ঝরা শিউলি
এক মেয়েটা মুঠো মুঠো জ্যোৎস্না কুড়িয়ে অপরের মুখমন্ডলে চাঁদ দেখত। মানুষের উপকার করার ক্ষেত্রে,…..
-এই বিরুদ্ধতাই পারে ছিঁড়ে ফেলতে বিভ্রমের ইতিহাস। মুক্তিপথে অবাধ্য হওয়া ছাড়া গতি নেই অন্য। সমুখের বারণবার্তাকে ছিঁড়ে ফেলে অবারিত হোক মোহজাল সব !
-শোন, শান্ত হও, বসো-
-এইসব নুয়ে পড়া, গলিত স্খলিতদের ভিড়ে মনুষ্যজীবন কঠিন বড় !
-আবেগ উষ্মা দিয়ে বিচার করা ঠিক হবে না, মানতে হবে-
-না মানার দিন কেবল শুরু আজ-
-জানতে হবে, কোথায় নিয়ে যাবে- একরোখা পথ শেষকালে-
-ঐ দূর পেছনের আগুন-বিছানো পথই হোক পাথেয়-
-মায়া, কেবলই ভ্রম- বিচ্ছিন্নতার একশেষ সবখানে-
-এই বিচ্ছিন্নতার ভেতরেই আছে আগুনের আঁচ-
ফেলে আসা পথের বাঁকগুলোতে থরে থরে সাজানো আছে আগুনপোড়া নুড়ি পাথর-
সেখানেই রচিত হবে পথ সমুখের-
২।
সংরক্ষিত ভবন থেকে সহসাই যে নোটিশ প্রচারিত হলো, সেই নোটিশকে ফালা ফালা করে- সারা ক্যাম্পাস রাত দ্বিপ্রহরে আগুন-শিখায় উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। মধ্যবয়সি সে আগুন-শিখার উত্তাপ বাড়তেই থাকে, এবং রাত শেষ হওয়ার আগেই যখন দিনের আলো ফুটে ওঠে তখন মনে হয় রাত কিংবা দিন একাকার হয়ে আছে বুকের স্ফিতকায় ধ্বনিতরঙ্গে। মুঠো মুঠো শক্তি থেকে ছুটে চলে বারুদের একান্নবর্তী সিসাসমগ্র।
ফলতঃ, সমূহ বিহিতাদেশকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে ক্যাম্পাসের একমাথা থেকে আরেক মাথায় ছড়িয়ে পড়েছিল সে ধ্বনিতরঙ্গ।
পুলকের এ ক্যাম্পাস-জীবন সবে দুই বছর গেল। আশপাশের অনেককিছু এখনো চেনাই হয়নি তার। দক্ষিণে কাঁটাতারের বেড়া সংলগ্ন পানাপুকুর, ঝুলে পড়া বেওয়ারিশ জামরুল কিংবা একা এক খেঁজুরগাছ, অপটু হাতের ধনুকের মতো উঁইয়ের ঢিবি, কি তার অনতিদূরে চালতার ঝাকড়া মাথা- চেনা হলো কেবল এই সেদিন। ডাইনিং হলের পেছনে এই যে শেওলাধরা টিনের কিচেনশেড- জনরবের আড়ালে কালো ছাই মাথায় করে দাঁড়িয়ে আছে, তার কোলের কাছে এই মাথাসমান ধানখেত- কখনো কাছেপিঠে এসেছে বলে মনে পড়েনা পুলকের। জানবাজি দৌড়ের মধ্যে ঝোপ-ঝাড় পেছনে ফেলে, আরো অনেকের সাথে পুলকও ঝপ করে নেমে যায় ঘন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ধানখেতে। অতঃপর কিছুদূর গিয়ে পুলক নাগাল পায় একা এক পাকা সড়কের। স্বভাবতই খুব অপরিচিত, অপ্রশস্ত এই পাকা সড়কটিকে কেনো জানি খুব প্যাঁচানো আর দুর্বোধ্য বলে মনে হয় পুলকের।
দুইদিক থেকে চেপে ধরেছে নানান অচেনা বৃক্ষসারি। পত্রপুষ্পহীন, একেবারেই ন্যাড়া, খোয়া ওঠা এবড়ো-থেবড়ো- বাস্তুচ্যূত কোন এক বৃদ্ধার মতো। পুলক হাঁটতে থাকে সড়কটির মতোই এলোমেলোভাবে। অদূরে, দুই পাশে ছোট বড়- বিচ্ছিন্নভাবে গড়ে ওঠা বাড়ি ঘর, লাঠিম খেলায় মগ্ন একটা ছেলের দলকে দেখা গেল। কিছুদূর এগোলে- একটা মুদির দোকান, সামনাটা ঢেকে আছে লটকে রাখা বর্ণিল মোড়কের লহরিতে। তার লাগোয়া চা দোকানে আলস্যে বসে আছে বেশ অনেকজন; এলইডি টেলিভিশন থেকে হার্সা ভোগলের স্মার্ট কণ্ঠ ভেসে আসছে লাগাতার। কিন্তু পুলক, কিংবা তার সঙ্গীয়দের উর্ধ্বশ্বাস ছুটে-চলাকে আমলে নিল না কেউই। পুলক একবার ভাবে, নিউজ আপডেটটা একবার দেখে যাবে কি না। কিন্তু কোন উসিলা ছাড়া এভাবে বসে পড়া– নিদেন এক কাপ চায়ের অর্ডার তো দিতেই হবে, আবার তার জন্য পাঁচটা টাকা নষ্ট করা, সেই জোর আছে কি না- সাথে সময় নষ্ট- নাহ, মন সায় দিল না তাতে। পুলক বরং হাঁটতে থাকবে। এবং যতই সে এগিয়ে যেতে থাকল, কিংবা বলা যায় পিছিয়ে যেতে থাকল, ততই দুরত্ব বাড়তে লাগল অন্যদের থেকে। সে জন্য পুলকের কোন আফসোস বোধ হলো না বটে, তবে দন্ডায়মান মোবাইল টাওয়ারের নিচে জড়োসড়ো ছাতিম গাছটার বামুন বামুন অবয়ব পুলককে বড় পীড়িত করে তুলল।
