ফেলে আসা গন্ধের সন্ধানে

রুমা মোদক
গল্প
Bengali
ফেলে আসা গন্ধের সন্ধানে

ফেসবুকে ‘এলোমেলো তুমি’ আইডিটা বারবার আসছিলো সাজেসটেড ফ্রেণ্ড হয়ে। বেশ কদিন দৃষ্টি এড়িয়ে গেলে হঠাৎ একদিন প্রোফাইল পিকচার বদলে গেলে চোখ আটকে যায়। হিজাবে ঢাকা চেহারায় কোথাও একটা নস্টালজিক চেনা ছাপ। চোখের বিড়ালের মতো সবুজাভ মণিতে, হরিপদ কেরানির বাঁশির মতো টিকলো নাকে… কোথাও একটা চেনা চেনা ছায়া। মোবাইলের স্কিন থেকে  সেই ছায়া  আমার ভেতরে  সংক্রামিত হয়ে খুব তীব্র একটা আলোড়ন তুললে আমি আর ঘুমাতে পারিনা। অস্থির লাগে। বিড়ালের মতো নিঃশব্দ পায়ে বিছানা থেকে নেমে ল্যাপটপ নিয়ে ড্রইংরুমে আসি। লোপা টের পায় নি। পেলে কটমটিয়ে ইচ্ছেটাকে হত্যা করে দিতো। রাতে ঘুমের ডিস্টার্ব ও সহ্যই করতে পারে না।

ল্যাপটপ অন করে ফেসবুকে লগ অন করি, নিঃশব্দেই। এমনিতেই সন্দেহবাতিকগ্রস্ত লোপার অত্যাচারে আমার ইচ্ছে অনিচ্ছের বাঘে মোষে একঘাটে জল খায়। পারতপক্ষে কোনো মেয়ের ছবিতে লাইক কমেন্ট করি না। আজ মধ্যবয়সী এই নারী সকালে অফিস যাবার তাড়া, দ্রুত ঘুমের আয়োজন থেকে বিচ্যূত করে নিমিষে রহস্য গল্পের মতো নির্ঘুম আমাকে টেনে নিয়ে আসে অনিবার্য আকর্ষনে। আমি তার প্রোফাইলে ঢুকি, সব রেস্টিক্টেড। কোথাও কোন ইনফর্মেশন নেই চেনার মতো, সনাক্ত করার মতো। প্রোফাইলের ছবিটা ছাড়া কোনোই ছবি নেই।আমি নিশ্চিত হতে পারি না, এই বিড়ালচোখী, টিকালো নাক, ঘন আঁখিপল্লবের নারীটিকে নিয়ে।তবু কী এক অজানা আকর্ষনে, অদম্য কৌতুহলের কাছে পরাজিত হয়ে, লোপার চোখরাঙানি তুচ্ছ করে  আমার ফেসবুক ব্যবহারের রীতি ভঙ্গ করে  ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাই এক মধ্যবয়সী নারীকে। তারপর এক অতীত স্মৃতির তীব্র হুল গায়ে নিয়ে বহু বহু বছর পর পুণরায় রাত গভীর থেকে গভীরতর হলে ঘুমাতে যাই…।

দূর থেকে ডাকপিয়নকে দেখে চায়ের টং এর তুমুল আড্ডা পানসে হয়ে যায় আমার। আধখাওয়া চায়ের কাপখানা টেবিলে রেখে দ্রুত বাইরে আসি আমি, পিয়ন আমাকে দেখেই হাতটা বাড়িয়ে দেয়। পকেটে বাবার পকেট থেকে চুরি করে আনা ২০ টাকা। বুকটা টনটন করে। আজ সারাদিনের চা সিগারেট সব জলাঞ্জলি। সেসব বিবেচনা করিনা। টাকাটা পিয়নের হাতে দিয়ে নাজু আপার চিঠিখানা হস্তগত করি। টং দোকানের নির্দিষ্ট জায়গায় ব্লেডটা রাখা থাকে। সুকৌশলে আমি খামটা খুলি, সবগুলো হুমড়ি খেয়ে পড়ে।

