ইমন কল্যাণ
পরিচ্ছেদ ৬ অনেক রাতে ফিরেছিল কল্যাণ ওরফে শহীদুল।গাড়িটা শেডে রাখার পর দু’বার হালকা করে মা…..
যেদিন প্রথম গুছিয়ে রাশিয়ানে কথা বলতে শিখলাম, সেদিন মায়া আবিদোভনাকে বলেই ফেলেছিলাম সেই কথাটা যে কথাটা বলবার জন্য অনেক দিন ধরে চেষ্টা করে যাচ্ছি। শুধু বললেই তো হবে না, যুক্তি দিয়ে বোঝাতে হবে তাকে। সে যদি পুরোপুরি বুঝতে না পারে আমার কথা, তাহলে সব ভেস্তে যাবে, আমার আসল উদ্দেশ্য সফল হবে না। ধৈর্য ধরে মনে মনে গুছিয়ে তৈরী করেছি প্রত্যেকটা বাক্য, বাছা বাছা শব্দরূপ ধাতুরূপ এবং যুক্তি দিয়ে।
ক্লাসে দুটো পিরিয়ডের মধ্যে একটু করে বিরতি থাকে। ডিসেম্বরের শেষাশেষি এমনি এক বিরতিতে একা পেয়ে এগিয়ে গেছলাম মায়া আবিদোভনার দিকে। উনি প্রথমটায় ভেবেছিলেন যে পড়াশুনোর ওপর কোন প্রশ্ন আছে। কথা বলতে শুরু করে খেই হারিয়ে যায়, সমস্ত গুছিয়ে ভেবে রাখা বাক্যগুলো ভুলে যেতে থাকি। উনি ধৈর্য ধরে থাকেন, কোন তাড়া দেন না। আমার কথা শুনতে গিয়ে ক্লাসে যেতে দেরি হয়ে যায়। মরিয়া হয়ে বলি, মায়া আবিদোভনা যে বিষয় নিয়ে পড়ব বলে এসেছি এ দেশে, সে বিষয় আমি পড়তে চাই না, সে বিষয় আমি একেবারে ভালবাসি না, আপনি বুঝতে পারছেন? উনি বলেন, তাহলে কী পড়তে চাও তুমি? আমতা আমতা করে বলি আমার পছন্দের বিষয়ের নাম। আমি অভিনয় শিখতে চাই, অভিনেত্রী হতে চাই।
উনি চুপ হয়ে যান। একটু ভেবে নিয়ে বলেন, কিন্তু এখন তুমি যে গ্রুপে ভাষা শিখছ, সে গ্রুপে যা যা পড়ানো হচ্ছে সেসবের সঙ্গে তো তোমার পছন্দের বিষয়ের অনেক তফাৎ, তুমি পড়তে এসেছ বায়োফিজিক্স, তোমার গ্রুপের অন্যরা পড়বে ডাক্তারি, এখন তুমি যা বলছ তাতে তো অন্য গ্রুপে গেলে ভাল হত। আমি যুক্তি সাজাতে থাকি, আচ্ছা যদি আমি কাল থেকেই অন্য গ্রুপে চলে যাই তাহলেও কি খুব অসুবিধে হবে? বিষয় পাল্টানো কি খুব শক্ত ব্যাপার? আপনি পারবেন না ডীন কে বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজি করতে?
মায়া আবিদোভনা চিন্তায় পড়ে যান, কিন্তু আশ্বস্ত করেন যে উনি যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন আমার বিষয় বদল করতে। কদিন পরে খবর দেন, হয়ত আমাকে প্রস্তুত হতে হবে আলাদা পরীক্ষার জন্য। আমি আশার আলো দেখতে পাই। পরীক্ষা দিতে হলে অবশ্যই দেব, প্রমাণ করে দেব যোগ্যতা। তবে কারোকে বলিনা এই গোপন অভিসন্ধি। ক্লাসের একজনও জানতে পারে না, ইন্ডিয়ান কমিউনিটিরও কেউ জানে না এ ব্যাপারে। বলা যায় না, শুধু মুধু ঠাট্টা টিটকিরি করে মনটা ভারী করে দিতে পারে। মার্চের মাঝামাঝি খবর দিলেন শারিপভা, প্রস্তুত হও পরীক্ষার জন্য, যে কোন দিন ডাক পড়তে পারে। তোমার পরীক্ষা এখানে হবে না, যেতে হবে ইনস্টিটিউটে, ভয় পেও না আমরা তোমায় সঙ্গে করে নিয়ে যাব।
গল্পের অডিওপাঠ শুনুন এখানে:
দেখতে দেখতে ঠিক হয়ে গেছে পরীক্ষার দিন ক্ষণ। আর কী সমাপতন, নদীর ধার দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমি দেখে ফেলেছি সেই ইনস্টিটিউটের দরজা। আর মাত্র কটা দিন রয়েছে হাতে। জায়গাটা দেখে মনটা যেমন ভাল হয়ে গেছে, তেমনি পরীক্ষার জন্য দুরুদুরু কাঁপছে হৃদপিণ্ড। গোপনে প্রস্তুতি নিই পরীক্ষার, পাছে কেউ দেখে ফেলে হাসাহাসি না করে। এইজন্যই ফাঁকা রাস্তা আমার এত প্রিয় হয়ে উঠছে। কেউ ডিস্টার্ব করবার নেই, পরীক্ষার জন্য তৈরী হবার এটাই বেস্ট জায়গা।
এপ্রিলের মাঝামাঝি এক ঝলমলে দিনে আমায় বগলদাবা করে নিয়ে চললেন শারিপভা। সঙ্গে সহকারী ডীন লারিসা ভাসিলিয়েভনা সিমোনভা। হস্টেলের পেছনের দিক দিয়ে একটা শর্টকাট রাস্তা আছে, সেদিক দিয়েই পা চালিয়ে হেঁটে চলেছি আমরা। কীরকম পরীক্ষা হবে, কারা পরীক্ষা নেবে কিছুই জানি না। মিনিট দশেকের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম চিয়াত্রালনি ইন্সতিতুতের সদর দরজায়। ওঁরা আমায় নিয়ে গেলেন দোতলার একটা ঘরে। সে ঘরে ডেস্ক বেঞ্চি কিচ্ছু নেই। ফাঁকা ঘর, দুটো চেয়ার, মেঝের ওপর পড়ে আছে একটা লম্বা মত কাঠের টুকরো। দুজন লোক ঢুকে পড়েছে ঘরে, ওঁরা আমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে কথা বলছেন নীচু গলায়। এঁরাই আমার পরীক্ষক। ঘরের মাঝখানটায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম।
