বাংলার বাউল

সুদীপ ঘোষাল
কবিতা
Bengali
বাংলার বাউল

বাংলার বাউল

সঙ্গ ছাড়ে না লাল খালি জমির চটান
মহুয়ার প্রেমে মানায় লাল পাহাড়ির জঙ্গল
গভীরে নাড়া দেয় অগভীর অভাবি বাংলার ডোবা
টুসু গানে ভরে যায় অতৃপ্ত মাদল
মৃত ময়ালের মত মোড়াম রাস্তা
লাল রুমালে ঢাকে শীত, বসন্তে আদুল গাঁয়ের ছবি
খেজুর রসে তৃপ্ত জোতদার সকাল
গুড় তিক্ত হয় অভাবের পাতে

ভাঙ্গা কৌটোর মত গরীব হৃদয়
রঙচঙে বোতলে ভরা খিদের তরল
ঝুড়ি ভরে তোলে একশ দিনের কাজ
দিনমজুরি জুড়ে শ্রমিকের ঘাম
চোত্ মাসের বোলানে জীবনছন্দের অনুপস্থিত ছবি
বেঁচে থাকে ভাগাড় পেরিয়ে পোরো বোলানের দল

পুরুলিয়ার ছৌ নাচ লাফায় রক্তমাংস ঘিরে
আন্দোলন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়
কৃষকের আর্তনাদে কাঁদে দেশের হৃদয়
ছৌ নাচ পাক খায় শ্রমিকের ঘাম শরীর জুড়ে
রুগ্ন লিপ্তপদি পায়ে জীবনসাগর পাড়ি

ধীরে বয়ে যায় না পাওয়ার বিকেল
পাহাড়ি রাস্তায় নামে আঁধারের কালো চাদর
একপেশে প্রাচুর্যের দম্ভে মরে যায় প্রতিভার ছটা
তবু আসে ফিরে বৃত্তাকারে শীতের ফসল

বাংলার খরখরে মাঠে রক্তমাংসের ঘাম
রোদ,জলে ভরে ওঠে সবুজ দিগন্তের গোল
শহর থেকে গ্রামে যায় নম্র ঘাসের মন
পেট ভরে খায় মহাজনি পেটমোটা দুপুর
অবশিষ্টে বেঁচে থাকে শ্রমিকের সোহাগি সকাল

 

ঢ্যাম কুড়াকুড় ঢাকের বাজনা জুড়ে ব্যাঙ্গের বিকেল
নদীর তীরে কাশফুলগুলো মনে হয় ভুট্টার খেত
বাবুদের জামার গন্ধ টা মাংসের ফ্লেভার
এক পেট খিদে থাকা মানুষগুলো নদীর জল, ভুট্টা খেয়ে কবিতা লিখত, গাইত
প্রাচীন একটা গোল কাঠের নৌকায় পেটমোটা লোক গুলো বোবা জলে ভেসে যায়,আর তাকিয়ে উপহাস করে অভুক্তজনকে আর দেখে, কাশফুলগুলো ছিঁড়ে চিবোয় ভুখা মানুষের দল
ওরা জানে না কাশের রক্তমাংস জুড়ে ভুট্টার
খাদ্যপ্রাণ শুষে নিচ্ছে প্রাণপণে বাংলার উপোসি ভোর

 

পরিশ্রমের পাশে শ্রমিকের ফসলবিহীন গোলা
ঋণের বোঝা ভরে দেয় মহাজনি হাসি
আস্তে আস্তে কাস্তে হাতে জেগে ওঠে শিরা ও রক্তমাংস
লাল কলম লেখে বিপ্লবের আগমণি গান
তবু ওরা চিরকালের বাংলার প্রাণ

শাঁখ বাজায় না উপোসি কাদার হাত
গড়ে যায় মৌন মিছিলে আশার দুপুর
ছেলেমেয়ের থালাভরা গরম ভাতের গর্বের দুপুর
এবার আসবে লাল সিঁদূরের মত ভরাট সকাল

লাঙলের ফলায় জেগে ওঠে রক্তমাংস ঘাম
ঘামের লবণে ফুটে ওঠে উপোসি ঠোঁট
দাঁতে দাঁত চেপে ফসলের কান্না
জেগে ওঠে অভুক্ত মানচিত্রের ছবি
ক্যারি ভরে এসে যায় কুড়ি টাকার পাউচ

