বিবৃতি সিরিজ

বেনজীন খান
মুক্তগদ্য
Bengali
বিবৃতি সিরিজ

লুটেরা দূর্নীতিবাজ, আজকের রাজাকার

রাবণ অপরাধী হলেও কখনো কখনো সাহিত্যে বীর হিসেবে খ্যাত হন কিন্তু রামের সহযোগী ‘বিভীষণ’ ইতিহাসে বেঈমান-বিশ্বাসঘাতক হিসেবেই রয়ে গেল! মানুষ এ নাম এড়িয়ে চলে।

কারণ, বিভীষণ তার দেশের ক্ষতি করেছিল।

চাচা আবু লাহাব রসুলের শত্রু ছিলেন কিন্তু আজও দুনিয়ার মুসলমানেরা নামাযে দাঁড়িয়ে তাকে গালি ও অভিশাপ দেয়। আবু লাহাব এখন আর কোন ব্যক্তির নাম নয় বরং ‘জালিম’ এর প্রতীক। মানুষ এ চরিত্র ঘৃণা করে।

কারণ, আবু লাহাব শান্তি প্রতিষ্ঠায় বিরোধী ছিল।

মীর জাফর নবাব সিরাজের ফুপা হলেও ভারতবর্ষের মানুষের কাছে নামটি এখন ‘বিশ্বাসঘাতক’ এর স্থলাভিষিক্ত হয়েছে।

কারণ, তার জন্য দেশ পরাধীন হয়ে ছিল।

রাজাকার শব্দের আভিধানিক অর্থ ‘স্বেচ্ছাসেবক’ হলেও বাংলাদেশের জন্মদিন থেকে বাংলায় এই শব্দটি ‘বেইমান-বিরুদ্ধচারি-দেশদ্রোহী-শত্রু’ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

কারণ, তারা বাংলাদেশের স্বাধীন জন্ম-অস্তিত্ব অস্বীকার করেছিল।

তেমনি আজ এবং এখন যে ব্যক্তিই দেশের বিরূদ্ধচারণ করে, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি তথা ক্রাইম করে, এ যুগে সেই ব্যক্তিই হলো ‘রাজাকার’।

কারণ, তারা দেশকে পরাধীনতার শৃঙ্খলে বাঁধতে চায়।

আমাদের (নাগরিকের) খুঁজে দেখতে হবে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে আজকে এই দুর্নীতিবাজ, চাঁদবাজ, দখলবাজ, ক্রিমিনালরা কারা? কোথায়, কোন পতাকাতলে তারা সমবেত?

ইতিহাসের কষ্টিপাথরে পরখ পূর্বক সেই সব রাজাকার ও তাদের সংঘ-শক্তিকে রাজাকার ও রাজাকারদের দল আখ্যা দিয়ে রাষ্ট্রের মালিকদের এই বিষয়ে চোখ-কান খোলা রেখে আওয়াজ তুলতে হবে-

রাজাকার নিধনের আওয়াজ!

কারণ, রক্ত-সাগরে জন্ম নেয়া এই ‘দেশ’ আমরা পরাধীন হতে দেব না।

দুই

জাতিসংঘের ৭৪তম সাধারণ অধিবেশন এবং ভারত-পাকিস্তানের রাজনীতি, প্রেক্ষিত: কাশ্মীর

কাশ্মীর নিয়ে ভারতেরও কিছু কথা ছিল। হয়তো সে কথাগুলি খুবই ন্যায়সংগত, যুক্তিনির্ভরও ছিল।

কিন্তু কোনভাবেই কাশ্মীর ইস্যু বহুপাক্ষিক বা আন্তর্জাতিক ইস্যু নয় বা ইস্যু হতে দেওয়া যাবে না, ভারতের এমনি গিট বাঁধা চিন্তার কারণে জাতিসংঘের ৭৪তম সাধারণ অধিবেশন থেকে ভারতকে পেছনে ফেলে একতরফা পাকিস্তানই বিশ্ব মতামত সংগ্রহ করে নিয়ে গেলো।

ভারতকে এখন পাকিস্তানের পেছনে পেছনে চলতে হবে আর সংবাদ সম্মেলন করে করে জবাব দিতে হবে।

কাশ্মীর ইস্যু নিয়ে ডিপ্লোম্যাটিক রাজনীতিতে ভারত পিছিয়ে পড়লো। এর খেসারত হবে সুদূরপ্রসারি। ভারতের মতো প্রবীণ রাজনৈতিক নেতৃত্ব সমৃদ্ধ দেশ কিভাবে এই ভুলটি করল আমার বোধগম্য নয়।

শুনতে খুবই বিপ্লবী কথা মনে হলেও- ‘কোন আপোষ নয়’ রাজনীতিতে এটিই যে সবথেকে বড় অরাজনৈতিক কথা, বৃহৎ ভারতের প্রবীণ ও দাম্ভিক নেতৃত্ব হয়তো সেটি ভুলে গিয়েছে।

ফলে, অবশ্যই কাশ্মীর সংকট এখন আর কোনো একটি বিশেষ দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়তো থাকলোই না, এমনকি তা দ্বিপাক্ষিক থেকেও বেরিয়ে পড়লো! হয়ে উঠলো আন্তর্জাতিক তথা বিশ্ব মানুষের সমস্যা চিহ্ন!

পাকিস্তান বিষয়টিকে এখন নিজস্ব সংকটের জায়গা থেকে ছুঁড়ে দিতে পেরেছে বিশ্ব মানুষের সংকট হিসেবে।

বিশ্ব প্লাটফর্মটি যথাযথ ব্যবহার না করে ভারত এক কণ্টকাকীর্ণ পথে প্রবেশ করলো। এখন থেকে ভারতকে শুধু অভিযোগ করতে হবে। কারণ, পাকিস্তানের সামনে যুদ্ধ ছাড়া আর কোনো রাস্তার অবশেষ তারা রাখেনি।

হয়ে যেতে পারে এ যুদ্ধ ১৯৭১এর প্রতিশোধ। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের হয়ে ভারতের সেদিনের মহান ভূমিকা আজ ২০১৯-এ এসে রূপ নিতে পারে কাশ্মীরিদের হয়ে পাকিস্তানের মহান ভূমিকায়!