” প্রিয়তমেষু নাজ

আজ সকালটা অন্যরকম, অন্যরকম শুধু তোমার জন্য। তোমাকে আজ সকালে একনজর দেখেছি শুধু। কলেজ থেকে ফেরার পথে তুমি কী আঁখি তুলে একটিবার দেখতে পারতে না আমাকে! অনন্তকাল আমি সাইকেল নিয়ে প্রতীক্ষায় থাকবো কলেজ গেটে…কবে, কখন তুমি একটিবার তাকাও আঁখি মেলে! ময়না আমি একজীবনের পর অন্যজীবন, জনম জনম তোমার প্রতীক্ষায় কাটিয়ে দেবো…লক্ষ্মীটি…”

চিঠির ভাষারা অতপর একটু হাত ঠোঁট ছুঁয়ে আবার ফিরে আসে  ঘাস মাটির বাস্তবতায়। আমাদের বিদ্রুপাত্মক পড়ার ঢংএ বেচারার আবেগ সব খেলো হয়ে ভাসতে থাকে পরিত্যক্ত ডোবায়। আমি ইয়ারদের সাথে ঝগড়া করে চিঠিটা অক্ষত উদ্ধার করি। যত্ন করে খামে ঢুকাই। আঠা লাগাই। ইয়াররা টিপ্পনী কাটে, শালা নিজেই নাজু আপার প্রেমে হাবুডুবু। আমার নাক চোখ মুখ কান গরম হয়ে বাস্প নির্গত করে, ধরা পরে যাচ্ছি এদের কাছে? নাজু আপার কাছে যতো প্রেমপত্র আসে সব কেনো আমার নিজের লেখা বলেই মনে হয় ইদানিং। ঠিক একইরকম ভাবে তো কালসকালে স্কুল ফেলে আমি দাঁড়িয়েছিলাম নাজু আপার প্রাইভেট স্যারের বাসার গেটে, নাজু আপা ফিরেও দেখেনি। ইয়ারদের কাছে নিজের ধুকপুক লুকাতে দ্রুত চিঠি হাতে রওয়ানা হই নাজু আপাদের বাসামুখী।

নাজু আপা নিমিষে ছোঁ মেরে চিঠি টা চালান করে দেন ব্লাউজের ভেতরে কোনো এক গোপন কুঠুরি তে। তখন এক অপার্থিব গন্ধ নাজু আপার ব্লাউজের রহস্য কুঠুরি ভেদ করে আমার নাকেমুখে ঝাপটা মেরে আমাকে মোহগ্রস্ত করে তোলে। তারপর নাজমা আপা আমাকে প্লেটে করে সেমাই খেতে দেন, খেতে দেন তরমুজ লিচু, পেয়ারা।আমি খেয়ে যাই, কিন্তু  গন্ধের মোহগ্রস্ততা থেকে আর বের হতে পারি না…। নাজু আপা কোথায় হাওয়া হয়ে যান, বিদায় নেয়ার জন্য আমি আর তাকে খুঁজে পাই না। এঘর ওঘর খুঁজি…। মেঝেতে জায়নামাজ পেতে বসে মাথা নিচু করে ঝুলে ঝুলে কোরান শরীফ পড়েন নাজু আপার আম্মা। নাজু আপার আব্বা টিভিতে আগের দিনের বিশ্বকাপ খেলার রিপ্লে দেখেন। নাজু আপা কোথাও নেই, কেবল ভীষন  জীবন্ত হয়ে জেগে আছে সেই অপার্থিব গন্ধ। গন্ধটা বুকে গভীর জড়িয়ে ধরে আমি দরজায় দাঁড়িয়ে থাকি, যেনো কোন ফোকড়েই গন্ধটা আমাকে ফেলে  পালিয়ে যেতে না পারে। হঠাৎ কোত্থেকে উদয় হয়ে আমার গালে চকাস চকাস চুমু খায় নাজু আপা। বলে কাল আবার আসিস। পাকা আম খাওয়াবো। আমি এবার ডুবে যেতে থাকি অথৈ গন্ধের সমুদ্রে। আর দিকবিদিক না পেয়ে পা বাড়িয়ে বাড়ির পথ ধরি…।

