বর্তমান সমাজ ও বর্তমানের নারী

তীর্থপতি গুপ্ত
নারী, প্রবন্ধ
Bengali
বর্তমান সমাজ ও বর্তমানের নারী

বর্তমান সমাজ বড্ড গোলমেলে। তার বাইরে এক ভেতরে আর এক। থিওরি ও প্র‍্যাক্টিক্যালে বিস্তর পার্থক্য। এরই মাঝে বর্তমানের নারী ও নারী স্বাধীনতা নিয়ে দুই-চার কথা বলতে গেলে আলোচনার সুবিধার্থে সমাজকে আগে কয়েকটা ভাগে ভাগ করে নেওয়া দরকার। বিত্ত অনুযায়ী সমাজকে সরল তিনভাগে ভাগ করে নিলে যা দাঁড়ায় এক নিম্নবিত্ত দুই মধ্যবিত্ত তিন উচ্চবিত্ত। আর একদিক দিয়ে ভাগ করে নিতে পারি তা হল মেয়েদের প্রতি মেয়েদের ভূমিকা এবং মেয়েদের প্রতি পুরুষের ভূমিকা।

গতকালকেই আমার এক পরিচিত বয়স্কা মহিলার সাথে হাঁটছিলাম। উনি খবরের কাগজে ছাপা একটা ঘটনার কথা বললেন। একটি শিশু কন্যা সন্তান পাওয়া গিয়েছে খড়ের গাদায়। সদ্যজাত বলাই বাহুল্য। ওনার কথা অনুযায়ী পুরুষতান্ত্রিক সমাজই এর জন্য দায়ী। সত্যিই তাই। কিন্তু এখানে নারীর ভূমিকা কী? সে নীরব কেন? কন্যাটির মা, বা ঠাকুমা বা দিদিমা? তারা? সরল পথে দোষ পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বলে নিশ্চিন্ত হতে পারি কিন্তু তাতে সমাধান খোঁজার দায় থাকেনা। থাকেনা চিন্তার ছবি।

পুরুষ এবং নারী এক ধরনের প্রাণীর দুই রূপ। অন্যান্য প্রাণীর ক্ষেত্রে যেরকম আন্ত প্রজাতি ও অন্ত প্রজাতি সংগ্রাম চলে এখানেও সেটা চলে। মানুষ বুদ্ধি বিচার এবং বিবেক দিয়ে এগুলো প্রতিরোধ করে, নিয়ন্ত্রণ করে এবং রিয়াক্ট করে। ফলে নারীদের মধ্যে লড়াই এবং পুরুষ নারীর লড়াই চলতেই থাকে। পুরুষ চালাক তাই নারীদের মধ্যে লড়াই বাঁধিয়ে ফায়দা তোলে। কিন্তু বর্তমানে নারীরা বুদ্ধি দিয়ে বিচার করে সেই ফায়দা তোলা প্রতিহত করছে এবং নিজের অবস্থান মজবুত করছে।

এবার সামাজিক বিভাজন অনুযায়ী কিভাবে আগের আলোচিত বিষয় গুলো কাজ করে দেখা যাক। নিম্নবিত্তর নারীদের অনেকেই বা প্রায় প্রত্যেকেই রোজগেরে। তাদের নিজস্ব বুদ্ধি এবং ক্ষমতা অনুযায়ী রোজগার করে। আবার আশ্চর্য তাদের মধ্যেই অত্যাচারিতও বেশি। আগে প্রায় প্রত্যেকেই অত্যাচারের শিকার হত এখন ক্রামশ কমেছে। তার একটা কারন শিক্ষা। প্রায় প্রত্যেকেই ন্যূনতম শিক্ষা পেয়েছে এবং বাইরের দুনিয়ে বা আশপাশের দুনিয়ে সম্বন্ধে জানছে। এবং দুই আশেপাশের নারীরা তাদের সেই সাহস যুগিয়েছে যাতে সে প্রতিবাদ করতে পারে এবং করলে পাশে অনন্ত কেউ দাঁড়াবে। এখানেই নারীর জন্য নারী যে সম্পর্ক যেটা আগে কম দেখা যেত সেটা বেড়েছে। এখনও অনেক ঘাটতি আছে। এখনও শিশুকন্যা মৃত্যু হচ্ছে কিন্তু আগের তুলনায় প্রতিবাদ, প্রতিরোধ বেড়েছে। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, শিক্ষা এর মুল কারন। এই শিক্ষা এবং স্বাধীনতা তাদের পাশের নারীদের সাহায্যেও উদ্বুদ্ধ করছে। সামাজিক এই পরিবর্তন খুব দ্রুত হচ্ছে। এতে মোবাইলের ভূমিকাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যোগাযোগ এবং খবর দেওয়া নেওয়াতে বিরাট সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে মোবাইল। এই সমাজে থিওরি এবং প্র‍্যাক্টিক্যাল জীবনযাত্রা একই। লুকোছাপা নেই।

