বিনায়ক নার্সিংহোমের ৩০৪ নং কেবিন থেকে

বিতস্তা ঘোষাল
নন ফিকশন
Bengali
বিনায়ক নার্সিংহোমের ৩০৪ নং কেবিন থেকে

জীবন মৃত্যুর মাঝখানে একটা হাইফেন। এই হাইফেনটা কখনো কখনো এতটাই কাছে এসে যায় যে মনে হয় সব বুঝি নিভে গেল। আমার নিজের জীবনের ক্ষেত্রে এই হাইফেনটা কয়েক বছর অন্তর অন্তর একদম ছোটো হয়ে আছে, যেকোন মুহূর্তে মনে হয় এই বুঝি… 

এই এবার যেমন, কোনো কিছু নেই, হঠাৎ করেই রাতের দিকে কাঁপুনি দিয়ে রোজ জ্বর, আমি কী আর জ্বরে বাড়ি বসে থাকার মেয়ে! ক্যালপল আর কাজ, দিব্যি চলছিল পাঁচ দিন ধরে এমনি। কিন্তু ওই যে মাঝেমধ্যে সেই সুদূরের আহ্বান আসে. .. ব্যাস, আমি কাবু, তারপর থেকে বিনায়ক নার্সিংহোমের ৩০৪ নং কেবিন বরাদ্দ। তাও এক সপ্তাহ হতে চলল। প্রতিদিন ভাবি, আসছে, ডাক্তারের চিঠি আসছে, আমার ছুটি, আর তখনি বেহায়া শরীর নতুন কোনো ফন্দি আঁটে, ঠিক কিছু না কিছু এতটাই বাড়িয়ে দেয় যে, চিঠি আসে না। সিপ্টোসেমিয়া বলে নাকী! লিভার, ইউরিনারি ট্রাক, চেস্ট, লাংগস, আরো কত কী! সব সব ইনফেকটেড। মালট্অরগ্যান ফেলিওর হচ্ছে কী! ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করি। ডাক্তার রিপোর্ট খুলে বোঝাতে বসেন, দেখুন এতগুলো লেভেল বেশি।

আমি আর শুনি না। শুধু দূর্বল থেকে দূর্বল হতে থাকি। বাম হাতের শিরা ফুলে যায় স্যালাইন খেতে খেতে, স্থান বদলে ডান হাততারও অবস্থা ক্রমেই জটিলআমি যন্ত্রণা ভুলতে গল্প শুরু করি যত সিস্টার, যত আয়া মাসি, আর এম ও…, সুইপার, ক্যান্টিনবয়সিস্টার সুজাতা আমার বোন হয়ে যায়, যায়, সে আমার মামার বাড়ি অঞ্চলের মেয়ে। তার সঙ্গে মনে মনে মনে ছুটে বেড়াই রামপুরহাট, নিশ্চিন্তপুর, আমার শৈশবের মামার বাড়িচোখের সামনে কত ঘটনা ছবির মতো ভেসে ওঠে।

দৃশ্যান্তরে সিস্টার রুপা গান শোনায় শ্রাবণের ধারার মত, আমি ঝরতে থাকিঅপেক্ষায় থাকিসেই বাদল বায়ুর যে ফুৎকারে উড়িয়ে দেবে সব রোগআমি ফিরে গিয়ে বসব আমার প্রিয় টেবিলে, হাতে তুলে নেব কলম

কে জানে আরো কতদিন!

দুই.

আমার কেবিনটা তিনতলায়। রাস্তার দিকে। সেদিকে কেবিনের গা ঘেঁষে একটা রাধাচূড়া গাছ। হলুদ ফুলে ঢেকে আছে। কাচের জানলায় তার প্রতিবিম্ব পরে। কতগুলো পায়রা সেখানে, কখনো বা জানলাটায় বসে দিন রাত বকবকম বকবকম করে। ওরা এত কী কথা বলে! আমার আরোগ্য প্রার্থনা করে কী? আমি তো রোজ বলি ওদের, ওই, দোহাই তোদের একটুকু চুপ কর, ভালবাসার দে মোরে এতটুকু অবসর। তারপর নিজের মনেই হাসি। ভালবাসার অবসর! হায় রে!

