বাতিল দৃশ্যাবলী (পর্ব- ৬) সব বদলে বদলে যায়

যোষিতা
ধারাবাহিক, নন ফিকশন, পডকাস্ট
Bengali
বাতিল দৃশ্যাবলী (পর্ব- ৬) সব বদলে বদলে যায়

গভীর রাতে ইন্টারন্যাশানাল টার্মিনালে একজন, হ্যাঁ মাত্র একজন যাত্রী নেমেছে। টার্মিনালের লম্বা লম্বা করিডোরগুলোর আলো নেভানো। অনেকটা পর পর ক্ষীণ আলো যেটুকু জ্বলছে তাতেই পথটুকুর আবছা আন্দাজ পাচ্ছি, একটাই পথ তাই ভুল হচ্ছে না। দীর্ঘ পথের শেষে ইমিগ্রেশনের কাউন্টার। কেউ নেই। দরজা বন্ধ। দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি, এবার সেই করিডোরগুলোর আলো পর পর জ্বলে উঠল। ইমিগ্রেশন অফিসার এল। লাগেজ এল। দুজন কাস্টমস অফিসার আমার সুটকেস খুলে সমস্ত কিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে তন্ন তন্ন করে খুঁজল বেআইনি জিনিস কিছু আছে কি না। বুঝলাম কেন লোকে এই রুটে যাতায়াত করে না। এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে বাইরেটা ফাঁকা। গভীর রাত। দূরে একটা দুটো ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে। বড্ড ঘুম পায়। আমার হস্টেল দশ মিনিটেরও কম দূরত্বে। সেখানে পৌঁছে দেখি মেইন গেট বন্ধ। দরজার কাচে দুম দুম করে ধাক্কা মারি, ঘুম চোখে আমায় দেখে সেই বুড়ি চৌকিদার অবাক, —এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলি, আরও এক মাস ছুটি আছে তো! আমি সুটকেস নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে চারতলা অবধি উঠব কী করে তাই ভাবছি, সে আবার বলে, তোর ঘর তো আর নেই, তোর ঘরে এখন অন্য লোকে থাকছে।
সর্বনাশ করেছে, আমি ঘুমোব কোথায়? বাড়ি যাবার সময়ে যে ঘর খালি করে গেছলাম সে কথা এতদিন মনেই ছিল না, এরা সেই ঘর ইয়ুথ হস্টেলের মত করে ভাড়া দিয়ে দিয়েছে। আমার দুই রুমমেট যারা গরমের ছুটিতে লাওস যেতে পারেনি, বা যারা আফ্রিকা কি লাতিন অ্যামেরিকার মত দূর দেশ থেকে এসেছে তারাও টিকিট কিনতে পারেনি, তারাই রয়ে গেছে হস্টেলে। কেউ কেউ অন্য শহরে বেড়াতে গেছে। সে রাতটা সিঁড়ির ধাপে বসেই কাটিয়ে দিলাম। পরদিন সকালে পাদফাকের অফিস খুলল। সেক্রেটারি লোলা মিষ্টি হেসে বলল কোনও চিন্তা নেই, তুমি চিয়াত্রালনি ইন্সতিতুতে চলে যাও, এই নাও কাগজ, ওখানেই তোমায় হস্টেলে ঘর দিয়ে দেবে আজ।

অডিও পডকাস্ট শুনুন এইখানে

জিনিসপত্র চৌকিদারের কাছে রেখে টুক করে দোমব্রাবাদের মেডিকেল হস্টেলে চলে যাই, যদি কেউ থাকে। সবাই গরমের ছুটিতে হয়ত দেশে যায় নি। ডাক্তারিতে সবাই সব বিষয়ে পাশ করতে পারে না, পাশ না করলে বাড়ি যাবার পার্মিশান পাওয়া যায় না। যা ভেবেছি, গোটা চার পাঁচ ভারতীয় ছাত্র হস্টেলের গেটের সামনে গুলতানি করছিল, আমায় দেখতে পেয়ে তাদের ভূত দেখার মত মুখ হয়ে গেছে। দেড় দুদিন যাবদ আমার একই পোশাক এবং চুলটুল না আঁচড়ানো চেহারা, ঘুমও হয় নি, দিল্লির গরম, ফ্লাইটে বদমাশের পাশে তিন ঘন্টা, তারপরে গভীর রাতে কাস্টমসের সঙ্গে মোকাবিলা, ঘর বেহাত হয়ে সিঁড়িতে রাত কাটিয়ে অবশেষে নতুন হস্টেলে ঘর পাবার কাগজ হাতে পেয়েছি, কিন্তু সমস্ত জিনিস নিয়ে অচেনা হস্টেলে একা যাবার শক্তি নেই। দুজন তৎক্ষণাৎ আমার সঙ্গে যেতে রাজি হয়ে গেল। পঙ্কজ এবং অজয় কুমার ঘোষ। আধ ঘন্টার মধ্যে সোজা ট্যাক্সি নিয়ে আমরা চিয়াত্রালনি ইন্সতিতুতের সামনে। ইন্সটিটিউটের অফিসে আমার অ্যাডমিশনের কাগজ জমা দিলাম। সেক্রেটারি ভদ্রলোক কীসব রেজিস্টার খুলে দেখলেন, এদিক ওদিক খুচখাচ কাগজ গোছালেন, তার পরে আমাকে জিগ্যেস করলেন আমি উজবেক ভাষা জানি কি না। জানি না। উনি বললেন তাহলে তো এবছর হবে না। তার মানে! আমরা তিনজনেই সমস্বরে প্রায় চেঁচিয়ে উঠেছি। জানা গেল, একটা মস্ত ভুল হয়ে গেছে, প্রত্যেক বছর রাশিয়ান ভাষার মাধ্যমে পড়ানো হয় না, এক বছর অন্তর করে রাশিয়ানে পড়ায়। এবছর উজবেক ভাষার মাধ্যমে পড়ানো হবে। তাহলে কী উপায়? আমরা ফিরে চলি পাদফাকে। লোলা আমাকে দেখে অবাক হয়, আমাদের আরেকজন অ্যাসিস্ট্যান্ট ডীন লারিসা গ্রেগরিয়েভনা তখন সেখানে উপস্থিত। হড়বড়িয়ে সব বোঝাতে গিয়ে প্রথমে গুলিয়ে গেলেও উনি বুঝতে পারেন, ফোন করেন চিয়াত্রালনি ইন্সতিতুতে। আমার মাথার ভেতরটা কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। কিছু বুঝতে পারছি না কী করব। ঐ ছেলে দুটো কথা বলছে লোলার সঙ্গে। মিনিট দশেক আলোচনার পর ঠিক হয়, দুটো পথ খোলা আছে আমার। এক, রাশিয়ার কোনও শহরে গিয়ে নাটকে ভর্তি হওয়া, হয়ত তারা আবার পরীক্ষা নিতে পারে, ফলাফল কী হবে তার নিশ্চয়তা নেই, দুই, তাশকেন্তেই আমার পছন্দের অন্য কোনও বিষয় নিয়ে পড়াশুনো করা। এই দু নম্বর অপশন শুনে পঙ্কজ ও অজয় কুমার ঘোষ লাফিয়ে ওঠে, ডাক্তারি পড় ডাক্তারি পড় ডাক্তারি পড়, করে কান ঝালাপালা করে দেয়। আমি শুধু ভাবছি, তাহলে আমার আর এ জন্মে থিয়েটার করা হবে না। কেমন করে করব? এত বাধা। নিজের মাতৃভাষাই এই বিষয়ের জন্য শ্রেষ্ঠ মাধ্যম হওয়া উচিত, মানুষের মন নিয়ে কাজ, তবু চেষ্টা করেছিলাম অন্য একটা ভাষা শিখে সেই ভাষায় অভিনয় করবার, তাতেও বিধি বাম। আর কত লড়ব? মন ভেঙে যাচ্ছে। একটা মাস ছুটিতে ছিলাম কোলকাতায়, আকাশ পাতাল অনেক কিছু ভেবেছি। কয়েকটা আর্ট ফিল্ম দেখলাম, আগের মত সেরকম রোমাঞ্চ অনুভব করিনি, আগে খুব ভাল লাগত। এবার কেমন যেন আলগা আলগা লেগেছে, গল্পের বিষয়বস্তু আগে যেমন নির্ভুল মনে হত, এবার দেশে গিয়ে তেমন লাগে নি, অনেক ফাঁক দেখতে পাচ্ছি। কেন এমন হচ্ছে? “ভাল মেয়ে” হিসেবে যে চরিত্রগুলো দেখানো হচ্ছে সেগুলো বড্ড ওল্ড ফ্যাশনড ঠেকছে আমার চোখে। আমার বন্ধুরা তাই দেখেই বাহ বাহ করল, আমরা কফি হাউসে বসে আড্ডা মারলাম, ওরা চেরনোবিল জানতে চেয়েছিল আমি বলতে পারিনি, আমি তারাচাঁদবাবুর গল্পটাও ওদের বলতে চাইনি। ছকে বাঁধা কিছু গল্প আছে যেগুলো চলছে, যেগুলো আমার বন্ধুরা তপন, কল্লোল, পুরুষোত্তম, রানা অ্যাপ্রিশিয়েট করবে, আমিও করতাম ছ সাত আট দশমাস আগে পর্যন্ত। এখন কেমন যেন টান কমে যাচ্ছে, রানাদের বললে ওরা হাসবে, বলবে খুব ফরেন রিটার্নড হয়ে গেছিস এই ক মাসে। কিন্তু তা নয় রে। সমাজতান্ত্রিক দেশে “কুঠার” বিক্রি করা যায় না। মায়ের কাছে মাসির গল্প বলার মত কেস হয়ে যায়।
লারিসা গ্রেগরিয়েভনা আমার কাঁধে হাত রাখেন, কী নিয়ে পড়তে চাও তুমি? এই নাও বুকলেট এর মধ্যে সব কটা বিষয়ের নাম আছে, দেখ কোনটা পড়তে ইচ্ছে করে। আমার কেমন যেন হাসি পায়। এই তো সেদিন ভ্লাদলেন উসমানোভিচ বলছিলেন যে যেদিন কমিউনিজম আসবে সেদিন যার যে প্রোফেশন খুশি সে সেটাই নিতে পারবে, কোনও ভেদাভেদ থাকবে না। মিখাইল সের্গেইভিচ নাকি সেদিকেই আরও এক পা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন দেশটাকে, হুঁ হুঁ বাওয়া এরই নাম পেরেস্ত্রৈকা, গ্লাসনস্ত। তাহলে কি কমিউনিজম এসেই গেল? বুকলেটটায় চৌষট্টি পৃষ্ঠা, আমি ফরররর্ করে পাতাগুলো উল্টে চোখ বন্ধ করে আন্দাজে একটা পাতায় এক জায়গায় আঙুল রেখে বলি —এইটা!
