ইমন কল্যাণ
পরিচ্ছেদ ৬ অনেক রাতে ফিরেছিল কল্যাণ ওরফে শহীদুল।গাড়িটা শেডে রাখার পর দু’বার হালকা করে মা…..
জয়া বচ্চন ও তারাচাঁদবাবু নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলেন দেখে আমি এগিয়ে গেছলাম আমতা আমতা করে অটোগ্রাফ চাইতে কিন্তু সুযোগ পেলাম না, উনি বললেন যে ওঁর বাচ্চারা ওপরে ঘরে একা রয়েছে, তড়িঘড়ি সেই করিডোরের দিকে মিলিয়ে গেলেন। কিছুটা সময় চারজনে সেই মাঝারি লাউঞ্জে প্রায় চুপচাপ বসেছিলাম। ভারতীয় সিনেমার এক নম্বর তারকা অহংকারহীনভাবে সাধারণ কথাবার্তা বলছিলেন তারাচাঁদবাবুর সঙ্গে। পাশে গডউইন ও আমি হাঁ করে সেসব দেখছিলাম। ডলার ফলার সব মাথা থেকে উড়ে গেছে। আর কিছুক্ষণ পরেই ওঁদের কীসব মিটিং প্রোগ্রাম এসব শুরু হবে, হাতে ভাঁজ করা অটোগ্রাফের কাগজটা নিয়ে চলে যাচ্ছি তারাচাঁদবাবু পেছন থেকে ডেকে আমায় পরদিন সকালে ওখানে ফের যেতে বললেন। বললেন নিয়ে যাবেন ফিল্মের বাজারে, সেখানে ফিল্ম বিক্রি হয়, আমার ভাষাজ্ঞান ওঁর কাজে লাগতে পারে ফিল্ম বেচবার জন্য। পরদিন সোমবার, ক্লাস কামাই করিনি কোনওদিন এর আগে, তা সত্ত্বেও রাজি হয়ে গেলাম। ফিরবার পথে গডউইন ইয়ার্কি মারছিল, তারাচাঁদবাবুর পরের সিনেমার নায়িকা বানিয়ে ফেলতে পারেন আমাকে। আর্ট ফিল্মের জন্য তো আর নাচ টাচ জানতে হয় না, সুন্দরী হবারও বাধ্য বাধকতা নেই।
সে বড় ধীর স্থির সময় ছিল। এক দেশ থেকে অন্য দেশে চিঠি পৌঁছতে মেরেকেটে পনের দিন তো লাগতই, রেডিওর নিউজও কান পেতে শুনতাম আমরা, টেলিভিশনে বিদেশের চ্যানেল পাওয়া যেত না, খবরের কাগজ থকে বাসি খবর জেনে নিতে হতো যদি তা আদৌ ছাপা হয়ে থাকে। তবু চেরনোবিলের ভয়ঙ্কর ঘটনা আমরা জানতে পারিনি সেভাবে। বিদেশের ঘটনা নয়, তবু প্রায় সমস্ত ঘটনাই চেপে দেওয়া হল জনসাধারণের কাছে। যেটুকু না বললেই নয় সেই ধাঁচে জানানো হয়েছিল নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টের দুর্ঘটনার খবর, হতাহত কতজন, কী পরিমান তেজষ্ক্রিয় দূষণ ছড়িয়ে গেল পরিবেশে, আরও কত বছর ধরে এর মূল্য দিয়ে যাবে পরিবেশ, কিছুই জানানো হল না দেশের জনগনকে। দিন কয়েক পরে সবাই ভুলে গেলাম সে খবর, চেরনোবিল তো কত দূরে সেই ইয়োরোপে উক্রাইনায়, মধ্য এশিয়ার মানুষ এসব নিয়ে মাথা ঘামায় নি, মধ্য এশিয়ার মানুষেরা সিনেমার নেশায় মাতাল হয়ে উঠেছিল বসন্তের ফিল্ম ফেস্টিভালে। আর তো কিছু পাল্টায় না জীবনে, সেই একই খবর ঘুরে ফিরে শুনতে হয় রেডিও টিভিতে, সেই একই ভাবে উৎসব ও ছুটির দিনের উদযাপন, একই লাইন দোকানে, সব যেন থেমে রয়েছে, পাল্টায় কেবল সিনেমাগুলো। সিনেমাগুলো নিয়ে যায় অন্য দুনিয়ায়, সফর করিয়ে আনে স্বপ্নের দেশে মাত্র আড়াই থেকে তিন ঘন্টার মধ্যে, এক রুবল চল্লিশ পয়সার বিনিময়ে। রাজ কাপুর কি কম অক্সিজেন জুগিয়েছেন এই মানুষগুলোর জীবনে? সেবারই ওঁর শেষ সফর ছিল এই ফেস্টিভালে। হয়ত কোনও ফিল্মের শুরুতে এক মিনিটের জন্য তিনি দেখা দিতে পারেন সিনেমা হলে, এই আশায় আশায় ভিড় করে অপেক্ষা করে উজবেকরা, বুড়ো বাচ্চা যুবক যুবতী সবাই হিন্দি সিনেমার ফ্যান। অ্যাডভান্স বুকিং করে টিকিট কাটা যায় না, তাই প্রতিটি শোয়ের আগে ধৈর্য ধরে লাইনে দাঁড়ায় তারা। লাইনে দাঁড়ানোতো নতুন কিছু নয়, প্রতিদিনই তো কিছু না কিছুর জন্যে লাইনে দাঁড়াচ্ছে। ইন্ডিয়ান সিনেমা অধিকাংশই মিলনান্তক। গল্পের শেষে প্রেমেরই জয় হবে, সবাই নিরবচ্ছিন্ন সুখের জগতে শান্তিতে বসবাস করতে চলে যাবে। দর্শক জানে এসব কথা। আবার সাচ্চা প্রেমের জন্য কেউ ত্যাগ স্বীকার করলে হাপুস নয়নে কেঁদে তারা রুমাল ভেজায়। কাঁদতে লজ্জা পায় না। আগে কতবার দেখেছি হল থেকে বেরিয়ে গিয়েও এরা বিজাতীয় ভাষায় গেয়ে ওঠে, দোস্ত দোস্ত না রহা…। সব শব্দের মানেও বোঝে না। গানের তো ডাবিং হয় না! তবু ওরা গায়।
অডিও পডকাস্ট শুনুন এইখানে-
ফিল্ম বাজার কাকে বলে তা জানলাম সেদিন। “দোম কিনো” বলে একটা সিনেমা হল এবং তৎসংলগ্ন ফিল্ম সংক্রান্ত অফিসে আমিই ট্যাক্সি করে নিয়ে গেছি তারাচাঁদবাবুকে। শত হলেও ইনি আমাদের অতিথি, স্টুডেন্ট হতে পারি, কিন্তু এমন একটা অনুভূতি হচ্ছে যেন তিনি আমার দেশে বেড়াতে এসেছেন, উজবেকিস্তান তো আমার দেশ নয়, কেন এমন মনে হল তবু!
