বর্তমান সময়ে বিশ্বের শাসক: করোনা ভাইরাস

সন্দীপন ধর
প্রবন্ধ
Bengali
বর্তমান সময়ে বিশ্বের শাসক: করোনা ভাইরাস

স্টিভেন সোদারবার্গ পরিচালিত ছবি ‘কন্টাজিয়ন’ মুক্তি পায় ২০১১ সালের তেসরা সেপ্টেম্বর, আটষট্টিতম ভেনিস আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে। ছ-কোটি ডলার বাজেটের এই হলিউডি ছবি বেশ ভালোই বাণিজ্য করেছিল মুক্তি পাওয়ার পরপর। তারপরে যা হয় আর কী, দেখে ফেলা সিনেমা ছেড়ে নতুন সিনেমার প্রতি আগ্রহ দেখাল মানুষজন। ফলে ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা পড়তে শুরু করল। এরই মধ্যে অবশ্য সিনেমার বিষোয়বস্তু নিয়ে প্রশংসা করেছে মিডিয়া। নামি প্রকাশনার দিকপাল সমালোচকরা বিনা দ্বিধায় বলেছেন যে বিজ্ঞানের বিষয়টা নিবিড়ভাবে মিশে গিয়েছে কাহিনিচিত্রের ঠাসবুনটের সঙ্গে। যাই হোক, এরপর সেই কাহিনিচিত্র ঢুকে পড়ল ইতিহাসে, স্বাভাবিক নিয়মে। কিন্তু ইতিহাসের পাতা থেকে আবার সে সিনেমার গা ঝাড়ে উঠে পড়া ২০২০ সালের শুরুতে। সিনেমা হল বা থিয়েতারে নেই ঠিকই কিন্তু নানা ও্যেবসাইটে ঢুকে সারা বিশ্বের মানুষজন দেদার দেখা শুরু করলেন সে ছবি। মার্চের মধ্যে কনটাজিয়ন উঠে এল প্রথম দশটা জনপ্রিয় ছবির তালিকায়। কোনো কোনো সংস্থার বিচারে তাঁর স্থান দ্বিতীয়, কারো বিচারে সপ্তম! কীভাবে হল এমনটা?

কারণটা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত সভ্যতার চরম দুরবস্থার সঙ্গে। একটা ভয়ঙ্কর ভাইরাস কীভাবে অরণ্যের গভীরে সুপ্ত অবস্থা থেকে মানবসমাজে ঢুকে পড়ল আগ্রাসী বাণিজ্যের হাত ধরে তাঁর ভয়-ধরানো বর্ণনা রয়েছে সিনেমা জুড়ে। অদ্ভুতভাবে সিনেমার বর্ণনা মিলে গিয়েছে নভেল করোনা ভাইরাসে শাসিত পৃথিবীর সঙ্গে, আজকের বিশ্বজোড়া মহামারীর আগাম সংবাদ যেন বুকে ধরে রেখেছিল এই ছবি। তবে নাস্ত্রাদামুস জাতীয় আজগুবি কোনো বাণী উচ্চারিত হয়নি ছবিতে, যা দেখানো হয়েছে তাঁর বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আসলে প্রমাণিত হয়ে গিয়েছিল এক দশক আগেই। এমনিতে ভাইরাসে দুর্বল, একজন পোষক বা ইংরেজিতে যাকে বলে হোস্ট, তেমন একটা জীবিত শরীর না পেলে জীবনবৃত্তান্ত বলে কিছিউ নেই। প্রোটিন মোড়া ডি-এন-এ (বা আর-এন-এ) পড়ে থাকে নির্জীব হয়ে। কিন্তু পোষক পেলেই ভাইরাস ভয়ঙ্কর। সকালে খবরের কাগজের প্রথম পাতা থেকে মোবাইলের রাতের শেষ মেসেজ অবধি আমরা এখন সে বার্তাই পাচ্ছি। নভেল করোনা ভাইরাস, নতুন নামকরণে সিভিয়ার অ্যাকিউট রেস্পিরেটরি সিনডড়োম করোনা ভাইরাস টু বা সংক্ষেপে সার্স-কভ-টু, ভাইরাসের ভুবন-কাঁপানো ক্ষমতা জানান দিচ্ছে। চীনে উৎপন্ন হয়ে এই ভাইরাস দেশ থেকে দেশান্তরে পাড়ি দিচ্ছে ইচ্ছেমতো, ঘটাচ্ছে কোভিড-নাইনটিন অসুখ, আক্রান্ত এবং মৃতের সংখ্যা বাড়ছে লাফিয়ে-লাফিয়ে।কোনো পরিসংখ্যান এখানে যোগ করার মানে নেই কারণ এ লেখা প্রকাশের সময় সেটা অবান্তর হয়ে যাবে। তবে এইটুকু বলা যায় যে ইতালি, স্পেন, ভারত বা আম্রেরিকার মতো দেশ এখন আক্রান্তের সংখ্যা গুনছে লক্ষে, হাজারে নয়। কিছু গাণিতিক মডেল দাবি করছে যে অচিরে মৃতের সংখ্যাও লক্ষে গুণতে হবে পৃথিবীর বহু দেশে। অবিশ্বাস করার কারণ দেখছেন না বিশ্বের নাগরিকরা।