আমার এখন অনন্ত অবসর। সারাদিন কেবল শুয়ে, মাঝেমধ্যে উঠে বসি, জানলা দিয়ে দেখি, দূরে পুকুরটা পুরো কচুরিপানায় ভরতি। বালি সিমেন্ট মাটি দিয়ে ভরাটের চেষ্টা হয়েছিল, ব্যর্থ যদিও। তার পিছনে খেলার মাঠ। পাঁচটায় যখন মাসি তাগাদা দেয়, দিদি ওঠেন, মুখ ধুয়ে নেন, ডাক্তার বাবু আসবে, ওষুধ খেতি হবে, আমি বিরক্তি নিয়ে চোখ খুলে উঠে বসেই জানলা দিয়ে প্রথমে ওদিকেই চোখ চলে যায়। ভোরে ছেলেপুলের দল ফুটবল খেলছে। ভীষণ ইচ্ছে করে দৌড়ে ওদের কাছে চলে যাই। কিন্তু তখনি যন্ত্রের মত সিস্টার এসে স্যালাইন বোতলটা পালটে দেয়, বলে, ডাক্তার এসে গেছেন। খুব রাগ হয়, ডাক্তারবাবুর কী কোনো কাজ নেই! এত সকালে কেন আসেন! নাকি রাতে ঘুমোন না! ভোর হতেই বেরিয়ে পরেন! তারপরেই মনে পরে যায়, আরে উনি তো এখানে রোগী দেখে চলে যাবেন বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ। সেখানে আমারই মতো শত শত রোগী ওনার অপেক্ষায়। মাফ করে দিই ওনাকে।

তাড়াতাড়ি ফ্রেস হয়ে পারিষদবর্গ (আর এম ও, সিস্টার এদের মধ্যে আবার আর এম ও এর দেখা শুধুমাত্র ডাক্তার এলেই পাওয়া যায়। তবে চুপি চুপি বলি ২ দিন একজন আর এম ও এসেছিলেন, সবদিক থেকেই ব্যতিক্রম, এমন ডাক্তার এলে শরীর এমনিই সুস্থ হয়ে যায়। যদিও দুইদিনই ওনার টার্ন ছিল) নিয়ে আসা ওনাকে হাসিমুখে বলি সুপ্রভাত।

কিছু সাধারণ প্রশ্ন জ্বর এসেছিল? ইউরিন, পটি, হেডেক, ভমিটিংআমি বাধ্য মেয়ে হয়ে সব উত্তর দিই, তারপর বলি, কবে আমার ছুটি হবে? উনি বলেন, এই তো অ্যান্টিবায়োটিকটা শেষ হোক, কদিন দেখি

দুজনেই আর কথা বাড়াই না। উনি চলে যাবার পর মাসি তাগাদা দেয়, বিছানা পাল্টাতে হবে, স্নান করতে হবেআমার তখন দুচোখে ঘুম। ভালো বাচ্চার ভূমিকায় অভিনয় করা ছাড়া কিচ্ছু করার নেই। উঠে সামনে পাতা সোফায় বসি, বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকি। মাসির বিছানা পালটানো শেষ হয়, এক রংচটা নীল চাদর থেকে আরেক রংচটা চাদরে উঠে বসিএবার ১৫ মিনিট অক্সিজেন নেওয়ার পালাকী যেন বলে তাকেনেবুলাইজেসন! কখনো কখনো স্যালাইন চ্যানেলে রক্ত এসে যায়। মাসি মৃদু ধমক দেয়G সিস্টার এসে সিরিঞ্জ দিয়ে ওয়াশ করে আবার নর্মাল করে চ্যানেল। বলে, এত ছটফট করলে রোজ চ্যানেল বদলাতে হবে। আমি হাসি। এই সাতদিনে সাতবার চ্যানেল বদলেছে। মনে মনে বলি, যা খুশি কর তোরা হাত নিয়ে, আমার কী!