ফিল্মের বাজার চলছে দুটো কি তিনটে ঘরে, তার মধ্যে একটা ঘরে লোক বেশি। ছোট স্ক্রিনে এক একটা ফিল্মের ছোট ছোট অংশ দেখানো হচ্ছে, হিন্দি এবং বাংলা। যারা পছন্দ করবে বলে বসে আছে তারা এই দুটো ভাষার একটাও বোঝে না, সীন দেখে আগ্রহী হলে বলে —অনুবাদ করে দাও, কী গল্প এই সিনেমার? আমি যতটা পারি রাশিয়ানে বলে দিই। কুঠার তাদের পছন্দ হয় নি। কুঠারে নাচ গান নেই, ফাইট নেই, তারা মন্তব্য করে নিজেদের মধ্যে, সে মন্তব্য বাংলায় অনুবাদ করে দিই নি আমি তারাচাঁদবাবুকে। আরও অনেকগুলো ফিল্ম রয়েছে সেগুলো বিক্রির ব্যাপারেও তারাচাঁদবাবুর ভূমিকা বা দায়িত্ব রয়েছে দেখলাম। ফিল্মগুলো রিজেক্টেড হতে দেখে তারাচাঁদবাবুরা ইংরিজিতে অনুবাদ করা শুরু করেছিলেন, হয়ত আমার রাশিয়ান অনুবাদকে সাবস্ট্যান্ডার্ড ভেবে থাকতে পারেন, বিক্রি করাটা আসল উদ্দেশ্য, ওঁরা মরিয়া হয়ে উঠছিলেন। পাশের ঘরে কিছু অন্য ভাষার ফিল্ম টপাটপ বিক্রি হয়ে গেছল। যে ছবিগুলো ওঁদের পছন্দ হচ্ছিলো সমস্তই খুব কালারফুল, নাচে গানে সুন্দর লোকেশানে সমৃদ্ধ। কীভাবে যে সময় কেটে যাচ্ছিল তা বোঝা যায় নি। সেদিন লাঞ্চ হয় নি। আমি এমনিতেই তখন দেশে যাবার টিকিটের জন্যে পয়সা বাঁচিয়ে দিনে একবার খেতাম, সাত আট মাসে চোদ্দ কিলো ওজন কমে গেছল। তারাচাঁদবাবুর মন মেজাজ খুব একটা ভাল ছিল না, একটা ব্রেক নিয়ে দোম কিনোর পাঁচতলার ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম আমরা। উনি সিগারেট খাচ্ছিলেন, হাতের কব্জিতে অনেক পাথর টাথর বসানো রিস্ট ওয়াচ। এই রিস্টওয়াচ নবাগত নায়কের বাবা উপহার দিয়েছে ওঁকে, অনেক দাম সেই ঘড়ির, তিরিশ নাকি চল্লিশ হাজার টাকা। কি মনে হয়ে হয়েছিল, বলেছিলাম, এত দুর্ভিক্ষ সমাজ চেতনা গরীব দুঃখীদের নিয়ে সিনেমা বানান এদিকে চল্লিশ হাজারের রিস্ট ওয়াচ পরেন। উনি করুন চোখে তাকিয়ে রইলেন, না পরলে নায়ক দুঃখ পাবে, নইলে সস্তার ঘড়িই তো পরি বিশ্বাস করো। আমি ঘড়িটা দেখতে চাইলাম, উনি খুলে দিলেন। ঘড়িটা হাতে নিয়ে বললাম, এবার এটা নীচে ফেলে দিই? নীচে ঐ যে ফোয়ারাটা রয়েছে সেটার ওপর তাক করে ছুঁড়ছি। উনি কাতর হয়ে বললেন, তবে সময় দেখব কীকরে, আমার তো আর ঘড়ি নেই। আমিও যুক্তিবাদী, বললাম, ঐ দেখুন রাস্তার ওপারে গাছের সারি, তার পেছনে একটা দোকান আছে, ওখান থেকে সবচেয়ে সস্তার ঘড়ি কিনে দেব আপনাকে, খুব সস্তা, কিন্তু সময় দেখাবে, ফেলে দিই এটা এখন? তারাচাঁদবাবু চুপ করে গেছলেন, একটু পরে বললেন, ঘড়িটা দাও, ঐ দোকানে কী পাওয়া যায়, চলো দেখি।
ফিল্ম বাজার আরও চলেছিল, আমরা পাঁচটা সাড়ে পাঁচটা অবধি ছিলাম। রাস্তার ওপারের সেই দোকানটায় গেছলাম তারপর। সেখানে ঘড়ি দেখা হয় নি, তারাচাঁদবাবুর চোখ চলে গেছল টপ শেলফে রাখা মুভি ক্যামেরাগুলোর দিকে। দাম ছশো থেকে হাজার রুবলের রেঞ্জে। উনি হিসেব করছিলেন ডলারে কত পড়বে। বিক্রেতাকে অনুরোধ করে ক্যামেরাগুলোর পুস্তিকা হাতে নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখছিলেন তিনি। সমস্ত রাশিয়ানে লেখা হলেও স্পেসিফিকেশনগুলো সংখ্যাতেই লেখা থাকে। কিনতে চাইছিলেন একটা মুভি ক্যামেরা। হয়ত যথেষ্ট ডলার ছিল না সঙ্গে, বলেওছিলাম যদি ব্ল্যাকে ভাঙাতে চান ব্যবস্থা করে দিতে পারি, সরকারি রেটের বিশ গুণ বেশি পাবেন, কিন্তু দিল্লিতে পারবেন কি কাস্টমসের গ্রিন চ্যানেল দিয়ে বের করতে? উনি বলেছিলেন সেসব হয়ে যাবে, এত সব