বিদ্যুৎলতা

পারিজাত ব্যানার্জী
ছোটগল্প
Bengali
বিদ্যুৎলতা

এভাবে ঘুমটা ভেঙে গেলে বড্ড কষ্ট হয়। গলার কাছে দলা পাকিয়ে জমতে থাকে নিশ্বাসগুলো, কিছুতেই আর ফুসফুস অবধি তা যেন পৌঁছোয় না। ঘাড়ের কাছে চিনচিনে ব্যথাটা বেড়ে যায় — জল তেষ্টা পায়। তবু বিছানা থেকে নামার সাহসটুকুও আর নিজের কাছেও নিজে দেখিয়ে উঠতে পারিনা।

অথচ বরাবর কিন্তু এমন ছিলামনা আমি। ছোটবেলা থেকেই পাড়ার অন্যতম ডাকাবুকো ছেলে হিসাবে বেশ নামডাক কুড়িয়েছিলাম। বাবা রাজনৈতিক দলের নেতা হওয়ার সুবাদে আমাদের পুরো পরিবারকেই বলতে গেলে মান্যিগণ্যি করত জনসাধারণ। বাবার বাদবাকি কাজ নিয়ে আমার তেমন কোনো আগ্রহ না থাকলেও বাবার দৌলতেই পাড়ার দুর্গাপুজো নিয়ে আমার উত্তেজনা এক অন্য পর্যায়ে পৌঁছে যায় যৌবনে। মনে আছে আজও, প্রতি বছর আমাদের পাড়া অন্তত শ্রেষ্ঠ থিমের জন্য পুরষ্কারটুকু ঠিক নিজের নামে আদায় করে নিত। পুজো শেষেও সেই পুজো নিয়ে উন্মাদনা তাই কিছুতেই কমত না আর আমাদের। পুজোর এই থিম বা বিষয়বস্তুর ভাবনার পিছনে যেই দুজনের হাত থাকতই থাকত সেইসময়, তাদের মধ্যে একজন ছিলাম আমি (বলাই বাহুল্য, বাবার পৃষ্ঠপোষকতায় এই দায়িত্বভার স্বচ্ছন্দেই পাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার), তবে অন্যতম কারণিক ছিল আরেকজন — দেবিকা।

দেবিকা বয়সে আমার থেকে বছর পাঁচেকের বড়। ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটিতে তখন ইতিহাস কি বাংলা – কি নিয়ে যেন মাস্টার্স করছিল ও। শ্যামা, দীর্ঘাঙ্গী ওই তরুণীর সর্বাঙ্গে সবসময় কিভাবে যেন লেগে থাকত বিদ্যুতের ঝলক আর স্পন্দন — ওকে দেখলেই উত্তেজনায় কানের ডগা লাল হয়ে যেত আমার। ওর শরীরী আবেদন আর গভীর সবজে-নীল চোখের মণির দৃষ্টি ওকে সবার মধ্যে ভীষণভাবে আলাদা করে চিনিয়ে দিত সহজেই। ইচ্ছে করত, ওর বিদ্যুৎপ্রবাহের সমস্ত তার নিজের রক্তে মিশিয়ে নিই। জন্মাতে দেখি বিদ্যুৎস্পৃষ্ট স্ফুলিঙ্গকে!

অথচ, কাজের সূত্রে কয়েকমাস সারা দিনরাত একসাথে থাকলেও কাজের বাইরে দেবিকা আর বিশেষ কোনোরকম কথাই যেন বলতনা আমার বা অন্য কারও সঙ্গে।মাঝেসাঝে আনমনা হয়ে দেখতাম ও তাকিয়ে রয়েছে আকাশের দিকে। কি দেখছে জিজ্ঞেস করলে বলত, “ তেমন কিছু নারে — সামনে তাকালে আমি সব দগ্ধ পোড়া হাড়গোড় দেখতে পাই শুধু — আর দেখি একটা রাস্তা যেখানের পরতে পরতে মিশে রয়েছে কান্না। উফ্! তাই — তাই আমি শুধু আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি — ওসব নিয়েই বাঁচি, জানিস, ওই আকাশ থেকেই সৃজনশক্তির রসদ কুড়োই। আবার,কখনো কি দেখি জানিস, কালো নিকষ আঁধারের কোলেই জ্বলে ওঠে কোনো কোনোদিন, আমার নামের আস্ত একখানা তারাবাতি!”