একজন আমাকে জিগ্যেস করলেন,— তুমি গান গাইতে পার? করোনা, একটা গান করো আমরা শুনি।
না, গলা শুকোয় নি, ভয় পাই নি, চট করে ভেবে নিতেও পারিনি। ঝলমলে বসন্তের দুপুরে ঘন বর্ষার রবীন্দ্র সংগীত ধরেছি মন্দ্রলয়ে, আআজিই ঝঅরোও ঝঅরোও মুউখঅরোও বাআদোওরোও দিইনেএ…
লোকদুটো কেমন অদ্ভুত তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। দ্বিতীয় লাইনে পৌঁছনোর আগেই একজন উঠে দাঁড়িয়েছে চেয়ার থেকে। এমতাবস্থায় গান থামালে ডাহা ফেল করব। লোকটা দরজার দিকে হেঁটে চলে গেল, দরজাটা ভাল করে চেপে বন্ধ করে ফিরে এসে বসল আবার চেয়ারে। আমি তড়িৎগতিতে স্ট্র্যাটেজি পাল্টে ফেলেছি। অন্তরা শুরু করে দিয়েছি অন্য সুরে, দ্রুত লয়ে। অল্প পরেই গান শেষ। পুরো পরীক্ষাটা চলছে দুটো ভাষায়। ওরা রাশিয়ানে জিগ্যেস করছে, আমি বাংলায় নেচে কুঁদে লাফিয়ে ইম্প্রোভাইজ করে চলেছি। প্রায় মিনিট চল্লিশ ধরে চলেছিল সেই ভয়ানক কাণ্ড কারখানা। চারজন দর্শকেরই বলিহারি কন্ট্রোল মুখের পেশির ওপর। নিজের নাচন কোঁদন তো নিজে দেখিনি, কিন্তু ওঁরা না হেসে গম্ভীর মুখে অতক্ষণ বসে রইলেন কীকরে সে আজও রহস্য রয়ে গেছে। মাঝে একবার সেই কাঠের টুকরোটাকে কাল্পনিক ডিঙি বানিয়ে ঝড়ের রাতে নদী পেরোনোর অভিনয়ও করতে হয়েছে। পরীক্ষার শেষে কী যে হল বুঝতে পারলাম না, পরে জানিয়ে দেবে বলল। থিয়েটারের ইনস্টিটিউট থেকে বেরিয়ে আমার দুই শিক্ষিকা একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন। আমার সঙ্গে ফিরতে চান না। কী আর করব, হাঁটা দিলাম একাই হস্টেলের দিকে। একটু পরে পেছন ফিরে অন্যমনস্কতার কারনটা বুঝলাম, দুজনেই একটা খাবারের দোকানের সামনে লাইনে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। নিশ্চয় দুর্লভ কোন খাবার এসেছে দোকানে, লাইন দিয়ে কিনে না ফেললে পরে আবার কবে পাওয়া যাবে কেউ জানে না। হতে পারে তা দামি চকোলেট, কি সসেজ, কি আরও লোভনীয় কিছু। সবসময় লোকজন কেবল লাইনে দাঁড়াচ্ছে। দুটো অপশন তোমার হাতে, হয় লাইনে দাঁড়াও, নয় ঘুষ দাও। অনেক জিনিসের জন্যই লম্বা লম্বা লাইনে দাঁড়াতে হয়। নয়ত ঘুষ দিয়ে নিতে হয়। দোকানপাট ব্যক্তিগত মালিকানাধীন নয় বলে অসাধু কর্মচারীরা পন্য লুকিয়ে ফেলে বেশি দামে গোপনে বেচে দেবার চেষ্টা করে।
মে দিবসে পর পর দুদিন ছুটি থাকে, পয়লা এবং দোসরা। তার কদিন পরেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জয়লাভের জন্য ৯ই মে আবার ছুটির দিন। এই সব দিনগুলোয় উৎসবের আনন্দ উদযাপন করতে রাস্তায় বেরিয়ে পড়াই রীতি। সকাল নটার মধ্যে সেজে গুজে ফুলের তোড়া হাতে নিয়ে পৌঁছে যেতে হবে নিকটবর্তী কোনও একটা স্মৃতিসৌধ গোছের জায়গায়। আমাদের ফ্যাকাল্টি থেকে নিয়ে গেল বাসে করে “ভূমিকম্প স্কোয়ারে” (প্লোশাদ জিম্লাত্রেসেনিই); সেখানে ফুলে ফুলে ছয়লাপ অবস্থা, পরিচিত অপরিচিত সকলকে সাদর সম্ভাষণ করে ফিরে এলাম আবার হস্টেলে। পয়লা এবং নয়ুই মে দুদিন ই বাধ্যতামূলকভাবে টিভির সামনে বসে দেখতে হল মস্কোর প্যারেড, লাইভ টেলিকাস্ট। এরকম টেলিকাস্ট আগেও একবার দেখা হয়ে গেছে ছঁয়ুই নভেম্বরে। ছঁয়ুই এবং সাতুই নভেম্বর খুব জাঁক জমকের সঙ্গে দেশব্যাপী উদযাপিত হয় অক্টোবর বিপ্লবের বিজয় উৎসব। পুরোনো ক্যালেন্ডার অনুসারে সে তারিখ আসলে ছিল পঁচিশে ও ছাব্বিশে অক্টোবর। মস্কোর রেড স্কোয়ারে (ক্রাসনাইয়া প্লোশাদ) বিশাল কুচকাওয়াজ অনেক অস্ত্র শস্ত্রের গর্বিত প্রদর্শন। চারিদিকে লাল পতাকা, সমস্ত লালে লাল। সেবারেও শীতের মধ্যে গোড়ালি ডোবা বরফের মধ্যে ভূমিকম্প স্কোয়ারে গিয়ে বিপ্লবের আটষট্টিতম জয়ন্তীতে সবার সঙ্গে গলা মিলিয়ে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে হুররা হুররা বলেছি, মায়া আবিদোভনা আগে