বাতিল দৃশ্যাবলী (পর্ব- ৭) নিষিদ্ধ বস্তু

যোষিতা
ধারাবাহিক, নন ফিকশন
Bengali
বাতিল দৃশ্যাবলী (পর্ব- ৭) নিষিদ্ধ বস্তু

মীনাক্ষির সঙ্গে আলাপের পর জিগ্যেস করেছিলাম তোকে পর পর দুবার ইলেকশানের দিনগুলোয় দেখিনি কেন বল তো? ও জানিয়েছিল যে ১৯৮৫ র ইলেকশনের দিন ও ছিল হাসপাতালে, ১৯৮৬ তেও তাই। এত হাসপাতালে যাস কেন? আসলে অক্টোবরের শেষ কি নভেম্বের গোড়ায় প্রতি বছর যখন ইলেকশনের ডেট পড়ে সেটা সীজন চেঞ্জের টাইম। কেন জানি না, ঐ সময়ে ওর হাঁপানি খুব বেড়ে যায়, প্রত্যেকবার। এ দেশে তো আর নিজের বাড়ি বা আপনজন বলতে কেউ নেই, অসুখ করলে হাসপাতালে থাকাই সবচেয়ে নিরাপদ। মীনাক্ষিকে মাঝে মাঝেই হাসপাতালে যেতে হয়। ও প্রথম যখন এদেশে এসেছিল, তখন ডাক্তারির স্টুডেন্ট ছিল মস্কোয়। কিন্তু মস্কোর ঠান্ডায় প্রতিদিন ভোরে মেডিকেল ইন্সটিটিউটে ক্লাস করতে যেতে ওর খুবই কষ্ট হচ্ছিল, মেডিকেলে ক্লাস কামাই করার মাশুল খুব বেশি দিতে হয়। হাসপাতালেই ছিল ও। খবর পেয়ে ওর বাবা চলে এলেন মস্কো, তিনি আবার মীরাট ইউনিভার্সিটির রুশ ভাষা বিভাগের হেড। বাবা এসে মেয়ের এই অবস্থা দেখে বুঝলেন ওকে বাঁচাতে হলে মস্কোর চেয়ে কম ঠান্ডা জায়গায় একটু কম সিরিয়াস বিষয় নিয়ে পড়তে দিলে হয়। চেষ্টা চরিত্র করে মীনাষিকে পাঠানো হল তাশকেন্তে রাশিয়ান ফিলোলজি পড়বার জন্য। সেই থেকে ও তাশকেন্তে রয়েছে, মাঝে এক বছর অসুস্থতার কারনে পরীক্ষাও দিতে পারে নি। তবু মীনাক্ষি দেশে ফিরে যেতে চায় না। এখানে কত জনে কত কুৎসা রটায় ওর নামে, তবু ও এখানেই থাকতে চায়। বড্ড অদ্ভুত লাগে ব্যাপারটা। সব কিছুই তো অদ্ভুত লাগে এদেশে। আসলে তখন ছিল একটা ট্রানজিশন ফেজ, আসতে আসতে আমরা সবাই পালটাচ্ছিলাম, মীনাক্ষিও।

রিসেন্ট ইলেকশানের গল্পটা ওকে বলতে না পেরে আমার শান্তি নেই। তাই বলেই ফেললাম। ১৯৮৬র ইলেকশনের দিন সত্যিসত্যিই হাতাহাতি মারামারি হয়েছিল।