মানুষের মনে খুব আশা ছিল যে ঋতু বদলালে তাপমাত্রা বাড়বে, হয়তো নিঃশব্দে থামবে কোভিড-১৯ রোগের দৌড়। আসলে বার্ড ফ্লু বা সোয়াইন ফ্লু রোগের ক্ষেত্রে আমরা এমনটা হতে দেখেছিলাম কিনা! কিন্তু সে আশায় জল ঢেলে দিয়েছে নভেল করোনা ভাইরাসের হাড় হিম করা বিস্তার। ভাইরাসকে পোষক থেকে বঞ্চিত করতে বিশ্বজুড়ে লকডাউনের বন্দোবস্ত, ফলে সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং আজ সব থেকে চেনা পরিভাষা। যে সব দেশ লকডাউনের পালা শুরু করতে গড়িমসি করেছিল তাঁদের চরম মূল্য দিতে হয়েছে নাগরিকদের জীবনের বিনিময়ে। লকডাউনের মধ্যেও যারা অবহেলা করছে দূরত্ব রক্ষার নীতিকে তারাও বুঝেছে যে কত ভয়ঙ্কর এই ভাইরাস। কিন্তু একদিন থামবে এই ভাইরাসের মরণ-দৌড়, এই আশায় বুক বেঁধে আছেন সবাই। কিন্তু এক আগমনেই কি সীমিত থাকবে নভেল করোনা ভাইরাস? হয়তো প্রত্যেক বছরে নির্দিষ্ট সময়ে সেটা ফিরবে নিয়ম করে। অথবা হয়তো বেশ কয়েক বছর বা দশক ঘাপটি মেরে পড়ে থেকে সেটা আরও বড়ো মহামারী ঘটাতে ফিরে আসবে। এ সবের বিরুদ্ধে আমাদের সুরক্ষা একটাই-আমাদের জ্ঞান। শুধু চিকিৎসকের কাছে এই জ্ঞান থাকলেই যদি চলে যেত তবে সাদা কাগজে মসীলেপন না করলেও চলত। জনগোষ্ঠীর মধ্যে জ্ঞান ছড়িয়ে না পড়লে প্রয়োজনীয় সুরক্ষা নেওয়া একেবারেই সহজ হয় না। তাই ভুবন শাসানো ভাইরাসে নিয়ে ভাবনা।

না-মানুষের মধ্যে উৎস
মটন-চিকেন পেলেই সন্তুষ্ট আম বাঙালি। আডভেঞ্চার-প্রিয় বঙ্গসন্তান আরো কত পশুপাখির দিকে যে হাত বাড়ায় তাঁর হিসেব রাখা দায়। না জেনেবুঝে যখন সেই বাঙালিই ফাস্ট ফুড সেন্টার থেকে ভাগাড়ের ফসল মানে বেড়াল-শেয়ালের মাংস পেটে চালান করে তখন সব হিসেবই গুলিয়ে যায়। বাংলায় লেখা হচ্ছে বলে এমন ব্যাপারস্যাপারের দায় কেবল বাঙালির উপর চাপানো অবশ্য ঠিক হবে না। মাংসের রান্নায় আজ সীমাহীন বৈচিত্র্য বিশ্বজুড়ে। সব মাংস যে রান্না করে তবে উদরস্থ করা হয় এমনও নয়। স্থানীয় রীতিনীতি অনুযায়ী আধসেদ্ধ বা নেহাৎই কাঁচা মাংসও জায়গা পায় প্লেটে। খাদ্যরসিক এবং বৈচিত্র্যপিপাসু মানুষ এসব নিয়ে বিপুল আমোদ করবেন বৈকী! কিন্তু কথা হচ্ছে যে এ জগতে বহু জিনিসের সঙ্গে ফাউ মেলে, না চাইতেই। মাংসের সঙ্গে, এমনকি অনেক রকম মাছের সঙ্গএও, তেমনভাবেই ফাউ হয়ে আসে ভাইরাস! এ নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহেরসুযোগ নেই। ত্রাস জাগানো কোভিড-১৯ মানুষের শরীরে ঢুকেছে না-মানুষের মধ্যে দিয়ে। তবে শুধুমাত্র খাদ্যপ্রিয় মানুষগুলোকে কাঠগড়ায় দাড়করানো বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে সঠিক হবে না। পশুপাখি, পোকামাকড়ের কেবলমাত্র ছোঁয়াছুঁয়ি পেলেই ভাইরাস- লাভ হতে পারে, একথা জেনেই এগোনো যাক। অরণ্য যখন ধ্বংস করি আমরা, না বুঝে গভীরে ঢুকে যখন সম্পদ হাতানোর ‘মানবিক’ কর্ম করি তখন ভিটেছাড়া হয় বহু প্রাণী। উচ্ছেদ হওয়া না-মানুষদের ভীত-সন্ত্রস্ত ছোটাছুটির সময় বেরিয়ে আসে ঝাঁকে-ঝাঁকে ভাইরাস। ঢুকে পড়ে মানব শরীরে। এভাবেও ভাইরাস আহ্বান করে চলেছি আমরা। উদাহরণ হিসেবে প্রথমেই বেছে নেব বাদুড়দের।

