বাতিল দৃশ্যাবলী (পর্ব- ৩) গান ও নদী

যোষিতা
ধারাবাহিক, নন ফিকশন, পডকাস্ট
Bengali
বাতিল দৃশ্যাবলী (পর্ব- ৩) গান ও নদী

—তোমরা গান গাইতে পারো?

লোকটা জিগ্যেস করেছে রাশিয়ানে, কিন্তু বাক্যটার বাংলা অনুবাদ করলে এরকমই দাঁড়ায়। বিকেলের আলো কমে আসছে, প্রশ্নটা করে লোকটা আমাদের কাছে এগিয়ে এল। আমরা দুজন। ফেরেসালাম আমার পাশে দাঁড়িয়ে। লোকটার পরণে কোট প্যান্ট, মাথায় কাঁচাপাকা ঝাঁকড়া চুল, বয়স তার পঞ্চাশও হতে পারে আবার ষাটও হতে পারে। প্রশ্নটা করবার পর থেকে সে মিটমিটিয়ে হাসছে, দুচোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে আমাদের দুজনকেই যেন জরিপ করে নিচ্ছে। ফেরেসালাম আমার ফ্রকে টান দেয়, অস্পষ্ট করে ইংরিজিতে বলে, লেটস্ গো। আসলে ও বলতে চাইছে, চল্ পালাই এখান থেকে। তবু আমরা নড়তে পারি না। আমাদের পা যেন পাথরের মত ভারি হয়ে গেঁথে রয়েছে মাটিতে। লোকটা হাতের ইশারা করে আমাদের ডাকে, মুখেও বলে, এসো ভেতরে এসো। তার পেছন পেছন আমরা যেন হিপনোটাইজড হয়ে চলতে থাকি। লতানে গোলাপে মোড়া লোহার দরজাটা ঠেলে, আরও একটু এগিয়ে তিনচার ধাপ সিঁড়ি বেয়ে কাঠের দরজা খুলে বাড়িটার ভেতরে নিয়ে যায় সে আমাদের। ফের সে আমাদের প্রশ্ন করে, — তোমরা কি গান গাইতে জানো?

গল্পের অডিওপাঠ শুনুন এখানে:

ঘরের মধ্যে একটা পিয়ানো। সিনেমায় সাধারণত যেসব প্রকান্ড হাপরের মত ডালা খোলা পিয়ানোর সামনে বসে নায়ক নায়িকারা গান করে তেমন পিয়ানো এটা নয়, এটায় ডালার অংশটা বাদ, পরে জেনেছিলাম এগুলোকে ভার্টিকাল পিয়ানো বলে। ঘরে আমাদের তিনজনকে বাদ দিলে আরও মানুষ রয়েছে। চারজন কিশোর কিশোরী সেই পিয়ানোর পাশে দাঁড়িয়ে আছে গানের খাতা হাতে নিয়ে। এদের গান শুনেই পথ চলতে চলতে আমরা থমকে দাঁড়িয়েছিলাম বাড়িটার বাইরে। জানলা দিয়ে আমাদের দেখতে পেয়ে গানের মাস্টার মশাই তাই দৌড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। এখন অবশ্য এরা গান গাইছে না। ঘরে আরও কিছু বাদ্য যন্ত্র রয়েছে যেগুলোর নাম আমি জানিনা। মাস্টারমশাই ঘরের সবার সঙ্গে আমাদের আলাপ পরিচয় করিয়ে দিলেন। নিজের নাম বললেন আলফ্রেদ গ্রেগরিয়েভিচ, তারপর ছাত্রছাত্রীদের বললেন গান ধরতে। একজন পিয়ানোর সামনে টুলটায় বসে বাজাতে লাগল, বাকিরা দাঁড়িয়ে। গান শুরু হয়ে গেছে — রো ও দিনা… ভি লি কা ই য়া মাইয়া রো ও দি না.. (বাংলা করলে দাঁড়ায়, জন্মভূউমি… ম হা আন আমার জন্মভূউমি…)।