সামনে অপেক্ষমাণ- হয় চরম ম্যাসাকারের মধ্যদিয়ে উভয় দেশ ধ্বংস অথবা সামান্য ক্ষতিতে ‘স্বাধীন কাশ্মীর’!

কারণ, কেউই চায়না দুনিয়া এখন পারমাণবিক যুদ্ধের অভিজ্ঞতা নিক।

তিন

প্রাচ্যবাদিদের তথা পশ্চিমাদের এটা একটা অভিযোগ যে, প্রাচ্যের মানুষেরা ‘গ্রস (Gross)’ কথা বলে। স্থূল বা গড়ে কথা বলে। তারা তলিয়ে দেখেনা। উপরি উপরি ভাবে ভাসাভাসা দেখে।
অভিযোগটি সর্বৈব মিথ্যা নয়, কখনো কখনো খুবই সত্যি। আমরাতো মনে হয়, বাংলাদেশের মানুষের ক্ষেত্রে এই অভিযোগটি খুবই প্রযোজ্য!

সম্প্রতি বাংলাদেশে দুর্নীতিবিরোধী কথিত অভিযান চলছে। অনেকেই খুশি। সাধারণের অভিযোগ হলো— পুলিশ এবং সাংবাদিকরা এতদিন এই অভিযান চালায়নি অথবা লেখেনি কেন? সুতরাং তারা খুবই অপরাধী!

আসলে, এটাই হল সেই ‘গ্রস কথা’ বা উপরি কথা! গভীর গিয়ে না দেখা কথা! কারণ, রাজনৈতিকভাবে যখন কোন দেশ বা জনপদের মানুষ এবং প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানসমূহ স্বাধীন না থাকে তখনই এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। সাধারণ মানুষ যখন এই মূল জায়গাটি ধরতে ব্যর্থ হয় বা সেটি নিয়ে কথা না বলে তখন তাদের অভিযোগটি হয়ে যায় একপেশে ও অবিবেচনাপ্রসূত।

আমরা কি জানি না, সঠিক সংবাদ পরিবেশনের কারণে এদেশে সংবাদ মাধ্যম ও সংবাদকর্মীদের কী পরিণতি ভোগ করতে হয়েছে?

প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের ভাগ্যে কি পরিণতি নেমে এসেছে?

যদিও তাদের অভিযোগের আংশিক সত্যতা আছে। কেননা, সেই বিশেষ রাজনৈতিক পরিবেশ পরিস্থিতির সুযোগ নিয়েই অনেক দুর্বল চরিত্রের মানুষেরা ব্যক্তিস্বার্থ হাসিল করে থাকে একথা একেবারে মিথ্যে নয়।

আমাদের বরং দাবি তোলা উচিত- মাননীয় প্রধানমন্ত্রী না দেখলে, না বললে যখন কোনো কাজই হয় না বা করা যায়না তখন দেশে এত এত মন্ত্রণালয়, মন্ত্রী, পতাকা, গাড়ি, বেতন, বাড়ি আর টাকার ছড়াছড়ির দরকার কী?

সবাইকে বরং মাঠে-মিলে-কলে-কারখানায় পাঠিয়ে দিয়ে উৎপাদন বৃদ্ধির কাজে লাগানো লাভজনক নয় কি?

চার

মোহাম্মদ বিন সালমান। সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স। পরিবারের সদস্যদের মধ্যেই যিনি বিতর্কিত। সে দেশে চাউর আছে- যার হওয়ার কথা ছিলো ক্রাউন প্রিন্স তিনি আছেন কারাগারে আর যার থাকার কথা ছিলো জেলে তিনি অধিষ্ঠিত সিংহাসনে!

এই মোহাম্মদ বিন সালমান সংক্ষেপে এমবিএস খ্যাত। যিনি আরব তথা মুসলিম জাহানের চরম দুশমনদের পরম বন্ধু হয়ে দুনিয়াব্যাপী বিতর্কের শীর্ষে অবস্থান করছেন।

এই এমবিএস গৃহীত পদক্ষেপের কারণে সৌদি আরব এখন দুনিয়ার মুসলমানদের কাছে একটি শত্রু রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে।

এই এমবিএস এর কারণে পবিত্র আরব ভূমিতে মানব নির্মিত বোমা বর্ষণ হতে শুরু করেছে।

আমার আশঙ্কা, তার আমলেই বিশ্ব মুসলমানদের কেন্দ্রীয় প্রতীক পবিত্র কাবা ঘর ও সারা বিশ্বের মুসলমানদের হৃদয় মদিনা-মনোয়ারার উপরেও বোমা আক্রমণ হবে। যে কাজের হোতা হবেন হয়তো এমবিএস নিজে! এবং যে দায় চাপানো হবে তার শত্রুরাষ্ট্র ইরান-ইয়েমেনের উপরে!

এমনকি আরব দুনিয়া তথা সারা পৃথিবীর মুসলমানদের মধ্যে রক্ত বন্যা বইয়ে দেয়ার জন্য ‘ওয়ার অন টেরর’ এর কুশীলবরাও এ কাজটি সংঘটিত করে তারই ঘাড়ে সওয়ার হবে!

