বট মানে গরুর ভুঁড়ি

নাসিমা আনিস
গল্প
বট মানে গরুর ভুঁড়ি

দ্বিতীয় বিয়েটা করেছিলো একটা কারণেই, পরিষ্কার হাতে ভুঁড়ি ধুয়ে খাওয়াবে। এমনভাবে পরিষ্কার করবে যেন পরিষ্কার করার পরই কাঁচা ভুঁড়ি কচকচ করে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছা হয়। বিয়ে করার সময় শর্তও দিয়েছিলো -সিগরেট খাই না, বিড়ি খাই না, পানও খাই না, খাই একটু বট। সপ্তাহে অন্তত দুই দিন গরুর বট পরিষ্কার করন লাগবো, গাইগুই করলে চলবে না।

ওস্তাদ ছুতোর মিস্ত্রী ফকা বলে, এই একটা কাম করার জন্য কেউ আরেকটা বিয়া করে, আরেকটা বউ পালে, তোরে না দেখলে কেউ বিশ্বাসই যাইবো না!

-বিশ্বাস না গেলে না যাক।

বট বিদ্বেষীরা ছাড়া বাকিরা অবশ্য প্রথম বউর বাচ্চা না হওয়াকেই বিয়ের কারণ হিসেবে ধরে নিয়েছিলো।

-আবার বিয়ার কারণ কি মিয়া?

আসগর বট বিদ্বেষীদের পক্ষ নিয়ে অম্লান হেসে বলে বউর হাতো ঘা, বট ধুইতে পারে না, এ লিগ্যা বিয়া করলাম।

-খাডাস কাহাকা! বট খাওয়ার লইগ্যা বিয়া করে কেউ! পনের বছরের বেশি হইছে বিয়া করছোছ, কইলেই পারছ পোলাপান চাই। খাডাসের লাহান কস, বট খাওয়ার লইগ্যা!

পোলাপানের জন্য আরেকটা বিয়ে করার অধিকার রাখে আসগর ষোলআনা। অথচ এমন একটা যুক্তি থাকার পরও কেন যে বটের কথা বলে ভেবে পায় না গ্রামের লোকজন।

 বিয়ের পর বেদানা অবশ্য কোন দিন ভুঁড়ি ধোয়া নিয়ে কথা বলেনি। মা বলেই দিয়েছে, সামান্য একখান কাম। না করিছ না। বাপ কোদাল হাতে মাঠে যেতে যেতে গজগজ করে, মাইনষে মাছ খায়, মাংস খায়, বিড়ি খায়, পানতামুক খায়, হেয় কি খায়? কিনা, গরুর আতুরি পেডি, আহাম্মক কাহাকা!

আর গ্রামের লোকও বিরক্ত, সারা বছর বট খাওন, এইডা আবার কি! বরকাঈদে খাও, বছরে একবার শখ কইরা খাওন যায়, আমরাও খাই।

ঈদ ছাড়া লোকে যেখানে বট চোখেই দেখে না, সেখানে আসগরের বউরা নিত্য দিন বট পরিষ্কার করে দক্ষিণধার কুলষিত করবে আর তারা( বট বিদ্বেষীরা) এটা মেনেই নিবে এমন মানুষ কি তারা! বট খাওয়া নিয়ে যেমন বাতচিত করে তেমনি বেদানার গায়ের রং নিয়েও সুযোগ পেলে কথা বলে। সকাল বিকাল দক্ষিণধারে থালবাটি ধুতে গেয়ে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে- কালা হাতর বট ধোয়ানি সাদা অয় লো! হতিনের গরে আগুন দিতে আইছোছ!

দুই বউ নিয়ে আসগরের অশান্তি আছে প্রচুর কিন্তু সব কিছু নিয়ে দুই সতীনে ঝগড়া হোক বিবাদ হোক বট খাওয়া নিয়ে তাদের কোন মতভেদ নাই। তারা বিশ্বাস করে গ্রামের লোকের বড় হিংসা মানুষটার বট খাওয়া নিয়া। -তোরাও খা। কে না করছে খাইতে! তয় বট খাইতে হাডান লাগে। খাইমু কইলেই খাওন যায় না। বট ধোও দুধের লাহান সাদা কইরা, তারপর জ্বাল দাও। জ্বাল দেয়া বট জোনাকি পোকের কইলজার মত ছোড ছোড কইরা কাট, কাটা বট এইবার নানা পদের মশল্লা দিয়া জ্বাল দাও তিনদিন, যত জ্বাল তত মজা। খরচ বলে নাই! খাইয়া দেখলে বুঝতি বডের মশল্লা দিয়া আস্তা খাসি খাইয়া লাওন যায়!

