ইমন কল্যাণ
পরিচ্ছেদ ৬ অনেক রাতে ফিরেছিল কল্যাণ ওরফে শহীদুল।গাড়িটা শেডে রাখার পর দু’বার হালকা করে মা…..
কবিরের মতো রায়নার বাবা মাও চেয়েছিল অর্ক যেন পৃথিবীর আলো না দেখে, রায়নাকে বারবার জিজ্ঞাসা করেও উনারা রায়নার সন্তানের বাবা কে জানতে পারেননি। যে মানুষটা এতোগুলো বছরের অপেক্ষার পর ক্যারিয়ারের উন্নতি আর জীবনে সহজ সম্পদ অর্জনের হাতছানি পেয়ে এক মুহূর্তে সবকিছু অস্বীকার করে চলে গেল তাকে পেছনে টেনে ধরার কি দরকার, যাক না, রায়না সবসময় দোয়া করবে ও জীবনে যা চায় তাই যেন পায়। শেষে বাবা মা বলেছেন রায়না যেন আর বাড়িতে না যায়, অবিবাহিত মেয়ে সন্তানসম্ভবা সমাজে উনারা কিভাবে মুখ দেখাবেন। মামুন রনি বলেছিল সত্যিটা জানাতে, রায়না ওদের নিষেধ করেছে। পোস্টিংটা মুন্সিগঞ্জে হওয়াতে ও হাঁফ ছেড়ে বাঁচল, জয়েন করার পর বন্ধুরা এসে দেখে গেছে, ওরাও নিজেদের জীবন গুছাতে উঠে পড়ে লেগেছে, অর্ক জন্মানোর অল্প কিছুদিন আগে রনি আর কামরুল কানাডার সাস্কাচুয়ান ইউনিভার্সিটিতে পড়তে চলে গেল, পরের সেমিস্টারে মামুন চলে যাবে ইউনিভার্সিটি অব আলবার্টা তে।
মেটারনিটি ছুটি শেষে দুমাস ছাব্বিশ দিন বয়সের অর্ককে সালেহা খালার তদারকিতে রেখে রায়নাকে হাসপাতালের কাজে ফেরত যেতে হলো। সালেহা খালা না থাকলে অর্ককে রেখে কাজ করা রায়নার কঠিন হয়ে পড়ত যদিও কাজের ফাঁকে সময় পেলে বা দুপুরের খাবারের সময় এক ছুটে গিয়ে এক পলকের জন্য হলেও অর্ককে দেখে আসতে না পারলে ওর বাকিটা দিন অস্থিরতার মধ্যে কাটত। সালেহা খালা শুধু অর্ককেই দেখে রাখতো না রায়নার দেখাশুনাটাও খুব ভালোভাবে করত, দরকার হলে বকাঝকাও করত। বিধবা মানুষটা রায়নার মায়ের অভাব পূরণে কোন ঘাটতি রাখে নাই।
বৃষ্টির দিন অথবা রোদেলা বিকেল, নদীর পার অথবা ধান ক্ষেত, ছুটির অলস দিন অথবা পূর্ণিমার রাত গুলোতে নিজের অজান্তেই কবিরের কথা মনে পড়ে যায়, কেমন আছে মানুষটা, সাত সমুদ্রের পারে নিশ্চয়ই অনেক অনেক ভালো আছে, ভালো থাক।
পড়াশুনার পাট চুকিয়ে রনি আর কামরুল মাঝখানে দেশে এসে বিয়ে করে গেল, কিভাবে যেন চাকরীর সুবাদে রায়না ছাড়া তিন বন্ধু এখন একই শহরে, ছুটির দিনগুলোতে চলে আড্ডা আর সেই আড্ডার অংশ হয় রায়না স্কাইপিতে।
অর্কর দিকে তাকালে রায়নার মনে হয় ওর জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া হলো ওর এই ছেলেটা, কবির নিজে ওর জীবন থেকে চলে গেলেও ওকে সবচেয়ে দামী উপহার দিয়ে গেছে, ভাগ্যিস সেই দিন ঝড় বৃষ্টি হয়েছিল তানাহলে তো ওর অর্ককে পাওয়া হতো না। এক জীবনে সবকিছু পেতে হবে এমন কোন কথা নেই, পেলে ভালো না পেলেও কোন সমস্যা নেই, যা আছে তা নিয়ে ভালো থাকাটাই সবচেয়ে জরুরী। অর্ককে বড় করা আর মন দিয়ে রোগীদের সেবা করাটাই এখন রায়নার জীবনের লক্ষ্য। মুন্সিগঞ্জ থেকে মানিকগঞ্জ হয়ে রায়নার পোস্টিং এখন সাভারে। সালেহা খালা ওদের