বিরিঞ্চির দোকান

সুদীপ ঘোষাল
অণুগল্প
Bengali
বিরিঞ্চির দোকান

সকালে উঠে মায়ের মমতামাখা মুড়ি ও লিকার চা খেতাম। তারপর দাদু বলতেন, এবার পড়তে বোস। তারপর বিরিঞ্চির দোকানে যাব নটকনের মাল আনতে। আমি বলতাম,নটকনের মাল কি দাদু?
দাদু বলতেন,এই চাল,ডাল, মশলাপাতিকে গ্রামের লোক নটকনের মাল বলে।
ছোটবলায় এই দোকানেই আমাদের স্বপ্নপূরণ হত। বন্ধুরা সকলে একত্রে ঈশানী নদীর পাড়ে বনভোজন করতাম এই দোকান থেকে চাল ডাল তেল ,ডিম,মশলাপাতি ক্রয় করে ।
লজেন্স, চানাচুর আর শোনপাপড়ির মিশ্রিত গন্ধজুড়ে মেতে উঠত ছেলেবেলার সোহাগি বিকেল।
তারপর দাদু পরলোকে চলে গেলেন আামাদের ছেড়ে।
আমার মা বলতেন,তোর বয়স বেড়েছে । কিন্তু আদৌ বড় হয়েছিস কি না কে জানে?
বাবার সঙ্গে একবার দুর্গাপুজোর প্রসাদ খেতে গিয়ে বিরিঞ্চির দোকানঘর দেখে থমকে গেলাম। তার মাটির ঘরের কাবারির কঙ্কাল বুকে শেলবিদ্ধ করল আমার।খুব মর্মাহত হয়ে বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম,বাবা বিরিঞ্চির দোকানের এই হাল কেন? বাবা বললেন, সেই বিরিঞ্চিদাও নেই আর দোকানও নেই।তার ছেলেরা এই বাড়ি বিক্রি করে শহরে গেছে উন্নতির আশায়।

বাবার কথা আমার কানে ঢোকে নি।
আমি তখন, দাদুর সঙ্গে বিরিঞ্চির দোকানে চলেছি ছোটবেলার স্মৃতিপথ ধরে।

সুদীপ ঘোষাল নন্দনপাড়া খাজুরডিহি পূর্ববর্ধমান ৭১৩১৫০ মো ৮৩৯১৮৩৫৯০০.

ফিরে দেখা

সুদীপ ঘোষাল

যে স্কুলে পড়তাম, দীর্ঘ কুড়িবছর পরে সেই স্কুলের সিঁড়িতে দেখলাম স্মৃতিগুলো থমকে আছে অতীতের থাম ধরে। আমার কাঁচাপাকা চুল সহসা কালো হয়ে ফুটে উঠল । কি করি, কোনটা আগে দেখি পড়িমরি করে ছুটলাম রসায়নাগারে। এখানে লাফিং গ্যাসের বোতল খুলে গেছিল, আমরা সকলে হাসছিলাম, এমনকি শিক্ষকমহাশয় পর্যন্ত হাসছিলেন। তারপর, গ্রন্থাগারের দরজা খুলে মৌন হলাম। সারি সারি বই সাজানো, আব্দুল স্যার গম্ভীর হয়ে বই পড়ছেন। মায়ামাখানো অপূর্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে তিনি বললেন,এখানে আয়।কেমন আছিস?
ঢং করে, ঘন্টা পড়তেই চমকে দেখি কেষ্টদা বলছেন,কেমন আছিস বাছা।তোর নাম মনে পড়ে না, তবে মুখটা মনে আছে। মনে পড়ল কবিশেখরের কথা,” মালিকা পরিলে গলে, প্রতিফুলে কে বা মনে রাখে”…