আমরা ইতিমধ্যেই জানি যে যে শহরে দশ পনেরোর বেশি ইন্ডিয়ান ছাত্র আছে সেসবখানে দলবাজি তো মাস্ট বটেই, কিন্তু সে শুধু মুখের কথায় বা প্যাঁদাপেঁদি বা চোরাগোপ্তা হানাহানির স্টেজেই সীমাবদ্ধ থাকে না। তেড়েফুঁড়ে আইনী স্বীকৃতি দাবী করে। ব্যাপারটা খুব অর্গ্যানাইজ্‌ড্‌ভাবে হয়। প্রথমে ছাত্ররা একটা “ইন্ডিয়ান স্টুডেন্ট্‌স্‌’ অর্গ্যানাইজেশন” বানায় তারপরে গোটা দুতিন বা চারেক দলকে তার মধ্যে লড়িয়ে দেয়। যত বেশি দল, তত মজা। শীতের আগেই ইলেকশানের দিন ঠিক হয়ে যায় এবং কোন দল জিতবে এই নিয়ে গরম গরম মারামারি হতে থাকে। এগুলো রেগুলার প্র্যাক্টিস্‌। এম্ব্যাসীর কাছে সব খবরই পৌঁছয়, কিন্তু খুব্যাক্টা খুনোখুনির স্টেজে ঝামেলা ম্যাচিওর করে না। তারপরেই শীত পড়ে যায়, পড়াশুনোর চাপ অল্প বিস্তর বাড়ে, ঠান্ডা, ঝড়, বরফের টাইমে ছাত্ররা অল্প কেলিয়ে পড়ে- তাই শীতের আগেই ইলেকশানের ব্যাপারটা মিটিয়ে নেওয়া হয়। অদ্ভুত সেই বিকেল। চাপা উত্তেজনা। স্ট্যাক করা আছে মালের বোতল ক্যান্ডিডেটদের ঘরে। রেজাল্ট বেরোনোর পরে যেন মালের অভাবে হাপিত্যেশ করতে না হয়।

৮৫ নং হোস্টেলের একতলার হলঘরে তিলধারণের স্পেস নেই। টান টান উত্তেজনা। টোটাল ৫৬ জন ইন্ডিয়ান স্টুডেন্ট ইন্‌ক্লুডিং মী। জয়েন্টলি দুজন ইন্ডিয়ান স্টুডেন্টস্‌ অ্যাসোসিয়েশানের প্রেসিডেন্ট হতে পারে না। এবার হাত তুলে ভোট হবার পরে দেখা গেল রেজাল্ট টাই হয়েছে।

দুই বিজয়ী দল চুপচাপ নিজ নিজ আস্তানায় ফিরে গেল। তারপরে ভোৎকা ফুল চার্জ করে সেই রাতেই বেজে উঠল যুদ্ধের দামামা। ঐতিহাসিক সেই প্যাঁদাপেঁদিকে পাবলিক পরবর্তীকালে “এইট্টিসিক্সের লড়াই” বলে কোট করত। কতোগুলো ফাঁকা মদের বোতল ভাঙ্গা হয়েছিলো তার হিসেব কেউ কষেনি। পুলিশ এসেছিলো কিন্তু বীরপুঙ্গবেরা গা ঢাকা দেওবার ব্যাপারে ছিলো এক একটি ওস্তাদ। কিন্তু প্রবল ভাঙচুর ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমান খতিয়ে দেখতে ইউনিভার্সিটি ও পলিটেকনিকের হত্তাকর্তারা ভারতীয় এম্ব্যাসীকে তলব করে। সে এক গমগমে ব্যাপার।

ফের ইলেকশান। উঁহু, কোনো হোস্টেলের হলঘরে নয়। শহরের তাগড়া থিয়েটারে গদিমোড়া অডিটোরিয়ামে।

স্টেজের ওপরে মখমলের চেয়ারে বসে রয়েছেন ফার্স্ট সেক্রেটারী ও সেকেন্ড সেক্রেটারী মহাশয় যুগল। মস্কো থেকে আগের রাতের ফ্লাইটেই এসেছেন। দুজনেরই নীল সুট পরণে। নীচে দর্শকের আসনে আমরা সবাই, ভোটার ও ক্যান্ডিডেটসকল। সবাই খুব সেজেগুজে এসেছে। শনিবার নয়, তবুও আমাদের প্রত্যেককে ক্লাস থেকে বিশেষ ছুটি দেওয়া হয়েছে। এবারেও বিয়েবাড়ী অ্যাটমস্‌ফেয়ার। দামী শাড়ীর খশ্‌খশ্‌, বাহারী সুট পরা যুবকের দল, যে যত পেরেছে পারফিউম আফটার্শেভ ঢেলেছে। বল্‌বন্‌ৎ তা সত্ত্বেও প্রায় আউট, কোনো কাণ্ডজ্ঞান নেই। বল্‌বন্‌ৎ ভার্সেস রঞ্জনকুমার। টাই হবার চান্স রাখেনি ইন্ডিয়ানরা। ছাপ্পান্নর বদলে ভোটারের সংখ্যা সেদিন সাতান্ন।