নভেল করোনা ভাইরাসের দাপট শুরু হও্যার কিছু দিন আগে বার্কেলের ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার এক গবেষক দল সম্প্রতি বাদুড়ের দেহে উপস্থিত ভাইরাসের গতিপ্রকৃতি জানতে অনুসন্ধান চালান। তাঁদের গবেষণায় জানা গিয়েছে যে বাদুড়ের শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং ভাইরাসদের লড়াইয়ে বিপজ্জনক ফল হয় মানুষের মতো স্তন্যপায়ীদের জন্য। স্তন্যপায়ী প্রাণী বাদুড়ের প্রতিরক্ষা ভীষণ শক্তপোক্ত। ভাইরাসের উপস্থিতি দেখা মাত্রি সক্রিয়তার চরম অবস্থায় চলে যায় এই ব্যবস্থা। ভাইরাসকে কিছুতেই প্রবেশাধিকার দেয় না কোষের মধ্যে। এই জবরদস্ত প্রতিরক্ষার প্রাচীর অতিক্রম করার লক্ষ্যে ভাইরাসের দেহে ক্রমাগত পরিবর্তন ঘটতে থাকে। ফলে ভাইরাস হয়ে ওঠে আরো মারাত্মক। দ্রুত বংশবিস্তারও করতে থাকে ভাইরাস যাতে পোষক দেহ প্রতিরক্ষা গড়ে তোলার আগেই ঢুকে পড়া যায় তাঁর মধ্যে। কিন্তু এত সত্ত্বেও সুস্থথাকে বাদুড়ের দল। মানুষের দেহে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আর ভাইরাস যদি এমন মারদাঙ্গা চলত তাহলে অসুস্থ করে ফেলার মতো প্রদাহ তৈরি হত শরীরে। জ্বর হত, অন্যান্য সমস্যা দেখা দিত। কিন্তু অদ্ভূত ব্যাপার হল, বিবর্তনের মাধ্যমে প্রদাহ আটকানোর কৌশলও তৈরি হয়ে গিয়েছে বাদুড়ের শরীরে। ফলে ভাইরাস থেকে নিরাপদ বাদুড়কুল। তাঁদের শরীরে এ সব উপসর্গ দেখা দেয় না বা বলা ভালো উপসর্গ তৈরির জীবরাসায়নিক ক্রিয়াটাই সৃষ্টি হয় না।

ঘন, গভীর জঙ্গল যখন উন্নয়নের নামে নাশ করে মানুষ তখন বাস্তুচ্যুত হয় বাদুড়েরা। তাঁদের মল-মূত্র-লালা ক্ষরণ হয় বেশি, তাঁদের সঙ্গে খুব বেশি করে বেরিয়ে আসতে থাকে ভাইরাস। ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার গবেষ্কদলের প্রধান কারা ব্রুক তেমনি জানিয়েছেন। এই শক্তিশালী ভাইরাস যখন অন্য স্তন্যপায়ীর শরীরে বাসা বাঁধে তখন ফল হয় মারাত্মক। বাদুড়ের মতো নিশ্ছিদ্র প্রতিরক্ষা না থাকায় সহজেই কাবু হয় তাঁরা। মানুষের ক্ষেত্রেও এমনই দুরবস্থা ঘটে। কোভিড-১৯ সহ বহু ভাইরাস এভাবেই এসেছে মানবশরীরে। তবে গবেষকদের অন্য একটা সিদ্ধান্তও মনোযোগ দিয়ে শোনার মতো। বাদুড়ের মধ্যে থাকা অনেক ভাইরাস কোনো এক মধ্যবর্তী প্রার্ণীর শরীর হয়ে তবে মানুষের মধ্যে পৌঁছায়। তালিকা তৈরি করে দিয়েছেন তাঁরা। সার্স এসেছে বেড়ালের মত দেখতে এশিয়ান পাম সিভেট হয়ে, মার্স এসেছে উট হয়ে, ইবোলা গরিলা ও শিম্পাঞ্জি হয়ে, নিপা বহন করে এনেছে শুয়োরের শরীর, মরবার্গ এসেছে আফ্রিকার সবুজ বাঁদরদের দেহ হয়ে। তবে এই প্তহে আসার সময় ভাইরাসের শক্তি কিন্তু একটুও কমে না।

নিপা ভাইরাসের প্রকোপের কাহিনি আর-একবার ঝালিয়ে নিলে পুরোটাই যে বার্কলের গবেষকদের তথ্যের সংগে মিলবে এমন নয়। ১৯৯৯ সালে মাওলয়েশিয়ার শূয়োর চাষিদের মধ্যে প্রথম এই রোগের প্রকোপ দেখা যায়। কিন্তু তাঁর পরে আর কিন্তু সে দেশে এই ভাইরাসের আক্রমণের কথা শোনা যায়নি। বাংলাদেশে এই রোগ দেখা যায় ২০০১ সালে এবং তারপর প্রত্যেক বছর এর আবির্ভাব ঘটেছে। সন্নিহিত ভারতের পূর্ব অংশেও এর প্রকোপ দেখা গিয়েছে। ঐ বছরেই অর্থাৎ ২০০১ সালে শিলিগুড়িতে নিপা ভাইরাসে আঘাত হানল, স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যেও হু হু করে ছড়িয়ে পড়ল নিপা। কাম্বোডিয়া, ঘানা, ইন্দোনেশিয়া, মাদাগাস্কার প্রভৃতি দেশে এর মড়ক লাগা অসম্ভব নয় যেহেতু এ-সব জায়গায় ভাইরাস বয়ে নিয়ে যাওয়া বাদুড়দের অস্তিত্ব রয়েছে। মালয়েশিয়ায় যেবার নিপা ভাইরাসের আক্রমণ ঘ\টল মানুষের শ্রীরে সেবার সিঙ্গাপুরেও রোগ ছড়াল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে এর অধিকাংশটাই ঘটেছিল অসুস্থ শুয়োরের সংস্পর্শে আসায়। কিন্তু বাংলাদেশে ও ভারতে যে রোগ ছড়ানোর ঘটনা তাঁর মূলে ছিল বাদুড়। যে-সব ফল বা ফলের রসে বাদুড়ের মল-মূত্র-লালা মিশে ছিল সেগুলো মানুষের শরীরে বয়ে নিয়ে গিয়েছে ভাইরাস। আম-জামে কামড় দিয়ে বা ভালোবেসে খেজুরের রস খেয়ে অনেকে আক্রান্ত হয়েছেন নিপা ভাইরাসে। ফলে এখানে মধ্যবর্তী প্রাণীর প্র্যোজন হয়নি বলেই দেখা যাচ্ছে। কোনো উপসর্গ রৈরি না করেই মানুষের শরীরে থেকে যেতে পারে এই ভাইরাস। বাড়াবাড়ি অবস্থায় মারাত্মক শ্বাসকষ্ট অথবা প্রাণঘাতী এনসেফালাইটিস হতে পারে আক্রান্তের দেহে।