নৌকাবিহার
সুদীপ ঘোষাল

একদল বলাকার দল উড়ে এল রিমির মনমেঘে।তখন সে সাদাশাড়িতে সতের।দেহের সাগর ঘিরে উথালপাথাল ঢেউ।ঠিক সেই সময়ে নোঙর করে তার মনের তীরে সমীরণের ছোঁয়ায় তার শিরশিরে পানসি নৌকার অনুভব।ধীরে ধীরে পালতোলা জাহাজের মত দুজনের প্রেম তরতরিয়ে এগিয়ে চলে।শত ঝিনুকের মুক্তোর সোহাগে দুজনেই রঙীন হয়ে উঠত।
চিন্তার রেশ কাটতেই বিপিন বলে উঠল,রিমি তুমি এত কী চিন্তা করছ?
– কিছু না।এমনি করেই কাটুক সময়।
– আমাদের বিয়ের পাঁচ বছরে একটা অনুষ্ঠান করলে হয় না?
– থাক ওসবে আর কী হবে? এই বেশ বসে আছি নদীর তীরে।
– তোমার অতীতের কথা বলো। আমি শুনব।
– কেন তোমার অতীত নেই
– আমার অতীত বর্তমান হয়ে রাজুর বউ হয়ে বসে আছে।
– ও, রাজুর বউ তোমার পূর্ব প্রেমিকা ছিল?
– হ্যাঁ ছিল একদিন। গ্রামের মন্ডপতলায় গেলেই মনে পড়ে বাল্যপ্রেম।কাঁসর ঘন্টা বাজত আরতির সময়।আমি ভালো কাঁসর বাজাতাম।আর তাছাড়া ওর মুখ দেখার লোভে ছুটে চলে যেতাম পুজোমন্ডপে। আরতির ফাঁকে দেখে নিত ওর চোখ আমাকে।তার চোখের নজর আমার দিকেই থাকত। সারাদিন তাকিয়ে থাকতাম ওদের বাড়ির দিকে।যদি একবারও দেখা যায় ওর মুখ। অসীম খিদে চোখে কেটে গেছে আমার রোদবেলা।
– আমারও অতীত ভেসে গেছে অজানা স্রোতে।এসো আজ আমরা আবার নতুন মনে এক হই অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথ চেয়ে।
– হ্যাঁ ঠিক বলেছো তুমি। পুরোনো ব্যাথায় মলম লাগাব দুজনে দুজনকে।চলো আজ নৌকাবিহারে আমাদের বিবাহবার্ষিকী পালন করি।
– চলো। নব উদ্যমে এগিয়ে যাই আমরা নবসূর্যের আহ্বানে।

 

মাটি

সুদীপ ঘোষাল

সূর্য হেলে পড়েছে পশ্চিমপাড়ে। আলপথ কোথাও জেগে আছে কোথাও জলে আধো ডোবা। কেনা আলপথ পেরিয়ে বাঁধে উঠে দেখল এদিকটায় একজন এখনও লাঙল চালাচ্ছে জমিতে।কেনা ঠিক ঠাওড় করতে পারছে না। চিৎকার করে বলল কেনা,কে গো এখনও জমিতে লাঙল দিচো।কে তুমি, ঠিক ঠাওড় করতে লারছি।
– আমি মরা গো , হাজরাদের মরা।এবার উঠব।
– ও মরাদা, একখান ট্রাকটর ডেকে জমিটা চষে দিলেই তো পারো।এত পরিশ্রম আর কেউ করে না।