খুবই দেশাত্মবোধক গান, মহতী জন্মভূমির প্রতি ভালোবাসা জানানো হয়েছে গানের কথায়, কিন্তু বাপরে কী কণ্ঠ এদের, যেন অপেরা হচ্ছে! আওয়াজে কেঁপে যেতে হয়, তেমনি গম্ভীর সুর। কায়দা করে ঝুঁকে পড়ে গুনতে চেষ্টা করছি কতগুলো অক্টেভ ঐ পিয়ানোর। সাড়ে সাতটা অক্টেভ, অর্থাৎ সাতের বেশি আটের চেয়ে কম। দু কলি গাওয়া হলে তিনি হাতের ইশারা করতেই গান থেমে গেল। আলফ্রেদ গ্রেগরিয়েভিচ আমাদের দিকে ফিরে বললেন— গাও না, তোমরাও গাও এবার।

এখন ফেরেসালাম আমতা আমতা করে মুখ খুলল, — না মানে, আমরা তো গান গাইতে জানি না।

— গান সবাই জানে।

মাস্টারমশাই আমাদের গানের পরীক্ষা না নিয়ে ছাড়বেনই না। একটা টিপয়ের ওপর রাখা রয়েছে টিপট, কাপ, প্লেটে কয়েক টুকরো প্লাম কেক। সেই দিকে নজর ঘুরিয়ে দিয়ে লোভ দেখাতে লাগলেন, গান গাইলে প্লাম কেক দেবেন বলে। নিজেই আআআ করে একটা স্বর গেয়ে বলেন, এইটে গাও, আআআ। ফেরেসালাম মুখ খোলে না। আমি গেয়ে উঠি আআআ। উঁহু আরো জোরে, আরো জোরে গাও! উনি পেটের নাভির দিকে আঙুল দেখিয়ে বলেন, ওখান থেকে উঠে আসবে আওয়াজ, গাও, আবার গাও, এইতো, হচ্ছে হচ্ছে, হবে না মানে? এমনি করে বেশ কিছুক্ষণ চলল। প্রথম দিকে একটু হাঁফিয়ে যাচ্ছিলাম, ক্রমশ কায়দাটা মনে হল একটু একটু ধরতে পারছি তবে এ জিনিস একদিনে হবার নয়, অনেক চেষ্টা লাগবে, অনেক রেওয়াজ করলে পরে পেট থেকে যেন উঠে আসবে আওয়াজ। উনি বলে দিলেন, প্রত্যেক মঙ্গল আর শুক্রবারে চলে আসবে বুঝেছ, এই নাও কেক, এই গানের ইস্কুলের নাম নারোদনাইয়া ফিলার্মোনিয়া, মনে থাকবে তো?

চিত্র: রিয়া দাস

মাস্টারমশাইকে একবাক্যে কথা দিয়ে দিই, নিশ্চয় আসব নিয়মিত। ওখান থেকে বেরিয়ে আসবার পরে লক্ষ্য করি ফেরেসালামের মুখ গম্ভীর। ও এমনিতেই কথা বলে খুব কম। আমরা একই ক্লাসে পড়ি, ইথিওপিয়ার মেয়ে ফেরেসালাম। আরও একজন ইথিওপিয়ান আছে আমাদের ক্লাসে, সে ছেলে। আশেনাফি। আশেনাফি যেমন ছটফটে, ফেরেসালাম তেমনি শান্ত, একেবারে বিপরীত চরিত্র। কী হলো তোর বলতো? ও কিছু বলে না, কিছুক্ষণ পরে আবার বলি, বলবি তো কেন এমন চুপ মেরে রয়েছিস। ও শান্ত স্বরে বলে, —দেখলি কত দেরি হয়ে গেল, এখন হস্টেলে ফিরে কত কাজ বাকি পড়ে রয়েছে।

—জানিনা আবার! এখন আমাদের পড়াশুনোর চাপ নেই বললেই হয়, কেবলই তো ভাষা শেখা, সন্ধেবেলা রান্নাবান্না গল্পগুজব হৈহল্লা ছাড়া কীই এমন দরকারি কাজ থাকে যে দেরি হলে মারাত্মক ক্ষতি হয়ে যাবে!
ও আর কোন কথা বলে না। আমরা পা চালিয়ে ফিরতে থাকি।

দুই.

