বারীন ঘোষাল

স্বপন রায়
প্রবন্ধ
Bengali
বারীন ঘোষাল

বারীনদা, কবি বারীন ঘোষাল নেই। আমার কাছে , আমাদের কাছে ‘বারীনদা’ এই ডাকটার কোন উত্তর আর আসবে না। মানুষ মরণশীল। সবাইকেই উত্তর না দেয়ার জায়গায় যেতে হবে। বারীনদা, কবি বারীন ঘোষালও (১৯৪৪-২০১৭) চলে গেছেন। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যেটা হয় যে চলে যাওয়া মানুষটা দৈনন্দিনের বাইরে থাকা কোন প্রশ্নের উত্তর না খুঁজেই চলে যান। কেউ কেউ প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আমি ‘আমি’ ‘আমি’ করে যান সারাজীবন। উত্তরটা যদিও জরুরী নয়। উত্তর খোঁজার রাস্তাটা জরুরী। কারণ উত্তর দেয়ার মধ্যেও আহৃত জ্ঞানের একটা ব্যাপার থাকে। অহং থাকে। হামবড়াই থাকে। বারীনদা আজীবন খোঁজেই ছিল, কবিতার খোঁজ। আর সেটা পড়াশোনার আবহে নয়, চেতনার আবহে। পড়াশোনা আবশ্যিক সবার ক্ষেত্রেই। কবিতা আবশ্যিক নয়। কোন আবশ্যিকতা দিয়ে কবিতার কাছে পৌঁছন যায়না। আর তাই সময়ের চিহ্ণ রাখা আধুনিক, উত্তরাধুনিকের সময়শাসনে বারীনদা বাঁধা পড়েনি। ‘অতিচেতনার কথা’ কোনও সময়বাঁধানো তত্ব নয়, তত্বই নয়।আশি দশকের মাঝামাঝি বারীনদা প্রথাগত ছন্দের স্থিথিস্থাপক কবিতার ‘প্রোটোটাইপ’ থেকে বেরোতে চাইছিল আর জীবনানন্দের সুদূরপ্রসারী প্রভাব থেকেও। ওই সময়ে গোটা সত্তর এবং আশি’র দশক জুড়ে পঞ্চাশের জীবনানন্দ প্রভাবিত কবিতার ভাবনাই( যার কেন্দ্রে ছিল পরাবাস্তবতা) ছিল বাংলা কবিতার চালিকাশক্তি। কিভাবে বেরোন যায়? এই ভাবনাই ‘অতিচেতনা’কে নিয়ে এল। স্বামী বিবেকানন্দ প্রথমে ‘অতিচেতনা’ শব্দটি ব্যবহার করেন যোগশাস্ত্রের আলোচনা করতে গিয়ে। বারীনদা তার ভাবনাপ্রসূত চেতনার কেন্দ্রছাড়া অভিযানের  নাম দিল ‘অতিচেতনা’। এই ‘অতি’টা এক্সট্রা,  সুপার নয়। তো, এটাই জরুরী। প্রায়োগিক এই ভাবনা বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে অশ্রুতপূর্ব এবং অপূর্ব। এই ভাবনা ভুল না ঠিক এ নিয়ে কোন দুর্দান্ত সমালোচনা আমার নজরে আসেনি। তবে তিরিশ বছর আগে লেখা কয়েক পৃষ্ঠার কবিতাভাবনা নব্বই আর শূন্যদশককে তুমুল ভাবে আলোড়িত করেছিল এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই।

***

বারীনদা মহামানব ছিলনা। মানুষ ছিল। দোষগুণের মানুষ। চাপা। কিন্তু সব অনুভবের আকর। ব্যক্তিনিন্দা আর ব্যক্তিপূজা পছন্দ করতোনা। আবার কক্ষনো কারো প্রভাবে বা প্ররোচনায় কোন কবি বা তার ভাবনা সম্পর্কে কোনরকম মতামত দিতনা। যা বলার সেই কবিকেই সরাসরি জানাতো। কিছু অর্বাচীন  নোংরা আক্রমণ করেছে, কুৎসা করেছে, হীন করার চেষ্টা করেছে। বারীনদা উত্তর দেয়নি। ওই যে প্রথমে বললাম না, বারীনদা খুঁজিয়ে ছিল। যে খোঁজে তার কাছে খোঁজের বাইরে থাকা অন্য সবকিছুই একসময় অবান্তর হয়ে যায়। নির্লিপ্ত, উদাসীন বারীনদা ‘অতিচেতনায়’ বাঁচতো। কাল্পনিক অভিজ্ঞতার দুনিয়ায়। আর সেই থাকাটা উপভোগ করতো। সারাজীবন প্রচুর তর্ক করেছি, কথা শুনিনি, কবিতার সমালোচনা করেছি। বারীনদা সেই পরিসর আজীবন দিয়ে গেছে। আর এই পরিসর না থাকলে কবিতার অভিযানে আমরা যেতাম কিভাবে? ঘরের কোনে বসেই তো সব চেয়ে ভাল নিন্দেমন্দ, কুৎসা রটনা আর ঝগড়া করা যায়। বারীনদা এক মুক্ত চেতনার সৈনিক ছিল। কখনো নিজের কবিতাকে চাপিয়ে দিতে দেখিনি। উল্টে তরুন কবিদের সারাজীবন ধরে নিজের ভাষাকে খোঁজার কথা বলেছে। এটা, আজকের নিরিখে অবিশ্বাস্য মনে হয়, তাইনা?