– তা বটে। তবে কি জানো আমার মাটির বুকে ধরফরিয়ে ট্রাকটর চালাইতে আমি পারব না।
– কেনে, কেনে?
– আরে বাবা, মাটি তো আমাদের বুকের মত গো।আস্তে আস্তে বুক মালিশ করি যেমন, ঠিক তেমন করে জমি চষি।
মরাদা এবার জমা জলে হাত,পা ধুয়ে নিচ্ছে। মোষ দুটোর পিঠে জল দিয়ে ধুয়ে হাত বুলোতে বুলোতে বলল,চলো তোমার সঙ্গে বাড়ি যাই।
কেনা বলল, চল। কিন্তু তুমি তো সার দাও না জমিতে। কেন গো?
মরাদা বলল,দি তো। জৈব সার দিই।গোবর, পচা খড় প্রথমে দি। তারপর বৃষ্টি হলে আরও পচে।তারথেকে আর ভাল সার কী হতে পারে?
– কেনে, রাসায়নিক সার।
– ও সারে বন্ধুপোকা মরে যায়।মাটির খেতি হয় গো।
কেনা বলে,ওসব বুঝি না। তবে তোমার চাষের পদ্ধতি আমার কিন্তু বেশ লাগে। সবথেকে তোমার জমিতে ফসল ভাল হয়, তা বটে।
– আরে সেইকথাই তো বলছি গেরামের সকলে যদি গোবরসার ব্যবহার করি মাটি বাঁচবে,উর্বর হবে।
কেনা ওর পাড়ার পথে পা বাড়ালো।
মরাদা স্বপ্ন দেখে মাটিরগর্ভে কতজীবন আছে।তাদের সে বাঁচিয়ে তুলছে আর সবাইকে তার কথাটা বোঝাতে পেরেছে।
মরাদা ভাবে,কবে যে সেই স্বপ্নের দিন আসবে, কে জানে।

সুদীপ ঘোষাল নন্দনপাড় খাজুরডিহি পূর্ব বর্ধমান মো৮৩৯১৮৩৫৯০০ পিন ৭১৩১৫০.

অণুগল্প

চিঠি

সুদীপ ঘোষাল

সুমন যে গ্রামে বাস করত, সেই গ্রামের মেয়ে জয়ন্তী।তখন মাঠে হাঁটতে গেলে জয়ন্তী, সুমনের জন্য দাঁড়িয়ে থাকত চিঠি হাতে। তখন মোবাইল ছিল না। ছিল না হোয়্যাটস আ্যাপে, চ্যাটের দাপট।
সুমন বলত,তোমার চিঠির আনন্দে আমি সারাদিন আনন্দে থাকি।
জয়ন্তী বলত,উত্তর না দিলে কিন্তু খুব রাগ করব।
তারপর সুমনও চিঠি লিখত। সারদিন চেয়ে চেয়ে চমকে যেত বিকেল। সকালে মেঘের চালফুঁড়ে জয়ন্তীর চিঠি সুমনকে বাঁচিয়ে রাখত,তরতাজা রাখত। কোনো কারণে পত্রালাপ না হলেই মনখারাপের মেঘগুলো ভিড় করত মনে। তার মনে অকারণে জয়ন্তীর বিপদের কথা মনে হত। এইভাবে চলত ছাইখেলার ছলে পুতুলখেলা। তারপর একদিন জয়ন্তীর ঘরে আগুন লাগলো।কারা যেন চিঠিগুলো পুড়িয়ে মনের সাধ মিটিয়েছে।
জয়ন্তী বিয়ে করেছে।তার মেয়ে আছে।এখন আর উড়োচিঠিগুলো আনন্দ দেয় কি তার মনে। সুমনভাবে একবার দেখা হলে জিজ্ঞাসা করবে। প্রায় কুড়িবছর পরে জয়ন্তীর মেয়ের বিয়ের চিঠি এল সুমনের হাতে।সুমন বিয়েতে গিয়ে পুরোনো চিঠিগুলো নিয়েছিলো ব্যাগে। যদি জয়ন্তী দেখতে চায়, সে দেখাবে পুরোনো চিঠির মালা।
জয়ন্তী সুমনকে ডেকে বলল,এই দেখ, আমার বর। ডাক্তার মানুষ।এই আমার মেয়ে। তোমার বউ কই?
সুমন বলে,বিয়ে করাটা হয়ে ওঠে নি,আর হবে বলেও মনে হয় না। জয়ন্তী কাজের ব্যস্ততায় বরকে নিয়ে বেড়িয়ে গেলো কাজে। জয়ন্তী বলল,তুমি বসো।আমাদের এখন অনেক কাজ। মেয়ের বিয়ে বলে কথা। সারাদিন আর জয়ন্তী সুমনের ঘরে আসে নি। বিয়ের পরের দিন বাইরে এসে সুৃমন চিঠিগুলো আগুনে পুড়িয়ে দিলো। এক নতুন জীবনের খোঁজে সুমনের শুরু হল পথচলা।

