ফেব্রুয়ারির দিনলিপি-রাতলিপি

ঋতো আহমেদ
ধারামুক্ত কবিতা
Bengali
ফেব্রুয়ারির দিনলিপি-রাতলিপি

০৭.০২.২০১৯

চোখের যন্ত্রণাটা আগের চেয়ে বেড়েছে। ভেতরটা ভেঙে কখন যে বেরিয়ে আসতে চায়!—কিন্তু আমি ঠিকই টের পেয়ে যাই ওর খরা। জলের জন্য ওর হাহাকার। কুরে কুরে খেতে চাওয়া চোখের জমিন যে ভেতরে ভেতরে উদগ্র মরুভূমি হয়ে আছে সেটাও বুঝি। তাই তো বেরিয়ে আসতে চেয়েও যখন কিছুই হয় না তেমন, তখন‌ই শুরু হয় যন্ত্রণা। আর, আগের চেয়েও বেড়ে যায় অনেকখানি।। আজকাল দূরদৃষ্টির কিছুই অবশিষ্ট নেই তেমন। কেবল কাছে এলেই জানতে পাই কতোটা দূরত্বের তোমার অবস্থান আমাকে শ্রান্ত করে। প্রশান্তি পাই কতোটা। কতোটা দূরে চলে গেলে মনে হয় কাছেই আছো। আমার একান্ত আপন হয়ে আমার অন্তর্গত বেদনার ভেতর নিজেকে সমর্পিত করেছো, নিঃশর্তে। আর,, নিঃসঙ্গ করেছো পৃথিবীকে।

২২:০০

দূরত্বের দরোজা খুলে ‘দূর’-এর কাছে আসার অপেক্ষায় আছি।
আজকের রাত—ওঃ রাত,—ওহ্—

ও দূর! দূরত্ব! এসো, এই উত্তাল চোখের ভেতর এই অথৈ জীবন সমুদ্রের অফুরান জলের মধ্যে ভালোবাসার মারণাস্ত্র নিয়ে সটান দাঁড়িয়ে যাও। শিকারী প্রেমিকার মতো ছুঁড়তে থাকো তোমার অতলস্পর্শী প্রেম। ওই বর্শা। ঘায়েল করো আমায় অযুত বাণে। আমার হৃদয়-রক্তের বানে ভেসে যাক এই বিশ্ব চরাচর।
যেন সকাল হলেই আগন্তুক ভোর আমার সমাধি রচনা করতে পারে। পৃথিবীর মৌন মায়ায় আমার অবগাহন-কাল আমার চোখের থেকে গড়িয়ে নামা ঢল পর্যন্ত আমার অনিচ্ছার রেশ ধরে নেমে আসতে পারে যেন এই মাটি এই ঘন কুয়াশায় ঢাকা এইসব রাত্তির এইসব স্বপ্নদর্শী একেকটি সময়-পরত একেকটি জীবন-ঘোর আমাদের কান্নার এই যে নৈঃশব্দ্যের বিপুল বিভূতি, কোন্ মায়াময় আঁধারে আমি আর কোন্ গহিনে লুকিয়ে রাখবো আমার ‘দূর’—আমার দূরতা—? বলো আমায়—
তোমার জন্য অপেক্ষার প্রহর এবার কবে আর ভাঙবে তুমি! এসো, এই উত্তাল চোখের ভেতর। এই উন্মুখ বুকের মধ্যে আছড়ে পড়ো। ও আমার বিষাদ ছুঁয়ে থাকা ‘দূর’ বিশ্বাস!, এসো—

০২:২০; উত্তরা

০৮.০২.২০১৯

যদি হায়েনা হ‌ই—যদি ঝাঁপিয়ে পড়ি—যদি কামড়ে দিই স্তনাগ্র তোমার,— কী বলবে একে ? আমার স্খলন ? নাকি আমার নয়— ‘আমি’ বলে যাকে তোমরা চেনো এদ্দিন— যার সৌম্য সুন্দর মুখ ও মনন বলে জানো— আমি ন‌ই সে,— আমার‌ই কোনো এক মুখ—কোনো এক মুখোশ তবে—..

তবে ‘আমি’ কে? লম্পট?