মধ্যবিত্ত সমাজে সমস্যা চিরকালই জটিল এবং যা দেখা যায় তার চেয়ে ভিন্ন। এই সমাজেই এখনও প্রায় অনেক নারীই গৃহবধূ অর্থাৎ উপার্জন করেন না এবং অনেক পুরুষই মনে মনে পুরুষতান্ত্রিক কিন্তু মুখে সাম্যবাদী। এখানেই সমস্যা। ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে শোফায় বসে এপেক্ষায় থাকে ফিজিওথেরাপি থেকে ফিরে বউ কখন চা করবে। আজও ইস্ত্রি করতে বসলে বউ এর ব্লাউজ বা চুরিদার ইস্ত্রি করলে সম্মানহানি হয়। আজও এই সমাজে নারীরা নারীদের হয়ে প্রতিবাদে পিছিয়ে থাকে। আজও সংসারের নাম এডজাস্টমেন্ট। পড়াশোনা করা শাশুড়ির মুখেও শোনা যায়, আমরা এই এই করেছি তোদের তো তাও করতে হচ্ছে না। বা আমার শাশুড়ি যা শাসন করতেন তোরা হলে ছেড়ে চলে যেতিস। নিজে একজন নারী এই পরিচয়ের চেয়ে আজও অমুকের বউ অমুকের শাশুড়ি হতেই বেশি পছন্দ করেন। আজও এরাই টিভি সিরিয়ালের প্রধান দর্শক। এই সমাজের পুরুষেরা নামীদামী স্কুলে ছেলে মেয়ে পড়ায়। মেয়েকে বিয়ের জন্য এবং ছেলেকে নিজের ভবিষ্যতের ইনভেস্ট হিসেবে। এই সমাজের আর এক ধরনের নারী দেখাযায় যারা অন্য নারীর খুঁত খুঁজতেই ব্যস্ত। এরাই মূলত পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রতিনিধি। এরা নিজেরা যাই করুক মেয়েদের কী কী করা উচিৎ এর চেয়ে কী কী করা উচিৎ নয় সেটা শেখাতেই বেশি আগ্রহী। পুরুষের হয়ে পুরুষের কাজটা সহজ করে দ্যায় এরা। এই সমাজে শিক্ষিত অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন মেয়েরাও বিয়ের পরে টাইটেল পাল্টাতে আগ্রহী।

এবার উচ্চবিত্ত। এই সমাজ আর নিম্নবিত্ত সমাজের মধ্যে মিল অনেক। এই সমাজে অর্থ নিয়ে কোনই সমস্যা নেই। এবং স্বাধীন সমাজ হওয়াই কারোর অধীনের থাকার ব্যাপার নেই। এখনে পুরুষতন্ত্র কাজ করে কম। বা করে অন্যভাবে। বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠান থেকে বেরিয়ে এসে এখন স্বাধীন জীবনযাপন করছে অনেকেই। আবার অনেকেই একাধিক বিয়েতেও পিছপা হচ্ছে না। আপাত দৃষ্টিতে সম্পর্ক গুলো ঠুনকো মনে হলেও এর মধ্যে থেকেও অনেকে দীর্ঘদিন সম্পর্কে থাকছেও। এই সমাজ অনেক স্বচ্ছ। লুকোছাপা কম। মেয়েরা মতামত ও অর্থের দিক থেকে স্বাধীন। তাই যে অত্যাচার বা অন্যায় যেটুকু হচ্ছে তার কারণ কোন ভাবেই নারী পুরুষ বৈষম্য নয়।