কীকরে তা সম্ভব? একজন লুকোনো ভোটার ছিলেন, একজন রিসার্চার। নিজে ভারতীয় কিন্তু বিয়ে করেছে পাকিস্তানীকে, তাই তাকে আগে কেও ডাকত না উৎসবে অনুষ্ঠানে। সেদিন তাকে প্রায় গার্ড অফ্‌ অনার দিয়ে আনা হয়েছিলো। ফার্স্ট সেক্রেটারীর সামনে নিজের নেভি ব্লু পাসপোর্ট দেখিয়ে সেই রিসার্চার নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করে ভোট দিয়েছিলেন।

রেজাল্ট নিয়ে আমরা মাথা ঘামাই নি। রঞ্জনকুমার যে হেরেছিলো তাতেই আমাদের আনন্দ।

সুষ্ঠুভাবে ইলেকশান সম্পন্ন করে মস্কোয় ফিরে যাবার আগে প্রথম ও দ্বিতীয় সচিব নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা দিয়েছিলেন। ছাত্রদের যে পারে জ্ঞান দেয়। তবে একটি লাইন আমার মনে আছে, হুবহু মনে নেই তবে এইরকম- দ্যাখো মদ খেতে বারণ তো করতে পারি কিন্তু তোমরা শুনবে না, তাই বলছি বুঝে শুনে খেও, এদের মতো তাগড়া স্বাস্থ্য তো আমাদের নয়, তাই লিমিট বুঝে খেলেই আর ঝামেলা হয় না।

এটা সম্ভবতঃ ফার্স্ট সেক্রেটারীই বলেছিলেন। করতালিতে ফেটে পড়েছিলো অডিটোরিয়াম। সেবার থেকেই চালু হয়ে গেল গোপন ব্যালট পেপার।

মীনাক্ষির কথা আবার ঘুরে ফিরে আসবে, এখন অনেক পরের অন্য একটা ঘটনা বলি।

সেটা সামার ভেকেশানে দেশে যাবার টাইম। জুলাই ফুলাই হবে। খুব সম্ভবতঃ তখনও সোভিয়েত ইউনিয়ন একটাই দেশ। নাকি জাস্ট ভেঙ্গে গেছে? মনে করতে পারছি না। যাই হোক, সন্ধে সাড়ে আটটা নটার আগে অন্ধকার হয় না তখন। খুব ভাল ওয়েদার। আমাদের ফ্লাইট সেই রাতে, এয়ার ইন্ডিয়ার। আমরা বলতে চারজন। আমি ও আরো তিনটে ছেলে। একজন কাশ্মীরি (আফতাব), আরেকজন দিল্লীর (হরিশ), বাকিজন পোর্ট ব্লেয়ারের (অভি)। কাশ্মীরি ছেলেটা দিল্লীতেই থাকে। পোর্ট ব্লেয়ারের ছেলেটা আবার বাঙালী কিন্তু বাংলা জানে না। সকলে দিল্লীর ফ্লাইটই ধরব। তা সন্ধেটা কাটাচ্ছি মস্কোর পার্ক কুলতুরীর মধ্যে একটা রেস্টুরেন্টে। আমাদের বসবার জায়গা রেস্টুরেন্টের বাইরে খোলা আকাশের নীচে। আফতাব ও আমি নিয়েছি ফ্রেশ স্ট্রেবেরী আইস্ক্রীম উইথ আখরোটের টুকরো। সঙ্গে রয়েছে লেমন জেলি ও পেপ্সি। হরিশ ও অভি আইস্ক্রীম খায় না – খুব ম্যাচো স্বভাবের, তাই বিকেল থেকেই চলছে বিভিন্ন মদ, সঙ্গে টুকটাক স্ন্যাক্স্। হরিশ অভির থেকে সিনিয়র ও যথেষ্ট ঝানু প্রকৃতির। অভির মেন্টরিং করছে হরিশ। মেয়েদের সঙ্গে কিকরে আলাপ করতে হয়, কোন মেয়ে কেমন করে পটাতে হয় সব হরিশের নখদর্পণে, নানারকম টিপ্স্ দিচ্ছে সে ব্যাপারে। এই ট্রিপেই নয়, ওরা বরাবরই একসঙ্গে ঘোরে, নানান মেয়ে ঘটিত অ্যাড্ভেঞ্চারে যায়। অভি বলতে গেলে হরিশের শিষ্য এ ব্যাপারে।