আসগর অবশ্য তিনদিন অপেক্ষা করে না। পরের দিন থেকেই খাওয়া শুরু করে। তিন দিনের দিন যদি ডেকচির তলায় কিছু অবশিষ্ট কিছু থাকে তবে বউরা একটু ভাগে পায়। বড় বউ ছোমেলা, এক কালে মোটাতাজা ছিল ভালেই। গুণ তার যেমনই এখন হাতে চর্ম রোগ। তার হাতের ধোয়া খাবে না বলেই না বেদানাকে বিয়ে করা। হাত যখন ভালো ছিলো তখন সপ্তাহে তিনটা পর্যন্ত খেয়েছে। তখন দামও ছিলো কম, ছোমেলাও ছিলো শক্তিশালী। ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাত ভিজিয়ে এ সব কাজ করেছে। সারাবছর বট পরিষ্কার করে করে হাতের বারটা বাজিয়ে ফেলেছে। যত গোস্বা তার বট নিয়ে কিন্তু বাড়িতে বট আসার সঙ্গে সঙ্গে কেমন মায়া মায়াও লাগে। আবার হাতছাড়া স্বামীকে সুযোগ মত কব্জা করাও সে ছাড়ে না –  মাগো মা, ওরা (ঝুড়ি) ভরা বট ঘরে ঢুকার লগে লগে বুড়ার কি নাচন! আসগরমিস্ত্রীর যেন চইন( তেল) বাইয়া বাইয়া পড়ে।

নামে মিস্ত্রী হলেও সে যেমন খাঁটি মিস্ত্রী না তেমনি খাঁটি বুড়াও না। ফকা মিস্ত্রীর ডানহাত বাঁহাত, জোগাল হিসাবে সে ফকার স্নেহের পাত্র। মিস্ত্রী ছিলো বাপ, বাপ বেঁচে থাকতে কাজ শেখেনি, তার ধারণা আর শেখার বয়স নাই, যোগালই তার ভবিতব্য। স্বাধীনতার সময় বয়স ছিল মোটে দশ। বিশ বছর বয়সে বিয়ে করেছিলো ছোমেলাকে। তখন ছোমেলার বয়স দশও হয়নি। বড় না হওয়া মেয়েকে বিয়ে করে কি দিগদারিতে পড়তে হয়েছিলো সে কেবল সেই জানে। আর এত কষ্টেশিষ্টে অভাবের সংসারে ভাত খাইয়ে যাকে বড় করলো সেই কিনা এখন তাকে বলে বুড়া! সে মোটেই বুড়া না। আসল কি সে জানে না! বুড়াটুড়া বলে বেদানার মনে তার সম্পর্কে ঘৃণা তৈরি করাই এখন তার কাজ।

প্রথম প্রথম ছোমেলার মত বেদানারও ভুঁড়ি পরিষ্কার করতে বেগ পেতে হয়েছে। বটির আগা দিয়ে খোঁচা দিলে প্রথম বেরিয়ে আসে গোঘাসি তারপর গায়ে লেগে থাকা কিলবিল লাল লাল পোকা। প্লেন, খাঁজকাটা, ভাঁজভাঁজ নানা পদের ভুঁড়ির গায়ে গোবরসহ নানাপদের পোকা। একেকটা পরিষ্কার করার কায়দা একেক। কোনটার ময়লা চটপট উঠে আসে কোনটা আবার খুবই ত্যাদর, কিছুতেই ওঠে না। রীতিমত কুস্তি লড়তে হয়। আর চিকন চিকন নাড়িভুঁড়ি পরিষ্কার করতে গিয়ে নিজেদের নাড়ি উল্টে আসে। তবে ছোটখাট যা কায়দা, তা সবই শিখিয়ে দিয়েছে ছোমেলা বেদানাকে। কাজটা করতে খারাপ বেশি দিন লাগেনি। অভাবের সংসারে ভুঁড়ি ভুনা খাওয়ার মজা যখন একবার পেয়ে গেছে তখন তো তা সয়ে আসবেই। সয়ে আসলেও কত আর রোজ রোজ ভুঁড়ির মত দ্রব্য পরিষ্কার করতে ভালো লাগে। মাসের পর মাস, বছরের পর বছর।

