বিজ্ঞাপন

সাঈদ কামাল
গল্প
Bengali
বিজ্ঞাপন

‘আমার আর কিছু চাওয়ার নাই।চোখ ভরে তোমায় দেখব।একটি রাত্রি পাশাপাশি থাকব।ভয় পেয়ো না,গহীন কোথাও ¯পর্শ করব না।তোমার চোখে দুবার,কপালে দুবার, মুখের একপাশে ও ঠোঁটে দু বার আমার ঠোঁট ছোঁয়াবো।আসবে, ডালিয়া?’

ডালিয়া অনেক সময় নিস্পলক আমার চোখে তাকিয়ে থাকলো,কথা বললো না।আমি ডালিয়ার চোখে অসংখ্য কবিতা দ্যাখলাম।ঝলমলে তরতাজা স্নিগ্ধ পদ্য উজ্জ্বল আলো ছড়ায়।সে আলো ফিরদাউসের জ্যোতির মতো নিষ্পাপ কোমল লাগে।

বললাম, ‘আমার চোখের নিচে কালি জমে গেছে,গালে ফুস্কুড়ি জন্ম নিয়েছে,ঠোঁটে ময়লা স্থান করেছে,মুখের সব সৌন্দর্য অমাবস্যার মতো তিন তিন করছে,আমি স্পর্শ করলে ঘৃণা হবে তোমার?’

ডালিয়া হাসলো। এক লক্ষ বছর পর আসমানে প্রশান্তিময় কোন গ্রহ উদ্ভাসিত হলে পৃথিবী যেমন হাসে।অবাক হয়ে সে হাসি দেখি।মনে হয় যে দূরতম সুগন্ধি ফুলের কোন গ্রহে চলে যাচ্ছি।আমার কোন দুঃখ ,নৈরাশ্য থাকে না।যেন সুখী পাখির মতো সুখের গ্রহে অতি আনন্দে উড়ে যাচ্ছি।

বললো সে,তোমার চোখের নিচের কালি আমার চোখের কাজল, গালের ফুস্কুড়ি কপালের অলংকার,ঠোঁটের ময়লা সূরা,তোমার মুখের অমাবস্য আমার চুলের সেীন্দর্য; যদি না আসি বিষাদের মেঘে ঢেকে ফেলবে আমায়।’

আমি হাসলাম।দীর্ঘক্ষণ তার চোখে তাকিয়ে হাত ধরে বললাম,আমার চাকরিটা খুব স্বাধীন, তাই না?’

ডালিয়া আমার হাত চেপে ধরে মৃদু স্বরে বলল,-‘হ্যাঁ,এরকম চাকরি কারো হয় না,ভাগ্য তোমাকে নিদারুণ চমক দিয়েছে,বলতে হবে তুলনাহীন চাকরি। কিন্তু এটা না করলে কতো যে ভালো হতো যদি বুঝতে পারতে।এবং আমার কাছে মনে হয় খুব বোকামি ।

বললাম হেসে হেসে,এ ছাড়া কোন পথ যে ছিল না।সবাইকে তো একদিন মরতেই হবে,তাই না? আমি না হয় সবাইকে জানিয়েই মরলাম।একদম আনকমন মৃত্যু।এমন মৃত্যু কজনের ভাগ্যেই বা জুটে?’

‘কিন্তু কিসের বিরহে তুমি নিজেকে বলি দিচ্ছ?’-আমার ডান হাতের মধ্যমা আঙুলে সামান্য চাপ দিয়ে ডালিয়া বলল।

‘পাগলি,তুমি তো সব কিছু জানো আমার।এ আমার এক স্বপ্ন।মানুষ নিজের চোখ কিডনি দান করে না,আমি না হয় নিজেকে দান করলাম।তাও বিজ্ঞাপন হয়ে থাকলাম।মন্দ কী?’-হেসে আমি বললাম।

ডালিয়া বিষণ্ন হয়ে নদীর অপাড়ে উঁচু গাছের দিকে তাকিয়ে বলে,কিন্ত এটা আত্মহত্যা ছাড়া কিছু হতে পারে না।খুনের চেয়েও এর চেয়েও শাস্তি বিশদ।এই সময়ে কুড়ি লাখ টাকার জন্য এমন কেউ করে?’

