বিষ্টুপদর চিন্তা

পরমার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়
ছোটগল্প
Bengali
বিষ্টুপদর চিন্তা

বিষ্টুপদ হাজরা খুব চিন্তার মধ্যে আছেন, বস্তুত চিন্তার মধ্যে থাকাটাই বিষ্টুপদর কাজ, নয়তো অফিসপাড়ায় যে সরকারি অফিসে বিষ্টুপদ চাকরি করেন সেখানে কাজ বলতে বিশেষ কিছু নেই। তাই বিষ্টুপদ নিজেকে চিন্তার সাগরে নিমজ্জিত রাখেন। অফিসের বাজে আড্ডায় তিনি একদম থাকেন না, ওতে তার চিন্তার ব্যাঘাত ঘটে। এই তো গত মাসে বউ গেছে বাপের বাড়িতে, সকালবেলা অফিস যাবার পথে বিষ্টুপদই নামিয়ে দিয়ে এসেছেন। হঠাৎ বিষ্টুপদর চিন্তা হল সুলতা রাতে প্রেশারের ওষুধটা খাবে তো! চিন্তা করতে করতে বিষ্টুপদ অফিস শেষে শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত। বিষ্টুপদর ছোট শালী বিনীতা মহা ফাজিল, বলে কিনা জামাইবাবু বিয়ের দশ বছর বাদেও এত? দিদিকে ছেড়ে এক রাত থাকতে পারেন না! প্রেসারের ওষুধের কথা মোবাইলে বলা যেত না? বিষ্টুপদ কি করে বোঝায় যে নানা চিন্তার যাঁতাকলে মোবাইলের চিন্তাটা আর মাথায় আসেনি। বিনীতা বললো থাক আর বাড়ি ফিরে কাজ নেই, থেকে যান, নয়তো আবার নতুন কোনও চিন্তাকে, চিন্তা করে বার করে দিদির কাছে আসতে হবে। বিষ্টুপদর তো লজ্জায় দুকান লাল, শাশুড়িও মুখ টিপে হাসছিলেন, বিষ্টুপদ চলেই আসতেন, কিন্তু চিন্তা হল যদি কাল সকালে ঠির সময় অ্যালার্ম না বাজে তাহলে অফিস কামাই হয়ে যাবে, সুলতা তো এখানে, তার চেয়ে কাল অফিস থেকে ফেরার সময় সুলতাকে নিয়েই একেবারে বাড়ি ফিরবেন। সেদিন রাতে সুলতাও ঘরের দরজা বন্ধ করার পরে খিলখিলিয়ে হেসে বলে কিনা, এই যে অত হ্যাংলামো ভালো নয়। বিষ্টুপদর চিন্তা নিয়ে যদি ওর বিন্দুমাত্র চিন্তাও থাকতো!

আগের রোববার দুলাল সামন্তর মুদির দোকান থেকে সওদা করে ফেরার সময় হঠাৎ চিন্তা করলেন, দুলাল যখন মাল মাপছিল, তখন তার ভুঁড়ির ওপর লুঙ্গিটা যেভাবে বিপজ্জনক সীমায় ঝুলছিল তাতে যেকোনও সময় খুলে গিয়ে একটা কেলেঙ্কারি হয়ে যেতে পারে, আর দুলালের দোকানে তখন দাঁড়িয়ে আছে বিষ্টুপদর ওপরের ফ্ল্যাটের সান্ন্যাল বউদি, বিষ্টুপদ তাই দুলালকে সাবধান করে দিতে ফিরলেন, দোকানের কাছাকাছি এসে সান্ন্যাল বৌদির স্লিভলেস বাহু যুগলে দৃষ্টিবিদ্ধ হয়েও ঠিক সময়ে বিষ্টুপদ সম্বিত ফিরে পেলেন। দুলাল সামন্ত গতমাসের সাতশো টাকা তার কাছে পায়, এখন লুঙ্গির সীমারেখা টানার  কথা বলতে গেলে ওর যদি সেকথা মনে পড়ে যায়, তবে সেটা খুব চিন্তার কথা, তাই অবাধ্য দৃষ্টি পথকে সান্ন্যাল বৌদির স্লীভলেসের লাইন অফ কন্ট্রোল থেকে নো ম্যানস ল্যান্ডে এনে ফেলে বাড়ির পথ ধরলেন। অনেক চিন্তার ভিড়ে বিষ্টুপদ এতদিন আসলে খেয়াল করেননি, দুলাল সামন্ত গত দশ বছর ধরেই অমীমাংসিত কাশ্মীর সমস্যার মতো লুঙ্গির কষি বিপজ্জনক সীমারেখায় ঝুলিয়ে রেখে দিব্যি দোকান চালিয়ে যাচ্ছে। পরে বিষ্টুপদ চিন্তায় পড়লেন তিনি কি সেদিন সত্যিই দুলাল সামন্তকে সাবধান করতে গেছিলেন না এ নেহাতই তার বৌদি বিলাসী অভিযান!  চিন্তার এই বিপথগামীতায় রীতিমতন বিব্রত বিষ্টুপদ কোনও সিদ্ধান্তে আসতে পারেননি, তবে চিন্তা করছেন যদি সান্ন্যাল বৌদির মসৃণ দ্বিভুজের তটরেখা থেকে চিন্তার গতিপথকে দুলাল সামন্তর মধ্যপ্রদেশের উপত্যকায় নিয়ে আসতে পারেন, সুবিধা করতে পারছেন না।

