বিশ্বাসের অনড় জেরুজালেম

হিমাদ্রী চৌধুরী
কবিতা
Bengali
বিশ্বাসের অনড় জেরুজালেম

বিশ্বাসের অনড় জেরুজালেম

তোমার দূরত্ব কতটুকু — আমি মাপতে পেন্সিলে আঁকি আকাশ
তার নিচে পাখি
তার নিচে ঝর্ণা
তার নিচে মিশর এবং প্রাচীন মমি

আমার হাতে ইরেজার, ভূত তাড়ানো মন্ত্রের মতো একটু পর পর তোমার নাম জপি, কাটাকাটি করি।
আমি নামাজ পড়ি, তুমি মন্দিরগামী, মাথায় সিঁদুর
বুকে কোমল পাখি উড়ে, তুমি আমার বুকে ঘুরো
চোখে খুব নেশা যদিও মারিজুয়ানার বড্ড অভাব, অভাব পকেটের
তবুও লাল চোখ, তবুও খয়েরি টিয়া দেখি,
শুনি — কোটি কোটি কণ্ঠ নকল করে তোমার গান গায়,
তোমাকে ডাকে, সাথে আমিও ডাকি।

ছিলে নীরব, আজো নীরব।
হাঁটো ধীরে, কোমরে বর্শা নিয়ে
একপায়ে নূপুর, অন্য পায়ে সঙ্গীত
আমি আরাধনা করি, তুমি মন্দিরগামী,তুমি সূর্য পূজারী — তোমাতে দেখি চাঁদ
আমি চাঁদ ভালোবাসি, তোমাকেও।

তোমার দূরত্ব কতটুকু — আমি মাপতে বাজারে যাই
ভীড় ঠেলে ঘুরি, নিজেকে হারিয়ে ফেলি, মানুষে মানুষে ঠাসা ভীড় — আমি কই?
বাড়ি ফিরে আসি, তুমিও ফিরে আসো
অনুভব করি শরীর শিল্পকলায়, তবুও কাছে না পাই, হারাই! হারাই চোখে চোখে।

আমি খুঁজে ফিরি যীশুকাল।কাশেম মিয়ার মিঠাই, রঙিন হাওয়াই মিঠাই।শোনতে পাই সেই হাঁক —এই মিঠাই…
ছুটে যাই ছাঁদে কিবা পথময়
আমার বষর্ণক্লান্ত দুই চোখ — খুঁজে ফিরে
কাশেম মিয়ার সেই মিঠাই, রঙিন হাওয়াই মিঠাই,
তোমাকেও তো তাই।

তুমি কোথায় থাকো জানতে হাত রাখি
চোখে তুমি জেগে
নাকে তোমার ঘ্রাণ
ঠোঁটে গভীর চুম্বনের দাঁগ
গ্রীবায় তোমার জলছাপ
বুকে তুমি গান শুদ্ধ সারগাম
লোমে পোড়া শিরহণ
পেটে অদ্ভুত মোচড়
নাভীয় তোমার স্নান
নিতম্বে তোমার রোদ
উরুয় তোমার ধ্যান
এবং বিক্ষোভ ঝঞ্ঝা ঝড়

আমি চিৎকার দিই, আমি চুপ থাকি, আমি হাত পোড়াই, রক্তপাত করি, পাখি পুষি, মুক্ত করি
আকাশ কালো দেখি, বাতাস হলুদ দেখি
আকাশ দেখিনা, বাতাস জাহাজ হয়ে যায়
আমি হাত সাজাই, মেহদি রাঙাই, আতর মাখি, সুরমা পড়ি, সমুদ্র চুষে খাই
পিপাসায় মরি — তোমার দেখা নাই

তুমি কোনদিন আসো — ভাবতে বসে দেখি
রবিবার তুমি ক্যামেলিয়া
সোমবার আমার মাউর্থগান
মঙ্গলবার গানের লিরিক
বুধবার কফির আড্ডায়
বৃহস্পতিবার স্বপ্নযোগে
শুক্রবার প্রার্থনায়
শনিবার কালো রঙ

তোমার দূরত্ব কতটুকু — মাপতে স্কেল ধরি
দেখি, তোমার পায়ের দাগে উর্বর ফসলের ক্ষেত
শিশিরের গায়ে মৃদু শীতের আবহ
বৃষ্টির ছন্দে তোমার তা থৈ
জলকেলির বিছানায় তোমার স্লোগান
কাগজের নোটে তোমার আঙুল রেখা
ছুরির শরীরে তোমার শান
সূচের ডগায় শাসন
আমি কবিতায় পড়ি, তোমার কথা লিখি, তুমি কালো অক্ষর, তুমি গ্রন্থের ভাষা

আমি তোমাকে বুঝিনা, আমি তোমাকেই বুঝি
তুমি আমাকে খোঁজো না, আমি তোমাকেই খুঁজি
তোমার হাতে বালা, আমার হাতে তুলি
তুমি হেঁটে যাও ধীরে, আমি তোমাকে আঁকি