এমন একটি ক্ষেত্র প্রস্তুত হচ্ছে সৌদি আরবে বহুদিন ধরে। সর্বশেষ এমবিএস এর হাত ধরে, যেমন:

১. আরবদের চরম বিলাসী জীবন।

২. নারীর প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ।

৩. আধুনিক উন্নয়নের নামে জুয়া, ক্যাসিনো ও কথিত হালাল বার নির্মাণের উদ্যোগ।

৪. রসুলের (স.) স্ত্রী ইহুদী ছিলেন বিধায় ইহুদীদের সাথে তার কোন বিরোধ নেই মর্মে তত্ত উপস্থাপন।

৫. অস্ত্র কেনার নামে আমেরিকাকে বিলিয়ন ট্রিলিয়ন অর্থ সহযোগিতা করা।

৬. সাম্প্রদায়িকতায় ক্ষয়িষ্ণু ভারতের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার লক্ষ্যে সোনার মেডেল ও ব্যবসার নামে কোটি কোটি ডলারের সহযোগীতা।

৭. শত্রু রাষ্ট্র চিহ্নিত করে ইয়েমেনে গৃহযুদ্ধ বাঁধানো একই সাথে সেখানে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করে মানুষকে নির্মম মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড় করানো।

৮. ইরানকে প্রতিদিন অনাহুত যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়ার প্রচেষ্টা।

৯. সর্বোপরি পশ্চিমা শক্তিকে আরব ভূমিতে দীর্ঘ স্থায়ী বসবাসের সুযোগ করে দিয়ে আরববিশ্বের সমস্ত তেলসহ অর্থ-সম্পদ পশ্চিমাদের লুটে নিতে সহযোগিতা করায় এই দেশটি এখন পৃথিবীর মুসলমানদের কাছে এক নম্বর শত্রু রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে।
এবং পৃথিবীর সেরা মুনাফেক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন এমবিএস নিজে।

যে কোনো সময় এই পাপের খেসারত সৌদি আরবসহ মুসলিম জাহান কে দিতে হতে পারে!

পাঁচ

ভারত বাঘের পিঠে সওয়ার হয়েছে! কিভাবে যে নামবে ঠিক বলা যাচ্ছে না। আজ দুই মাস হলো কাশ্মীরের ৯০ লাখ মানুষ কার্ফু বন্দী। ৯ লাখ সশস্ত্র সেনাবাহিনীর সেখানে যুদ্ধাংদেহী উপস্থিতি। প্রতিদিন প্রতি রাতে কাশ্মীরিদের পরিবারে কি ঘটছে আমরা ঠিক জানি না। আরো কতদিন তারা কার্ফু বন্দী থাকবে সেটিও নিশ্চিত বলা যাচ্ছে না।

তবে যেদিনই কার্ফুর অবসান ঘটবে, সেদিন এই ৯০ লাখ মানুষের সাথে ৯ লাখ সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে কি তুমুল উত্তেজনা কাজ করবে আমরা ঠিক কল্পনাও করতে পারছি না। কিন্তু এ কথা ঠিক, অনন্তকাল কাশ্মীরিদেরকে গৃহবন্দি রাখা যাবেনা।

তাহলে সমাধান কী?

অন্যদিকে, কাশ্মীরের সাথে যেমন জড়িয়ে গেছে পাকিস্তানের অস্তিত্বের প্রশ্ন তেমনই ভাবে ভারতের জড়িয়ে গেছে প্রেস্টিজ।
এই অস্তিত্ব বনাম প্রেস্টিজের সংঘাত কিভাবে সমাধান হবে ঠিক করে বলা যাচ্ছে না।

বাস্তবতা হলো: অর্থনৈতিক ভাবে জর্জরিত ও ভারতীয়দের ভাষায় ‘মিসকিন’, ‘বর্বর’ পাকিস্তানের হারানোর কিছু নেই! অপর দিকে ভারতের রয়েছে, হারানোর ভয়। ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনৈতিক প্রভুত্ব, সম্প্রসারণবাদী থেকে সাম্রাজ্যবাদী হওয়ার আকাঙ্ক্ষা হারানোর ভয়।

ইতিহাস হল: যার হারানোর ভয় থাকে না, তার থাকে কেবল জয় করার অবশেষ। সে যেভাবে যুদ্ধে জীবন বাজি রাখতে পারে, সেভাবে যুদ্ধে অংশ নিতে পারে না যার হারানোর ভয় থাকে। আর এই মুহূর্তে যুদ্ধ ছাড়া কাশ্মীর সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধানের কোন পথ খোলা আছে?

সবথেকে ভালো হতো—যদি ভারত, পাকিস্তান ও চীন তরফে ছেড়ে দিত অধিকৃত জম্মু কাশ্মীর, আজাদ কাশ্মীর এবং আকসাই চীন অর্থাৎ প্রতিষ্ঠিত হতো “স্বাধীন কাশ্মীর”।

কিন্তু তা কি সম্ভব? না।

কারণ, সে পথ একতরফা বন্ধ করেছে ভারত। সেই ১৯৪৭ সালে ‘মাউনব্যাটেন প্রস্তাব’ ভায়োলেট করে হায়দারাবাদ ও জুনাগড় দখলের মধ্যে দিয়ে।

যার ফলশ্রুতিতে ১৯৪৭ সালেই স্বাধীন ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে প্রথম যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ভাগ হয়ে যায় অখন্ড কাশ্মীর। নাম নেয়- আজাদ কাশ্মীর ও জম্মু কাশ্মীর। এবং ১৯৬২ সালে ভারত-চীন যুদ্ধের মধ্য দিয়ে জম্মু কাশ্মীর ভাগ হয়ে জন্ম নেয় আকসাই চীন।

সুতরাং ‘স্বাধীন কাশ্মীর’? সে তো, এক গঙ্গা রক্তের প্রশ্ন!

তাহলে সমাধান কী?

সমাধান কি নিউক্লিয়ার বোমা?

ছয়

এ দেশ এখন ভাগাড়ে পড়ে থাকা মরা গরু। শেয়াল, কুকুর, হায়না, শকুন যে যেমনি পারছে খুবলে খাচ্ছে…

এত দূর্নীতি কেউ কি কখনো দেখেছে জীবনে?
এত গলাবাজি কেউ শুনেছেন কখনো?

দুনিয়া ব্যাপী পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় দূর্নীতি হয়—শুনেছে সবাই।

কিন্তু দুনিয়ার কোথাও বাঁশের চটা, কয়েল রড আর ভিতবালি দিয়ে ব্রীজ নির্মাণ হয়, শুনেছে কেউ?

