বানানটা এদিক ওদিক করলেই নাড়ি

অহনা সরকার
নারী, প্রবন্ধ
Bengali
বানানটা এদিক ওদিক করলেই নাড়ি

“নারী”! তাকে নিয়ে আবার কিছু লেখা যায় নাকি! বা লেখা হয়! বরং বানানটা একটু এদিক ওদিক করে নিলে নাড়ি! ভেতরের শব্দবন্ধনী টান পড়ে কোথাও যেন একটা।

একটা ঘটনা বলি এখনই ঘটা একটু আগে, প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছি খড়গপুর আপ লোকাল, যত লোক নামলেন নামার পর ওটা এক ভদ্রমহিলা কোলে দুটো বাচ্চা কাঁধে একটা ব্যাগ আমরা তো সবাই সব সময় দৌড়াচ্ছি না কাজ না থাকলে দৌড়াচ্ছি স্পেশালি ট্রেন স্টেশনে! সবাই ভীষণই ব্যস্ত! তো কি হল এই ব্যস্ত ভিড় ভাড় লোক জমায়েত সমস্ত নিয়ে সাথে দুটো বাচ্চা সটান প্লাটফর্মে এসে পড়লেন! বাচ্চাদুটোর কান্নার শব্দ সেটা বোধহয় একটু বাঁচালো না হলে সিওর উনি প্যামপেস্ট হতেন আর আমাদের কোনো ভ্রুক্ষেপ ছাড়াই!

দারুণ না! ভদ্রমহিলা যেখানে পড়লেন তার ঠিক ওপরে নয় একটু পাশে বাঁয়ে সরে বিশাল বড় করে কোনো গয়নার দোকানের অ্যাড হোডিং, ” নারী দিবস উপলক্ষে এই এত এত ছাড়”! আসুন আসুন আসুন দেখতে দেখতে ভীষণ হাসি পেলো, পুরো ঘটনাটাই সমগ্র! অসাধারণ কৌতুক না! “নারীদিবস”!

আচ্ছা একটু প্রেক্ষাপট বলা যাক বরং কেন এই দিনটি এমন রাখা হলো, কি বিশেষ তাঁরা করেছিলেন!

যতদূর আমি জানি, ১৯১১ সালের ১৯ শে মার্চ অস্ট্রিয়া, জার্মানী, ড্রেনমার্ক, সুইজারল্যান্ড প্রভৃতি জায়গা থেকে প্রায় কয়েক লক্ষ মানুষ প্যারিস কম্যিউনে জমা হন, তাদের মধ্যে বেশ কয়েকশো নারী ছিলেন যাঁরা হেঁটে প্যারেড করতে করতে ওখানে জমা হয়েছিলেন, প্রধানত দাবী ছিলো ভোটাধিকার (১৮৯৩ সালে নিউজিল্যান্ড গভর্মেন্ট প্রথম ভোটাধিকার দেয় মেয়েদের, তবে তারা পার্লামেন্ট ইলেকশনে অ্যাস এ প্রার্থী হিসাবে দাঁড়াতে পারবে না। ১৮৯৪ তে দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ান কলোনী ইউরোপে সম্মতি দেয় যে নারীরা ভোট দিতে পারবে এবং ভোটে দাঁড়াতেও পারবে। আর ভারতে সম্ভবত ১৯২১ সালে তাও পুরো ভারতে নয় যতদূর জানি আর কি!) তো নারীরা সেদিন সেখানে জমা হয়েছিলেন ভোটাধিকার আর কাজের জায়গায় জেন্ডারগত বৈষম্যের প্রতিবাদ জানাতে। পরে ১৯১৪ সালের ৮ই মার্চ, মানে এখন যে দিনটিকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসাবে উৎযাপন করা হয় ইউএনওর সাক্ষরের পর, তা প্রথম পালিত হয়েছিলো, জার্মানিতে। তবে এই দিনটি পড়ার কারণ হলো সেদিন রবিবার ছিলো! তারপর থেকে এই দিনটিকেই আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসাবে সারা দেশে বা পৃথিবীতে পালন করা হয়। ইউরোপের কিছু কিছু দেশ আর আমেরিকা প্রধানত এই দিনটি পালন করে তাদের ন্যাশনাল হলিডে হিসাবে।

