ফেরা

স্বাতী মুখার্জী 
গল্প
Bengali
ফেরা

দোতলা বাড়ি। কাঠের সিঁড়ি। দরজা খুলে ছাদ। রেলিং দিয়ে ঘেরা। উল্টো দিকে রাস্তা। রাস্তার পরে দূরে দূরে বন ঝোপ গাছ, গাছ ঝোপ বন। এই পর্যন্তই দেখে অরূপ। চোখ খুলেই কল্পনাতে দেখে। অরূপের ক্লাস টেন। একদিন ও ব্যালকনিতে বসে ছবিটা আঁকল। বাড়িটার ছবি। পেন্সিল স্কেচ। ভেতর থেকে ঠামি চেঁচিয়ে কি বলছে একটা কথা শুনতে মুখ ফেরালো,,, আর তখনই হাওয়ায় উড়ে ছবিটা নীচে রাস্তায়।

তুলে আনতে দৌড়লো। চারতলার দুটো ফ্যাট নিয়েই থাকে অরূপরা। নীচে নেমে দেখল ছবিটা হাতে নিয়ে একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটা অরূপের থেকে বছর তিনেকের ছোটোই হবে।

ছবিটা অবাক হয়ে দেখছে। অরূপ ওর সামনে যাওয়াতে চোখ তুলে তাকিয়েই বলল,  “এটা রুমনিদের বাড়ি। “

“রুমনি?” অরূপের জিজ্ঞাসা।

ছেলেটা আবার ছবিটার দিকে তাকালো। “এখানে না। মধুপুরে। অনেক দূরে। রুমনি আমার একটা দিদি হয়। আমার বাবার বন্ধুর মেয়ে।”

অরূপ ওর হাত থেকে ছবিটা নিয়ে নিল।” তাই নাকি। তুই কোথায় থাকিস?  নাম কি তোর?”

ছেলেটা হাসলো। “ঐ তো তোমাদের ফ্ল্যাটের কোনাকুনি রাস্তার ওপারের ফ্ল্যাটটা। মিল্টন আমার নাম। তোমাকে চিনি আমি। ইয়ং স্টারের নেটে তুমি প্রাকটিসে যাও। দারুণ খেলো তো!”

অরূপ একটু লজ্জিত হাসি হাসলো। “ঠিকাছে কোনও দিন ইচ্ছে হলে তোকে নিয়ে তোর রুমনি দিদির বাড়ি থেকে ঘুরে আসবো।”

মিল্টন এবার একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,”তুমি এই ছবিটা কি করে পেলে? “

অরূপ কাঁধ স্রাগ করল। “পাবো আবার কি? আঁকলাম তো আমি!”

মিল্টন ভ্যাবলা।”না দেখেই আঁকলে? গাছ গুলোও এক।”

অরূপ হেসে ওদের ফ্ল্যাটের দিকে দেখালো।”আসিস একদিন। চার তলায় থাকি।”

ঘরে এসে অরূপ অনেকক্ষণ ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকলো। কে নাকি এক রুমনিদিদির বাড়ি। কি জানি। রাতে শোবার আগে আর একবার দেখলো ছবিটা। তারপর ঘুমিয়ে পড়ল।

তারপর অরূপ সব ভুলেই গেল। ছবিটা থেকে গেল তাকের এক কোনে। ফাইনাল পরীক্ষার টাইম টেবিলে ডুবে গেল রাত দিন। তারপর পরীক্ষা শেষ। মন  ফ্রি। ছুটি। এর মধ্যেই ইয়ং স্টারের খেলার মাঠে মিল্টনের সাথে আলাপটা আলাপচারিতার বন্ধুত্বে এগিয়েছে। কথা শুধুই খেলা নিয়ে। নো রুমনি দিদি। বা সেই ছবি।