তুমি হাঁসের সাঁতার, পালকের ওম, সহজ বাতাস তুমি, ফেরারী ঘুঙুর,
তুমি ডার্ক সার্কেল, তুমি ডিপ্রেশন, তুমি ঘুমের বড়ি
তুমি সুইডিশ ঘুম
তুমি কাঁথায় জড়ানো শীত, তুমি রূপকে মোড়া লাল বসন্ত

তোমাকে পাইনা শরৎ-এ, উড়ে যায় মেঘ
তোমাকে পাইনা হেমন্তে, ঢেঁকির বিহরে
তোমাকে পাইনা শীতে, নিরুত্তাপে জমি
তোমাকে পাইনা বসন্তে, কৃষ্ণচূড়ায় ক্ষত
তোমাকে পাইনা গ্রীষ্মে, ভ্যাপসা জীবনে ঘাম
তোমাকে পাইনা বর্ষায়, আশ্রয়হীন ভিজি

তোমার ঠোঁটে দুশো কোটি মিসাইল
তোমার চোখে দুশো আলোকবর্ষ আউন্স রোদ
তোমার চুলে পৃথিবীর সবচেয়ে মিহিন অন্ধকার
তোমার শরীরে হীরকচূর্ণ ভোর
আমার হাতের মুঠোয় তুমি
আমার মুষ্টবন্দী শূন্য
তোমার ঘ্রাণে নেশা আসে
তোমার ঘ্রাণে ফাগুন উড়ে
তোমার ঘ্রাণে ভুল করি সহজ বিকাল
তোমার ঘ্রাণে পকেটে রাখি অমাবস্যার রঙ

তুমি কোন রঙে ফুটো?
তুমি কী আনবিক ত্রাস?
তোমাকে না দেখেই ধ্বংস আসে চোখের পাতায়
তুমি পারমাণবিক বোম্ব
তোমার নামে পদ্মপাতায় জল
তোমার নামে যমুনায় গায়ে জ্বর
তোমার নামে টর্চারসেল
তুমি সুদীর্ঘ কুয়াশায় মোড়া ভ্রমণ

কত সহস্র সকাল আমি ছুটেছি তোমার নামে
কত সহস্র ক্ষুধা আমি পিষেছি তোমার নামে
কত সহস্র ঘাম আমি মুছিনি তোমার নামে
কত সহস্র কান্না আমি লুকিয়েছি তোমার নামে

তোমার দূরত্ব কতটুকু মাপতে আমি পেন্সিলে আঁকি —
সমুদ্রের তলদেশে মুক্তো,ঝিনুকের বুকের ক্ষত
বারমুডা ট্রাংয়াঙ্গেল,বরফের পাহাড়, ডুবে যাওয়া টাইটানিক
তুমি রোজ আমি জ্যাক
তুমি হাত ছড়াও, আমিও ছড়াই
আমাদের মাঝে মহাদেশ
আমাদের মাঝে বিস্ফোরণ
আমাদের মাঝে সীল আর হাঙর

আমি নামাজ পড়ি, তুমি মন্দিরগামী, তোমার সিঁথিতে সিঁদুর, তুমি সূর্যের পূজারী

তোমাকে দেখে শুষ্ক পাতায় ফিরে আসে সবুজ প্রাণ
উল্লাসে ফেটে পড়ে মন্দিরের পিতলের ঘন্টার ধ্বনি
প্রচণ্ড আহত যুবক ব্যথা ভুলে গিয়ে যুদ্ধসাজে সাজে
সোনালী সিংহ শিকার ভুলে গিয়ে সন্ধি করে মোষশাবকের সাথে
জলে তরঙ্গে মাছের মিলন থেমে বরশিতে গাঁথিয়ে দেয় ঠোঁট
আতা গাছের তোতাপাখি ডালিম গাছের মৌয়ের সঙ্গে সংসারের স্বপ্নে খেলা করে বৌ ছি
তামাম পরাশক্তির মধ্যে দ্বন্দ্ব বেধে যায়
কবুতর উড়ে শান্তি শান্তি করে

তুমি এক দুর্বোধ্য আলো
তুমি এক নৃশংস চৌম্বক
তুমি এক সুরম্য করাতকল

জেনেছি —
বহু নাস্তিক ঈমাণ এনেছে তোমার নামে
বহু আস্তিক ঈমাণ হারিয়েছে তোমার নামে
বহু রক্ত গড়িয়ে পড়েছে
বহু রক্তপাত থেমে গেছে

কোনদিন আমার অধিকারে না এসেও
কোনদিন আমার হাতে আলতা না পরেও
কোনদিন আমার সঙ্গে হেমন্তে না বেড়িয়েও
কোনদিন আমার সঙ্গে পানপাত্রে চুমুক না দিয়েও
কোনদিন আমার বুকে নখের আঁচড় না বসিয়েও
কোনদিন আমার জামায় লিপস্টিকের চিহ্ন না রেখেও
তুমি আমার মূর্তিমতী অহংকার

