেরি নেই। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে আলোর ছটা। জনপদ এত কাছে?
একটা আলো এগিয়ে আসছে। সবার চোখ সেদিকে। সম্ভবতঃ প্রতিবেশি রাজ্যের লোকজন। ওদের কোন টহলদার সৈন্যদল?
আলোর বৃত্তটি ক্রমশঃ বড় হচ্ছে; হতে হতে বিশ্রামরত ফেকলু আর তার সহচর দলটির কাছে এসে থামল। জনা পঁচিশেক সশস্ত্র অশ্বারোহী। কয়েকজনের হাতে জ্বলছে মশাল। এরা কারা?
-কহাঁ হোহি ফেকলুরাজা? কহাঁ হমনকে যুবরাজ?
এগিয়ে এলেন বিক্রমজিৎ সিং, সতর্ক পদক্ষেপে। তোমরা কে? কহাঁ লে আওথ?
-আমরা? আমরা হলাম রাজা ফেকলোয়ার সশস্ত্র দেহরক্ষী। তুই কে বটিস?
–মুখ সামলে! আমি এই রাজ্যের প্রধান সেনাপতি। আর এই ফেকলুরাম কোন রাজা বা যুবরাজ নয়। এ হল এক বন্দী, রাজা যার ‘দেশ নিকালা’ আদেশ জারী করেছেন।
আগন্তুক দলের আর একজন এগিয়ে আসে।
বাজে কথা। আমাদের একজনই রাজা, –রাজা ফেকলুরাম। আর তুই ছুছুন্দর, তুই এখন আমাদের হাতে বন্দী।
বাকিটা আমরা পিপলগাছের ডালে বসা ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমীর মুখ থেকে শুনব।
বিক্রমজিৎ এর মত তলোয়ারবাজ এ রাজ্যে আর ক’জন আছে? তবু তিনি বন্দী হলেন? হ্যাঃ!
শুধু বন্দী? প্রাণটাও খোয়ালেন।
কাবর?
কাকর কাকর নাম লেবো? কা লা কা বাতাবো।
ন্যাকামি রাখ বেঙ্গি! মশালের আলোয় ঘুম গেল চটে, তারপর তলোয়ারে তলোয়ারে ঠন ঠন, মাঝেমধ্যে শিক শিক, ব্যস। এবার ঝেড়ে কাশ দিকি, তারপর ঘুমোবো।
বলার আছেটা কি? ও’রম দশজনের মহড়া নিতে উনি একাই যথেষ্ট, কিন্তু পেছন থেকে বীরভদ্র সিংয়ের বর্শা পিঠ দিয়ে ঢুকে পেট ফুঁড়ে নাড়িভুড়ি বের করে দিল যে!
বলিস কী রে! বীরভদ্র সিং? ঠিক দেখেছিলি?
বেঙ্গির চোখে তোমার মত ছানি পড়েনি। ভুল দেখবো কেন? ও হ্যাঁ, একবারই ভুল দেখেছিলাম, তোর সঙ্গে মালাবদলের সময়।
ব্যাঙ্গমাবুড়ো শুনেও শুনল না। বলল—তারপর?
মশালের আলোয় স্পষ্ট দেখলাম বীরভদ্র আর আগন্তুক দলের নেতা কোলাকুলি করছে। আর হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়িয়েছে ফেকলুরাম। ওর বমিটমি পেটব্যথা মাথাব্যথা সব ঠিক হয়ে গেছে।
বিক্রমজিতের সংগী ন’জন যোদ্ধা কিছু বোঝার আগেই কচুকাটা হল। অপকম্মের সাক্ষী রাখতে নেই।
আরে আসল ব্যাপারটাই দেখলি না? আগন্তুক দলের দুই নেতা হল ফেকলুর অপকম্মের সেই দুই গা-ঢাকা দেওয়া সংগী যাদের বিক্রমজিৎ খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন।
জানি জানি। ওদের খুঁজে পাবেন কী করে? ওরা তো লুকিয়েছিল যুবরাণীর মহলে।
কিন্তু প্রধান সেনাপতির ডানহাত বীরভদ্র, সে তলে তলে সাঁট করেছে ফেকলুর সঙ্গে। কী কান্ড!
