বাতিল দৃশ্যাবলী (পর্ব-১) হোয়াইটনার

যোষিতা
ধারাবাহিক, নন ফিকশন, পডকাস্ট
Bengali
বাতিল দৃশ্যাবলী (পর্ব-১) হোয়াইটনার

বাতিল দৃশ্যাবলী

প্রিয় পাঠক,

শুরু করতে চলেছি ধারাবাহিক ‘বাতিল দৃশ্যাবলী‘, মূলতঃ ইদানীংকালের সিনেমার শেষে যেমন ‘ডিলিটেড সীনস‘ দেখানোর ব্যবস্থা আছে, সেই রেওয়াজ মেনে। এর মধ্যে থাকবে টুকরো টুকরো ঘটনা বা চরিত্র। লঘু-গুরু ভেদাভেদ না মেনে হালকা বা গভীর সবরকম লেখাই রাখতে পারব আশা করছি। দৈর্ঘেরও কোনও নির্দিষ্ট মাপ রাখতে চাই না, ছোট-বড়-মাঝারি নানান মাপের হবে এক একটি পর্ব। আমার জীবনের বেশকিছু বছর কেটেছে সোভিয়েত দেশে, মোটামুটি দশ বছর- ১৯৮৫ থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত। এই সময়কালের মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গিয়ে যেমন গোটা পনের স্বাধীন রাষ্ট্রের পুনর্জন্ম হয়, তেমনি ঘটনাবহুল ছিল সেই সময়কাল। আমি সেই সময়ে উচ্চশিক্ষার্থে ভারত থেকে ওইদেশে গিয়েছিলাম। সেই সময়কার অভিজ্ঞতা দিয়েই শুরু হোক প্রথম পর্ব।

 

গল্পের অডিও শুনুন এখানে:

ইউটিউবে-

প্রথম পর্ব – হোয়াইটনার

তখন সোভিয়েত দেশ অবিভক্ত। ভারতীয় নাগরিক তথা ছাত্রী হিসেবে মধ্য এশিয়ার তাশখন্দ থেকে সুদূর মস্কোয় অবস্থিত ভারতীয় দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ রাখাটা ছিল খুবই জরুরি। নানান ব্যাপারে দূতাবাসের প্রয়োজন পড়ত। পাসপোর্ট রেজিস্ট্রেশন হোক কি পাসপোর্ট রিনিউ, ফরেন কারেন্সি থেকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, নানান রকমের নো-অবজেকশন সার্টিফিকেট বা কোনও ছাত্র-ছাত্রী মারা গেলে তার মৃতদেহ দেশে পাঠানো, অল্প খরচে দেশে চিঠিপত্রের আদান-প্রদান, ভারতীয় ছাত্রদের মধ্যে অন্তর্কলহের মীমাংসা, স্বাদেশিকতাবোধে উদ্বুদ্ধ করা, এইরকম বিবিধ কার্যকলাপে এমব্যাসি আমাদের অভিবাবকের ভূমিকা পালন করত। সেই সময়ে যেমন ভারতে সবার ঘরে ঘরে টেলিফোন ছিল না, তেমনি চিঠিপত্রের জন্য ডাকমাশুলও নেহাৎ কম পড়ত না। চিঠির আসতে যেতে সময়ও লাগত বিস্তর। আমরা থাকতাম মধ্য এশিয়ায়, কিন্তু কলকাতা থেকে চিঠিপত্র পেতে কি পাঠাতে একতরফেই কমপক্ষে পনের দিন সময় লেগে যেত। খুব জরুরি খবর দিতে বা পেতে হলে একমাত্র উপায় ছিল টেলিগ্রাম। সেই টেলিগ্রাম এখন ইতিহাস। মোবাইল ফোন বা ইমেইল তখনও চালু হয় নি।

অতবড় দেশের নানান প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল ভারতীয় ছাত্রেরা, তারা বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিতে বা ইন্সটিটিউটে পড়াশুনো করছে। মস্কো অনেকের জন্যই বেশ দূরে। এসব কথা বিবেচনা করে, এবং সোভিয়েত দেশের বাসিন্দাদের ভারতে যাবার ভিসা ইত্যাদির সুবিধার্থে, মধ্য এশিয়ায় তাশখন্দ শহরে একটা কনসুলেট খোলা হল, শহরের মধ্যিখানে একটা দোতলা বাড়ী ভাড়া নিয়ে।

১৯৮৭র বসন্তকাল। যেসব ভারতীয়রা তাশখন্দে থাকতাম, তখনও পর্যন্ত সকলেই ছাত্রছাত্রী। হাতে গোনা দুএকজন ছিলেন শহরে যাঁরা ছাত্র নন। কেউ হয়ত অনুবাদক, কেউ বেতার বা টেলিভিশনের সঙ্গে যুক্ত। সদ্য খোলা কনসুলেটের লোকজনদের নতুন দেশ সম্পর্কে অকাতরে উপদেশ দিতে কি সাহায্য করতে অনেকেই এগিয়ে গেল। ভাষা একটা সমস্যা। সোভিয়েত দেশে দৈনন্দিন জীবনে ইংরিজি ভাষা চলে না, এবং ভারতীয় কূটনৈতিক মিশনের কেউই রাশিয়ান ভাষা শিখে আসেন নি।