কী অদ্ভুত! কী আশ্চর্য তোমার শরীর! ভাঁজ খুললেই বেরিয়ে পড়ে জিভ—আলগা হয় শক্ত হয়ে লেগে থাকা নিপুণ মুখোশ। ঘন হয়ে নামে শ্বাস,/নিঃশ্বাস। কী বিস্ময়— কী বিস্ময়কর আয়না তোমার তুমি— উত্তল/অবতল ঢেউ— কী বিপুল সমতল তট!!—— চুঁইয়ে পড়ে লালা। বিকশিত হয় ভয়ানক চকচকে দাঁত। আমার আমাকে চেনাও তুমি। এই শেষ বিষণ্ণ বিকেল—ক্ষীণ আলোর সংলাপ আর, পৃথিবীর ধূসর ধূলোয় এমন পতন—এমন আকস্মিক মৃত্যুর সাথে শেষ চোখাচোখি— তুমিই পারো। হে নারী!, হে অগ্নি!,, হে আমার জন্মদুয়ার জঙ্ঘিণী!

১৮:২০; ফার্মগেট

০৯.০২.২০১৯

আলোর বাতাসা। এক টুকরো দাও, হাতের তালুতে আমার। নিয়ে যাই মুঠো করে।

১০:২০

১৫.০২.২০১৯

আমার যে বন্ধুটি প্রবাসী—বরফের দেশে থাকে, একটু ওমের জন্য ঘাপটি মেরে বসে থাকে ঘরে—গড়ম কাপড়ের ভেতর, কিংবা যে বন্ধুটি থাকে দূরে—সাত সমুদ্দুর ও’পারের ওই ধূ-সমুদ্র মরুর বুকে, নির্জন সূর্যের নিচে, তীব্র তাপে, নিদারুণ তেষ্টাতেও ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে গিয়ে, ডুকরে ওঠে প্রায়শই তার,— কান্নায় চোখ বেয়ে নেমে আসে জল, তার‌ই কথা শুনে,—শুনে শুনে হিংসে হয় আমার; আহা,, কতোদিন কাঁদিনি আমি। ভুলে গেছি কাদা মাটি জল মায়ার মধ্যে থেকেও মরুভূমি হয়ে আছি। ভেতরটা ভীষণ—ভীষণ শীতল, বরফ-নিথর হয়ে গেছে কবেই।

সব দেখে শুনে শেষে মহৌষধ দিলেন আজ ডাক্তার মহাশয়। ভাবলাম ঈর্ষার দিন এইবার হলো শেষ— হবে সমাপ্তি বোধহয়।

এক ফোঁটা দু’ফোঁটা করে দিলাম চোখেও। আহা, কান্না! আহা!… ক‌‌োথায় সে? দুমড়ানো মোচড়ানো ক‌ই? ডুকরে তো ওঠে না কিছুই? কেবলই গড়িয়ে পড়ে জল— চোখের থেকে চোখের.. চোখের থেকে মুখে,—আহ্—

ও আমার মা
ও আমার মাটি
ও আমার জল কাদা জল.. কান্না! আহা!

২৩:৪৩; উত্তরা

১৬.০২.২০১৯

সাত সমুদ্দুরটুকু পেরিয়ে যখন ভেঙে যায় ঘুম। অর্ধেক দিন এসে ঢুকে যায় আমার শিয়রে। আছড়ে পড়া পাখিদের দাম্পত্যের রাত্রিজল যখন চোখে আর মুখে আর— লেগে থাকে কর্ণকুহরে আমার এখনো। এই দিন—অর্ধেক দিনে শেষ হয়ে এসে—শুরু হয় আবার যখন— আমিও শুনি: শব্দের ধ্বনির ভেতর মায়াজালে পাক খেতে খেতে গড়িয়ে নামছে এক আশ্চর্য বৈভব। মধুর স্পর্ধা। স্পর্শানুভূতির আলোকময় উজ্জ্বল প্রখর একটি দিন; শুরু হচ্ছে আমার সময়-রেখায়। অথচ—