এখনও অবধি বিজ্ঞানীদের বড় অংশ মনে করছেন বাদুড়ে থেকেই এসেছে নতুন এই ভাইরাস। প্যাঙ্গোলিনকেও অবশ্য রাখা হয়েছে নভোল করোনা ভাইরাসের উৎসের তালিকায়। সাধারণ সর্দিকাশি ঘটানো করোনা ভাইরাসের দঙ্গে তাঁর মিল প্রচুর। এখানে আর-একটু পরিষ্কার করে বলা ভালো যে সার্স-কভ-টু হল সপ্তম করোনা ভাইরাস যা মানুষকে আক্রমণ করার ক্ষমতা দেখিয়েছে। চীন জৈব অস্ত্র হিসাবে ঐ জীবাণু ৯নাকি বীজাণু?) ব্যবহার করার পরিকল্পনা করেছিল এমন গুজব হাওয়ায় ভাসলেও তাঁর কোনো ভিত্তি নেই। অভিজ্ঞ বিজ্ঞানীরা উপযুক্ত বিশ্লেষণ করে সে সম্ভাবনা বাতিল করে দিয়েছেন। ফলে হোয়াটসয়াপ বা ফেসবুক পাঠশালার শিক্ষার্থীরা ছাড়া এ-সব গুজবে কেউ কান-চোখ দিচ্ছেন না। আরো যে ধন্দটা কাজ করছে তা হল কোভিড ১৯ রোগটা মানুষ মারায় কতটা সক্ষম সেই তথ্য নিয়ে। বহু মানুষকে আক্রমণ করলেও শতাংশের হিসেবে মানুষ মারার দক্ষতায় কোভিড সম্ভবত সার্সের থেকে পিছিয়ে। প্রথমে যেমনটা মনে হয়েছিল সবার, তা বোধহয় সত্যি নয়। সার্সের ক্ষেত্রে মানুষের মৃত্যুর শতাংশ যেখানে আক্রান্ত মানুষের দশ শতাংশ সেখানে কোভিডের ক্ষেত্রে এই হার সম্ভবত এক থেকে দুই শতাংশে দাঁড়াতে চলেছে। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি ল্যান্সেট পত্রিকার অনলাইন সংস্করণ এমন তথ্য দেয়। তবে শেষ কথা বলার সময় এখনও আসেনি। তবে মানুষের শরীরের মধ্যে নিজের জায়গা করে নিতে অনেক বেশি দক্ষ নভেল করোনা ভাইরাস।

জীবনযাত্রার কারণে এই বিস্তার
এইডস সম্পর্কে বোধহয় নতুন কথা কেউই পড়তে চাইবেন না। তবু ঝালিয়ে নেওয়া যাক ভাইরাসের বৃত্তান্তটা। শিম্পাঞ্জির শরীরের থাকা সিমিয়ান ইমিউনোডেফিশিয়েন্সি ভাইরাস (এস আই ভি) মানুষের শরীরে এসে হয়ে গেল এইচ আই ভি ১। ঘটাল এইডস। কিন্তু শিম্পাঞ্জির দেহে এই ভাইরাস এসেছিল বাঁদর থেকে। মাংসাশী প্রাণী শিম্পাঞ্জি, বাঁদরের মাংস খুব প্রিয় তাঁদের। এই মাংস থেকেই তাঁদের শরীরের ঢোকে ভাইরাস। দুটো ভিন্ন ধরনের বাঁদর থেকে ভাইরাস এসে হাইব্রিড হয়ে তৈরি হয়েছিল এস আই ভি। তবে ম্যাঙ্গাবে বাঁদর থেকে সরাসরি মানুষের শরীরে ঢুকেছে এইচ আই ভি, এমন ধারণা ছিল। সেভাবেই এসে থাকতে পারে এইচ আই ভি ২। এই ১ ও ২ ভাইরাসকে আলাদা করার একটা কারণ আছে। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়েও ভাইরাসের উৎস নির্দিষত করা যায়নি। তবে ধারণা করা হয়েছিল যে প্সহু থেকেই এসেছে এই ভাইরাস। কিন্তু তখন লাইবেরিয়া থেকে একজন আক্রান্ত ব্যক্তিকে পাওয়া গেল যার শরীরে ভাইরাসের ধরন কিছু আলাদা, তাই সে ভাইরাসের সঙ্গে জুড়ল ২ সংখ্যাটা। এই ভাইরাসের ভালো রকম মিল রয়েছে দুটি ম্যাঙ্গাবে বাঁদরের দেহে উপস্থত ভাইরাসের সঙ্গে। এই বাঁদর শিকার করে মাংস খাওয়াটা ওখানকার স্থানীয় রীতি। ফলে সেভাবে মানুষের শরীরে এইডস ভাইরাসের ঢুকে পড়া অস্বাভাবিক নয়। এতেও তেমন সমস্যা ছিল না। কোনো একটা বিচ্ছিন্ন জায়গায় পশু থেকে মানুষে ভাইরাস লাফাতেই পারে। তাতে গোটা মানব্জাতি বিপন্ন হয়ে পড়ে না। কিন্তু গ্রাম থেকে শহরে চলাচল যত বাড়ল ততই ছড়াতে লাগল ভাইরাস। একবার শহরে বা তাঁর কাছাকাছি জায়গা পাওয়ার পর দেখা গেল যে বড়ো সড়ক বা হাইওয়ে বরাবর ছড়াচ্ছে এই জীবাণু। তারপর আরো দূরে, সড়ক থেকেহাওয়াপথে, প্লেনের আত্রীদের মাধ্যমে দেশ-বিদেশে। এই শেষ ধাপতা ছিল মারাত্মক, এইডস রগ বিশ্বজোড়া মহামারী বা প্যানডেমিক হওয়ার প্তহে আর কোনো বাধা রইল না। এমনিতে এইচ আই ভি খুব দুর্বল ভাইরাস, পোষক দেহে ঢোকার পরে অনেক সময় লাগে রোগভোগ ঘটাতে, সহজে ছড়াতে পারে না। কিন্তু এত বড়ো ক্ষেত্র পেয়ে যাওয়ায় এবং মানুষের পরিবর্তনশীল আচরণ (যার মধ্যে যৌন সংসর্গই এখানে গুরুত্বপূর্ণ), তাঁর সাহায্যে গোটা বিশ্বের ত্রাস হয়ে উঠল এইচ আই ভি। ১৯৯৫ সালে নিউইয়র্কের রকফেলার ইউনিভার্সিটির স্টিফেন মর্স এভাবেই ব্যাখ্যা করেছিলেন ব্যাপারটা, এমার্জিং ইনফেকশাস ডিজিজেসের প্রথম সংখ্যায়।