কেউ শুনেছে, রাস্তা নির্মাণের তিন মাসের মাথায় চলাচলের অনুপযোগী হওয়ার কাহিনী?

পুঁজিবাদী দুনিয়ায় কেউ শুনেছে—বড় পদ, বড় চাকুরির জন্য যোগ্যতা হলো: অসৎচরিত্র, দেশপ্রেমহীন, অন্ধ আনুগত্য আর দাসমনোবিত্তি!

পুঁজিবাদী দুনিয়ার কোথাও কেউ শুনেছে, স্বাধীনতা হলো— আপন দেশের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে অন্য দেশের সেবা করা?

এ কি সম্ভব, জীবনে একবার এমপি হলে সারাজীবন বসে খাওয়া যায়?

পুঁজিবাদী দুনিয়ায় কেউ দেখেছে, ভিক্ষুকের বাচ্চা ছাত্রনেতা সেজে রাতারাতি কোটিপতি হয়েছে?

কেউ দেখেছে, এই ধরণের চোর ক্রিমিনালদের মানুষ সেখানে সম্মান করে?

কেউ শুনেছে, গণতান্ত্রিক দেশে বিনা ভোটে বারবার সরকার গঠন হয়েছে?

এমনকি গণতান্ত্রিক দেশে জনগণ বারবার কোনো একটি দলকে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা (Absolute majority) দিয়ে ক্ষমতায় বসিয়েছে!

অথচ এ সবই এখন আমাদের নিত্য দৃশ্য! কারণ, এদেশের জন্ম ইতিহাসও এমনই আশ্চর্যের!

কারণ, এই দেশ-ই পৃথিবীর একমাত্র দেশ সবথেকে কম সময়ের যুদ্ধে যে দেশ স্বাধীন হয়েছে!

কারণ, এই দেশ-ই পৃথিবীর একমাত্র দেশ সবথেকে বেশি মানুষের মৃত্যুতে যে দেশের জন্ম হয়েছে!

সাত

আমারও ধারণা, ‘আইডি হ্যাক হয়েছে’!

দিল্লি থেকে বুয়েট হয়ে ভোলায় আছড়ে পড়ছে—-সুনামি।

‘চুক্তি’, ছাত্রের মৃত্যু অতঃপর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়া—-এক অশনিসংকেত।

এতসব থামাতে হলে কি করতে হবে, হ্যাকাররা জানে।
কোন দূর্বল স্থানে সুরসুরি দিলে তারা মাতবে, হ্যাকাররা জানে।
অবশেষে সুষ্ঠু বিচারের দাবি করে তারা থামবে, হ্যাকাররা জানে।

অতঃপর ‘চুক্তি’ বহাল থাকবে!

হ্যাকাররা জানে, এ জাতির কোনো অভীষ্ট লক্ষ্য নেই।
এরা যতটা না সচেতন তারচেয়েও বেশি স্বতঃস্ফূর্ত।
মূহুর্তে মূহুর্তে লক্ষ্যচ্যুত হয়।
হুজুগে চলে…

আট

হুদাইবিয়া সন্ধি: বিপ্লবী মুন্সীআনা

রাজনীতিতে “কোনো আপোষ নয়” কথাটা শুনতে বিপ্লবী মনে হলেও আসলে তা প্রতিক্রিয়াশীল কথা।

বিপ্লবের সামনে কখনো কখনো এমন পরিস্থিতি হাজির হয় যখন নীরব থাকতে হয়, পাশকেটে অথবা দুই কদম পিছিয়ে যেতে হয়। এটাই সেই লেনিনের বিখ্যাত ‘one step forward two steps backward’ তত্ত্ব।

আবার প্রায় ১৪’শ বছর পূর্বে ৬২৮ খ্রীষ্টাব্দে প্রথম আমরা এই কৌশলের প্রয়োগ দেখেছিলাম রাসুল সা. এর বিখ্যাত “হুদাইবিয়ার সন্ধি” বাস্তবায়নের মধ্যে।

এটি ছিলো মদিনা শহরবাসী এবং মক্কার কুরাইশ গোত্রের মধ্যে সম্পাদিত একটি ঐতিহাসিক চুক্তি।

এই চুক্তির পটভূমি ছিলো:

হিজরি ৬ষ্ঠ সনের জ্বিলকদ মাসে রাসুল সা. চৌদ্দশ সাহাবীসহ উমরা পালন করার জন্য মক্কা অভিমুখে রওনা হয়ে ছিলেন। কিন্তু জেদ্দা থেকে মক্কাগামী পথের পাশে হুদাইবিয়া নামক স্থানে মক্কার মুশরিকদের দ্বারা তিনি প্রবল বাধাপ্রাপ্ত হন; এমনকী কুরাইশদের পক্ষ থেকে সামরিক অভিযানের হুমকিও আসতে থাকে। ফলে, মক্কায় পৌঁছে উমরা পালন করা সে যাত্রা আর তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি।

শেষ পর্যন্ত রাসুল সা. এর সাথে এক সন্ধিতে আবদ্ধ হওয়ার জন্য কুরাইশদের পক্ষ থেকে সুহায়ল ইবনে আমরকে দূত হিসাবে পাঠান হয়। রাসুল সা. সে প্রস্তাবে রাজি হন। কিন্তু তথাপি দেখা দেয় এক নোতুন সমস্যা।

হুদায়বিয়া সন্ধি পত্রের লেখক ছিলেন হযরত আলী রা। শুরুতে তিনি লিখেছিলেন ‘লা ইলাহা আল্লাহ্ মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’।

সঙ্গে সঙ্গে আপত্তি জানায় কুরাইশরা। তারা বলে, ”আমরা যদি মোহাম্মদকে রাসুলই মানতাম, তাহলেতো যুদ্ধই করতাম না। সুতরাং এই বাক্য মুছে লিখতে হবে- সুহায়ল ইবনে আমর ও মোহাম্মদ বিন আব্দুল্লাহ’র মধ্যে চুক্তি হইলযে…”