ছুটিতে বাড়ির সবাই মিলে সাতদিনের জন্যে দার্জিলিং।  দার্জিলিং এ ওরা যখনই যায় পরিবারের অনেকে দল বেঁধে যায়। বাজারের দিকে  একটা বাড়ির একটা অংশ ভাড়া নেয়। একটু চেনা জানা তারা। ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়ে পড়ে। তারপর যে যার মতো,  বা ছোটো ছোটো গ্রুপে গ্রুপে ঘুরে বেড়ায়। কেউ কেউ ম্যালেই ঘোরে। বসে থাকে। কারোর মহাকালের মন্দিরে প্রথমদিনই ওঠা চাই। কেউ জলাপাহাড়ের রাস্তায়,  কেউ রাজভবনের সামনে দিয়ে চিড়িয়াখানার দিকে। শহর। মেঘ, পাহাড় , গাছ। রেলিং দেওয়া রাস্তা। কিউরিও শপ। কুয়াশা,  ঠান্ডা। বৃষ্টি। ,,,,,,,, বেশ ভালো লাগে। আজ অরূপ একলা হাঁটতে বেরোলো। ম্যাল ঘুরে রাজভবনের ওদিক দিয়ে নেমে আবার কোন একটা রাস্তা ধরে উঠে শুনশান পথ। একদিকে খোলা প্রকৃতি। রাস্তার থেকে কোথাও কোথাও পথ উঠে গেছে। কোথাও নেমে গেছে। দূরে দূরে ঝাপসা পাহাড়। একটা  ওপরের দিকের পথের সামনে এসে অরূপ তাকালো। সেই বাড়িটা। মিল্টন তো মধুপুর বলেছিলো। অরূপ উঠে এল। জঙ্গলের ছায়ায় সেই বাড়িটাই।

শুকনো পাতা মাড়িয়ে ঢুকলো বাড়িটার ক্যাম্পাসে। কেউ থাকে না বলেই মনে হচ্ছে।  অরূপের বেশ সাহস আছে। কাঠের সিঁড়ি ভেঙে বারান্দার ওপর উঠতেই একটা মেয়ে দরজা ঠেলে বেরিয়ে এল। সাদা শার্ট। মালটি কালারের চেক স্কার্ট । গলায় স্কার্ফ । খোলা চুল। মুখে হাসি। “এতদিনে সময় হল? চিনতে পারছো? “

অরূপ অপ্রস্তুত। মুখে কোনও কথা নেই। হাসতেও ভুলে গেছে। কস্মিনকালে দেখেনি তো!

মেয়েটার মুখে সেই মিষ্টি হাসি।”এসো না! ভেতরে এসো!”

বারান্দার দরজা দিয়ে যে ঘরটা দেখা যাচ্ছে সেটাতে আবছা অন্ধকার। অরূপের ঘরে ঢুকতে ইচ্ছে হল না। “এমনি ঘুরতে এসেছি দার্জিলিং। নীচের রাস্তাটা দিয়ে হাঁটছিলাম। জঙ্গলের ভেতর বাড়িটা দেখে কি মনে হল উঠে এলাম। বাড়িতে আর কে কে আছেন? “

মেয়েটা অরূপের চোখের অতলে কেমন উদাস ভাবে তাকিয়ে আছে। যেন অনেকদূরের কিছু দেখছে। “সবাই আছে । এসো না! চিনতে পারোনি। না?”

অরূপ ভেতরে ঢুকে এল। ধুলো পড়া ঘর। এককোনে ভাঙা চোরা আসবাব। “না চিনতে পারছি না। এই বাড়ি টা তো পোড়ও বাড়ি! এখানে থাকো!” আশ্চর্য হয়ে তাকালো ওর দিকে।

মেয়েটার মুখের হাসি নিভে গেল। চোখ দুটো করুণ হয়ে গেল। ” তুমি আসবে বলে গেছিলে,  তাই যেতে পারি না আর কোথাও। এই ফটো গুলোর সাথেই থাকি।”

ভূত ব্যাপারটা অরূপের মাথাতেই এল না। পাগল ই হবে। কে জানে বাড়ির লোক একা কেন ছাড়ে?  অল্প বয়স। অরূপের বয়সীই হবে। হাসল অরূপ, “ফটোর সাথে থাকো। আর খাও কি এই ধুলো? বেরিয়ে এসো আমার সাথে। আসল বাড়িতে যাও এবার।”

উজ্জ্বল হয়ে উঠল আবার মেয়েটার মুখ। “চিনতে পেরেছো আমাকে?? খুশিতে চোখে জল।”

আরে আচ্ছা মুশকিল! অরূপ বলল, “তুমি আমার মতোই একজন। চেনার আর কি আছে। চলো এখন।”

মেয়েটা অনুরোধ করল, “একবার অন্তত এই ফটোটা দেখো! সব মনে পড়বে।”

অরূপকে দেওয়ালে টাঙানো একটা বিবর্ণ প্রায় ফটোর দিকে নিয়ে গেল। অনেকে আছে। কাউকেই  অরূপ চেনে না। ভালো কিছু বোঝাও যাচ্ছে না। তবে গ্রুপ ফটোর দুই প্রান্তে দুজন। একদিকে মেয়েটা। আর একদিকে কোন জন্মের অরূপ, অরূপ নিজেও জানে না। মুখ এবং বয়স এখনকার। বেশবাস টা আলাদা। চুলের স্টাইলটাও।

ছবি থেকে চোখ সরিয়ে এবার  মেয়েটার মুখে। ” তোমার কি ধারণা দুপাশের দুজন তুমি আর আমি?”