সঙ্গে এখনো আছে, থাকা খাওয়া ছাড়া খালা কোন টাকা পয়সা নিতে চায় না বলে মুন্সিগঞ্জে খালার নামে ছোট্ট একটুকরো জমি কিনে দুরুমের একটা বাড়ী করে ভাড়া দিয়েছে, ভাড়ার টাকাটা খালার নামে করা ব্যাংক একাউন্টে জমা হয়, স্বজন ছাড়া মানুষটা নিজেকে যেন সহায়সম্বল হীন না ভাবে তাই এই কাজ করা, রায়না আর অর্কর জীবনে এই মানুষটার অনেক অবদান। এরই মাঝে রায়না বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজে পরের ধাপের পড়াশুনা শুরু করে দিয়েছে।
এক ছুটির দিনের স্কাইপি আড্ডার সময় মামুন বলল তুই ইমিগ্রেশন এর জন্য আবেদন কর না বুড়ি, ওখানে একা একা আছিস, চলে আয় চার বন্ধু ছোটবেলার মতো এক শহরে থাকব। বাকিরাও মামুনের প্রস্তাবে সায় দিল। রায়না বলল সে তো অনেক ঝামেলা, এতো কিছু সামলে কি করে করব, এইতো ভালো আছি সপ্তাহান্তে তোদের সঙ্গে কথা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওদের যুক্তির কাছে হার মেনে কাগজ পত্র গুছানো শুরু করল, সার্টিফিকেটের এসেসমেন্ট আর আই ইএল টি এসের স্কোর একই সপ্তাহে হাতে পেল। বাকি কাগজপত্র গুছানোই ছিল, আবেদনপত্র জমা দেয়ার পর ধাপে ধাপে সবকিছু শেষ হয়ে মাত্র সাত মাসের মাথায় ইমিগ্রেশনের ভিসার সিল সহ পাসপোর্ট আর ল্যান্ডিং পেপার দুটো ভিএসএফ সেন্টার থেকে নিয়ে এলো। ওর হাতে এগারো মাস সময় আছে ওদেশে চলে যাওয়ার, এর মধ্যে চাকরি ছাড়া অথবা স্টাডি লিভ, যাওয়ার প্রস্তুতি সব করতে হবে, ওর সবচেয়ে বেশি চিন্তা হচ্ছে খালার জন্য, মানুষটাকে কি বলবে, উনিতো ওদের পরিবারের সদস্য। অথচ খালা ওর চিন্তাটা খুব সহজে দূর করে দিল, খালা উনার জন্য করা বাড়িটাতে গিয়ে থাকবেন আর রায়না যদি পারে মাঝে মাঝে উনার খরচের জন্য কিছু টাকা পাঠাবে, না পাঠাতে পারলেও ক্ষতি নেই, উনি টুকটাক হাতের কাজ করে চালিয়ে নিবেন, তবে রায়নাকে কথা দিতে হবে যে কয়েক বছর পর পর অর্ককে নিয়ে এসে উনাকে দেখিয়ে নিয়ে যাবে।
এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে এক রোদেলা দুপুরে রায়না অর্কর হাত ধরে এডমন্টন এয়ারপোর্টের এরাইভাল ট্র্যাক ধরে বের হয়ে এসে হাসি মুখের বন্ধুদের দেখে লম্বা জার্নির কস্ট ভুলে গিয়ে ভাবল মানুষ কত আপন মনে করলে কানাডার মতো দেশে অফিস ছুটি নিয়ে দুটো মানুষকে নিতে তিনজন মানুষ আসে। আপাতত আজকের জন্য ওরা রনির বাসায় থাকবে, মামুন হ্যান্ড লাগেজ ছাড়া বাকী লাগেজ গুলো ওদের জন্য ভাড়া নেয়া এপার্টমেন্টে রেখে আসবে, কাল সকালে ওদের সোশ্যাল ইনস্যুরেন্স নাম্বার আর হেলথ কার্ডের ঝামেলা মিটিয়ে ওদের এপার্টমেন্টে নামিয়ে দেবে।