থেকেই শিখিয়ে পড়িয়ে রিহার্সাল দিইয়ে তৈরী করে রেখেছিলেন আমাদের। ভূমিকম্প স্কোয়ারের ছোট কুচকাওয়াজে মন্ত্র পড়ার মত করে একজন মাইকের সামনে যেই বলছিল “মহান সমাজতান্ত্রিক অক্টোবর বিপ্লবের আটষট্টিতম জয়ন্তীর অভিনন্দন!” (দা জ্দ্রাস্ৎভুয়েৎ শেস্তজেসিয়াৎভাসমোই গদাভশিনি ভিলিকোই অক্তিয়াবর্সকোই সৎসিয়ালিস্তিচেসকোই রেভালিউৎসিই!) অমনি আমরা গলা ফাটিয়ে চেঁচাচ্ছিলাম— হুররা! সে যতবার বলছিল ততবার করে হুররা। হস্টেলে ফিরে দেখলাম টিভিতেও কুচকাওয়াজে ওরকম হচ্ছে, গ্যালারিতে দর্শকেরা হুররা করছে, হুররা থেমে গেলে পিন ড্রপ সায়েলেন্স, এমন অরগ্যানাইজড দর্শক এর আগে কোনদিনও দেখিনি।
এতটা বীররস দিয়ে উৎসব উদযাপনের অভ্যাস দেশে থাকতে তৈরী হয় নি। সেখানে স্বাধীনতা দিবস, প্রজাতন্ত্র দিবস উদযাপনের পদ্ধতি ছিল জাতীয় পতাকা উত্তোলন, মাইক বাজিয়ে গান, ইত্যাদি। এখানে বারোয়ারী উৎসবগুলো অধিকাংশই বীররসাত্মক হলেও ভক্তিরসও যে তাতে থাকে তা বুঝতে পারি। সকালের দিকে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে বন্ধু প্রতিবেশীদের অভিনন্দন জানানোর পরে সকলেই ছুটিটুকু মন দিয়ে উপভোগ করে। সন্ধে হলেই সরকারি ভবনগুলোর গায়ে দেখা যাবে আলোকসজ্জা। অক্টোবর বিপ্লবের জয়ন্তীতে আলো দিয়ে সাজিয়ে লেখা থাকবে “বিপ্লব জিন্দাবাদ” (স্লাভা রেভালিউৎসিই), ঝলমল করবে চতুর্দিক। প্রতেকটা শহরে লেনিনের মূর্তিসহ একটা করে লেনিন স্কোয়ার (প্লোশাদ লেনিনা) থাকবেই। সেখানে মেলার মত পরিবেশ, লোকজন সেজেগুজে এসে ঘুরছে আনন্দ করছে। সব উৎসবেই এই একই রীতি। উৎসব বিশেষে শুধু স্লোগানগুলো বদলে যায়, মে দিবসে বলে “শান্তি, শ্রম, মে” (মির, ত্রুদ, মাই), নারীদিবসে “৮ই মার্চ জিন্দাবাদ” (স্লাভা ভাসমোয়ে মার্তা) কি “সোভিয়েত নারী জিন্দাবাদ” (স্লাভা সোভিয়েৎস্কিম জেনশিনাম), নতুন বছরের দিনেও ঝলমল করে প্লোশাদ লেনিনা। সন্ধের দিকে প্রায় সকলেই কম বেশি কয়েক পাত্র ভোদকা চড়িয়ে উৎসবে সামিল হয়। আমরা বিদেশিরাও যাই, যেতে শিখিয়ে দেওয়া হয়েছে।
নতুন বছরের দিনটায় অবশ্য অন্যরকম মজা হয়েছিল। সেই মাছ ছুঁড়ে ফেলা এবং তা ফিরিয়ে দিয়ে আসার ঘটনার পরে গডউইনদের সঙ্গে বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেল। পয়লা জানুয়ারি আমরা কয়েকজন মিলে সিনেমা দেখতে গেছলাম। তাশকেন্তে বেশ অনেকগুলো সিনেমাহল, এবং রাশিয়ানে ডাব করা হিন্দি সিনেমা কোনও না কোনও হলে চলবেই। সেসব অধিকাংশই পুরোনো বই, রাজকাপুর ঘরানার। অল্প স্বল্প সমসাময়িক বইও চলে যেমন, মিঠুন চক্রবর্তীর ডিস্কো ডান্সার, অমিতাভ বচ্চন অভিনীত অমর আকবর অ্যান্টনি, ইত্যাদি। ইন্ডিয়ানরা রাশিয়ানে ডাব করা হিন্দি বই দেখতেই পছন্দ করত। পয়লা জানুয়ারি প্লোশাদ লেনিনার ঠান্ডায় বেশিক্ষণ দাঁড়ানো গেল না, লোকজন যারা রয়েছে সবই মারাত্মক রকমের মাতাল, রাত সাড়ে নটা নাগাদ আমরা তিনচারজন মিলে গরম জায়গা খুঁজতে কাছেই একটা সিনেমাহলে ঢুকে পড়লাম। হলটার নাম ইস্ক্রা (বাংলা অর্থ স্ফুলিঙ্গ, এই হলে হিন্দিবই চলত না), কী বই চলছে নাম না দেখেই ঢুকে পড়েছি। সেই প্রথম একটা রাশিয়ান ছবি দেখেছিলাম যেটা বীররসাত্মক নয়, ওয়র মুভি নয়, আমার দেখা দশটা প্রিয় সিনেমার মধ্যে এইটা সারাজীবন থেকে যাবে। গুনে গুনে তিন মাস হয়েছে তখন ভাষা শেখা , সব সংলাপ বুঝতে পারি না, তবু হাঁ হয়ে আদ্যন্ত দেখেছিলাম বইটা এবং অবাক হয়েছিলাম এত কড়াকড়ির দেশে ঐ বই কীকরে দশ বছর আগে(১৯৭৬) ব্রেঝনেভের আমলে সেনসরের ছাড়পত্র পায়! নাঃ ভদ্রলোক সত্যিই রসিক ছিলেন। “নিয়তির পরিহাস, অথবা চট করে শুকিয়ে উঠুন” (ইরোনিয়া সুজবি, ইলি স্লোঃকিম্ পারম্) এই নাম সেই বইটার (এখন ইন্টারনেটে দেখলাম ইংরিজিতে অনুবাদ করছে: Irony of fate, or enjoy your bath উঁহু, “enjoy your bath” টা সঠিক অনুবাদ নয়)। আমার সঙ্গীরা প্রথমে খুব হাসতে থাকে মজার ঐ সিনেমা দেখতে দেখতে, তারপর রাত হতে থাকে, তাদের খিদে পেতে থাকে, হস্টেলে ফিরবার জন্য তাড়া দেয় ঘন