স্টারেরা ফিরবে ওদের সঙ্গে বেরিয়ে গেলেই হবে, ওদের কেউ চেক করে না। শেষে ফিরিয়ে দিলেন বুকলেটগুলো হয়ত যথেষ্ট টাকা পয়সা ছিল না সঙ্গে, কিংবা মনস্থির করে উঠতে পারেন নি। ওঁকে হোটেলে পৌঁছে দেবার সময় ঐ হোটেলেরই কাছে একটা কাফেটেরিয়ায় কফি ও সসেজ খেয়েছিলাম আমরা। আমার সঙ্গে ছিল কিছু জিনিস কলকাতায় আমার বাড়িতে পৌঁছে দেবার জন্য, একটা রেলগাড়ির নিখুঁত মডেল ও এক টুকরো ড্রেস মেটিরিয়াল। উনি নিজেই বলেছিলেন প্রথম দিন, যদি চিঠি পৌঁছে দিতে হয় বাড়িতে কি ছোটখাট কিছু গিফট, সেইজন্যই এনেছিলাম সেগুলো। কাগজে লিখে এনেছিলাম বাড়ির ঠিকানা। আমরা তখন উত্তর কলকাতার হালসিবাগানে থাকতাম। হোটেলে ঢুকবার মুখে গডউইনের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। গডউইন কে ডেকে নিয়ে তিনজনে গেলাম ওপরে ওঁর রুমে। জিনিসগুলো দিয়ে একটু বসেছিলাম আমরা। উনি আর দুদিন পরেই ফিরে যাচ্ছেন। উনি আমার পাশে বসেছিলেন খুবই ঘেঁষে, সেটা আমি লক্ষ্য করিনি কিন্তু মুখোমুখি বসে গডউইন লক্ষ্য করছিল। উনি হাত বাড়িয়ে আমার কাঁধের ওপর হাত রেখে ক্যাজুয়াল কথা বলছিলেন, আমার অস্বস্তি লেগেছিল, কিন্তু ভেবেছিলাম হয়ত এ আমার মনের ভুল। গডউইন উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিল, ওকে স্যার, উই শুড লীভ নাও, আপকো তো রেস্ট লেনা হ্যায়। তারাচাঁদবাবু বিড়বিড়িয়ে কী বলছিলেন সব আমার কানে যায় নি। একটা কথা কানে ঢুকেছিল, এই ছেলেটাকি তোমার বয়ফ্রেন্ড? না তো, ও আমার বয়ফ্রেন্ড কেন হবে! উনি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছিলেন আমরা যখন বেরিয়ে যাচ্ছিলাম। বাইরে বেরিয়ে গডউইন বলেছিল, আই হ্যাভ আন্ডারস্টুড ইয়োর সিচুয়েশন, মহোল দেখকে চলনা। আমার মনে তখনও সংশয় ছিল, সারাটা দিন যার সঙ্গে ঘুরলাম এত জায়গায়, কত গল্প করছিলেন নিজের জীবনের, বৌ প্রেম দুই পুত্র সাফল্য ব্যর্থতা সিনেমার জগতের কথা, এমনকি আমাকে সরাসরি অফারও দিয়েছেন ওঁর ফিল্মে অভিনয়ের, আমিই বরং প্রত্যাখান করেছি, বলেছি আগে তো বিষয়টা শিখব তারপরে তো কাজ করব। উনি বলছিলেন কলেজে ইন্সটিটিউটে কতটা শেখাবে শিখতে হয় হাতে কলমে, তারপর অন্যমনস্ক হয়ে নিজের কথা তুলেছিলেন, দেখ না আমিই তো এ জিনিস পড়ব বলে ইউনিভার্সিটিতে ঢুকেছিলাম, সেখানে পড়া হল না, লাভের মধ্যে কেবল বিয়েটা হল। প্রায় আমার বাপের বয়সী একটা লোক, ওঁর ছেলে তো আমার বয়সী, আরেক ছেলে অসুস্থ তা ও বলেছিলেন, তিনি কি সত্যিই আমার গা ঘেঁষে বসে কাঁধে হাত দিয়ে আবোলতাবোল বকে যেতে পারেন? আমার কান্না পেতে থাকে। বলি, গডউইন বড্ড টায়ার্ড লাগছে, তুই আমাকে একটু পৌঁছে দে না আমার হস্টেলে।
জুনের গোড়াতেই আমাদের সব পরীক্ষা শেষ হয়ে গেল। পাশের খবরও সঙ্গে সঙ্গেই পেয়ে যাচ্ছিলাম। এদেশে তিন রকমের নম্বর হয়। টায়েটুয়ে পাশ করলে তাকে বলে তিন, ভাল করলে চার, খুব ভাল করলে পাঁচ। এছাড়া ফেল করলে তাকে কোনও নম্বর দেওয়া হয় না, কিন্তু দুই বলতে ফেল বোঝায়। একটা জিনিস বুঝে গেছলাম ফার্স্ট সেকেন্ড থার্ড টার্ড আর নেই। এ জিনিস হজম করতে প্রথম দিকে অসুবিধে হয়েছিল, অসুবিধে তো নরম করে বলছি, রীতিমতো কষ্ট হয়েছিল, অ্যাডিকশান কাটানোর মত কষ্ট। ছোটবেলায় দূরসম্পর্কের এক কাকা, সতুকাকা আসত আমাদের বাড়ি। সতুকাকার ছিল নেশা, অ্যাডিকশান, রেস খেলত সে নিয়মিত। অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়েও