ইনফ্লুয়েঞ্জা রোগের বিশ্বব্যাপী বিস্তারের মূলে রয়েছে আমাদের খাবার উৎপাদনের পদ্ধতি, আমাদের চাষ-আবাদের পালটে যাওয়া ধরন। চীনে শুরু হয়েছিল হাস-শুয়োরের মিলিত চাষ। এর অনেকগুলো লাভজনক দিক ছিল। অলাভের মধ্যে আছে ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়া। জলের পাখি যেমন হাঁসের মধ্যে বাসা বাঁধে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস। এর মানে অবশ্য এই নয় যে হাঁসেই কেবল পাওয়া যায় এই ভাইরাস। বিংশ শতক জুড়ে বিভিন্ন উৎস থেকে আলাদা করা হয়েছে ইনফ্লুয়েঞ্জা এ ভাইরাসকে। শুরুর দিকে পাওয়া গেল গৃহপালিত মুরগীতে, বিশের দশকে শুয়োরে, তিরিশের দশকে মানুষের মধ্যে, পঞ্চাশের দশকে ঘোড়া আর গৃহপালিত হাঁস থেকে, ষাটের দশকের শুরুতে সামুদ্রিক পাখি টার্ন থেকে এবং সত্তর দশকের মাঝামাঝি নানা জলের পাখি থেকে যার মধ্যে অবশ্যই সামুদ্রিক পাখিও রয়েছে। ভাইরাসের শরীরে থাকা আর এন এ প্রকৃতিতে কেমন তা নিয়ে বিশ্লেষণ করার সুযোগ পাওয়া গেল বিংশ শতকের শেষের দিকে কারণ তখন জিন সিকোয়েন্সিং আসতে শুরু করেছে গবেষকদের হাতে। এদিকে কী হল, পঞ্চাশের দশকের শেষে এশিয়ায় এবং ষাটের দশকের শেষে নির্দিষ্ট করে হংকংয়ের নাগরিকদের বমধ্যে ইনফ্লুয়েঞ্জার প্রকোপ দেখা দিল। এর পরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কর্তাব্যক্তিদের আগ্রহে অনুসন্ধান শুরু হল। না-মানুষদের মধ্যে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের অস্তিত্ব নিয়ে খোঁজ শুরু হল যাতে মহামারীর গতিপথ বোঝা যায়। বিজ্ঞানের গবেষকরা প্রকল্প বা হাইপোথেসিস তৈরি করে এগোন। এক্ষেত্রে একটা হাইপোথেসিস তৈরি করা হল যে জলের পাখি থেকেই অন্যান্য প্রাণীতে ছড়িয়েছে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস। নেচার নামের জার্নালও ১৯৮৮ সালে একখানা বিবরণ প্রকাশিত হয়েছিল এ বিষয়ে। সেখানে বলা হয় যে জলের পাখির মধ্যে ভাইরাসের ভাণ্ডার থাকলেও সরাসরি সেখান থেকে মানুষের মধ্যে ছড়ায় না ইনফ্লুয়েঞ্জা এই রকমের ভাইরাস। আগে তা শুয়োরে গিয়ে ঢকে, সেখানে কিছু জিনগত পরিবর্তন হয় এবং তাঁর পরে মানুষের শরীরে ছড়ানোর সক্ষমতা অর্জন করে এই ভাইরাস। আঙুল তোলা হয় কৃষি ব্যবস্থার দিকে যেখানে কখনো হাঁস এবং শুয়োর বা কোথাও তাঁর সঙ্গে মাছ চাষও করা হয়। পাখির মল মাছের ফলন বাড়াচ্ছে, মানুষের খাদ্যের ঘাটতি মেটাতে ঘটে যাচ্ছে নীল বিপ্লব! খরচ নেমে যাচ্ছে চাষের পরিবর্তিত কৌশলে। কিন্তু শুয়োরের সঙ্গে এই ক্রমাগত্র মেলামেশা ইনফ্লুয়েঞ্জার বিকাশে অনুকূল হয়ে দেখা দেয়। চীনে তো হাঁস আর শুয়োর এক্সঙ্গে পালনের রীতি বহু প্রাচীন, ফলে সেখান থেকে সরবরাহ হয়েছে ভাইরাস। ১৯৯২ সালে রবার্ট ও্যেবস্টার এবং সহযোগী বিজ্ঞানীরা যে আলোচনা শোনান আমাদের তাতে চাষবাসের ধরন নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস-বাহী বন্য হাসকে যেন আটকানো হয় তা বারবার বলেন তাঁরা। আয়ারল্যাণ্ড, আমেরিকার পেন্সিলভানিয়া, অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়াতে যে ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারী হয়েছিল তা আটকানো যেত যদি চাষিরা তাঁদের পালিত হাসগুলোকে আলাদা করে রাখতে পারতেন। পোলট্রির পাশে একখানা পুকুরে হাঁস পালন করার রীতি মারাত্মক হয়ে দেখা দিয়েছে বলে গবেষকদের অভিমত। ঘরের হাঁস আকর্ষণ করে বন্য হাসদের। মেলামেশায় ভাইরাস আমদানি হয় দেদার। কৃষি বিভাগের কর্তারা চাষিদের কাছে আবেদন জানা যাতে এই খোলামেলা হাঁস পালন বন্ধ হয়। এতে কাজ হয়েছিল কিনা জানা নেই কারণ উৎপাদনের লাভজনক পথ কখনোই ছাড়তে চাইবে না মানুষ।