আসলে আমরা বিকেলের দিকটায় বেরিয়েছিলাম একটু কেনাকাটি করতে। ফেরেসালামের কিনবার দরকার ছিল চুলে দেবার তেল, ও মাথায় মাখে ভিটামিন এডি অয়েল, যে তেল কৌটোর তলানিতে এসে ঠেকেছে। স্প্রীংএর মত কুঁচকোনো আফ্রিকান চুলের যত্নের জন্য চাই ভিটামিন সমৃদ্ধ পুষ্টি জোগানো তেল। সেই স্পেশাল তেলের সন্ধানে অনেক দোকান ঘুরেছি, মনোমত কিছুই পাওয়া যায় নি, পথের ধারে ছোট ছোট রাসবেরির ঝোপে সদ্য ফল ধরেছে, রং তখনও সাদা, সেসবই তুলে তুলে খেতে খেতে ফিরছিলাম এ গলি সে গলি দিয়ে ঘুরে ঘুরে। হঠাৎ গান শুনে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম, আলাপ হল আলফ্রেদ গ্রেগরিয়েভিচের সঙ্গে। এই দেশে, এই তাশখন্দ শহরে তো দেখতে দেখতে ছমাসের ওপর কেটে গেছে। বুক ঠুকে যেখানে সেখানে একা বেরোতে পারি, এখন আমরা গড়গড় করে রাশিয়ান বলতে পারি, পড়তে পারি, লিখতেও পারি মোটামুটি ভালই। শীতকাল প্রায় শেষই হতে চলল। জীবনে প্রথম তুষারপাত দেখেছি গত অক্টোবরে। তুষার জমে জমে সাদা করে ফেলেছিল শহরটাকে। যেদিকে চোখ যায় শুধু বরফ। সেই বরফ গলে যায়, আবার পড়ে জমে গলে, ফের পড়ে, বাতাস পরিষ্কার হয়ে যায়, ঠাণ্ডায় কাঁপি, অনভ্যস্থ পায়ে হাঁটতে গিয়ে জমে যাওয়া কঠিন বরফের ওপর পা হড়কে আছাড় খাই, মানিয়ে নিতে থাকি শীতপ্রধান দেশের আবহাওয়ায়। শীতের ছুটি ছিল দু সপ্তাহের। ফ্যাকাল্টির নিয়ম মাফিক আমাদের সবাইকে নিয়ে গেল স্যানাটোরিয়ামে, শহর থেকে চল্লিশ কিলোমিটার দূরে পাহাড়ের ওপরে। জায়গাটার নাম চির্চিক। সেখানে দুটো সপ্তাহ কেটেছে খেয়ে দেয়ে ঘুরে বেড়িয়ে সিনেমা দেখে। রোজ রাতে একটা করে সিনেমা, তার মধ্যে অধিকাংশই হরর ফিল্ম। সেই রাতের শোতে আমার জীবনের প্রথম দেখা হরর ফিল্মের নাম —ভী। নিকোলাই গোগোলের লেখা গল্প থেকে, বেশ পুরোনো ফিল্ম, ১৯৬৭ সালে তৈরি। কিন্তু তা হলে কী হবে? সিনেমা হল থেকে বেরিয়ে স্যানাটোরিয়াম অবধি হেঁটে আসবার পথটা বনের মধ্যে দিয়ে। সে পথে কোনও বাতি নেই। অল্প স্বল্প চাঁদের আলো পড়ছে বরফের ওপর। পাঁচ ছজনের ছোট ছোট দল বানিয়ে আমরা বেয়ে উঠছি পাহাড়ি রাস্তা। রাত হয়ত বারোটা কি একটা। সিনেমার সব ডায়ালগ বুঝতে না পারলেও ভয়ের দৃশ্যগুলোর জন্য তো আর ভাষা জানতে হয় না। সেই থমথমে আবছা অন্ধকার পথে যেই কোনও গাছের ডাল থেকে ছপাৎ করে বেশ খানিকটা তুষার পড়ল, আমরা কেঁপে উঠছি সবাই অস্ফুট আর্তনাদে। টাটকা দৃশ্যগুলো মনে করতে না চাইলেও বেশি বেশি করে মনে পড়ে যাচ্ছে। তারই মধ্যে কেউ আবার বদমায়েসি করে ভয় দেখানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। তখন মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলেও ঘর থেকে বেরিয়ে একা একা টয়লেট যেতে পারি না। আমার রুমমেটদেরও একই দশা। শোবার ঘরগুলো পরপর সারি দেওয়া লম্বা করিডোরে, সেখানে সারারাত জ্বলছে খুব অল্প পাওয়ারের লাইট, এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত স্পষ্ট দেখা যায় না ঐ আলোয়। করিডোরে একটু পরে পরেই লম্বা লম্বা কাচের জানলা, ছোট ছোট গোল টেবিলের ওপর রাখা ফুলদানিতে নানারকমের লিলি ফুল। সেই সব পেরিয়ে যেতে হবে টয়লেট। লিলি ফুল দেখলেই মনে পড়ে যায় হরর ফিল্মের সেই সীনটার কথা যেখানে গির্জাঘরের বেদীতে রাখা সুন্দরী মেয়েটার মৃতদেহের কাছে হুবহু এই রকমেরই সাদা সাদা লিলি। মেয়েটার মাথায় হলুদ-সাদা ফুলের মুকুট পরানো। হিরো যখন একা একা বেদীটার কাছে গিয়ে মেয়েটার মুখের দিকে ঝুঁকে কীসব বলছিল, মৃত মেয়েটার বন্ধ দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছিল জল, যা মুহূর্তের মধ্যে বনে গেছল রক্ত! ওরে বাবারে! আমি সারারাত জেগে কাটিয়ে দেব কিন্তু ঐ করিডোর পেরিয়ে টয়লেট যাওয়া অসম্ভব। ঘরের মধ্যে আমরা কেউ কাউকে বলতে পারিনা যে সবাই জেগে রয়েছি, সবারই হিসি পেয়েছে। ঐ দুটো সপ্তাহেই আমরা সবাই সবার বন্ধু হয়ে যাই, সেই স্যানাটোরিয়ামেই। সেখানেই আমরা হাঁটতে হাঁটতে আবিষ্কার করে ফেলেছি একটা সরু নদী। পরে জানতে পারি নদীটার নামও জায়গাটার নামে— চির্চিক। অত ঠাণ্ডাতেও নদীটার কাছে গিয়ে কান পাতলে জলের শব্দ শোনা যাচ্ছিল, সবটা জমে যায় নি, বরফের তলা দিয়ে কুলকুল করে জল বয়ে যাচ্ছিল, ঝরঝর করে লাফিয়ে পড়ছিল নদীবক্ষের নীচের দিকের পাথরগুলোর ওপর। চুপ করে দেখবার মত ধৈর্য বা সময় হাতে থাকত না। আমাদের দলটা তখন দাঁড়িয়ে থাকবার মত বিরক্তিকর কাজ করত না, হাঁটতে হাঁটতে খুঁজতাম আরও আকর্ষণীয় কিছু। সেই দলে কি ফেরেসালাম একবারও থাকেনি? মনে পড়ে না ঠিক করে। আজ নাহয় বাবা তুই চুলের তেল পাস নি দোকানে, তা বলে অত মুষড়ে পড়বার কী আছে, অ্যাঁ?