ঘড়িতে তখন সবে ছটা। আমার শহর আড়মোড়া ভাঙছে, ধোঁয়া উঠছে রাস্তার উনুনে, কেটলির জল ফুটছে, প্রথম ট্রাম ডিপো ছেড়ে ঘড়াং ঘড়াং শব্দে এগিয়ে চলেছে

শুরু হচ্ছে আরো একটা দিন।

তিন.

নার্সিংহোমের যে ঘরটায় আমি রয়েছি, তার সবটাই ঘিয়ে রঙের। দুদিকে দেওয়াল, একদিকে দরজা, একদিকে কাচের জানলা। জানলার পাশে এসি। বিছানার মুখোমুখি দেয়ালে জয়পুরী প্রিন্টের সরু একখানা ছবি, একফালি চাঁদের মতো ঝুলে। তার নিচে খয়েরি রেক্সিন দেওয়া সোফা। ওখানেই ভিজিটররা বসেন, রাতে অ্যাটেন্ডেন্ট ঘুমোন। ঠিক তার পাশে বাথরুম। মোটামুটি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন মাঝারি মাপের। তার বাঁদিকে একটা ছোট দেরাজ, ওষুধ, জলের জার, গ্লাস রাখার পাশাপাশি পেশেন্টের টুকিটাকি জিনিস রাখাও সেখানেই। তার পাশেই কাঠের আলমারি। বিছানার চাদর, কম্বল ইত্যাদি থাকে তাতে। এই আলমারির গায়েই ছোটো একটা টিভি। রাতের আয়া মাসি এসেই টিভি খুলে বসার চেষ্টা করতেই, ধমক খেয়ে আর দ্বিতীয়বার সে ভুল করেনি। আর কেমন করে যেন সবাই সেই মুহুর্তে জেনে গেছিল, নতুন পেশেন্ট টিভি দেখে না, গল্প করে। মনের দুঃখের কথা শোনে। ভালোবেসে কথা বলে, মা সম্বোধন করে

বা্স, সেই থেকে প্রতিটি মাসিদিদির কত গোপন যন্ত্রণার কথা শুনলাম এই সাতদিনে। শর্মিলাদি, পিয়ালি, ঝুমা মাসি, কাত্যায়নী

তেমনি এক দিদি রিনা দি। লম্বা, সুন্দরী, এক নজরে দেখলে দক্ষিণী কোনো নায়িকা মনে হবে। সে আমার অ্যাটেন্ডেন্ট নয়। অন্য পেশেন্ট সামলে আসে দেখভাল করতে আমার। তার সঙ্গেও কাজের ফাঁকে আড্ডা জমে। ১০ বছর আছে এই পেশায়। বরের গার্মেন্টসের ব্যবসা ছিল যৌথভাবে। সুখী পরিবার, নিজেদের বাড়ি। ভরা সংসার। ছোট মেয়ে হবার ১ বছরের মাথায় ধরা পরল কিডনির সমস্যা।

সাতদিনের অসুখে চলে গেল জ্বলজ্যান্ত মানুষটা দিদি।রিনাদির চোখে জল।

জানো দিদি, বর না থাকলে শ্বশুর বাড়িতে ছেলের বৌয়ের কোনো অধিকার থাকে না। ১ মাসের মাথায় আমাকে ২ মেয়ে নিয়ে বের করে দিল। অপয়া মেয়েমানুষ, স্বামী খেয়েছি। কী করব বলো! সেই লড়াই শুরু হল।

তোমার বরের ব্যবসা?