তার নেশা কাটানো যায় নি, শনিবারে তাকে কিছুতেই কলকাতার বাইরে রাখা যেত না, টাকা না থাকলে শনিবারে সে ধার করতে বেরতো আত্মীয় বন্ধুদের কাছে। এদেশে এসে আমারও প্রথম দিকে নিজেকে রেসুড়েদের মতো লেগেছিল, পরীক্ষা মানে শনিবার এগিয়ে আসছে, মাথার ভেতর পাগলা ঘোড়া দড়ি ছিঁড়ে ছুটতে চায়, অথচ আগাগোড়া রেস কোর্সটাই লোপাট হয়ে গিয়েছে। সেই মাধ্যমিকের টাইম থেকে লেলিয়ে দেওয়া হয়েছিল আমাদের ঘোড়দৌড়ের রেসে। ডিভিশন, স্ট্যান্ড করা, লেটার, স্টার, কতগুলো লেটার, কত বেশি নম্বর, অমুকের চাইতে কত নম্বর কম বা বেশি, কীরকম কায়দা করে উত্তর সাজিয়ে লিখলে বেশি নম্বর দেবে পরীক্ষক, ক্রমাগত প্রিটেস্ট টেস্ট ফাইনালের তামাশা। কে কার কান ঘেঁষে আধ ইঞ্চি বেশি নম্বর পেয়ে বেরিয়ে গেল, কে পারল না, যে পারল না তাকে লোক দেখানো হায় হায়, ইশ, আহা উহু, ভেতরে ভেতরে অন্যের কম নম্বরে নিজের শাডেনফ্রয়েডে। এই রেস শেষ হয় না, ফের উচ্চমাধ্যমিক, আরও কড়া রেস, আরও উন্নত জকি চাই, দৌড়ের নেশা রক্তের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে অজান্তে কার্বন মনোক্সাইডের মত, যতক্ষণে না মেরে ফেলছে কেউ টের টি পাবে না, সম্পূর্ণ সিম্পটমহীন নেশা। জয়েন্ট এন্ট্রান্সের প্রথম কয়েকটা পত্র দেবার পর আর পরীক্ষা দিতে ভাল লাগেনি, ছেড়ে চলে এসেছিলাম। কিন্তু জকির চাকরিতে যে ঢুকেছে সে কি অত সহজে পার পায়? বেটিং করছে শুভানুধ্যায়ীরা, তারা তো অত সহজে ছেড়ে দেবার পাত্র নয়। দৌড়ে জিতি বা না জিতি, মাঝ পথে থেমে যাই বা না যাই, স্বতঃসিদ্ধের মত জানতাম দৌড়নোই একমাত্র পথ, নান্য পন্থা বিদ্যতে অয়নায়, নিস্তার লাভের আর নাহি রে উপায়। সোভিয়েত ইউনিয়নে পড়তে এসে সেটাই প্রথম ধাক্কা। মহানগর সিনেমার সেই সীনটা মনে পড়ত, মাধবী অফিস যাবার আগে দাওয়ায় খেতে বসেছেন, ননদের ভূমিকায় জয়া ভাদুড়ি উঠোনের কলঘর থেকে উঁকি মেরে জিগ্যেস করে, বৌদি পালং শাক খেয়েছ? বৌদি বলে, পাশ করে গেছিস। ননদ বলে, শুধু পাশ! আমারও সেরকম অবস্থা, শুধু পাশ! সবার স্টেটাস “পাশ” করা কেন হবে? এত শ্রেণী বিভাজন তোমাদের সমাজে, কৃষক শ্রেণী শ্রমিক শ্রেণী বুদ্ধিজীবি শ্রেণী, অথচ পড়াশোনা থেকেই শ্রেণীটুকু তুলে দিল। কীকরে প্রমাণ করব শ্রেষ্ঠত্ব, কীরকম গোদা সিস্টেম, দৌড়নোর চার্মটাই নেই, উইথড্রয়াল রিয়্যাকশানে কাতরাতে থাকি ভেতরে ভেতরে। ক্রমশ মেনে নিতে হয়, মেনে না নিয়ে উপায় নেই। দৌড়নোটা বাধ্যতামূলক না হওয়াটা যে অভিশাপ নয়, তা বুঝতেও সময় লাগে। প্রাচুর্যের ঘরে ফেলে ছড়িয়ে খাবার মত। তোমার যা খুশি পড়ো, মোটামুটি যোগ্যতা থাকলেই চলবে। সব জানা থাকলে ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে আর শিখবে টা কী? যদি পরে মনে হয় এ বিষয়ে তুমি আগ্রহ পাচ্ছ না, কি বিষয়টা আয়ত্ব করা তোমার পক্ষে মুশকিল, তাহলে ছেড়ে দিলেই হবে। অন্য কিছু শিখো, অন্য প্রোফেশন বেছে নিও। সেই মত চাকরি করবে। চাকরির অভাব নেই দেশে। হ্যাঁ এইটাই কথা, চাকরির অভাব নেই দেশে। সেভাবে বড়ো চাকরি ছোট চাকরি বলে খুব একটা বিভেদ নেই, আবার আছেও। সে প্রসঙ্গ পরে হয়ত আসবে। একজন শিক্ষিকার স্বামী হয়ত কারখানার শ্রমিক, কিংবা একজন সেলসম্যানের বউ বাসের ড্রাইভার। চাকরি নিয়ে যে পরিমান কাস্ট সিস্টেম ইন্ডিয়ায় দেখে এসেছি তাতে এরকম পরিস্থিতিতে ব্যাপারটা বুঝতে অসুবিধে হত। ক্যাশিয়ারের বউ কেন ট্রলিবাস