ডালিয়ার চোখে এক পলক তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে আমি বললাম,এই সময়ে কুড়ি লাখ টাকা কে দেবে আমায়? টাকা কি রাস্তায় শুয়ে থাকা কাঠাল পাতার মতো যে ,কুড়িয়ে পাওয়া যাবে? নাকি চুরি করব,লুট করব কোথাও।আমি জাস্ট কুড়ি লাখ টাকায় নিজেকে বিক্রি করেছি।এটা আত্মহত্যা হতে পারে না।’

ডালিয়া একটা শুকনো ঘাস ছিঁড়ে নদীর জলে ফেলে সেদিকে তাকিয়ে বলেনিজেকে বিক্রি করার রাইট তোমার নেই।তুমি যা সৃষ্টি করতে পার না তা ধ্বংস করার অধিকার তোমার নেই।’
আমি অল্প নড়ে বসে ডালিয়ার একটা হাত ধরে বলি,তুমি তো জানতে অল্প বয়সে আমি মা বাবাকে হারিয়েছি।আমার আঠার বছর বয়সে ভাইটির নয় বছর।আমি ওকে খুব ভালোবাসতাম।খুব স্বপ্ন ছিল যে ওকে আমার সর্বস্ব দিয়ে মানুষ করব।সে রকম ভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম।

বাবার রেখে যাওয়া নগত টাকা ও কিছু জমি দিয়ে মোটামুটি মন্দ যাচ্ছিল না সময়।সে সময় অঘটন শুরু হয়।ছোট ভাইটি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে।প্রথমে জ্বর জ্বর ভাব।পরে হাঁটুতে ব্যথা,কোমরে ভয়াবহ যন্ত্রণা শুরু হল।সে চিৎকার করে কাঁদে।ডাক্তার দেখিয়ে ওষুদ খেল কমল না।সে বিছানা নিল।খাওয়া কমে এল।শহরে বড় ডাক্তারের কাছে ও পরে ইন্ডিয়া নিয়ে যাওয়া হল।অতি উচ্চ মানের যন্ত্রের মাধ্যমে সব রকম টেস্ট করানো হল।না রোগ নির্ণয় হলো না সুস্থ হল।আমাদের আর্থিক অবস্থা মন্দ ছিল।যার ফলে চিকিৎসার জন্য কারো কাছে হাত পাততে হল।এবং সে টাকার পরিমাণ ছিল কুড়ি লক্ষ টাকা। টাকার ব্যবস্থা করেছিলাম বন্ধুর কাছ থেকে হয়ত কোন শর্তের মাধ্যমে বা ভালোবাসা নামক কোন বন্ধনের ভিত্তিতে।মুসাদ্দিক তখন স্থায়িভাবে বিছানা নিল।খাওয়া ঘুমের দরিদ্রতা থাকায় শরীর দুর্বল হয়ে এল।একা একা বসতে দাঁড়াতে খেতে পারে না। যা খায় তাও অল্প।শরবতের মত করে পানি করে চামচ দিয়ে খায়।অদ্ভুত রহস্য মায়া ভরা করুণ দৃষ্টিতে মাঝেমধ্যে তাকায় পরিচিতদের চোখে।অতি অল্প ভাষায় ক্ষীণ গলায় সে একবার বলল-‘,যদি বৃষ্টি হত।চোখ ভরে দেখতাম।বৃষ্টির জল শরীর মাখতাম।’তখন চৈত্র মাস।কাঠফাটা রোদ।আকাশ উত্তপ্ত।আকাশে মেঘের ছায়াও নেই।এরপর এক মাস কেটে গেল।বৃষ্টি হল না।জৈষ্ঠ্যের মাঝামাঝি সময়ে মুসাদ্দিক আবার বলল,‘-একটু যদি বৃষ্টি হত,প্রাণটা শীতল করে নিতাম।’মুসাদ্দিকের প্রার্থনা এবারও কবুল হলো না।আকাশ উত্তপ্ত হয়ে থাকল।বৃষ্টি অভিমান করে থাকল।জৈষ্ঠ্যের কুড়ি তারিখে ঝুম বৃষ্টি হল।আকাশ ভেঙে বৃষ্টি হল।সে বৃষ্টিতে বাড়ির পাশের জমিতে হাঁটু পানি জমল।ব্যাঙেরা আনন্দে গান করল কিন্তু মুসাদ্দিকের বৃষ্টি দেখা হল না।বৃষ্টি হওয়ার পঁয়ত্রিশ মিনিট পূর্বে মুসাদ্দিক বিদায় নিল চোখের জলের বৃষ্টি দিয়ে।

যে বন্ধুটি আমায় টাকা দিয়েছিল সে আজ নাই।তার স্ত্রী আছে।কথা ছিল যে সে না থাকা অবস্থায় টাকা ওর স্ত্রীর কাছে দিতে।ওদের দুটো বাচ্চাও আছে।দ্যাখো তো চিন্তা করে ওদরে টাকাটা যদি না দিই নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারব?’