ছোমেলা যখন ভাতে ভাজা ভুঁড়ি মাখিয়ে খেত, আসগর খাওয়া শেষে কুলকুচি করে এসে অশেষ তৃপ্তি নিয়ে বলতো, বড়লোকে এহনও এর মাজা পায় নাইরে ছমি, হেলিগ্যাই কম দামে পাই। আর এখন, বেদানা যখন খায় তখন ভ্র কুচকে বলে, বড়লোকে চিন্যা গেছে গা গো বটের মজা, আইজ দেড় কেজি আশি টেহা দিয়া আনছি। গরীব মাইনষের কপালে শেষ পর্যন্ত পিছার বাড়ি!

কিন্তু লাভ হয়েছে বেদানার। এখন বাজার থেকে পরিষ্কার বট আনে। সামান্য গরম পানি দিয়ে দুই একবার ধুয়ে নিলেই হয়ে যায়। মিডিসিন দিয়ে নাকি ধোয়। সাদা ফকফকা। বড়লোকের চোখ পড়লে সে জিনিস আর অকৃত্রিম থাকার জো নাই। আগের মত তেলচর্বি নাই, স্বাদও নাই। তেল মশল্লা দিতে দিতে জান শেষ। স্বাদ লাগে না যাদের মুখে তাদের জন্য আসগরের পরামর্শ সহজ, মজা না লাগলে তোর খাওন দরকার নাই। গ্রামের লোকে ইদানিং আসগরের পোলাপান না হওয়ার পিছনে এই বট খাওয়াকেই দায়ি করে- এত বট খাইলে কি আর পোলাপান অয়! বটের নাড়ি পেডের নাড়ি কাইট্যা লাইছে, নাইলে বিশ বছরেও পোলাপান অয় না ক্যা, বড়ডা না বাজা, বেদানার কি দোষ! পোলাপান নিয়ে আসগরের মাথা ব্যথা নাই, তা না। কিন্তু আল্লায় না দিলে আর কি করা। যখন দেয় দিবে। বউরা ভিতর ভিতর বাপের বাড়ি গিয়ে কবিরাজি করিয়ে আসে, তাবিজতুমার সঙ্গে নিয়ে আসে, কখনো বা আসগরের শরীরেও তার দুএকটা তাগাসহ ঝোলে। এ সব নিয়েই দুই সতীন সারাক্ষণ লেগে আছে।

আসগর বিশ বছর বয়স থেকে বট খাওয়া শুরু করেছে পঁয়তাল্লিশের কোঠায় পা দিয়েও সমান উৎসাহ। এখন আয় রোজগার কম বলে খেতে পায় কম। গ্রামের মানুষ এখন শহর থেকে নৌকা ভরে আসবাব নিয়ে আসে। শহরের মিস্ত্রীদের সাথে পাল্লা দিয়ে আসবাব বানাতে পারে না বলে রোজগারের এই অবস্থা। আর অধিক রোজগারের ফিকির সে করবেই বা কার জন্য! পোলাপান নাই, বাবামা মারা গেছে বহু আগে। থাকার মধ্যে আছে একটু বট খাওয়া। এখন অবশ্য সে জানে, তার আগ্রহ কত সামান্য খাবারে অথচ তাই জোগাড় করতে তার এক সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হয়। কখনও আরও বেশি। অপেক্ষার পর বট ঘরে এলেও খেতে পাবে না আরো দুদিন, এটাও এক অসহ্য ব্যাপার। আগে পরদিন থেকে খাবে বলে জেদ করলে বউগুলো কথা শুনতো, খানেকটা বট তুলে নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা জ্বাল দিয়ে লাল ভাজা ভাজা করে তপ্ত ভাতের সঙ্গে খেতে দিতো। এখন তারা ত্যাদরামি করে। কি না, জ্বাল হউক, একটা দিন সবুর করেন, বুড়া হইছেন তাও জিবলা কমে না আপনের!