লোলা বলে, শূন্য ছয় শূন্য আট। আমি চোখ খুলি। ছেলে দুটো ঝুঁকে পড়ে দেখে নেয় শূন্য ছয় শূন্য আট এই কোড নম্বরের অর্থটা কী, পাশে কী লেখা আছে। তারপর পঙ্কজ বলে ফেলে, আরে ইয়ে তো কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং হ্যায়!
আধ ঘন্টা পরে একটা অঙ্ক পরীক্ষা হয় আমার, মুখে মুখে। তাতে উৎরে যাই। লাঞ্চের পর পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটে যাই আমরা। বিকেলের মধ্যে তল্পিতল্পা নিয়ে ভুজগারাদোক। তিরিশ নম্বর হস্টেলের বি ব্লক, তিন তলা। এই হস্টেলে খুব কম মেয়ে, কোনও ইন্ডিয়ান মেয়ে নেই এই ইন্সটিটিউটে, তবে আরও একজন ইন্ডিয়ান মেয়ে স্টুডেন্ট আছে এ তল্লাটে, সে জার্নালিজমের ছাত্রী গীতা। তার অবশ্য ফিফথ ইয়ার, মানে ফাইনাল ইয়ার। আরও মেয়ে আছে, ফিফথ ইয়ারের ছাত্র লাক্শার সিং এর বৌ পাম্মি মানে পরমিন্দর। সে পড়ে না, তার কোলে এগারো মাসের শিশুকন্যা। আর আর …উঁহু আর নেই। লাক্শার সিং দোতলায় থাকে, তার ঘরে নিয়ে যায় আমায় ঐ দুজন। ওরা সকাল থেকেই সারাক্ষণ আমার সঙ্গে ঘুরছে, প্রচুর হেল্প করেছে, ওরা না থাকলে এত কিছু একদিনে পারতামই না। সব শুনে লাক্শার সিং হাসি মুখে বলেন, কোনও চিন্তা নেই এটা মেয়েদের সাবজেক্ট, বেশি শক্ত ড্রইং থাকবে না, হাল্কা সাবজেক্ট। পঙ্কজ ও অজয় কুমার ঘোষ দুজনেই তাও চিন্তা প্রকাশ করে। লক্শর অভয় দেন, আরে না না, সহজ ড্রইং থাকবে, মেক্যানিকালের মত কি সিভিল বা আর্কিটেকচারের মত নয়। আমি বোকার মত বলে ফেলি, মেক্যানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর ড্রইং কি খুব শক্ত। লক্শর সিং স্মিত হেসে বলেন, মেক্যানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ইজ মর্দওয়ালা সাবজেক্ট, নট সুটেবল ফর গার্লস।
দিনান্তে নিজের একটা ঘর, একটা বিছানা পেয়ে মনে হয় আমার বাড়িতে এ খবর শুনলে কত খুশি হবে। ইঞ্জিনিয়ার হব। ইঞ্জিনিয়াররা সবাই চাকরি পায়, গরীব ইঞ্জিনিয়ার হচ্ছে অক্সিমোরোন। ঐ ছেলে দুটোও খুশি আল্টিমেটলি আমার শুভ বুদ্ধি হয়েছে বলে। দেশে যাবার আগে গডউইনরা তো সব চেঁচিয়েছিল, সুন্দরী নই যে মেইনস্ট্রিম সিনেমায় নায়িকার রোলে চান্স পাব, নাটক ওরা বুঝত না, আমারও আর শক্তিতে কুলোচ্ছিল না। এই যা হয়েছে ভাল হয়েছে। নতুন ঘরে প্রথম রাতে ঘুম আসতে চায় না, জানলায় পর্দা লাগানো হয় নি, রাস্তার আলোয় ঘরের ভেতরটা ভরে গেছে। হলদে কাঠের মেঝে, হলদে কাঠের টেবিল, সাদা দেওয়াল, প্রকান্ড ঘরটা কেমন মরুভূমির মত। লক্শর সিং গরমের ছুটিতে দেশে যায় নি কেন? ফেল করেছে নাকি মর্দওয়ালা সাবজেক্টে? আচ্ছা এই ভুজগারাদোকেই আর একটা ইন্ডিয়ান মেয়ে ছিল না! সেই যে রান্ডি টাইপ, আহা কী নাম যেন তার, ধুত্তেরি মনে পড়ছে না, নাকি সে অন্য কোথাও থাকে? কী পড়ে মেয়েটা? দীপুদাও তো এই পাড়াতেই। কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়াররা কী করে? কম্পিউটার বানায়? কম্পিউটার দেখতে কীরকম হয় কে জানে। কম্পিউটার দিয়ে খুব বড়ো বড়ো অঙ্ক নাকি হুশ করে সেকেন্ডের মধ্যে কষে ফেলা যায়। নেক্সটবার যখন কোলকাতায় যাব বন্ধুদের সামনে খুব রেলা নেব। এক বোতল ভোদকা নিয়ে যেতেই হবে ওদের জন্য, নইলে প্রেস্টিজ থাকে না।
