বুকক্যাফে ও আর্ট থেরাপি

মঈনুস সুলতান
ভ্রমণ
Bengali
বুকক্যাফে ও আর্ট থেরাপি

জিম্বাবুয়ের হারারে শহরে আসলেই বুকক্যাফেতে এক চক্কর ঢুঁ মারা খানিকটা নিয়মের মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিষয়টি অনেকটা বোলপুরে বেড়াতে গেলে শান্তি নিকেতনে যাওয়ার মতো। সেন্সার মুক্ত প্রতিবেশের জন্য আর্ট-লাভারদের বৃন্দাবন বলে ক্যাফেটির আফ্রিকার তামাম দক্ষিণাঞ্চল জুড়ে পরিচিতি আছে। এখানকার খোলামেলা কফি পানের চত্তরে হামেশা লেগে থাকে গ্রন্থ প্রকাশনা উৎসব, কবিতাপাঠ বা প্রতিবাদি হিপহপের জলসা। এখানে আড্ডারতবস্থায় দেশকালপাত্র ভেদে অনায়াসে মোলাকাত হয়ে যায়, আফ্রিকার যশস্বী সব কবি, ছন্নছাড়া হিপি পর্যটক, নেশাসক্ত চিত্রকর বা বিভ্রান্ত সব এইড্ ওয়ার্কারদের সাথে। আমি এ ক্যাফেতে এ নিয়ে চৌদ্ধ বারের মতো আসলাম। সিঁড়ি বেয়ে দোতালায় উঠে কোথাও কাউন্টার কালচারের কোন সমজদারকে দেখতে না পেয়ে একটু অবাক হই। বুকক্যাফেতে ইন্টারনেটের ওয়ারলেস্ সংযোগ আছে, তাই আমি এখানে এসেছি  একটি লেখা দ্রুত ডিসপ্যাচ্ করবো বলে।

আমি যুক্তরাষ্ট্রের অখ্যাত একটি মফস্বলী পত্রিকায় জিম্ববুয়ে জার্নাল বলে অনিয়মিত কলাম লিখছি, লেখাটি না পাঠালেই নয়; তাই ক্যাফের যেদিকে বুকস্টোর ও অফিস সেদিকে অগ্রসর হই। বুকস্টোরের দরোজায় ঝুলছে পেল্লায় একটি তালা, তার চাবির ছিদ্র গালা দিয়ে সিল মেরে- পাশে গঁদ দিয়ে আটকানো কাগজে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের গ্রন্থ বিক্রি নিষেধের হুকুমনামা। খানিক থতমত খেয়ে ক্যাফের যে দিকে পানাহার ও অনুষ্ঠান মাইফেলের আসর বসে, সে দিকে পা বাড়াই। চেয়ারগুলো জনহীন, টেবিলে রাখা আধ-খাওয়া সব কফির কাপের দিকে তাকিয়ে মনে হয়, একটু আগেও এখানে জমজমাট আড্ডা চলছিলো। আমি বেশ খানিকটা পথ রোদে পুড়ে এসেছি, তাই খাজুল হয়ে একটি চেয়ারে জিরাতে বসি।

বুকক্যাফের সাইনবোর্ড

বুকক্যাফেতে আমি যখন প্রথমবার আসি, সে বছর দেড়েক আগের কথা, ইমাজিন আফ্রিকা বলে ঠিক এই জায়গায় চলমান একটি মাইফেলে মিশে যেতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয়নি। পেটিন গাপপা নামের তরুণী এক লেখিকা তাঁর ছোটগল্প অভিনয় করছিলেন। লেখিকাটি বেজায় লোকপ্রিয়, তিনি মতপ্রকাশের স্বধীনতার বিষয়ে একটু ইশারা দিতেই, স্পাইডারওয়েব গোষ্ঠির লেখক-কুল ঠোঁটে সেলাই আঁকা মুখোশ পরে উলুধ্বনি দিয়ে মাইফেল একদম জমিয়ে দিয়েছিলেন। পরের অঙ্কে লেখিকা তাঁর নদীজলবঙ্কিম দেহে শরীরী ভালোবাসার অনুসঙ্গ ফোটালে, জেমস্ মুজুরু বলে হারারের এক হিপহপ কবি এ্যয়সা জোশকাতর হয়ে পড়েন যে, তিনি  দু’মুটো কনডম হরিলুটের বাতাসার মতো ছিটিয়ে- এইডস্ আক্রান্ত এদেশে বস্তুটি রক্ষাকবচের মতো প্রয়োজনীয় অঙ্গে ধারণ করতে এ্যপিল জানান।

