বাদল মেঘের আলোয় (পর্ব ৯)

শাহনাজ হোসেন
ধারাবাহিক, নন ফিকশন
Bengali
বাদল মেঘের আলোয় (পর্ব ৯)

আগের পর্ব পড়ুন এখানে >>>>

১০৯ স্ট্রিট ধরে গাড়ি চালিয়ে ওয়াল্টার ডেল হিল এর ঢালু বেয়ে নেমে নতুন ব্রিজটা পার হয়ে ৯৭ এভিনিউয়ে বামে মোড় নিয়ে লেজিস্লেশন এসেম্বলি বিল্ডিং এর পাশ ঘেঁসে টানেলটার ভিতর দিয়ে গাড়িটা নিয়ে হুঁশ করে আবার ১০৯ ষ্ট্রীট এ বের হবার সময় রায়নার নিজেকে কেমন যেন কিশোরী বয়সে দেখা ফল্গাই টিভি সিলিয়ালের নায়কের মতো মনে হয়। প্রতিদিন এই রাস্তাটা ধরে হাসপাতালে যায় তার পরও প্রতিদিনই এই জায়গাটাতে গাড়ি চালাতে ওর নেশার মতো ভালো লাগে। প্রথম যে দিন এই টানেলটা দিয়ে বের হলো ওর কেন যেন সেদিন প্রিন্সেস ডায়নার এক্সিডেন্টের কথা মনে হয়েছিল, খবরে পড়েছিল এই রকমই একটা টানেলের ভিতর গাড়ি দুর্ঘটনায় প্রিন্সেস ডায়না মারা গিয়েছিল।

টানেল দিয়ে বের হওয়ার মুখে সেলফোনটা বেজে উঠল, গাড়ির ডিসপ্লে স্ক্রিনে অচেনা নাম্বার ভেসে উঠেছে, স্পীকার অন করে হ্যালো বলতেই অন্য পাশ থেকে ভরাট গলা ভেসে আসলো, কবির বলছি- দু মিনিট কথা বলা যাবে? টানেলের ভয়ঙ্কর বাঁকটায় স্টেয়ারিং হুইলটা দক্ষতার সাথে ৩৫ ডিগ্রি এঙ্গেলে ধরে মোচড় দিয়ে বেরিয়ে আসার সময় আজ সেকেন্ডের জন্য একটু কি টাল খেল? স্টেয়ারিং হুইল ব্যাল্যান্স করার সাথে সাথে নিজের গলার স্বরটা ব্যাল্যান্স করে বলল, বলো শুনছি।

– আমরা কি কোথাও বসে এক কাপ কফি খেতে পারি?

– কফি? কেন? এ সপ্তাহে হবে না, পুরো সপ্তাহ আমার ডিউটি আছে।

– প্লিজ না করো না, বেশি সময় নিব না, মাত্র আধা ঘন্টা, প্লিজ রায়না।

– আমার নাম্বার কার কাছে পেলে?

– গওহরের কাছে।

– আশ্চর্য,  সে দিন তার সম্পর্কে যতোটুকু শুনেছি আর বুঝেছি তাতে অবাক হচ্ছি যে তুমি তোমার ওয়াইফের কাছে আমার ফোন নাম্বার চেয়েছ আর সে তোমাকে দিয়েছে।

– ভুলে যাচ্ছ তুমি একজন ডাক্তার, কারো কাছে তোমার নাম্বার চাওয়া সহজ কাজ।

– কেন দেখা করতে চাও?

– আমি তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাই।

– বাঃরে গত পরশু দিনই তো রনির বাসায় দেখা হলো, কথা হলো।

–  সে তো ফর্মাল ভাবে সবার সঙ্গে যেভাবে হয় সেভাবে হয়েছে।

– আমাদের মধ্যে কি কোন ইন-ফর্মাল সম্পর্ক আছে?

– রায়না আমি তোমার কথা, তোমার ছেলের কথা, তোমার পারিবারিক জীবনের কথা জানতে চাই।

– এক দিনের পরিচয়ে কারো একান্ত জীবন সম্পর্কে জানতে চাওয়াটা কি শোভনীয়?