শুয়োরের দেহ ভাইরাস রূপান্তরের কারখানা। এ কথা জেনেছি আগেই। কিন্তু আরো কিছুটা জানা দরকার। ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের মোড়কের উপর দুটো পদার্থ থাকে যেগুলো শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে উত্তেজিত করে। এরা জাতে প্রোটিন এবং নামে অয়ান্টিজেন। একটার নাম হেমাগ্লুটিনিন, বোঝানো হয় ইংরেজি এইচ অক্ষর দিয়ে, আর অন্যটা হল নিউরামিনিডেজ, ইংরেজি এন অক্ষর দিয়ে সূচিত হয়। শোলো রকম হেমাগ্লুটিনিন আর নয় রকম নিউরামিনিডেজ এখনও পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। পাখি থেকে, মানুষ থেকে শুয়োরের শরীরে এসে মেশে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস। তাঁর নিজের শরীরের ভাইরাসও আছে সেখানে। এবার চলল রূপান্তর। কত রকম এইচ আর এনের কম্বো যে তৈরি হয়! ফলে ভাইরাসের নতুন-নতুন সাব-টাইপ চলে আসে প্রকৃতিতে। কিন্তু কিছু ভাইরাস কেবল শুয়োরের দেহেই রোগ ঘটাতে পারে। প্রধান যেগুলো তা হল H1NI, H1N2, H3N2 আর H3N1. ভাইরাস রোগ ঘটায়, কাশি-সর্দি-আলস্য-ক্ষুধামান্দ্য হয় শুয়োরদের। কিন্তু চট করে মানুষে ছড়ায় না। একেবারেই ছড়ায় না এমনও নয়, শুয়োরের সংস্পর্শে আসা চাষি পুরোপুরি নিরাপদ নয়। তবে আক্রান্ত হওয়ার হার খুবই কম। এখানে খাদ্যরসিকদের প্রসঙ্গটা ফের আনা উচিত একবার। শুয়োরের মাংস খেলেই কি ভাইরাস চলে আস্তে পারে শরীরে? উচ্চ তাপমাত্রায় ঠিকমতো রান্না করে খেলে শুয়োরের মাংস ভাইরাস ছড়াবে না বলেই অভিমত আমেরিকার সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অয়ান্ড প্রিভেনশনের। তাহলে? ছড়ানোর পথ শুয়োরের হাঁচি-কাশি। হাওওয়ার মধ্যে দিয়ে এই ভাইরাসের বায়ুবাহিত হওয়া। একবার মানুষ আক্রান্ত হলে তাঁর হাঁচি-কাশি দিয়ে ছড়াতে পারে অন্য মানুষের মধ্যে। ফলে মানুষে-মানুষে মেলামেশা বন্ধ করে ভাইরাসের সংক্রমণ রোধ করাই হয়ে ওঠে প্রতিরোধের একমাত্র পথ।

পশু থেকে মানুষের ভাইরাস যত না ছরায় ততই ভালো। ঠিকই। কিন্তু যে ভাইরাসের এমন ছড়ানোর ক্ষমতা আছে তা যদি একেবারেই না ছরায় তাহলেও বিপত্তি। কয়েন? কারণ মাঝে-মাঝে ছড়ালে মানুষের দেহে প্রতিরক্ষা তন্ত্র কিছুটা তৈরি হয়ে থাকতে পারে। আক্রমণ ঘটলে প্রতিরোধ গড়তে পারে কিছুটা বা পুরোটা। বহু দিন অবধি ছড়ানোর ঘটনা না ঘটলে উদবেগের কারণ ঘটে। ১৯৬৮ সালের ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারীর কথা বলেছি আগেই। ২০০৯ সালে জার্নাল অফ মলিকিউলার অয়ান্ড জেনেটিক মেডিসিনে ও্যেনজুন মা ও সহযোগী গবেষকরা মনে করিয়ে দেন যে H2 আছে এমন ভাইরাস ১৯৬৮-র পর আর মানব্দেহে আক্রমণ চালায়নি। ফলে তৈরি নেই ইমিউন সিস্টেম। ফের যে কখন আক্রমণ চালিয়ে বিপর্যয় ঘটাবে তা গভীর আশঙ্কার বিষয়। একই-রকম আশঙ্কা তৈরি হয়ে আছে বার্ড ফ্লু ভাইরাস H5N1-কে নিয়ে। ব্যাপকভাবে মানুষে ছড়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে এরও। কোনো কোনো জায়গা থেকে ছড়ায় তা আগেই আলোচিত হয়েছে। এই গবেষ্ণাপত্রে আর-একবার আঙুল তোলা হয়েছে যে উৎসের দিকে তা হল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ‘ও্যেট মার্কেট’। এই সব বাজারে মানুষ-শুয়োর-হাঁস-মুরগীর মেলামেশা চূড়ান্ত রকমের। জনস্বাস্থ্যের পক্ষেতা ভয়ঙ্কর।