চালাবে? ক্যাশিয়ার তো হোয়াইট কলার জব, মানে তথাকথিত ভদ্রলোকের চাকরি, তার বউ কিনা ট্রলিবাস চালাচ্ছে! কায়িক শ্রমের কাজ, ব্লু কলার জব। ক্যাশিয়ার কোনও অপেক্ষাকৃত ভাল কাজ করা বউ পেল না? এদের আয়ের অঙ্কে সেরকম কোনও তফাৎ ছিল না। ছোটবেলা ট্রামের ড্রাইভার হতে চেয়েছিলাম। হতে পারিনি। ট্রাম কোম্পানীতে মেয়েরা চাকরি করত না, ড্রাইভার কন্ডাক্টর চেকার ডিপোর কর্মচারী কেউ মেয়ে ছিল না, একজনও নয়। সোভিয়েত দেশে দলে দলে মেয়ে বিশাল বিশাল বাস চালাচ্ছে, ট্রাম, ট্রলিবাস সব চালাচ্ছে, দেখে আনন্দ হয়েছিল, সত্যিকারের আনন্দ। বিশ্বাস করেছিলাম এর নামই সমানাধিকার। নতুন জিনিস দেখলে যেমন ঘোর লাগে চোখে, তেমনি ঘোর। সময়ের সঙ্গে চোখ সয়ে আসে, খুঁটিয়ে দেখার চোখ তৈরী হয়, এত সমানাধিকারের মূলে কী তা একটু একটু জানা যায়। তবে শিক্ষা কখনই প্রিভিলেজ ছিল না। নইলে এতগুলো দেশ থেকে গাদা গাদা ছাত্র আনিয়ে বিনামূল্যে পড়ানো, খাইয়ে দাইয়ে রাখতে পারে? কেন করছিল এত সব ওরা? কী লাভ হচ্ছিল এতে? অনেক বছর পরে একটা বাঙালি মেয়ে এই নিয়ে স্মৃতিচারণা করবে বলে নয় নিশ্চয়। এমনও তো নয় যে এই শিক্ষার সুফল ওরা সরাসরি পাবে, বিদেশি ছাত্রগুলো ওদেশেই কাজ কর্ম করে ওদের ফিরিয়ে দেবে এই শিক্ষার খরচ। বিদেশিদের পক্ষে নাগরিকত্ব পাবার কোনও পথ খোলা ছিল না, সোভিয়েত দেশের নাগরিককে বিয়ে থা করলেও নাগরিকত্ব পাওয়া যেত না সহজে। তবে কেন এই বিশাল খয়রাতি? সবই কি বন্ধুত্ব ও শান্তির জন্য? এসব শুনলে রেসের ঘোড়াও দৌড় ভুলে ফিক করে হেসে দেবে।
আমাদের হস্টেলে একজন চৌকিদার কাজ করতেন যিনি প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভেটেরান। পুরুষ নন, মহিলা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় উনি তরুণী। তা ১৯৮৫-৮৬ নাগাদ ওঁর বয়স কম বেশি নব্বই বছর। বন্দুক নিয়ে লড়াই করেন নি, কিন্তু টেলিফোন টেলিগ্রাফের লাইন টাইনে কীসব যেন করতেন, শত্রুপক্ষের খবরাখবর জানার ব্যাপারে। খুব বেশি লেখাপড়া শিখেছেন বলেও মনে হয় না। ১৯১৭য় রুশ সাম্রাজ্যের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর উনি রাশিয়াতেই ছিলেন সেই পূর্ব ইয়োরোপে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ও সম্ভবত টেলিফোনের সেই কাজই করেছিলেন। কবে কখন কীভাবে কেন মধ্য এশিয়ার তাশকেন্তে এসেছিলেন তা জিগ্যেস করা হয় নি। দুরকমের পেনশন পেতেন, যুদ্ধের ভেডেরান হিসেবে এবং অবসরের বয়স হয়ে যাবার জন্য, তা সত্ত্বেও চৌকিদারের চাকরি করতেন। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর আইনত নারীপুরুষের সমানাধিকার স্বীকৃতি পেলেও রাতারাতি মেয়েরা পুরুষের মত কাজ সমানে সমানে কাজ করেনি, অন্তত সর্বস্তরে তো নয়। হ্যাঁ যুদ্ধের জন্য প্রচুর পুরুষের মৃত্যু হয় দেশে। পুরুষের তুলনায় মেয়েরা সংখ্যায় অনেক কম গিয়েছিল যুদ্ধে। ঐ যুদ্ধের কারনেই দেশে পুরুষের সংখ্যা কমে যায়, তারা যে কাজগুলো করত সেসব কাজের দায়িত্ব মেয়েদের দেওয়া হয়। অনেক পুরুষই যুদ্ধে মারা যায়, নারী পুরুষের অনুপাত খুব বেড়ে যায়, তখন মেয়েরা সব কাজই করত, নইলে দেশ চলবে না, সব থেমে যাবে। সেই ভাবেই দ্রুত মেয়েদের গ্রহন করা হয়েছে “পুরুষালি” কাজে, তবুও পার্টির উচ্চপদে মেয়েদের প্রায় দেখাই যেত না। সেই পদগুলোয় ক্ষমতা পাওয়া যায় অনেক, পনেরোটা রিপাবলিকের একটাতেও কোনও মেয়ে