– এক দিনের পরিচয়?

– তাই নয় কি?

– রায়না প্লিজ—-

– কবির আমি হাসপাতালে পৌঁছে গেছি, তোমাকে আজ আর সময় দিতে পারছি না, বাই।

কবিরকে আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ফোনটা কেটে দিয়ে গাড়িটা পার্ক করে গটগট করে লকার রুমের দিকে হাঁটা দিল, কাপড় পাল্টে হাসপাতালের কাপড় পরে ইমারজেন্সি ইউনিটে চেক-ইন করে রোগী দেখায় মনোযোগ দিল।

কফি ব্রেক এর সময় এক কাপ কফি নিয়ে বসে ফেসবুকে ঢূ মারতে ঢুকেই রনির পেজে উইকেন্ডের ছবিগুলো চোখে পড়ল। কবিরের কথা মনে করবে না ভেবে রেখেছিল কিন্তু ছবিগুলো চোখে পড়তেই মনে পড়ল সে দিন রনিদের লিভিং রুমের কোনের দিকে সোফায় একজন বয়স্ক মহিলাকে বয়সের সঙ্গে বেমানান রঙ চঙ্গে সাজগোজ করে বসে থাকতে দেখে ভেবেছিল হয়ত কারো মা হবে, পরে যখন রনির বউ মহিলাকে কবিরের ওয়াইফ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিল রায়না পুরাই হতভম্ব। এতোগুলো বছর রায়নার ধারনা ছিল কবির হয়ত ঝলমলে সুন্দরী টাইপের কাউকে বিয়ে করেছে কিন্তু এ কি এতো দেখতে কবিরের চাইতে ৫/৭ বছরের বড় মনে হচ্ছে, থলথলে গালের সঙ্গে বেমানান বড় বড় কানের দুল আর জেড ব্ল্যাক চুল, বোঝাই যাচ্ছে সাদা চুল রঙ করে কালো করা হয়েছে, উপরন্ত মহিলার গলার স্বর আর আচরণ কেমন যেন অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে। আসার সময় মহিলা যখন ফোন নম্বর চাইল তখন অনেকটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও নাম্বারটা রায়না দিয়েছিল আর এও বলে দিয়েছিল যে ও সবসময় ফোন পিক করতে পারে না বেশি প্রয়োজন হলে যেন উনি টেক্সট মেসেজ করেন, পরে সুবিধামতো রায়না উত্তর দেবে। ফোন নাম্বার দেবার পর সে বাসার ঠিকানাটাও চেয়ে নিল, সবার সামনে ভদ্রতার খাতিরে সেটাও দিতে হলো। কবিরের মতো চুজি মানুষ এমন কাউকে বিয়ে করেছে ভাবতেই পারছে না, আরো অবাক হয়েছে মহিলা যেভাবে সবার সঙ্গে তার আর কবিরের পারিবারিক জীবন নিয়ে কথা বলছিল সেটা শুনে। সেদিনই সবার সঙ্গে উনার প্রথম পরিচয় অথচ উনি কি নির্দ্বিধায় বললেন যে উনি কবিরকে দয়া করে উনার স্বামী হবার সার্টিফিকেট বহন করতে দিচ্ছেন, এখানে কবিরের কেউ নেই, নিজস্ব কোন পরিচয় নেই, কবির উনার পরিচয়ে সবার সঙ্গে পরিচিত, আরো বেশি অবাক হয়েছে যখন বলল কবিরের বাবা হবার ক্ষমতা নেই তাই উনাদের কোন বাচ্চা নেই ইত্যাদি ইত্যাদি।

