প্রক্সি
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
সন্ধ্যের অন্ধকার। ঝিরঝিরে বৃষ্টি হচ্ছে। অনুপম নতুন চাকরি নিয়ে গ্রামে এসে উপস্থিত। শহুরে বাবুর প্রথম গ্রামে পদার্পন।বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচতে এক চায়ের দোকানে এসে উঠলো। চায়ের দোকানে ছিল গোটা দুয়েক লোক।
–মশাই নতুন এখানে, মনে হচ্ছে?
–হ্যাঁ, আসলে আমি এই গ্রামের স্কুলে নতুন চাকরি নিয়ে এসেছি।
–ও,বা,খুব ভালো। তা উঠেছেন কোথায়?
–এখনো ঠিক করিনি কিছু।দেখি কাল সকাল হোক।
–ও আচ্ছা,দেখুন। বলেই পাশের লোকটিকে বললেন, চলো হে হরি ওঠো বাড়ি যাই, নইলে গিন্নি আবার চিন্তা করবে।
শুনশান চায়ের দোকান। দোকানি কিছুক্ষন পর বললো
–মশাইকে আমার বাড়ি নিয়ে যেতে পারতাম,কিন্তু ঘরে আমার আইবুড়ো মেয়ে আছে, বোঝেন ই তো গাঁয়ের লোক মন্দ কথা কইবে। আপনি বরং সামনের মোড়টা ঘুরে একটা বাড়ি পাবেন,ওখানে যান।কেউ থাকে না। চাবি আমার কাছেই থাকে। রাত টুকু কাটিয়ে কাল সকালে যা হোক ব্যবস্থা করবেন ক্ষণ।
সম্মত হয়ে অনুপম মাথার উপর ব্যাগটা তুলে চাবি নিয়ে এগিয়ে গেল সেই বাড়ির দিকে।
টর্চ জ্বেলে বাড়ির গেট খুলে ভিতরে ঢুকল সে। কেমন একটা সোঁদা গন্ধ ভিতর থেকে আসছে।অনেকদিন বন্ধ আছে বলেই হয়তো হবে । ভিতরে ঢুকে দেখল বিছানা পত্র সব ই আছে। ভিজে পোশাক খুলে ব্যাগে থাকা রাতের পোশাক পরে নিল বছর আঠাশের অনুপম মিত্র।তারপর রাতে আর রান্নার বন্দোবস্ত না করে বিস্কুট আর জল খেয়ে সটান ঘুম।হঠাৎ কিছু পরে কিসের একটা খসখস আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায় তার। ধড়ফড় করে উঠে বসে টর্চ জ্বেলে দেখে এক মহিলা বসে আছে তার পায়ের দিকের কোণে।
–কে তুমি? কি করে ঢুকলে এখানে?
ভয়ের স্বর অনুপমের গলায়।
–আমি পার্বতী। দরজা খোলাই তো ছিল, তাই ঢুকেছি।
–পার্বতী মানে, কোন পার্বতী?আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।কে তুমি?
–আমি শরৎ চাটুজ্জের নায়িকা গো।দেবদাসের পার্বতী। তোমার প্রথম প্রেম।
–এখানে কেন এসেছ কেন?কি যা তা বকছো?
হঠাৎ করে মুখ নামিয়ে একরাশ লজ্জা নিয়ে হাতের নখ খুঁটতে লাগলো সেই শরৎ বাবুর নায়িকা।
মুখ খানার উপর টর্চের আলো পড়লো।হঠাৎ যেন বুকের ভিতর ধক করে উঠলো অনুপমের।
নিষ্পাপ সরল মুখ,চোখে ফুটে উঠেছে এক মোহময়ী লাবণ্য। মাথায় কোঁকড়ানো চুল। শাড়ির আঁচল আর ব্লাউসের হাতের একটু অংশ ছেঁড়া।কিন্তু কি এক জ্যোতি যেন টর্চের আলোকে ম্লান করে তুলেছে।
–এখানে কেন এসেছ বললে না তো? কি হলো?