আলো জ্বালিয়ে সিলিং সমান উঁচু কাবার্ডগুলোর দরজা খুলে ফেলতেই নতুন রঙের গন্ধ নাকে এসে লাগল। এ ঘরে তিনটে কাবার্ড। তার মানে তিন জনের জন্য এই ঘর। নেহাৎ গরমের ছুটি চলছে তাই বাকি দুজন এখনও আসে নি। কাবার্ডের মধ্যে রেখেছি আমার কাপড় চোপড়, অন্য জিনিস পত্র। এই হস্টেলটা একেবারে আনকোরা নতুন, মূলতঃ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংএর ছাত্রদের জন্য তৈরী। দোতলাটা বিবাহিত ছাত্রদের দিয়েছে বৌ বাচ্চা নিয়ে থাকার জন্য, তিনতলাটা মেয়েদের। এই ফ্লোরের অধিকাংশ ঘরই ফাঁকা। আমি গভীর রাতে সুটকেস খুলে জিনিস গোছাতে লেগে যাই। হলদে কাঠের টেবিলটা আজ সন্ধেবেলায় নিজে নিজেই বানিয়েছি। নতুন টেবিল, কাঠের টুকরোগুলো হস্টেল থেকেই দিয়েছিল, একটা কাগজে ছক আঁকা ছিল, সেই ছক দেখে দেখেই বানালাম। টেবিলটা সরিয়ে জানলার সামনে নিয়ে যাব ভাবলাম। একটু ঠেলা দিতেই সেটা হুড়মুড় করে খুলে মেঝেয় পড়ে গেল। সর্বনাশ, এখন কী হবে? ভাগ্যিস আশে পাশের ঘরে কেউ নেই, যে পরিমান আওয়াজ হয়েছে তা বলবার নয়। আলো নিবিয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়ি। কথা বলবার কেউ নেই। কথা বলতে এত ভালবাসতাম আমি, সেই আমার ভাগ্যেই জুটেছে এরকম একটা জীবন। এ ভালো না মন্দ, তা বুঝতে হয়ত সময় লাগবে।

পয়লা সেপ্টেম্বর থেকে শিক্ষাবর্ষ শুরু। ইস্কুল ইউনিভার্সিটি ইন্সটিটিউট সর্বত্র, গোটা সোভিয়েত ইউনিয়নে। অগস্টের শেষে আমার রুমমেট হল একজন উজবেক মেয়ে, সে ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রী, নাম জেবো। জেবো পড়ছে ফলিত গণিত, রাশিয়ানে যাকে বলে প্রিক্লাদনাইয়া মাতেমাতিকা। জেবো ভাঙা ভাঙা রাশিয়ান বলতে পারে, আমি ভারতীয় জেনে অবাক হয়ে চেয়ে চেয়ে দেখে, তার ধারণা হিন্দি সিনেমার মত আমিও ঝলমলে সাজগোজ করে যখন তখন নেচে নেচে গান গাইব। সে তার আরও দু তিনজন বান্ধবীকে জুটিয়ে এনে আমায় অনুরোধ করতে থাকে নাচতে। অনুনয় বিনয় থেকে ক্রমশ তা হুকুমের লেভেলে পৌঁছে যায়, কিন্তু নাচ তো আমি জানি না, বকা ঝকা এমনকি মারধোর করলেও নাচ আমার দ্বারা হবে না। ওদের ধারণা হিন্দিস্তানের সব মেয়েরাই নাচতে পারে, নাচের ট্যালেন্ট নিয়েই সব ভারতীয় মেয়ে জন্মাচ্ছে। খুবই আশাহত হয় ওরা। আমাদের বন্ধুত্ব জমে না, তা সত্ত্বেও কদিন দু তরফেই খুব চেষ্টা করা হয়। জেবো সপ্তাহখানেক আমার ঘরে ছিল। বিশাল বিশাল চার্ট পেপার, খাতা পত্তর নিয়ে সে তার ফাইনাল ইয়ারের পড়াশোনার পরিবেশ তৈরী করছিল। খুচখাচ গল্প করত। তার একজন বয়ফ্রেন্ডও ছিল যে এলে জেবো বেড়াতে যেত বাইরে। এই জেবোর কাছেই কথায় কথায় জেনেছিলাম উজবেক মেয়েদের বিয়ের পর একরকম পরীক্ষা দিতে হয়, সতীত্বের পরীক্ষা বা বলা যেতে পারে কৌমার্যের পরীক্ষা। খুব গর্ব ভরে সে