মাথার উপর কাক আর ফিঙ্গেগুলো উড়তে উড়তে, কিংবা ঠোঁটের ভেতর গরাস পুরতে পুরতে যখন অবসাদ, ক্লান্তি, অথবা নতুন শিকারের নিমিত্ত বসতে চাইল কাছেপিঠের কোন অবলম্বনে, তখন মিশমিশে কালো এক কাক গিয়ে বসল ঝুলানো তারের ওপর, অমনি ভোম করে একটা আওয়াজ উঠল। মুহূর্তের মধ্যে অনেকগুলো কাক আর ফিঙে কা-আ কা-আ- চি-ই চি-ই করে ছুটে এল, ঘুরতে লাগল উল্টো হয়ে ঝুলে থাকা কাকটাকে ঘিরে। কালোরঙ কাকটি জ্বলে-পুড়ে অঙ্গার হয়ে ঝুলেই থাকল। এক ফোটা রক্ত চুইয়ে পড়ার আর ফুরসত মিলল না।
মন খারাপের কিছু ঘটল কিনা ঠিক বুঝতে পারল না পুলক। কিন্তু পা যে খুসিমনে চলছে না আর- সেটা বেশ বুঝতে পারল। মতিগতির এমন রকমফের নিয়ে ভাবতে ভাবতে খাপ খোলা রোদের মধ্যে বসে পড়ল সে। মাথাটা যতই ভোঁ ভোঁ করে চক্কর দিতে থাকল ততই চারিদিকে অস্পষ্ট ছায়ার মতো দেখা গেল- লম্বা লম্বা ঠ্যাংয়ের ওপর ভর করে হামাগুড়ি দিচ্ছে একটি মানব-কায়া আর তার কাঁধে ঠ্যাং ঝুলিয়ে বসে আছে একজন ধবধবে মানুষ। সে ভীষণ ধন্দে পড়ে মানুষটার পা নিয়ে, দুটা পা দেখল এতোক্ষণ আর এখন দেখছে তিনটি পা। তারই পেছনে ওমনি আরেজন মানুষকে দেখতে পেল সে, দেখল সেই মানুষটি এবার নুয়ে পড়েছে আর দেখা যাচ্ছে দুটি, তিনটি এবং চারটি পা ঝুলে আছে কাঁধ থেকে তার। পুলক মাথার ওপর সূর্যের দিকে একবার তাকাতে চেষ্টা করে এবং শরীরটাকে কোনমতে উঠিয়ে নিয়ে হাঁটতে থাকে ধুঁকে ধুঁকে। সে দেখতে পায় চারপেয়ে অগুনতি মানুষ তাকে পাশ কেটে চলে যাচ্ছে জলের মতো থৈ থৈ করা সড়ক ধরে। এবং দেখতে দেখতে পাকা সড়কের চিকচিক করা বুকের ওপর দিয়ে সাঁতরে যেতে থাকল সে অন্য অনেকের সাথে।
পুলক খুঁজতে থাকে দীপা নামের মেয়েটিকে, যে মাত্র গত বছর একটা বাঁশি নিয়ে এ ক্যাম্পাসে পা রেখেছিল। অথচ বাঁশি নয়, সে দেখতে পায় মনুষ্যদেহের অসংখ্য অগণিত গহবর, হুঁসহুঁস করে প্রবল বেগে খরবায়ু বয়ে চলেছে। পুলক দুহাত উর্ধ্বে তুলে আঁজলা ভরে পান করতে থাকে সেই খরবায়ু, তাপদগ্ধ রৌদ্রকিরণ। নিমিষেই নিজেকে একটা বাঁশি বলে ভাবতে থাকে পুলক এবং চারপাশে অগুনতি দীপা তড়পাতে থাকে, শূন্যে ছুঁড়ে মারে পাঁজরের বিশ্বাস, ভয়হীন আকাশ জ্বলে ওঠে- আর জ্বলে ওঠে।
৩।
হতচকিত সুরক্ষিত ভবনের হর্তাকর্তাগণ। রক্তহিম পাথুরে বৈঠক বসে রক্ষিবেষ্টিত হয়ে। আদেশ নির্দেশ প্রেসনোট নিমিষে ছুটে যায় সকল ব্রডকাস্টিং প্রকোষ্টে। ‘সন্ধ্যা সাতটার মধ্যে হল ত্যাগ না করলে উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য কেউ দায়ি হবে না’- বাক্যসম্বলিত হাজার হাজার পৃষ্ঠা উড়তে থাকে, স্তব্ধ বাতাসে ঠোকাঠুকি খায় পরষ্পর। শূন্যতরঙ্গে জ্যাম লেগে গ্যাঁ গ্যাঁ করতে থাকে প্রেসনোটভাষণ, বিফল হওয়ার উপক্রম হয় কলকলাদির যাবতীয় প্রকার ও প্রকরণ। ফলতঃ ক্যাম্পাসের সুউচ্চ কপাটে পাহারা জোরদার করা ছাড়া গতি থাকে না আর। কিন্তু অবিলম্বে খবর পাওয়া গেল- এক নম্বর হোস্টেলের গেটে আগুন-চেহারা নিয়ে ঘাট হয়ে বসে আছে হনুমানের এক বিরাট দল।