ঘন, তিনঘন্টার ওপর চলে সিনেমা, আমি জেদ ধরে বসে থাকি শেষ না দেখে কিছুতেই বেরোতে রাজি হই না। ঐ একটাই রাশিয়ান সিনেমা দেখা হয়েছিল প্রথম বছর, যেটা সিলেবাসের বাইরে, যেটার বিষয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নয়। খুব অল্প ভাষাজ্ঞান নিয়েও হাসতে হাসতে যতটুকু বুঝতে পেরেছিলাম, তা ভাবায় এবং ভয় পাইয়ে দেয়। গল্পটা এইরকম, না জেনে কেউ যদি এক শহরে যেতে গিয়ে অন্য শহরে উপস্থিত হয়, তবে সে ফারাক বুঝতে পারবে না। গল্পের নায়ক মস্কোয় থাকে, মাতাল অবস্থায় ঘটনাচক্রে সে পৌঁছে যায় লেনিনগ্রাদ। দুটো শহরে একই নামের রাস্তা, একই রকম দেখতে বাড়ি, দরজার চাবি পর্যন্ত মিলে যায়, ঘরের আসবাব এক, জামাকাপড়, বাসনকোসন সমস্ত অবিকল এক। আমরা দর্শকেরা হেসে কুটিপাটি হচ্ছি, রাস্তা বাড়ী দরজা জানলা চাবি সব মিলে যাচ্ছে দেখে। হয়ত বিদেশি বলেই আমার চোখে পড়ছে বেশি করে যে বিপ্লব নববর্ষ সব অনুষ্ঠানই একরকম, সবসময়েই লোকে ভক্তিভরে ফুল দিয়ে আসে প্লোশাদ লেনিনায়, এমনকি বিয়ে করে নবদম্পতিও লেনিনের স্ট্যাচুর কাছে সবার আগে যায়, ভক্তি ভরে ফুল দেয়, ফটো তোলে, বাকি সব অনুষ্ঠান এর পরে।
ঐ নতুন বছরের সময় থেকেই একটু একটু করে বুঝতে পারতাম সোভিয়েতদের চেহারার প্রভেদ, চিনতে পারতাম কে এশীয় কে ইয়োরোপিয়ান, কে উজবেক কে রাশিয়ান।
থিয়েটারের ইন্সটিটিউটে পরীক্ষা দিয়ে আসার পরে এক উইকেন্ডে মেডিক্যাল স্টুডেন্টদের হস্টেলে গিয়ে এলপি রেকর্ডে একটা উজবেক দলের গাওয়া কয়েকটা রাশিয়ান গান শুনেছিলাম। গ্রুপটার নাম ইয়াল্লা, গেয়েছেন ফারুখ জাকিরভ। সুর যেমন সুন্দর তেমনি প্রত্যেকটা কলির মানে বুঝতে পারাও রোমাঞ্চকর। অজানা গান বাজছে রেকর্ডে, উচ্ কুদুক (এটা তিনটে কুয়োর গান) কিংবা সেই বিখ্যাত গানটা— চাইখনা। সে গানের মর্ম পূবের দেশের লোক ছাড়া বুঝবার সাধ্যি আর কারও নেই।
মে দিবসের ছুটির পরপরই শেরগোল পড়ে গেল হস্টেলে। খুব করিৎকর্মা এক ডিরেক্টর এসেছেন হস্টেলে, সামনের সপ্তাহ থেকে শুরু হচ্ছে আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভাল। সেই ফেস্টিভালের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিদেশি ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে নাচ গান করানো হবে। আমাদের মধ্যে থেকে জনা তিরিশেককে তিনি বেছে নিলেন। আন্তর্জাতিক ফেস্টিভালের আন্তর্জাতিক দর্শকদের জন্য স্টেজে নাচবে গাইবে আন্তর্জাতিক টিম। এই হচ্ছে আইডিয়া। লাতিন অ্যামেরিকার ছেলেমেয়েরা চমৎকার নাচতে পারে, আমি ইন্ডিয়ার কলঙ্ক কোনও দিনও নাচ শিখিনি। খুবই ক্ষুব্ধ এবং আশ্চর্য হলের ডিরেক্টর মশাই। কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছেন না যে, যে দেশের সিনেমায় প্রত্যেকটা নায়িকা এবং খলনায়িকা কথায় কথায় নেচে ওঠে, সত্যিই সেই দেশ থেকে এসেছি কিনা। কিন্তু হাল ছাড়বার পাত্র উনি নন। গোটাকতক স্টেপ শিখিয়ে দিলেন, সেই সঙ্গে হাত ঘোরানো। একটা গ্রুপ ডান্সে মাঝখানে দাঁড়িয়ে ওরকম করলেই চলবে। প্রত্যেকদিন বিকেল হলেই শুরু হয়ে যেত আমাদের রিহার্সাল। চলেছিল ফিল্ম ফেস্টিভাল শুরু হবার আগের দিন অবধি, তাশকেন্তের প্রাসাদের মত অডিটোরিয়াম দ্রুঝবি নারোদভ -এ।
রিহার্সাল যখন তুঙ্গে, প্রায় মেরে এনেছি নাচের সব কটা স্টেপ, এমনি এক বিকেলে হন্তদন্ত হয়ে মায়া আবিদোভনা সেখানে উপস্থিত। স্টেজের ওপর থেকেই দেখছি তিনি নীচে দাঁড়িয়ে ইশারা করে চলেছেন। আমাদের প্র্যাকটিসটা শেষ হতে না হতেই মামা বলে একটা মেয়ের গানের রিহার্সাল শুরু হয়ে গেল। মামা মালির মেয়ে, যেমন স্টেজ ফ্রি তেমন ব্যক্তিত্ব। মামা মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে চোখ বুজে দরদ দিয়ে গাইছে, আমি লাফিয়ে স্টেজ থেকে নামতে গিয়ে পড়ে গেছি। মায়া আবিদোভনা খুব তাড়াহুড়ো করে বললেন, “খবর আছে, তুমি পাশ করে গেছ”। কীসের পাশ? মাথায় ঢোকে না কথাগুলো। উনি চোখ কপালে তুলে বলেন—মনে নেই সেদিন পরীক্ষা দিয়ে এলে অভিনয় শিখবে বলে!