খেলা ছেড়ে খাবার টেবিলে যখন অর্ক খাবার নিতে এলো না তাকিয়েও রায়না বুঝতে পারছিল কবিরের জিজ্ঞাসু দৃষ্টি, কারন অর্ক কবিরের অবিকল ছোট ভার্সন। কবিরের ফোনের কারন যে অর্ক এটা বুঝতে পেরেই রায়না দেখা করার জন্য রাজি হচ্ছিল না, কিন্তু কবিরের প্রতিদিনের ফোনের অত্যাচারে শেষ পর্যন্ত একদিন বলল ঠিক আছে আজ বিকেলে আমার কিছুটা সময় আছে কোথায় দেখা করতে চাও? South Gate Tim Hortons টা চেনে কিনা জানতে চাইলে রায়না বলল ও GPS এ বের করে নেবে, রায়না জানতো না কবির ওর বাসার কাছাকাছি দেখা করতে চেয়েছে আর ও South Gate TD Bank Branch এ চাকরি করে।

কফি নিয়ে কোনের দিকের একটা টেবিলে বসে রায়না বলল বলো কি বলতে চাও?

-রায়না অর্কের বাবা কে?

বিরক্ত হয়ে একটু ভ্রূ কুঁচকে বলল, ওর বাবা আমাদের সঙ্গে থাকে না।

– রায়না ও কি আমার ছেলে?

– কবির অর্ক আমার ছেলে, তোমার ছেলে হলে তুমি জানতে তাই না? তুমি ওর জন্ম হওয়া ধীরে ধীরে বড় হওয়া, পছন্দ অপছন্দ সব কিছু জানতে তোমাকে জিজ্ঞাসা করতে হতো না।  তোমার সঙ্গে আমার প্রায় এক যুগ পরে দেখা, তাহলে কিভাবে অর্ক তোমার ছেলে হবে? কবির আমার মনে হয় আমরা দুজনেই নিজেদের জীবনে নিজেদের মতো করে ভালো আছি শুধু শধু জটিলতা তৈরি করতে চাইছো কেন?

– রায়না অর্ক আমার ছেলে না হলে ও অবিকল আমার মতো দেখতে কেন?

– কে বলেছে ও তোমার মতো দেখতে? ওর চুল দেখেছো? ওর চুল আমার মতো সোজা সিল্কি, তোমার চুল সোজা না। ওর গায়ের রঙ দেখেছো? ওর গায়ের রঙ উজ্জ্বল, তোমার রঙ শ্যামলা। কবির অর্ক ওর নিজের মতো দেখতে, ও কারো মতো না।

– রায়না প্লিজ।

– কবির আজ আমার উঠতে হবে, আজ আর সময় দিতে পারছি না।

-তুমি এখনো আগের মতোই সুন্দর আছো রায়না।

-অথচ তোমার চোখে এখন আর আগের মতো সেই অন্তর্ভেদী দৃষ্টি টা নেই কবির, ভীড়ের মধ্যে তোমাকে এখন আর আলাদা মনে হয় না, বড় সাধারন হয়ে গেছো তুমি, চলি।

কবিরকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে এসে গাড়িটা স্টার্ট দিয়ে পারকিং লট থেকে বেরিয়ে রাস্তায় পড়ল।

রাগে রায়নার মাথা দপ দপ করছে। বাড়ি না গিয়ে ইউনিভার্সিটি এভিনিউ ধরে সাস্কাচুয়ান নদীর পাড় ঘেঁসে গাড়ী দাঁড় করিয়ে ঘাস জমির উপর দিয়ে হেঁটে নদীর ধারে দাঁড়িয়ে থাকল। পনের মিনিট পর গাড়িতে ফিরে এসে রনিকে ফোনে ধরল।

– রনি কবির এই শহরে থাকছে, তুই জানতিস অথচ আমাকে বলিসনি, তুই না আমার বেস্ট ফ্রেন্ডদের একজন। তুই সেদিন কবির আর তার পরিবারকে দাওয়াত দিয়ে আমাদের কেন ডেকেছিলি, তুই তো সবই জানিস, জেনে বুঝে কেন ঝামেলা তৈরি করতে গেলি? আমাদের সেদিন না বললেই তো পারতিস, এমনও তো হয়েছে তোরা গেট-টুগেদার করেছিস, আমি আমার কাজের জন্য যেতে পারি নি, সেদিনও নাহয় এমন ভাবতি।