সেই সময় কনসুলেটে অফিস গোছানোর কাজ চলছে। ভারতীয়রা মামার বাড়ীর আবদারের মতো সেখানে যখন খুশি ঢুকছে বেরোচ্ছে, আড্ডা দিচ্ছে। একতলায় বড়ো হলঘরটা হাসি মশকরায় গমগম করছে। দারোয়ান কাম চাকর একজন লোক, একজন পিয়ন, একজন ভাইস কনসাল ও সপরিবারে কনসাল জেনারেল – তাঁর ছোটো পরিবার। এরা ছাড়াও একজন স্থানীয় উজবেক যুবককে হামেশা দেখা যেত, সে সম্ভবত দোভাষীর চাকরির চেষ্ঠায় উমেদারি করতে ওখানে যাতায়াত করত। ক্রমে সে চাকরিতে বহাল হবে, তার ক্ষমতাবৃদ্ধি হবে, ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু সে প্রসঙ্গ অন্য, কনসুলেটের কাজ পুরোদমে চালু হয় নি। চালু হয়ে গেলে তখন আমাদের মধ্যে কে কে পাত্তা পাবে, কে কে বিশেষ সুবিধা পাবে, সেই নিয়ে আমাদের নিজেদের মধ্যেই চোরা কম্পিটিশন চলত। নিজেদের পড়াশোনা, খাওয়াদাওয়া রান্নাবান্না, বিনোদন, ইত্যাদির থেকে সময় বাঁচিয়ে অনেকেই চেষ্টা করতাম যতটুকু সম্ভব কনসুলেটে যাতায়াত করে নিজের গুরুত্ব প্রমাণ করতে।

সরকারি কাজকর্ম সেখানে অল্প অল্প করে শুরু হলেও, ওখানে গিয়ে আমরা স্টুডেন্টরা মূলত ভাইস কনসাল ও কনসাল জেনারেল-এর সঙ্গে গল্প আড্ডা করতাম। না ছিল কোনও ভিজিটিং আওয়ার, না ছিল কারোর চোখ রাঙানি। কনসাল জেনারেলসাহেবের কে কত বেশি খাতিরের লোক, সেই নিয়ে কলার তুলে তৃপ্তি পাবার একটা ফ্যাশন চালু হয়ে গেল।

ওঁরা অবশ্য চিঠি পার্সেল কাগজ বাক্স এসব গোছাতেই ব্যস্ত থাকতেন, পাশেই কনসাল জেনারেল -এর রেসিডেনশিয়াল অ্যাপার্টমেন্ট। মাঝে মধ্যে তাঁর স্ত্রী ও পাশের দরজার পর্দা সরিয়ে ধীর পদক্ষেপে এদিকে এসে আমাদের সঙ্গে আড্ডায় যোগ দিতেন, আমরা তাঁকে ম্যাডাম সম্বোধন করে সম্মান জানাতাম। আমরা যারা ওঁদের সঙ্গে একটু বেশি খাতির জমাতে পেরেছিলাম তারা পর্দার ওপাশে  বৈঠকখানায়ও ঢুকে পড়তাম হাসিহাসি মুখ করে। সেই বৈঠকখানায় ঢুকলেই কেমন একটা স্বর্গীয় গন্ধ। স্বর্গে কী ধরণের পারফিউম ব্যবহার হয় জানা নেই, তবে সেই বৈঠকখানায় যে গন্ধটা পাওয়া যেত তা চন্দনের গন্ধের সঙ্গে নাম না জানা কোনও একটা ফুলের মিষ্টি গন্ধ মিলে মিশে একাকার। সে ঘরে সমস্ত মেঝেটাই দামি কার্পেটে মোড়া, অপূর্ব সুন্দর টি-সেট ট্রেতে করে নিয়ে কাশ্মিরী কাজ করা টিপাইয়ের ওপর রেখে যেত বেয়ারা। আমরা হস্টেলের জীবনে খুব বেশি চায়ে আসক্ত হতে পারি নি। চায়ের চেয়েও বেশি অভ্যস্থ ছিলাম ভোদকা ইত্যাদি অ্যালকোহল সমৃদ্ধ পানীয়ে। তবে এই বৈঠকখানায় এক কাপ চা খেতে পারার সুযোগকে অমৃতের স্বাদ নেবার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। সোনালি দার্জিলিং টি স্বচ্ছ পোর্সিলেনের কাপে কাপে ঢেলে দিতেন কনসাল জেনেরালের স্ত্রী।