বলেছিল, মেয়েদের জীবনে এটা খুব গর্বের ঘটনা, এই পরীক্ষায় পাশ করে তারা শ্বশুরবাড়ীর কাছে নিজের পবিত্রতা প্রমাণ করে। আমি উল্টে ওকে বলি, এতো খুব প্রাইভেট ব্যাপার, শ্বশুরবাড়ীর লোকেরা বরবৌয়ের ঘর থেকে রক্তমাখা রুমাল নিয়ে হৈচৈ করছে, সবাই ঝুঁকে ঝুঁকে সেই রক্তের দাগ দেখে নতুন বৌয়ের সতীত্ব যাচাই করছে, এতে তো অস্বস্তি হবার কথা, ছেলেরা কি নিজেদের সতীত্বের পরীক্ষা দেয়? জেবো রেগে যায়, অসন্তুষ্ট হয়, বলে, ছেলেরা কি পেটে সন্তান ধরে, তাদের পরীক্ষা দেবার কোনও দরকার নেই তো! এর দুয়েক দিনের মধ্যেই সে ঘর বদলে অন্য কোথায় যেন চলে যায়, সম্ভবত অন্য কোনও হস্টেলে। তিরিশের বি তে তাকে আর দেখিনি। সেপ্টেম্বরের শুরুতেই আমার রুমমেট হয় মঙ্গোলিয়ার মেয়ে, তুমে। ওর পুরো নাম তুমেন্দেনবেরে সাইদারাহিন, স্বভাবে জেবোর একেবারে অপোজিট। তুমের কাছ থেকে মঙ্গোলিয়া সম্বন্ধে কিছু জ্ঞানার্জন করেছিলাম, অনেক বছর পরে একটা ফ্যান ফিকশন লিখি (“প্রোফেসর শঙ্কু ও মোংরু”), সেখানে ঐ জ্ঞান অল্প বিস্তর কাজে লেগে গেছল।
তুমে বড্ড চুপচাপ মেয়ে, সে বলেছিল সতীত্ব টতিত্বের ফান্ডা মঙ্গোলিয়ায় নেই, মাত্র দু মিলিয়ন জনসংখ্যা যে দেশের সেখানে বিয়ের রাতের রক্তমাখা রুমাল নিয়ে উল্লাস উৎসব অ্যাফোর্ড করা যায় না। হয়ত আরও কারণ থাকতে পারে, কিন্তু সংসার সম্পর্কে অনভিজ্ঞ ফার্স্ট ইয়ার ইঞ্জিনিয়ারিংএর ছাত্রীকে এর বেশি সে বলেনি। সে তখন ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর থার্ড ইয়ার। পাঁচ মাস পরে জেনেছিলাম তার বাবা মঙ্গোলিয়ান এম্ব্যাসীর অ্যাম্বাসাডার, অথচ তুমের লাইফস্টাইল ছিল অবিশ্বাস্য রকমের সাদামাটা— একটা দামি সাবান পর্যন্ত ব্যবহার করতে দেখিনি, তার ছিল মাত্র দুসেট কাপড়জামা, একটাই ফুরিয়ে যাওয়া লিপস্টিক যেটা সে দেশলাই কাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তলানিটুকু বের করে করে ঠোঁটে ঘষে নিত। আর ছিল তার মাসলম্যান বয়ফ্রেন্ড আম্রা।
তিনশো পনের নম্বর ঘরে তুমের সঙ্গে বেশিদিন আমার থাকা হয়ে ওঠেনি, ঊনিশশো সাতাশির বসন্তকালে প্রায় জোর করেই ঘর পাল্টে দেওয়া হল আমার নতুন হওয়া বয়ফ্রেণ্ডের আদেশে। প্রেমে পড়বার ঐইতো বয়স। হস্টেলের পেছনের দিকে তিনশো পাঁচ নম্বর ঘরে দুই উজবেক রুমমেটের সঙ্গে থাকতে শুরু করলাম। তিনশো পনের ছিল হস্টেলের সামনের দিকটায়, জানলার সামনেই নীচে প্রায় চারপাঁচ মিটার চওড়া করে ফুলের বাগান গাছ পালা দিয়ে ঘেরা। সেটার পর সরু রাস্তা পিচে মোড়া। রাস্তার ওপারে প্রকান্ড মাঠ, মাঠের ওপারে বুনো আপেলগাছে ভরা জঙ্গল, তারও ওপারে দেখা যায় বারো এবং চোদ্দ নম্বর হস্টেল। তার পরে শুধু আকাশ। হস্টেলের সামনের রাস্তাটা দিয়ে সবসময় লোকজন হেঁটে যাচ্ছে, সেই রাস্তাতেই মাঝে মাঝে দেখতাম একটা মেয়ে অল্প খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে যায়। মেয়েটার গায়ের রং ময়লা, মনে হয় ভারতীয় হলেও হতে পারে। একদিন সে চোখ তুলে ওপরে তাকাল, আমায় দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল। ঐ মেয়েটাই মীনাক্ষি, যার সম্বন্ধে অল্প অল্প গল্প শুনেছি গত এক বছর ধরে। ব্যস, সেই থেকে আমরা বন্ধু হয়ে গেলাম।