সুদীপ ঘোষাল

পূর্ববর্ধমান।

অণুগল্প

পুনর্মিলন
সুদীপ ঘোষাল

সুমনা তার পরিবার নিয়ে ভিড় ট্রেনে উঠে বসার জায়গা খুঁজছে। বর আর মেয়েকে বসিয়ে সুমনা পরের কামরায় গেল সিট খুঁজতে। হতাশ হয়ে সে দাঁড়িয়ে রইল।ওপাশ থেকে সুমনার বর বলল,বসার জায়গা দেখে নাও। আমি মেয়েকে কোলে নিয়ে বসে আছি।
সুমনা বলল,বেশ।
হঠাৎ একটি লোক উঠে বলল,এখানে বোসো। আমি দাঁড়াই।
সুমনা অবাক হল লোকটার মুখ দেখে। এ যে রিন্টুদা, তার পূর্ব প্রেমিক।
অসমাপ্ত প্রেম আবার দুজনকে মিলিয়ে দিল কিছুক্ষণের জন্য।

অণুগল্প
পুজোয় প্রথম প্রেম
সুদীপ ঘোষাল

গতকাল পুজোর শেষে ধুনুচি নাচ চলছিলো দুর্গামন্ডপে।রিতা নাচের ফাঁকে দেখে নিলো তপুর চোখ।নিস্পলক দৃষ্টি তপুর চোখে।গিলছিলো রিতার নাচের ভঙ্গিমা।তারপর তপু গিয়ে একটা ঢাক বাজাতে শুরু করলো।কখন যে রিতার নাচ শেষ হলো তপু জানতেই পারলো না। তখন নাচ শুরু করেছে পাড়ার ক্যাবা মস্তান।ঢাকের তাল কাটতেই তপুর কপালে জুটলো তিরস্কার। রিতার তখন দারুণ হাসি।তার বান্ধবীরাও হাসছে। তপু বাজানো বন্ধ করে পাশে দাঁড়ালো।সে মনে মনে ভাবলো, অসুরের মত দেখতে ছেলেগুলো কেন মেয়েদের এত প্রিয় হয়।পাশে আমি ছিলাম। বললাম, পাগলা পুজো শেষ হয়ে যাবে। যা বলার এখনি বলে দে রিতাকে।নইলে পরে পস্তাতে হবে। তপু ঢাকের কাঠি দুটো নিয়ে গিয়ে রিতাকে বললো,তুমি আর একবার নাচো না প্লিজ। সঙ্গে সঙ্গে আবার হাসি। তারপর থেকে লজ্জায় প্যান্ডেল ছেড়ে পালিয়ে বাঁচলো।জানিনা কবে যে তপু সাবালক হবে।

সুদীপ ঘোষাল। গল্পকার। জন্ম ভারতের পশ্চিমব্ঙ্গরাজ্যের কেতুগ্রামের পুরুলিয়া গ্রামে। প্রকাশিত বই: 'মিলনের পথে' (উপন্যাস)। এছাড়াও কয়েকটি গল্প ও কবিতার বই আছে।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

দৌড়

দৌড়

একবার এক দৌড় প্রতিযোগিতায় কেনিয়ার হয়ে দৌড়চ্ছিলেন আবেল মুতাই। খুবই ভালো দৌড়াচ্ছিলেন তিনি। সবাইকে পেছনে…..