বন্ধ করো

বদরুদ্দোজা শেখু
কবিতা
Bengali
বন্ধ করো

হায়, ফুলগুলো !

হায়,ফুলগুলো !
সৌন্দর্যের পরম প্রকাশ
কেবল অবলীলায় বলি হ’য়ে যায়
শৌখিন প্রেমের উপচার হ’য়ে,
রঙীন ভালবাসার বাঁধানো তোড়ায় ,
কফিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণে,
দেবদেবীর চরণে বহুযুগের ব্যর্থ আরতিতে ।
আমাকে দিও না ফুল
স্বাগত সভায়  কিংবা জন্মদিনে কি কফিনে,
যদি পারো—-পুঁতে দিও
শুধু একটি ফুলগাছের চারা
কোনোদিন
আমার কবরে ।।

বিবর্তন 

শৈশবে খেলেছি খুব পাশের বাড়ির সেই শ্যামলা -বরণ রোগা খুকুটির সাথে
দিনরাত, দু’বাড়ির চৌহদ্দির আনাচেকানাচে আর ফটকের পাশে,আঙিনাতে ,
অগাধ ধূলোর লিকে ,কুড়ের কার্ণিশে খেলেছি পুতুল-খেলা ,কানামাছি, ঘর-কন্নারা রূপক ;
আমি পরতাম একরঙা ঢোলা হাফ্প্যান্ট , সে পরতো ফুল-তোলা ফ্রক ।
তখন সে অন্তরঙ্গ খেলার সাথীকে মেয়ে ব’লে মনেও হয়নি ,বড়ো ছিল খেলার খেয়াল ।
কৈশোরের আগমনে কীভাবে সে হ’য়ে গেল
ক্রমশঃ আড়াল
বুঝতে পারিনি কিছু, ইতস্ততঃ দেখা ছিল দ্বিধায় আনত, অকারণ
ভীরু ভীরু ,চকিত চাওয়ায় ছিল অকস্মাৎ বুকে বেজে-ওঠা এক মৌন শিহরণ ,
তারপর জানিনা কখন্ শরীরে শরীর চেয়ে লাগলো আগুন ,
বধূবেশে কখন্ সে বিদায় নিয়েছে পরিচিত গণ্ডী থেকে ; আহত করুণ
সংক্রামক কামনায় অলিগলি এভেন্যূয়ে খুঁজেছি চরিত্রভ্রষ্ট  নারীর শরীর ,
হতাশ প্রেমের ভূতগ্রস্ত মনে এঁকেছি উলঙ্গ ছবি স্বপন-পরীর
আর হাঁকিয়েছি হতচ্ছাড়া ভাগ্যের ছ্যাক্ড়া গাড়ি ইতস্ততঃ রুক্ষ পথের ঠেকায় ,
এভাবেই বহুপথ পাড়ি দিয়ে এসেছি একাই ।
আজকাল কালেভদ্রে বেড়াতে এলে সে তার খেলুড়ে খুকুর
ফেলে-যাওয়া ফ্রকগুলো নাড়িচাড়ি ,তুলে রাখি । প্রেমে নয় , মমতায় লেজ নাড়ে যৌবনের কামার্ত কুকুর ।।

 গ্রামবাসীর প্রতি 

ঘরে ফিরি , পথে ঘাটে দু’চারটে শালিকের সংবর্ধনা জুটে ,
মুখ তুলে তাকায় জিজ্ঞাসু  চোখে পথচারী নিরীহ ছাগল
গাঁর মুখে ঘেউ ঘেউ ডেকে উঠে গুটিকয় বেজন্মা কুকুর
চারিদিকে পরিচিত প্রতিধ্বনি আর শিষ্ট স্বরগ্রাম উঠে ।
ওরা কি বলতে চায় ‘চিনি চিনি , আমাদের-ই গাঁয়ের মানুষ
আমাদের-ই ছেলে বটে , একদিন এইখানে মানুষ হয়েছে
এখন বিদেশী । বহুদিন পরে দেখা ; কী খবর ? কুশল তো ?
শহর-সংবাদ দাও গাঁয়ের নগরবাসী প্রবাদ-পুরুষ ।’
বয়স্ক স্বজন আর সমবয়সী বন্ধুরা সব একে একে
এসে জুটে , কতো কী জানতে চায় , আমি যেন সদ্যঃ-প্রকাশিত
নগর-গেজেট ; এবং উচ্চ প্রশংসায় পঞ্চমুখ , আকাঙ্ক্ষিত
শহরের জীবনকে কৌতুহলে ক্যামন্ সোনালি চোখে দ্যাখে ।
খড়ের গাদার মতো নগর-সুখের রম্য গম্বুজ বানায়
ওরা কল্পনার পটে (যেহেতু ওদের খড়ের গাদার নির্মাণ-শৈলীই শুধু
গ্রাম্য-দৃশ্যে ইতস্ততঃ নাগরিক নজরে আসার মতো কিছু )
আসাম পঞ্জাব রাজীব গান্ধী থেকে জ্যোতি বসুর সরকার
ইত্যাকার রহস্যের আরো নানাবিধ ওরা ঔৎসুক্য জানায় ।
হে আমার গ্রামবাসী অজ্ঞ চাষী ঋজু-হাসি দুঃখী অভাজন ,
শহুরে বৈশিষ্ট্য শুধু শৌখিন কায়দা-দুষ্ট মৌখিক ভদ্রতা ,
শকুনের তীব্র ছোঁ-য়ে স্বভাব-দুরস্ত সভ্য চোখ , বিজ্ঞাপনী
রূপের বেলেল্লাপনা , প্রেসের ভাগাড়ে হৃদয়-বৃত্তির শব্দ ,
নাটমঞ্চে রাখালী কিংবা দেহাতী দুর্দশার জ্ঞাতব্য পালিশ ,
কিন্তু কোনোখানে নাই পাড়াগাঁর প্রাণধর্ম প্রতিবেশী আত্মীয়তা , মন ।।