ডানহাত না, বাঁহাত—যা দিয়ে মানুষজন নিত্যি অপকম্ম করে।
(৮)
দিন-দুপুরে চাঁদের উদয় রাত পোহানো হল ভার।
হল পূণ্যিমেতে অমাবস্যা চারিচক্ষু অন্ধকার।
এ রাজ্যে অমঙ্গলের ছায়া। কার যে কুনজর লেগেছে বোঝা দায়। নইলে যা কখনও ঘটেনি তা ঘটে? একটা বাচ্চা মেয়েকে কিছু নররাক্ষস খুবলে খায় আর সেই দলের দুটো দামড়া উধাও হয়ে যায়! লোকে বলছে—দিনের বেলা প্যাঁচা ডাকছে। হঠাৎ করে শুকিয়ে যাচ্ছে কুয়োর জল আর মায়ের বুকের দুধ।
ফেকলুরামকে সীমান্তপারে রেখে আসতে রওনা দিয়েছিলেন প্রধান সেনাপতি বিক্রমজিৎ সিং। দু’দিন হয়ে গেল এখনও ফেরেন নি, কোনও খবর নেই। মহারাজ দরবারে বসে বৃথাই অপেক্ষা করেন। আর লীলাকুমারী! খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিয়ে ঘরের মধ্যে ক্রমাগতঃ পায়চারি করে যাচ্ছেন। কঠিন মুখ, শক্ত চোয়াল, চোখ দুটো জ্বলছে।
এই ধাক্কা সামলাতে পারে নি রাজার বেয়ান—সেই ছোটকি ছুরি গাঁয়ের ছুতোর গিন্নি বুধবারিন বাঈ।
শেষকালে বেয়াইমশাই আমার ছেলেকে নির্বাসনে পাঠালেন? আমার একমাত্র ছেলেকে? আমার দিকটা একবারটি ভাবলেন না? কেন? পুরুষেরা ওমনিই হয়। ওদের তো আর পেটে ধরতে হয় না! কী করে বুঝবে ছেলে কী জিনিস? সারারাত ধরে এইসব সাতপাঁচ ভেবে বেয়াই মশাইয়ের এমনতরো ব্যাভারের নিজের মত করে মানে খুঁজে পেয়ে ভোরের দিকে সে নিশ্চিন্তে চোখ বুঁজল, আর খুলল না।
তৃতীয়দিন নগর সীমান্তের কোতোয়াল দূত মুখে আগাম খবর পেয়ে উর্দ্ধশ্বাসে ছুট লাগাল দরবারের দিকে। জনাকয়েক সৈন্য নিয়ে রাজার ছোট দলটি ফিরে আসছেন, নেতৃত্বে বীরভদ্র সিং। কিন্তু বিক্রমজিৎ কোথায়?
গজব রে গজব! কহাঁ গইস হমর সেনাপতি?
ওহি তো হ্যায়! পালকওলা সাফা সর পে ঘোড়ে পর সওয়ার।
রোঘা! বেররা! মরুটে পাজি বদমাস! তোর আঁখি লা ফুটে! চোখের মাথা খেলি নাকি? আমাদের সেনাপতিকেও চিনিস না?
আররে! উ দেখ , উ দেখ! উহো কৌন হাবে কালী ঘোড়ি পর সওয়ার?
হমনকে জামাইরাজা ফেকলুরাম নো হে?
হউ জি।
তবে কি মহারাজ জামাইয়ের শাস্তি মকুব করে দিলেন?
কিংকর্তব্যবিমুঢ় রাজদরবারে হাঁটুমুড়ে মাথা নত করে বসে আছেন বীরভদ্র সিং।
–আমাকে শাস্তি দিন মহারাজ! সেনাপতিকে ফিরিয়ে আনতে পারলাম না। উনি বীরগতি প্রাপ্ত হয়েছেন।
সীমান্ত এলাকায় আদিবাসী ডাকাতদের একটি দল আমাদের অতর্কিতে আক্রমণ করে-উদেশ্য জামাইরাজাকে অপহরণ করা। আমরা প্রাণপণে লড়েছি। দস্যুরা সব নিকেশ হল। অল্প ক’জন পালাতে পারল। আমাদের অধিকাংশ সাথী নিহত। জামাইরাজাকে রক্ষা করে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় আহত বিক্রমজিৎ অত্যধিক রক্তক্ষরণের ফলে মারা যান। দেহ নিয়ে এসেছি। তাই আমাদের ফিরতে দেরি হল। ওঁর শেষ ইচ্ছা–এখানে আহিরণ নদীর পাড়ে একটি পিপল গাছের তলায় সমাধিস্থ করা হোক।
শোন রে বেঙ্গি! বিক্রমজিতের শেষের কাজকম্ম বেশ ধূমধাম করেই হল, দেখলি তো?
ধ্যাৎ, এ কী বিয়ে না অন্নপ্রাশন? ধূমধাম করে? বলতে হয় ‘রাজকীয় সমারোহে’; তাও গলার আওয়াজ মোটা করে, চোখ নামিয়ে!