বউগুলো এখন আর বট খায় না। একাই সে খায়। আর খাবে কি! এক দেড় কেজি কিনে আনে, রান্নার পর আসগরের পাতে পড়তে না পড়তে শেষ। আগে পুরো বটটা যখন জ্বাল দিতো হাড়ির গলা সমান ভরে যেতো। পরিষ্কার করার পর কতটা হলো দেখানোর জন্য জ্বাল দেয়া হাড়িটা রাতে ঘুমাতে যাবার আগে সামনে এনে রাখত ছোমেলা। আসগর হারিকেন কাত করে জমাচর্বিতে ডুবে থাকা বট দেখে অমৃত আস্বাদনের আকাক্সক্ষায় ছটফট করতো। মন ভরে যেতো। দু’তিন দিন এবার নলু ডুবিয়ে খাও আসগর, জগতে স্ত্রী সহবাসের চাইতেও আকর্ষক এই বট!

রোজকার মত হাটের দিন বাজারে গিয়ে ঘুরতে থাকে আসগর। কোথায় একটু কম দামে কেনা যায় । গোটা বটটা আজ সে কিনবে বলে ঠিক করে এসেছে। গত মাসেও তাই কিনতে গিয়েছিলো কিন্তু একাধিক খরিদ্দারের পিড়াপিড়িতে দু কেজি কিনে ফিরেছে। আজকেও একা কেনারই মনস্কামনা। কিন্তু হাটে গরুর মাংস নাই বললেই চলে। এনথ্রাক্স নামক কি রোগ ছড়িয়ে পড়েছে গরু থেকে মানুষের মধ্যে। আতঙ্কগ্রস্থ মানুষের এখন মাংস খাওয়া বন্ধ। কিন্তু তারপরও আড়ালে এক আধটা গরু জবাই হয়, গোপনে খায়ও কেউ কেউ। তো আসগরের পুরো বটটা একা কিনতে আজ কোন দিক থেকেই কষ্ট হয়নি। এমনকি বহু দিন পর সেই গোঘাসি সহ অকৃত্রিম বট! বিক্রেতা মেডিসিন দিয়ে পরিষ্কার করবে কি, বিক্রিই হয় কি সন্দেহ। তেলচর্বিসহ এক’শ টাকায় একটা পুরো বট, বিনা পয়সায় পাওয়ারই সামিল!

দুই বউ মিলে পরিষ্কার করে উঠানের শেষ মাথায়। আসগর বড় হারিকেনটা ধরিয়ে ঠিক জায়গায় স্থাপন করে বহু কসরত করে। কসরত আর কিছু না, আসল ব্যাপার হারিকেনের উছিলায় বটের কাছাকাছি থেকে চোখকে তৃপ্তি দেয়া। এমনকি পরিষ্কার করতে দক্ষিণধার থেকে বিলের পানি বালতি ভরে এনেও সাহায়্য করে। এক মনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পরিষ্কার করে যায় ওরা। কথা বলে ফিসফিস করে, পাড়ার মানুষের যা মুখ, একটু আড়ালেই ভালো!

ছটফট করে আসগর। শেষে আর সইতে না পেরে পৈঠা ছেড়ে নেমে আসে। আবদারের সুরে বলেই বসে, জ্বাল দেয়া বট কাইল সকালেই কুচি কইরা আমারে একটু রাইন্দা দিছ। কত দিন আইশ মিডাইয়া খাইতে পাইনা!  বউগুলিও আজ খুশি। এমন দিন বহু দিন পর এসেছে। এবার তারাও একটু ভাগ পাবে।

বট ধুতে ধুতে ঝমঝম করে বৃষ্টি নামে। শেষ বর্ষায় এমন বৃষ্টি হতেই পারে। কিন্তু আসগর খুব বিরক্ত – বিষ্টি না, যেন পোলাপানের মুত, ছাড়লেই অইলো! ধোয়া আধোয়া বট নিয়ে রান্নাঘরে উঠে আসে ওরা। মাথার উপর এক টুকরা টিনের ছাউনি, বৃষ্টির ছাঁট আসছে ভালই। হারিকেনের আলোআঁধারিতে কর্মরত বউ দুটোকে তার বড় আপন মনে হয়। শোয়ার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকে বোকার মত। ঘষে ঘষে চামচ দিয়ে ময়লা তোলার দৃশ্যটা বহুক্ষণ চোখের সামনে স্থির হয়ে থাকে। আহারে, জীবনে তারা একটা বাচ্চার মুখও দেখলো না। ঠিক সময়ে সন্তান আসলে এখন হয়ত বিয়ের বয়সও হয়ে যেতো। তবে কি বট খাওয়াই দায়ী! এক মুহূর্ত, পরক্ষণেই চিন্তাটা থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে কাল কখন কিভাবে বট খাবে তা নিয়ে গভীর আবেগে ডুবে যায়।

