বিভেদ

রুদ্র অয়ন
ছোটগল্প
Bengali
বিভেদ

অন্তরাদের ফ্ল্যাটের সামনে পাশের বাসায় তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ থাকে। ওদের বেলকনি আর অন্তরাদের বেলকনি প্রায়ই সামনাসামনি।

অন্তরার পাঁচ বছরের ছেলেটার সাথে ওদের বেশ ভাব। একদিন অন্তরা লক্ষ্য করে দেখে বেলকনি থেকে ওরা কিছু ঝালমুড়ি একটা কাগজের ঠোঙায় ভরে ছেলেকে দিচ্ছে। অন্তরাকে দেখা মাত্রই ওদের মধ্যে কয়েকজন বেলকনি থেকে সরে দ্রুত রুমের ভেতর ঢুকে পড়লো। বাকি একজন ছিলো সে হয়তো ওদের দলের সর্দার। সে অন্তরাকে দেখে অপরাধীর মতো বললো, ‘ওকে কিছু বলিস নারে বোন। ওর কোনো দোষ নাই। আমরাই ডেকেছি ওর সাথে গল্প করবো বলে।’

অন্তরা ছেলের হাত থেকে ঠোঙাটা একটানে কেড়ে নিয়ে বেলকনি দিয়ে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেললো। ছেলেটা ওর দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে রইলো। ওপাশের বেলকনিতে থাকা ওদের একজন অবাক নয়নে দেখছিলো।
অন্তরা ছেলেকে টানতে টানতে ভেতরে নিয়ে চলে গেলো।

এর মাঝে এক সপ্তাহ চলে গেছে। অন্তরা ভেবেছে সেদিনের পর থেকে ওর ছেলে বা ওরা কেউ ই আর কথাবার্তা বলবে না। কিন্তু না, তার ধারণাকে ভুল প্রমাণিত করে অন্তরার ছেলে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে ওদের সাথে ঠিক গল্প করছিলো।

সেদিন অন্তরা রাগে পুরো শরীর থরথর করে কেঁপে ওঠে। অন্তরা প্রেগন্যান্ট। পেটে আট মাসের বাচ্চা। এই সময় এতো উত্তেজিত হলে চলবে না। অন্তরা ভাবছে ছেলেকে রুমে এনে কয়টা কথা শুনিয়ে দেবে।
বেলকনির দিকে পা বাড়াতেই কানে এলো ছেলের কথা।
‘আচ্ছা আন্টি বলোতো আমার আম্মু কেন তোমাদের পচ্ছন্দ করেনা? আমাকেও বকা দেয়! যেন তোমাদের সাথে কথা না বলি। আমার আম্মু বলে খারাপ মানুষদের সঙ্গে মিশতে নেই৷ তাহলে কি তোমরা খারাপ মানুষ?’

সহসা অন্তরা সেখানে উপস্থিত হয়ে ঠাস করে ছেলের গালে একটা চড় বসিয়ে দিলো! ছেলেটা তখন গালে হাত দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে সেখান থেকে চলে গেলো। অন্তরা রাগে কটমট করতে করতে ওদের উদ্দেশ্যে বললো, ‘আর একদিন যদি তোমাদের আমার ছেলের সাথে কথা বলতে দেখেছি আমার চেয়ে খারাপ আর কেউ হবে না।’

ওদের মধ্যে থেকে একজন কর্কশ গলায় বলে ওঠলো, ‘কেন রে! ওইটুকু বাচ্চাকে এতো ভেদাভেদ শিখাচ্ছেস কেন! ও ছোট মানুষ, তোদের মতো এতো ভেদাভেদ বুঝেনা। এতো অহংকার কেনো রে তোদের? আর কি খারাপ দেখাবি তুই! ওপর ওয়ালাইতো আমাদের মেরে দিয়েছে, আমরা হিজরা। খারাপের কি দেখাবি তুই? বেশি অহংকার ভালো না।’

ঐ ঘটনার পর কেটে গেলো কিছু দিন। আজ বিকেলের দিকে হঠাৎ প্রসব ব্যাথা শুরু হয় অন্তরার। বাসায় অন্তরা, তার স্বামী, ছেলে আর কাজের খালা ছাড়া কেউ থাকে না। ওর স্বামী এখন অফিসে রয়েছে। এদিকে খালা বিকেলে বাজার করতে গেছে। অন্তরা ব্যাথায় যখন কাতরাচ্ছিলো তখন ওর ছেলেটা দৌঁড়ে একবার কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে পরক্ষণে কোথায় যেন ছুটে যায়।