তুই কত কী যে জানিস বেঙ্গি! এই দেখ আওয়াজ বদলে চোখ নামিয়ে বলছি—এখন রাজ্যের নতুন প্রধান সেনাপতি বীরভদ্র সিং।
বীরভদ্র? ঠিক জানিস? তাহলে আমরা যা দেখেছিলাম?
চুপ, নইলে গাছের ঊপর আমাদের বাস উঠবে।
কেন চুপ করব? ওই লোকটাই তো—আমিই তো স্পষ্ট দেখেছিলাম।
এক্কেবারে চুপ। আমরা গরীবগুর্বো,আদার ব্যাপারী, জাহাজের খোঁজে কি দরকার?
আর মহারাজ? উনি তো লোক ভালো।
কিন্তু ওঁর এখন সময় খারাপ যাচ্ছে। কথায় আছে না—‘পুরুষ বলী নহি হোতে, সময় হোত বলবান’।
হ্যাঁ, হ্যাঁ। বেশি শোলোক ঝাড়িস না। পুরুষকার নয়, সময় হল আসল শক্তিমান।
ব্যস, সময় ভাল নয়। এখন মুখ খুলতে নেই। খুলব, তবে মওকা দেখে।
কিন্তু মহারাজ যে ধর্মসংকটে পড়েছেন।
ফের বড় বড় কতা! ধর্মসংকট আবার কী?
মানে ফিরে এসেছে জামাই। কিন্তু কোথায় তারে দিবি রে ঠাঁই? ঘরে না কারাগারে? ও যে রাজার ঘরজামাই।
সে কি! শাস্তি তো একবার ঘোষণা হয়ে গেছে। বীরভদ্র যাক, ব্যাটা ফেকলুকে সীমান্তপার করে জঙ্গলে ছেড়ে দিয়ে আসুক। কাঠুরের ব্যাটা কাঠ কেটে পেট চালাক গে।
না, না। কোন কোন সভাসদ বলছেন যে যারা ওই কিশোরীর ওপর অত্যাচার করেছিল তাদের তো প্রাণদণ্ড হয়েই গেছে। তাহলে ফেকলুকে নিয়ে আর টানাটানি কেন? ও তো জঙ্গলে শিকারে ব্যস্ত ছিল।
বাঃ, খুনিগুলো যে বলল সব ফেকলুর কথায় হয়েছে?
দূর! ও তো নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে মিথ্যে কথা। খুনিদের কথায় বিশ্বাস করে কি রাজার জামাইকে অমন কড়া সাজা দেওয়া যায়?
আরে খুনিগুলোকে রাজবাড়ির আঙিনায় তো উনিই এনেছেন। ছোটলোকদের মাথায় তুললে যা হয়! আর দু-দুটো খুনি যে এখনও ধরা পড়ে নি তার কী হবে?
অঃ ,ওরা? ওরা ভিনরাজ্যে পালিয়ে গেছে।
কিন্তু আমি যে দেখলাম জামাইরাজা ফিরে আসার সময় ওদের কালোঘোড়ার আগে আগে যেতে?
অ্যাই! তুই ওদের চিনিস? তুই কিচ্ছু দেখিস নি, আমরা কিচ্ছু দেখি নি।
(৯)
‘জঙ্গল জঙ্গল ঘুম কে দেখা,
বস্তি বস্তি ঘুমকে দেখা।
হর তরফ হরিয়ালি হ্যায়,
সির্ফ আঁখে সবকী খালি হ্যায়।‘
ধীরে ধীরে আবহাওয়া শান্ত হয়ে এল। বাতাসে শীতের আমেজ। টুপ টাপ করে খসে পড়ছে জীর্ণ পাতা। একটু একটু করে জীবন আবার পুরনো ছন্দে ফিরছে।
মানে? এর মানে হলঃ
ফুলগাছ ফুল দিচ্ছে,
ফলগাছ ফল দিচ্ছে।
গাভীরা দুধ দিচ্ছে,
মহাজনকে খাতক সুদ দিচ্ছে।
চাষী ক্ষেতে হাল দিচ্ছে,
কামার ঘোড়ার পায়ে নাল দিচ্ছে।
বৌ দুধ জ্বাল দিচ্ছে,
শাশুড়ি তাকে গাল দিচ্ছে।
কুমোর ভায়া বানায় হাঁড়ি,
নাপিতভায়া কামায় দাড়ি।
অ্যাই অ্যাই, এবার থাম তো! আমার জাতধম্মো তুলে ছড়া কাটতে হবে না। আমি তোকে বিনিপয়সায় কামিয়ে না দিলে তোকে আর রাজসভায় ভাঁড়ামো করে খেতে হত না।
মানে?