– রায়না কবির ভাই তোর সঙ্গে যা করেছিল সেটা ভুলি কি করে। তুই এ পর্যন্ত বাচ্চাটা নিয়ে যে যুদ্ধটা করেছিস সেটা ভুলি কি করে? উনার জন্য আজ তুই পরিবার পরিজন ছাড়া। তুই ব্রূকস এ চলে যাবার পর উনি অটোয়া থেকে এখানে শিফট করেছেন, বাংলা এসোসিয়েশনের একটা অনুষ্ঠানে গিয়ে উনার সঙ্গে দেখা হয়।

– কিন্তু তোরা তো আমাকে আগে বলিসনি। তাহলে হয়ত আমি এই শহরে ফিরে আসার চেস্টা করতাম না, অন্য কোন শহরে চলে যেতাম।

–  রায়না এই শহরে কবির ভাই আমাদের পরে এসেছে, তোর কাছে আমাদের কোন গুরুত্ব নেই, কবির ভাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ ?

-তোরা জানিস অর্ক দেখতে অবিকল কবিরের মতো, যে কেউ ওদের এক সঙ্গে দেখলে প্রশ্ন করবে, আমি জানতাম না  সে এই শহরে এসেছে, না জানাই থাকতাম, কেন একই দিনে আমাদের ডাকলি?

– রায়না তুই হয়তো জানিস না গওহর ভাবী সবাইকে বলে বেড়ায় যে কবির ভাই ইম্পোটেন্ট অথচ দেখ কবির ভাই জানতোই না তার জলজ্যান্ত একটা ছেলে আছে।

– শুনেছি, সে দিন সব মহিলাদের সামনে বলছিল। তোরা কিন্তু কাজটা ভালো করিস নি, সবাই কথা বলতে শুরু করলে অর্কের কেমন লাগবে সেটা ভাবলি না? আর কবিরের ওয়াইফকে যেমন বুঝলাম  এই মহিলা একবার যদি কবির আর আমার আগের সম্পর্কের কথা জানতে পারে আমাদের স্বাভাবিক আনন্দময় জীবনটা অস্বাভাবিক করে দিতে একটুও দ্বিধা করবে না।

– সত্যি বলতে কি জানিস আমি মামুন আর কাম্রুল কিন্তু এই ব্যাপারটা ভাবি নি, আমরা শুধু চেয়েছিলাম উনাকে মানসিক কস্ট দিতে। চিন্তা করিস না তোর বন্ধুরা আছে তোর জন্য।

– জানি রে, কিন্তু জানিস তো অনেক কস্ট করে আজকের এই সুখী অবস্থানটাতে এসেছি, আমি চাই না কেউ আমার আর অর্কের গুছানো জীবনে ঝড় তুলুক।

– রায়না, মামুন কিন্তু এখনও তোর জন্য অপেক্ষা করে আছে, ভেবে দেখতে পারিস।

-আজ রাখি রে, বাসায় যাব, পরে কথা হবে।

চাবি দিয়ে দরজা খুলে কাঁধের ব্যাগটা আর ল্যাপটপটা সোফার উপর রেখে ছেলের ঘরে উঁকি দিল, লক্ষ্মী বাচ্চাটা কি সুন্দর করে নিজে নিজেই হোম ওয়ার্ক করছে। আলতো পায়ে হেঁটে কাছে গিয়ে ওর চুলগুলো ঘেঁটে দিয়ে বলল পড়া শেষ করো মা নাস্তা রেডি করছি, খেয়ে আমরা হাটতে বের হবো।