আবার আসা যাক আধুনিক নারী বলতে কী দেখা যাচ্ছে। কিভাবে তারা নিজেকে পুরুষের সমকক্ষ বা অধিক মেধাবী কর্মক্ষম করে তুলছে সেই কথায়। একাধিক ব্যাপার এই ক্ষেত্রে লক্ষণীয়। যেমন শিক্ষা, প্রতিটা মেয়েই ন্যূনতম শিক্ষা পাচ্ছেই। ফলে তারা কাজ করতে চাইছে। চোখের সামনে খরচের জায়গা দেখতে পাওয়াই পরমুখাপেক্ষী হতে চাইছে না। আবার অন্যদিকে তাকালে দেখা যাচ্ছে পুরুষের সমকক্ষ হতে গিয়ে বা দেখাতে গিয়ে পুরুষের খারাপ গুন গুলোই আগে আয়ত্ব করে নিচ্ছে। যেমন মদ্যপান ধূমপান ইত্যাদি। আধুনিকতা মানে খোলামেলা পোশাক এবং উৎশৃঙ্খল জীবনযাপন নয় সেটা এরা বুঝছে না। এই জীবনযাপন যে পুরুষের পক্ষেও হানীকারক সেটা এদের কে বোঝাবে।

শেষ কথা বলার কে আছে? সমাজ পরিবর্তনশীল। আজ যা আছে কাল তা পাল্টাবেই। পাল্টানোই এখানে ধ্রুবক। নারী এবং নারীর সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রেও তাই একই কথা প্রযোজ্য। শিক্ষা এবং অর্থনৈতিক দিক দিয়ে যত এগোবে তত এর স্তরবিন্যাস পাল্টাবে। ততো নিজের কথা নারীরা বলতে শিখবে। অন্য নারীর কাছে সাহায্য তত বেশি পাবে। চোখ বন্ধ করে পুরুষ হওয়ার চেষ্টা না করে নারী হয়েই আত্মসম্মানে বাঁচার চেষ্টা করবে। যেদিন নারী পুরষেকে হারিয়ে আনন্দ পাওয়ার সাথে সাথে নিজের অক্ষমতা নিজের দীনতাকে হারাতে পারবে সেদিনই প্রকৃত নারী মুক্তি হবে। নিজের আলোয় আলোকিত করবে নিজেদের। পুরুষের দোষ খোঁজা থেকে বিরত হয়ে নিজেকে উন্নীত করবে এমন স্তরে যেখানে নিজেই নিজের প্রতিপক্ষ। আর কেউ তুলনা করবে না। কেউ বলবে না, সত্যিই ছেলের মতো কাজ করেছে। বলবে, সত্যি মানুষের মতো কাজ করেছে। সেদিনই প্রকৃত নারী মুক্তি হবে। সেই পথেই চলেছে আজকের সমাজ। আমরা আশাবাদী আমরা তাকিয়ে আছি সেই সূর্যোদয়ের দিকে।

তীর্থপতি গুপ্ত। কবি ও চিকিৎসক। পেশায় ফিজিওথেরাপিস্ট হলেও নেশায় কবিতা, ক্যামেরা, কালার। নিজেকে যখন দমবন্ধ লাগে তখন কবিতাই প্রাণ দেয়। মুর্শিদাবাদ জেলার সদর শহর বহরমপুরেই জন্ম কর্ম ও বেড়েওঠা। তাঁর মতে, একটু ভালো থাকা একটু ভালো রাখার জন্যই বেঁচে থাকা,...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

গণতন্ত্র, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও বাংলার নবজাগরণের দু একটি কথা

গণতন্ত্র, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও বাংলার নবজাগরণের দু একটি কথা

একটি পরাধীন দেশ আর তার বাসিন্দাদের মনে স্বাধীনতার আকুতি আমরা দেখেছিলাম ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে। এর…..