ম্যাজিক চাই, ম্যাজিক
অতশত জেনে কী হবে, বিজ্ঞান কী করছে! মানুষ সবরকম, সব ধরনের আচরণে লিপ্ত হবে আর বিজ্ঞানকে কিছু একটা ম্যাজিক সুরক্ষা দিতে হবে! বিশ্বজুড়ে প্রত্যাশাটা সেরকমই। তাতে অবশ্য সমস্যা নেই, বিজ্ঞান-নির্ভরতা তো চাই আমরা সবাই। কিন্তু এটা বোধহয় বৈজ্ঞানিক মানসিকতার প্রমাণ নয়। ভাইরাস আর ব্যাক্টিরিয়া এমনিতে সমার্থক, নিত্যযাত্রী থেকে মাল্টিমিলিওনেয়ার, কবি থেকে ক্রিকেতার বিশেষ ভেদ করেন না এদের মধ্যে। ফলে অয়ান্টিবায়োটিক প্র্যোগ করেও যখন ভাইরাসের দলকে তাড়ানো যায় না তখন হতাশা, বিরক্তি ইত্যাদি নানারকম আবেগ খেলা করে তাঁদের মধ্যে। বুঝে কী হবে যে ভাইরাস ব্যাক্টিরিয়া থেকে আলাদা? জানার কী দরকার যে ভাইরাস কোষের দখল নিয়ে নেয়, ফলে ভাইরাস মারতে চাওয়া মানে কোষকেই মারতে চাওয়া? আই পি এল না দেখে শোনার কোনো মানে হয় যে শরীরের প্রতিরক্ষা তন্ত্রের জ্বর ঘটানোর অন্যতম একটা কারণ হল তাপমাত্রা বাড়ানো? বেশি তাপমাত্রায় ভাইরাস টেঁকে না জেনে কে কবে বড়োলোক হয়েছে? এমন ‘যুক্তিপূর্ণ’ সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার ক্ষমতা কোনো বিজ্ঞানী বা সমাজবিজ্ঞানীর নেই। উপভোক্তার দরকার ম্যাজিক। সে ম্যাজিকের কিছুটা দিতে পারে টিকা অর্থাৎ ভ্যাক্সিন। ভাইরাস ঢোকার আআগে থেকেই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে উত্তেজিত করে প্রতিরোধের দেওয়াল তৈরি রাখে ভ্যাকসিন। ইনফ্লুয়েঞ্জার জন্য ভ্যাক্সিন আছে যা প্রত্যেক বছর উপযুক্ত মরশুমে নেওয়ার সুপারিশ করেন অনেক চিকিৎসক। কিন্তু ভ্যাকসিন মানেই সম্পূর্ণ নিরাপত্তা নয়। অবশ্য তা না হলেও কিছুটা প্রতিরোধ তৈরি থাকে যদি প্রত্যাশিত ভাইরাসের আক্রমণ ঘটে থাকে। কিন্তু অন্য সাবটাইপ উপস্থিত হলে কৌশল কাজ করবে না। তখন শুরু হয়ে যাবে রোগভোগ।

পনেরোটা ভাইরাসের বিরুদ্ধে তোরি ভ্যাকসিন লাইসেন্স পেয়েছে বাজারে আসার। শেষ যে ভ্যাকসিন লাইসেন্স পায় তা হল জরায়ুমুখের ক্যান্সার ঘটায় যে হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস, তাঁর বিরুদ্ধে। এটা ঘটে ২০০৬ সালে। তাঁর পর থেকে আর কোনো ভ্যাকসিন আসেনি বাজারে। জীববিজ্ঞানের ক্ষেত্রে নতুন প্রযুক্তির ছড়াছড়ি সত্ত্বেও এই অনুপস্থিতি। অর্থাৎ ভ্যাকসিন তৈরিতে সময় লাগে। তবু চেষ্টা চলছে। কোভিড-১৯ যখন ছড়িয়ে পড়ছে হু হু করে তখন প্রায় আড়াইশো ভ্যাকসিন তৈরির উদ্যোগের কথা জানা গেল। এমনকি মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাকে সম্বল করে ভারতের হায়দ্রাবাদ আর বেঙ্গালুরুর বহুজাতিক টিকা প্রস্তুতকারীরাও নেমে পড়েছেন তাঁদের পন্য বাজারে আনতে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে অবশ্য সব থেকে বেশি স্মভাবনাময় হিসাবে ঠাই পেয়েছে মিডিয়ার প্রচারে। সেখানে সেচ্ছাসেবীদের নিয়ে হিউমান ট্রায়াল শুরু হয়ে গিয়েছে। তবে এই ট্রায়েল শেষ হয়ে বাজারে টিকা আসতে সময় লাগবে বেশ কয়েক মাস।

কিন্তু টিকা তোইরি হলেই কি সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? বিশ্বের আটশো কোটির কাছাকাছি মানুষের কাছে কি পৌঁছে দেওয়া যাবে এই টিকা? দেওয়া গেলেও সামাজিক-রাজনৈতিক-ধর্মীয় বাধা কাটিয়ে টিকাকরণ কি সম্ভব হবে? এর উপরেও যে কথাটা আছে তা হল মাত্র একটা টিকাতে কোভিড-১৯ আটকানো যাবে কিনা! টিকাতে শরীরে যে অয়ান্টিবডি তৈরি হয় তাতে নির্দিষ্ট ধরনের প্যাথোজন বা জীবাণুকে আটকানো যায়। কিন্তু ইতিমধ্যেই নভেল করোনা ভাইরাসের একাধিক ধরন পাওয়া গিয়েছে। ভারতের কয়েকটা রাজ্যে অতিরিক্ত আক্রান্তের সংখ্যা তৈরি হওয়ার পেছনে নভেল করপোনা ভাইরাসের বেশি আক্রামণাত্মক একটা ধরন কার্যকরী রয়েছে বলে দাবি করছেন বিজ্ঞানীরা। ফলে একটা ধরনের জন্য তৈরি টিকা অন্য আর-একটা ধরনের বিরুদ্ধে কতটা সুরক্ষা দেয় তা দেখার।