নখ খুঁটতে খুঁটতে পার্বতী বললো–
–পার্বতী আর অন্য কাউকে কখনো বিয়ে করবে না দেবদা।তোমায় যে পেয়েছি আবার।
–কে দেবদাস,আমি অনুপম মিত্র। নতুন চাকরি নিয়ে এসেছি এখানে।
–না না,তোমায় আমি ঠিক চিনেছি,তুমি দেবদাস আমার।দেবদা আমায় আর অন্য কারো হতে দিও না।
–ভারী মুশকিল তো রাতের বেলা।এই যাও তো যাও।
যত পাগল ছাগল রাতের বেলায় জোটে।
একপ্রকার ঠেলে বের করে দিয়ে দরজা দিল জোর করে বন্ধ করে।
ভোরের সময় আধো ঘুমে কানে এলো পাখিদের কিচিমিচি। নতুন জায়গায় ভোরেই ঘুম ভাঙলো অনুপমের। হঠাৎ টের পেল বিছানার কোনে বসে কেউ যেন কাঁদছে।ধড়ফড় করে উঠে বসলো আবার,কিন্তু এবার কাউকে দেখতে পেলো না আর।
প্রচন্ড অস্বস্তি নিয়ে বেরিয়ে গেল চায়ের দোকানে।–ইসস সারারাত বৃষ্টি হয়েছে, চারিদিকে বেশ জল দাড়িয়েছে। দাদা এক কাপ চা দিন তো।
–ও যে মাস্টারমশাই আসুন, রাতে ঘুম হয়েছিল তো?
-হ্যাঁ তা হয়েছিল। কিন্তু এখানে যে একটা পাগলী আছে,সে রাতে খোলা দরজা পেয়ে ঢুকে পড়েছিল।পরে অবশ্য বের করে দিয়েছি।
–পাগলী!এই তল্লাটে তো দেখিনি আগে । তবে অন্য কোনো গাঁ থেকে এয়েছিল হয়তো। আচ্ছা আপনি ওই বাড়ীটাই তো ভাড়া নিতে পারেন,যদি আপত্তি না থাকে তো। বাড়ির মালিক সপরিবারে কলকাতায় থাকেন।আমিই দেখভাল করি।-
-হ্যা,তবে তো মন্দ হয় না।বেশ বেশ আপনি তাহলে মালিককে বলে ঠিকঠাক করে রাখুন,নিয়ম কানুন যা আছে আমি বৈকালে এসে সারবো।
এখন উঠি দাদা,নতুন স্কুল,নতুন চাকরি, একটু আগে আগে যেতে হবে।
–হ্যাঁ হ্যাঁ, আসুন আসুন বিকেলে তবে দেখা হচ্ছে।
ওই বাড়িতে ফিরে এল অনুপম বাবু। নতুনস্কুলে প্রথম দিন। অনেক উৎসাহ নিয়ে তাড়াতাড়িতে বাথরুমে ঢুকলো স্নান করতে।গিয়ে দেখে বাথরুমের প্রতিটা বালতি ওর স্নান করার জলে ভর্তি।অনুপম ভাবল দোকানি বোধহয় এসব করিয়ে রেখেছে।
স্নান সেরে এসে ব্যাগে থাকা ইন্ডাকসন বের করে মায়ের দেওয়া চাল ডাল দিয়ে খিচুড়ি বানিয়ে খেয়ে চলল নতুন কর্মজীবনে।
–আসুন অসুন অনুপমবাবু,নমস্কার। হেডমাস্টার স্বাগত জানালেন তাকে।
–কবে এসেছেন তবে?
–নমস্কার স্যার, আমি কাল সন্ধ্যায় এসেছি।
–আচ্ছা খুব ভালো। থাকছেন কোথায়?