অপ্রস্তুত আমার বিছানা
অপ্রস্তুত আমার বিন্যাস
অপ্রস্তুত আমার বিভূতি

১০:৩০

অদ্ভুত আলস্য এসে ভর করেছে। ধীর ও স্থিতিশীলতায় আমার শব্দের শরীর এখন নৈঃশব্দ্যের বান। বিস্ময়, বিশ্বাস আর ঘৃণার বহুমুখীতায় নীরব তারা। বুঝতে পারছিলাম নৈকট্যের শূন্যতা পূরণে এবার আমাকে স্বাগত জানাতে হবে পাখিদের। কেননা একমাত্র পাখিরাই পারে সুর-কে জাগাতে। বায়ুকে সুরঞ্জিত করতে। তাই আমার হিংসার ধূলিকে উড়িয়ে দিয়ে একটা পাখি আঁকলাম আকাশে। তারপর একটা শিসও আঁকলাম। আর, পাখিটা উড়ে যেতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল মাটিতে। হতবুদ্ধি আমি বুঝতে পারিনি যে ঘৃণার গলায় কোনো শিস থাকে না, থাকে মারণাস্ত্র। এরপর আমি রৌদ্রের ঝড় চাইলাম। আঁকলাম উজ্জ্বল একাগ্রতা।

কী আশ্চর্য! পোড়ামাটির পৃথিবীটা মুহূর্তে ঝলমল করে উঠল। পাখিটার কানের কাছে ফিসফিস করে অন্য একটা পাখি এসে বললো ভালোবাসি। আমার অলস দুপুর ফুটে উঠলো গড়ম ভাতের ওমের মতোই। আঙুল গুলো আড়মোড়া ভেঙে টানটান হলো। কিছু একটা স্পর্শ করতে চেয়ে সমস্ত রুগ্নতাকে ত্যাগ করে বরাবর প্রসারিত হলো। লিখলো: এবার তোমরা ঠিকই শুনতে পাবে মুখর কলরব আর সেই প্রতিশ্রুত কামনার জলধ্বনি; জলা-জঙ্গল।

১৩:২৫

২২.০২.২০১৯

মহাকালের প্রগাঢ় এক চুম্বনই আমার ইহকাল। একটা পাথরের পাশে বসে আজ সারাদিন এই প্রতীতি ফুটে উঠেছে আমার সর্বাঙ্গে। যতোই আমি নিজের দিকে তাকাচ্ছি, আমার বাঁ চোখের কুঞ্চনে আমার ভাবনা-দগ্ধ দুপুর আজ স্বতঃসিদ্ধ বিগলনে মোহিত করছে মানুষের বোধগম্য আশা। বুঝতে পারছি, আমার জন্যই রাখা আছে বিস্তীর্ণ পিছুটান। আমার শরীরের শৈশব। আমার পাঠযোগ্য কৈশোর। আমার আকাঙ্ক্ষার বিপুল যৌবন-রোদ। আর রয়েছে অপরিণামদর্শী অপূর্ব ঈর্ষার তীব্র প্রণয়। এদ্দিন যেই সীমানা পেরিয়ে যেতে চেয়েছিলাম, যেই দাগ, যেই সীমারেখা নিরূপণ করতে চেয়ে জীবনের সীমান্তের দিকের ওইপারে যেই দৃষ্টি নিক্ষেপ করে এসছি এতোকাল, এর কোনো উত্তর আসলে কোথাও নেই ওখানে। সর্বাত্মক

আমার ইহকাল এক হিংসার ধূলি।
আমার ইহকাল এক অন্ধত্বের আলো।
আমার ইহকাল এক শুভ্র সাদা স্থৈর্য‌ও।
আমার ইহকাল নদ-স্রোতের মধ্যে গতিময়তাও।

আমাকে ভালোবেসে বাঁচিয়ে রাখতে হবে পৃথিবীকে। মূহুর্তের প্রশ্বাস উপুড় করা এই রৌদ্রময় দুপুর। ওঃ আমার নিঃস্বার্থ পাথর। ওঃ আমার নৈঃশব্দ্যের প্রত্যয়। শরীরের অশ্রুতপূর্ব অবাঞ্ছিত শব্দেরা—