ডালিয়া চোখ মুছে বলল,- ‘তুমি একটা লোন নিতে পারতে।তারপর ধীরে সুস্থে তা শোধ করতে।’

আমি বললাম,‘ওরা আমার চোখ দিয়ে বিজ্ঞাপন করবে।আমার কান নাক সব কিছু দিয়ে আলাদা করে বিজ্ঞাপন করবে।আমার প্রাণ পৃথিবীতে না থাকলেও প্রতিটি অঙ্গ বেঁচে থাকবে।এটা তো বিশেষ কিছু।তাছাড়া আমাকে এত টাকার লোন কেই বা দিবে,বলো?’

ডালিয়া হাসলো।ভয়ংকর যন্ত্রণা ও স্বপ্নহীনতার মধ্যে এই জগতে ডালিয়াই একমাত্র মানুষ যে হাসতে পারে।পৃথিবীতে একরকম মানুষ থাকে কঠিন মধ্যম সহজ অবস্থায় স্বাভাবিক থাকে ডালিয়া সেরকমই।বলল সে,‘ যদি আমি তোমাকে লোনের ব্যবস্থা করে দিই?’

ডালিয়ার মধ্যমা আঙুলে আলতো ¯পর্শ করে বললা,-‘জগৎ তো এমনি যে টাকা দিয়েই সব চলে, এখানে এক টাকাও এমনি কাউকে দেয় না কোন জন।বিপদে কারো কাছে টাকা চাইলে তোমায় আশ্বস্থ করবে ঠিকই দেওয়ার সময় থাকবে না আর।এই যে বিশ লাখ টাকা রেখে যাচ্ছি তা দিয়ে চার পাঁচটি বছর খুব নিশ্চিন্তে কেটে যাবে ওদের।’

ডালিয়ে উঁচু গলায় বলল,‘এইসব আর শুনতে চাই না,প্লিজ।’

নিস্তব্ধ বিকেলের আলো কংশ নদের জলে অপরূপ দীপ্তি ফেলেছে।মায়াময় জাদুর স্পর্শের মতো লাগে।একবার সেদিকে তাকিয়ে ডালিয়ার কাঁধে আলতো ছুঁয়ে বললাম,‘তুমি ছাড়া তো কেউ নেই আমার,ওদের একটু দেখে রেখো?’

‘আমি জানি না কিছু।শুনতে চাই না কিছু।’

আমি ডালিয়ার চোখে তাকালাম।কোন দুঃখবোধ নেই চোখে।বাস্তবতাকে মানিয়ে নেওয়ার কী সূক্ষ্ণ ক্ষমতা হয়েছে তার।অবাক হই।

বলি,‘রাগ করো না,ডালিয়া।আমার আর কিছুই করার নেই।সব কিছু ঠিক হয়ে গেছে।আমি এটা না করলে কো¤পানির কোটি কোটি টাকা নষ্ট হয়ে যাবে।তাছাড়া ওরা আমাকে বাঁচতেও দেবে না।সব পথই বন্ধ।’

ডালিয়া হাসার চেষ্টা করে বলল,-‘আমি সব ব্যবস্থা করব।তুমি সঙ্গে থেক।শুধু এক রাত নয়,অগণন রাত সঙ্গে থেকো।’