কানাডার দিনগুলো যেন ঝড়ের গতিতে চলতে লাগল। আসার আগেই আইইএলটিএস এর একাডেমিক পরীক্ষাটা বাংলাদেশ থেকে দিয়ে এসেছিল বলে এসেই প্রথমে এসিস্টেন্ট ফিজিসিয়ান লাইসেন্স পরীক্ষা দিয়ে কানাডায় আসার মাত্র তিন মাসের মাথায় ইউনিভার্সিটি অব আলবার্টা হাসপাতালে এসিস্টেন্ট ফিজিসিয়ান হিসেবে কাজ শুরু করে দেয়। এরপর মাথায় এদেশে পুরোপুরি ডাক্তার হিসেবে কাজ করার ইচ্ছাটা ঘুরতে শুরু করল। কিন্তু শুনেছে এদেশে লাইসেন্স পরীক্ষা পাশ করলেও রেসিডেন্সি পাওয়াটা খুব একটা সহজ না। তারপরও পড়াশুনাটা চালিয়ে গিয়ে শেষ পর্যন্ত লাইসেন্স পরীক্ষা দিয়েই ফেলল। অর্ক এখনও এলিমেন্টারি স্কুলে পড়ে, দরকার হলে আলবার্টার রিমোট এলাকাতে হলেও রেসিডেন্সির অফার নিবে চিন্তা করে মরিয়া হয়ে যখন বিভিন্ন শহরের জন্য আবেদন করছিল তখন এডমন্টন শহর থেকে ৪২৫ কিলোমিটার দূরে ব্রূকস নামের শহরের হাসপাতালে রেসিডেন্সিটা পেয়েই গেল। রায়না চলে যাবে বলে বন্ধুরা সবাই মন খারাপ করলেও ওরা জানে এদেশে ডাক্তার হতে হলে ওকে যেতেই হবে, রেসিডেন্সির জন্য ভাগ্য সবসময় কাজ করে না। অগত্যা তল্পিতল্পা সহ আবার ভেসে পড়া।
মোট ১৩৬৭৬ জন মানুষের বসবাস ছোট্ট শহর ব্রূকস এ, ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ব্রূকস কে ভিলেজ টাউন বলা হতো, জনসংখ্যা ১০০০০ পার করার পর একে পূর্ণ শহরের মর্যাদা দেয়া হয়। একটু দক্ষিনে হওয়ার কারনে আলবার্টার অন্যান্য শহরের তুলনায় আবহাওয়া বেশ ভালো। আলবার্টার অন্যান্য শহরের মতো এখানেও তেল গ্যাস আয়ের অন্যতম সেক্টর, এছাড়াও এখানে আছে মেটাল মেনুফেকচারিং এবং কন্সট্রাকশন প্লান্ট, অন্যান্য শহরে যেখানে প্রতি ১০০০ জনের জন্য চারজন ডাক্তার, এখানে মাত্র একজন ডাক্তার। ছোটবেলা পড়া সেবা প্রকাশনীর ওয়েস্টার্ন গল্পের মতো এই শহরটা, অল্প কয়টা দোকানপাট, একটা কমন রিক্রিয়েশন সেন্টার, স্কুল, একটা হাসপাতাল, দুটো মোটেল, একটা পুলিশ স্টেশন সবকিছুই একটা লম্বা রাস্তার এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত। মাসে একবার বাজার করার জন্য ১৮৬ কিঃমিঃ ড্রাইভ করে কেলগ্যারি শহরে যেতে হয়। রায়নার প্রতিমাসে যেতে হয় না, ও যে বিল্ডিং এ থাকে সেখানে মোট চারটা পরিবার থাকে ওরা প্রতিমাসে এক পরিবার বাজার করার জন্য কেলগ্যারি শহরে যায় আর অন্যান্যদের প্রয়োজন অনুযায়ী বাজার করে নিয়ে আসে। প্রতিকূল পরিবেশে কিভাবে টিকে থাকার লড়াই চালাতে হয় সেটা কানাডায় না আসলে জানা হতো না।
দুটো বছর হুহু করে কেটে গেল, এর মধ্যে গরমের সময় প্ল্যান করে সবাই মিলে আশেপাশে কোথাও না কোথাও হইহই করে বেড়াতে গেছে, অর্কও স্কুলে ভালো করছে, শুধু মাঝে মাঝে রায়নার বাবা-মা ভাইদের জন্য মন টানে, মনে হয় একটু যদি ওদের সঙ্গে কথা বলতে পারতো, বাবা-মাকে নিজের কাছে এনে রাখতে পারতো। রেসিডেন্সি শেষ করে ব্রূকস হাসপাতালে কাজ করাকালীন কেলগ্যারি এডমন্টন আর লেডউক হাসপাতালের পজিশন ওপেনিং দেখে আবেদন করেছিল, এডমন্টন থেকে প্রথম ইন্টারভিউ এর ডাক পেয়ে ইন্টারভিউ দিয়ে এসে পরের দিন হাসপাতালে কফি ব্রেক এর সময় ফোন পেল, ওকে ওরা পুলিশ ক্লিয়ারেন্স আর রেফারেন্স পাঠাতে