স্টেজ থেকে লাফিয়ে পড়বার সময় পা যে মচকেছে তা অনুভব করতে পারিনি। শারিপভা বেরিয়ে গেলেন অডিটোরিয়ামের একেবারে সামনের একটা গেট দিয়ে স্টেজের দুপাশে যেগুলো থাকে। আমার মাথার মধ্যে কী হচ্ছে বুঝতে পারছি না, কানে যেন তালা লেগে গিয়েছে, স্টেজের ওপর মামা হাত নেড়ে নেড়ে গানের ভাব বোঝাচ্ছে। প্রথম সারির ফাঁকা চেয়ারে বসে পড়লাম। এ আনন্দ সংবাদ কারও সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া যাবে না। সমস্ত আনন্দটা চেপে রাখতে হবে নিজের মনের ভেতরে। একেবারে ‘লেংচে মরি’ অবস্থায় আবার স্টেজে উঠলাম, স্টেপস ভুল হতে লাগল, ডিরেক্টর চেঁচামেচি করছেন, বাট হু কেয়ার্স! ওরে বাবা, এ খবর চেপে রাখা যায় না, পেট গুড় গুড় করে আনন্দে, হস্টেলে ফিরেই বিছানার ওপর ঝাঁপিয়ে ডিগবাজি খেয়ে ফেলি গোটা কতক। মাথাটা একটু ঘুরে ঝিমঝিম করে, উঁহু এ জিনিস চেপে রেখা অসম্ভব, শাম্মি কাপুরের মত লাগছে নিজেকে, ইয়াহু! ডুডুম ডুডুম ডুম! ইয়াহু! চাহে কোয়ি মুঝে জংগলি কহে, কহনে কো জি কহতা রহে… ইয়াহু! ডুডুম ডুডুম ডুম! নিরীহ রুমমেট দুজন আমার আচরণে কিছু আঁচ করে থাকতে পারে। ঐ ঘরের মধ্যে দম বন্ধ হয়ে যাবে এত আনন্দ নিয়ে। বেরিয়ে পড়েছি বাইরে, অন্যমনস্কভাবে বাস পাল্টাতে পাল্টাতে পৌঁছে গেছি দোম্ব্রাবাদ।
দোম্ব্রাবাদের বন্ধুবান্ধবেরা এ খবর সুখবর হিসেবে নিল না, বসে গেল আলোচনাচক্র যুক্তি তর্ক সহকারে। উত্তর দক্ষিণ দুরকম ভারতের লোকই রয়েছে সেখানে। তারা আমাকে বোঝাতে থাকে অভিনেত্রী হবার কুফল কী কী হতে পারে। প্রথমত স্টেজের নাটক কাকে বলে সেটাই এরা জানত না, সেটা বোঝানোর চেষ্টা করতে লাগলাম। ভারতে এত প্রদেশ রয়েছে, তারা অনেকেই তাহলে স্টেজের অভিনয় কাকে বলে সেটা জানে না? “ডান্স ড্রামা” ভেবে নেয়। হিন্দি সিনেমার ভেতরে যেগুলো দেখায়, মনে করে সেগুলোই করতে চাচ্ছি। সিনেমার অভিনয় বোঝে। আরও বোঝে যে সিনেমায় যারা অ্যাকটিং করে সে সব মেয়েরা “ক্যারাকটারলেস”, তাদের দিয়ে সংসার হয় না, তারা জামাকাপড়ের মত পুরুষ সঙ্গী বদলায়, তাদের কেউ রেসপেক্ট করে না। আমি যদি অ্যাকটিং এর লাইনে যাই তবে আমাকে বিয়ে করবে কে? তারা খুব উত্তেজিত হয়ে পড়ল, ভদ্রঘরের মেয়ে হয়েও কেন আমি এসব পথে যেতে চাইছি, কে আমাকে এরকম দুর্বুদ্ধি দিয়েছে, আমার বাড়ির লোকজন এ খবর পেলে শকড্ হবে, এবং ফাইনালি আবারও জানিয়ে দেওয়া হল যে আমার “ক্যারাকটার” খারাপ হয়ে গেলে কেউ আমাকে বিয়ে করবে না।
এত সব কথা এর আগে ভেবে দেখিনি মন দিয়ে। হয়ত দেশে ঘনিষ্ঠজনেদের মনের কথা এরকমই, কেবল ভদ্রতার মুখোশটুকু খুলে এত খোলাখুলিভাবে তারা তাদের মনের কথা বলে উঠতে পারে নি। দেশে থাকতেও মনের মত পছন্দের বিষয় নিয়ে পড়তে পারি নি, পছন্দের পেশা বেছে নেবার পথে অনেক বাধা থাকে ভদ্রলোকের ঘরে জন্মালে। আত্মীয় স্বজন শিক্ষক হিতাকাঙ্খীরা ভুলিয়ে ভালিয়ে কেবলই বুঝিয়েছে এখন অভিনয়কে পেশা হিসেবে ভেব না, তুমি তো লক্ষ্মী মেয়ে, বুদ্ধিমতী মেয়ে, কত সুন্দর অঙ্ক কষতে পারো, ফিজিক্স কেমিস্ট্রির জটিল জটিল তত্ত্ব কি চমৎকার বুঝে ফেলেছ, কত নম্বর পেয়েছ পরীক্ষায়, সবাই কি ওরকম পারে? এত কিছু যখন পেরেছ তখন “ভালো ভালো” সাবজেক্ট নিয়ে পড়াশুনো করে পরিবারের মুখোজ্জ্বল করাই তো বুদ্ধিমানের কাজ। আরে বাবা নাটক করা তো পালিয়ে যাবে না। প্রথমে একটা ভদ্র গোছের শিক্ষাগত যোগ্যতা রইল, পাশে ফ্রি-টাইমে নাটক কর না, কেউ তাতে বাধা দেবে না। এর নাম ভুলিয়ে ভালিয়ে আমার ইচ্ছেটাকে চেপে মেরে দেওয়া। এসব আমি দেশে থাকতেই বুঝে ফেলেছিলাম, হয়ত ওদের বিচারে “বুদ্ধিমতী” বলেই। যে শক্ত শক্ত অঙ্ক কষে ফেলতে পারে, সে এই ছেলেভুলোনো ফন্দিও ধরে ফেলে, কিন্তু সে কিছু করে উঠতে পারে না, নিজের ইচ্ছেমত পেশা বেছে নেব বললেই তো তা করা যায় না, অনুরোধ মগজধোলাই ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলিং সমস্ত চলতে থাকবে যতক্ষণ না তুমি ভেঙে পড়ো, যতক্ষণ না তুমি পরাজিত হয়ে বশ্যতা স্বীকার করো, শেষ পর্যন্ত তোমাকে হেরে যেতেই হবে, তুমি আর্থিকভাবে সামাজিকভাবে তোমার পরিবারের ওপর নির্ভরশীল, যতদিনে এদের কথা মেনে তোমার অপছন্দের পেশা বেছে নিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াবে, ততদিনে তোমার নিজের পছন্দের পেশায় যাবার পথ আরও