স্যার সামনের ওই চায়ের দোকানের সামনেই যে বাড়িটা আছে, যার মালিক পক্ষ কলকাতায় থাকে, ওনার বাড়িতেই থাকবো ভাবছি।
–ও সদাশিব বাবুর বাড়ি, বা বেশ বেশ। খুব ভালো । আচ্ছা আসুন অন্যান্য স্টাফ দের সাথে আপনার আলাপ টা করিয়ে দিই।
বিকেলে ফিরে কেয়ারটেকার চায়ের দোকানির কাছে চুক্তিপত্র সই করে চাবি নিয়ে দেখল তার রেডি করে রাখা ইন্ডাকসনের পাশে প্লেটের উপর রাখা গরম চায়ের কাপ।অবাক হয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখল খাটের পায়া ধরে মুখ নামিয়ে কালকের সেই পাগলী।
–কি ব্যাপার, তুমি আবার এসেছ?কাল যে বের করে দিলাম তোমায়!
–আমি তোমায় ছেড়ে যাবো না দেবদা।আমায় তুমি তাড়িয়ে দিও না।
–কে দেবদা, আমি অনুপম। তুমি কে!তোমার বাড়ি কোথায়?
–আমি সত্যি বলছি তোমায়,আমি শরৎ বাবুর নায়িকা,পার্বতী। তোমার পারো।
–বেশ,এখন যাও। গেট লস্ট।
চুপচাপ চলে গেল সে। একটু জিরিয়ে অনুপম বিকেলের কিছু বাজার করে এনে এবং দু চারজন লোকের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ ও আলাপ সেরে ঘরে এসে নিজের মত খানিক রান্না করে গেল বাথরুমে ফ্রেস হতে।এসে দেখে থালায় পরিপাটি করে সাজানো তার ই রান্না করা ভাত।আর ঘরের লাগোয়া বারান্দায় দাঁড়িয়ে সেই পাগলী গাইছে গান। তার ব্লাউসের ছেঁড়া হাতের উপর জড়িয়েছে তার শাড়ির আঁচল।
–অপূর্ব।অসাধারণ গলা তোমার।কিন্তু প্লিস বলো তুমি কে? বলো ।
–পার্বতী।
ধীরে ধীরে চলে গেল সে। সাজানো থালার ভাত খেয়ে শুয়ে পড়লো অনুপম।
রাত বারোটার ঘন্টা বাজলো দেয়ালের ঘড়িতে।অনুপমের ঠিক মুখের উপর উষ্ণ নিঃস্বাস,
–পার্বতী,আমি দেবদাস নই, আমি অনুপম বিশ্বাস করো।
উঠে বসে দেখে কেউ কোথাও নেই।
পরদিন সকালে চায়ের দোকানে-
–আরে মাস্টারমশাই রাত্রে ঘুম হচ্ছে তো ঠিকঠাক? কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো?
অনুপম বলতে গেল তার অবাঞ্ছিত পাগলির কথা, কিন্তু তার লাবণ্যময় দুটো চোখ আর মায়া ভরা মুখ বলতে দিলো না কিছুতেই।
–হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিকঠাক হচ্ছে ঘুম। চা খেয়ে তাড়াতাড়ি উঠে পড়লো সে, পার্বতীর জন্য একটা শাড়ি ব্লাউস কিনতে হবে যে।
নতুন কেন প্যাকেটটা বিছানার উপর রেখে কোনো এক অজানা ব্যক্তির ভর্তি করে রাখা বালতির জলে স্নান করে বেড়ে রাখা ভাত খেয়ে স্কুলে গেল অনুপম।কি জানি কেমন একটা মায়া পরে গেছে দুদিনেই। কোনোরকম আশ্চর্য না হয়েই পাগলিটার উদ্দেশ্যে বলল–রান্নার হাত কিন্তু তোমার খুব ভালো পার্বতী। স্কুলে গিয়ে মনে পড়লো শাড়িটা দিয়ে আসা হয়নি। বিকেলে ফিরে এসে দরজা খুলে ভিতরে গিয়ে দেখে তার শাড়িতে দেবদাসের পার্বতী হাতে চায়ের কাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
–বাঃ ভারী মিষ্টি লাগছে তো। আচ্ছা, তুমি আমায় বলো তো সত্যি করে কে তুমি?