আজ সকালে বিষ্টুপদর অফিসে আসার পরে কোনও চিন্তার অবকাশের আগেই বেয়ারা দিলীপ এসে জানালো, তাকে বড়বাবু ডাকছেন। শেষ কবে বড়বাবুর ঘরে তার তলব পড়েছিল তা বিষ্টুপদ মনে করতে পারলেন না। বড়বাবু সুশীল ধাড়া সরকারি অফিসের বড়বাবুদের তুলনায় বেজায় রাশভারী মানুষ, বিষ্টুপদও তাকে এড়িয়েই চলেন। বিষ্টুপদ ঘরে ঢোকার পর বড়বাবু একটা ফাইল তার দিকে এগিয়ে দিলেন, বললেন দেখুন তো হাজরাবাবু ফাইলটা চিনতে পারেন কিনা? বিষ্টুপদ চিনলেন, মাস খানেক ধরে গোলাপী ফাইলটা তার টেবিলে পড়েছিল বটে, খুলে দেখার অবকাশ পাননি, মানে তার চিন্তার রাডারে সেরকম কোনও সংকেত পাননি আর কি। বড়বাবু বললেন এটার রিপোর্ট তো আপনারই তৈরি করবার কথা, তাই না? আর চীফ সেক্রেটারির দফতরে রিপোর্টটা পাঠানোর কথা কালকে, তাই কালকে সকালের মধ্যে রিপোর্টটা আমার চাই। রাত জেগে করবেন, না যাদুমন্ত্রবলে করবেন সেটা আপনি জানেন। এখন যান কাজ শুরু করুন। বিষ্টুপদ নিজের টেবিলে ফিরতে ফিরতে লক্ষ্য করলেন সুরজিত, শ্যামল, সুবীর, অমিতরা যথারীতি কোণের দিকের টেবিলটায় গোল হয়ে বসে হল্লা করছে, সব কটার টেবিলেই ফাইলের পাহাড়, কিন্তু ওদের তাতে হেলদোল নেই। বিষ্টুপদর চিন্তা হল, তার কোনও দল নেই বলেই বড়বাবু তাকে বেকায়দায় ফেললেন। ওদের তিনি এত সহজে কব্জা করতে পারতেন না, ভাবলেন ঝামেলাটা মিটলে একটু মেলামেশা শুরু করলে হয়। তারপর জলটল খেয়ে ফাইলটা খুলে বসলেন, রিপোর্টটা কোথা থেকে শুরু করবেন ভাবতে ভাবতেই চিন্তাটা এল, যদি তিনি রিপোর্টটা শেষ করতে না পারেন তাহলে কী হবে? সাসপেন্ড হবেন কি? প্রোমোশন আটকে যাবে? অতটা হবে না বোধহয়। নাকি দূরে কোথাও বদলি হতে পারে? হলে যাতায়াতের খুব অসুবিধা হবে বটে, অনেক সময় লাগবে, খরচাও হবে বেশি। আচ্ছা যেখানে বদলি করবে সেখানেই যদি বাসা ভাড়া করে উঠে যাওয়া যায় তবে তো ঝামেলা নেই, এখানেও তো ভাড়া করা ফ্ল্যাটেই থাকেন। ওখানেই ছেলে বিল্টুকে স্কুলে ভর্তি করে দেবেন, সবে তো ওর চার বছর বয়স, অসুবিধা হবে না। সেই ভালো হবে, সুশীল ধাড়ার মেজাজ তো দেখতে হবে না। চিন্তা করেন, বিষ্টুপদ চিন্তা করতেই থাকেন, অফিস ছুটির সময় হয়ে আসে রিপোর্টিং এর কাজ এক বিন্দু এগোয় না, বিষ্টুপদ বসে বসে চিন্তা করতে থাকেন।

পরমার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়। জন্ম ও বাস ভারতের পশ্চিমবঙ্গরাজ্যের কলকাতায়।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