যথারীতি আজকের মতো সে সময়ও উপস্থিত মুসলমানদের হৃদয়ে আঘাত লাগে এবং তারা যথারীতি তলোয়ার হাতে তুলে নেয়।

রাসুল সা. উভয় পক্ষের কথা শুনে কলম হাতে নিয়ে জানতে চাইলেন-

‘কোথায় আমার নাম লেখা আছে।’

এবং নিজ হাতে সে নাম মুছে দিলেন। আর বললেন-

‘এ কথাও তো মিথ্যা নয় যে, সে সুহায়ল ইবনে আমর এবং আমি মোহাম্মদ বিন আব্দুল্লাহ।’

অতঃপর চুক্তি সম্পন্ন হয়।

সেখানে নিম্নলিখিত সমঝোতা গুলিই ইতিহাস খ্যাত ‘হুদাইবার সন্ধি’ হিসাবে পরিচিত।

নবী করীম সা. মুসলিমদের নিয়ে মদীনায় ফিরে যান। পবিত্র কোরআনে এই সন্ধিকে প্রকাশ্য বিজয় হিসাবে অভিহিত করা হয়েছে।

সন্ধির শর্তাবলীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:

(১) মুসলমানগণ এ বছর উমরাহ না করেই মদীনায় ফিরে যাবে।

(২) আগামী বছর উমরার জন্য এসে তারা তিন দিন মক্কায় অবস্থান করতে পারবে এবং তাদের অবস্থানকালে কুরাইশরা মক্কা ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যাবে।

(৩) কুরাইশদের এবং মুসলমানদের মধ্যে আগামী দশবছর যুদ্ধ বন্ধ থাকবে।

(৪) কুরাইশদের কেউ মদীনায় আশ্রয় নিলে তাকে ফেরত দিতে হবে। কিন্তু মদীনার কোন মুসলমান মক্কায় আশ্রয় নিলে, তাকে ফেরত দেয়া হবে না।

(৫) আরবের যেকোন গোত্রের লোক মুসলমানদের বা কুরাইশদের সাথে সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ হতে পারবে।

(৬) মক্কায় ব্যবসায়ীরা নিরাপদে মদীনার পথ ধরে সিরিয়া, মিশর প্রভৃতি দেশে ব্যবসা করতে পারবে।

(৭) মক্কায় বসবাসকারী মুসলিমদের জান মালের নিরাপত্তা দেওয়া হবে।

(৮) চুক্তিতে স্বাক্ষর কারী পক্ষদ্বয় একে অপরেরে সম্পদকে সম্মান করবে।

(৯) মক্কায় প্রবেশকালে মুসলিমরা বর্শা বা ফলা আনতে পারবে না। আত্মরক্ষার জন্য কোষবদ্ধ তলোয়ার আনতে পারবে।

শর্তাবলী গভীর ভাবে পড়লে দেখা যাবে, অধিকাংশই কুরাইশদের পক্ষে। কিন্তু এই চুক্তির মাধ্যমে ইসলামের প্রথম বিজয় হলো, কুরাইশরা এই প্রথম ইসলামকে একটি পক্ষ হিসেবে স্বীকৃতি দিলো আর দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিজয় হলো, দশ বছরের জন্য মুসলমানরা বিরোধ বা যুদ্ধ মুক্ত নির্ঝঞ্ঝাট সময় পেলো। যে সময়টা ছিলো ইসলামের জন্য পবিত্র নেয়ামত।

এ থেকে বোঝা যায়, তাৎক্ষণিক উত্তেজনা অনেক সময় মানুষকে লক্ষ্যভ্রষ্ট করে কিন্তু লক্ষ্যে স্থির থেকে কখনো কখনো পশ্চাৎ অপসারণও বিপ্লব। আজ কোথায় সেই মহা ক্ষমতাধর কুরাইশরা, কোথায় সেই আবু লাহাব, আবু জেহেলরা।

এঘটনা উল্লেখ করার কারণ হলো- আমরা বিশেষ করে বঙ্গের মানুষেরা মূল লক্ষ্যে স্থির না থেকে উপসর্গের পেছনে ছুটে বেড়াই। নিত্য নোতুন ইস্যু আমাদের খুব সহজেই তাড়িয়ে বেড়াতে পারে। আমরা অনন্তকাল ধরে ইস্যুর পেছনে পেছনে দৌড়াচ্ছি!
অথচ তেইশ বছরে মহানবী সা. দুনিয়ায় এক সম্পূর্ণ নোতুন বিপ্লব সাধন করে এক নোতুন সমাজ ও রাষ্ট্র (মদিনা) উপহার দিয়ে ছিলেন।

কিন্তু আজ আমরা কী করছি? আজ দুনিয়ায় মুসলমানদের সংখ্যা বেড়েছে। মুসলিম অধ্যুষিত রাষ্ট্রেরও সংখ্যা বেড়েছে কিন্তু মদিনা সনদের স্প্রীট প্রতিষ্ঠা হয়নি কোথাও।

রাসুল সা. পরকালের কথা বলেছেন সত্য কিন্তু তাই বলে এহোকালকে কাফের (মূর্খ)দের হাতে ছেড়ে দেননি। তিনি রাজনীতি বীমূখ থাকেননি কখনো। অর্থাৎ অর্থনীতি ও রাজনীতিকে ইনসাফ ভিত্তিক করে তুলতে তিনি আজীবন মজলুমকে সাথে নিয়ে জালিম শাসক ও শোষকের বিরুদ্ধে লড়েছেন।

অথচ আজ আমরা করছি তার ঠিক উল্টো টা। আমরা পরকালের ইজারা নিয়েছি! আর এহোকালের অর্থনীতি ও রাজনীতিকে লিজ দিয়েছি জালিম শোষকদের কাছে।
যার বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাবার কথা; আমরা তার কাছে করুণা ভিক্ষা মাগছি!