তো এই তো গেলো ইতিহাস। বাকি পড়ে রইলাম আমরা চারিদিকে ছড়ানো ছিটানো। নারী দিবসে স্পেশাল গয়না শপিং এ ছাড় সিনেমা রিলিজ আর ফেসবুকে টুইটার ইনস্ট্রায় হাজারো পোস্ট ছাড়া আর কোনো গুরুত্ব কি আদৌ আছে এই দিনটার আমাদের কাছে! স্পেশালি ভারতে! এখনকার সময়ে আরো! আমি তো কোথাও দেখতে পাইনা। আজ বলে না, কখনোই দেখিনি। আমার মা ছুটির দিন ছাড়া রোজ যেমন সকালে উঠে বাজার করে রান্না করে দেন স্কুল, স্কুল থেকে ফিরে আবার বাজার পরের দিনের রাতের রান্না করা। আমাদের কাজের মাসি সেই তার ছেলেকে দোকানে রেখে সারাদিন দশ বাড়ি কাজ করার পর বাড়ি ফিরে অন্যদিনের মতোই বরের উত্তম মধ্যম। আমার মামার হোটেলে কাজ করা রিন্টু যত মাইনে পায় তার হাফেরও কম মাইনে পাওয়া হোটেলের মাসি। কিন্তু দেখলে রিন্টু কেবল জল তোলে তার বাসন মাজে। রান্না বাজার যাবতীয় কুটনো খেতে দেওয়া সব হোটেলের মাসি! বা এই ঠিক আমাদের কোয়ার্টারের নিজের মানুষটি বৌ দরজা না খোলা পর্যন্ত চেপে থাকা কলিং বেল! আদৌ কোনটাই রোজকার কথা বাদ দিলাম ৮ ই মার্চ ও কি তার কোথাও বিন্দুমাত্র কোনো পরিবর্তন ঘটবে! না। আমি অন্তত কোনোদিন দেখেনি বা হতে পারে চোখে পড়েনি

শুধু এটুকুই বোধহয় ঘটবে ঘটতে পারে, রোজ আমরাই আমাদের সবচেয়ে বেশি অপমান করবো রোজ আরো একটু একটু করে। চরম নির্যাতিত অপমানিত হওয়া “নারী” নামধারী এক মানুষকে ক্ষমতার পদবর্তী আরেক “নারী” আঙুল উঁচিয়ে জোর গলায় জানাবে সাজানো ঘটনা। আমরা শুনবো চুপ করে বড়জোর শুনবো খুব বেশি হলে মোমবাতি মিছিল ফেসবুক টাইমলাইন বা টি শার্টের বুকে! আর কোনো পত্রিকায় নারী দিবস উপলক্ষে লেখা পাঠাতে বলার সংগ্রামে বড়জোর দু চার লাইন!

তবে শাহিনবাগ কখনো যাওয়া হবে কিনা জানি না। পার্কসার্কাস এখনো যাওয়া হয়নি একদিন যাবো ঠিক যাবোই তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে হাত মুঠো করে জোড়া আকাশের দিকে তুলবো। কি বলবো ঠিক জানিনা তবে করবোই।

অহনা সরকার। কবি। জন্ম ভারতের পশ্চিমবঙ্গরাজ্যের পশ্চিম মেদিনীপুরে। উচ্চারণ নামের একটি ওয়েব ম্যাগাজিনের সাথে যুক্ত। প্রকাশিত বই: 'শুরু যারপরনাই সন্ধিগ্ধ এক চৈতি'।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

গণতন্ত্র, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও বাংলার নবজাগরণের দু একটি কথা

গণতন্ত্র, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও বাংলার নবজাগরণের দু একটি কথা

একটি পরাধীন দেশ আর তার বাসিন্দাদের মনে স্বাধীনতার আকুতি আমরা দেখেছিলাম ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে। এর…..