ফের মানে? এর মানে তোমার সিদ্ধির নেশা মাথায় চড়েছে। দেবরজি বলছেন উনি বিনিপসায় তোমার চুলদাড়ি না কাটলে কপালে দুঃখু ছিল। মহারাজ হলেন কেতাপসন্দ মানুষ। রাজসভায় গোঁফদাড়ি চুলের জট নিয়ে ঢুকলে তোমার বিদুষকের পদটি কবেই ফুরুৎ হয়ে যেত।
আর এক গেলাস দাও দিকি গিন্নি!
আর না, তোমার কথা জড়িয়ে যাচ্ছে।
ধ্যাৎ, আমার নেশাটেশা হয় নি। এই পৈতে ছুঁয়ে বলছি।
কিন্তু কিছু একটা হয়েছে। আজ একটু বেশি বকবক করছ।
বলছি তো আজকে আমার মনমেজাজ ভাল নেই।
-অ্যাই বিটলে বামুন! বৌকে না বলিস আমাকে বল। নিঘঘাৎ আজ রাজসভায় কিছু হয়েছে। আরে প্যাঁচে পড়লে আমি বেরিয়ে আসার উপায় বাতলে দেব।
হ্যাঁ, কথায় বলে না কাক ধূর্ত আর নাপিত ধূর্ত।
-আমায় রাগালে ভাল হবে না। আসল কথাটা বল তো! আজ কি আবার তোর জিভে দুষ্ট সরস্বতী ভর করেছিলেন?
নরসুন্দর বন্ধুর কথায় বিদুষক মাথা হেলিয়ে সায় দেয়। তারপর গুম হয়ে বসে থাকে। ভর সন্ধ্যেয় ওর আঙিনায় নিত্যিকার সিদ্ধির আসর। সদস্য মাত্র ওরা দুজন। আর রান্নাঘরের থেকে ব্রাহ্মণী জোগান দিচ্ছেন বেগুনভাজা, পলতাপাতার বড়া আর ধনেপাতার চাটনি।
বিদুষক আস্তে আস্তে মুখ খোলে।
হয়েছে কি, আজ দরবারে সবাই প্রশংসা করছিল—সুশাসনের, সুখশান্তির। এবার ফসল ভাল হয়েছে। গোলায় ধান উপচে পড়ছে, কোষাগারে খাজনা। এরমধ্যে একজন আবার জামাইরাজার তারিফ করে বলল- মহারাজ, আপনি নির্দোষ জামাইরাজাকে শাস্তি না দিয়ে বড়সড় পাপের হাত থেকে বেঁচে গেলেন। তাই কোসগাই পাহাড়ের দেবী প্রসন্ন হয়েছেন। এবার আপনার রাজ্যে ফসলের বন্যা।
এমন সময় মহারাজ আমার দিকে তাকালেন। বললাম-আমি একটি গান বেঁধেছি। অনুমতি হলে শোনাই।
উনি হাসিমুখে অনুমতি দিলেন।
-সে কি রে! তুই আবার গান বেঁধেছিস? এসব ব্যামো কবে ধরল?
আঃ, শোন না।
‘জঙ্গল জঙ্গল ঘুম কে দেখা,
বস্তি বস্তি ঘুমকে দেখা।
হর তরফ হরিয়ালি হ্যায়,
সির্ফ আঁখে সবকী খালি হ্যায়।‘
(দেখেছি দেখেছি বনপ্রান্তর,
গেছি জনপদ মানুষের ঘর।
ক্ষেতভরা ধান, সবুজ শ্যামল
তবুও শূন্য অক্ষিকোটর।)
–তারপর?