১০

নেশায় খিদে ভোলে পেরিয়ে যাওয়া দুপুর
মারি পোকা খুঁটে খায় বিষাক্ত ফুসফুস
ঢলে পড়ে অস্তগামি সূর্যছটা
থামে না বীজতলার হাত
হাঁটুগেড়ে রোয়ানো ধানের বীজ
চিরদিন ভাত বাড়ে কৃষকের হাত

 

সুবোধ বালক

ভিতরের সুবোধ বালক আগলে রাখে
হিংসা আর ঘৃণার বাইরে আর এক জীবন
সুবোধ বালক রায় পুকুরে ভেলা বায় জেলেবন্ধুর আদরে
বাল্যবন্ধুর গলা জড়িয়ে বিশ্বাসের পিঠে পাড় হয় সোহাগি স্কুলবেলা
রঙীন বর্ষায় কাদামাখে আর লাফিয়ে পাড় হয় কাঁদরের ক্যানেল
বন্ধুর সাথে সাহসি বিকেলে হাসির লড়াই মত্ত মাতাল
সুবোধ বালক আগলে রাখে মায়ামাখা মন
আড়ালে রাখে কষ্টের রামায়ণে কাঁটার আঁচড়
ঠাকুরদার কৃত্তিবাসী সুর, হলুদ চিঠি, সুবাস দুপুর
সুবোধ বালক আগলে রাখে করোনার দিনরাত
খড়ের চাল ভেসে যায় স্মৃতির বন্যায় শ্বাসকষ্ট ভুলে
চোরকুঠুরির কুলের আচার, মায়ের চাবির আঁচল
ভুলে যায় কর্কটকাল, যন্ত্রণার চিনচিন সকাল..

 

হোম স্টুডেন্ট

গৃহপাঠে প্রতিক্ষায় প্রেমিক- আকাশ জুড়ে দুটি ভরন্ত উল্কা
উড়ে যায় শরতের মুঠো মুঠো প্রেম সোহাগি সন্ধ্যার হাওয়ায়
আশার আসমানি আহ্বান হাতঘড়ি সময় পাঠের প্রেমিক
প্রেম সাহিত্য পড়ার পথে রজকিনী মায়ায় দৃষ্টি বিনিময়
অঙ্কের খাতাজুড়ে হিজিবিজি চিঠি ভালবাসা শেকল বুকে
গড়িয়ে পড়ে অশ্রু সাদা পাতাজুড়ে সোনালি স্বপ্নের পারিজাত
অভিভাবক ঘরে ঢোকে সাবধানী কাপ জুড়ে তৃপ্তির ঢেকুর
ঘরজুড়ে নীরবতা বন্ধ দরজা জুড়ে সাহসি আঙুলের খেলা
লিপ্তপদি ঠোঁট জুড়ে আনমনা কামড়ে কাঁপে হৃদয়জোড়া
ভিজে অনুভব বৃষ্টিশরীর জুড়ে, ফালি ফালি কলঙ্কবিহীন চাঁদ
পুরুষ ভূগোলজুড়ে স্মৃতিময় জীবনের পাঠে মগ্ন রাতের জিভ
কথা বলে চুপভাষা বোঝে শুধু কিশোরীর প্রেমজুড়ে খোলা এক মাঠ …

মেয়েবেলা

দুরন্ত বিকেলে সঙ্গিনী তির তির নদী হয়ে বহে
এক রক্তবীজ সকালে তার বুকে পাহাড় বাধা দেয়
সহজ সকাল হারিয়ে যায় ফোঁটায় ফোঁটায়
হলুদ কলকে ফুলে মৌমাছি মধু খোঁজে
ফ্রক কখন শাড়ি হয়ে ফোটে
প্রতি পদে কাঁকড়ের শেকল জড়ায় চরণ
শীতল নদী পাড় ভাঙ্গে, ক্রমশ সংস্কারজালে হারিয়ে যায় মেয়েবেলা
বটবৃক্ষের শাখাপ্রশাখার মত শেকড়েবাকড়ে
আষ্টেপৃষ্ঠে ঝোলে রান্নাঘরের ঝুল
সকাল, বিকেল হারিয়ে গিয়ে শুধু শূণ্য দিবসে ভরন্ত চাঁদের কাড়াকুড়ি
পুতুলের কাদা -পায়েস লুকোচুরি পুজোবাড়ির শ্যাওলা হারায় স্মৃতির জারিজুরি
আমের আচার আর লাফদড়ির কাঁপানো কথায়
ফিরে ফিরে আসে মেয়েবেলার স্মৃতি