কোনো উত্তর না দিয়ে চলে গেল পার্বতী।
পরদিন সকালে বারান্দায় বসে ফোন করছিল অনুপম তার মাকে।
–বাবু, তুই কেমন আছিস বাবা?রান্না করতে পারছিস তো?
–হ্যাঁ মা,তুমি চিন্তা করোনা। আমি ঠিক আছি।
–বাবু সাবধানে থাকিস। আর শনিবার আসার সময় তোর অপরিস্কার জামা কাপড় গুলো আনিস,আমি পরিস্কার করে দেব।
–হ্যাঁ মা ঠিক আছে। রাখছি। ভালো থেকো।
বাথরুমের ভিতরে কিছু কাচার আওয়াজ, না গিয়েও বুঝল অনুপম ,পার্বতী তার জামাকাপড় গুলোই রাখছে কেচে।
কিছুপরে উঠে গিয়ে দুহাতে তুলে ধরল তাকে, হাতের তালুর মধ্যে মুখটা নিয়ে জিজ্ঞেস করল–বলো না তুমি কে?
–পার্বতী,দেবদা।
জামা নিংড়াতে নিংড়াতে উঠোনের তারে মেলতে লাগলো সে।
স্কুলে কিছুতেই মন বসছিল না তার। বুকের মধ্যে একটা চাপা কষ্ট ,গলার কাছে দলা পাকানো মনখারাপ।
–অনুপম বাবুর বোধহয় বাড়ির জন্য খুব মনখারাপ করছে।
–না না ঠিক আছে উজ্জ্বল বাবু।
–আরে লজ্জার কি আছে,নতুন নতুন অমন হয় সবারই। মশাই বিয়ে টিয়ে ঠিক হয়ে আছে নাকি? মানে তার জন্য–
–না না, ওসব কিছু না।
সমবেত হাসির বেগ আর তার চাপা কান্না তাকে বের করে আনলো স্টাফরুম থেকে।
–স্যার,
পিছন থেকে ডাকলো ক্লাস সেভেনের শিল্পা।
–স্যার, আপনার কিছু হয়েছে কি আজ?
–না তো।
–আপনাকে কেমন যেন লাগছে আজ।
–না না,আচ্ছা শিল্পা তুমি কোথায় থাকো?
–ওই তো স্যার, ওই দিকের পাড়ায়।
–আচ্ছা একদিন যাবো তোমাদের বাড়ি।
–স্যার সত্যি যাবেন? খুব মজা হবে।
–আচ্ছা যাও এখন ক্লাসে। ঘন্টা পড়লো যে।
সন্ধ্যায় বারান্দায় চাঁদের আলো এসে পড়েছে অনুপমের সারা দেহে-মনে। বুকের মধ্যে মনখারাপ টা বড্ড তীব্র। কাল শনিবার,বাড়ি যেতে হবে, আসতে সোমবার।কিন্তু কে এই পার্বতী,যার জন্য এত মনখারাপ! ভাবতে ভাবতে রাতের চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে ঘুমের দেশে চলে গেল কখন।
সকালে ঘুম ভাঙতে দেখে সেই বারান্দার চেয়ারে তখনো।অবাক চোখ খুঁজতে লাগলো সেই অজানা অচেনা অথচ সেই চেনা মুখ।
সারাক্ষন অস্সস্তি আর চাপা টেনশন, কি হলো মেয়েটার,কি জানি। রান্না আর করা হলো না,স্কুল থেকে ফিরে সোজা বাসস্ট্যান্ড।
বাসে উঠে জানলা খুলতেই দেখে তার সেই পার্বতী তাকে টা টা দিচ্ছে আর হাসছে।
অনুপমের খুব ইচ্ছা করছিল নেমে জিজ্ঞেস করতে-কোথায় ছিলে তুমি? জানো আজ আমি কিছু খাইনি পার্বতী?কেন আসোনি তুমি?