কেউ নড়বে না একচুলও-
হল ছাড়বে না কেউ- কেউ না,
দীপা অথবা দীপার বাঁশি, অথবা হনুমানদল সমীপে বিবিধ সহমর্মিতা সহযোগে সদর্প পদচারণা চলে অতঃপর। দলা পাকানো, গুটিশুটি ঝিম মেরে পড়ে থাকা আজানুলম্বিত বিরস ক্যাম্পাস এক ঝটকায় অশান্ত হয়ে ওঠে।
বিস্ময় ঘিরে ধরে পুলকের চারপাশ। উড়তে থাকে ছেঁড়া ছেঁড়া বিবিধ ক্রোধ, তোলপাড় চলে ভিতর ও বাহির। ঘামতে ঘামতে, ঘোর কাটতে কাটতে- চোখের কোঠর থেকে উদগীরণ ঘটতে থাকে উত্তপ্ত ধোঁয়া। পুলক বুঝতে পারে না কী হবে, অথবা কী হতে চলেছে। সামনাসামনি, মুখোমুখি, কথিত গুরু এবং শিষ্যগণ।
অথচ এইসব ওলটপালট, দুমড়ানো-মোচড়ানো সকাল-সন্ধায় এক নিরাবেগ বৈপরীত্যকে বগলদাবা করে ঝিম মেরে বসেছিল অগ্রজ-অনুজ ভাই-বন্ধুগণ। হৈ-হুলস্থুল ছিল এখানে ওখানে, খোসআড্ডায় এফোঁড় ওফোঁড় হচ্ছিল সময়-অসময়ের অবশেষ। পুলক অবিকল দেখে, আইসক্রিমের লালায় চুয়ে চুয়ে পড়ছে প্রণয় অ-প্রণয়ের কালশিটে বৃত্তান্ত। উত্তরের মাঠ-সংলগ্ন, বৃক্ষতলবেষ্ঠিত চা-দোকানের জমাট ইয়ার-দোস্তি আরো তব্দা করে দেয় পুলককে। চা-কফি, বেনসন অ্যান্ড হেজেস সিগারেটের ঘূর্ণায়মান ধোঁয়ার কুন্ডলীতে ঢেকে যায় বলাৎকার-মুর্চ্ছিত বালক-কাল। পুলক বুঝে উঠতে পারে না দীপা নামের সদ্য অভিষিক্ত, সবে কৈশোরোত্তীর্ণ মেয়েটি কি ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত হচ্ছে আজই ? দীপার সাথে পুলকের সাক্ষাৎ পরিচয় হয়ে ওঠেনি তখনো, যদিও ডিপার্টমেন্টের নোটিশবোর্ডের পাশে, লাইব্রেরির টেবিলে মুখোমুখি হতে হয়েছিল বেশ কদিন। তবে ভলিবলের মাঠে, থার্ডকোর্ট থেকে অবলীলায় যে মেয়ে একহাতে বল পাঠিয়ে দিতে পারে অপরপক্ষের মুখ নিশানা করে, তাকে গ্রামের মাঠদৌড়ানো মেয়ে বলেই পুলকের গভীর প্রতীতি জন্মেছিল সেদিনই। দীপা কি সেই গ্রামেই ফিরে যাবে এখন ? সাড়ে সাত হাজার জনের থেকে বিচ্ছিন্ন, বিতাড়িত একা এক দীপা, কী জবাব দেবে তার মা কে, বাবাকে ! পুলক ভাবতে চেষ্টা করে, বাঁশি বাজানোর সর্বনেশে ঝোঁকটা হলো কী করে তার ! কিংবা কীভাবে, কার কাছে শিখল এই বাঁশিতে সুর তোলা ! তার কী কোন গুরু ছিলেন ? যদি থাকেন, কী বলবেন দীপাকে তিনি ? বোহেমিয়ান শিস দিতে দিতে একটা নায়ক চেহারার ছেলে তার পাশ কেটে চলে গেলে পুলক পেছন ফিরে দেখবার চেষ্টা করে । সে নিশ্চয়ই দীপার কথা শুনেছে। তাই হয়তো দীপার বাঁশির সুর তুলে নিয়েছে নিজের দুই ঠোঁঠের ভেতর। পুলক আরো সামনে এগোয়, দেখা গেল জনা দশ বারো ছেলে মেয়ে ঘাসের ওপর বসে হৈ হৈ করছে। আরো এগোলে দেখা যায় একাকি এক ছেলে কোলের ওপর গিটার রেখে টুংটাং সুর তুলছে। কিন্তু কোথাও দীপার একটা কথাও তার কানে এল না। পুলক এবার আরো আরো সামনের দিকে হাঁটার জন্য মনস্থির করল। সে দীপাকে খুঁজে বের করবে, অথবা দীপার আগেই ছেড়ে যাবে এই ক্যাম্পাস। পুলক যখন প্রায় মেইন গেটের কাছে চলে এসেছে, সেই ত্রিমুখি রাস্তার ওপাশ থেকে একটা ডাক ছুটে এল তার দিকে। দেখল তার বন্ধুটি গোল হয়ে বসে আছে আরো কয়েকজনকে সাথে নিয়ে। একটা বয়কাট চুলের মেয়ে কবিতা পড়ছে, রুদ্র অথবা সুনীলের । সে কাছে গেল, ভাবল দীপার খবরটা নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে এখানে। কিন্তু দীপার কোন কথা সেখানে