পরদিন অফিসে আমার মনেই থাকেনা অর্ধরাতের সেই  টিকালো নাক, ঘন আঁখিপল্লব, বিড়ালচোখী মধ্যবয়সী সেই নারীর কথা। স্বাভাবিক ভাবেই স্বাভাবিক কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। এমনকি ওয়াইফাইএর কারণে সর্বদা  অনলাইন হয়ে থাকা মোবাইলে টিং টিং করে ম্যাসেঞ্জারে মেসেজ আসার টিউন পেলেও আমার কাজে বিঘ্ন ঘটে না। আমি ফেসবুকে আসক্ত নই। জরুরী বেশ কয়টা ফাইল হাতে। শেষ হতে হতে লাঞ্চ ব্রেক, আপডেট অনলাইনে পাঠিয়ে আমি এবার রিলাক্স হয়ে ফোন হাতে নেই। ‘মানু’ স্কিনের উপরে ভাসতে থাকা সেই টিকালো নাকের নারীর মেসেজ। আমার কোথায় কোনজায়গায় খুব জোয়ার জাগে হঠাৎ। সব ভেঙেচুরে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। কতোদিন এ নামে কেউ ডাকেনা আমায়। আমি নিশ্চিত হই, যে দ্বিধাজড়িত নস্টালজিয়ায় হাতড়ে মরছিলাম আমি, এ সেই। কতোদিন পর। ক-তো-দি-ন!

ম্যাসেঞ্জারে  যাই রিপ্লাই দেবো বলে, দেখি উনি নেই।  এক্টিভ ওয়ান আওয়ার এগো। তবু রিপ্লাই রাখি। কোথায় তুমি? ঠিকানা দেবে? ফোন নাম্বার? একটিবার দেখা করতে চাই। কথা বলতে চাই। তারপর কী হয়, আমি আর কাজে মন বসাতে পারি না। বারবার ম্যাসেঞ্জারে ঢুকি। কোনো রিপ্লাই এলো কিনা। এমনকি শুভ সন্ধ্যা মার্কা সূর্যাস্তের ছবিগুলো ম্যাসেঞ্জারে ঢুকলেও আমি  কেঁপে ওঠছি। অন্য কারো ম্যাসেজ দেখলেই মেজাজ চড়ে যাচ্ছে পারদের মতো। কাঙ্ক্ষিত রিপ্লাই না পাওয়ার অস্থির অপেক্ষা আমাকে নানা ভুলে প্ররোচিত করছে। আমি চায়ে চিনি বেশি দেয়ার জন্য এম এল এস এস কে গালি দিচ্ছি, শব্দ করে দরজা লাগানোর জন্য ক্যাশ সহকারিকে….আমি নিজেই নিজের অসীম অসহিষ্ণুতার ব্যাখ্যা খুঁজে পাচ্ছি না। ২৫ বছর আগে শুরু এবং শেষ হয়ে যাওয়া কোনো ঘটনা নিয়ে আমাকে এই পর্যায় আর বয়সের সাথে সামঞ্জস্যহীন অস্থিরতা  মোটেই মানায় না। কোনো প্রয়োজন আছে  এর ?