বাস ছেড়ে দিয়ে অনেকদূর এসে গেছে কন্ডাক্টরের ভাড়া চাওয়াতে সম্বিৎ ফিরে এলো অনুপমের।
–কিরে বাবু, এসে থেকে গোমরামুখে বসে আছিস। জায়গা টা খুব খারাপ,না রে?
-না না মা, ঠিক আছে।
–না না তোকে দেখেই বুঝতে পারছি,বল না বাবা আমাকে।
–মা বলছি তো ঠিক আছে।
–কি জানি বাবা, আমার তো ঠিক লাগছে না।আমি তোর বাবাকে বলবো তোর কাছে গিয়ে থাকতে কদিন।
–মা, এসবের কোনো দরকার নেই।আমি ঠিক আছি।খেতে দাও তো, খুব খিদে পেয়েছে।
শনিবার রাত আর রবিবার দিন রাত যে কি করে কাটলো অনুপমের,তা আর কারো বোঝা সম্ভব নয়।
বাস থেকে নেমে প্রায় দৌড়ে যাচ্চিলেন অনুপম।
–স্যার স্যার
–ও শিল্পা বলো।
–এত তাড়াতাড়ি কোথায় যাচ্ছেন স্যার?
–আমি তো আমার ভাড়া বাড়িতে ফিরছি, তুমি কোথায় যাচ্ছ?
–আমি আপনার কাছেই আসছিলাম স্যার, সামনের মঙ্গলবার আমাদের বাড়িতে এক পুজো আছে,আপনি আসবেন স্যার?আমার বাবা বলছিল আপনাকে এসে নিমন্ত্রণ করে যাবে।
–আচ্ছা শিল্পা যাবো, এখন যাই একটু কাজ আছে।
তিনদিনের ছটফটানি আর মনের মধ্যে চেপে রাখা কান্নারা বেরোতে চাইছে এবার । দরজা খুলেই ভিতরে দেখে পার্বতী বিছানার নিচে বসে তার পুরানো শাড়িটা সেলাই করছে।অনপম একছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরল। কাঁধে মাথা দিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললো
–কোথায় ছিলে?বলো কেন আসোনি? বলো বলো।
–ও দেবদা আমি তো দুদিন বাড়ি গিয়েছিলাম গো, আমার মায়ের যে শরীরটা খারাপ হয়েছিল, তাই দেখতে গিয়েছিলাম।
সম্বিৎ ফিরলো অনুপমের। ছেড়ে দিল তাকে, জিজ্ঞেস করল–বলো না তুমি কে?
–পার্বতী।এসো হাত মুখ ধুয়ে একটু বসো।অনেক পথ এসেছো।
চায়ের দোকানে গরম আলোচনা,নতুন মাস্টার টা বোধহয় একটু পাগল।
–বুঝলে গিরিনদা, কাল বিকালে নদীর ধারে দেখলাম নতুন মাস্টার নিজের মনেই কথা বলছে।
–হ্যাঁ বাবলু,ঠিকই বলেছ।আমিও দেখেছি সকালে বাজার করে ফিরছিল যেন পাশে হাঁটছে এমন কারো সঙ্গে কথা বলছে।
ক্লাস শুরুর আগে
–এই অভি এখন কার ক্লাস আছে রে?
–কেন জানিস না,পাগলা বাবুর।
হা হা হি হি র মধ্যেই ক্লাসে আসেন অনুপম।
–এত হাসছো কেন?কি হয়েছে আমায় বলো।
–স্যার,মানস বলছে কাল বিকেলে আপনি রাস্তায় একা একা হাঁটছিলেন আর হাসছিলেন।
–ও বেশ এ আর নতুন কি! এ তো তোমরা রোজ দেখো আর বলো।এবার পড়ার কথায় আসা যাক।
হৈ হৈ ক্লাসেই কোনোরকমে পড়িয়ে বেরিয়ে আসে অনুপম।পিওন রামুদা এসে খবর দ্যায় হেডস্যার ডাকছে।
–স্যার,ডেকেছেন?