***

বারীনদার কবিতা সময়নিষ্ক্রান্ত কবিতা। যারা সময়ের নিরিখে কবিতা লেখেন তাঁদের কাছে বারীন ঘোষাল অপাঠ্য মনে হবে। এতে কারো দোষ নেই। দোষ কারো নয় গো মা। বা বলা যেতে পারে ‘মাইণ্ডসেট’-এর দোষ। নতুন ভাবনা জন অ্যাশবেরি বা এজরা পাউণ্ডের মত অয়েকজন ব্যতিক্রমী ছাড়া প্রতিষ্ঠিত প্রবীণ কবিদের কাছে  কোনদিনই পাত্তা পায়নি। তাঁরা নিজেদের ছায়া খোঁজেন তরুনদের কবিতায়। যেখানে পান, সেখানে স্নেহসুধারস অকাতরে ঢেলে দেন। আমাদের তারুন্যে দেখেছি বহু তরুন কবিই এঁদের প্রশ্রয়ে এঁদেরই ভাষায় কবিতা লিখেছে। খ্যাতিপ্রাপ্ত হয়েছে। এই প্রাকটিক্যাল অ্যাপ্রোচ অবশ্যই নতুন ভাবনার পরিপন্থী। তবে   আবারও বলছি এটা অন্যায় নয়, দোষের নয়।  অন্যদিকে সবসময়েই কিছু সচেতন তরুনের মনে প্রতিষ্ঠিত কবিতাভাবনা আর তার প্রকাশের ভাষা নিয়ে প্রশ্ন জাগে। সে বিদ্রোহ করে। নিজের প্রকাশ খুঁজতে চায়। আমার নিজের মধ্যেও এটা হয়েছিল আর আমি এবং আমার মত আরো কয়েকজন হয়ত চেতনাগতির বিশৃঙ্খল ঐক্যের টানেই কাছকাছি চলে এসেছিলাম। বারীনদা হয়ে উঠল আমাদের কবিতাভাবনার ক্যাটালিস্ট। ‘নতুন কবিতা’ ধীরে ধীরে ‘কয়েনেজ’ হয়ে গেল। আর সেই প্রতিষ্ঠিত ‘কয়েনেজ’কে ভেঙে আরো নতুনের দিকে যাওয়ার কথা যখন আমরা ভাবলাম বা তরুনতররা ভাবল, বারীনদার আন্তরিক সমর্থন পেল তারা। এটা বারীনদার নৈতিক অবস্থান ছিল। কিন্তু কেন? এর উত্তর এই উদ্ধৃতিতে রয়েছেঃ ‘বিশ্বসংসার তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গে ভাসছে। তার একশো ভাগের মাত্র ৬ ভাগ প্রতিফলন আমরা খোলা চোখে দেখতে পাই। মানুষের সমস্ত শিল্পকলা সংস্কৃতি বিস্ময় আগ্রহ ঐ ৬ ভাগে সীমিত। অতিচেতনা এই সীমা ভেঙে দেয়, চেতনাকে ছড়িয়ে পড়তে দেয়। ঐ যা ছিল সীমানার বাইরে, যার অস্তিত্ব টের পাচ্ছি অসাধারণ অবাক প্রতিফলনে, তাকে extra consciousness  বলা চলে। super তাতে quality বা গুণ বোঝায়।।….সীমানা ভাঙার ফলে অবিন্যস্ত হয়ে পড়ে ভাবনা আর ধারণাগুলো, যা আছে অথচ ছিল অনলদ্ধ তাতে হঠাৎ ছোঁয়া দেয় সেই ভীষণ অবকাশ যা অতিচেতনার পরিসর। একে extra বলাই ঠিক। অস্তিত্ব বোঝা যায়, বর্ণনা করা যায়না। এতদিন যা বাস্তব ভেবেছি আজ তা ছাপিয়ে ফুটে উঠছে এক অতিবাস্তব এবং সবকিছুর মানে বদলে যাচ্ছে…” (অতিচেতনার কথা)। যখনই কারো লেখায় এই সীমা ভাঙার অসীম আগ্রহ চোখে পড়েছে বারীনদার ভালবাসার হাত তাকে স্পর্শ করেছে। সাহস যুগিয়েছে। দুই বাংলাতেই রয়েছেন সেইসব তরুন কবিরা যাঁরা  তাঁদের কবিতাসংক্রান্তির দ্বান্দ্বিক ভাবনাযুদ্ধে বারীনদাকে পেয়েছেন সাথী হিসেবে। অগ্রজ সহযোদ্ধা হিসেবে। নিরলস ভালবাসায় বারীনদা কবি আর কবিতাকে ভালবেসে গেছ। এটা একটা ‘ওয়ে অফ লাইফ’।