দরবার চুপ, কেউ কোন কথা বলছে না। মহারাজ হঠাৎ উঠে ভেতরে চলে গেলেন।
–বুঝলাম; এ রাজ্যে তোর বাস উঠলো বলে।
প্রকৃতির নিয়মে কিছুই স্থায়ী নয়। আজ গ্রীষ্মের দাবদাহ পোড়ায় তো কাল টানা বৃষ্টির চোটে নদীতে বান ডাকে। শরতের কাশফুলের দিন ফুরোতে না ফুরোতে জেঁকে বসে শীত। তেমনি ক্ষেতের ধান ঘরে উঠে নবান্নের গন্ধ ছড়ানোর আগেই এল দুঃসংবাদ।
রাজ্যের পশ্চিম সীমান্তে প্রজারা বিদ্রোহ করেছে। শুধু তাই নয়, ওদের দমন করতে পাঠানো একটি ছোট বাহিনীকে পরাজিত করে কিছু সৈন্যকে বন্দী করেছে।
মহারাজের রক্তচাপ বেড়ে গেল।
মন্ত্রী-পাত্র-মিত্র-অমাত্য সবাই একযোগে বললেন—ওদের আর বাড়তে দেওয়া উচিত নয়। এখনই কিছু করতে হবে।
তাই এবারের অভিযানে বীরভদ্র সিং একশ’ অশ্বারোহীর একটি বাহিনী পাঠাবেন ঠিক হল।
কিন্তু মহারাজ বললেন—না, এবারের অভিযানের নেতৃত্ব করব আমি।
ওঁর আদেশ—উনি ফিরে না আসা পর্যন্ত বীরভদ্র রাজাধানী ছেড়ে এক পা নড়বেন না। রাজকুমারী ও জামাইরাজার ভালোমন্দের ভার ওঁর ওপর। আপাততঃ রাজমহলের এক প্রকোষ্ঠে উনি থাকবেন।
মহারাজের মন আজ কুডাক ডাকছিল। টের পাচ্ছিলেন বয়েস হয়েছে। মেয়ের থেকে বিদায় নেবার সময় বললেন—শরীরটা ভাল নয়। বড্ড ক্লান্ত লাগছে। আজ যদি আমার একটি পুত্রসন্তান থাকত, তবে হয়ত এই সময় সব সামলে নিত।
লীলাকুমারী কিছু বললেন না। কেমন এক অদ্ভূত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।
তিনদিন পর গোটা রাজ্য জুড়ে যেন ঝড় বয়ে গেল।
বিদ্রোহ দমিত, রাজ্য শান্ত, কিন্তু রাজা ফেরেন নি। বয়সের ভারে ক্লান্ত শরীর এত উত্তেজনা এত ধকল নিতে পারে নি। সৎকারের আগে রাজবৈদ্য মৃতদেহের শরীরে কিছু অস্বাভাবিক চিহ্ন দেখে প্রশ্ন তুলেছিলেন, বিশেষ করে নীলচে ঠোঁট ও বিস্ফারিত চোখের মণি। কিন্তু লীলাকুমারী সেসব বুড়োবদ্যির চোখের ভুল ও বয়সকালের ভীমরতি বলে উড়িয়ে দিলেন।
দেখলি বেঙ্গি, দেখলি? এ রাজ্যের লোকজন কেমন বেয়াক্কেলে দেখলি? শেষকালে সিংহাসনে বসাল সেই কাঠুরের ব্যাটা লকড়হারা ফেকলুরামকে!
তো কী করবে? তোকে বসাবে?
ইয়ার্কি না; আর কেউ ছিল না?
আরে, অপুত্রক রাজা। একমাত্র কন্যাটি আদরিণী। তাই ফেকলু হল ঘরজামাই। মহারাজ নিজেই তো একসময় মেয়েজামাইয়ের হাতে রাজ্যপাট সঁপে দিয়ে বানপ্রস্থে যেতে চেয়েছিলেন, তবে?
তাহলে ভালই হল বলছিস?
দেখা যাক, বাকি ভালমন্দ সময় বলবে।
(১০)
ফেকলুরাম। নামটা বড্ড হালকা। মানে যে মহা ফালতু অথবা যে বড় বড় ডিং হাঁকে, চাল মারে। চালবাজ তো আর সিংহাসনে বসা রাজার নাম হতে পারে না, তাই রাজপুরোহিত পাঁজিপুঁথি ঘেঁটে গণনা করে জানালেন নাম হবে ‘রাজা ফোকলোয়া’।
এখন এই রাজ্যের নতুন রাজা হলেন জামাইরাজা– ‘রাজা ফোকলোয়া’।
দরবারে উনি একা নন, সঙ্গে বসেন রাণী লীলাকুমারী। ওঁদের যুগলে দেখে প্রজারাও বিগলিত।
দেখ গা, বিলকুল রামসীতা জইসন লাগথে?
হহৌ হহৌ, বরোবর!
নতুন রাজা কিছু কিছু নতুন নিয়ম করেছেন। যেমন বিদুষকের ভাঁড়ামো ওঁর পছন্দ নয়। এইসব হালকা ঠাট্টা তামাশায় মেতেই তো গোটা রাজ্য উচ্ছন্নে গেছে। ওসব চলবে না।তাই বিটলে বামুনকে বিদেয় করে দেওয়া হল।
কোথায়? জিজ্ঞেস করতে নেই।
রাণীমার গান-টান পচ্ছন্দ নয়। আরে লোকজন খালি গান বাঁধবে গান গাইবে তো কাজ করবে কখন?