আমরা ইস্যুর পেছনে ছুটছি! যে সমাজে নিত্য নোতুন ইস্যু সৃষ্টি হয় না আমরা এমন সমাজ প্রতিষ্ঠার অর্থনীতি ও রাজনৈতিক সংগ্রামের লক্ষ্য স্থির করছি না।

ফলে নিয়তি হলো-

আমাদের সামনে একেরপর এক, বারবার, ঘুরে ফিরে আসবে: ‘চুক্তি’ ‘ভোলা’ ‘ভোলা’ ও ‘চুক্তি’…

আমরা বন্দী থাকবো আমাদের অজ্ঞতায়, লোলুপ-স্বার্থপর-গোলক ধাঁধাঁয়!

নয়

কাশ্মীর থেকে দৃষ্টি ফেরাতে
এনআরসি প্রকাশ।
এনআরসি থেকে দৃষ্টি ফেরাতে
রামমন্দির রায়।
রামমন্দির থেকে দৃষ্টি ফেরাতে
পরিবর্তন চেষ্টা তাজমহলের ধাম…

এমনি ইস্যু-ইস্যু খেলা খেলেছে তারা
দীর্ঘদিন ধরে এই বাংলায়!
মৃত্যু ভয়ে আতঙ্কিত নিরবতাকে শান্তি ভেবে,
বড় পুলকিত ভারত এখন নেমেছে নিজ জমিনে!

হতাশ… জমিপুত্র আজ ভাবতে পরেছে,
প্রতিবেশীর ঘরে এতদিন যা ঘটেছে
তা ছিল প্রোয়োগ পরীক্ষা।

বিধিবাম! ক্ষোভে ক্ষোভ যুক্ত হচ্ছে
দানা বাঁধছে, মহাদানা!

এবার বলি,
প্রাচীর চাদরে আটকানো যাবেনা
বেকারত্বের হাহাকার;
ধর্ম জাতি দেশের পরিচয়
রুটির দাবির কাছে ফিকে হয়ে যায়!

চিৎকারের চেয়ে বড় আওয়াজ
পারমাণবিক বোমার নয়!
ক্ষুধার আগুনে পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে
ক্ষমতার মসনদ, তখতেতাউস,
লোভের আঁতুরঘর!

দশ

আমি কোনো কিছুই ভাঙতে চাই না।
কেউ ভাঙুক সেটিও না।

কিন্তু কোনো কিছু যদি নিজে নিজেই ভেঙে যায় আমি তা ঠেকাতে চাইনা।

আমি বরং বেশি আগ্রহী ভেঙে পড়ার কারণ বুঝতে।

আমি এখন বুঝি, ‘৪৭ এর কারণ;
আমি বুঝি ‘৭১ এর কারণ।

এখন আমি এও বুঝি—-
‘৪৭ যে কারণে আবার ফিরে আসবে;
‘৭১ও সেই কারণে নোতুন রূপ নেবে…

এগারো

পেঁয়াজের মূল্য বৃদ্ধি এবং পুঁজিবাদী রাজনীতি

খাদ্যনিরাপত্তা (food security) বনাম খাদ্যসার্বভৌমত্ব (food sovereignty), পুঁজিবাদী দুনিয়ায় এ বিতর্ক দীর্ঘ দিনের।
মুনাফা ভিত্তিক উৎপাদন সম্পর্কের বয়ান হলো : খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে অর্থকরি ফসলের অধিক উৎপাদন। অর্থাৎ অর্থ বা টাকা-ই খাদ্যনিরাপত্তার গ্যারান্টি। তারা বলতে চায়- ‘টাকা থাকলে বাঘের চোখ মেলে’।

পক্ষান্তরে প্রকৃতি বিজ্ঞানীদের দাবি ভিন্ন। তারা বলতে চায় : অর্থ বা টাকা খাদ্যনিরাপত্তার গ্যারান্টি নয়। বরং খাদ্য সার্বভৌমত্বের ধারণা প্রতিষ্ঠাই কেবল পারে খাদ্যের নিশ্চয়তা দিতে। কারণ খাদ্য মানুষের সৃষ্টি নয়। খাদ্য প্রকৃতিসৃষ্ট। মানুষ পৃথিবীতে আসার পূর্বেও খাদ্য ছিলো। মানুষ আবির্ভাবের পর সে খাদ্য সংগ্রহ করে খেয়েছে এবং আরো লক্ষ বছর পর মানুষ খাদ্য পুনঃউৎপাদন করা শিখেছে মাত্র। সে দিক থেকে প্রকৃতির কোনো কিছুই মানুষ উৎপাদন করেনি। মানুষ যা করেছে সেটি হলো: পুনঃউৎপাদন। এবং পৃথিবীর কোন্ মাটিতে কোন্ আবহাওয়ায় কোন্ উদ্ভিদ বা ফসল জন্মাবে এটা ছিলো প্রকৃতির নির্বাচন (selection of the nature)। যেমন, সুন্দরবনের নোনা পানিতে জন্ম নেয়া গাছ বরেন্দ্র অঞ্চলের মাটীতে জন্মাবে না। তেমনি রাজশাহীর ফজলি আম সুন্দরবনে জন্ম নেয় নি। এ বিধান প্রকৃতির, মানুষের নয়। এটিই হলো ‘খাদ্যসার্বোভৌমত্ব’।

মানুষের উচিত প্রকৃতির কানুন মেনে চলা। প্রকৃতির উপরে শাসন নয়। অর্থাৎ ফসলকে তার নাড়িপোঁতা মাটি থেকে উচ্ছেদ করতে নেই। হোক তার আর্থিক মূল্য কম।

আমরা শুধু অর্থকেই গুরুত্ব দিয়ে ধানি জমিতে ফুল লাগাচ্ছি। মুশুরীর জমিতে তামাক! কৃষিতে এ হলো নৈরাজ্য। এ নৈরাজ্য চলছে সর্বত্র। শহরে বইয়ের দোকান থেকে বই সরিয়ে জুতা বিক্রি হচ্ছে অধিক মুনাফার লোভে!