উচ্চারিত হলো না। আরো সামনে এগোলে দেখতে পেল, দলবেঁধে কয়েকজন যাচ্ছে সদর রাস্তার দিকে, সেখানকার রেস্তোরার বিছানো প্রাঙ্গণে নানান জন আড্ডা-ইয়ার্কিতে ডগোমগো। কেউ চিবুচ্ছে মুরগির মাংশল রান, বুক, ঠ্যাং অথবা বিফকাবাব, ফুচকা। পাঁচজন, সাতজন, কিংবা প্রণয়ডোর বেঁধে জোড়ায় জোড়ায় বসে আছে ধোঁয়া ওঠা কফি সামনে নিয়ে। অনেকের মেলার মাঝে না-মেলা, এক পরস্পর শূন্যতা যখন বিনিসুতার মতো ঝুলছে, তখন পুলক পেছন দিকে ফেরে, দীপার এক নম্বর ছাত্রী হোস্টেলের দিকে নিশানা ঠিক করে।
আর, পুরো ক্যাম্পাস সেদিন কানকা-কাটা কৈ মাছের মতো তড়পাচ্ছিল, পুলক অবিকল দেখতে পায় এখনো।
৪।
অতঃপর, প্যাঁচানো- দুর্বোধ্য- এবং পাকা সরু সড়কটি অনাদরে বেড়ে ওঠা একটা মর্তমান কলার ঝোপ পেরিয়ে, মশৃণ এক পাকা সড়কের সাথে মিশে নিজের অস্তিত্ব নাই করে দিল । সেখান থেকে অদূরেই দেখা যাচ্ছে বেশুমার উঁচু উঁচু মার্বেলপাথর-মোড়া অট্টালিকার সারি।
কিন্তু অবাক বিস্ময়ে পুলক দেখল, সেই চকচকে পাকা রাস্তা দিয়ে দীপা নয়, বাঁশি নয়, একজন- দুইজন- অনেক অনেক লোক এগিয়ে আসছে তারই দিকে। দেখতে দেখতে- লোকগুলো তার মুখোমুখি হতে যাবে, ওমনি ঝট করে তারা তাদের চোখগুলো আলগোছে খুলে নিল, স্প্রিংবলের মতো শূন্যে লাফাতে লাগল কাজলকালো অথবা নীলবরণ চোখগুলো। মুহূর্তমাত্র, একেকটা চোখ ভোজবাজির মতো উড়তে শুরু করল। কোনটা বুক পকেটের বলপয়েন্ট, কোনটা ননজুডিশিয়াল স্ট্যাম্প, সাবরেজিস্টারের লালসালু মোড়া টেবিল, অর্পিত সম্পত্তি আইনের ধারা-উপধারা, সোফা, শোকেস, ফাইল কেবিনেট, ওয়াশিং মেশিন, শীতাতপ নিয়ন্ত্রন যন্ত্র- অথবা এপার্টমেন্টের বেলকুনি হয়ে দুলতে লাগল।
অতঃপর পুলক অনুভব করল একটা অর্জুন গাছের বাকল হয়ে সে ঝুলে আছে, অনন্তকাল ধরে।
৫।
ক্যাম্পাসের অর্জুন গাছটার সান্নিধ্য অনুভব করে পুলক, যার সাথে গেল দুই বছরে তার বেশ একটা সখ্যতা গড়ে উঠেছিল- অন্য অনেকের মতো । প্রায় প্রতি বিকেলেই এই অর্জুন তলায় পশ্চিমের দেওয়ালে পিঠ ছড়িয়ে দিয়ে, শুকনো পাতায় ঢাকা ঘাসের ওপর বসে কত রাজা উজির মেরেছে পুলকরা। গত পরশু এমনি যখন সে হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে হাজির হয়েছিল সেই অর্জুনতলায় তখন দেখা গেল ক্যাম্পাসের বড়ভাইয়েরা কিছু একটা নিয়ে কখনো ফিসফাঁস- কখনো উচ্চেস্বরে শোরগোল করছে ; কয়েকজন সহপাঠিকেও নজরে এল পুলকের। কিন্ত গাছের উপরদিকে চেয়ে তার মনটা যারপরনাই খুসি হয়ে উঠেছিল। শয়ে শয়ে হনুমান বসে আছে গাছের ডালে ডালে। কেউ লেজ ফুলিয়ে এ-ডাল ও-ডালে লাফ দিচ্ছে, কেউ মাথাটা গোল করে এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে নিচের দিকে। হনুমানদের জাত-পাত নিয়ে তখন তার কৌতুহল উঁকি দিয়েছিল বোধ হয় খানিকটা। কিন্তু অচিরেই সে টের পেল- বানর অথবা হনুমানের প্রজাতি-বিচার বিষয়ক জ্ঞানবুদ্দি তার খুব সীমিত বটে । বানর, শিম্পাঞ্জি কিংবা হনুমানগোত্রের সাথে নিজের জন্মসূত্র নিয়ে ভাবনার মাঝখানে অন্য এক জটলা থেকে আগত মৃদু গুঞ্জন তাতে ছেদ ঘটায় সহসা। এবং পরিপার্শ্ব-পরম্পরাহীন একটা বাঁশি, বেমানান চক্কর দিতে থাকে বৃত্তাকারে।