আমি ও আফতাব বাইরে বলে লেকের জল দেখছি, বাচ্চারা দৌড়চ্ছে, চেঁচামেচি, বারের ভেতর থেকে ভেসে আসছে গানের আওয়াজ। ওরা দুটোয় একবার করে গেলাস ভরে মদ নিয়ে আসছে, আমাদের সঙ্গে একটু বসছে, ফের ঢুকে যাচ্ছে রেস্টুরেন্টের ভেতরে। দুজনেরই হাল্কা নেশা হয়েছে। বেশি হাসছে। এবার দুজনে ভেতরে গেল। আফতাব ও আমি জল্পনা করছি, এখানেই ডিনার সেরে ফেলব কিনা। ফ্লাইট সেই রাত্রে। ফ্লাইটে উঠেই ঘুমোবো, মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠিয়ে খেতে দেয় – বড্ড বিরক্ত লাগে। কী অর্ডার দেওয়া যায় ঠিক করে ফেললাম, তবুও হরিশ ও অভির কথা ভেবে অপেক্ষা করছি, ওয়েট্রেসকে ডাকিনি।

দুম করে হরিশ বেরিয়ে এলো ভেতর থেকে – হাতে তুড়ি দিয়ে বলল, – চল্ ইয়ার, অভি নিকাল্তে হেঁ ইধার্সে।

– আরে, ডিনার তো কর্ লে! (আফতাব বলল)

– নেহি ইয়ার, অভি নিকাল্তে হেঁ ফটাফট্।

– ঔর অভি?

– আয়েগা বাদমেঁ। চল্ চল্ এক কাম ইয়াদ আয়া।

হরিশের ভীষণ তাড়া। ঝটিতি পার্ক থেকে বেরিয়ে আমরা ট্যাক্সি নিয়ে নিলাম। সোজা শেরেমিয়েতভো২ এয়ারপোর্ট। পাক্কা চল্লিশ মিনিটের জার্নি।
হরিশের কোন “কাম ইয়াদ” এসেছিল, সেটা জানা হল না। আগে আগে পৌঁছনর জন্যে ভাল পছন্দের সীট পেলাম, আরও বেশ কয়েকটা চেনামুখের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল, তুমুল হুল্লোড় করতে করতে দিল্লীর ফ্লাইটে চেপে প্রায় না ঘুমিয়ে গল্প আড্ডা খাওয়া দাওয়া হাসি ঠাট্টা করতে করতে সময় কাটিয়ে দিলাম। কি অদ্ভুত মানুষ আমরা, একবারও অভি ফ্লাইটে কোথায় বসেছিল, ও ফ্লাইট সময়মতো ধরতে পেরেছিল কিনা সে ব্যাপারে ভাবি নি। জাস্ট ভুলে গেছলাম ওর কথা।

ছুটি কাটিয়ে ফের ওদেশে ফিরলাম। পুরোদমে নতুন সেমেস্টার, নতুন নতুন সাবজেক্ট, নতুন টাইমটেবল, আনন্দময় হোস্টেল লাইফ।

অভি কিন্তু ফেরেনি। সবাই ঠিক সময়ে বা একটু দেরী করে ফিরেছে, কিন্তু একমাস কেটে গেল, দুমাস। অনুপস্থিতির জন্যে ওর নাম কাটা গেছে শুনলাম ইন্স্টিটিউটের খাতা থেকে।

– ভেরি স্যাড্ ইয়ার!