মঙ্গল এবং শুক্র, বার দুটো বিলক্ষণ মনে আছে। কদিন পেরোতেই বিকেলবেলা ক্লাসের পর ফেরেসালামের ঘরের দরজায় টোকা দিয়েছি। ঘরে ওর তখন দুজন রুমমেট এবং একটা অচেনা ছেলে। ফেরেসালাম এক ডেচকি স্প্যাগেটিসেদ্ধ নিয়ে ঢুকল মিনিটখানেকের মধ্যেই। টেবিলের ওপর নানারকম নাম না জানা মশলা। সেইসব মশলা মেশাতে শুরু করল গরম স্প্যাগেটিতে। আমাকে বলল, তুইও খাবি কিন্তু।

— খাব কী রে এখন, গানের ইস্কুলে যাবি না!

কোনও উত্তর দেয় না সে। রুমমেট দুজনের একজন পানামার মেয়ে, ড্যানেলিস রোমানো। অন্য মেয়েটা ইথিওপিয়ার, যে সেই অচেনা ছেলেটার সঙ্গে ঘনিষ্ট হয়ে বসে আছে, আমাকে দেখে একটু হেসেছিল যখন ঘরে ঢুকেছিলাম। আমি আবার তাড়া দিই ফেরেসালামকে, পাঁচটার মধ্যে পৌঁছতে হবে তো, তোর রান্নাবান্না কতটা বাকি? শান্ত হয়ে সে উত্তর দেয়, আজ যেতে পারছি না, আজ আমার রান্না করার ডিউটি। অদ্ভুত তো! আমি রেগে যাই, বিরক্ত হই। তবু বলি, পরেরদিন অন্য কাউকে ডিউটি দিবি। ও সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে। বেরিয়ে আসবার সময় দেখি ওর রুমমেট ও সেই ছেলেটি চুমু খেতে ব্যস্ত, ড্যানেলিস আমার দিকে তাকিয়ে হাসি হাসি মুখ করে।