ওর এসব কথায় আমার বিচলিত হওয়া মানাতোনা তখন। আমি জানতাম, অমন একটু আধটু আজগুবি নাহলে বড় শিল্পী কিছুতেই হওয়া যায় না।আমিও তো তখন স্কুল কলেজের পথ ভূলে ঘুরে বেড়াচ্ছি রাস্তায় রাস্তায় – যদিও, ঠিক কি খোঁজার তাগিদে — তা জানি না। আমিও কি কম পাগলামি করেছি তবে, তাই না! যদিও দেবিকার ব্যাপারটা আলাদা। ও ছিল যাকে বলে, একদম জাত শিল্পী — সামান্য খরকুটো বা পাতাও ওর হাতের ছোঁয়ায় মায়াবী হয়ে উঠতে দেখেছি মণ্ডপের অলিন্দে বারবার — তাই ওর এরকম মাথার ব্যামোয় আমাদের তো আসকারা দেওয়ারই কথা যাতে আরও বেশি করে উঠে আসে ওর প্রতিভা – দিতামও। ওর সঙ্গে শিল্পের সব ডেরায় যাওয়ার এর থেকে ভালো ফন্দি যে তখন আর আমার কিছুই জানা ছিলনা। ক্ষাণিকটা কাজের সূত্রে তো বটেই, তবে মোটের উপর আমার ওই সময়ের এলোমেলো ছন্নছাড়া ‘আমি’ টাকে ভালবাসে দেবিকা — এই ভাবনাটা বারবার দপদপ করে উঠত তখন ভিতরভিতর। ওর প্রতি আমার যে তীব্র কামনা আমি অনুভব করতাম তখন — তারফলেই হয়তো বারবার মনে হতো, ঘনিষ্ঠ ভাবে নিবিড় করে শুধু খুঁজে চলি ওর কেন্দ্রস্থল — বাকি কথা নাহয় পরেই ভাবব যেকোনো অসময়ে!

সত্যিই আর মাথা ঘামাইনি তাই। যখন কথা বলতে বলতে আমার হাত বারবার নেমে গেছে ওর পিঠে, বাধা না পাওয়ায় আর একটু বাড়তে দিয়েছি আমার প্রশ্রয়কে, তখনও বুঝিনি, এ কেমন মরীচিকা, এ কিসের কুহেলিকা! তবে ঠিক যেই সময় আমি সম্পূর্ণভাবে নিবিড় করে পেতে চেয়েছি ওকে আমার অভ্যন্তরে — হঠাৎ টের পেয়েছি, দেবিকা আর নেই সেইখানে। কখন যে অন্ধকারকে সঙ্গী করে নিঃশব্দে পার করে গিয়েছিল ও আমার জীবন্ত দগদগে শব, আমি তাও বুঝিনি। শুধু টের পেয়েছিলাম, এরপর এক রাতও আর আমার নিশ্চিন্তে ঘুম হবে না।

দেবিকাকে কি আমি ভালবাসতাম? নাকি ও শুধুই ছিল আমার আকাঙ্ক্ষা, ভ্রম? ওর মাখনের মতো পেলব শরীর পেরিয়ে ওর মনের খবরাখবর কি নিয়েছিলাম আমি কখনও? এখন বুঝি, না। নিইনি। অথচ দেবিকা কিন্তু একটা একটা পালক গুছিয়ে পেতে ডানা মেলে খুলে দিচ্ছিল আমার সামনে নিজেকে ওর মতো করে। আমি শুধু আমার উদ্দামতায় সময় দিতে চাইনি ওকে এতটুকু! ওর যেসব কথা আমি বুঝিনি, পাগলের প্রলাপ বলে হেসে উড়িয়ে দিয়েছি একসময়, আজ জানি, তার প্রতিটি কথা কতখানি খাঁটি। কিভাবে জানলাম? দেবিকাই সব বুঝিয়ে বলেছে এই কদিন আগে, অন্ধকার নির্মম অনিদ্রা ভোগা ক্লান্ত অবসন্ন রাত্রিতে।

