বিপন্নতাগুলি

লক্ষ্মীকান্ত মণ্ডল
ধারামুক্ত কবিতা
Bengali
বিপন্নতাগুলি

বিপন্নতাগুলি

এই রাখলাম বিপন্নতা । কেমন আলপথ ক্ষয়ে যায় । তার ধারে বেগমবাহার । লতানো সময়ে পাঁপড়ির মিহিঘ্নাণ এক ফুল- পারো যদি পরে নিও এলোচুলের বাঁকে বাঁকে – না না , কোনো প্রতিশ্রুতি নেই – কিংবা রক্ত ঝরবে না নাবাল পুড়ে পুড়ে তা এখন কালো ঘুম । পাখির গানে গেয়ে যায়, রেখে যায় শূন্যের অসীম স্বান্তনা নদীটির শেষ ঢেউয়ে মিশে থাকে রোদ্দুরের হাওয়া, ঢেউ যতই উঁচুতে উঠুক- নদী জানে সে তার জলের অধিক নয়, জলের জলজশরীর ছিঁড়ে ছিঁড়ে জলের মৃত দেহে যত শক্তি- যত মনস্তাত্ত্বিক আকাশের বিশালতা কোথাও অত বড় আকাশ নেই, তাই- প্রিয় মেঘে মেঘে আজ সবকিছু ভাসিয়ে দেবার আগে কথার অব্যক্ততায় রেখে গেলাম ভালোবাসার মস্ত পৃথিবী!

দুই.

এক দঙ্গল হাঁস ছাড়িয়ে পূবে দাঁড়িয়ে আছে যে – তার আমার প্রেমিকা হওয়ার কথা ছিল। শুধু মাঝে ছিল জল আর ছোট ছোট তরঙ্গে ভেঙ্গে যাচ্ছিল আকাশ – আমি তাকে নীলের গুঁড়ো ভেবে ডুবিয়ে দিয়েছি শরীর – এর নাম আত্মহত্যা হতে পারে না কখনো । কয়েকটা ফুল নড়ে, ক্লান্ত দুচোখে ঘুমের বদলে অপেক্ষা জাগে, আমি নাবালের অন্তিম রেখায় সূর্যের আলো খুঁজি। সুখ যায়, শেষ না হওয়া স্পর্শ নিয়ে। ফিরে আসে অগনিত ব্যাঙের ছাতা, সারি সারি ভিজে কাপড় উড়তে থাকে বুক সমান দড়িতে -মাঝখানের সময় টুকুতে দূরের কলাঝাড় দেখা যায় – সেখানে বাতাস আর কুয়াশা , তা স্বত্বেও ভালোবাসার উপর ডানার ঝাপট – চারদিকে ছিটকে যায় জল -আমাদের মাঝখানে অতীতের সেই বৃক্ষটি আরও সময় নেয় – তখনও তার পাতা ঝরা বাকি । সেখানে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলাম আর সাঁতার কাটছিল চাঁদামাছ , তার চকচকে ঘ্রাণ নিয়ে কোনো কথা বলতে পারিনি আমরা – কিভাবে পাশাপাশি ধান রুয়েছি –

তিন.

অনন্তের কথা লেখে সে । যথারীতি আমিও পুরুষ ; প্রকৃতির কাছাকাছি আমিও – পার্থিব বাতাসের ভিতর ক্ষুদ্রাতি এক জলবিন্দু । কিছুটা হাড় মাটির সাথে পরিত্যক্ত পাখির পালক। উড়ে গেছে কেউ দিগন্তের দিকে । সেই গেরুয়া আভার দিকে কাচ ভাঙা রং। এখনো ভাঙেনি দহন , যে কোনো দিক থেকেই হাওয়া আসতে পারে ; আমাকে খুঁড়লে পাবে কয়েকটা চৈত্রমাস । দ্যাখো, স্পর্শ করো – সম্পর্কের মাঝে দৃষ্টি, নিদ্রা ও মৃত্যু ছাড়া সূর্য রচিত হয় ধান ক্ষেতে । এ আঁকাবাঁকা নদীর নাম জীবন । কত সম্পর্কের খালপাড় দিয়ে এগিয়ে যায় রাসায়নিক কালো জল ; যাদের সন্ধ্যায় নীলাভ অন্ধকার প্রদক্ষিণ করি । তাদের উপশিরায় প্রবাহিত কোনো উচ্চারণ নেই । নীল বঙের স্বপ্নে খুলে দিয়েছি ইচ্ছের খরস্রোত। দুচোখে দুটি ছিন্ন শিমুলের কুঁড়ি । স্তনের স্থিরতায় সেখানে গড়েছি এক মহাকাশ । এই ছিল আমার নীরবতা।
আর জানতে চেয়ো না বিগত শীতকালের ছোঁয়া –

চার.

একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ একেঁ দিল সকাল । আগুনের ফুল ফুটতে দেখিনি কখনো – তবু সে আগুন দেবে বলে খুলে দিয়েছে সব অনুরাগ , তাদের পাতা ছুঁয়ে ছুঁয়ে প্রতিটি ইচ্ছের পরিধি ভেঙে মাটিতে নামি । মাথায় একরাশ ডালপালা । কোত্থেকে এক জোড়া কাঠঠোকরা ঠুকরে দিতে থাকে ঠোঁট , আহা কত তীক্ষ্ণ সেই রং – তার নিচে বসে কতবার পড়েছি সক্রেটিসের বিষ পাত্র । পড়েছি অন্তরার স্তন্যদান । কিম্বা যদি এমন হতো যে ঝরা মেহগনি পাতাকে দেওয়া হলো দরজার কড়া – নাড়তে থাকো, নাড়তে থাকো হে ফাল্গুন ; শুধু ভাববে আর শব্দ শুনবে অনন্তের –
এত তাচ্ছিল্যের মাঝে উপেক্ষা করা যায় না ভোর । এই নদীতে কত ভোর আসে অন্তরার , কত ক্ষয় চাপা পড়ে পলিতে – তোমার উতল চোখে ভোরের ধূসর কুয়াশা ; নিশ্বাস , তবে কি চোখের জলের নিচে লাগিয়ে দেয় কালো রং । সে হেঁটে হেঁটে উদাহরণ হয়ে যাক ।
আর আমি বেঁচে আছি – যতই মেঘলা হোক বসন্ত –

পাঁচ.

এ পর্যন্ত আমি একটিও পায়রা ওড়াইনি । কোন কোন পতাকা ওড়ার সাথে কেউ কেউ উড়িয়ে দেয় একটা দুটা তিনটা , আমি তখন দেয়ালের ওধারে যে চায়ের দোকান তার সাথে রং চটা কথা বলি । আমার প্রেমিকার ফোন আসে – আমি তাচ্ছিল্য করি আকাশমনির পাতা ঝরার শব্দ কে – আকাশের নীলে তাই শুয়ে যাচ্ছে পাখি যন্ত্রণার মতো –
বারে বারে শ্লোগান আসছে রঙিন পাপীর মতো –
আকাশ এবার রক্ষা করুক নিজেকে ।

লক্ষ্মীকান্ত মণ্ডল। কবি।  জন্ম ১৯৬৯ সালে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গরাজ্যের পশ্চিম মেদিনীপুরে। পেশাগত জীবনে তিনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। প্রকাশিত বই: হঠাৎ হঠাৎই (১৯৯৮), মানুষের নদী (২০০০), খরানদীর বৃষ্টি সম্ভব (২০১০), সজনেফুল ও নিঃশর্ত সমর্পণ (২০১১), আঁধারের পাঁজর (২০১২)।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