প্রথম শীত ১৯৮৫ ( আসলে, জীবনের উষ্ণতম দশটি শীতের প্রথমটি)। পেছনের সারিতে বাঁদিক থেকে – আমজাদ, জামিলা, গাসান, করিমা, আশেন্নাফি, ফেরেসালাম, আমি, (বাকিদের নাম মনে পড়ছে না)।সামনের সারিতে বাঁদিক থেকে – আব্দুররজ্জাক, মানুয়েল, (নাম মনে নেই) ও কেনেত।

তিন.

রাস্তায় বেরিয়ে খেয়াল হয়, আরে, এ কদিন তো গানটা প্র্যাক্টিস করা হয় নি, গলাও একদম সাধা হয় নি, সেই আআআ করে একেবারে শরীরের ভেতর থেকে আওয়াজ বের করা। বেমালুম ভুলেই গেছলাম। যদি মাস্টারমশাই বুঝতে পেরে যান যে ফাঁকি দিয়েছি! কী আর করা যাবে, যা হবার হবে, দৌড়তে দৌড়তে যাই, রাস্তাটা ভালমত মনেও পড়ে না, কিন্তু জেদ চেপে গেছে লতানে গোলাপে মোড়া সেই লোহার গেট খুঁজে বের করবই। সেদিন আলফ্রেদ গ্রেগরিয়েভিচকে একটু দুর্বল কেমন যেন অসুস্থ মনে হয়, তবু আমাদের গানের ক্লাস, গলা সাধা সবই হয়। ঐ চারজন ছাত্রছাত্রী অদ্ভুত ভাল গায়, ওরা সবাই কনসেরভাতরিয়াতে ভর্তি হবে বলে তৈরী হচ্ছে। কনসেরভাতরিয়া হচ্ছে মিউজিকের ইউনিভার্সিটি। ক্লাসের শেষে চুপিচুপি ওঁকে জিগ্যেস করি, কত মাইনে দিতে হবে এখানে? উনি হো হো করে হেসে বলেন, — কিচ্ছু না, কিচ্ছু না, যাও বাড়ি যাও এখন।

বাড়ি মানে হস্টেল অবশ্য তখনই ফিরি না। আরো অলি গলি হাঁটি। আমাকে তো আর ঘরে ফিরে রান্না করতে হয় না। যখন খুশি খাই, যা বানাতে পারি তাই ই খাই। ভাগ্যিস ঐ ইন্ডিয়ান দুজনের সঙ্গে খাই না, তাহলে পালা করে করে রান্নার ডিউটি পড়ত। গানের ইস্কুলের সরু গলিটা এঁকে বেঁকে গিয়ে পড়েছে একটা সরু রাস্তার ওপরে। এ পথে কোনও দিন আসিনি আগে। আর কী আশ্চর্য ব্যাপার! সরু রাস্তার পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে একটা নদী। একদম চওড়া নয়, সরু মত নদী। দেখলে মনে হবে নালা বুঝি। না, এ নালা নয়। একটু দূরেই রয়েছে একটা ছোট্ট সেতু, পায়ে হেঁটে পার হবার সেতু। নদীর দুপারেই গাছ। কী নাম এই নদীর? পথে লোকজন তেমন নেই, মানে প্রাপ্তবয়স্ক লোক নেই। কতগুলো বাচ্চা ছেলে মেয়ে ছুটে ছুটে খেলছে একটু দূরে। ওদের জিজ্ঞেস করা যাবে না। এত সুন্দর একটা নদী ছিল এত কাছে, অথচ তা জানতামই না এতদিন? একটু হেঁটে এগিয়ে একজন বুড়িকে দেখতে পাই। বলি,— নমস্কার, মাফ করবেন, একটা কথা জানতে চাই, কী নাম এই নদীর?