ও ব্যবসা দেওর নিয়ে নিল। শাশুড়ি বলল, তোমার বরের আবার কী? সব আমার ছেলের ছিল, তাকেই তো

রিনাদির চোখে জল।

আমি চুপ করে থাকি। এ দৃশ্য তো গরীব বড়লোক মধ্যবিত্ত বলে আলাদা কিছু নয়, এ তো সব মেয়েদের যন্ত্রণা, অপমানের। যুগ যুগ ধরে চলে আসা এক দৃশ্য। কেবল স্থান, বদলে যায়।

রিনাদি বলে, আগে বাড়ির কাছেই আয়ার কাজ করতাম। পড়াশোনা তো বেশি দূর করিনি। এছাড়া কীই বা করব! তবে বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছি সকলের আশির্বাদে। জামাই বেশ ভালো। বলতে নেই, মেয়ে আমার ভালো আছে।

আমি মনে মনে বলি, তাই যেন থাকে ঈশ্বর। মাকে আর চোখের জল ফেলিও না।

কিন্তু রিনাদির মুখ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে যখন ছোট মেয়ের কথা বলে।জানো দিদি, আমার এ মেয়ে পড়াশোনা, নাচ সবেতেই দারুণ। কত প্রাইজ নিয়ে আসে নাচ করে।

ভালো তো, আজকাল নাচ তো ভালো পেশা।

মেয়েও তাই বলে। তবে এখন কদিন বন্ধ আছে। আপেন্ডিসাইটিস অপারেশন হয়েছে। তাছাড়া আর একটাও বিষয় আছে। আগে মেয়ে ছোটো ছিল। নাচ করলে পাড়ার লোকেরা কিছু বলত না। কিন্তু এখন নোংরা কথা বলে। আমি সারাদিন বাইরে থাকি। তাই ভয় হচ্ছে কেউ না আবার কিছু করে দেয়। দিনকাল তো ভালো নয়।

অত ভেবো না। মেয়েকে বলো, যেটা করছে মন দিয়ে করতে। এখন ডান্স বাংলা ডান্সের মাধ্যমে দেখছ না কত মেয়ে উঠে আসছে। খারাপ হলে বাবা মা ছাড়ত? আমি বলি।

মেয়েও তাই বলে। তবে আমার ভাগ্য তো ভালো নয়। ভয় হয়।

ভয় পেও না। কে বলেছে তোমার ভাগ্য খারাপ? দুই মেয়েকে একা হাতে মাথা উচু করে সম্মানের সঙ্গে মানুষ করছ, এ কী কম প্রাপ্তি! নিজেকে অপয়া ভাববে না কখনো। দেখো সব ভালো হবে।

আমি সান্তনা দিই। এর বাইরে আমার তো কিছু করার নেই।

রিনাদির মুখে হাসি ফোটে। ঠিক বলেছ, এই যে এত মানুষের দিন রাত ভালোবাসা পাচ্ছি, তোমার মতো মানুষ এত গল্প করছ, এটা কী কম প্রাপ্তি! তারপরেই বলে, তোমার কোনো অসুবিধা হলে আমাকে ডাকবে, কোনো সংকোচ কোরো না।

আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানাই। রিনা দি চলে যায়। আমি ভাবি, এই যে একদিনের বাস আমার এখানে, এরা আছে বলেই না আমি থাকতে পারছি, নইলে এইতো একটা ছোট্ট ঘর, স্যালাইন, অক্সিজেন, ওষুধের গন্ধ, বাঁচব কী করে আমি

সারাদিন মোবাইলে ব্যস্ত পিয়ালির আবার বিয়ের একবছরের মাথায় বর ছেড়ে চলে গেছে। পেটে তখন ছেলে। বাপ ছেলের মুখ দেখেনি। সেই ছেলে এখন ৭ বছর। থাকে দাদু দিদার কাছে। স্কুলে পড়ে। মেদিনীপুরে বাড়ি। ঘন ঘন তার ছেলে ফোন করে মা মা করে।