কিন্তু সবচেয়ে বড় পরিবর্তন? দাঁড়াও বাপু, এদিক ওদিক ভাল করে দেখে নিই। সেই যে বলে না–দেয়ালের ও কান আছে?
হ্যাঁ, সবচেয়ে বড় পরিবর্তন হল দরবারে কোন নালিশ নিয়ে আসা চলবে না।
মানে? তাহলে প্রজারা ওদের দুঃখের কথা বলতে যাবে কোথায়? কার কাছে ফরিয়াদ করবে?
কেন? ওরা যাবে ওদের গাঁয়ের মোড়ল-মোকর্দম- পটেল—গুণাইত বা কোতোয়ারের কাছে।
সেখানে সুরাহা না হলে?
আরে, জেলায় যত রাজকর্মচারি আছে তাদের কাছে।
সেখানেও সমিস্যের নিদান না পেলে?
তখন ভগবানের কাছে। আ মোলো যা! দেখস নি, নতুন রাজ্যে এমন ভাল ব্যবস্থা যে আজ অবধি কেউ নালিশ জানাতে গিয়ে অসন্তুষ্ট হয়ে ফিরে আসে নি।
ফলে দরবারে রোজ রোজ বাজে লোকের ঘ্যানঘ্যানানি নেই। তাই রাজা-মন্ত্রী-পাত্র-মিত্র-অমাত্য সবার হাতে অঢেল সময়। ওঁরা সেই সময়ে দেশের উন্নয়নের জন্যে মাথা ঘামিয়ে অনেক ভালো ভালো নতুন নতুন চিন্তা করছেন।
আর রাজার সেই সব ইয়ারদোস্ত? সেই ছোটকি ছুরি গাঁয়ের ছেলেগুলো?
আরে ওরাই তো এখন জেলায় জেলায় রাজকর্মচারি, শান্তিরক্ষার দায়িত্বে আছে।
রাজ্যে শান্তি ফিরেছে।
তাই সকালে কাক-চিল ওড়ে আর সন্ধ্যেয় শেয়াল ডাকে।
কিন্তু একটা গান, মাত্তর কয়েক কলি, ধীরে ধীরে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। লোকে গুনগুন করছেঃ
‘জঙ্গল জঙ্গল ঘুম কে দেখা,
বস্তি বস্তি ঘুমকে দেখা।
হর তরফ হরিয়ালি হ্যায়,
সির্ফ আঁখে সবকী খালি হ্যায়।‘
রাজা মাঝে মাঝেই মৃগয়ায় বেরিয়ে পড়েন। তবে আগের মত ইয়ারদোস্তের সঙ্গে নয়। দেহরক্ষী বাহিনী ও রাণী লীলাকুমারী সঙ্গে সঙ্গে থাকেন। আজকাল জঙ্গলের ধারে শিবির করে রাতকাটানোর কথা শুনলেই লীলাকুমারী কেন জানি অস্থির হয়ে পড়েন। রাজা ফোকলোয়াকে একলা ছাড়তেই চান না।
এমনি এক বকুলফুলের গন্ধে ম’ম করা শ্রাবণরাতে শিবির পড়েছে কোসগাই পাহাড়ের কাছে, ছোটকি ছুরি গাঁয়ের পাশের জঙ্গলের ধারে।
সন্ধ্যেয় শ্রীকমল চালের ভাত আর হরিণের মাংস খেয়ে সবাই শুয়ে পড়েছে। কাল সকালে রাণীমা পূজো দিতে যাবেন কোসগাই পাহাড়ের উপর দেবীর থানে।
রাত্তির দো-পহর, শেয়াল ডেকে উঠল। প্রহরী ঘুমে ঢুলছে। রাজা ফোকলোয়ার চোখে ঘুম নেই। পা টিপে টিপে বাইরে বেরিয়ে এসেছেন।
বনের দিকে এগিয়ে চলেছেন রাজা।
না, ভুল হবার কথা নয়। এই তো সেই পায়ে -চলা –পথ, যেখান দিয়ে কাঠুরের দল জঙ্গলে ঢোকে কাঠ কাটতে।
এই তো সেদিন, মাত্তর দু-আড়াই বছর আগের কথা। তখন উনি ছিলেন পাশের গাঁয়ের গোবিনরাম কাঠুরের ব্যাটা ফেলুরাম। এত তাড়াতাড়ি ভোলার তো কথা নয়! এই পথ দিয়েই তো—
সেই নিকষকালো রাত, ঠিক আজকের মত। রাক্ষস-রাক্ষসী; এক পায়ের মল। সেই মল থেকেই তো দিন ফিরল। আজ উনি রাজা। উত্তেজনায় বুকে হাতুড়ির বাড়ি।
ব্যস, এই শিমূলগাছটা পেরোলেই আসল জঙ্গল শুরু।
পেছনে পায়ের শব্দ।
ক্ষিপ্রগতিতে ঘুরে দাঁড়ালেন রাজা, হাতে খোলা তলোয়ার।
–এ কী, মহারাণী তুমি? কী চাও? আমার পেছনে পেছনে কেন?