দেখা গেলো ফুল, তামাক আর জুতা বিক্রি করে মানুষের ঘর ভর্তি টাকা আছে কিন্তু খাবার নেই দুই ছটাক; মানুষ বাঁচবে? আর এই সুযোগেই খাবার বিক্রেতা এক কেজি চাউলের দামে অনায়াসে লুফে নিবে ঘরভর্তি সবকটি টাকা! সুতরাং ‘টাকা থাকলে বাঘের চোখ মেলে’ এ প্রবাদ সত্য নয়।

নিকট অতীতে আমরা দেখেছি, গোডাউন ভর্তি বিলিয়ন-ট্রিলিয়ন মূল্যের অস্ত্র মজুদ থেকেও শুধুমাত্র রুটির অভাবে ভেঙে ষোলো খণ্ডের টুকরো হতেও সময় নেইনি পরাক্রমশালী সোভিয়েত রাশিয়ার।

ইতিহাস স্বাক্ষী, শুধুমাত্র খাদ্যের অভাবে দুনিয়ায় ঘটে যাওয়া দুর্ভিক্ষ সমূহ ছারখার করে দিয়েছে ক্ষমতার মসনদসহ জনপদের পর জনপদ!

ইতিহাস দেখেছে, শুধুমাত্র খাদ্যের অভাব-ই জনপ্রিয় নেতা ও পিতাকে পর্যন্ত রাতারাতি জনগণের দুশমনে পরিনত করেছে!

সুতরাং ফুল, তামাক, জুতা এবং শ্রমিক রপ্তানি করে চাল-ডাল আর মেধা আমদানির অর্থনীতি কোনো কাজের কথা নয়। এখনো ভাববার সময় আছে।

কথা বলছিলাম, পেঁয়াজের দাম নিয়ে। ক’দিন ধরে পেঁয়াজ নিয়ে দেশে হুলুস্থল অবস্থা।

অনেক দিন আগে যশোর শহরের মেহেরুল্লাহ ময়দানে ”খাদ্যসার্বোভৌমত্ব ও পুঁজিবাদী রাজনীতি” বিষয়ে দীর্ঘ বক্তব্যে বর্তমান সংকটের আগাম ইশারা দিয়েছিলাম। দুর্ভাগ্য, আমরা আজও বুঝি নাই ‘খাদ্য’ই হলো পৃথিবীর সবথেকে বড় রাজনীতির হাতিয়ার। আর আমারা খাদ্য নিরাপত্তা বা food security’র ধূয়ো তুলে সেই মহামূল্যবান হাতিয়ার প্রতিনিয়ত তুলে দিচ্ছি আপন শত্রুর হাতে!

‘পেঁয়াজের মূল্য বৃদ্ধি’ একটি ইশারা মাত্র। এখনও সময় আছে ‘খাদ্যসার্বভৌমত্ব’ বা food sovereignty প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে ফিরে আসা। ফিরে আসা প্রকৃতির কানুনে, আত্মসমর্পণে।
মানুষের শুভ বুদ্ধির জয় হোক।

বারো

রাজনীতির পচন মানেই সমাজের পচন

এদেশের সবকিছু ভেঙে পড়েছে
আগাপাছতলা সব কিছু।

আজ প্রায় বছর ধরে কাজ করছি নানা মিস্ত্রীদের সাথে। উদ্দেশ্য: ‘প্রাচ্য আকাদেমি’ নির্মাণ।

রাজমিস্ত্রী, রড মিস্ত্রী, কাঠ মিস্ত্রী, ইলেকট্রনিক মিস্ত্রী, থাই মিস্ত্রী, টাইলস মিস্ত্রী, স্যানিটারি মিস্ত্রী, রঙ মিস্ত্রী, গ্রিল মিস্ত্রী, টিন মিস্ত্রী শত শ্রমিকের সাথে; অদ্ভুত ব্যাপার কেউই কোনো কাজ বোঝে না। কারোরই কোনো আইকিউ নেই, কমনসেন্স নেই, সৌন্দর্য জ্ঞান নেই। শুধুই তর্ক করে। আর একটি কথাই তারা শিখেছে- ‘হাতের কাজতো—এদিক ওদিক হবেই’!

অর্থাৎ ওদের রুচিতে আপনাকে চলতে হবে। আপনার রুচিতে নয়!

সমস্যা হলো, আপনার যদি নিজস্ব পছন্দ থাকে তবে আপনি মরেছেন। আর যদি আপনার কোনো পছন্দ না থাকে, বোধবুদ্ধি না থাকে তবেই রক্ষা।

তার পরেও কথা আছে, যদি আপনি আপনার তাবৎ কাজ কাম ফেলে মিস্ত্রীদের পেছনে লেগে থাকতে পারেন তবেই কাজ হবে, অন্যথায় যা করে যাবে তা দেখলে আপনার রীতিমতো স্ট্রোক হবে। আগেই বলেছি, নির্বোধ হলে বাঁচা।

অথচ সেই মোঘল থেকে ব্রিটিশ হয়ে পাকিস্তান আমলেও ভারতবর্ষ তথা বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিদ্যমান স্থাপত্য নিদর্শন সমূহ এখনো বহন করে চলেছে সে সময়ের কর্মদক্ষতা ও শিল্প নৈপুণ্যের ছাপ।

এই দেশেরই মাটি দিয়ে তৈরি সেই মান্ধাতার আমলের প্রযুক্তি—খেজুর গাছ দিয়ে পাজায় পোড়ানো ইট আজও রেললাইনের ব্রীজ কালভার্টে অক্ষত আছে।

না নোনা ধরেছে, না আমা হয়েছে।

কারণ কী?