মীনাক্ষির সঙ্গে আলাপ হবার সময়টা সেই সময় যখন সবাই এইডস (রাশিয়ানে “স্পিদ্”) রোগটার নাম জেনে ফেলছে, দুনিয়া কাঁপিয়ে এইচআইভি-এইডস এর প্রতিরোধে ক্যাম্পেইন চলছে। প্রতিটি ফরেনার (বা যে সব সোভিয়েত নাগরিক বিদেশ সফর করে এসেছে) কে এলিজা টেস্ট করানো হচ্ছে বাধ্যতামূলক ভাবে। তখনও অবধি কোনও এইচআইভি পজিটিভ বিদেশি ছাত্রছাত্রী পাওয়া যায় নি। তখন এইভাবে প্রচার চলছে — স্পিদ্ হয় তিন ক্যাটেগোরির মানুষদের, যথা, হোমো সেক্সুয়ালদের, এইচআইভি পজিটিভ গর্ভবতী মায়ের থেকে তার গর্ভস্থ সন্তানের এবং যারা ক্ষণে ক্ষণে সেক্স পার্টনার পাল্টায় অর্থাৎ বেশ্যাদের। হোমো সেক্সুয়ালিটি এবং বেশ্যাবৃত্তি সারা দেশে এমনিতেই নিষিদ্ধ। বাকি থাকে একটি মাত্র অপশন, আক্রান্ত মায়ের থেকে গর্ভস্থ সন্তানের শরীরে সংক্রমন। এই তিনটি মর্মে নিয়ম করে করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এইচআইভি-এইডস এর অ্যাওয়ারনেস্ জাগিয়ে তোলা হচ্ছিলো এবং প্রথমেই মিলিৎসিয়ার দায়িত্ব থাকে জন হিতার্থে কাজ করবার।
সে অদ্ভুত দৃশ্য। নিজের চোখে না দেখলে লিখে বোঝানো প্রায় অসম্ভব। স্পিদ কন্ট্রোলকে সামনে রেখে
সন্ধের মুখটার যে সব হস্টেলে বিদেশীরা থাকে তার পেছন দিকে নিঃশব্দে চুপচাপ আলো নিভিয়ে লুকিয়ে থাকত মিলিৎসিয়ার ভ্যান। অল্পবয়সী সোভিয়েত (হ্যাঁ তাদের অধিকাংশই রুশি) মেয়েরা কোনো বিদেশি ছাত্রের সঙ্গে দেখা করতে এলেই তাকে খপ্‌ করে ধরে জোর জবরদস্তি করে ভ্যানে তোলা হচ্ছিল। সাত আটটা (বা কম বেশি ) মেয়েকে ভ্যানে তুলে নিয়ে যাওয়া হতো স্পিদ্‌-এর “টেস্ট” করাতে। আদতে কোনও ডাক্তারি পরীক্ষাও হত না, মেয়েগুলো কিছুক্ষণ পরেই ছাড়া পেয়ে যেত, তবে মিলিৎসিয়ারা এমনি এমনি ছেড়ে দেয় না। হয়ত তাদের পাসপোরৎ আটক করে রেখে দিলো (আজ দেব কাল দেব করে ঘোরাবে), নয়ত মার ধোর বলাৎকারের বিনিময়ে পাসপোরৎ ফেরৎ পেত মেয়েগুলো। মিলিৎসিয়া বলে কথা! এদের বিরুদ্ধে তো আর ধর্ষণের রিপোর্ট লেখানো চলে না। “ভালো” মেয়েদের তুলে নিয়ে গেলে তাদের খুবই বিপদে পড়তে হতো। ঐ পাসপোরৎ ছাড়া ওদেশে কোনও নাগরিকেরই গতি নেই, সব জায়গাতেই ওটা দেখাতে হয় আইডেন্টিটি প্রুফ হিসেবে, যদিও ওই পাসপোরৎ দিয়ে বিদেশে যাওয়া যায় না।
মীনাক্ষির পরিচিত এমনি একটি মেয়ের সঙ্গে একবার গল্প হচ্ছিল। তার সেই ভয়ানক অভিজ্ঞতার কথা শুনে আমরা সমস্বরে বললাম, ফেরৎ পেলি তোর পাসপোরৎ?
– আর বলিস না। লোকটা তো আমায় রোজ ঘোরাচ্ছে আজ দেব কাল দেব করে। যখন টাইম দেয়, থানায় যাই, গিয়ে দেখি নেই – কোথায় বেরিয়ে গেছে। অন্য দিন গেলে দেখা হলে বলে কী সব প্রোটোকল লেখা বাকি আছে। এমনি করতে করতে প্রায় দু মাস কেটে গেছে। পাসপোরৎ সব জায়গায় দরকার, ওটা না দেখালে স্টাইপেন্ডের টাকাও তোলা যায় না।
– তারপর?