কয়েক মুহূর্ত পর ছেলের পেছন পেছন পাশের ফ্ল্যাটের সেই হিজড়াগুলো এক এক করে রুমে প্রবেশ করে। অন্তরা আবছা চোখে দেখে ওরা ধরাধরি করে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সিএনজিতে বসিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যায়।

অন্তরার কোল আলো করে জন্ম নেয় এক শিশুকন্যা।
সকালে অন্তরা তার স্বামীর মুখে শুনে সারারাত ওরা কয়েকজন কেবিনের বাইরে বসেছিলো।

নিজের ভুলগুলোর জন্য অন্তরা অনুতপ্ত হয়। ওরাও যে রক্ত-মাংসে গড়া মানুষ এই চরম সত্য কথাটা ভুলে গেলেতো চলবেনা। সবার ওপর মানুষ, মনুষ্য। এটাই বড় কথা। জাতপাত ভেদাভেদ তৈরি করে সৃষ্টি কর্তার সৃষ্টিকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করাটা অন্যায়।

স্বামী কে অন্তরা বলে, ওদের ভেতরে আসতে বলো।
এক এক করে ওরা পাঁচ ছয়জন অন্তরার পাশে এসে দাঁড়ায়।
অন্তরা বলে, ‘তোমাদের প্রতি আমার আচরণের জন্যে আমি লজ্জিত। তোমরা ক্ষমা করে দিও।’

ওদের মাঝে সর্দার যে তার নাম ববিতা। সে বললো, ‘তুই আর তোর বাবুটা যে সুস্থ আছিস আমরা তাতেই খুশি। আর একটা কথা, আমরাও মানুষ। আমাদেরও মন আছে, বিবেকবোধ আছে। যখন কিছু মানুষ আমাদের তুচ্ছ করে কথা বলে তখন আমাদের খুব খারাপ লাগে। যাকগে, তোকে আমরা মাফ করে দিয়েছিরে বোন।’

অন্তরার স্বামী ওদের কে অনুরোধ করে বললো, ‘আমাদের সাথে গ্রামের বাড়িতে যেতে। সেখানে মেয়ের নাম রাখা হবে। মেয়ের নাম ওরাই যেন রাখে।

ওদের চোখে পানি টলমল করছে। হয়তো এমন কথার জন্যে ওরা প্রস্তুত ছিলো না।
ববিতা ছলছল চোখে বললো, ‘ভাইয়া, আমরা কি এমন সম্মান পাওয়ার যোগ্য?’

অন্তরার স্বামী বললো, ‘হ্যাঁ যোগ্য। তোমরাও তো মানুষ। জাতপাতের ভেদাভেদ, রেষারেষি তৈরি করে সৃষ্টি কর্তার কোনও সৃষ্টিকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করাটা নেহায়েত বোকামি ছাড়া কিছু নয়। আর মানুষকে যারা সম্মান করে তারা সম্মান পাওয়ারও যোগ্য।’

কিছুক্ষণ চুপ থেকে পরক্ষণে অন্তরার স্বামী আবার বলে, ‘তোমার আর কারও করুণার পাত্র হয়ে থাকবেনা। আমি তোমাদের সেলাই প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে দেবো আর সেলাই মেশিনও কিনে দিবো। তোমরা রোজগার করে সম্মানের সাথে জীবন যাপন করবে।’

ওদের চোখে এতক্ষণ যে জল টলমল করছিলো, দু’গাল বেয়ে তা গড়িয়ে পড়ে। এ অশ্রু আনন্দের। প্রেরণায় এগিয়ে চলার এক নতুন ভোরের খুশিতে ওদের মন ভরে যায়। অশ্রু আর আনন্দের সংমিশ্রণের খুশিতে ওরা বলে ওঠে, ‘এরকম উদ্যোগ নিয়ে যদি প্রতি এলাকায় সমাজের কর্তাব্যক্তি, সমাজপতি বা দেশের নেতারা এগিয়ে আসে তবে আমরাও সম্মানের সাথে জীবন যাপন করতে পারবো। দেশের প্রতি আমরাও ভুমিকা রাখতে সক্ষম হবো।’

রুদ্র অয়ন। কবি।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