শুধু বাব-মার কথা ভেবে আর সমাজের মানুষ জানতে পারলে কি ভাববে চিন্তা করে গওহর তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ জানতে পেরেও কবির ওদের সম্পর্কটা টেনে চলেছে। রায়নাকে যেদিন শেষবারের মতো দেখে এসেছিল তারপর ভেবেছিল সেই ঝড়ের রাতের ঘটনা আর তার পরের দিনের ঘটনাটা ওর জীবনের একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা, ওকে সব ভুলে এগিয়ে যেতে হবে। প্রতিনিয়ত গওহরের মানুষের সামনে করা অপমান আর আব্দুল্লাহ সাহেবের ওকে কন্ট্রোল করার সমস্ত কারসাজি মেনে নিয়ে কবির ওর কানাডার জীবন গুছিয়ে চলছিল। যেদিন জানতে পেরেছিল যে গওহর একজন পূর্ণ গঠনের মেয়ে না তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ সেদিন বাকি রাতটা লিভিং রুমের সোফায় কাটানের সময় কবিরের শুধুই মনে হয়েছিল প্রকৃতি রায়নার প্রতি করা অবিচারের প্রতিশোধ নিয়েছে। মানুষের সব চাওয়া পাওয়া হয় না, প্রকৃতি ওকে ওর সব চাওয়া পাইয়ে দিয়েছিল, ও কেনো রাখতে পারল না।

অটোয়াতে ওর আর ভালো লাগছিল না তাই হেড অফিসে অনেক অনুরোধ করে এডমন্টনে এসেছিল। ও যে ব্রাঞ্চে কাজ করে হঠাত করেই সেখানে রনির সঙ্গে দেখা, এরপর তো এসোসিয়েশনের অনুষ্ঠানে রায়নার সব বন্ধুদের সঙ্গে দেখা। কবির ভেবেছিল ওদের যতোটা সম্ভব এড়িয়ে চলবে কিন্তু গওহরের যা স্বভাব তাতে সে অল্প দিনের মধ্যেই রনি আর কাম্রুলের ওয়াইফের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়ে ফেলে। তাই সেদিন যখন বলল যে ওদের রনির বাসায় দাওয়াত আছে ও মোটেও অবাক হয়নি। বিচিত্র সাজগোজ করে প্রতি সপ্তাহে কারো না কারো বাসায় যাওয়া, পরিচিত সবার একান্ত নিজস্ব কথা জানা তারপর সেগুলো ঝাল-মসলা আর সসের প্রলেপ লাগিয়ে অন্য কারো সঙ্গে গল্প করাটা গওহরের শখের কাজগুলোর মধ্যে পড়ে।

সেদিন রায়নাকে দেখে অবাক হয়েছিল ঠিকই কিন্তু অর্ককে হেঁটে আসতে দেখে কবিরের চোখের সামনে পুরো পৃথিবীটা এক মুহূর্তের জন্য দুলে উঠেছিল। রনির দিকে তাকাতেই রনি চোখের ইশারায় হ্যাঁ বলেছিল। সেদিন সারারাত কবির ঘুমাতে পারেনি, রায়নার দৃঢ়চেতা আত্মবিশ্বাসী চেহারাটা আর টেবিলের দিকে হেঁটে আসা বাচ্চাটা বারবার মনে পড়ছিল। তারমানে কবির রায়নাকে এবরশন করতে বললেও রায়না করে নি কিন্তু ওর হাসবেন্ড কি জানে যে ছেলেটার বাবা কবির?

কবির জানে গওহরের অভ্যাস হলো নতুন কারো সাথে পরিচয় হলে তার ফোন নাম্বার সংগ্রহ করে রাখা আর এই ফোন নাম্বার এর সূত্র ধরে নেটওয়ার্ক শুরু করা, লিঙ্গ বৈষম্যের কারনে এই গুণটা সে জন্মগতভাবে পেয়েছে। রনির বাসা থেকে আসার কয়েকদিন পর গওহরের কাছে ডাঃ রায়নার ফোন নাম্বার আছে কিনা জানতে চেয়েছিল, বাঙ্গালী ডাক্তার, বলা তো যায় না কখন কাজে লাগে।