– তারপর আবার কী? এমনি করে দু মাস ঘোরানোর পর একদিন থানার মুখটায় দেখা হলো, সে তখন গাড়ি নিয়ে কোথায় একটা বেরোচ্ছে, গাড়ীতে স্টার্ট দিচ্ছিল। আমাকে ডেকে গাড়ীতে তুলে নিলো। পথে যেতে যেতে কাজের কথা হলো। লোকটা বলল, দ্যাখো তোমার কেসটা দুমাস ধরে পড়ে আছে, এখন এটা কোর্টে উঠবে, শিগ্‌গিরই তোমার কাছে চিঠি যাবে কোর্টে উপস্থিত হবার জন্য। আমার তখন কাঁদো কাঁদো অবস্থা। একবার এইসব মামলায় জড়িয়ে পড়লে আমার জীবনে কালো ছাপ পড়ে যাবে, কোনও দিনও ভাল চাকরি পাব না। লোকটা আমার মনে ভাব বুঝে নিয়ে বলল, অবশ্য তুমি যদি বুদ্ধিমতি হও তবে এর ফয়সালা এখনই হয়ে যেতে পারে।
– হল ফয়সালা?
– হল তো। আমি বললাম কী করতে হবে? সে আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসলো। আমি কিছু বললাম না। সে গাড়ি ঘুরিয়ে নির্জন একটা জায়গায় নিয়ে গিয়ে, তার যা কাজ করবার করে নিল।
– আর পাসপোরৎ? দিল?
– কেন দেবেনা? পকেটে করে নিয়েই ঘুরত সবসময়। কাজের শেষে সঙ্গে সঙ্গে দিয়ে দিলো। এই দ্যাখ্‌!
দেখলাম পারপোরৎ, নিদাগ। কোনো ভুলভাল স্ট্যাম্প মেরে দেয় নি ভেতরে। টানা বেশ কয়েক বছর এইভাবে মিলিৎসিয়ার অত্যাচার চলেছিলো। ভাগ্যিস দেশ ভেঙ্গে গিয়েছিলো, তখন মিলিৎসিয়া আরো ইন্টারেস্টিং কাজ খুঁজে পায়। প্রথম দিকে আমরা জানতামই না যে ব্লাড ট্রান্সফিউশন বা ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জের মাধ্যমেও সংক্রমন ছড়ায়। সে সময় আমরা সমকামীদের ঘৃণা করতাম, জানতাম বেশ্যাবৃত্তি ও সমকামিতা নিষিদ্ধ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

 

***

 

দেশে থাকতে কিছু রবীন্দ্রসংগীত শিখেছি, গেয়েছি। হস্টেলে গিয়ে বাঙ্গালী না থাকায় স্নানের সময় ছাড়া গান গাইতাম না। মীনাক্ষির সঙ্গে বন্ধুত্ব হবার পরে ওর সামনে রবীন্দ্রসংগীত গেয়েছি, কিন্তু বাণীপ্রধান হওয়ায় ও মানে বুঝতে পারেনি, সেভাবে উপভোগ করতে পারেনি। তখন রোজই মীনাক্ষির হস্টেলে বেড়াতে যেতাম, বা ও আসত আমার হস্টেলে। ওর একজন রুমমেট ছিলো, রুশ মেয়ে, সে আদ্দেকদিন হস্টেলের ঘরে ফিরতো না। সন্ধে হলেই নানান বন্ধুবান্ধব আড্ডা ইত্যাদি নিয়ে আড্ডা মারা ছিলো নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। মীনাক্ষির প্রচুর বন্ধুবান্ধব, তারা সব নানান দেশের। মাঝে একটি ছেলে বড্ড উৎপাত শুরু করল। নাম বসির, বাড়ী করাচি। সে জানে তাকে আমরা পছন্দ করিনা, তবু সন্ধেবেলা হুট্‌ করে মীনাক্ষির ঘরে চলে আসবে, দরজায় টোকা দেবে। নানাভাবে তাকে বোঝানো হয়েছে ,তবু সে আসবেই। আমি ইচ্ছে করে তার নাম ভুলভাল বলতাম, বসির বলতে গিয়ে রশিদ বলতাম, আরও নানাভাবে তাকে নিয়ে রগড় করা হতো তবু সে নাছোড়বান্দা। সেদিন আমরা ঠিক করেই রেখেছি, বসির এলেই বলব “আমরা তো এখন বেরোচ্ছি” ইত্যাদি। অথচ এত প্ল্যান করার পরে বসির আর আসেই না। না এলেই ভালো, কিন্তু ওকে জব্দ করার প্ল্যান বানিয়েও সেটার প্রয়োগ হচ্ছে না, তাই আমরা একটু টেনশনে ছিলাম। রাত সাড়ে দশটার সময়ে ভাবলাম অনেক আড্ডা হয়েছে, এবার রান্না চড়ানো যাক। সেদিন মীনাক্ষির হস্টেলেই এসব হচ্ছিল যদ্দূর মনে পড়ছে। রান্না করতে গিয়ে দেখা গেলো কিছুই প্রায় নেই ফ্রীজে। তখন আমরা দুজনে মিলে আমার হস্টেলে চলে এলাম। এগারটা নাগাদ রান্না চাপিয়েছি, রান্না বলতে মাংস আর ভাত, ঘরের দরজা হাট