অবশ্য বাঁশির খবরটা পুলক জেনেছিল তারও কদিন আগে, এবং জানবার একদিন বাদেই- গত সপ্তাহের এক বিকেলে সেই বাঁশির সুর তার কানে এসে বেজেছিল অনেক্ষণ। পুলক সেদিন সদ্য সিগারেট তালিম দেওয়া বন্ধুটিকে নিয়ে একেবারে বিনা কারণে ঘুরতে বেরিয়েছিল, একনম্বর ছাত্রী হোস্টেল তখন বেশ পেছনে । না, তেমন আহামরি কোন রাগ রাগিনী কিংবা উঁচুদরের কোন সুর ছিল না সেটা। বরং একটা চটুল মতন গানের সুর ছড়িয়ে যাচ্ছিল এক অ-দেখা বাঁশি থেকে। তবে পুলক কিঞ্চিত রোমাঞ্চিত হয়েছিল এই খবরে যে, বাঁশিটা বাজাচ্ছে দীপা নামের প্রথম বর্ষের এক মেয়ে। সারা ক্যাম্পাসে ততদিনে চাউর হয়ে গেছে, দীপা নামের ঐ ছাত্রীটি বিকেল বেলা হোস্টেলের ছাদে ওঠে বাঁশি বাজায় আর তার বাঁশি শুনে বন-বাদাড় থেকে ছুঠে আসে সব গেছো হনুমান। এরা গোল হয়ে বাঁশি শুনে নিবিষ্ট ভাব নিয়ে, এমন নিয়ম হয়ে গেছে এই কদিনে। তবে বিষয় সেটা নয়, গোল বাঁধে অন্যখানে। পাশের টিচার্স কোয়ার্টারের আহ্লাদি বধুগণ সেই বাঁশির সুর নাকি মোটেই হজম করতে পারছেন না, বধুগণের ততোধিক প্রণত পতিপ্রবরগণ তাই উদ্বেগে পাগলপারা। ইতরকুল হনুমান-দর্শনে মানবকৌমার্য প্রায় যায় যায়। গো-রাখালজাত-বংশী অনাচারে কি এই বিশ্ববিদ্যালয় তার জাত-গৌরব জলাঞ্জলী দেবে ? গভীর ধ্যানমগ্নতায়, জলদগম্ভীরভাবে ধ্বনিত হলো- কস্মিনকালেও তাহা বরদাশত করা যাইবে না। আবশ্যিকভাবে তাই লাঠি আর বন্দুকওয়ালাদের তলব করা হলো জরুরী নির্দেশে। কিন্তু বিদ্যাশিক্ষার মুখে ঝাঁঠা মেরে হনুমানগোত্র চাষাভূষার মতো আচরণ করতে থাকল, ক্ষেপে গিয়ে হানা দিতে থাকল পাশের টিচার্স কোয়ার্টারে এবং যেখান যা পেল তা নিয়ে ছেলেখেলা করতে থাকল। এহেন, একজন উর্ধ্বতন অধ্যাপক-স্ত্রীর মেকআপ বক্স নিয়ে চম্পট দিলে হনুমানবংশের ভোগবাদ নিয়ে খিস্তি করলেন কেউ একজন। তবে, সদ্য পদন্নোতি পাওয়া এক সহযোগী অধ্যাপকের পিএচডি থিসিসের হার্ডকপি গায়েব হয়ে গেলে চৌর্যবৃত্তির রকমসকম নিয়ে তুলকালাম ঘটে গেল। সেইহেতু, বহুবর্ণিল সজ্জায় ধুপদুরস্ত পরাশক্তিমান সেই জাঁদরেল অধ্যাপকের লাফালাফি চাপাচাপিতে রাতেই জরুরী বৈঠকে বসতে বাধ্য হলেন দিনরাত রঙিন গগজপরা ভিসি মহোদয়। এবং কাউকে টুশব্দটি উচ্চারণ করবার ফুরসত না দিয়ে নিষেধাজ্ঞা জারী করলেন- দীপা আর ক্যাস্পাসে বাঁশি বাজাতে পারবে না মর্মে। ঘটনার আকস্মিকতায় স্তব্ধতা গ্রাস করল চারিদিকে। দীপা, সদ্য কৈশোর পেরুনো মেয়েটি এবার অজোরে কাঁদবে, বুক চাপড়াবে, চোখের জল নাকের জল এক করে বুক ভাসাবে, অথবা বাঁশিগুলো বিসর্জন দেবে ক্ষোভে দুঃখে- এমন অনুমানই যথাযথ। কিন্তু, ঘটনাপরম্পরা তার ধারেকাছে দিয়েও গেল না। দীপা, পাঁচশ আট নম্বর কক্ষ, আর বাঁশিগুলো-সহ এক নম্বর ছাত্রীহোস্টেল এক খরস্রোতা নদী হয়ে কুল কুল ধ্বনিতে দুলতে থাকল। সময়কে পেছনে ফেলে ঘণিভূত হতে থাকল নানান সৃষ্টিছাড়া ঘটনার ঘনঘটা। আর- দীপা এবং বাঁশিগুলো, অন্যরকম এক আলো হয়ে টিকরে বেরোতে থাকল, যাতে দিনের কথিত সত্যাসত্য ডুবে যেতে থাকল আপাতঃমিথ্যের সৌর্য-সামর্থের কাছে । দীপাকে ঘিরে থাকল অনেক অনেক দীপা কিংবা অনেক অনেক বাঁশি। রাতের অন্ধকারের গহীন বুকের ভেতর এমন এক রোদেলা ঘ্রান, এমন এক সৃষ্টিছাড়া ওম তাদেরকে তাতাতে লাগল, অনুভূত হতে থাকল- একটা পরিখার ভেতর অসংখ্য পরিখা হয়ে দীপা কিংবা বাঁশিসকল দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এক অ-বিশ্বাসী বস্তুময় জগত-সংসারে। এবং হনুমানগোষ্ঠী ক্ষেপে উঠল অচিরেই। বুকসটান