– শায়দ শাদি করকে সেট্ল্ হো গিয়া উধার্।

– লওন্ডিবাজি খতম্।

– আজীব সা বান্দা হ্যায়!

নানান রকমের কমেন্ট করে ছাত্ররা।
ধীরে ধীরে অভিকে আমরা ভুলে গেলাম। কিন্তু একটা অদ্ভুত ব্যাপার নাকি লক্ষ্য করা গেছল যেটা কয়েকবছর পরে (চার বছর পরে) শুনেছিলাম। ইন্ডিয়ান এম্ব্যাসীর একতলার সেই বিরাট টেবিলটাতে ভারতীয় ডাকের অঁভলপে অভির নামে চিঠি আসত পোর্ট ব্লেয়ার থেকে। ভায়া ডিপ্লোম্যাটিক ব্যাগ, সাউথ ব্লক, নিউ ডেলি। অনেকের বাড়ী থেকেই সস্তার পোস্টেজে ডিপ্লোম্যাটিক ব্যাগে চিঠি আসত। তারাই দেখতে পেত অভির চিঠি পড়ে আছে।

-মালটা গেল কোথায়?

-বাড়ীর লোকে ভাবছে ও এখনো পড়ছে, এদিকে ও হয়ত অন্য কোনো শহরে গিয়ে হেভি মাগিবাজি করছে।

ঠিক এইরকমই রিয়্যাক্শন্ ছিলো অনেকের। কিন্তু ঐ অবধিই। তারপরে আমরা ভুলে যেতাম।

হরিশ খুব ঘন ঘন মস্কো যেত তখন। ওখানে ওর রাশিয়ান গার্লফ্রেন্ড ছিলো, মেয়ে ছিল। অন্যান্য ধান্দাও ছিল – কেমন করে সেট্ল্ করবে, বিজনেস করবে, এসমস্ত।

দেশে ফিরে আসার এক সপ্তাহ আগে হাড় হিম করা একটা খবর শুনেছিলাম। একটা বাংলাদেশি ছেলে এসে আমাকে বলে গেছল। হরিশ নাকি মদের ঝোঁকে কন্ফেস করেছে। সেই ক বছর আগে পার্ক কুলতুরীর রেস্টুরেন্টে ওর সামনে অভি খুন হয়ে যায়। একটার পর একটা মদ কিনছিল ওরা। ঘুরছিল হাসছিল, মেয়ে পটাবার চেষ্টা করছিলো। এমনি একটা মেয়েকে গিয়ে পটাবার চান্স নিয়েছে, দূর থেকে লক্ষ্য রাখছিল মাফিয়া। সেই মেয়ে মাফিয়ার গার্লফ্রেন্ড। দুজন হেফ্‌টি লোক এল, অভিকে জাস্ট ঝুলিয়ে নিয়ে গিয়ে দেয়ালে মাথা থেঁতলে দিল, তারপরে কোনো রিস্ক না নিয়ে রিভলভার বের করে কাছ থেকে মাথায় গুলি।

ভেতরের গান বাজনা, খাওয়া দাওয়া এতে এক সেকেন্ডের জন্যেও থামেনি। হরিশ তাড়াতাড়ি বাইরে বেরিয়ে এসে আমাদের নিয়ে তড়িঘড়ি এয়ারপোর্ট চলে যায়। আমরা বাইরেই বসে আইসক্রীম খচ্ছিলাম – দশ মিটারেরও কম দূরত্বে একটা খুন হয়ে গেল, কিছু বুঝতেই পারলাম না।

দেশ তখনও জোড়া। একত্র। এমন সময়ে ওদেশে মা কে নিয়ে এসেছিলাম বেড়াতে। যা হয় আরকি, দেশ থেকে আত্মীয় স্বজন এলে স্থানীয় দেশের নেটিবদের বাড়িতে ডেকে ডেকে নেমন্তন্ন করে খাওয়ায় দাওয়ায়, গল্প করে।