কারণ অনেক। হতে পারে এখন মাটিতে পর্যন্ত ইউরিয়ার ব্যবহার অন্যতম কারণ। কিন্তু আমার ধারণা, প্রধান কারণ- প্রশাসনিক ব্যর্থতা ও রাজনৈতিক দূর্বলতা।

অশিক্ষা, দূর্নীতি, গণমানুষের চরিত্রহীনতা এ সবেরই উৎস রাজনৈতিক দূর্বলতা। মাথায় পচন ধরলে যেমন দেহের কোনো একটি কোষ আর সুস্থ থাকতে পারেনা; তেমনি রাজনীতিতে পচন ধরলে রাষ্ট্রের কোনো একটি অর্গান আর সুস্থ ভাবে কাজ করেনা। অথচ আজ সমাজে প্রতিষ্ঠিত ধারণা- আধুনিক দুনিয়ায় রাজনৈতিক নেতা-ই ঈশ্বর। বিচারের রায় ও ক্ষমা প্রদান উভয়ই রাষ্ট্রপ্রধানের ইচ্ছের উপরে নির্ভর করে।
আর সে কারনেই প্রয়োজন হয়, রাষ্ট্র নির্মাণ বা বদলের। প্রয়োজন হয়, রাজনীতির। একই সাথে রাজনীতির জন্য প্রয়োজন হয় মানুষের বায়োলজিক্যাল চাহিদা, যা পুরোন করে অর্থনীতি। আর রাজনীতির জন্য আরো যা প্রয়োজন হয় তা হলো নৈতিক মন, যা পুরোন করে, ধর্মজ্ঞান। কিন্তু এ সমুদয় কাজও সম্পাদনা করে রাজনীতি।

কথা বলছিলাম, অশিক্ষিত শ্রমিকদের নিয়ে। আসলে এ দশা বিরাজমান সমাজের সর্বত্র। শিক্ষালয়, বিচারালয়, ধর্মালয় সর্বত্র।

সুতরাং ‘রাজনীতি’ কোনো ভাবেই ফেলনা বিষয় নয়। কেবলমাত্র আঠারো বছর বয়সই যথেষ্ট নয়। যথেষ্ট নয়, তথাকথিত বিশ্ববিদ্যালয় অথবা মাদ্রাসা পাস। প্রয়োজন রাষ্ট্রজ্ঞান এবং আমল। সবার আগে প্রয়োজন- ভালো মন্দ জ্ঞান ও শুভ বোধ।

 

তেরো

মহান বিজয় দিবস ২০১৯

১৬ ডিসেম্বর, মহান বিজয় দিবস!

কার যে বিজয় আর কিসের বিজয়, প্রায় ৫০বছর ধরে দেখছেন শহীদ আত্মাগণ!

কুয়াশাচ্ছন্ন চশমা মুছে যখন তাঁরা দেখেন- আজ মুক্তি যুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল এম এ জি ওসমানীর নাম মুছে গেছে। ‘বিতর্কিত’ খেতাব নিয়ে কোনঠাসা মুক্তি যুদ্ধের আটজন সেক্টর কমান্ডার। অবহেলিত, মুক্তি যুদ্ধোত্তর দেশের সংবিধান রচয়িতাগণ। গৌণ করে দেখার চেষ্টা মহান সেনাবাহিনীকে। এসময় চশমাটা আছাড় দিয়ে ভেঙে ফেলা ছাড়া কী-বা করার আছে শহীদ আত্মার?

দু’কান থেকে ৫০বছরের ধূলি সরিয়ে শুনতে পাচ্ছেন তাঁরা- ব্রিটিশ মুলুকে গিয়ে এ দেশের কোনো এক মন্ত্রী ঘোষণা দিচ্ছে, ‘বাংলাদেশ ভারতের অংশ’! আরেক মন্ত্রী দিল্লি গিয়ে বাগাড়ম্বর বলছে, ‘ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক স্বামী স্ত্রীর মতো‘! লাগামহীন বলেচলেছে কথিত নাগরিকরাও। মার্কিন দেশে গিয়ে তাদের প্রেসিডেন্টকে জানাচ্ছে, ‘বাংলাদেশে মুসলিম মৌলবাদীদের দ্বারা তারা উচ্ছেদ হচ্ছে‘। ভারতে গিয়ে ধর্ণা দিচ্ছে, বাংলাদেশে হস্তক্ষেপের দাবি নিয়ে।

যারা যুদ্ধ করেনি, রাজাকার; তারাই দেশ চালাচ্ছে। প্রকৃত যোদ্ধারা এখন পলাতক অথবা আসামি। দেশপ্রেমিকরা বাকরুদ্ধ। তাঁবেদার ও সম্প্রসারণশীল আগ্রাসী শক্তির চাকরবাকরাই আজ বড় কথা বলছে।

সুযোগ বুঝে চোর-ডাকাত অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, মূর্খরা বড় বড় আসনে বসে লুটেপুটে খাচ্ছে- জমিজমা, নদীনালা, গাছপালা, ব্যাংক বিমা, শেয়ার বাজার, কাঁচা বাজার সবকিছু!

অবহেলা আর অনিয়মের ঝাঁঝালো তাপে মলিন হয়েগেছে বিজয় উৎসবের ঝলমলে রং। নাগরিকের আনন্দ থেকে তা সরে গিয়ে শামিল হয়েছে ব্যক্তি দল ও গোষ্ঠীর আনন্দ উৎসবে।

তবুও, তবুও হে ‘বিজয় দিবস’
তুমি চির অম্লান, চির ভাস্বর
তোমার দিকে তাকিয়ে আছি
অনন্ত মুক্তির প্রতিক্ষায়…

বেনজীন খান। দার্শনিক, লেখক ও প্রাচ্যসংঘের প্রতিষ্ঠাতা। জন্ম ৯ ডিসেম্বর ১৯৬৬, বাংলাদেশের যশোরে। লেখাপড়া করেছেন 'ইসলামের ইতিহাস ও সভ্যতা'য় স্নাতকোত্তর। তিনি মূলত রাজনীতিক। রাজনৈতিক দায়িত্ব পালন করেন তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব, ইতিহাস, দর্শন ও সাহিত্যচর্চার মাধ্যমে। তাঁর প্রিয় সৃষ্টি ‘প্রাচ্যসংঘ্য’ বহুমাত্রিক জ্ঞানচর্চাকেন্দ্র।...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