বন্ধ করো

রুজির দায়ে লড়তে এলাম , আদর্শ আর অভাবে
রপ্ত হলাম নগর-সভায় দাঁড়াতে ;
লোভের লতা বাড়লো মনে চতুর্দিকের প্রভাবে ,
পারিনি তবু মনের সত্য হারাতে ।
নজর হলো নিত্য নাপাক ,পুড়লো আদিম বাসনা
বে-আব্রুয়ান নারী-দেহের নিবিড়ে ,
রক্তাক্ত বিবেক-পাখির জাগলো বাঁচার আশও না
বস্তি-বিরাণ সজ্জাহীনের শিবিরে ।
মর্ম-ফলায় দাগ কেটেছে গরীব ঝি এক শহরী
ফুটপাতে  সে দিচ্ছিল জ্বাল হাঁড়িতে
তুচ্ছ -বাসে লজ্জা পেলেও লজ্জা ঢাকার  প্রহরী
ছিল না তার স্বল্প-বহর শাড়িতে ।
রূপ-চর্চার সাজসজ্জার আড়াল উগ্র জৌলসে
নারীত্ত্বের নি-লজ্জা যায় না এড়ানো ;
বন্ধ করো রূপের নিলাম— আধুনিকতার খোলসে
কামিজ খুলে’ ,কাঁচুলি প’রে বেড়ানো ।।

বুকের চর-হোগলার উজানীর মাঠে

রাত আসে, ধীরে ধীরে দিবাক্লান্ত চোখ থেকে মুছে দিয়ে যায়
পৃথিবীর রঙ , সমারোহময় নিসর্গের খোলা বাতায়ন
আঁধারের পর্দায় আড়াল  হয় ধীরে ধীরে , ধীরে ধীরে আমিও চুকাই
ঠেলেঠুলে কোনোক্রমে দিন-চালানোর আয়োজন ।
ক্রমশঃ নিবিড় অন্ধকারাচ্ছন্ন ঝোপঝাড় গাছগাছালির
ফাঁকে ফাঁকে ইতস্ততঃ জ্ব’লে-ওঠা জোনাকির মতোই মিছিল
ক’রে ওড়াউড়ি করে আমার বুকের চর-হোগলার উজানীর
মাঠে আশা আর দুরাশার ছত্রভঙ্গ যতো গাঙচিল ।।

বদরুদ্দোজা শেখু। কবি। জন্ম ১৯৫৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গরাজ্যের মুর্শিদাবাদ জেলার সাগরদিঘিতে। অভাব অনটনের মধ্যে তাঁর বেড়ে উঠা। প্রথাগত শিক্ষায় স্নাতকোত্তর। পেশায় অবসরপ্রাপ্ত রাজ্য সরকারি কর্মচারী, নেশায় কবিতা লেখালিখি। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ: অলৌকিক আত্মঘাত, দুঃস্বপ্নের নগরে নিভৃত নগ্ন, শব্দ ভেঙে...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

ঝরা পাতা

ঝরা পাতা

  চারিদিকে কোলাহল শূণ্যতা করেছে গ্রাস, বেদনা বিধুর অতৃপ্ত বাসনায় হাহাকার, অজান্তে নীরবতা তোমার স্পর্শে…..

ফ্রেম

ফ্রেম

দেবী না পরিণীতা রাতটা একা থাকে এবং নিঃসঙ্গ অন্ধকার মানে রাত; তাহলে অন্ধকার নিজেও একা…..