ফ্লোরা নামের এক ভদ্রমহিলার বাড়িতে তেমনি এক সন্ধ্যায় ভুরিভোজের নিমন্ত্রন ছিলো। ফ্লোরা আমাদের ইন্সটিটিউটের বিদেশিদের ফ্যাকাল্টিতে একাধারে ক্লার্ক এবং ক্যাশিয়ার। প্রথমে অল্প চা মিষ্টি নোনতা, তারপরে ডিনার, সবশেষে খোশগল্প। সেইসময়ে ফ্যামিলি ফোটোর অ্যালবাম দেখাচ্ছিলো ফ্লোরা। এক এক করে সব ফোটো দেখাচ্ছে ও চিনিয়ে দিচ্ছে কে কোনজন। বিরাট ফ্যামিলি একান্নবর্তী পরিবার। সেই পরিবারের সকলেই হাসি মুখে আমাদের সঙ্গ দিচ্ছিলেন। এরা খুবই অতিথি বৎসল জাত। তাশকেন্তের পুরোনো শহরে সামারকান্দ দার্ভাজা বলে একটা জায়গায় ফ্লোরাদের বাড়ি। সে বাড়ির বাইরে পাঁচিল তোলা, বাইরের দিকে কোনও জানলা নেই। ফ্লোরার দিদি ও জামাইবাবুর ফোটো দেখলাম। তারা সেদিন সেখানে উপস্থিত ও ছিলেন তাই চাক্ষুষ মানুষগুলোকেও দেখলাম।

অ্যালবামে আরও একজনের ফোটো আছে, সেই দিদির সঙ্গেই যেন মনে হলো। ফ্লোরা পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে সেই ফোটোর সঙ্গে – দিদি জামাইবাবু। খটকা লাগছে- দিদি তো একজনই কিন্তু জামাইবাবুর ছবিগুলো মনে হচ্ছে দুজন আলাদা মানুষের। একদম আলাদা মুখ। আমার মনের ভাব আঁচ করে নিয়ে সে বলেছিলো – পরে কখনও বলব।

এরপরে ফ্লোরাকে আমার পাল্টা নিমন্ত্রণ করবার পালা। সেই নিমন্ত্রণরক্ষার্থে এসে সে তখন ঐ ফোটোর কনফিউশান দূর করে দেয়।

বেশ কিছু বছর আগে দিদির বিয়ে হয়েছিল সেই জামাইবাবুর সঙ্গে, যাঁকে শুধু ফোটোয় দেখলাম। এর কিছুদিন পরে এরা দল বেঁধে ভ্লাদিভস্তকে বেড়াতে যায়। দিদি জামাইবাবু ফ্লোরা নিজে আরও দুজন ভাই মা এক কাকা অনেকে মিলে। খুবই আনন্দে ঘুরে বেড়িয়ে সময় কাটছিল। অদ্ভুত সুন্দর সেই দ্বীপ। খুবই ঝলমলে আনন্দের পরিবেশে গান বাজনা রেস্টুরেন্টে খাওয়া দাওয়া করে এনজয় করছিল ওরা সকলে। এক সন্ধ্যায় ওরা সবাই রেস্টুরেন্টে খেতে গেছে। এক সময় জামাইবাবু টয়লেটে গেল। ওরা সব খাচ্ছে তখন ডেসার্ট। মোটামুটি হাল্কা নেশাও হয়েছে। চমৎকার বাজনা বাজছে। ডেসার্ট শেষ হয়ে গেল, বাজনা একটার পর একটা হয়ে যাচ্ছে, বিল চোকানোর সময় এসে গেছে- বিল জামাইবাবুই ভরবে – সে আর টয়লেট থেকে ফেরে না। লোকজ্ন অপেক্ষা করছে তো করছেই। শেষে টয়লেটে গিয়ে খোঁজা হল। টয়লেটে খুঁজে তাকে পাওয়া গেল না, রেস্টুরেন্টের বাইরে, আশেপাশে কোত্থাও না। গ্রীষ্মের সন্ধ্যা। ক্রমশ অন্ধকার নেমে এল, জাহাজের আলোগুলো জেগে উঠছে একে একে অন্ধকার সমুদ্রের দিক থেকে। মিলিৎসিয়াকে খবর দেওয়া হল। খোঁজ খোঁজ রাস্তায় হাসপাতালে সর্বত্র। তারপরে গোটা সোভিয়েত ইউনিয়নে আর কোনোদিন তাকে খুঁজে পাওয়া যায় নি। নিরুদ্দেশ। তবে এই নিরুদ্দেশের ঘটনাকে জাস্টিফাই করবার সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য যে গল্পটা ওরা মেনে নিয়েছিল সেটা হচ্ছে – কোনও কারনে মাফিয়ার হাতে মৃত্যু হয়েছে জামাইবাবুর। মাফিয়ারা নাকি এমন করে। খুন করে ফেলে দেয় সমুদ্রে। এমন নাকি আরও হয়েছে সেই জমানায়।