বলল, ফোনটা ছেড়ে রায়নার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে শুরু করল, ও জানে পুলিশ ক্লিয়ারেন্স আর রেফারেন্স চাওয়া মানে এডমন্টনে ওর চাকরীটা হয়ে গেছে, আবার তল্পিতল্পা গুটানোর সময় হয়ে এল। ওরা ব্রূকস থেকে চলে যাবে শুনে এই প্রথম অর্ক বলল “মা আমর যখনই কোন বন্ধু হয় তখনই তুমি বলো এখান থেকে চলে যেতে হবে, বন্ধু বানানো কতো কঠিন তুমি জানো?” হালকা হেসে রায়না বলল জানি বাবা, কিন্তু আমরা আবার এডমন্টন গেলে রনি মামাদের পাব, তুমি ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত একই শহরে পড়তে পারবে, আমরা হয়ত অনেক দিন ওই শহরেই থাকব।
রয়েল আলেক্স হাসপাতালের প্রবিশন পিরিয়ডের প্রথম ছয় মাস ভালোভাবে কেটে গিয়ে রায়না মোটামুটি থিতু হলে আস্তে আস্তে শহরের বাঙালি অনুষ্ঠান গুলোতে সময় পেলে যেতে শুরু করল, মামুন, রনি কামরুল ছাড়াও অন্যান্যদের সঙ্গে কথা হলেও সাধারণত কম মেশার চেস্টা করত, কারন হাসপাতালের হাড়ভাঙ্গা খাটুনি, ঘরের সব কাজ সামলে ছেলেকে সময় দিয়ে ওর নিজের জন্য তেমন একটা সময় থাকতো না। সাধারনত সপ্তাহান্তে ছুটি পেলে বন্ধুদের ডাকে এর ওর বাসায় আড্ডা দিতে যাওয়া হয়,প্রায় সময়ই রায়নার শনি-রবিবার ডিউটি থাকে বলে সব আড্ডাতে ওর যাওয়া হয়ে উঠে না।
সামারের শেষে যখন ঠান্ডা বাতাস বইতে শুরু করেছে, যখনতখন স্নো পড়া শুরু হতে পারে এমন এক সময়ে রনি ওর শনি-রবিবার ছুটি আছে কিনা জানতে চাইল, ওর বাসায় কয়েকজনকে দুপুরে দুটো ডাল্ভাত খাওয়া আর আড্ডার জন্য বলেছে, এই শনি-রবি ছুটি আছে দেখে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা আর অর্ক ওদের বাচ্চাদের সঙ্গে খেলতে পারবে ভেবে রায়না যেতে রাজি হয়ে গেল। গাঢ় সবুজ জংলা ছাপার একটা শাড়ি পড়ে রনির বাসার দরজা খুলে ভেতরে ঢুকেই ডাইনিং টেবিলের দিক থেকে অনেক গুলো মানুষের হাসির শব্দের মাঝে একটা হাসির শব্দ খুব পরিচিত মনে হওয়াতে অর্ককে বাচ্চাদের সঙ্গে খেলতে বলে ডাইনিং টেবিলের আড্ডাতে এগিয়ে গেল। রায়না আয়, বোস, বলতেই সবকটা মাথা ওর দিকে ঘুরে গেল, এর মধ্যে একটা মুখ দেখে রায়নার সমস্ত শরীর চলার শক্তি হারিয়ে যেন জমে গেল। এক মুহূর্তের মধ্যে রায়না নিজেকে সামলে নিয়ে দেখল মামুন, কামরুল ছাড়াও আরো তিনটা পরিবার আছে জমায়েতে, হালকা হেঁসে ও নিজের পরিচয় দিল, আমি ডাক্তার রায়না অল্প দিন হোল আপনাদের শহরে এসেছি।
চলবে…
পরিচ্ছেদ ৬ অনেক রাতে ফিরেছিল কল্যাণ ওরফে শহীদুল।গাড়িটা শেডে রাখার পর দু’বার হালকা করে মা…..
পরিচ্ছেদ ৫ আকাশে এখন আর মেঘ নেই। হাওয়া হচ্ছে।কদিন পরেই বর্ষা নামবে।একদিন হাসপাতাল থেকে ফিরতে…..
পরিচ্ছেদ ৪ ভোর হয়ে আসছে।রাতে ভালো ঘুম হয়নি।ঘুমের ঘোরে মনে হচ্ছিল দম বন্ধ হয়ে আসছে।এরকম…..
বাংলার চিত্তাকর্ষক ইতিহাস সম্পর্কে জানার সময়, গৌরের মতো আর কিছু গন্তব্য হতে পারে না।…..