চাপা হাসির আওয়াজ।
–তুমি যে জন্যে মাঝরাতে গহন বনে ঢুকছ!
-তুমি জানো আমি কী চাই?
–আমি তোমাকে খোলা পুঁথির মত পড়তে পারি রাজন। তুমি চাও সেই মলজোড়ার আরেকটি, নইলে তোমার ঘুম হচ্ছে না।
-ঠিক ধরেছ গো! দেখ, এই একটি মল আমাকে কাঠুরে থেকে রাজা করেছে। জোড়ার অন্যটি পেলে কী যে হবে–!
–একটু ভুল হচ্ছে তোমার ফোকলোয়া। মল নয়, তোমায় রাজা করেছি আমি। তোমার কাঠুরে বুদ্ধিতে চললে–। ওই মল তো এখন আমার পায়ে। এর বাকি জোড়াটি পেলে আমাকেই দেবে। অন্য পায়ে বেশ মানাবে। আজ অবধি আমার অবাধ্য হও নি, আজকেও হয়ো না।
রাণী এবার তাকালেন রাজার দিকে, এক অদ্ভূত দৃষ্টিতে, সেই দৃষ্টি যা একসময় বৃদ্ধ মহারাজ দেখেছিলেন রাজপ্রাসাদে, লীলাকুমারীর চোখে। দেখেছিলেন আর শিউরে উঠেছিলেন।
ফোকলোয়া চোখ নামিয়ে নিলেন।
–বেশ, চল। কিন্তু এতে বিপদ আছে।
–তুমি তো জান আমি বিপদ নিয়ে খেলতে ভালবাসি,নইলে তোমায় বিয়ে করতুম না। আমিও তো তলোয়ার ধরতে জানি। আর ওরা দু’জন, সে ভেবেই বলা।
শিমুলগাছের বাঁক ওঁরা অনেকক্ষণ পেরিয়ে গেছেন। জঙ্গল এখন গভীর। হাওয়া নেই। সেই কৃষ্ণপক্ষের রাত। রাজা ফোকলোয়া ভেতরে ভেতরে চাপা উত্তেজনায় ভুগছেন। তলোয়ারের বাঁটে চেপে বসেছে হাতের আঙুল। অন্ধকার বটে! এবার লীলাকুমারী নিজের মেখলার আড়াল থেকে বের করে ফেলেছেন সেই মায়াবী মলের একটি। তার দীপ্তিতে পথ দেখে ওঁরা এগিয়ে চলেছেন। কোথায় সেই কোসম গাছ? আর রাক্ষস দম্পতি? বেঁচে আছে? ওরা যদি মরে হেজে গিয়ে থাকে তবে জোড়ার বাকি মলটা? সেটা এখন কার কাছে?
আচমকা একটা দমকা হাওয়ার বেগ, নড়ে উঠল গাছের পাতা। তারপর একটা বোঁটকা গন্ধ। কাছে, বেশ কাছে। আর শুকনো পাতা খড়মড়িয়ে উঠল। আসছে, কেউ আসছে। এলোমেলো জোড়া পদক্ষেপ।
ফোকলোয়া ফিসফিস করে বললেন—হাঁটু গেড়ে বস। ওরা যেই ঝাঁপ দেবে আমরা কোমর লক্ষ্য করে চালিয়ে দেব, তাতেই কাজ হবে।
পায়ের শব্দ থেমে গেল।
খানিকক্ষণ চুপচাপ। ফোকলোয়ার হৃৎপিন্ড যেন ফেটে যাবে।
আবার পায়ের শব্দ।
কিন্তু এ কী? পিছিয়ে যাচ্ছে কেন? দূরে সরে যাচ্ছে ? টের পেয়েছে? পালাচ্ছে?