আমি বললাম,‘অতীত নিয়ে ভেবো না আর।আমি চাচ্ছি সবকিছু মেনে হিহি হেসে আমায় বিদায় দিবে।জানো তো সেই কবে থেকে একটু বসতে চেষ্টা করছি।পারছি না তো। চারপাশে ভাঙা কাচের টুকরো,মান্দার কাঁটা,কেঁচো,সাপ,উইপোকা,বিছে।আমাকে বসতে দেখে লোকেরা বলতো,বসো না,সাপে কামড়াবে,কাচ ঢুকে যাবে,কাঁটা বিঁধবে,দাঁড়িয়েই বেশ ভালো আছো।অথচ দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আমার পা ফুলে যায়,ব্যথায় কুঁকড়ে যাই।আমি বসে পড়ি।ধীরে সুস্থে কাঁটা সরাই,কাঁচের টুকরো সরাই,সাপ মারি।এই দেখে লোকেরা ভয় দেখায় আরোও,বলে সাপের কামড় খেয়ে মরবা।আমি ভয় পাই না দেখে লোকেরা ঢিল ছুঁড়ে।আমিও ও পাশ ঘুরে ঢিল ফেরাই।একটা একটা ঢিল জমা করে করে দেয়ালের মতো তৈরী করে ঢিল ফেরাই, তখন ভাবি যে,জগৎ তো এমনি যে, বসতে চাইলে সবাই বাঁধাই দিবে,স্থান নিজেকে করে নিতে হয়।সব চেষ্টা শেষেও আমি বসে থাকতে পারি নি।’

ডালিয়া চুপ করে থাকলো।

আমি আবার বললাম, ‘আমি তো এক শোলা,পড়ে ছিলাম খরখরে রোদ্রে,কোন এক বিকেলে কাক সুখাদ্য ভেবে ঠোঁটে নেয়,অবিরত ঠোকরায়,খাদ্যের গন্ধ না পেয়ে নদীতে ফেলে;আমি নদীর জলে পাক খাওয়া স্রোতে সেই থেকে ঘুরতে থাকি।আমার পিপাসা হয় না,ক্লান্তি বোধ হয় না;শোলার এসব হওয়ার কথা না।’

ডালিয়া আমার চোখে তাকাল।ডান হাতে স্পর্শ করল।কথা বললো না।

আমি ডালিয়ার চোখে না তাকিয়ে মৃদু ঢেউয়ে দৃষ্টি নিবন্ধ করে বললাম,‘মায়াবতী,এইসব উড়িয়ে দাও,বন্দী পাখিকে যেমন উড়িয়ে দেয় মানুষ,দুঃখ খুব ফাও একটা জিনিশ,সিগারেটের ধোঁয়ার মতো তাকে ছেড়ে দাও;মায়াবতী,হৃদয় থেকে মুছে ফেলো অভিশপ্ত কোন ঠিকানার কথা,যে ঠিকানা তোমার চোখে জল এনে দেয়,হৃদয়ে সমুদ্র বয়ে দেয়।ভুলো,মুখোশের ভিড়ে থাকা কোন মায়াকে।মায়বতী,ওই যে সরষে ফুলের ক্ষেত দ্যাখো,যেন হলুদ কোন গ্রহ,শান্তি আনন্দে কী নিদারুণ খেলা তুমি বরং হেঁটে বেড়াও হলদে গ্রহের ভিতর দিয়ে,দ্যাখো,পৃথিবীর

সব পাখিরা তোমার বন্ধু হবে,সুখ স্বপ্নের গান শুনাবে।’

ডালিয়া হেসে বলল‘,কবিতার মতো কথা বলছো যে।’

বলি আমি,‘জীবন মানেই তো কবিতা।একটা জীবন জন্ম দেয় কয়েক কোটি কবিতা।কয়েক কোটি কবিতা মানে তো কয়েক কোটি পৃথিবী।’

ডালিয়া বলল,‘বেশ দারুণ বলতে শিখেছ যে।শেষ সময়ে কি সবাই এমন করে বলতে শিখে?’

আমি বলি,‘জীবন এমন শিশু যে হাঁটতে শেখার আগেই শেষ হয়ে যায়।’

ডালিয়া অপরূপ হাসে।সে হাসিতে নদের জল নত হয়ে অভিবাদন জানায় তাকে।আমি অবাক হয়ে সে হাসি দেখি।জলের সঙ্গে নত হয়ে হাসিকে সম্মান জানাই।তারপর বলি,‘হরিণি,আমার চোখে তাকাও,ঠোঁট দ্যাখো,কপালে হাত ছোঁয়াও,ঘামের জলের ঘ্রাণ নাও,তোমার মুখে মাখো।বৃহৎ অশ্লীল হও,ধরো আমার স্বেদ সুগন্ধী ক্রিম,মুখে মাখো,আমার চোখের নিচে কালোতে হাত ছোঁয়াও,সে কালো দিয়ে কপালে টিপ দাও,ঠোঁটে যে ময়লা লেগে আছে ধরো তা ঠোঁটের রঙ।হরিণি,সে রঙ মুখের দু পাশে মাখো ,কী নিদারুণ দীপ্তি ছড়াবে যে তোমার চোখে মুখে ,একবার চেষ্টা করে দ্যাখো,যদি পারো!’