অভিও ওরকম নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। ভ্যানিশ। মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া না গেলে তো আর মৃত বলে অত সহজে ঘোষণা করে দেওয়া যায় না। খুন বা অস্বাভাবিক মৃত্যুর দায় কোনও রাষ্ট্র নিতে চায় না। বিদেশি হলে তো আরওই না। মানুষগুলো নিরুদ্দেশ হয়ে যায়।

ওদেশে পড়তে যাবার আগে বা পরে সব দেশের সব ছাত্রদের তো উদ্দেশ্য অভিন্ন থাকে না। কেউ সোভিয়েত দেশটাকে ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করে আরও পশ্চিমে পাড়ি দিতে চায়, কেউ পড়াশুনো শেষ করে দেশে ফিরে সুখে বাকি জীবনটুকু অতিবাহিত করবার কথাও ভাবে, কেউ ওদেশেই থেকে যেতে চায় বিয়ে থা করে- এই আশায় আশায় যে শীঘ্রই ওখানকার অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে, তৈরী হবে ব্যক্তিগত মালিকানার কনসেপ্ট।

ব্যবসা বানিজ্য করে ওখানেই ব্যক্তিগত সম্পত্তি বাড়ি ইত্যাদি করা যাবে। পেরেস্ত্রৈকার কিছু না কিছু সুফল তো হওয়া উচিৎ। অন্ততঃ এইটুকু, যেখানে “নিজের” বলে কিছু থাকবে।

এই চাওয়াগুলো কি অস্বাভাবিক? ঐ দেশটার প্রত্যেকটা মানুষও কি এগুলো চায় নি যে নিজস্ব বা ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলে তাদেরও কিছু থাকবে, যেখানে ঊর্দ্ধসীমা বেঁধে দেবে না রাষ্ট্র, যেখানে সমস্ত কিছুই লুকিয়ে লুকিয়ে জমাতে হবে না। সেই জমানোটা তো শুধু টাকা পয়সা বাড়ি গাড়ি জমি গয়না নয়, হয়ত কোনও গোপন বিশ্বাস, ভালোবাসা, আস্থা, যা হয়ত হতেও পারে ঈশ্বরের প্রতি। ঊনিশশো সতেরো থেকে সেই সফল বিপ্লবের পর থেকে প্রকাশ্যে ধর্মাচরণ তো নেই, সত্তর বছর কেটে গিয়েছে, তিনটে কি চারটে জেনারেশন দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর বেড়ে উঠেছে, বেঁচে বর্তে রয়েছে এমন পরিবেশে যেখানে প্রকাশ্যে ধর্মাচরণ হয় না। নিষিদ্ধ বলিনি কিন্তু, তবে হয় না। কোনও ধর্মীয় উৎসব বা ছুটি নেই।