কতটা প্রেমিক আমি, নির্ণয়ে —
রিক্টারস্কেল ভুল যায় কম্পনবিদ্যা
হরিণক্ষেত্রে নামে বিবর্ণ ডাস
শীতপাখি ভুলে যায় মুগ্ধ উড়াল
কাজলদানী শোকে লাল হয়ে যায়

তোমার জন্যে সূর্যাস্তের পরেও কিছু সূর্যমুখী ফুটে থাকে
ভাত শালিক বিকালের নার্সিংহোমের কার্ণিশে বসে ডাকে
অতল জলের তলে মাছেরা বাজার বসিয়ে বেচে মানুষের ছায়া
মাংসের অর্কেস্ট্রায় হঠাৎ হঠাৎ পীতবর্ণ রক্ত হু হু করে বাজে
ম্যাপলের বনে একঝাক অ্যালবাট্রস গোলাপি মদ ফেরী করে সমুদ্রে ফিরে যায়
ফার্স্ট এইড বাক্স ভর্তি চিঠি গুলো উড়ে যেতে চায় তোমার ঠিকানায়
মৌন ফড়িং যৌনেচ্ছা বিসর্জন দিয়ে পিকাসো কে চ্যালেঞ্জ করে বসে

তুমি কতটা নিকটে এলে?
আমি জানিনা সেই খোঁজ
আমার কোলাজ ভর্তি তুমি
তোমার নখের ডগায় এ-প্রাণ

আমি স্রষ্টায় বিশ্বাসী। আত্মহত্যা মহাপাপ মানি
আমি কবিতায় আত্মঘাতী হই, মুসলিম হয়েও শ্মশানচারী মাটি মাখি
আমি চিতায় ধ্যানে বসি
তুমি আগুন জ্বেলে দাও
আমার হাতে রুদ্রাক্ষমালা, মুখে আরশের বানী জপ
তুমি মন্দির হতে ফিরো, তোমার হাসি পদ্মফুল

আমি পিছন থেকে ডাকি
তুমি বারেক ফিরে চাও
তুমি ঘৃণা ছুড়ে মারো
আমি গভীর করে চাই

তুমি এতোই দূরে থাকো, স্পন্দনেরও কাছে
তুমি মুখ ফিরিয়ে রাখো, আমি খিস্তি করে বাঁচি

মেনেছি — মারেফাত জিকিরের সুউচ্চ মাকাম
পাথরে আগুন, পাথরেই ক্রন্দন
আমি দাস হই তার, নই তোমার
তবুও দাসের বেশে ঘুরি, যদি করুন শঙ্খ বাজে

তোমার দূরত্ব মাপতে আমি ভেঙে ফেলি পেন্সিল
পৃথিবীর সমস্ত ব্যারিকেড ভেঙে আমার জ্বর আসে,ঘোরে ডুবে পুড়ি, জাগে মরুজলপট্টি।লিখে রাখি মহাকাল —
পৃথিবীর সমস্ত ঘড়ি মিথ্যা কম্পাসচূর্ণ বেলায় দূরত্বের বিষুবরেখায় তুমি কোমল সত্য
তুমি হাত বাড়াও উর্ধে,
তোমার নেক্রোপলিস আয়ু,
তোমার হাতে ইথানল গ্লাস
প্রেম হলো এক পাপ, তুমি দূরগ্রহচারী
তুমি মন্দিরগামী, তোমার মাথায় সিঁদুর, আমি নামজে অবনত হই
দেখি —
গড়িয়ে পড়ছে শ্বাস
ধেয়ে আসছে প্লেগ
নামছে মৃত্যুযান
তোমার প্রেম মৃত্যুসুধা
“And miles to go before I sleep”
বাজছে ব্রায়ান অ্যাডামস
তোলপাড় জলপাই রঙ শাড়ি

তুমি মৃত্যু
তুমি সত্য
তুমি স্তুতি
তুমি শাস্তি

তবুও ভালোবাসায় আমি কুকুর,
সম্মুখে তুমি অভিধান হয় দাড়িয়ে আছো — আমার বিশ্বাসের অনড় জেরুজালেম…

হিমাদ্রী চৌধুরী। কবি ও শিক্ষার্থী। জন্ম ও বাস বাংলাদেশের ঢাকায়। লেখাপড়া করছেন ইংরেজি সাহিত্যে। তিনি স্বপ্ন দেখেন পৃথিবী হবে ক্ষুধা ও বৈষম্যমুক্ত। তিনি বিশ্বাস করেন, ভুল বোধের প্রাচীর ভেঙে একদিন আলো আসবেই।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

ফ্রেম

ফ্রেম

দেবী না পরিণীতা রাতটা একা থাকে এবং নিঃসঙ্গ অন্ধকার মানে রাত; তাহলে অন্ধকার নিজেও একা…..

সীমানার শর্ত

বিজ‌য়ের সব মুহূ‌র্তেই… তার অ‌ধিকার! কেন্দ্র হোক আর কেন্দ্রা‌তিগ ব‌লের আসন; কেউকেউ বোরকায় রমনীয় স‌ঙ্গানুসঙ্গের;…..