সর্বোচ্য ক্ষমতাসীন হয় নি। বরং দশ সন্তানের জননী হলে সেই নারীকে হিরোর সম্মান ও সুযোগ দেবার নিয়ম ছিল। হ্যাঁ, নারীর নিজের শরীরের ওপর অধিকার ১৯১৮ সালেই স্থাপিত হয়েছিল, সন্তানের ওপর অধিকার, গর্ভপাতের অধিকার, বিবাহবিচ্ছেদের অধিকার, বিবাহবহির্ভূত সহবাস, ইত্যাদি। স্তালিনের আমলে এসব আইনের কিছু পরিবর্তন হয়েছিল। এ সবই পুঁথিগত তথ্য, বাস্তবের গল্প আস্তে আস্তে আসবে এই লেখায়। রঙচঙে সোভিয়েত নারী পত্রিকায় সেসব গল্প ছাপার যোগ্য হিসেবে বিবেচ্য হয় নি। সেই সব সোভিয়েত নারীদের সঙ্গে সুখে দুঃখে কাটিয়েছি দশটা বসন্ত, তারা কেউ রাশিয়ান, কেউ উজবেক, কেউ তাতার, আবার কেউ জার্মান।
টাকা পয়সা যেটুকু জমাতে পেরেছিলাম তা দিয়ে টায়ে টুয়ে দেশের যাতায়াতের টিকিট কেটে ফেলা গেল স্টুডেন্টস কনসেশনের ৩০% ছাড়ের জন্য। রুটটাও সংক্ষিপ্ত। তাশকেন্ত-দিল্লি-তাশকেন্ত। এই রুটে ব্যবসা বানিজ্যের কোনওরকম সুযোগ নেই। অর্থাৎ ছুটির পর তাশকেন্তে ফিরে আমায় ফের পুরোপুরি নির্ভর করতে হবে স্টাইপেন্ডের ওপর। কলকাতায় পৌঁছে বাড়িতে কিছু দুঃসংবাদ জানতে পারলাম, সে সব খবর চিঠিতে জানিয়ে আমার বিদেশবাস দুশ্চিন্তায় ভারাক্রান্ত করতে চায় নি নিকটাত্মীয়েরা। নিজেকেও খুবই স্বার্থপরের মত লেগেছিল কিছু করতে পারছি না বলে। অবশ্য করবার মত ক্ষমতা আমার নেই। দুমাসের ছুটি ছিল, একমাসও থাকতে পারিনি কলকাতায়, তাশকেন্তের জন্য মন কাঁদত। সে ও এক ধরণের হোমসিকনেস। চৌরঙ্গীর আয়েরোফ্লোত (Аэрофлот) অফিসে গিয়ে সরকারদাকে দিয়ে টিকিটের তারিখ এক মাস এগিয়ে আনি। দেখা করতে গেছলাম তারাচাঁদবাবুর বাড়ি। উনি সেই রেলগাড়ি ড্রেস মেটিরিয়ালে মুড়ে নিজে হাতে পৌঁছে দিয়ে গেছলেন, একটা ধন্যবাদ দিতে হয়, এবং মনের মধ্যে খচখচ করছিল যে জিনিসটা সেটারও হেস্তনেস্ত হবার দরকার ছিল। আমার বন্ধু রানা তারাচাঁদবাবুর পাড়ার কাছেই থাকত। রানাকে নিয়ে একদিন সকালে পৌঁছে গেছলাম ওঁর বাড়ি। সে এক নাটকীয় সকাল। আগের রাতে ভগ্নীপতিকে দাহ করে শ্মশান থেকে সবে ফিরেছেন তিনি। বৈঠকখানায় বিষন্ন মুখে বসে আছেন, রাত জাগার চিহ্ন ওঁর সারা মুখে। ওঁকে ঘিরে ইতি উতি বেশ কয়েকজন লোক, কেউ অতিথি, কেউ মোসায়েবি করছে, প্রত্যেকেরই আসার উদ্দেশ্য ভিন্ন। রানা ও আমি দরজার কাছটায় দাঁড়িয়েছিলাম। একজন বলছিল যে একটা বাচ্চা জোগাড় করা হয়েছে। তারাচাঁদবাবু জানতে চাচ্ছিলেন বাচ্চাটার সাইজ কতটা, বাচ্চাটা ফর্সা না কালো। লোকটা মাথা নীচু করে দুহাত বাড়িয়ে সাইজ বোঝালে মনে হল নবজাতকের মত, অস্পষ্ট স্বরে সে বলল, তেমন ফর্সা নয় একটু পাউডার মাখালেই—। তুমুল রেগে গেলেন তিনি। ফর্সা বাচ্চা চাই, বললেন, বড়োদেরই পাউডার মাখাচ্ছি না তো বাচ্চাটাকে পাউডার মাখাব নাকি! বোঝা গেল নতুন বইয়ের শুটিং চলছে, কোনও ফর্সা বাচ্চার রোল আছে। আমরা এসব দেখছিলাম, তারপর তিনি আমাদের দেখে ডেকে বসতে বললেন। ঘর ভর্তি একগাদা অচেনা লোকের সামনে আমার প্রশংসা করতে শুরু করে দিলেন, মেজাজ অল্পক্ষণের জন্য একটু ভাল হল, তারপর আবার যেই কে সেই, একজন যুবক কী যেন বলতে গেছল জোর ধমক খেল। আর বসিনি সেখানে। মনের মধ্যে যে সংশয় এবং প্রশ্ন বয়ে বেড়াচ্ছিলাম তার উত্তর সেদিনের কথাবার্তার মধ্যেই পেয়ে গেছি। রানাকে সেজন্যই সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়া। উনি বার বার করে যেতে বলছিলেন অন্য দিন। ওরেব্বাবা, আর কখনও ওমুখো হই!