***

আমি আগেই লিখেছি ‘অতিচেতনা’ কোন তত্ব নয়। চেতনার নতুন প্রবাহের অভিযান। আর বারীনদা এক অভিযাত্রী। এই অভিযাত্রা এমন একটা পরিসর তৈরি করে দিল যেখানে কবি তার ভাবনাকে নিয়ে খেলার সীমাহীন উৎসাহবিন্দু পেতে থাকবে। পেতেই থাকবে। এই নিঃস্বার্থ পরিসরেই কবি বারীনের সঙ্গে দুই বাংলার অসংখ্য কবিরা আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। কারণ তরুন কবিরা জানতো বারীনদা নিজের কবিতার ঢাক পেটাবে না। কর্কশ আত্মপ্রচারে কান ঝালাপালা করে দেবেনা। বরং পরম মমতায় তরুন কবির কবিতা নিয়েই কথা বলবে। এই কথাবার্তার আদানপ্রদানের ভেতরেই তরুন কবি তার চেতনাপ্রবাহকে গুরুত্ব দিতে শুরু করতো। নিজেকে আবিষ্কার করতো আরেকবার। এই যাপনের বীজ অবশ্যই ‘কৌরব’ পত্রিকার যৌথতার অবদান। পরে কবিতা ক্যম্পাস, নতুন কবিতা, ভিন্নমুখ, এখন বাংলা কবিতার কাগজ, বৈখরী ভাষ্য সহ নব্বই আর শূন্য দশকের বিভিন্ন কাগজে  তরুন কবিরা এক অন্যপথের পথিক বারীন ঘোষালকে পেতে থাকে। এই নির্লোভ সততার জায়গাটাই কবিতাখুঁজিয়ে বারীনদাকে তাঁর কবিতাভাবনার বিরোধীদের কাছেও প্রিয় করে তুলেছিল। কবি, সে যে ধরণের কবিতাই লিখুক না কেন, বারীনদা আজীবন তাদের নিজেরই সম্প্রসারিত অস্তিত্ব ভেবেছে। কখনো কোন কবির বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত আক্রমণ করেনি। নিজে যখন আক্রান্ত হয়েছে অত্যন্ত কুৎসিত ভাষায়, প্রতি আক্রমণ করেনি। কষ্ট পেয়েছে। সহ্য করেছে। বলেছে, ওরা ওদের কাজ করছে, আমি আমার কাজটা করি। কবির কাজ কবিতাকে কেন্দ্র করেই হতে থাকে। কবিতা লেখা, কবিতা বিষয়ক গদ্য লেখা। কবি বারীন এই ‘কাজে’র নিরলস কর্মী ছিল, আর ছিল বলেই বারীন ঘোষালের কাজ ধীরে ধীরে সৃষ্টির অফুরন্তে মিশে গেছে।

স্বপন রায়। কবি। জন্ম ১৯৫৬। ভারতের দুটো ইস্পাতনগরী জামশেদপুর এবং রাউরকেলা স্বপন রায়ের অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। প্রথমটি জন্মসূত্রে। দ্বিতীয়টি বড় হয়ে ওঠার সূত্রে। নব্বই দশকের শুরুতে 'নতুন কবিতা'র ভাবনায় সক্রিয় হয়ে ওঠেন। পুরনো, প্রতিষ্ঠিত ধারাকবিতা ত্যাগ করে কবিতাকে নানাভাবে...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

গণতন্ত্র, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও বাংলার নবজাগরণের দু একটি কথা

গণতন্ত্র, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও বাংলার নবজাগরণের দু একটি কথা

একটি পরাধীন দেশ আর তার বাসিন্দাদের মনে স্বাধীনতার আকুতি আমরা দেখেছিলাম ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে। এর…..