গত একমাস ধরে চেষ্টা করেও রায়নার কাছ থেকে ছেলেটা সম্পর্কে কোন কথা জানতে না পেরে শেষে সিদ্ধান্ত নিল রনিদের কারো কাছ থেকে জানতে হবে। ঘড়ির কাঁটা ধরে বাসায় না ফিরলে গওহর চরম অশান্তি করে, একই ছাদের নিচে বসবাস ছাড়া ওদের মধ্যে স্বামী স্ত্রী সম্পর্কিত কোন সম্পর্ক কোনদিনই হওয়া সম্ভব হয় নাই অথচ একটা কাগজের জোরে প্রতিনিয়ত কবিরকে জব্দ করে রেখেছে। অটোয়াতে থাকাকালীন কবির একটা মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক করার চেস্টা করেছিল, জানতে পারার পর যে অশান্তি আর কেলেঙ্কারি করেছিল তাতে কিছুদিন পর কবির অটোয়া ছাড়ার কথা ভাবতে বাধ্য হয়েছিল। এছাড়াও অটোয়া আর টরোন্ট শহরে গওহরের এতো আত্মীয় স্বজন, কবিরের নিজেকে মাকড়শার জালে আটকে পড়া ফড়িং মনে হতো। মনে হয়েছিল এখানে এলে হতো সেই জাল থেকে মুক্তি পাবে, কিন্তু বিধি নাম, আসার অল্প দিনের মধ্যেই গওহর কিভাবে যেন কিছু বন্ধুবান্ধব বানিয়ে ফেলে আর তারপর প্রতি উইকেন্ডে সেই একই সার্কেলে ঘুরেফিরে যাতায়াত আর এই জন্যই গওহর সবাইকে বলে বেড়ায় ওকে কেউ ওর পরিচয়ে চেনে না সবাই গওহরের হাসবেন্ড হিসেবে চেনে।

রায়নার সাথে কফি শপে দেখা হবার পর থেকে ফোন  করলেও রায়না ধরছে না অথবা পরে কল ব্যাকও করছে না, দু সপ্তাহ পর এক ছুটির দিনে কবির গওহরকে বলল চলো আজ ডাঃ রায়নার বাসায় বিকেলে কফি খেতে যাই। সঙ্গে সঙ্গেই গওহর রাজি, ঝটপট রায়নাকে মেসেজ দিয়ে দিল যে আধাঘন্টার মধ্যে ওরা কফি খেতে ওর বাসায় আসছে।

দুপুরে খাওয়ার পর থেকে ছেলের সঙ্গে লিভিং রুমে বসে নেটফ্লেক্স এ “স্পীড” সিরিয়ালটা দেখছিল, হঠাত ফোনে ট্রিং শব্দটা কানে আসাতে হাতে নিয়ে দেখে মেসেজ, মেসেজটা দেখেই রায়নার মন তেতো হয়ে গেল, এরা কি ওকে কোনমতেই শান্তিতে থাকতে দেবে না। কিচেনে গিয়ে ফ্রিজ থেকে নাগেট আর ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ের প্যাকেট বের করে এয়ার ফ্রায়ারে দিয়ে রনিকে ফোনে ধরল।

 

চলবে…

শাহনাজ হোসেন (ঝিনুক)। গল্পকার। জন্ম ও বেড়ে ওঠা বাংলাদেশের দিনাজপুর শহরে। শিক্ষা জীবন ঢাকা শহরে, সেই সময় সংস্পর্শে আসেন দৈনিক বাংলার সাপ্তাহিক বিচিত্রার একঝাঁক মেধাবী মানুষের সঙ্গে; পরিচিত হতে শুরু করেন লেখালেখির সঙ্গে। এরপর শিক্ষাজীবন শেষ করে দীর্ঘ ১৫ বছর...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

প্যাটাক্যুয়রিক্যাল নাইটশোয়ে আপনাকে স্বাগতম (পঞ্চম পর্ব )

প্যাটাক্যুয়রিক্যাল নাইটশোয়ে আপনাকে স্বাগতম (পঞ্চম পর্ব )

ইংরেজি ভার্সান এখানে >>> Welcome to the Pataquerical Night Show (Episode-5) পূর্ববর্তী পর্ব এখানে>>> শেষ…..