বুড়ি সম্ভবত রাশিয়ান ভাল জানে না, তবু ভুরু কুঁচকে শুনে বুঝে ফেলে আমার প্রশ্ন। একগাল হেসে নদীটার দিকে এক ঝলক দেখে নিয়ে বলে— চির্চিক।

জানতে পারিনি যে সেদিনই ছিল আমার শেষ গানের ক্লাস। নদী আবিষ্কারের সঙ্গে এও বুঝে ফেলেছিলাম যে পৃথিবীটা সত্যি সত্যিই গোল। যে নদীকে তুমি দুমাস আগে দেখে এসেছ চল্লিশ কিলোমিটার দূরে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে যেতে, সে ই চুপিচুপি এসে উপস্থিত নির্জন রাস্তার ধারে। কেউ তোমাকে আগে থেকে বলে দেয় নি যে এই পথ ধরে সিধে হেঁটে গেলেই তার সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে। এই অবিশ্বাস্য ঘটনায় আমার সঙ্গে আর কেউ রইল না সাক্ষী হয়ে। তা হোক গে, আকাশের আলো যখন একেবারে পড়ে যায় নি তখন পিছুটানই বা কীসের? আরেকটু হেঁটে দেখা যাক আরও কী কী আছে এই নদীর ধার ঘেঁষে। ডানহাতে নদীটাকে রেখে চলতে থাকি। চমৎকার বাঁধানো রাস্তা। বাঁদিকে গাছপালার আড়ালে বাড়ি টাড়ি রয়েছে। আরেকটু এগোলে রাস্তা একটু সরু হয়ে যায়, সরু রাস্তা এসে পড়ে একটা বাগানের মত জায়গায়। বাগান মানেই এমন নয় যে পথ ওখানেই শেষ, বাগান পেরিয়ে গেলে ফের রাস্তা পাওয়া যাবে দেখা যাচ্ছে। নানানরঙের গোলাপের গাছ দিয়ে বাগানটা খুব সুন্দর করে সাজানো। ফুটে রয়েছে আরও অনেক ফুল যাদের নাম আমি জানিনা। আর রয়েছে কিছু গাছ, যাতে ফুল নেই। এমনি একটা গাছের পাতা দেখে চমকে উঠতে হয়, সে পাতা সবুজ নয়, হালকা নীলচে আভা। যদিও এপাশটা ছায়া ছায়া মত, তবুও সবুজকে নীল ভেবে ভুল করবার মত খারাপ চোখ তো আমার নয়। হাতে ধরে দেখি, সত্যিই নীল। একটু মোটা, ফোলাফোলা মত পাতা, পাথরকুচি পাতার মত অনেকটা। যাক, এটাও আবিষ্কার করা হয়ে গেল। সঙ্গে কেউ আসেনি ভালই হয়েছে। নিজের ইচ্ছে মত হাঁটব। বাগানটা আসলে একটা মস্ত বাড়ির সঙ্গে জোড়া। একটা দরজাও দেখা যাচ্ছে বাঁদিকে, দরজার পাশে পাথরের ফলক। এগিয়ে গিয়ে পড়তে চেষ্টা করি কী লেখা রয়েছে। পরপর দুটো ভাষায় লেখা, একপাশে উজবেক ভাষায়, অন্যপাশে রাশিয়ানে। ফলকটা পড়ে নিয়ে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারি না, ঠিক পড়ছি তো? এসব কী হচ্ছে এই বিকেল থেকে! আবার পড়ি। এটাই তো থিয়েটারের ইনস্টিটিউট! আমি তো এখানেই থিয়েটার শিখতে চাই, এটাই তো আমার আসল পরিকল্পনা। যে কথা আমার ক্লাস টিচার ছাড়া কেউ জানে না, সেইটের জন্য আমাকে উঠে পড়ে লাগতে হবে এবার। আমি বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে চাই না, আমি অভিনয় শিখতে চাই। আমি অভিনেত্রী হব। বুকের ভেতরে ধুকপুক করে। মাথা তুলে বাড়িটার দিকে তাকাই এবার ভাল করে, এই গেটটা হচ্ছে পেছনের গেট, সামনের দিকেও গেট থাকবে, সেই গেটে যাবার জন্য নিশ্চয় অন্য দিকে রাস্তা আছে। না, আজ এইটুকুই থাক। নীল গাছগুলো পেরিয়ে বাগানের শেষে অন্য রাস্তাটা ধরে যখন বেরিয়ে যাচ্ছি সেদিকে নদী দূরে সরে যাচ্ছে, এই রাস্তাও সোজা চলেছে বড়ো রাস্তায়, যে দিকে গেলে বিশাগাচের ট্রলিবাস ধরা যাবে।