এরপর কী হয়, নাজু আপার কোন চিঠি আর আমি আর ইয়ারদের নিয়ে চায়ের টঙে খুলি না। এরজন্য অবশ্য আমার বেশ কদিনের পকেট খরচ খসে যায়। একসাথে কয়েকদিনের টাকা একসাথে করে ডাকপিয়নকে দিতে হয়। তারপরও নিজের স্কুল, প্রাইভেট সব ফেলে পিয়ন আসার সময়টাতে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় বেতনভোগী পাহারাদারের মতো।পিয়নের কোনো বিশ্বাস নেই, অন্যকেউ টাকা বিশেক ধরিয়ে দিলে তার হাতেই চিঠিখানা ঠিক দিয়ে দেবে। যদিও জানি নাজু আপার চিঠি নিয়ে আমার মতো মাথাব্যথা কারোরই নেই,তবু সাবধানের মার নেই। পিয়ন রাস্তায় পেয়ে চিঠিগুলো আমার হাতে দেয়, আমি  চিঠিগুলো নিয়ে বাসায় গিয়ে সুনিপুণ কৌশলে খুলে পড়ি, আবার আঠা লাগিয়ে যথারীতি তাঁর বাড়িমুখো হাঁটা দেই আর তার ব্লাউজ ফুঁড়ে উড়ে আসা অপার্থিব  গন্ধ নিয়ে মোহগ্রস্ততায় বাড়ি ফিরি। ঘুমের ঘোরে তার ভেজা বগল, ঠোঁটের উপর জমে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘাম আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে চলে অন্য কোনো জগতে, পুরুষ হয়ে ওঠার জগতে।ক্রমাগত নিজের শরীর মনের বদলে যাওয়া জগতে।

বাকি ইয়াররা প্রথমটায় ধরতে পারেনি।  নিয়মমতোই চলছিলো কাজ খুঁজে না পাওয়া  বিকেল- বিকেল,আর অলস দুপুর- দুপুর  আমাদের চা-ডালপুরির আড্ডা। মোহন সিনেমা হলে নবাগত সিনেমা আর আটার বস্তা খ্যাত গার্লস স্কুলের সবচেয়ে মোটা মেয়েটাকে নিয়ে ঠাট্টা তামাশা। এরমধ্যে একদিন ডাকপিয়ন চায়ের দোকানে ডালপুরি খেতে ঢুকলো আর সবাই সচকিত হয়ে ওঠলো।  হঠাৎ  বাঁক বদল করলো আড্ডার গতিপথ। আলোচিত সব প্রসঙ্গ অতলে তলিয়ে গিয়ে ভেসে ওঠলো চিঠি প্রসঙ্গ। সবার মনে পড়ে গেলো নাজু আপা আর তার চিঠিগুলোর কথা। ব্যাপারটা খুব জরুরী বটে। যে নাজু আপার প্রেমপত্র প্রায় সপ্তাহে তিন চারবার আসে,আজ মাস দুয়েক তার কোনো চিঠিই আসে না, এটা অষ্টম আশ্চর্য হয়ে প্রতিভাত হলো তাদের কাছে। ঠিকঠাক দিন-মাসের হিসাব হয় না বটে,তবে তারা অবাক বিস্ময়ে আবিষ্কার করে অনেকগুলো দিন নাজু আপার প্রেমপত্র খোলা হয় না, পড়াও হয় না।

মূলত নাজু আপা শহরের বিখ্যাত সুন্দরী। ডাক্তার বাবার পরীর মতো তিনকন্যার বড় কন্যা। শহরের অগ্রজ, সমবয়সী এমন  কেউ নেই তার প্রেমে পড়ে নি আর প্রেমপত্র লেখে নি। আমরা তার পাড়ার অনুজরা সেসব চিঠির প্রথম পাঠক।আমাদের ঠিক নখদর্পণে কবে কার চিঠি আসবে। কিন্তু শহরের সবচেয়ে অভিজাত বাড়িটিতে সব ইয়ারদের মাঝে  কেবল আমার অধিকার ছিলো  প্রবেশের। তার একমাত্র কারণ তার বাবার সাথে আমার বাবার ছেলেবেলার বন্ধুত্ব।

আমার এই ঈর্ষনীয় অবাধ যাতায়াতে এমনিতেই ইয়ারদের চোখ টাটাতো, তারউপর সেদিন  ডাকপিয়ন যখন অপ্রত্যাশিত হাড়ি ভেঙে দিলো সবার সামনে তারা আমাকে বাগে পেলো যেমন বড়শিতে আটকানো মাছ। নাজু আপা আমার  থেকে বয়স পাঁচ বড়। তার প্রতি আমার যে অনিবার্য আকর্ষন তার মর্যাদা বোঝার মতো গভীরতা এদের বোঝার কোনো কারণই নেই,কাজেই ধরা পরা যাবেনা। ইয়ারদের ক্রমাগত চাপ, আক্রমণ আর ঠাট্টায় ক্ষতবিক্ষত হতে হতে আমার কী হয়, আমি সত্যটা প্রকাশ করে দেই আত্মরক্ষার খাতিরে।