–অনুপমবাবু, আপনার নামে কমপ্লেন তো এসেই যাচ্ছে। আচ্ছা কি হয়েছে বলুন তো? বলছিলাম যে আমার এক বন্ধু খুব ভালো চিকিৎসা করছে যদি একবার যান।
বিকেলে অনপমের ঘরের লাগোয়া বাগানে ঘাসের বিছানায় পার্বতীর কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে অনুপম,চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে পার্বতী।
–তোমার দেবদা যে পাগল প্রমাণিত হচ্ছে লোকের কাছে।
–জানি তো দেবদা, তোমাকে আমি কতবার তো বলি আমায় নিয়ে বাইরে যেও না,যেও না। কেন যাও, ওইজন্য তো এমন বলে সবাই।
উঠে বুকে টেনে নিল পার্বতীকে। –কি করবো তোমায় ভালোবাসি যে। ঈশ্বরের সামনে তোমায় বিয়ে করেছি যে।
শিল্পা একদিন সকালে অনুপমের বাড়িতে এসে হাজির।
–স্যার,আমার বাবা একদিন এসেছিল আপনাকে নিমন্ত্রণ করতে,আপনি নাকি দরজাই খোলেন নি।আজ আমি এসেছি স্যার
–ও বাবাকে বোলো স্যার দুঃখিত যেতে না পেরে।
–স্যার আমার মা খুব অসুস্থ,আপনি আজ একবার যাবেন? মা খুব করে বলছে।
কোনো কিছু না ভেবেই অনুপম বলল–আচ্ছা যাবো।
–জানো তো,শিল্পা খুব বলছে ওর মা অসুস্থ আমায় একবার যেতে।
–না দেবদা, আমি যাবো, তুমি যেও না।
–ও আচ্ছা।
রহস্যময় অনুপমের জীবন এখন শুধুই দেবদাস হয়ে গেছে। পার্বতী তার বিবাহিতা স্ত্রী।কোনো রহস্য উনমোচন করতে যান না অনুপম।তার জন্য তার পার্বতী রান্না করে,জামাকাপড় কাচে, গান গায়,অপেক্ষা করে, ভালোবাসে।আদর করে।
দীর্ঘ তিনদিন বেঘোর জ্বরে শহুরে অনুপম, মাথার কাছে বসে আছেন মা। বাবা ঘরের এক চেয়ারে কিছুটা চিন্তাগ্রস্ত।
–হ্যাঁ অজয়বাবু,ছেলের জ্ঞান ফিরেছে,এবার dr.মিত্র সাইক্রিয়াটিস্ট ওনার সঙ্গে যোগাযোগ করুন।
বাড়ির ডাক্তার অমিয় বাবু বললেন অনুপমের বাবাকে।
আবছা স্মৃতি স্পষ্ট হয় অনুপমের। শিল্পা এসে ভেঙে পড়ে একেবারে–স্যার আপনার দুটো পায়ে পড়ি, একটিবার চলুন। মা খুব অসুস্থ স্যার।
পার্বতীকে কিছু না বলেই শিল্পাদের বাড়ি গেল অনুপম।বিছানায় নির্জীব হয়ে পড়ে আছেন ওর মা।
–মা, স্যার এসেছে।
–এসেছেন মাস্টার মশাই! আসুন। আমার বোধহয় আজ রাত আর কাটবে না। তাই শিল্পাকে দিয়ে জোর করে আনালাম আপনাকে।
–ছি ছি এমন বলবেন না,আমিই আসতাম,আসলে…
–আমায় বড় মেয়ে আসতে দ্যায়নি তো??না মাস্টার মশাই?
–বড় মেয়ে মানে?কি বলছেন এসব?