করে খোলা কারন বারবার রান্নঘরে যেতে হচ্ছে, হঠাৎ দরজার সামনে দেখি মূর্তিমান হাজির। মীনাক্ষিকে তার ঘরে না পেয়ে এখানে উপস্থিত। পূর্বনির্ধারিত প্ল্যান অনুযায়ী “আমরা তো এখন বেরোচ্ছি…” বলা যাবে না, তাতে রান্না পুড়ে যেতে পারে, কিন্তু আমরা তখন সহ্যের শেষ সীমায়। “কেয়া খানা বন্‌ রহা হ্যায়? গোশ্ত? ” বলে বসির রান্নঘর থেকে একবার ঘুরেও এলো। সে রান্নাঘরে গেলে মীনাক্ষি করুণ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “যোষি কুছ তো কর্‌। ম্যায় বহৎ পরিশান হুঁ”। “কুছ” বলতে যে কী করব আমার মাথায় এল না, এদিকে বসির চেয়ার টেনে বসে খোশগল্প করতে চাইছে। আমাদেরও হাসিহাসি মুখ করে সেই গল্পে তাল ঠুকতে হচ্ছে; এরকম সময়ে আমি চেয়ার থেকে উঠে বুকশেল্ফের দিকে গেলাম। ভাব দেখাতে চাই, যেন অনেক পড়া করতে হবে। যদিও সেই আইডিয়াটা খুব একটা ধোপে টিঁকবে বলে মনে হলো না। আর বসিরও “ও সারে কিতাব ফিতাব ছোড়িয়ে! আইয়ে গপ্‌শপ্‌ করতে হেঁ… ” বলে ডাক দিলো আমাকে। তৎক্ষণাৎ আমার মাথায় আইডিয়া খেলে গেল। দেশ থেকে আনা অখণ্ড গীতবিতানটা হাতে নিয়ে আমি নিজের জায়গায় ফিরে এলাম “রশিদ, গানা সুনোগে?”
বসির তো আনন্দে আটখানা, মীনাক্ষিও চোখ গোল্লাগোল্লা করে আমাকে দেখছে। আমি গীতবিতানের প্রথম পাতা থেকে গান গাইতে শুরু করলাম “কান্না হাসির দোল্‌দোলানো পৌষফাগুনের পালা…” , রসিদ চুপ করে শুনে যাচ্ছে। গানের মধ্যে কথা বলতে নেই, অসভ্যতা। গান শেষ হলে ওয়াঃ ওয়াঃ করল, করে আবার যেই কথা বলতে যাবে, অমনি দুনম্বর গানটা ধরেছি, “সুরের গুরুউউউ…” বসির কথা বলবার জন্যে মুখ খুলেছিলো সেটা খোলাই রয়ে গেল, আমি গাইছি “দা আ ও , দা আ ও, দা আ ও গো সুরের দীইইক্‌খা” মীনাক্ষি কাজ করে চলেছে, স্যালাদ কাটছে, একবার রান্নাঘরে গিয়ে মাংসের ঝোলের সিচুয়েশনটা দেখে এলো। আমি গান গেয়েই চলেছি ” মন্‌দাকিনীর ধারা, ঊষার শুকোওতারা, আ আ আ মন্‌দাকিনীর ধারা আ” বসির চেয়ার থেকে উঠে পড়ল। দরজার কাছে গিয়ে করিডোরে উঁকি মেরে দেখে নিল মীনাক্ষি কোথায়, এদিকে মীনাক্ষি ঘরে এসে প্লেট গুছোচ্ছে তখন বসির আবার চেয়ারে বসতে যাবে, এই মুহূর্তে আমি আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে হস্টেল কাঁপিয়ে , “কোলা হলের বেগে,এ এ” গেয়ে উঠতেই দেখি বসির দরজা দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। গানটা শেষ অবধি গাওয়া হয় নি। খাওয়া দাওয়ার পরেও গভীর রাত অবধি আমাদের হাসতে হাসতে কেশে ফেলে যাতা অবস্থা হয়েছিলো। এর পরে বসির আর আসতই না, এমনকি পথে ঘাটে দেখা হলেও এড়িয়ে যেত। মীনাক্ষি সুযোগ পেলেই, “আরে রশিদ, কাঁহা খো গয়া থা তুম্‌, কভি আয়া তো করো! যোষি রবিন্‌দর সংগীত সুনায়েগি…” বললেই, বসির নিমেষে কোথায় যে উধাও হয়ে যেত কে জানে।

চলবে…

 

 

যোষিতা। লেখক ও কম্পিউটার প্রকৌশলী। জন্ম ও বেড়ে ওঠা উত্তর কলকাতায়। ১৯৮৫ সালে উচ্চশিক্ষার্থে তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নে যাত্রা। প্রাক-পেরেস্ত্রৈকা ও তৎপরবর্তীকাল, সবমিলিয়ে দশ বছর কাটিয়েছেন মধ্যএশিয়ার উজবেকিস্তানে। তিনি সামাজিক প্রথাবহির্ভূত জীবনের পাশবইয়ে জমার অঙ্ক ভরে তুলেছেন বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞান। ১৯৯৫ সালের...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