সৈনিকের মতো তারা লাইন বেঁধে এসে বসে থাকে দীপার ছাত্রিহোস্টেলের ছাদে; সেখান থেকে টিচার্স কোয়ার্টার, ডাইনিংহল- সর্বত্র গোল গোল চোখ নিয়ে তারা নিঃসঙ্কোচে টহল জারি রাখে। এতে আরো ক্ষেপে যান উর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ। আমদানি করা হয় সযত্ন-লালিত জোয়ান তাগড়া এলসেশিয়াননের কনভয়। ক্ষেপে যায় হনুমানদলও, উন্নতির বদলে পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটে। অনেক অনেক বাঁশি কিংবা বাঁশের লাঠি কাঁধে হনুমানদল বেরিয়ে পড়ে এদিক ওদিক। ক্যাম্পাসের সিংহকপাট থেকে চালু থাকে দীর্ঘ মার্চপাস্ট, ঘেরাও হয়ে পড়ে ভিসি-বাঙলোর সুরম্য প্রবেশপথ । ক্যাম্পাসের সবকটা ভবন ফ্যাকাশে, চিৎ হয়ে পড়ে থাকে কতগুলো বেয়াড়া-বেঢপ পায়ের ছাপচিত্র হয়ে।
অতঃপর দীপাকে বহিস্কার করা হয়েছিল এই অভিযোগে যে, সে-ই হনুমানদিগকে ক্ষেপিয়ে তুলছে উদ্দেশ্যমূলকভাবে।
৬।
-অবাধ্য হলেই চোয়ালের দাঁতগুলো উপড়ে ফেলতে হবে। কোন কথা নেই, মুখ থেকে রা বের করবার আগেই কণ্ঠশুদ্ধ দুই হাতে পিষে ফেলতে হবে, সময় ক্ষেপন করা চলবে না । মাথা খাঁড়া করে- কোমর সোজা করে উঠে দাঁড়াতে দেয়া যাবে না একদন্ড ।
বিনীত হও, মাথা নত কর ! নতুবা উড়ে যাবে এক ফুৎকারে !
ঝিম মেরে বসে থাকে পুরো ক্যাম্পাস, কোন কথা নেই। পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ- বিবিধ পথ, গোলচক্কর, বক্সকালভার্টের পাথুরে পিঠ, ভলিবলের মাঠ, লাইটপোস্ট, লন টেনিসের রেখামন্ডলী, অর্জুনতলার ছিন্নপত্র, পরাণদার হাতের টুংটাং, কনডেন্সড মিল্কের কালো গাভি- এক ঘুমকাতুরে বাহানায় পড়ে থাকে চোখ বুজে। পুলক যখন দীপার এক নম্বর ছাত্রী হোস্টেলের দিকে পা বাড়ায়, তখন ভেসে এল সুদূরের এক ক্ষীণ বাঁশির সুর। পুলক কান পাতে, আন্দাজ করতে চেষ্টা করে কোন দিক থেকে আসছে সুরটি, কিন্তু সে যখন মুটামুটি স্থির করেছিল দক্ষিণ দিক থেকেই আসছে, অমনি সুরটা দিক পাল্টে একেবারে বিপরীত হয়ে গেল- এখন তার মনে হতে লাগল পশ্চিমের সেই বাঁশবাগানের কোন এক ফাঁকে হয়তো ঝিম মেরে বসে আছে বাঁশিটি । পুলক যেই পশ্চিম দিকে পা বাড়াবে অমনি চারিদিক থেকে তীব্র বেসুরো ধ্বনিতরঙ্গ এসে পুলককে ভীষণ এক ধাক্কা দেয়। তীরবেগে দৌড়াতে থাকে সে, টাল রাখতে পারে না কিছুতেই। এ-তো বাঁশির সুর নয়, মনে হচ্ছে সাইরেনের ঝাঁজালো চিৎকার, অথবা ফায়ারসার্ভিসের হুইসেল, অথবা এম্বুলেন্সের ভেঁপু ভেঁপু- অনবরত ছুটে চলেছে এদিক ওদিক। পুলক বুঝে ওঠতে পারে না কিছুই। সে দেখতে পায় অনেক অনেক ছুটে চলা পায়ের ধপধপ আওয়াজ কম্পন তুলছে মাটিতে। কী হচ্ছে এসব, খেই হারিয়ে ফেলে সে। ছুটতে থাকে- ছুটতেই থাকে। কিন্তু সে দেখতে পায় এক কদমও এগোতে পারে নি, একই বৃত্তে ঘুরপাক খেতে থাকে পুলক। এক সীমাহীন বৈপরীত্যের অভিঘাতে হাঁসফাঁস করা সময়ের ভেতর গড়িয়ে যেতে থাকে অনবরত। চারিদিকে ঘুরতে তাকে মানব-ইতিহাসের অতলান্ত। সাদা কালো অক্ষরসমূহ বাতাসের প্রপাতে উড়তে থাকে, অস্থিমজজ্জা থেকে টিকরে বেরোয় লাল লাল আগুনের জিহবা।
-থামবে না, থামবে না এ অবাধ্যতা আর-
কথা চলবে- বারণ মানবে না, না কেউ না-
ওলটপালট এবার ঘটবে- ঘটবেই-
এদিক ওদিক ছুটোছুটি করছে সবাই। এখানে ওখানে তেতে ওঠা সংশয়- বিস্ময়, শোধ-স্পৃহা, দলা পাকানো ক্রোধ। বাধাহীন। দুর্বিনীত। আছড়ে পরে ফেনিল ঢেউ, একটার পর একটা।