সকালে অফিস যাবার তাড়ায়, দ্রুত ঘুমিয়ে পড়ার অভ্যাস হলেও আমার ঘুম আসে না। ফেসবুক আমি চালাই বটে, কিন্তু মোটেই এডিকশন নেই। লোপার দারোগাগিরির ভয়ে মেয়েদের সাথে তো পারতপক্ষে বন্ধুত্বই করিনা। পুরুষ কারো সাথেও হাই হ্যালো করি না। বড়জোর টাইমলাইনে চোখ বুলিয়ে ইরানের নির্বাচন, সৌদি প্রিন্স,খুলনার মেয়র নির্বাচন… ইত্যাদি সারিবদ্ধ নানা কিসিমের স্ট্যাটাস পড়ে ঘুমিয়ে যাই। অবশ্য মাঝেমাঝে বন্ধুদের ম্যাসঞ্জার গ্রুপে নানা আদিরসাত্মক কার্টুন লোপাকে পড়ে শোনাই আগ্রহ ভরে, লোপাকে যদি একটু আনন্দ দেয়া যায়।যেমন আজ যে কার্টুন টা এসেছে, স্ত্রী বাপের বাড়ি গেছে, স্বামী ফোন করে জানতে চাইছে, কনডম কোথায় রেখে গেছো? স্ত্রী পাল্টা জবাব দিচ্ছে আমি নিয়ে এসেছি, এসব এখানে পাওয়া যায় না।লোপা শুনে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি যায়।

 লোপা আনন্দিত হয় বটে, আমাকে পাল্টা চোখ রাঙায়।  সাবধান তুমি এসব দিতে টিতে যেও না। আফটার অল তুমি একজন সিভিল সার্ভিসিয়ানের হাসব্যাণ্ড।আমি চুপ করে মেনে অতি বাধ্য স্বামীর মতো মোবাইল বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়ি। কিন্তু আজ ঘুম আসে না। আজ ম্যাসেঞ্জারের একটা মেসেজ আমাকে আকুল আহবানে উন্মাতাল অস্থির করে রাখে। আমার ঘুম আসে না। কতোক্ষন পরপর মোবাইল অন করে ফেসবুকে ঢুঁ মারি। লোপা গভীর ঘুমায়। কিচ্ছু টের পায় না। কিন্তু কোথায় কী!

দিন তিনেক অপেক্ষার পর যখন আমি অপেক্ষা প্রায় ছেড়ে দেই, সময়মতো ঘুমিয়ে পড়ি,সময়মতো জাগি, অফিস করি,ছেলে মেয়ের খাতাপত্র কিনে আনি, লোপার ধমকের ভয়ে টকশোর উত্তেজিত কথা কাটাকাটি মাঝপথে রেখে টিভি বন্ধ করে যথারীতি ঘুমিয়ে পড়ি। তখনই একদিন মধ্যরাতে টুং করে মোবাইলে মেসেজ আসার সংকেতে আমার পাতলা ঘুম ধুম করে ছুটে যায়।আমার অন্তরে কেউ একজন দ্রিম দ্রিম মৃদঙ্গ বাজায়। আজীবন সিদ্ধান্তহীনতার দোলাচলে ভোগা আমাকে সেই দ্রিম দ্রিম আওয়াজ এই প্রথমবার ঘেমে নেয়ে স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছায়,কোনো এক অলৌকিক কারণে। আমি কাঁপা হাতে নিশব্দে মোবাইল হাতে নেই। ফেসবুকের ম্যাসেঞ্জারে ঢুকি। হ্যা, তার মেসেজ। ঢাকাতেই আছি। তুই কেমন আছিস মানু? আমার ফোন নাম্বার…। সেই রাত আমার নির্ঘুম অসহনীয় হয়ে ওঠে…। রাতের অন্ধকার সহ সমস্ত চরাচর গভীর ঘুমে নিমগ্ন। কী দুঃসহ সেই রাত কাটানো!  কী অপার নিঃসঙ্গতায় অস্তিত্বের ভিত্তিমূল কাঁপিয়ে দেয় সেই রাত! আমি নিজেকে নানা প্রবোধে শান্ত করতে চাই, কী আশ্চর্য!  ফোন নাম্বার রয়েছে, ঠিকানা রয়েছে, চাইলেই আমি যোগাযোগ করতে পারি। শুধু শুধু এই অস্থিরতার কোনো কারণ তো নেই! তার জন্য এমন কী এতো অস্থির হতে হবে! প্রবোধ দেয়ার চেষ্টা করি বটে, সেই প্রবোধ আর ভেতরের অস্থিরতা অবধি পৌঁছায় না।বাইরের এলোমেলো ভাবনাতেই ধাক্কা খেয়ে খেয়ে ফিরে যায়।