টিকা বাদ দিলেও ওষুধ রয়েছে চিকিৎসকদের হাতে। এইডস রোগেরভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর ওষুধগুলো কাজে লাগাতে তৎপর চিকিৎসকরা। ভাইরাসের আক্রমণ না রুখতে পারলেও তাঁর বংশবিস্তারে বাধা সৃষ্টি করে এই সব ওষুধ। তবে এই ভাইরাসকে লক্ষ করে নতুন ওষুধ তৈরি করার চেষ্টাও চলছে সমান্তরাল্ভাবে। একটা উদাহরণ দেওয়া যায় এক্ষেত্রে। এইডস রোগের ওষুধ আবিষ্কারে অবদান রেখেছিলেন পার্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঙালি বিজ্ঞানী অরুণকুমার ঘোষ। ২০০৬ সালে তাঁর আবিষ্কৃত ওষুধ ‘দারুনাভির’ এইডসের প্রথম ওষুধ হিসাবে স্বীকৃতি পায় আমেরিকার ফুড অয়ান্ড ড্রাগ অয়াডমিনিস্ট্রেশন থেকে। আজ সেটা বিশ্বের আশিটা দেশে অনুমোদিত ওষুধ। অধ্যাপক ঘোষ নভেল করোনা ভাইরাসের বংশবিস্তার আটকাতে এমন এক ওষূধ তৈরি করার চেষ্টা করছেন, যা মানকোষের ভেতরে ভাইরাসের জীবঞ্চক্রের বিশেষ একটা ধাপকে আটকে দেয়। ২০২০-এর হেমন্তে এই ওষুধ বাজারে আনার চেষ্টা করছেন অধ্যাপক ঘোষের ল্যাবরেটরি।

এদিকে নানারকম বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে অন্য একটা ওষুধ হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন নিয়ে। ফ্রান্সের এক গবেষক দাবি করে বসলেন যে অয়াজিথ্রোমাইসিনের সঙ্গে এই ওষুধ প্র্যোগ করলে কোভিড-১৯ রোগীদের বাঁচানো সম্ভব। কিন্তু তিনি নিজের গবেষণার সম্পূর্ণ তথ্য প্রকাশ করেননি। এই গবেষণাতেই বিরূপ প্রতিক্রিয়া পাওয়া গিয়েছিল, মানুষ মারাও যায় এই চিকিৎসার পরে, এসব চেপে যান ওয়ি গবেষক। কিন্তু এর ভিত্তিতেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলে বসলেন যে হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন পালটে দিতে পারে গোটা অবস্থাটা, প্রায় হুমকির সুরে ভারতের কাছে চাইলেন এই ওষুধের বিরাট পরিমাণ সরবারাহ। কিন্তু এক সপ্তাহের মধ্যেই আমেরিকার অভিজ্ঞ বিজ্ঞানী এবং চিকিৎসকরা বোঝাতে লাগলেন যে এই ওষুধ প্র্যোগে লাভের থেকে ক্ষতি হচ্ছে অনেক বেশি। হৃদযন্ত্রের গোলমাল দেখা দিচ্ছে সহজে। আমেরিকায় এক দম্পতি ফ্রান্সের গবেষকের আশ্বাসবাণী শুনে অতিরিক্ত পরিমাণ হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন খেয়ে ফেললেন, মারা গেলেন স্ত্রী, স্বামী যুঝতে লাগলেন মৃত্যুর সঙ্গে। ভারতেও এ নিয়ে সরব হল ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিকেল রিসার্চ। বোঝানো হল যে কোভিড রোগীদের নিয়ে নাড়াচাড়া করছেন যারা একমাত্র তাঁদের জন্য এই ওষুধ দেওয়ার নিদান দিচ্ছেন তাঁরা। সে নিদানের সঙ্গেও অবশ্য জুড়ে থাকছে নানা শর্ত।

এভাবেই আজ রূপ পাচ্ছে করোনাচিত্র। আগামী দিনে এ চিত্র করটা করুণ হয়ে উঠবে তা বলা কঠিন। কিন্তু এটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং, মাস্ক পরা, ঘঙ্ঘন হাত ধোয়ার ব্যাপাটাকে আমাদের সঙ্গে নিয়েই বাঁচতে হবে। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে যে প্লেগ বা কলেরার মহামারী কয়েক মাসে বিদায় নেয়নি, মানবজাতিকে তাড়া করে ফিরছিল বেশ কয়েক বছর। কোভিড-১৯ ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে সবার এবং সে মনে হওয়াটা ভুল নয়। সতর্কতা এবং সুরক্ষার মোড়কে আমরা ক্রমশ মুড়ে নিচ্ছি নিজেদের। এর পরেও নিরাপদ থাকা যাবে কিনা তা নিয়ে অবশ্য সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে।

সন্দীপন ধর। পিএইচডি,  বিজ্ঞান লেখক ও বিজ্ঞান সঞ্চারক। জন্ম কলকাতার এক মধ্যবিত্ত পরিবারে। বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশুনো, পরবর্তী সময় ভারতে বিভিন্ন বিজ্ঞান আন্দোলন এর সাথে সম্পর্ক, ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেস এর জীবন সদস্য, ফেডারেশন অফ ইণ্ডিয়ান রেশন্যালিস্ট এসোসিয়াশন এর জীবন সদস্য। এছাড়া...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

গণতন্ত্র, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও বাংলার নবজাগরণের দু একটি কথা

গণতন্ত্র, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও বাংলার নবজাগরণের দু একটি কথা

একটি পরাধীন দেশ আর তার বাসিন্দাদের মনে স্বাধীনতার আকুতি আমরা দেখেছিলাম ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে। এর…..