পরের দিনও ফেরেসালাম যেতে চায়নি আমার সঙ্গে। সরাসরি বলে দিল, কী লাভ আছে ওখানে গিয়ে, সে তো ডাক্তারি পড়বে বলে এসেছে এদেশে, ঐ ভূতুড়ে পরিবেশ, ঐ পাগলাটে গানের মাস্টার, এসব তার সুবিধের ঠেকে নি। একা একাই চলে গেলাম। লতানে গোলাপে মোড়া লোহার গেট আজ বন্ধ। উঁকি ঝুকি মেরে দেখতে চেষ্টা করলাম ভেতরে আলো জ্বলে কিনা, কান পেতে শুনতে চেষ্টা করি গানের আওয়াজ একটুও যদি শুনতে পাই। সব নিস্তব্ধ। কেউ কোত্থাও নেই যে জিগ্যেস করব। আবার কি আসব পরের দিন? মাস্টারমশাই কি অসুস্থ? হতেও পারে। বেশ বলেছিল ফেরেসালাম, ভূতুড়ে পরিবেশ। ভূতই তো। ভূতের রাজাও বলা যায়। ভূতের রাজার আশীর্বাদে এই গুপী গাইনটার হেঁড়ে গলার যদি কিছুটা উন্নতি হতো! কিন্তু বরাতে নেই।

চার.

বিশাগাচের মোড়ে মস্ত একটা বাজার আছে। বেশ পুরোনো বাজারটা। সন্ধে হলে নিয়ম মত বাজার বন্ধ হয়ে যায়, যেমন আর সব দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায় সন্ধে সাতটা বাজতে না বাজতেই। বিশাগাচের মোড়ে তাই বাজার বন্ধ হবার ব্যস্ততা। কম করে জনা তিরিশেক লোক ব্যস্ততার সঙ্গে বাজার করে বেরিয়ে আসছে বাসস্টপের দিকে। সবার হাতেই কম বেশি মালপত্তর। তবে মূল বাজারটা বন্ধ হলেও বিক্রিবাট্টা এখনি পুরোপুরি বন্ধ হবার নয়। বাজারের সামনে ফুটপাথে ছোট ছোট পসরা সাজিয়ে বসতে শুরু করেছে কিছু দোকানি। বাজার বন্ধ হবার পরেই এদের ব্যবসা শুরু হয়। কেউ বিক্রি করছে ফুল, এক বুড়ির টুকরিতে রয়েছে কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা গরম সামসা। বাজারের গেটের পাশে ছুরি শান দেবার দোকানটা বন্ধ হয়ে গেল এইমাত্র। পরপর এসে উপস্থিত হচ্ছে গাজরের স্যালাদ বিক্রেতা, কেউ বেচছে ঠোঙায় ভরে সদ্য রোস্ট করা গরম গরম সূর্যমুখীর বীজ। আমি ঝুঁকে পড়েছি বিশ পয়সার সামসা কিনতে। ভেড়ার মাংস আর চর্বি দেওয়া গোল প্যাটিসের মত দেখতে এই সামসা, বুড়ি দরদ দিয়ে মশলার গুঁড়ো ছিটিয়ে দিল সামসার ওপর। দুতিনটে ছেলেকে দেখলাম ব্যস্ত হয়ে ট্যাক্সি ধরবার চেষ্টা করছে। ফাঁকা ট্যাক্সি নেই তবু চেষ্টা করে যাচ্ছে, কোন গাড়ি কাছ দিয়ে গেলেই হাত তুলছে থামানোর চেষ্টায়। ওদের ছটফটে ভাব দেখেই আরেকটু নজর করে দেখলাম এরা তো সব আমাদের হস্টেলের ছেলে। সব কটার নাম জানিনা তবে একজন আমার ক্লাসমেট, ইরাকের ছেলে গাসান, গাসান আবিদ কাতার। আমাকে দেখতে পেয়েও ওরা যেন চিনতে চায় না। থেমে যায় একটা গাড়ি, ওরা হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ে গাড়িটার মধ্যে। গাড়ি ছেড়ে দেয়, জায়গাটা ভরে থাকে সেন্টের গন্ধে। জানি ওরা কোথায় চলেছে এত তাড়াহুড়ো করে। একদম সঠিক ঠিকানাটা বলতে পারব না যদিও, ওরা গেল কোনও একটা দামি রেস্টুরেন্টে, সেখানে গিয়ে খানাপিনা করবে নাচবে, রেস্টুরেন্টের গায়কের হাতে এক মুঠো নোট গুঁজে দিয়ে পছন্দের গান গাওয়াবে, ইচ্ছুক মেয়েদের ডেকে আনবে নিজেদের টেবিলে, মাতাল হয়ে অনেক রাতে টলতে টলতে ফিরে আসবে হস্টেলে। গাসান অর্ধেক দিন ক্লাসে আসে না, ঘুম থেকেই উঠতে পারে না সকালে। আশেনাফির সঙ্গে একদিন কী একটা ব্যাপারে কথা কাটাকাটির পর হাতাহাতি মারামারি হচ্ছিল, তখন এসব কথা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলেছিল আশেনাফি। গাসানও কম যায় না, খোঁটা দিয়েছিল আশেনাফিকে গরীবের দেশ ইথিওপিয়া বলে, বলেছিল, তোরা তো খেতেই পাস না, তোদের দেশে না খেয়ে দুর্ভিক্ষে মরছে লোক। পকেট থেকে কয়েকটা রুবলের নোট বের করে বলেছিল, ডোনেশান চাই? মারামারি থেমে যায় এরপর। আশেনাফি চেঁচিয়ে জবাব দিতে পারেনি আর, কেবল ফ্যাকাশে মুখটা হাসি হাসি করবার মত করে আস্তে আস্তে বলছিল, ওদের তো তেল বেচে এত টাকা, যেদিন সব তেল ফুরিয়ে যাবে সেদিন টেরটি পাবে। সমর্থন পাবার প্রত্যাশায় আমাদের দিকে তাকাচ্ছিল সে। আমরা চুপ করেছিলাম। কতটা তেল, সে তেল বেচতে বেচতে কত দিনে ফুরোবে এবং ততদিন আমরা বেঁচে থাকব কি না এসব তো এখনই হিসেব করা যাচ্ছে না, তাই চুপ করে থাকা। তবু সে নিজেকে ওভাবেই সান্ত্বনা দেয়।