ডালিয়া আমার মাথায় সামান্য ঝাঁকি দিয়ে বলে,‘একজন ডাক্তার দ্যাখানো খুব প্রয়োজন।তুমি বোধয় ঠিক নেই।’

আমি বলি,‘সবকিছুই ঠিক আছে।দ্যাখো,বাতাসে সরষে ফুল কম্পিত হচ্ছে,জলের ¯্রােত বয়ে যাচ্ছে।তোমার পাশে আমিও বসে আছি।সব কিছুই তো ঠিক আছে।’

ডালিয়া হাসতে চেষ্টা করলো।মেঘে ঢাকা আকাশে সূর্য যেভাবে হাসতে চেষ্টা করে।

‘আজ রাতে আসবে?’ডালিয়ার উড়তে থাকা মসৃণ সুগন্ধীময় পাপহীন কেশে আলতো স্পর্শ করে আমি বললাম।

ডালিয়া বলল,‘হু।’

মায়া ভরা দৃষ্টিতে আমার চোখে তাকালো।কি যেন হিসেব করলো সে।আঙুল গুণলো। তারপর বিষাদ মাখা গলায় বলল,‘এর পর আর কোনদিন আমাদের দ্যাখা হবে না,তাই না?’

আমি বললাম,‘হুঁ,তবে বিজ্ঞাপনে আমায় দ্যাখতে পাবে।’

ডালিয়া বলল,হু।

‘আমার চোখও দ্যাখতে পাবে।’

ডালিয়া বলল,‘হুঁ।’

তারপর সে দাঁড়াল।

বিকেলের ম্লান আলোর দিকে তাকিয়ে বলল,‘শেষ বারের মতো আজকের রাতে আমার দ্যাখা তো হচ্ছেই।’

আমি স্বাভাবিক গলায় বললাম,‘শেষ বার বলো না।এর পর আরোও অনেক বছর পর ,অনেক দিন আমাদের দ্যাখা হবে।তুমি আমার চোখ দ্যাখবে আমি তোমার চোখ দ্যাখব।চোখে চোখে আমাদের কথা হবে।’

ডালিয়া হেসে বলল,‘তা তো হবেই।যদি তোমার মতো আমিও বিজ্ঞাপন হয়ে যেতে পারতাম।দুজনে বিজ্ঞাপন হয়ে দুজনকে দ্যখতাম।কতো যে চমৎকার হতো।’

আমি বললাম,‘পাগলি!তোমাকে বাস্তবে খুব মানায়।নক্ষত্রদের যেমন আকাশে,জলকে যেমন নদীতে পাখিদের যেমন বৃক্ষে তেমনি তোমাকে পৃথিবীতে।’

ডালিয়া পুতুলের মতো আমার চোখে তাকালো।ঠোঁটের বাম পাশ বাঁকিয়ে বলল,‘বিদায়ের আগে বুঝি সব মানুষই সাহিত্যিক হয়ে যায়?’

আামি হেসে বলি,‘আমি সব সময় এমন করেই বলি।তুমি হয়তো শেষ কথা মনে করে এমন ভাবছো।’

খানিক সময় ডালিয়া নিচু হয়ে তাকিয়ে থাকে।এক পলক আমার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়িয়ে,স্থির পায়ে হাঁটে।

ডালিয়া চলে গেল।আমিও ঘরে ফিরে এলাম।শেষ বারের জন্য অন্ধকারের মধ্যে আলোর অপেক্ষায় কিংবা দীর্ঘ ক্লান্তির পর সামান্য সুশীতল হাওয়ার অপেক্ষায় থাকলাম।