নাঃ, আবার বরং ফিরে যাই গোড়ার ওই সময়ে। যখন একটু একটু করে জন্ম হতে শুরু করল জলপ্রপাতের। সেই জলে গা ভাসাতে কত লোকেই তো ব্যাকুল হয়ে ঝাঁপ দিয়ে থাকবে একসময় — তারা সবাই আজ কালের গর্ভে অঘোরেই নিশ্চিন্তে শুয়ে। আমি সব বুঝে তাই আর ঝাঁপ দিইনি কখনও — আলতো করে ভাসিয়ে নিয়ে গেছি শুধু নিজেকে ওই জলের নিবিষ্ট তোড়ে। বুঝিনি, যাকে ঝর্ণা বলে ভ্রম হচ্ছিল এতক্ষণ, তা আসলে বৈদ্যুতিন এক বলয়। এখানে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হলে মারা যায় না মানুষ — সমস্ত যন্ত্রণা আর অভিশাপ বুকে নিয়েই তাকে কেবল অযাচিত ভাবেই অমর হয়ে যেতে হয়।

সেবারের পুজোর থিম ছিল আমাদের ‘বিদ্যুৎলতা’। দুটো তারের যোগস্পর্শে কিভাবে জীবন পায় অজানা সব রোমহর্ষক মূর্চ্ছনা — তাই তার সুনিপুণ পরিকল্পনায় ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছিল দেবিকা। বিদ্যুৎ সেখানে শুধু আলোর দিশারী নয়, সে তখন ভয়ংকর এক বিভীষিকাও। ওর কাছেই শোনা, ছোটবড় কাউকে কখনও রেয়াৎ করে না ওই আলোর ঝলকানি — সবই শুধু কালো পোড়া কাঠের খণ্ড তার কাছে — ভাজাভাজা হয়ে যাওয়া রক্ত মাংসের হাহাকার।

উদ্বোধনের আগে মনে আছে সেবার, দরদর করে ঘামছিলাম। অন্যবার দেবিকার হাতটুকু এই উত্তেজনায় জড়িয়ে ধরতে সাহসের অভাব টের পেতাম না। আহ! ওই শ্যামাঙ্গিনীর নরম মসৃণ নিটোল দুটো হাত! হাত, হাত থেকে কাঁধ, গলা, গলা থেকে শুরু করে শরীরের প্রতিটি নিখুঁত ভাঁজ! এত কাজের পর এটুকু প্রাপ্য তো পাওনাই থাকে, তাই না?

তবে, সেবছরটা আলাদা। সেবছর মহালয়ার দিন থেকেই বেপাত্তা দেবিকা। পাড়ায় লোকজনের বলাবলি, মুখ চাওয়াচাওয়ি, পুলিশের ব্যস্ত সন্ত্রস্ত আনাগোনা। খুব ভয় করছিল আমারও। তবে কি সত্যিই আর কোনোদিন দেবিকাকে দেখতে পাবোনা? এভাবেই কি তবে মাঝপথে যৌবনের প্রথম সেই তাড়নার সাথে আমার সামনে পরে থাকা উজ্জ্বল জীবনের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল! বাবা জানতাম, তাই চাইছেন মনে মনে। পুলিশের দৃষ্টিতে তিনি আমার জন্য লেখা মৃত্যুর ফরমান যে স্পষ্ট পড়তে পারছিলেন!

আমি এসব কিছুই জানতাম না তখন। আমি তখন বিপুল ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে শুধু দ্বিতীয়ার শেষ বিকেলে তখন দেবিকার হাতে তৈরি থিমের মোড়ক উন্মোচনের অপেক্ষায়!

অবশেষে এলো সেই মুহূর্ত। মাহেন্দ্রক্ষণ। কালো গলির দুপাশেই জ্বলে উঠল বিদ্যুতের ঝর্ণা, হাজার তারাবাতির আলোয় নির্নিমেষ উজ্জ্বলতর হয়ে উঠল আশ্বিনের আকাশ। হঠাৎ এই চমকের রেশ ধরে প্রধান মণ্ডপের অংশটা দিকে কারো চোখ পড়েনি প্রথমে। আশপাশের এত আলোয় চোখ সয়ে এলে বাজপরা পোড়া একখানা বাড়ির চারদেওয়াল বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠল নাটকের পরবর্তী দৃশ্যের মতো আচমকাই। তার উপরেই হঠাৎ নজরে পড়ল প্রধান দালান জুড়ে কেবল একলাই অপেক্ষারত দেবীমূর্তির নিকষ কালো অবয়ব। হাঁ করে তাকিয়ে থাকলাম আমি অমন এক ঐশ্বরিক সময়ের সাক্ষী থাকার চেতনায়।