মোবাইলের গ্যালারি খুলে দেখায় ছেলের ছবি। মিষ্টি একটা হাসি খুশি বাচ্চার মুখ। চোখ দুটো যেন কত কথা বলছে। ছেলের নাম শুভ্রনীল।

মায়া হয় সে মুখের দিকে তাকিয়ে। আমিও তো মা। হঠাৎই মেয়ের জন্য বুকটা টনটন করে ওঠে। কতদিন হয়ে গেল মেয়েটাকে ছেড়ে। আমাকে পাশে না পেলে রাতে তার ঘুম আসে না।

বলি, ছেলেকে ছেড়ে থাকতে কষ্ট হয় বল!

শুনেই চোখ জলে ভরে ওঠে বেশ সুন্দরী টলটল মুখের পিয়ালির।

পরমুহূর্তে সামলে নেয়। কী করব দিদি! পেটের দায়ে রেখে আসতে হয়েছে। মানুষ করতে হবে তো!

বাড়ি যাস নিয়মিত?

আগে প্রতি সপ্তাহে যেতাম। শুক্রবার ভোরে গিয়ে রবিবার রাতে ফিরে সোমবার ডিউটি করতাম। কিন্তু অনেক টাকা চলে যায়। ছেলের পিছনে খরচ বাড়ছে। এখন তাই মাসে সাতদিন যাই, টানা থেকে আসি।

তবে ছেলের ছুটি থাকলে খুব মা মা করে, তখন যেতেই হয়।

আমি ভাবি, পৃথিবীতে সব যন্ত্রণা কী মায়েদের একা ভোগ করতে হয়! কবে রামমোহন, বিদ্যাসাগরসহ আরো কত মহান ব্যক্তি মেয়েদের জন্য ভেবে, তাদের আলো দেখাতে চেষ্টা করেছেন, অথচ এখনো সেই আলোর নিচে অন্ধকারেই পরে আছি, এর থেকে কী মুক্তি নেই! নাকি আমরা মেয়েরাই পিছিয়ে রাখছি নিজেদের! কে জানে

শুধু প্রার্থনা করি, হে ঈশ্বর জগতের মঙ্গল করো, মানুষের মঙ্গল করো

চার.

এই দুপুরগুলো বড় নিঃসঙ্গ। বাইরের চড়া রোদ। কাকেদের বিষন্ন কা কা, পায়রাগুলোর বকবকম।একটু আগেই মধ্যাহ্নভোজন শেষ করেছি। আজও বোনই খাবার পাঠিয়ে ছিল। নিম আলু সেদ্ধ, মুসুর ডাল, মোচা, পোস্ত বাটা। এই কদিনে আজ খানিকটা খেতে পারলাম।

ছোটো বোনটার উপর খুব চাপ যাচ্ছে, আমার খাবার নিয়মিত পাঠানো, জামা ধুয়ে আবার পাঠানো, মেজটাও টিফিন বানিয়ে পাঠাচ্ছে। মাঝে মাঝে ভাবি কী হত আমার এরা দুজন না থাকলে! তারপর ভাবি, ঈশ্বর এভাবেই সব ঠিক করে রাখেন।

নিঝুম এই মন খারাপ করা দুপুরগুলো কেমন একা একা। আমার ঘুম আসছে না। বসে বসে বাইরের রাধাচূড়া গাছটার, আর একটু দূরের নারকেল গাছদের পাতার দোলুনি দেখছি।

ওরা কী পরস্পর কথা বলছে! কী কথা! কেউ কী শুনছে? নিশ্চয়ই শুনছে। নইলে ওদের এত ফিসফিসানি তো বৃথা হয়ে যেত।