সে এলো রাত দশটার পরে।আমার ঘর যেন উজ্জ্বল আলোয় ভরে যায়।মিষ্টি সুঘ্রাণ আমার ভিতর স্পর্শ করে।আমি দেখি চারপাশে সবুজ পাখিরা উড়ে,সুস্নিগ্ধ গলায় গান বলে।এতো ভালো লাগে যে কোটি বছর বেঁচে থাকতে ইচ্ছে হয়।আমার যেন কোন অসুখ নাই,টাকার অভাব নাই,ভালোবাসার কমতি নাই,সুখের দারিদ্রতা নাই,যেন স্বর্গে আছি।তার দিকে তাকিয়ে কি যে হয় আমার,ঠিক বলতে পারব না। আমার যে সব পথই বন্ধ ,ফেরার পথ যে আর নাই ভুলতে চেষ্টা করি।মনে হয় যে আমি বিজ্ঞাপনে নাম লিখাই নি।অতীতে এমন কোন ঘটনা ঘটে নি।সে পাশে বসলে বললাম,‘তোমার খুব কষ্ট হবে, না?’

ডালিয়া অন্যরকম হেসে বলল,‘না তো, কষ্ট কী,তোমার চোখের বিজ্ঞাপন দেখে দেখে বিশ বেশ সুখেই থাকব।’

ডালিয়ার অভিমানী কণ্ঠের জবাবে বলি,‘কোথাও পালিয়ে যাই।যেমন করে বহু মানুষ প্রিয়জনকে নিয়ে পালিয়ে গেছে।’

ডালিয়া বলল,‘মানুষ মৃত্যু থেকে যেমন পালাতে পারে না জীবন থেকেও না।জীবন ও মৃত্যু থেকে কোথাও পালানো যায় না।’

স্থির গলায় বলি,‘তাই?’

ডালিয়ে নিষ্পলক আমার চোখে তাকিয়ে বলে,হুঁ।

‘তবে চলো প্রথম ও শেষবারের মতো একবার দুজনকে দ্যাখি।’

ডালিয়ার পাশে বসে আমি বলি।

ডালিয়া আমার ঠোঁটে আঙুল ছোঁয়ায়।শীতল গলায় বলে,‘এতো পান খাও কেনো?ঠোঁটে বিশ্রী পানের দাগ,দাঁতগুলো তো শেষ,একেকটা তরমুজের বিচি।কতোদিন সেভ করো না।দাড়ি গোঁফের কী জঙ্গল।রাতে ঘুমাও না।কপালে ব্রর্ণের বাগান।’

আমি হেসে বলি,‘তুমি একবার বললেই চাঁদের আলোর মতো আমার মুখে জ্যোতি ছড়াবে।হুরদের আঙুলের স্পর্শে পৃথিবীর সূর্য যেমন ম্লান হয়ে যায়।’

ডালিয়া ঠোঁট টিপে হাসলো।ডান হাত দিয়ে আমার গালে স্পর্শ করে দৃঢ় গলায় বলল,‘সে বেলা আর নাই।আমিও যে তোমার সঙ্গে বিজ্ঞাপন হতে এসেছি।দুজনে এক সঙ্গে বিজ্ঞাপন হয়ে

বহুদূরে হারিয়ে যাবো।প্রিয়দের নিয়ে মানুষ যেমন হারিয়ে যায়।’

বললাম আমি,‘ডালিয়া,বিজ্ঞাপন হতে ইচ্ছে আর নাই।’

ডালিয়া আমার ঠোঁটে মধ্যমা আঙুল চেপে ধরে বলল,‘আর একটি কথাও বলবে না তুমি।অনেক পাগলামি করেছ,এখন খুব চুপ করে থাকো তুমি।’

আমি মাথা নেড়ে সহজ নম্রত গলায় বলি,‘তুমি যা বলো।’

ডালিয়া হাসে।সে হাসির শব্দে পৃথিবীতে যেন সুঝংকার বয়ে যায়।মুগ্ধ হই।এক দল বিবস্ত্র নর নারীর মতো আমার উন্মাদের মতো হয়ে যাই।হাসির তালে তালে হারিয়ে যাই দুজনে দুজনের খুব গভীরে।পৃথিবীকে আর নোংরা মনে হয় না।সুখময় স্বর্গের খনি মনে হয়।

সাঈদ কামাল। গল্পকার ও ঔপন্যাসিক। জন্ম ৭  জুন ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দ, বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার ধোবাউড়া উপজেলার এক নিভৃত গ্রামে। প্রকাশিত বই: 'বৃষ্টি ছিল আমাদের ভালোবাসায়' (যৌথ কাব্যগ্রন্থ) এবং 'তৃতীয় জীবন' (গল্পগ্রন্থ)।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..