ঐজন্যই বিকেলের দিকটায় ঐখানে যাবার জন্য আমরা উশখুস করতাম। অভিজ্ঞতা থেকে জেনেছি যে অফিস আওয়ার শেষ হয়ে আসার সময়টাতেই খোশগল্প জমে ওঠে। তো একদিন অম্লান বদনে আমরা তিন বন্ধু বিকেলের দিকে কনসাল জেনারেল-এর অফিস ঘরে ঢুকে দেখলাম তিনি নেই, হয়ত কোনও কাজে বেরিয়েছেন কি রেসিডেন্সে গেছেন। তখন সেই ঘর পেরিয়ে ভেতরের দরজা দিয়ে ঢুকে গেলাম ভাইস কনসাল এর ঘরটায়। সে ঘরটা অপেক্ষাকৃত ছোট।

ঘরে ঢুকতেই ভাইস কনসাল ভদ্রলোক আমাদের দেখে কেমন হকচকিয়ে গেলেন। ঝট করে পেছন ফিরে দেয়ালের দিকে চলে গেলেন। তার পরে সেখানেই পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে রইলেন দুটো হাত শরীরের সামনের দিকে জড়ো করা, কেমন যেন অপ্রস্তুত উনি।

এরকম কাণ্ড দেখে ভ্যাবাচাকা খেয়ে আমাদেরও “ন যযৌ ন তস্থৌ” সিচুয়েশন। দু-এক সেকেন্ড থমকে থেকে, অপ্রতিভ হয়ে ঐ ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।

ঘরের বাইরে বেরিয়েই কিন্তু আমাদের ডিটেকটিভ মনে সন্দেহ ঘনিয়ে উঠল। লোকটা হঠাৎ অত ঘাবড়ালো কেন? কেনই বা আমাদের দেখামাত্র মুখ ঘুরিয়ে দেয়ালের দিকে চলে গেল? আমাদেরকে ফেস করতে ভয় পাচ্ছিলো? কোনও ইল্লিগাল কাজ করছিল কি যে মুহূর্তে আমরা ঢুকেছিলাম ঐ ঘরে? মহান ভারতের নাগরিক হিসেবে আমাদের কি কর্তব্য নয় লোকটাকে হাতেনাতে ধরে ফেলা? নাঃ আবার যাওয়া যাক ভেতরে, চুপি চুপি।

সামান্য জল্পনা সেরে নিয়েই পা টিপে টিপে আমাদের প্রত্যাগমন। দরজার আড়াল থেকে সন্তর্পনে উঁকি মেরে দেখা গেল তিনি তখনো দেয়ালের দিকে ফিরে (আমরা শুধু পেছনটা দেখতে পাচ্ছি) হাত দিয়ে সামনে কিছু করছেন, হাত নড়ছে দ্রুত, যদিও কী করছেন সেটা আমরা পেছন থেকে দেখতে পাচ্ছি না। হাইলি সাসপিশাস! পেছন থেকে লাফ মেরে জাপটে ধরব নাকি?

আমাদের মধ্যে সাহসী একজন ডেকে উঠল, স্যার!

— উঁ?
— হাম ওয়েট করেঁ?
— নো…

উনি ক্ষীণস্বরে উত্তর দেওয়ামাত্র আমরা এগোতে শুরু করেছি হাতেনাতে পাকড়াব বলে।

— আর ইউ শ্যুয়োর স্যার?

— হাঁ, মানে অ্যাকচুয়ালি ছোটাসা প্রবলেম হ্যায়…
— হেল্প চাহিয়ে?
এবার তিনি বাধ্য হয়ে আমাদের দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন, হাতে পেপার ন্যাপকিন, তা দিয়ে প্যান্টের জীপারের কাছটা ঢেকে রেখেছেন। তড়িঘড়ি কারেকশান হোয়াইটনারের শিশি খুলতে গিয়ে তার অনেকটাই পড়েছে প্যান্টের সামনে, শিশিটাও দেখলাম কাত হয়ে পড়ে রয়েছে টেবিলে। মুছেই চলেছেন, মুছেই চলেছেন, তাতে সাদা রং আরও ছড়াচ্ছে।

আমাদের মধ্যে সতীশ (সতীশ ভাটিয়া) অপরিসীম গাম্ভীর্যসহ বলল, আইয়ে স্যার ধো লিজিয়ে।

পাশেই টয়লেট, ভদ্রলোক সেখানে ঢুকে গেলেন, পেছনে পেছনে সতীশ চলল হেল্প করতে।

 

চলবে…

যোষিতা। লেখক ও কম্পিউটার প্রকৌশলী। জন্ম ও বেড়ে ওঠা উত্তর কলকাতায়। ১৯৮৫ সালে উচ্চশিক্ষার্থে তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নে যাত্রা। প্রাক-পেরেস্ত্রৈকা ও তৎপরবর্তীকাল, সবমিলিয়ে দশ বছর কাটিয়েছেন মধ্যএশিয়ার উজবেকিস্তানে। তিনি সামাজিক প্রথাবহির্ভূত জীবনের পাশবইয়ে জমার অঙ্ক ভরে তুলেছেন বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞান। ১৯৯৫ সালের...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