খুব ভোরে ঘুম ভেঙে যায় বেদানার। বেড়ার ঐ পাশটায় একা বিছানায় বড় বউ বেঘোরে ঘুমায়। বটের ডেকচিটা সে ভারি কিছু দিয়ে ঢাকা দিয়েছে কিনা মনে করতে পারে না। পালা বিড়ালও আজকাল ডেকচির ঢাকনা খুলতে চায়। চৌকি থেকেই দেখা যায় এমন দূরত্বে জলকান্দার উপর রাখা বটের হাড়ি। কিন্তু দেখতে পায় না অন্ধকার বলে। যতটা অন্ধকার ভেবেছে আসলে ততটা অন্ধকারও না। বাইরে আলো ফুটে গেছে। এইবার হাড়ির দিকে চোখ পড়তেই বেদানার চোখে বিস্ময়। আসগরের হাতে এক হাত লম্বা এক টুকরা বট। সে চিবাচ্ছে শিকারী বিড়ালের মত সন্তর্পণে। বেদানা কি বলবে বুঝতে না পেরে ‘হায় আল্লাহ আসিদ্ধ বট’ বলেই শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। কতক্ষণ কে জানে, জালে পড়া মাছের খলবলানি শব্দে ঘুম ভেঙে যায় বেদানার। উঠে বসতেই দেখে আসগরের চোখ বড় বড়। হাতের ইশারায় কাছে আসতে বলে বেদানাকে। মুহূর্তেই বুঝে ফেলে কি হয়েছে!

ততক্ষণে বড় বউ এসেছে, এসেছে সেই ভোরে যারা নামাজ শেষে বাইরে হাওয়া খাচ্ছিলো। আসগরের গলায় আটকে যাওয়া আসিদ্ধ বটের লতি ধরে কেউ বাইরের দিকে টানছে, কেউ বলছে মিয়া গিল্লা নেও। টানার সময় যেমন আসগরের চোখ উল্টে যাচ্ছে তেমনি গেলার চেষ্টায়ও একই পরিস্থিতি। মুখের বাইরে বেরিয়ে থাকা বটের অংশটুকু একবার দেখা দেয় একবার হারিয়ে যায়। সারা জীবন ভালোবেসে যে বট খেয়েছে, তারই কিনা আজ এমন বিভৎস লুকোচুরি খেলা! এত কিছুর মধ্যে ছোমেলা শুধু একবার বলে, চাবাইছে আর গিলছে ছিঁড়তে তো পারে নাই, টান দিলে মনে কয় সবডাই বাইরায় আইবো, একটু টান দেন না! মসজিদের ইমাম ছিলো কাছে, সে বলে টানলেও বিপদ আছে, পাকস্থলিও তো সমানে ভিতরে থেইক্যা টান মারতাছে, বোজেন না! হেরে ডাক্তারের কাছে নেওনের ব্যবস্থা করেন।

কোথায় ডাক্তার, কোথায় কি, এমন নিদারুণ রসময় দৃশ্য রেখে কেউ নড়ে না। বট খাউয়া আসগর আজ বট আটকে মারা যাচ্ছে! সত্যিই যদি মারা যায় তবে তা ইতিহাস, ইতিহাসের সাক্ষী সব্বাই থাকতে চায়। আসগরের একটা সন্তান থাকলে হয়ত এ যাত্রা বাঁচানোর একটা  চেষ্টা দেখা যেতো। তাছাড়া বেশিক্ষণ দৃশ্যটা দেখার সুযোগও তো দেয় না আসগর। গ্রামের লোক যাই বলুক, বিধবা বউ দুটো যা হোক শেষ পর্যন্ত আসগরের বট খাওয়ার পক্ষেই ছিলো।

নাসিমা আনিস। লেখক ও ঔপন্যাসিক। জন্ম ১৬ নভেম্বর ১৯৬২ কুমিল্লা, বাংলাদেশ। লেখাপড়া আজিমপুর গার্লস স্কুল থেকে এসএসসি, ইডেন কলেজ থেকে এইচএসসি, চট্টগ্রাম কলেজ থেকে অনার্স ও চট্টগাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। শিক্ষকতা করেন। প্রথম গ্রন্থ কাগজ প্রকাশন কর্তৃক তরুণ...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..