হতাশ লীলাকুমারী ধাওয়া করার উপক্রম করতেই রাজা ওর হাত চেপে ধরেছেন।
না; দু’জোড়া পায়ের আওয়াজ , আলাদা আলাদা। এবার আওয়াজ আলাদা দুটো দিক থেকে আসছে।
রাণী বুঝতে পারলেন। ওরা গাছটাকে বেড় দিয়ে দু’দিক থেকে চুপিচুপি এগিয়ে আসছে। হামলা হবে অতর্কিতে, দুপাশ দিয়ে।
এরাও প্রস্তুত হলেন। বসেছেন উবু হয়ে এক হাঁটু মাটিতে ঠেকিয়ে। পিঠে পিঠ বিপরীত মুখ, দুজনেরই শক্ত মুঠোয় শাণিত তরবারি।
আচমকা আক্রমণ। খিলখিল হাসির সঙ্গে দু’পাশ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়েছে রাক্ষস ও রাক্ষসী। সঙ্গে চলল তলোয়ার। ওরা লাফিয়ে এড়িয়ে গেল। বেড়ে গেছে হাসির তোড়।
ফাটা বাঁশের মত আওয়াজে রাক্ষসী বলছে—আয় , আয়। এবার খেলা দেখবি, মজা টের পাবি। নেংচে নেংচে এগিয়ে আসছে রাক্ষসী, ঝাঁপ দিল। এবার দুজনেই একটু দেরি করে হাত চালালেন।
লেগেছে! লেগেছে! তরোয়ালের কোপ লেগেছে রাক্ষস রাক্ষসীর পায়ে।
আবার! আবার! কিন্তু রক্ত কই? ফিনকি দিয়ে কালচে রক্ত বেরোল কই?
এই আঘাত কি যথেষ্ট নয়?
শেষ চেষ্টা। দুজনে মরিয়া হয়ে প্রাণপণে তলোয়ার ঘোরালেন। কিন্তু তলোয়ার হাওয়া কেটে বেরিয়ে গেল।
কোথায় রাক্ষস রাক্ষসীর জোড়া?
হাউইয়ের মত আলোকরেখা মিলিয়ে যাচ্ছে দূর আকাশে। শোনা গেল আকাশবাণীঃ
–অনেক অনেক ধন্যবাদ রে! তোদের জন্যে কতদিন ধরে অপেক্ষায় ছিলাম! কত দিন! কত মাস! কত বছর? আজ আমরা শাপমুক্ত হলাম। এবার তোদের পালা। অপেক্ষায় থাক, যতদিন না তোদের থেকেও লোভী, নীচ, বেইমান, খুনে জোড়া এসে তোদের দায় নিয়ে নেয়।
অবাক কান্ড। হতভম্ব লীলাকুমারী দেখলেন রাজা ফোকলোয়ার চামড়া কুঁকড়ে যাচ্ছে, গায়ের লোম পোশাক ফুঁড়ে বেরিয়ে আসছে কাঁটার মত।
এ কী রাজন! তোমার চোখ, তোমার শণের মত চুল আর ছুঁচলো দাঁতের পাটি? তোমাকে চিনতে পারছি নে, তোমার দিকে তাকাতে পারছি নে! এ কী রূপ তোমার?
লীলাকুমারীর গলা চিরে আর্তনাদ বেরিয়ে আসে—রাজা! রাজা ফোকলোয়া!
কিন্তু এই ভাঙা ভাঙা খোনা খোনা আওয়াজ? এ কার কন্ঠস্বর? লীলাকুমারীর?
হেসে ওঠে রাজা। সব হারানোর হাসি।
–সখি, নিজের দিকে তাকাও একবার। তুমি আমি যে রাজযোটক। তবু মলটা যদি পেতাম!
আবার আকাশবাণীঃ
এই নে, এই নে সেই মল।
আকাশ থেকে উল্কার মত নেমে আসছে এক আলোর টুকরো—তীব্রবেগে পাক খেতে খেতে। মাটি ছোঁয়ার আগে সেই আলোকবৃত্ত এক আশ্চর্য মল হয়ে জড়িয়ে যায় লীলাকুমারীর পায়ে।
আনন্দে নেচে ওঠে সে, রাজার হাত ধরে দুটো পাক খেয়ে নেয়।
না, আফশোস করে লাভ নেই। এই অরণ্যে গড়ে তুলতে হবে নতুন রাজ্য। সে হবে এক শক্তিশালী রাক্ষসরাজ। রোজ সূয্যি ডুবলে শেয়াল ও হায়নার হাসিতে মুখরিত হবে রাজার দরবার।
হুক্কা হুয়া! হুক্কা হুয়া!
রাজা ফোকলোয়া! ফোকলোয়া!
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নভেম্বর চলছে। অনির সাথে আজ দেখা হবে তা জানাই ছিল। এই তো ক’দিন আগেই দেখা…..
বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..
এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..