মেয়েটা হতাশ। “কিচ্ছুই মনে নেই তোমার।”

অরূপ ঘর থেকে বেরিয়ে এল। পেছোন পেছোন মেয়েটা। গেট পর্যন্ত এল। তারপর না হাসি না কান্না মুখে বলল,” তুমি একই রকম করে কথা বলো। তুমি সেদিন  বলে গেলে আসবেই। তারপর আর এলে না। আমাকে আম্মারা সবাই বলেছিলো ওরকম বলে সবাই,  দু’দিনের আলাপ মনে রাখবে না। কিন্ত আমার মনে হতো তুমি আসবেই।”

যদিও ফটোটা নিয়ে মনে বেশ খটকা, তবু
অরূপ গেট থেকে বেরিয়ে একটা সস্তির নিশ্বাস ফেলল। “বেশ। এলাম। দেখা হলো। তুমি খুশি হলে। এবার অন্তত বাড়ি চলো। সাপ বাদুড় ভাম টাম ও কি তোমার চেনা হয়ে গেছে? কি নাম তোমার? “

খুব মিষ্টি করে হাসলো মেয়েটা। “রোশনাই। নামটাও ভুলে গেছো!”

অরূপের এবার সত্যিই দেরি হয়ে যাচ্ছে। “ঠিক আছে রোশনাই, তুমি এখানে থাকতে চাইলে থাকো। আমি চললাম।”

অরূপ নামতে শুরু করল। নীচে রাস্তায় নেমে এসে একবার পেছোন ফিরে তাকালো। জঙ্গল । কোনও বাড়ি নেই। রোশনাই ও না।

এক ঝলক রক্ত বুকে চলকে উঠলেও অরূপ ভয় পেলো না। আধিভৌতিক ব্যাপার কিছু না থাকলে অরূপ ঐ বাড়ি টাই স্বপ্নে দেখে কেন?

এরপর যেকদিন ছিলো ঐ রাস্তায় আর হাঁটে নি। ঘটনাটা কাউকে বলেও নি। কলকাতায় ফিরেই মিল্টনের সাথে দেখা করল। “তোর রুমনিদিদির বাড়ি তে নিয়ে চল।”

মধুপুরে গেল দু’তিন দিনের জন্যে। সেই এক ডিজাইনের বাড়ি। রুমনি ওর বাবা মা কাকা কাকিমা সবার সাথে আলাপ হল। আসার কারণ হিসেবে নিজের আঁকা ছবিটা দেখালো। “পাগল করে দিচ্ছিলো। রোজ দেখতাম স্বপ্নে। যেদিন মিল্টন বলল,,,,, সেদিন থেকেই একবার আসার ইচ্ছে ছিলো,,,,”

রুমনি শুধু অবাক মুগ্ধতাতে তাকিয়ে থাকে অরূপের দিকে। অরূপ দেখে রুমনিকে। ভুল হয়ে যায় রুমনি নাকি রোশনাই? কাউকে কিছুই বলে না। রুমনিকেও না। দু’দিন ওরা অনেক গল্প করেছে,  বাড়ির লোকজন আশেপাশেই ছিলো। মিল্টন ছিলো। তারই এক ফাঁকে রুমনি কেমন আকুল ভাবে বলে উঠেছিলো, “খুব চেনা লাগে,  তুমি যেন আমার অনেকদিনের চেনা।”

অরূপ কোনও উত্তর দেয় নি। তাকিয়ে থেকেছিলো।

ফেরার দিন সবার সামনেই রুমনি  আকুল আবদারে জিজ্ঞেস করল, “আবার আসবে তো?”

সবার দিকে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে রুমনির চোখে এসে সেই দৃষ্টি থামিয়ে অরূপ উত্তর দিলো,” একদম। আর ভুল হবে না।”

ট্রেনের দুলুনিতে চোখ লেগে এসেছে। ফিরছে ওরা। জানলা দিয়ে উড়ে এসে গায়ে পড়ল একটা শুকনো পাতা। তুলে নিয়ে তাকালো অরূপ। রোশনাই এর হাসি মুখ। চোখে আর জল নেই। খুশি । শান্ত। টা টা করছে অরূপ কে। চোখ বন্ধ করে নিল অরূপ। হাওয়া এসে লাগলো গলায় চোখে মুখে। কে যেন পেলব স্পর্শে গলা জড়িয়ে ধরল অরূপের।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..