সকালে সিস্টার রূপা অনেকগুলো গান শুনিয়েছে। এত অসাধারণ গানের গলা, আমি মোহিত হয়ে শুনছিলাম। ও গাইছিল, গোঠের রাখাল বলে দেরে কোথায় বৃন্দাবন আমি ওর গানে বৃন্দাবন দেখছিলাম, রাখাল দেখছিলাম, কৃষ্ণ দেখছিলাম। তন্ময় হয়ে চোখ বুজে সে গাইছিল একের পর এক গান। গান শেষের পর জড়িয়ে ধরেছিলাম। ওর চোখে জল। কী সব প্রতিভা লুকিয়ে এই আপাত গাম্ভীর্যের আড়ালে, ভেবে ফোন নম্বর নিয়ে রাখলাম। শুনলাম, ও কখনো গান শেখেনি, শুনে শুনে তোলে। একরাশ মুগ্ধতা ছড়িয়ে বলে গেল, তুমি রাতে আছো তো আজও। আমার ডিউটি আছে।শোনাবো তোমাকে আরো গান।

আমি এই ঘরে বসেই দেখতে পাই হালকা গোলাপি রঙের রুদ্রাণী লেখা ফ্ল্যাটটার চার তলার ছাদে একটা গেঞ্জি পরা ছেলে ঘুড়ি ওড়াচ্ছে। অনেকক্ষণ ধরে একবার সেদিকে আর একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করি আর কোনো ঘুড়ি আছে কীনা।

নেই। একটা ফ্যাটফ্যাটে নীল সাদা আকাশ একাই। কতগুলো কাক কেবল পাক মারছে। পাশের ছাদটায় দড়িতে খয়েরি, সবুজ, লাল, নীল, ম্যাক্সি, হাফপ্যান্ট, গেঞ্জি, তোয়ালে ঝুলছে। ওগুলোর মালিক কে বা কারা মনে মনে ভাবার চেষ্টা করি। ওই ছেলেটাই কী! কিংবা অন্য কেউ।

ওদিক থেকে চোখ ঘুরিয়ে নিই। পিয়ালি আজ সকালে আমার অ্যাটেন্ডেন্ট। ও দেওয়ালে পিঠ দিয়ে একমনে মোবাইল ঘাঁটছে। নিজের মনেই হাসছে। আমি যে ওকে দেখছি সেদিকে তার খেয়াল নেই।

আবার বাইরের দিকে দৃষ্টি দিই। একটা ভাঙা ডালে বসে কাকটা ঠোঁট বেঁকিয়ে পালকের নিচ দিয়ে ঘাড় চুলকাচ্ছে। আর একটা ডালে ছোট্টো চড়ুই। বেশ কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে রইলাম। ওদের মধ্যে কী মানুষের মতো বিবাদ, কোলাহল আছে? কে জানে!

এখানে থাকতে থাকতে আমার মনেও অভিমান জড়ো হয়। কেন প্রিয় মুখগুলো ঠিক সময়ে এল না দেখা করতে! কেন যাদের কাছের মনে হয় তারা একবারও খোঁজ নিল নাপরমুহূর্তে ভাবি,

আমার নাইবা হল পারে যাওয়া। যে হাওয়াতে চলত তরী অঙ্গেতে সেই লাগাই হাওয়া। নেই যদি বা জমল পাড়ি ঘাট আছে তো বসতে পারি।

সবুজ গেঞ্জি পরে সুইপার রাজু এলো। একহাতে ফিনাইল, আরেক হাতে বড় ঝাড়ু।

দিদি ফিন্যাইল দিব? তোমার তো গন্ধ লাগে, বলে বার দুয়েক ভিজে ঝাড়ুটা ঘরে বুলিয়ে বলল, আর কতদিন বলছে ডাক্তার?

আমি বললাম, দেখা যাক।

এখানে কী আর ভালো লাগে! ডাক্তারকে বলো ছেড়ে দিতে, অনেকদিন তো হল।

রোজই তো বলছি রে। ছাড়ছে কই!