–শিল্পা যা তো মা তোর দিদির ছবিটা এনে দেখা তো।
রহস্যমাখা সেই মুখ সেই চোখ সেই হাসি।
–চিত্রা, আমার বড় মেয়ে।পাঁচ বছর হলো শহরে পড়তে গিয়ে এক্সিডেন্টে মারা গেছে। খুব বই পড়তো গল্প উপন্যাস নাটক…আপনি রোজ মোটর বাইকে ওর হোস্টেলের সামনে দিয়ে ফিরতেন, কোথায় যেতেন ও জানতো না, কিন্তু বিকেলে আপনার ফেরা সময় ও রোজ আপনাকে দেখতো। একদিন আপনি ফিরছিলেন আর চিত্রা আপনাকে মনের কথা বলতে যাচ্ছিল , আর তখনই উল্টো দিক থেকে আসা বাস টা…
অনুপমের মনে পড়ে গত বছর শীতের বিকেলের এক্সিডেন্টের কথা। ভিড়ের বাইরে থেকে মুখটা দেখতে পায়নি সে।
–তারপর থেকেই ও আপনার সঙ্গী। মৃত্যুর পরেও ওর আত্মা মুক্তি পায়নি।আমার কাছে আসতো আগে রোজ,আমি বারবার বলি আপনার কাছে না আসতে, তাই আমার কাছে আর আসে না। আর আসে না মাস্টার মশাই।আপনি মহান মানুষ, আমিও মৃত্যু শয্যায়।আপনি আমায় কথা দিন আমার মেয়েটাকে আপনি মুক্তি দেবেন।কথা দিন মাস্টারমশাই
কথা দেওয়ার আগেই চিত্রার মা চলে গেলেন নিরুদ্দেশে।
–মা জল খাবো।
–হ্যাঁ বাবু,এই যে নে।বাবা তোর কি হয়েছে?এখানে এসে তোর কি হয়েছে?
অপলক দৃষ্টি তখন ঠিক বুঝতে পারছে তার বুকের উপর গরম নিঃস্বাস আর গরম জল চুইয়ে ই পড়ছে।
দুই বছর পরের ঘটনা–
ঘরের এক কোনে টেবিলে বসে লিখছে অনুপম,পাশের চেয়ারে পার্বতী পা দুলিয়ে বলছে–
-ও দেবদা,বলো না আর কতদিন??ও দেবদা এবার চলো না আমরা দুজনে একসাথে থাকবো।
–যাবো পার্বতী যাবো, আর একটু লেখা বাকি আছে,আমি নতুন দেবদাস লিখছি যে, শরৎ বাবুর দেবদাসের মত না পাওয়ার যন্ত্রনা নিয়ে নয়,আমার পার্বতী তাকে বড্ড সুখী করেছে যে, বড্ড সুখী।
চাকরি ছেড়ে সবার চোখে পাগল পার্বতীর দেবদাস অনুপম মিত্র একদিন সকালে বালিশে মাথা রেখে চিরনিদ্রায় ঘুমিয়ে পড়লো। তার লেখার পাতাগুলো খোলা অবস্থায় উড়তে লাগলো গোটা ঘর এলোমেলো হয়ে
পরদিন খাবার দিতে এসে চাকর জগু দেখে গিয়ে খবর দিলো বাড়ির লোকদের । সকলে এসে দেখলো কাঁদলো আর অবাক হলো
অনুপমের গায়ের উপর হাতে বোনা এক চাদর চাপানো, তার উপর লেখা দেবদা আমি তোমাকে ভালোবাসি…পার্বতী।
শরীর ছেড়ে দেবদা আর পার্বতী তখন মুক্তির সন্ধানে অনেক দূরে যাচ্ছে আর বলছে–
আজি এ প্রভাতে রবির কর,
কেমনে পশিল প্রানের পর…
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নভেম্বর চলছে। অনির সাথে আজ দেখা হবে তা জানাই ছিল। এই তো ক’দিন আগেই দেখা…..
বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..
এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..