অগোচরে সন্ধ্যা নামে, নির্ঘুম রাত গিয়ে দিন আসে এবং তারপর উদ্ভ্রান্ত দিন যখন হলুদ আভা ছড়িয়ে রাতের দিকে নিশানা করে অমনি লোহার কপাট ভেঙ্গে ঢুকে পড়ে হুইসেল-বারুদ-সজ্জিত পোশাকধারীগণ।
অবশ্য পোশাকধারীদের কথা পুলক এতো এতো শুনেছে যে, এ নিয়ে তার ভয়-ডর নেই খুব । সে জানে, এই পুলকের তুলনায় বাবা ছিল কেবল শিশু তখন, বাবার সেইসব দিনের কথা পুলকের পিঠে এখনো চাবুক মারে সপাং করে। অজস্র মৃত্যুর ভেতর ডুবে যেতে যেতে বাবা সেদিন হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে এসেছিলেন, মৃত্যুকে তার কাছে মনে হয়েছিল দুআঙুলের তুবড়ির মতো। হাতগুলো পেছনে নিয়ে লাইনবেঁধে দাঁড় করানো হয়েছে শ’তিনেক জোয়ান-বৃদ্ধ-তরুণকে। পুলক অবিকল দেখতে পায় বাবাকে। অটোমেটিক মেশিনগানের ট্যাঁ ট্যাঁ ট্যাঁ- রক্তের পতপত-করা স্রোত মিশে গিয়ে শুকনো মাটি থেকে ধোঁয়া উড়ছে কেবল। পুলক খুব আফসোস করে, একটা বন্দুকও তোমরা যোগাড় করতে পারলে না বাবা ? হাসেন বাবা, আর তখন, তখনই পুলক লেগে গিয়েছিল বাঁশের চোঙা দিয়ে নিপুন নিশানার একনলা বন্দুক বানাতে। আনমনা হয়ে পড়ে পুলক, সেই অনেক অনেক বানানো বন্দুকগুলোর সাথে দীর্ঘ বিচ্ছেদ পুলককে মিইয়ে দেয়। সে হাতড়াতে থাকে তার পিঠ, কাঁধ; কনুইয়ের ওপর ভর করে পজিশন নেয় । ফায়ার !
পোশাকধারীদের হুইসেলের তীব্র ঝাঁজ এফোঁড় ওফোঁড় করে দেয় পুরো ক্যাম্পাসের হৃদপিন্ড। ছুঁড়ে দেওয়া ধোঁয়ার কুন্ডলিতে ঢেকে যায় আকাশের মেঘমন্ডলি, দ্বিতীয়ার চাঁদ তখন একটা মরচেপড়া কাস্তে হয়ে চক্কর দিতে থাকে। কাশতে কাশতে, এবেলা পশ্চাতে পশ্চাতে জড়ো হয়েছেন কর্মকর্তা আর বশংবদগণ। গজারি কাঠের লাঠি হাতে ধাওয়া দিতে দিতে- হাসতে হাসতে লুটোপুটি খান তারা। হাততালি সহযোগে বাহবা দিলেন অদূরে কাচা মেরে দাঁড়িয়ে থাকা আচার্যগোষ্ঠী। ছিন্ন বিচ্ছিন্ন ছাত্ররা তখন ধানখেতের মাঝে বিলি কাটছে। পুলকও সঙ্গী তাদের। ধানখেতের ভেতর দিয়ে লাইন ধরে, জল-কাদায় হাঁটতে হাঁটতে- পেছনের ব্যাগটা মনে হয় অনবরত সামনের দিকে ঠেলছে তাকে। পুলক দেখতে পায়- তার সামনে যে আছে, একটা মেয়ে বলেই মনে হলো, হাটুর উপর ভর করে কোমরটাকে ভেঙে মাথা নিচু করে হাটছে সে। তারপর এক এক করে সবাই মাটিতে বুক বিছিয়ে ক্রলিং করছে। পুলকও ক্রলিং করে এগোতে লাগল। কোমর পানি, হাটুপানিতে সাঁতার কাটতে কাটতে অবশেষে তারা পেল ছোট্ট এক মেঠো পথ। কিন্তু আশপাশে আর কাউকে তার নজরে আসছে না এখন। পুলক ভাবনায় পড়ে, এই এতো রাতে সে যাবে কোথায় এখন ? খুঁজতে থাকে একটা আশ্রয়। তার মনে পড়ে দিদারুলের মেসের কথা। যে মেসে সে দুরাত থেকেছে তার ছোট মামাকে নিয়ে। কত জায়গা ঘুরল একটা ডালপুরি খাবার জন্য। কিন্তু মামার সেই আব্দার পুরণ করতে পারল না কিছুতেই। মামা কি সুন্দর এক ফতোয়া পরে এসেছে। ভাতের ফেন দিয়ে ফতোয়াটাকে কড়া রোদে শুকিয়ে তারপর যত্নের সাথে ভাঁজ করে বালিশের তলায় রেখে ঘুমিয়েছিলেন দু-রাত, শহরে যাওয়ার আনন্দে আচ্ছন্ন মামা।