দুর্গম হয়ে গেছে। এত শত ভেবেই বিদেশে পাড়ি দিয়েছিলাম এখানে নিজের পছন্দমত তালিম নিতে পারব বলে, মাথার ওপরের ছাদ, কি অন্নবস্ত্রের জন্য কারো মুখাপেক্ষি হয়ে থাকতে হবে না। মাথার ওপরের নিরাপদ ছাদ এবং অন্ন বস্ত্রের বিনিময়ে বড্ড বেশি দাম চোকাতে হয় সংসারে, মনের স্বাধীনতা থাকে না, সমস্ত ইচ্ছেকে বেঁধে ফেলতে হয় যদি তা অন্নদাতার ইচ্ছের সঙ্গে না মিলে যায়। মেয়ে হয়ে জন্মেছি, ঘর থেকে দুম করে বেরিয়ে স্বাধীনভাবে গাছতলায় কি ফুটপাথে থাকাও তো নিরাপদ নয়। অনেক বেশি আঁটঘাট বেঁধে পথ বেছে নিতে হয়, পরামর্শ করবার মত কারওকে পাওয়া যায় না পাশে। এই ই তোমার ভবিতব্য। নাটকের মেয়ে বনে গেলে তোমায় বিয়ে করবে কে? কী ভাবে কাটাবে তুমি বাকি জীবনটুকু যদি বিয়েই না হল? ভদ্র পেশা বেছে নাও, ভালো ভালো সাবজেক্ট নিয়ে পড়াশোনা করে ভাল রেজাল্ট কর, ভালো ভালো পাত্রেরা লাফ দিয়ে ছুটে চলে আসবে তোমায় বিয়ে করতে। এমন সুযোগ কি সকলে পায়? কত গরীব দুঃখী আছে দুনিয়ায়, তারা খেতে পায় না দুবেলা পেট ভরে, পড়াশোনা করবার সুযোগ পায় না, কত মেয়ে কচি বয়সে বিয়ে হয়ে শ্বশুরবাড়িতে খেটে মরে। তুমি তো এদের দলে নও, তুমি প্রিভিলেজড মেয়ে। তবু তোমার স্বাধীনতা নেই নিজের পছন্দের পেশা বেছে নেবার, দুটি স্তন একটি যোনি থাকার জন্য তুমি যখন তখন চাইলেই যেখানে খুশি চলে যেতে পারবে না। তোমাকে নিয়ম মেনে চলতে হবে। একথা দেশে থাকতে সফিসটিকেশনের মোড়কে ঢাকা অবস্থায় শুনেছি, এখানেও শুনে নিলাম চাঁচাছোলা ভাষায়। মূল বক্তব্যে প্রভেদ নেই। প্রভেদ আছে শুধু আমার ভৌগলিক অবস্থানে। আপাতত মাথার ওপরের ছাদ কেউ কেড়ে নিতে পারবে না এখানে। মনটা তেতো হয়ে গেলেও এটুকু জানি আমি জলে পড়ে যাব না। ক্যারাকটারটা একদম খারাপ হয়ে যাবে সেটা বোঝা গেছে। এরা বলল, যেসব মেয়েরা অ্যাকটিং করে তাদের কত রকমের সীন করতে হয় পুরুষদের সঙ্গে, এর পর থেকে কোনও ইন্ডিয়ান কি আর আমার সঙ্গে মিশতে চাইবে? কত ভালো ভালো সাবজেক্ট নিতে পারতাম, ডাক্তারি, জার্নালিজম, মেয়েরা তো এসব পড়ছে এখানে, এসব পড়েও অনেক টাকা রোজগার করা যায়, আফগানিস্তান থেকে জাপানি কাপড় কিনে স্মাগল করে এনে চোরবাজারে বেচে দেওয়াও অনেক সম্মানের কাজ নাটকের মেয়ে হবার চেয়ে, লোকে রেসপেক্ট করে, ভালো পাত্রের সঙ্গে বিয়ে হয়। একটু সন্দেহ ঢুকল মনে, এরা আমার বিয়ে নিয়ে এত চিন্তিত কেন? আমায় পোটেনশিয়াল পাত্রী ভেবে রেখেছে নাকি নিজেদের জন্য? খুবই সম্ভব, এই তো প্রেমে পড়ার বয়স।
ফিল্ম ফেস্টিভালের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের শেষে দ্রুঝবি নারোদভের অডিটোরিয়ামের বাইরে বেরিয়ে আসা সহজ ছিল না। সারা দুনিয়ার সিনেমা জগতের সেলিব্রিটিদের দেখতে উপচে পড়েছে জনতা। তাদের ঠেকিয়ে রাখতে পারছে না মিলিৎসিয়া, ফাঁক পেলেই হুড়মুড় করে ঢুকে যাচ্ছে বেড়া ভেঙে। আমাকে শাড়ি পরা দেখে সেলিব্রিটি বলে ভুল করে ঘিরে ফেলে। যত তাদের বোঝাই যে আমি সাধারন একজন ছাত্রী, তারা মানবেই না। ভারতীয় মেইনস্ট্রিম সিনেমা এমন ঘোর লাগিয়েছে এদের চোখে, যে ঝলমলে সিল্কের শাড়িতে আমাকে দেখে তাদের রজ্জুতে সর্পভ্রম অবস্থা। রীতিমত দরাদরি শুরু করে দেয়, অটোগ্রাফ না দিলে ছাড়বে না। সই করতে করতে ভিড় ঠেলে বেরোচ্ছি, দেখতে পাচ্ছি বিশেষ সতর্কতা নিয়ে গার্ড করে টপ সেলিব্রিটিদের তোলা হচ্ছে গাড়িতে, সাঁই সাঁই করে বেরিয়ে যাচ্ছে গাড়িগুলো, জনতা হুড়মুড়িয়ে ছুটে যেতে থাকে সেদিকে। মুহূর্তের মধ্যে ফাঁকা হয়ে যায় প্রাসাদের চত্বর। আমরা যারা অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলাম ছোট ছোট গ্রুপ করে ফিরতে থাকি হস্টেলের দিকে। কিছু ফটো তোলা হয় প্রাসাদের পটভূমিকায়। দুনিয়ার নানান দেশ থেকে এসেছে কত ডিরেক্টর ফিল্মস্টার তাদের সিনেমা নিয়ে। সেই সিনেমাগুলো কি এখন তাশকেন্তের সিনেমাহলগুলোয় দেখানো হবে? কোন ভাষায় দেখানো হবে বইগুলো? এখানে তো রাশিয়ান ডাবিং ছাড়া কোনও বিদেশি বই দেখানো হয় না। ইন্ডিয়া থেকে কারা কারা এসেছে ঐ সেলিব্রিটিদের মধ্যে? রেখা, শ্রীদেবী এরা যদি এসে থাকে? এদের কারওকে সামনা সামনি দেখতে পাওয়া যাবে না? কারা এসেছে? কোথায় নিয়ে গেল ওদের? সেই অ্যক্ট্রেসটার নাম যেন কী, আহা সেই যে অমর আকবর অ্যান্টনি তে ছিল যে মেয়েটা, সেই যে— অভি অভি ইসি জাগা মে এক লেড়কি দেখি হ্যায়, আহা দেখি হ্যায়, আহা দেখি হ্যায়… ইশ্ পেটে আসছে মুখে আসছে না নামটা। সে এলে দারুণ হবে।