মূলত সত্যটা এই যে, শহরের নানা বয়সী প্রেমিককুল নাজু আপার উদ্দেশ্যে ক্রমাগত প্রেমপত্র লিখে গেলেও নাজু আপা একমাত্র একজনকেই ভালোবাসে। যদিও তাঁর জন্য সবচেয়ে বেশি উন্মাদ উকিল বাড়ির বড় ছেলে। এসবের সাক্ষী আমি। নাজু আপা উন্মাদের মতো অপেক্ষা করে তাঁর গানের শিক্ষক স্বদেশ বাবুর জন্য। আর নাজু আপার জন্য বিদেশের স্কলারশিপ ফেলে উন্মাদ হয়ে দেশে ফিরে আসে উকিল বাড়ির বড় ছেলে। নাজু আপার ডাক্তার বাপ আর উকিল বাপ দুজনেই রাজি। দুজনে রাজি দু কারণে,একদিকে উকিলের ছেলের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ আটকে আছে নাজুর কারণে, অন্যদিকে প্রভাব প্রতিপত্তি অর্থ বিত্তে উকিলের ছেলেই শহরের সবচেয়ে যোগ্য পাত্র নাজু আপার জন্য। অতএব দুয়ে দুয়ে চারের দিকেই আগাচ্ছিলো সব ঘটনা পরম্পরা। কিন্তু সত্যটা জানতাম একমাত্র আমি। নাজু আপা বিয়ের আগের দিনই স্বদেশ ওস্তাদজীর সাথে ইণ্ডিয়া চলে যাবেন। সেখানে দুজনে গানের স্কুল খুলবেন। স্বদেশ ওস্তাদজীর বড় ভাই সব যোগাড়যন্ত্র করে রেখেছেন। নাজু আপা ভেতরে চাপা শুঁটকি ভরা পিঠা খেতে খেতে সেদিন আমার মাথার দিব্যি দিয়ে কথাগুলো বলছিলেন। এতোদিন হজম করে রাখলেও আজ আড্ডায় ব্যাপারটা ফাস করে দেই আমি, কিছুটা আত্মরক্ষার তাগিদে, কিছুটা হয়তো নাজু আপার কাছে আমার গুরুত্ব প্রমাণ করে বাহাদুরি প্রমাণ করার জন্য!কিন্তু তারপরই হঠাৎ সব কেমন পাল্টে যায়! কেউ একজন সব জানিয়ে দেয় নাজু আপার আব্বাকে।একদিন  কলেজ থেকে ফেরার পথে নাজু আপা আমার দু গালে গায়ের জোরে দুই থাপ্পড় দিয়ে সব সুগন্ধ কেড়ে নেন। আমি আর নাজু আপা দুজনেই দু বাড়িতে বন্দী হয়ে যাই। নাজু আপার বাড়ি আমার জন্য আর স্বদেশ ওস্তাদজীর কাছে চিরকালের জন্য নিষিদ্ধ হয়ে যায়। শুনতে পাই দুই ধর্মের এই প্রেম নিয়ে শহরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার উপক্রম।  পাড়ার ছেলেদের ক্রমাগত হুমকির মুখে স্বদেশ স্যার দেশ ছেড়েছেন। নাজু আপার মনোযোগ বঞ্চিত যুবকের দল অগ্নিতে ঘি ঢালছে অতিউৎসাহে।