পেছন ফিরে পুলক দেখতে পায়- মায়ের শুকনো মুখের মতো খরখরে অবয়ব নিয়ে নুয়ে পড়ছে তার আজীবনের স্বপ্ন, প্রিয় ক্যাম্পাস। সারি সারি দেবদারু, পিচঢালা পথ, লেকচার ডায়াস, বেঞ্চ, ল্যাব, লাইব্রেরি- সব, সবকিছু চিৎ হয়ে পড়ে আছে একটা মৃত চামচিকার মতো, অথবা অন্ধ গন্ধমুষিকের বিষ্টা হয়ে স্যাঁতস্যাঁত করছে। জিন্স-টিশার্ট আবৃত প্রভাষক, কাঁচাপাকা কেশশোভিত সহযোগী অধ্যাপক অথবা ভারি কাঁচের কুঁতকুঁতে চোখের অধ্যাপকমন্ডলী জর্দামিশ্রিত পান চিবুতে চিবুতে, ফিক করে রক্তবর্ণ তরল ঢালতে ঢালতে কানামাছি খেলছেন। অদূরে দেখা যায়, ভিসি মহোদয় মেরুন কালারের গাড়ি থামিয়ে কড়ইগাছকে পেছনে রেখে চেইন খুলে হিসু করছেন আয়েশি ভঙ্গিতে।
পুলকের ভীষণ বমির উদ্রেক ঘটলে তাকে উদ্ধার করতে ঘিরে ধরে অসংখ্য বাঁশি, অথবা বাশি নয়- রংবেরঙের চরকি, নিমিষে যা রূপ নেয় একেকটা বর্শায়। শিউরে ওঠে পুলক, আর ঠিক তখন, বাঁশির ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে দীপা। হো হো করে হাসিতে ফেটে পড়ে সে পুলকের মুখোমুখি দাঁড়ায়। পুলক প্রাণপণ চেষ্টা করে দীপার একটুকু ছোঁয়া পেতে। কিন্তু পথ আগলে দাঁড়ান প্রভোস্ট-অধ্যাপকগণ। দীপা হাসতে হাসতে মিলিয়ে যেতে থাকে শূন্যে। পুলক আর কিছুই বুঝতে পারে না, কেবল ছয়পেয়ে একটা পতঙ্গের খোলস অনুভব করে তার পিঠে।
৭।
কিন্তু, অচিরেই দেখা গেল, মার্বেল পাথরে মোড়া অট্টালিকাগুলো পেছনে ফেলে একটার পর একটা গাড়ি যাচ্ছে ধোঁয়ার ঘুর্ণি তুলে। কোনটা থামছে, কোনটা সাঁই করে ছুটে যাচ্ছে। পুলকের চোখ আকাশের দিকে স্থাপিত। সে দেখতে পায় বাদামি ডানা মেলে অবিরাম চক্কর দিচ্ছে এক চিলের সারি। পুলক চিৎকার করতে থাকে তারস্বরে। কিন্তু কেউ নেই। কে কোন দিকে চলে গেছে যে যার মতো করে । পুলক কি করবে ভেবে পায় না। এক্ষনে নিজেকে একটা তেল চিটচিটে তেলাপোকার মতন মনে হয়। পিঠে হাত দিয়ে একটা অক্ষম পাখার অস্তিত্ব খুঁজতে থাকে। সামনেই একটা পাকা ব্রিজ পড়ে। না, সে দেখতে পায়, ব্রিজ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার মতো কোন পা নেই তার শরীরে। সে মনস্থির করে, বরং তার বুক বিছিয়ে দেবে ঢালু পাড়ের দিকে, সাঁতরেই পার হবে নদী। আর সে যতই নামতে থাকে ঢালু পাড় বেয়ে, ততই নদীটাকে মনে হতে থাকে একটা কসাইখানার ভাঙাচুরা দেওয়ালের মতো। মরা পঁচা পুজের মতো চুইয়ে পড়া রক্তের দাগ লেগে আছে এখানে ওখানে। বুকটাকে সম্বল করে পুলক ভাসতে থাকে, এবং একটার পর একটা দেয়াল ভেদ করে যে-ই সে তীর ছুঁতে যাবে, অমনি হাত বাড়িয়ে দেয় দীপা। দীপা আর পুলক তখন একটা দুর্ভেদ্য পরিখায় রূপান্তরিত । দেখতে দেখতে দীপা কিংবা পুলক, বাঁশি কিংবা পরিখা- বিস্তৃত থেকে বিস্তৃততর হতে থাকে। অসংখ্য বাঁশি, অসংখ্য পরিখা, অযুত অগণন দীপা কিংবা পুলক হয়ে ডবল মার্চ করতে থাকে।
তখন,
ঠিক তখন-
তীব্র বিউগলের তীক্ষ্ণ সুর ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে-
পরিখার পর পরিখা তখন ভরে উঠেছে উত্তপ্ত ধোঁয়ার কুণ্ডলীতে।
সৈয়দ মনির হেলাল । লেখক ও আইনজীবী। জন্ম ও বসবাস বাংলাদেশের সিলেটে।
এক মেয়েটা মুঠো মুঠো জ্যোৎস্না কুড়িয়ে অপরের মুখমন্ডলে চাঁদ দেখত। মানুষের উপকার করার ক্ষেত্রে,…..
শেষ থেকে শুরু। আমি রজকিনী রামী,ধোপার বংশে জন্ম আমার।ঘাটে সখিদের সঙ্গে কাপড় কাচি। একাজটা আমি…..
মালঞ্চার পথে ভোরবেলা। সূর্য সবে উঠছিল। বৈশালী দূর থেকে দেখতে পেল,বুনিয়াদপুর বাসস্ট্যান্ডে বালুরঘাটের দিকে মুখ…..
আমার বাবা ছিলেন অত্যন্ত সাহসী একজন লড়াকু মনের মানুষ।শত অভাব অভিযোগেও তাকে কোনোদিন ভেঙ্গে…..