ছুটিতে বাড়ি ফিরবার খবর শব্দের বেগে ছড়িয়ে গেছল বন্ধুদের মধ্যে। তপন, কল্লোল, পুরুষোত্তম, রানা, সবার প্রথম প্রশ্ন— ভোদকা এনেছিস? আনিস নি! সে কী হতাশা ওদের। তার পরে একের পর এক প্রশ্ন, ব্রেইন ওয়াশ হয় কিনা, রাশিয়ান মেয়েদের দেখতে কতটা সেক্সি, শুনেছি ওরা নাকি খুব ফাস্ট (জানতে চাইছিল চাইলেই শুয়ে পড়া যায় কিনা), টিকিটের দাম কে দিল, চেরনোবিলের দুর্ঘটনার* জন্য বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে কিনা, এত রোগা হলি কীভাবে, মদ খাস, ওখানে খুব মাংস আর রুটি খাস না রে? অনেক প্রশ্নেরই উত্তর জানতাম না, যেমন ব্রেইনওয়াশেরটা। সিনেমায় দেখা হীরক রাজার দেশের সেই মগজ ধোলাইয়ের মেশিন সত্যি হয় কিনা জানতাম না। কমিউনিস্টরা কী পদ্ধতিতে মগজ ধোলাই করে? উত্তর দিতে না পেরে লজ্জা করে। চেরনোবিলের ব্যাপারটাও দেখলাম ওরা অনেক বেশি জানে। ন দশ মাসের বিদেশবাসের মধ্যে রুটি মাংস খেয়েছি কবে মনেই পড়ল না, পোলাও খেয়েছি কয়েকদিন, ওদের বলতে ইচ্ছেই করল না। আরও প্রশ্ন ছিল ওদের মনে, আমি “ফাস্ট” বনে গেছি কিনা। হয়ত ঐ বয়সে এসব প্রশ্ন করাই স্বাভাবিক। দশটা মাস অন্য দেশে কাটিয়ে এসে কেমন যেন মনে হচ্ছিল দেশটা পাল্টে গেছে, বন্ধুগুলো বদলে গেছে, বা হয়ত আমি নিজেই বদলে যাচ্ছি দ্রুত। কিছু পুরোনো অভ্যাস ভুলে গেছলাম, নিজের শরীরটাকে বাঁচিয়ে রাস্তায় চলাফেরা করা। গত দশটা মাসে রাস্তায় বা পাবলিক ট্রান্সপোর্টে কোনও লোক গায়ে হাত দেয় নি ভিড় থাকুক বা না থাকুক, “আওয়াজ” খাওয়া হয় নি কত দিন হয়ে গেছে, সোজা হয়ে হাঁটার অভ্যাস তৈরী হয়ে গেছে, কলকাতায় ফিরে এসে টের পেলাম সেসব ছুটিতে।
দিল্লি থেকে যখন ফ্লাইটে উঠছি তখন রাত অনেক। সাড়ে তিনশো যাত্রীর মধ্যে শুধু একজন নামবে তাশকেন্তে, উজবেকিস্তানের ঘড়িতে তখন বাজবে দেড়টা।
আগেভাগে নামতে হবে বলেই দরজার সামনে বসেছি। আয়েরোফ্লোতের বিমানে কোনও সীট নম্বরের ব্যাপার নেই, যার যেখানে পছন্দ বসবে। কে কোথায় বসে এ নিয়ে মনোমালিন্য বিবাদও হয় না। আমার পাশে দুটো সীট খালি। গেট বন্ধ হবার ঠিক আগে হুড়মুড়িয়ে ঢুকলেন একজন। দেখেই কেমন একটু চেনা চেনা লাগল, মাঝ বয়সী বাঙালী ভদ্রলোকটি তো আমার চেনা। কলকাতায় দেখা হয়েছে বেশ কয়েকবার, উনি একটা সমাজতান্ত্রিক দেশের অনারারি কনসাল। ভদ্রলোকও আমাকে দেখে চিনতে পেরে গেলেন, প্রোফেসর অনিল ধর। আমার পাশেই বসে পড়লেন প্রোফেসর ধর।
— কী ব্যাপার, তুমি চলেছ কোথায়, মস্কো?
— না, অতদূর যাব না, সওয়া তিন ঘন্টার পথ, সামনের স্টপেজেই নেমে যাব।
গোটা দিল্লিতে একজনও চেনা লোকের দেখা মেলেনি, ডিপার্চার গেটের সামনে যত জন অপেক্ষা করছিল, ঘুরে ঘুরে সকলের মুখ দেখেছি যদি চেনা কেউ বেরিয়ে পড়ে, পাশের যাত্রীর সঙ্গে আলাপ আড্ডা দিতে দিতে যেতে না পারলে সাড়ে তিন ঘন্টা করব টা কী? অথচ এরকম অভাবনীয় ভাবে যে চেনা পরিচিত সহযাত্রী পেয়ে যাব কে জানত! প্রোফেসর ধর যে আসলে অধ্যাপনা করেন না সে সব কলকাতায় থাকতেই জেনেছিলাম। প্রথম জীবনে কিছুকাল অধ্যাপনা করলেও, পরে উনি প্রোফেশন পাল্টে ব্যবসায়ী বনে গেছেন। তখন সবে আমার প্রথম বিদেশ যাত্রার দিন ক্ষণ ঠিক হয়েছে, বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিলাম আনন্দে, ওঁর সঙ্গে আগেই আলাপ হয়েছিল কোনও একটা অনুষ্ঠানে, তখনই উনি ওঁর কার্ড দিয়েছিলেন। ক্যামাক স্ট্রীটে ওঁর অফিসেও একবার গেছলাম এক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে, কফি খাইয়েছিলেন আমাদের। কারও অফিসে গিয়ে কফি খেতে পাওয়া ছিল এক দারুণ সম্মানের ব্যাপার। সে এমন এতটা বয়স, যখন লোকে আমাদের মাঝে মাঝে আপনি বলে সম্বোধন করে ফেলছে। ইনিও প্রথমে আপনি আপনি করলেও অল্প পরেই তুমিতে চলে এসেছিলেন। সেই ভদ্রলোক কি না আজ আমার সহযাত্রী! উনি চলেছেন প্রাগে। মস্কোতে ফ্লাইট বদলাতে হবে। প্রাগ থেকে যাবেন লন্ডন, সেখানেও ব্যবসার নানারকম কাজ মিটিং ইত্যাদি আছে। অনেক