হিন্দু ছেলের সাথে যে মেয়ের প্রেম তাকে বিয়ে করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে স্কলারশিপের উদ্দেশ্যে দেশ ছেড়েছে উকিলের বড় ছেলে। আমিও এস এস সির বেড়া টপকে কলেজ পড়তে চলে আসি রাজধানীতে। আর খবর রাখি না নাজু আপার। কার কাছেই বা জানতে চাইবো। আমার একটা বোকামীর জন্য নাজু আপার জীবন উলোটপালোট হয়ে গেছে। আমার প্রতি তার এতো স্নেহ এতো আদর, তার প্রতি আমার অমোঘ আকর্ষন সবকিছুর প্রতিদান দিয়েছি বোকামী দিয়ে! এমনই বোকামী, যে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে দুটো জীবন। তার খবর জানতে চাওয়ার আর তো মুখ নেই আমার!

সেই নাজু আপার সাথে দেখা করতে যাবো আজ। পঁচিশ বছর পর। লোপার কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের ভয় উপেক্ষা করে বিবাহিত জীবনের ১৮ বছরে যা করি নি, তাই করি।নিজের কৌতুহল দমন করতে না পেরে ড্রাইভারকে বিদায় দেই, গাড়ির স্টিয়ারিং নিজের হাতে নিয়ে রাজধানীর প্রাগৈতিহাসিক জ্যাম ঠেলে চলতে থাকি দোহারের দিকে। সেখানেই একটা কলেজে পড়ায় নাজু আপা।  জানি না পৌছাবো কখন, ফিরবোই বা কখন। ফোনটা অফ করে দেই। লোপার রুদ্র দৃষ্টি আর কর্কশ কৈফিয়তের পিছুটান ভুলে গাড়ি চালাতে থাকি।

টিমটিম করে জ্বলতে থাকা বারান্দার বালব ছুঁয়ে বৃষ্টির পানি পড়ছে টুপটাপ। দেয়ালে এলোমেলো নকশা আঁকা শ্যাওলা। মাটির প্রলেপ। দেয়াল ঘেসে বেড়ে ওঠা নানা প্রজাতির ঘাস। বাড়িটিতে ঢুকলেই জানা হয়ে যায় এ এক প্রানহীন মনুষ্য নিবাস। এখানে মানুষ থাকে বটে প্রান থাকে না। দুবার কলিংবেলের সামনে হাতটা নিয়ে আবার ফিরিয়ে আনি, দেখা কী করবো নাজু আপার সাথে?

শেষবার তবু ডাক পাঠাই, কে… এক নিরীহ অথচ পোড় খাওয়া কন্ঠের রেশ কাটতে না কাটতে দরজা খোলে যে দাঁড়ায় তাকে আমি চিনি। তার টিকালো নাক চিনি, ঘন আঁখিপল্লব চিনি, বিড়ালচোখ দৃষ্টি চিনি শুধু চিনতে পারি না সেই চোখের বদলে যাওয়া দৃষ্টি। চিনতে পারি না মোহময় ভাঁজগুলোর এই পোড় খাওয়া বদলে যাওয়া! মানু – নাজু আপার বিস্ময় আমাকে ভেতরে ডাকে। আয় ভেতরে আয়, বস…। আমি সেই গন্ধটা খুঁজি, অপার্থিব গন্ধ। না পাইনা। একদমই পাই না। নাজু আপার আকুল আহবান উপেক্ষা করে আমি ফেরার পথ ধরি। অপার্থিব গন্ধহীন নাজু আপা তো যে কোনো নারী! কী হবে তার ডাকে সাড়া না দিলে?

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..