মাঝের তিনজন হচ্ছে ফেরেসালাম, আশেন্নাফি ও আমি।

গাসানরা ট্যাক্সি করে চলে যাবার পরে আর ট্রলিবাস নিতে ইচ্ছে করে না। ডান হাতে পড়ে কমসামোলসকাইয়া ওজেরা — বড়ো একটা লেক। আর খুব বেশি হাঁটতে হবে না, দুটো স্টপ। আমাদের হস্টেল এই রাস্তার ন নম্বর বাড়ি। ইউক্রেনের বীর বাগদান হ্মেলনিৎসের নামে এই রাস্তার নাম। আচ্ছা মধ্য এশিয়ার এই মরুদ্যানে সুদূর ইয়োরোপের বীরপুরুষ কী করেছিল যে তার নামে এই রাস্তা? উজবেকদের মধ্যে বিখ্যাত লোকের এতই অভাব? এইটে জিগ্যেস করতে হবে তো কাল ক্লাস টিচার মায়া আবিদোভনা শারিপভাকে। উঁহু শারিপভাকে নয়, জিগ্যেস করব ইতিহাসের শিক্ষক ভ্লাদলেন উসমানোভিচ ইউসুপভকে। অল্প পথ বাকি। সামসাটুকু খুঁটে খুঁটে খেতে খেতে শেষ করবার আগেই এসে পড়বে হস্টেলের দরজা।

আমাদের হস্টেল থেকে বেরিয়েই রাস্তায়, যিনি ছবির প্রিন্ট আউট বানিয়েছিলেন, তিনি উল্টো প্রিন্ট আউট করে ফেলেছেন ভুল করে। কাজেই ডানদিক গুলো বাঁদিক হয়ে গেছে আর বাঁদিকগুলো ডানদিক।

 

চলবে…

যোষিতা। লেখক ও কম্পিউটার প্রকৌশলী। জন্ম ও বেড়ে ওঠা উত্তর কলকাতায়। ১৯৮৫ সালে উচ্চশিক্ষার্থে তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নে যাত্রা। প্রাক-পেরেস্ত্রৈকা ও তৎপরবর্তীকাল, সবমিলিয়ে দশ বছর কাটিয়েছেন মধ্যএশিয়ার উজবেকিস্তানে। তিনি সামাজিক প্রথাবহির্ভূত জীবনের পাশবইয়ে জমার অঙ্ক ভরে তুলেছেন বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞান। ১৯৯৫ সালের...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