পিয়ালি এতক্ষণে হঠাৎ যেন হুশ ফিরে পেল। মোবাইল ছেড়ে বলে উঠলো, তোমার কাজ হলে এসো, মেলা বকিও না পেশেন্টকে। সিস্টার দিদিরা বকবে জানলে।

দেখছ দিদি, তুমি আমার সঙ্গে কথা বলছ বলে কেমন ব্যবহার করছে। আমি কী অচ্ছুৎ আছি!

আমি তাড়াতাড়ি বলি, পিয়ালি চুপ কর।

শালা দুনিয়া হারাম। খেটে মরব, কিন্তু ব্যবহার দেখো! বলতে বলতে রাজু বেরিয়ে যায়।

পিয়ালিকে বকি। এভাবে বলিস কেন? তোদের থেকে তো ওদের কাজ বেশি। একটু কথা বললে কী এসে যায়!

তুমি জানো না দিদি, একবার সুযোগ দিয়েছ কী মাথায় চেপে বসবে। কী জাত তার নেই ঠিক।

আমি অবাক হই ওর কথা শুনে। হাসপাতালেও জাতপাত!

চুপ করে যাই।

বাঁ হাতে স্যালাইনের মধ্যে দিয়ে এন্টিবায়োটিক দেওয়া শুরু করল সিস্টার। এই সময়টা বড় কষ্ট হয়, জ্বালা করে। কয়েক মিনিটের মধ্যে হাত ফুলে গেল। স্যালাইন যাচ্ছে না। চ্যানেল জ্যাম হয়ে গেছে।

এই তো কালকেই চ্যানেল করা হল। সিস্টাররা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিল। বরফ, থম্বোকম দেওয়ার পর আবার অন্য জায়গায় চ্যানেল করল।

এন্টিবায়োটিক যাচ্ছে শরীরে। জ্বালা করছে হাত, ভারি হচ্ছে, আমি মনে মনে গুন গুন করছি সকালে সিস্টার রূপার শোনানো মন ভোলানো গান

বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি।
শুষ্ক হৃদয় লয়ে আছে দাঁড়াইয়ে
ঊর্ধমুখে নরনারী।।
না থাকে অন্ধকার, না থাকে মোহপাপ,
না থাকে শোকপরিতাপ।
হৃদয় বিমল হোক, প্রাণ সবল হোক,
বিঘ্ন দাও অপসারি।।
কেন এ হিংসাদ্বেষ, কেন এ ছদ্মবেশ,
কেন এ মান-অভিমান।
বিতর’ বিতর’ প্রেম পাষাণহৃদয়ে,
জয় জয় হোক তোমারি।।

বিতস্তা ঘোষাল। কবি, গল্পকার ও অনুবাদক। জন্ম ৫ই জানুয়ারি, ভারতের কলকাতায়। ইতিহাসে এম এ, কলেজে সাময়িক অধ্যাপনা। অনুবাদ সাহিত্যের একমাত্র পত্রিকা ‘অনুবাদ পত্রিকা’র সম্পাদক। ‘বাংলা আকাডেমি’, ‘একান্তর কথা সাহিত্যিক', 'চলন্তিকা' পুরস্কারপ্রাপ্ত। বিতস্তার প্রকাশিত বই ২২টি। তাঁর কবিতা হিন্দি, ওড়িয়া, অসমিয়া ও ইংরেজিতে...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

স্বাধীনতা মুছে দেয়নি ভাই হারানোর ব্যথা

স্বাধীনতা মুছে দেয়নি ভাই হারানোর ব্যথা

৭১ এর মুক্তিযোদ্ধের গল্প বাঙালি প্রত্যেক পরিবারের মধ্যে কিছুনাকিছু জানার ইতিহাস রয়েছে।তখনকার বাংলাদেশের সাড়ে সাত…..