মীনাক্ষির ঘরে অনেক গোপন জিনিস আমি দেখে ফেলেছিলাম নানান সময়ে। ইচ্ছে করে বা উঁকি ঝুঁকি দিয়ে নয়, এমনিতেই চোখ চলে যেত। হয়ত মুখে কিছুই বলিনি, কিন্তু আমার চোখ চলে যাওয়াটাকে অনুসরণ করে প্রত্যেকবার ও কেমন যেন ধরা পড়ে যাবার মত অস্বস্তিতে ভুগত। প্রত্যেকবারই ও নিজে থেকেই যুক্তি দিয়ে ব্যাপারটা বোঝাতে চাইত, কেমন করে সেই সব নিষিদ্ধ আইটেম ওর ঘরে এল এসব জাস্টিফাই করতে আপ্রাণ চেষ্টা করত। অথচ আমি কিন্তু কোনও দিনই কোনও জাস্টিফিকেশন চাই নি। আমার চোখে বা বিশ্বাসে ঐ সব আইটেম নিষিদ্ধ মনে হতো না। কিন্তু তা বোঝালেও কি বুঝবে মীনাক্ষি! ওর মনে প্রাণে তখনও অনেক অনেক সংস্কার, যেগুলোকে ও না পারছে রাখতে না পারছে ফেলতে। ফেলতে গেলে বুকের ভেতরটা ফাঁকা হয়ে যেতে পারে, রাখতে গেলে কাঁটার মত সর্ব শরীরে বিঁধবে, কোথায় যাবে ও তখন? যদি একটি বারের মতও এটুকু বিশ্বাস করত যে আমি মুখে যা বলছি, মনে মনেও সেটাই মীন করছি, তাহলে আমাদের বন্ধুত্ব হয়ত বিষিয়ে উঠত না। নিষিদ্ধ জিনিস কি একটা? একবার দেখতে পেয়েছিলাম ছেঁড়া মত একটা প্লাস্টিকের মোড়ক, সেটা হাতে তুলে নিয়ে ফেলে দিতে যাচ্ছি, ও এমন করে তাকাল আমার দিকে যে মোড়কটা ফেলবার আগেই দেখে ফেলতে পারলাম যে ওটার গায়ে কয়েকটা অক্ষর লেখা আছে, প্রিজারভেটিভ – বাংলায় কন্ডোম। ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে গেল জাস্টিফিকেশনের গল্প। যতই স্মার্ট নিজেদের মনে করি না কেন, পেট থেকে পড়বার পরে যে সমাজে বেড়ে উঠেছি সেখানে অবিবাহিত মেয়ের ঘরের কোণে কন্ডোমের মোড়ক পাওয়া আশির দশকের শেষ ভাগে প্রচলিত অনুশাসনের সঙ্গে খাপ খায় না। সে তো নিষিদ্ধ আইটেমই বটে। আরেকবার দেখতে পেয়েছিলাম একটা বই। বইটার সবুজ রঙের মলাট।

চলবে…

যোষিতা। লেখক ও কম্পিউটার প্রকৌশলী। জন্ম ও বেড়ে ওঠা উত্তর কলকাতায়। ১৯৮৫ সালে উচ্চশিক্ষার্থে তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নে যাত্রা। প্রাক-পেরেস্ত্রৈকা ও তৎপরবর্তীকাল, সবমিলিয়ে দশ বছর কাটিয়েছেন মধ্যএশিয়ার উজবেকিস্তানে। তিনি সামাজিক প্রথাবহির্ভূত জীবনের পাশবইয়ে জমার অঙ্ক ভরে তুলেছেন বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞান। ১৯৯৫ সালের...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

প্যাটাক্যুয়রিক্যাল নাইটশোয়ে আপনাকে স্বাগতম (পঞ্চম পর্ব )

প্যাটাক্যুয়রিক্যাল নাইটশোয়ে আপনাকে স্বাগতম (পঞ্চম পর্ব )

ইংরেজি ভার্সান এখানে >>> Welcome to the Pataquerical Night Show (Episode-5) পূর্ববর্তী পর্ব এখানে>>> শেষ…..