পরের দিন রবিবার। দশটা এগারোটার আগে কেউ ব্রেকফাস্ট করে না। এমনি রবিবারে এগারোটার মধ্যেই গডউইন এসে পড়েছে আমার হস্টেলে। কী ব্যাপার, নাটকের মেয়ের সঙ্গে যোযাযোগ রাখার মত গর্হিত কাজ করতে ওর একটুও দ্বিধা হল না? সকলে মিলে যখন লেকচার দিচ্ছিল তখন তো সবই শুনছিল, নিজেও গুরুত্বপূর্ণ মতামত দিয়েছে, এত তাড়াতাড়ি পাল্টি খেল ছেলেটা! গডউইনের মুখে সলজ্জ হাসি। এরা তো শনিবারের রাতে ঘুমোয়ই না বলে জানি, সারারাত মদ খায় হৈ হুল্লোড় করে। সেই ছেলে এত সকাল সকাল এত দূর থেকে এখানে এসেছে কেন, মতলব টা কী ওর? এই প্রশ্নটাই ওকে সোজাসুজি করে বসি। কান এঁটো করে হেসে ফেলে সে। একেবারে ধরা পড়ে যাবার হাসি। মতলব একটা আছেই, সেটা হচ্ছে আমায় হোটেল উজবেকিস্তানে নিয়ে যাওয়া, সেখানে টপ ক্লাস সেলিব্রিটিরা এসেছে, কাপুররা তো আছেই, আরো অনেক সেলিব্রিটি রয়েছে, কোলকাতা থেকে এক বেংগলি ম্যান ও এসেছে, সে অ্যাক্টর না অন্য কিছু সেটা গডউইন জানে না, গতকাল হোটেলে গেছল মদ গিলতে, মিলিৎসিয়া গেটের কাছে ঘেঁষতে দেয় নি। হাই সিকিউরিটি জোন এখন হোটেল উজবেকিস্তান। এখন আমি যদি ওর সঙ্গে যাই, তাহলে হয়ত ইন্ডিয়ান গার্লকে দেখে গার্ড বা মিলিৎসিয়ার মন নরম হতে পারে, অবশ্যই শাড়ি পরে যেতে হবে, শাড়ি না পরলে পাবলিক বুঝবে কেমন করে যে আমি জেনুইন ইন্ডিয়ান গার্ল কি না। ওরা যাবে ওখানে বিদেশিদের কাছ থেকে ব্ল্যাকে ডলার কিনতে, ওদেরকে হোটেলের ভেতরে ঢুকিয়ে দেবার দায়িত্ব নিতে আমাকে বারবার রিকোয়েস্ট করল গডউইন মাথা নীচু করে। ওরা মানে? ও একা আসেনি! উঁহু, নীচে অপেক্ষা করছে আরও দুজন, ডলারের আশায় আশায় এই অবধি এসেছে। কিন্তু আমার এতে কী লাভ? আমার তো ব্ল্যাকে ডলার কেনার সঙ্গতি নেই, আমার নিজের কী উপকারটা হবে? প্রশ্নের উত্তর ওর ঠোঁটের গোড়াতেই রেডি ছিল — হোটেলের ভেতর ঘুরে বেড়াচ্ছে কত শত ফিল্ম স্টার, যাকে পছন্দ তার সঙ্গেই আলাপ করতে পারবে। এমন করে বলল গডউইন, এ যেন স্বয়ম্বর সভা, হোটেলে ঢুকে যাকে পছন্দ তার গলায় মালাটা পরিয়ে দিতে পারলেই কেল্লা ফতে। খদ্দরের একটা সাদা শাড়ি পরে চললাম ওদের সঙ্গে। হোটেলের কাছাকাছি আসতেই দেখি মিলিৎসিয়া এবং গার্ড ঘুরে বেড়াচ্ছে। একটা লোকের মুখ দেখে কেমন চেনা চেনা লাগছিল, ওরা কানে কানে আমাকে সাবধান করে দেয়, লোকটা কেজিবির এজেন্ট। দরজার কাছটায় ঝাঁকে ঝাঁকে রূপসী মেয়ে সেজেগুজে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদের ভেতরে ঢুকবার পার্মিশান নেই। গলায় আইডেন্টিটি কার্ড ঝোলানো না থাকলে অ্যাডমিশন প্রোহিবিটেড।
গডউইনরা ফিসফিসিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে ভেন্ট্রিলোকুইস্টদের মত করে আমার কানের পাশে বলে যায়, “কিসি তরফ মাৎ দেখনা, সিধা চলা যাও, ইয়ে সারে প্রসটিটিউটসকো ইগনোর করকে সিধা গেট কে সামনে চলো স্মার্টলি”। আমি ওদের নির্দেশ মেনে সোজা গেটের কাছে গিয়ে গার্ডকে উপেক্ষা করে গটগটিয়ে ভেতরে ঢুকে যাই, গডউইনকে গেটে আটকে দিলে পেছন ফিরে গার্ডকে হাতের ইশারা করে ইংরিজিতে বলে দিই যে ও আমার সঙ্গে আছে। বাকি দুজনকে কিছুতেই ঢুকতে দেয় না গার্ড। এই প্রথম ঢুকলাম হোটেলটার ভেতরে। উচ্ছ্বাসে আত্মহারা গডউইন আমার পাশে পাশে হাঁটতে হাঁটতে বলে, “সাড়ি ইজ ইয়োর পাসপোর্ট অ্যান্ড ইউ আর মাই পাসপোর্ট”। অল্প সোজা গেলেই নাক বরাবর ডাইনিং হল। গডউইন সব চেনে। হলের ভেতর অতিথিরা লাঞ্চ করতে বসেছে, কিন্তু হলের দরজায় আবার আটকে দেয় গেটকীপার, ভেবেছে আমরা খেতে ঢুকছি বুঝি। আমাদের গলায় তো কার্ড ঝুলছে না। খোলা দরজার বাইরে থেকে উঁকি ঝুকি মেরে গডউইন একজনকে দেখতে পায়, গেটকীপারকে বলে, “ঐ তো ওঁকে খুঁজছি আমরা”। বেশি দূরে নয়, কয়েকটা টেবিল পরেই দেখতে পাই দুজন বসে খাচ্ছে। একজন যুবক, তার মুখোমুখি আর একজন আমাদের দিকে পেছন ফিরে বসা, তার টাক দেখা যাচ্ছে। গডউইন আমাকে বলে, “ক্যান ইউ রেকগনাইজ দেম? দে আর বেংগলিজ”। ঐ যে টাক মাথা লোকটা বসে খাচ্ছে সম্ভবত তার সঙ্গে কথা বললেই কাজ হবে, তাকেই ও কাল দেখেছে। ওরকমভাবে ওদের দেখে হাতটাত নেড়ে কথা বলছি দেখে সেই যুবক খাওয়া ছেড়ে উঠে