১৪:২০

২৩.০২.২০১৯

কে মুখ ফিরিয়েছো? আর কেইবা চিরকাল জ্বলবে বলে মুখ এনেছো জলের কাছে? কেননা, আমিই জলধি। আমার‌ ভেতরেই আছে দীর্ঘ পরিব্যপ্ত হাহাকার। আছে অনুগামী থ‌ইথ‌ই। ঈর্ষাকাতর সুখ। ছলছল খুন। কে তাকিয়েছ এইদিকে? আমার বাসনার বিষাদঘন জল। আমার কামনার অস্ফুট প্রশ্রয়। মোড়ানো আগুন! কে? কে আমার অমোঘ মৃত্যুর সাথে যৌথ বাস্তবতায় এক অশ্রুসজল নদী? কেইবা সমর্পণ? অথচ, আমি—আমিই তো জলধি।

দাউ দাউ উত্তাপে তোমাদের চুম্বনের পবিত্র বিগলিত ভুল। কে মুখ ফিরিয়েছো?

২২:১২

২৪.০২.২০১৯

উদ্বাস্তুর মতো একটা পথ এসে উঁকি দিচ্ছে আমার হৃদয়ে। যখন, আমি তার চাক্ষুষ প্রেম সম্পর্কে সম্পূর্ণ নগ্ন এক অনুধাবন উপলব্ধি করতে পাই আর লিখে ফেলি শীতের শেষের এই ঝিরিঝিরি বসন্ত বাতাসটি যেমন—এমন-যে উদ্বাস্তুর মতো পথ হয়ে এসে তাকায় আমার হৃদয়-শরীরে। আর ঠিক তখনই উদ্বাস্তুর মতো একটা পথ আসে। লিখে ফ্যালে।

২৩:২৭

২৬.০২.২০১৯

আঙুলের মতো ঔদ্ধত্য আর হাতের স্পর্শের মতো ঔদার্য তোমার চোখে যে ঔদাসীন্য এনে দিয়েছে আজ আমি তার রূপ এই—কোথাও দেখিনি কখনো। জীবনের অনেক রঙের মধ্যে এও যে এক নির্জনতম রঙ। জীবনের অনেক ধ্যানের মধ্যে এও যে এক ধ্যানমগ্ন গতি। দীর্ঘশ্বাসের অনাঘ্রাত ব্যগ্র বকুল ওই চোখের সামনে সমস্ত‌ই ভেসে উঠছে আজ। ভেসে উঠছে আমার খুলে দেয়ার স্রোত। ভেসে উঠছে আমার অবাঞ্ছিত আর্তনাদ। অর্বাচীন পাপ। ভেসে উঠছে আমার খুলে দেয়ার দাগ। দাগের উপর ছড়িয়ে থাকা নির্ভার বিভাব আমার। ভেসে উঠছে আজ, আর—

আমি হয়তো কোনো বাঙময় দৃষ্টির অপেক্ষায় উন্মন হাহাকার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি এবং শতাব্দীর পর শতাব্দী পেরিয়ে যাচ্ছে, তবু তোমাদের শূন্য চোখে নদী নামছে না। স্তন্য নামছে না। রাতের বদলে পুষে রাখছো দীর্ঘ অন্ধকার। ও আমার অস্পর্শের রঙ.. ও আমার ধ্যানমগ্ন গতি…

২১:২৫

২৭.০২.২০১৯

কী আশ্চর্য দৈহিক পৃথিবী এই—
কী অদ্ভুত মানুষের মতো শরীর আমার!!

২০:১০

 

দিনলিপি-রাতলিপি (ফেব্রুয়ারি ২০১৯)

ঋতো আহমেদ। কবি ও প্রকৌশলী। পৈতৃক বাড়ি মুর্শিদাবাদ। জন্ম ময়মনসিংহ শহরের কালিবাড়ি বাইলেন, কর্মসূত্রে ঢাকায় বসবাস। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট থেকে শিল্প প্রকৌশলে স্নাতক। বর্তমানে একটি টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিতে পরিকল্পনা বিভাগের প্রধান হিসেবে কর্মরত। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ: 'শতাব্দীর অপার প্রান্তরে', 'ভাঙনের...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