সম্পূর্ণ নগ্ন ঝলসে যাওয়া শরীরে কোন অদ্ভুত মমতায় প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছে দেবিকা, বেশ কিছুক্ষণ তা টেরই পেলাম না। হঠাৎ তীব্র চিৎকার আর হাহাকারে হুঁশ ফিরল যেন। ভিড়ের মধ্যেই কেউ চেঁচাচ্ছে তখন আশঙ্কায়, “পুলিশ, পুলিশ ডাকো!”

আবার কেউ করছে হাহুতাশ — “ওমাগো! আমাদের দেবিকার একি অবস্থা!”

পুরোহিত হন্তদন্ত হয়ে সবাইকে ঠেলে মাঝখান দিয়ে বেড়িয়ে যাওয়ার আগে বলে গেল শুনলাম — “এই বেদীতে আর পুজো হবে না! হে ঈশ্বর! এতবড় অমঙ্গল! এ কেমন বিচার তোমার মা?”

এবার দেখলাম ভালো করে। ওই পোড়া গন্ধ মাখা বাকি পড়ে থাকা সমস্ত শরীরে কোথাও একটুকরো জায়গা করে নিতে পারলনা আমার কামনা। হরহর করে বমি করে দেওয়ার আগে চোখ বুঁজে শুধু বুঝলাম — ওই সবজে-নীল চোখের আভার শিখা কিন্তু কক্ষণও মরে না।

স্বপ্নে গায়ে চেপে বসা ভয়টা থেকে আজও নিস্তার পাইনি। মধ্যিখানে বয়ে গেছে বেশ কটা বছর, তিনটে মহাদেশ, আর বাসস্থানের জন্য প্রয়োজন কিছু এদিকওদিককার চাকরি। বাবা গত হয়েছেন। তাই দেশে ফেরার কথা বলার মতোও আর কেউ নেই, এমনিতে আমারও আর পুরোনো ওই দগ্ধ পাড়ায় ফিরে যাওয়ার কোনো বাসনা জাগেনা। বিয়ে থা করিনি, তবে রমণীসঙ্গে আপত্তিজনকও কিছু দেখিনা। বিকেল হলেই সুরার গ্লাসেরা চলকে ওঠে, সম্ভোগে ব্যস্ত করে রাখি নিজেকে যখনতখন। তবুও রাতের আবছা আলোয় যখন ঠিকরে ওঠে আলোর রাশি রাশি ফুলকি, আবার তখন, দেবিকার পুড়ে ‘নেই’ হয়ে যাওয়া কান কামড়ে ধরে আমার ভিতরে লুকোনো কুৎসিত ভয়ঙ্কর রাক্ষস। ও যত চিৎকার করতে থাকে, “ছাড়, ছাড় আমায়, আমি আকাশে দেখেছি আশ্চর্য আলোর বলয়”, তত উত্তেজনা আর লোভের লালসায় আমি তারে তারে যোগাযোগ ঘটিয়ে বিদ্যুৎ তরঙ্গিত করতে থাকি ওর শিরায় উপশিরায়।

আহ! এই দুঃস্বপ্ন আর কোনোমতেই যেন ভাঙবার নয়। এই থিমের প্রধান কুশীলব যে আমারই পোড়া ঝলসানো প্রেতাত্মা!

পারিজাত ব্যানার্জী। কবি ও গল্পকার। জন্ম ভারতের ধানবাদে হলেও আদ্যপ্রান্ত বেড়ে ওঠা কলকাতায়, বর্তমান নিবাস অস্ট্রেলিয়ার সিডনি। প্রকাশিত বই: 'লাল স্নানের গন্ধ' (গল্প সংকলন, ২০১৭), 'কৃষ্ণ অন্ত কাব্য' (পৌরাণিক কবিতা সংকলন, ২০১৭), 'তেরো চক্রে ভুত' (অণুগল্প সংকলন, ২০১৭) 'তবুও বেহিসাবি...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