গল্প করতে লাগলেন। দিল্লিতে একটা অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছেন শুধু এই কারণে যে ব্যবসার কাজে বারবার দিল্লিতে যাতায়াত করতে হয়, বিদেশ যাত্রা করবার জন্যও দিল্লি খুব দরকারি। এয়ার হোস্টেসদের ডেকে ডেকে বেশ কয়েকবার মদ চেয়ে চেয়ে খেয়ে একটু পরেই ওঁর চোখের দৃষ্টি চকচকে হয়ে উঠল। টয়লেট থেকে যখন ঘুরে এলেন, গায়ে ভুরভুর করছিল ওডিকোলনের গন্ধ। গা ঘেঁষে বসছিলেন। অনেক অপ্রয়োজনীয় কথা বলে চলছিলেন। এই ধরণের ব্যবহার আমি কিছুদিন আগেই আর একজন স্বদেশবাসীর কাছে পেয়েছি। বলতে গেলে সেই একই ব্যবহারের পুনরাবৃত্তি হতে চলেছে। ডিনার এলো, অত্যন্ত সাধারণ খাবার, মশলাহীন চিকেন, কালো রুটি, চীজ মাখন কফি। আয়েরেফ্লোতের মশলাহীন খাবার ভারতীয় জিভে রুচবার মত নয়। আমার কিন্তু বেশ লাগছিল খেতে। কেমন যেন মনে হচ্ছিল নিজের চেনা শহর, চেনা রাস্তা, চেনা ঘর, বাতাসের চেনা গন্ধ এগিয়ে আসছে। আর তো মাত্র ঘন্টাখানেক বাকি। উঠে গিয়ে অন্য সীটে বসব? এয়ার হোস্টেসকে ডেকে বলব যে পাশের যাত্রী অস্বস্তিকর ব্যবহার করছে? মায়া হল লোকটার জন্য। একটু সরে বসলাম। বিদেশে যাবার পথে, কি বিদেশের মাটিতে নেমেই এরা বদমায়েসি করবার সুযোগ খুঁজতে থাকে। বেচারা লোকটা, এই একটু আগে নিজের দুই ছেলের গল্প করছিল, নিজের বাচ্চাদুটোকে খুবই ভালবাসে, ছেলেরা সেন্ট লরেন্সে পড়ছে, ছোট ছেলে কেমন বাড়িয়ে বাড়িয়ে রং চড়িয়ে চড়িয়ে ইস্কুলের গল্প করে সেসবও শুনেছি, আবার নেশা হবার ভাণ করে আমার গায়ে ঢলেও পড়ছিলেন প্রোফেসর ধর। এত টাকা পয়সা রোজগার করেছে, অথচ মেয়েদের গায়ে হাত দেবার সুযোগ খুঁজছে, এয়ার হোস্টেসকেও ছাড়ে নি সেসব ও চোখ এড়ায় নি আমার। এর পরে কলকাতায় কখনও দেখা হলে ওকে কি আর সম্মান করতে পারব? আমি সজাগ হয়ে দূরত্ব বজায় রেখে বসে থাকি। একটু পরেই এরোপ্লেন নীচে নামতে শুরু করে। অধিকাংশ যাত্রীই ঘুমিয়ে পড়েছে। খুব অল্প ঝাঁকুনি দিয়ে ছবির মত ল্যান্ডিং, আমি উঠে পড়ি। তাশকেন্ত এসে গেছে।
*চের্নোবিলের দুর্ঘটনা। বহুচর্চিত বিষয়। সংক্ষেপে ১৯৮৬র শীতের শেষের দিকে নিউক্লীয়ার পাওয়ার প্লান্টের ছাদ উড়ে যায়। সহজ করে বললে বিস্ফোরণের ফলে ছাদটা উড়ে যায়। তারপরে মাধ্যাকর্ষণের জেরে আগের জায়গায় ফিরে এলেও তেরছা হয়ে বসে। ফলে সেই ফাঁক দিয়ে রেডিয়েশন ছড়াতে থাকে। তাও ভালো যে নিউক্লীয়ার পাওয়ার প্লান্টের ভেতরের চাপ, সব সময় অ্যাটমস্ফীয়ারিক চাপের চেয়ে বেশ কম রাখা হয়, নাহলে রেডিয়েশন অনেক বেশি মাত্রায় ছড়াতো।
কিন্তু কেন এমন বিস্ফোরণ হয়েছিলো? কিছু জায়গা ঠিকমতো ঠান্ডা রাখা যায় নি বলে। কেননা নিয়মিত যে পর্যবেক্ষণ ও মেরামতের দরকার ছিলো সেটা করা হয় নি। এর ফলে প্রচুর প্রাণহানি এবং শারীরিক ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াও পরিবেশের অশেষ ক্ষতি হয়। খবরটা প্রথমে চেপে দেবার চেষ্টা হয়। এদিকে পশ্চিম ইউরোপ অবধি সেই সময়টা দিনের বেলাতেই সন্ধের মতো অন্ধকার ঘনিয়ে আসে, যেন আকাশ কালো করে মেঘ করেছে, সূর্য দেখাই যাচ্ছে না। পশ্চিম ইউরোপেই প্রথম ধরা পড়ে যে মূল কারণ তেজষ্ক্রিয় বিকিরণ। সেই প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে সোভিয়েত দেশ স্বীকার করে চের্নোবিলের দুর্ঘটনা। তারও পরে খবর পায় দেশের ভেতরের মানুষ। ঘটনার ঘাত প্রতিঘাত অনেক রেখে ঢেকে কমিয়ে প্রকাশ করা হয়। আসল ডিটেল ১৯৯৩-৯৪ নাগাদ জানতে পারে জনগন। অনেক দেরীতে।
চলবে…
পরিচ্ছেদ ৬ অনেক রাতে ফিরেছিল কল্যাণ ওরফে শহীদুল।গাড়িটা শেডে রাখার পর দু’বার হালকা করে মা…..
পরিচ্ছেদ ৫ আকাশে এখন আর মেঘ নেই। হাওয়া হচ্ছে।কদিন পরেই বর্ষা নামবে।একদিন হাসপাতাল থেকে ফিরতে…..
পরিচ্ছেদ ৪ ভোর হয়ে আসছে।রাতে ভালো ঘুম হয়নি।ঘুমের ঘোরে মনে হচ্ছিল দম বন্ধ হয়ে আসছে।এরকম…..
বাংলার চিত্তাকর্ষক ইতিহাস সম্পর্কে জানার সময়, গৌরের মতো আর কিছু গন্তব্য হতে পারে না।…..