 

স্বপ্ন

দু’দণ্ড ধার্মিক বিকেলে
বিফলতাগুলো ছুঁড়ে মারি বারান্দা থেকে আশার আলোয়
একলব্য সাহসি সূর্য হতে পারে
এক বেকার বিকেলজুড়ে চা পাতার সুবাস
ছেঁড়া স্মৃতির পাতাজুড়ে স্নাতক প্রেমিক
প্রহর গোণে সুনীলের নীরা হয়ত এখনও প্রতিক্ষায় কবিতা লেখে
কথামালা জমিয়ে রাখে কালের গর্ভে
আমিও সখি ছুঁড়ে মারি আহত বাতাস
কত সকাল বসে আছে নিশ্চিত রোজগেরে সৈকতে

 

অস্পৃশ্যতা

প্রতিক্ষায় বসে আছে মোহনার মিলন
একটা একটা করে ফুল খসে অসময়ে
তবু রাত জাগে অন্ধকারে শ্বাসকষ্ট বুকে নিয়ে
সবাই একা ছোঁয় না কেউ ঝরে পড়া লাশ
অপেক্ষায় সাজায় গ্রীণরুম অন্ধকারের নাটক
রামধনু সকালে পাহাড়ে ডানা গজায়
উড়ে যায় ময়ূরপঙ্খী জাহাজ গগনে গগনে
কোয়ারান্টাইন সেবার আসরে মানুষের ঢল
সবাই আজ নেমেছে লোহিতসাগরের স্রোতে
কখন আসে রাংতামোড়া বিষ ছোবলের রাত
ঘরে ঘরে কর্মহীন প্রতিক্ষার প্রলাপ

 

ঝড়ের পরে

ছেলেটার কান্না দেখে পরিবারে ঝগড়া থামে
শাঁখা খুলে উঠোনে পা বাড়ায় নিয়তির লিখন
কলহ অসুরের শরীরে হিংসা দানা বাঁধে
সন্দিগ্ধ রাত্রিজুড়ে
ছেলেটার চোখের জলে বাঁধ ভেঙে তৈরি হয় ভোরের স্বাবলম্বী রাস্তা
মা ছেলে বেড়িয়ে আসে রাজপথে খোলা হাওয়ায় শ্বাস নেয় মুক্তজীবন
কান্নাভেজা স্মৃতির রাস্তা ধরে তখনও হেঁটে চলে জ্যামিতিক বিন্দু পথ
ছেলেটার বাবা ফাঁকা মানিব্যাগের মত নিকষ আঁধার বয়ে বেড়ায় ঘৃণার দুপুর জুড়ে
রান্নাঘরের পুরোনো ঘ্রাণ, হা হুতাশ উদাস স্মৃতির উঠোন
মনখারাপের বকুল খোঁজে নরম চুড়ির মিষ্টি আওয়াজ
শয্যার ঘেসো সিঁথির পথশোভা হারিয়ে বিন্দু বিষ ভেজায় পাপোষ
বিনম্র এক নরম হৃদয়ে অশ্রু জড়ায় গভীর সন্তানস্নেহ
ভুল বোঝে দূরত্বের বিরহ জীবন।

সুদীপ ঘোষাল। গল্পকার। জন্ম ভারতের পশ্চিমব্ঙ্গরাজ্যের কেতুগ্রামের পুরুলিয়া গ্রামে। প্রকাশিত বই: 'মিলনের পথে' (উপন্যাস)। এছাড়াও কয়েকটি গল্প ও কবিতার বই আছে।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

ঝরা পাতা

ঝরা পাতা

  চারিদিকে কোলাহল শূণ্যতা করেছে গ্রাস, বেদনা বিধুর অতৃপ্ত বাসনায় হাহাকার, অজান্তে নীরবতা তোমার স্পর্শে…..