এল দরজার কাছে, আমাকে দেখে পরিস্কার বাংলায় বলল, “আপনারা কি কাউকে খুঁজছেন”? গডউইন বাংলা বোঝে না, আমার দিকে তাকিয়ে ইশারা করল আবার। যুবকটিকে আগে কখনও দেখিনি, সে সপ্রতিভভাবে বলল, “আমাকে কী করতে হবে, অটোগ্রাফ চাই নাকি”? বললাম, “না অটোগ্রাফ না, ঐ ওঁকে একবার ডেকে দেবেন”? ভদ্রলোকটি এর মধ্যে এদিকে ফিরে তাকিয়েছেন, হাত তুলে ডাকলেন ওঁর টেবিলে। দেখলাম খাওয়া প্রায় শেষই হয়ে গেছে ওঁদের। গডউইন ধরা গলায় বলল, “স্যার উই আর ইন্ডিয়ান স্টুডেন্টস হিয়ার, আই অ্যাম গডউইন অ্যান্ড শী ইজ…”। যুবক সেখানে দাঁড়ালো না, ঘরে যাচ্ছে বলে চলে গেল সেখান থেকে। গডউইন আবার ভেন্ট্রিলোকুইস্টদের মত করে ধমকালো আমাকে, “অটোগ্রাফ লে নে মে কেয়া হর্জ থা”! টাক মাথা ভদ্রলোক জানালেন, তিনি বাংলা সিনেমার ডিরেক্টর, ঐ যুবকটি ওঁর লেটেস্ট বইয়ের নবাগত নায়ক, বইটা দেশে প্রাইজ পেয়েছে, এখন ফেস্টিভালে ওটা নিয়ে এসেছেন ওঁরা দুজন। নিজের পরিচয়ও দিলেন, গডউইন বাংলা সিনেমার জগতে সত্যজিৎ রায় ছাড়া আর কারও নাম জানে না, কিন্তু আমি তো এঁর বানানো একটা বই বিদেশযাত্রার আগেই দেখে ফেলেছি। ইনি আর্ট ফিল্ম বানান। লেটেস্ট বইটার নাম “কুঠার”, জানালেন নির্দেশক তারাচাঁদ চক্রবর্তী। খাবার টেবিলেই আলাপ এগোতে লাগল আমাদের। “বাঃ বাঃ কী পড়ো তোমরা? গডউইন ডাক্তারি পড়ছ? বাঃ, কোন ইয়ার? আর তুমি কী পড়তে এসেছ? বাঃ খুব ভাল। নাটক নিয়ে পড়বে এতো বেশ আনন্দের কথা”।
আমি উৎসাহ পাই। বলি, “জানেন আপনার সেই সিনেমাটা দেখেছি যেটায় অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় অভিনয় করেছিলেন, ওঁকে আমি মনে মনে গুরু মানতাম, কিন্তু উনি তো মারা গেলেন, তবু আমি অভিনয় শিখব বলে জেদ করে এখানে এসেছি, …”। উনি মন দিয়ে আমার কথা শোনেন, তারপর গডউইনের সঙ্গেও কথা বলেন, গডউইন ডলারের প্রসঙ্গটা কীভাবে তুলবে বুঝতে পারছে না, ইনি কতটা পয়সা ওয়ালা লোক, কত ডলার ভাঙাবেন, আদৌ ভাঙাবেন কি না কিছুই আঁচ করা যাচ্ছে না। আলোচনা এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য গডউইন জানতে চায় আরও ইন্ডিয়ান আছেন কিনা যাদের সঙ্গে উনি আলাপ করিয়ে দিতে পারেন। খুব বিনয়ের সঙ্গে কথা বলে গডউইন। রিস্ট ওয়াচটা দেখে নিয়ে তারাচাঁদবাবু তৎক্ষণাৎ উঠে পড়েন, বলেন, “চলো লবিতে দেখা হয়ে যেতে পারে, জয়া শুড বি দেয়ার বাই নাও”। উনি লবির দিকে এগিয়ে যান আমরা পিছুপিছু ফলো করতে থাকি, গডউইন বলে, “ও মাই গড, জয়াপ্রদা ইজ মাই টপ ফেভারিট, রিমেমবার দ্যাট শরাবিওয়ালা সং? মুঝে নওলখা মাংওয়া দে রে ও সঁইয়া দিওয়ানে, হোয়াট অ্যা ফিল্ম ইয়ার! আই হ্যাভ সীন ইট থ্রি টাইমস”।
লবিতে খুব কম লোক, একজন কি দুজন। রিসেপশান ডেস্কের সামনে দাঁড়িয়ে শাড়িপরা এক ভদ্রমহিলা ডেস্ক ক্লার্কদের কিছু বলছিলেন। তারাচাঁদবাবু আমাদের নিয়ে বসলেন সোফায়। দূরে করিডোর দিয়ে পাঞ্জাবি কুর্তা পরা একজন রোগামতন লোক হেঁটে আসছে মনে হল। রিসেপশানে কথা শেষ করে শাড়িপরা ভদ্রমহিলাটি এদিকে ঘুরতেই তারাচাঁদবাবু চেঁচিয়ে ডাকলেন, “জয়া! এই দেখ একজন বাঙালি মেয়ে এসেছে দেখা করতে”। কাকে ছেড়ে কাকে দেখব? তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়েছি। নিজের চোখকে বিশ্বাস হচ্ছে না, ইনি তো নওলখাওয়ালা জয়া নন, ইনি তো জয়া ভাদুড়ি! সেই রোগা লোকটিও ততক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছেন একদম আমার সামনে। তারাচাঁদবাবু আমাদের পরিচয় দিচ্ছেন এঁদের সঙ্গে, আমি ঢোঁক গিলে সেই রোগা লম্বা লোকটিকে বলে ফেললাম, “এক্সকিউজ মী— ইয়োর অটোগ্রাফ প্লিজ…”। কিন্তু হাতের কাছে কাগজ কলম কিছু নেই, এক লাফে রিসেপশন থেকে এক টুকরো কাগজ চেয়ে নিলাম, কলম ওঁর নিজের কাছেই ছিল। রিসেপশানের ডেস্কের পাশে দাঁড়িয়ে খশখশ করে সেই কাগজে সই করে দিলেন অমিতাভ বচ্চন।
চলবে…
পরিচ্ছেদ ৬ অনেক রাতে ফিরেছিল কল্যাণ ওরফে শহীদুল।গাড়িটা শেডে রাখার পর দু’বার হালকা করে মা…..
পরিচ্ছেদ ৫ আকাশে এখন আর মেঘ নেই। হাওয়া হচ্ছে।কদিন পরেই বর্ষা নামবে।একদিন হাসপাতাল থেকে ফিরতে…..
পরিচ্ছেদ ৪ ভোর হয়ে আসছে।রাতে ভালো ঘুম হয়নি।ঘুমের ঘোরে মনে হচ্ছিল দম বন্ধ হয়ে আসছে।এরকম…..
বাংলার চিত্তাকর্ষক ইতিহাস সম্পর্কে জানার সময়, গৌরের মতো আর কিছু গন্তব্য হতে পারে না।…..