বুকক্যাফে এবার রবার্ট মুগাবে সরকারের নেকনজরে (!) পড়েছে, সুতরাং আজ এ জাতীয় কোন জলসার সম্ভাবনা একেবারেই নেই, তারপরও হারারে শহরে এ ভরদুপুরে যাই কোথায়? একটু আগে রবার্ট মুগাবের সমর্থক জানুপিএফ দল বিরোধী দলীয় প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী মরগান চেংগারাইয়ের মুভমেন্ট ফর ডেমোক্রেটিক চেঞ্জ দলের সদস্যদের ধাওয়া করে ডান্ডা পেটা করেছে, এ হালতে তো ঠান্ডা মাথায় বাইরে যাওয়া ঠিক না। তাই এখানে বসেই জিম্বাবুয়ে জার্নালের ড্রাফটে বুকক্যাফে বন্ধ হওয়ার সংবাদটি যুক্ত করি। বিষয়টি বর্ণনা করতে গিয়ে মাস ছ’য়েক আগে এখানকার আরেকটি জলসার কথা মনে আসে। পয়েট্রি স্ল্যাম বলে একটি বৈকালিক অনুষ্ঠানে আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলের অত্যন্ত মশহুর কবি জুলিয়াস চিংগানো কবিতা পড়ছিলেন। জিম্বাবুয়েতে কেবলমাত্র বইপত্র বাজেয়াপ্ত হতে শুরু হয়েছে। চিংগানোর একটি বই ছাপাখানায় আটক করা হলে তিনি হাতে লেখা ড্রাফট নিয়ে পয়েট্রি স্ল্যামের জলসায় হাজির হন। সময়টা ছিল সরকারি নেকনজরে তার চাকুরীচ্যূতির চতূর্থ মাস। তার উপর বয়োবৃদ্ধ এ কবি দাঁতের ইনফেকশনে কষ্ঠ পাচ্ছিলেন সপ্তাহ তিনেক ধরে। মাইক্রোফোন হাতে তাঁর চোখমুখের এক্সপ্রেশন দেখে মনে হচ্ছিলো, তিনি তাবৎ সংসারের উপর বেজায় বিলা হয়ে আছেন। কবিতাকে ইকুয়িপমেন্ট ফর লিভিং বা বেঁচে থাকার হাতিয়ার হিসাবে অভিহিত করে তিনি তাঁর পান্ডুলিপি পৃষ্টাওয়ারী বিক্রির প্রস্তাব দেন। তারপর একটি পৃষ্টা ছিড়ে বলেন, “হারারেতে হাল জামানায় বিক্রি হচ্ছে না কি? এখানেতো হররোজ বিক্রি হচ্ছে জাতায় মিহি করে পেষা যব, বাটিকের চিত্রিত বস্ত্র, পাহাড়ে প্রচ্ছন্ন খনিজ দ্রব্য, সাপের মতো ফুস্ করে ওঠা সোডাজল, সোওণা যুবতীর হৃৎপিন্ড স্পর্শী অর্ন্তবাস থেকে মায় গন্ডারের অন্ডকোষ অব্দি, আমার কবিতাইবা এ মুদ্রাস্ফিতির বাজারে বিক্রি হবে না কেন?” তাঁর উদ্যোগে কাজ হয়েছিল, মিনিট পনেরোর মধ্যে নানা দামে বিক্রি হয়ে গিয়েছিল পান্ডুলিপির তেপান্নটি ছিন্ন পৃষ্ঠা।

বুকক্যাফেতে হিপহপের জলসা

আমার পাশের টেবিলে এক জোড়া চড়ুই পালা করে রুটির ভাঙ্গা টুকরা খুঁটছে। তাদের পাখার জাপটানিতে উল্টে পড়ে একটি পেয়ালা। ঠিক তখনই মিহি সুরে ক্লারিওনেটের বাদ্য ভেসে আসে। বাজনাটি ভেঙ্গে ভেঙ্গে স্রোতে ভেসে যাওয়া বাসি ফুলের তোড়ার মতো খাবি খায়। আমি আচমকা এক আচানক সুরধ্বনির উৎসের সন্ধানে এদিক ওদিক তাকাই। কিচেনের দরোজায় ঠুকঠুক করে আওয়াজ হয়, তারপর দুয়ারটি খানিক ফাঁক হতেই আমি ভেতরে বুকক্যাফের মালিক, একাধিক গ্রন্থের রচয়িতা, নামজাদা বাদক পল ব্রিকোলকে দেখতে পাই। পল আমাকে ভেতরে আসতে ইশারা দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলেন,‘বুকস্টোর ও ক্যাফের অনুষ্ঠানাধির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি হলেও ট্যাকনিকেলি কফি বিক্রিতে কোন আইনানুগ সমস্যা নেই।’ আমি কিচেন কাউন্টারের অগোছালো বাসনকোসন, ভাঙ্গা পেয়ালা-পিরিচ, ও ছত্রখান সব বিস্কিট, শশা, লেটুসপাতা ও ক্যাচাপের ভাঙ্গা বোতলের দিকে তাকিয়ে জানতে চাই, রান্নাঘরে উত্তপ্ত কোন পাঠার আগমণ হয়েছিল কিনা? পল ক্লারিওনেটকে শানানো অস্ত্রের মতো উর্দ্ধে তুলে বলেন,‘দিস ইজ অ্যা গুড ওয়ান, আই হ্যাভ টু রিমেম্বার দিস্। ওয়েল ওয়েল, ঘটনা হলো- কফির দোকান এখনই খোলা যাচ্ছে না। পুলিশ চিনির বয়াম, কফির জার ইত্যাদি নিয়ে গেছে ফরেনসিক টেস্ট করে দেখবে এগুলোতে কোন ড্রাগস্ আছে কিনা?’ এ পর্যন্ত বলে পল হাতল টেনে দেয়ালে বসানো আলমারির দরোজা খুললে, আমি তার পিছু পিছু শৌখিন গোয়েন্দার মতো গুপ্ত পথ ধরে চলে আসি অন্য একটি আধো অন্ধকার প্রশস্ত কামরায়।

এখানে আছে তিরাশি বছরের পুরানো একটি অকেজো প্রিন্টিং প্রেস। জিম্বাবুয়েতে যখন শ্বেতাঙ্গ শাসনের বিরুদ্ধে চলছিলো মুক্তির লড়াই, তখন এ প্রেস থেকে গ্রাসরুটস্ প্রকাশনীর শিরোনামে প্রকাশিত হতো গুপ্ত ইশতেহার ও পত্র-পুস্তক। ছাপা মেশিনের কাছের টেবিলে মোম জ্বালিয়ে ল্যাপটপ কম্পিউটারে কাজ করছেন কবি ফজিলা মাখোছানি। ফজিলার দেহে কালো রক্তের মিশ্রণ আছে বটে, তারপরও এ অল্প বয়সী তরুণী তার পূর্বপুরুষরা যে আফগানিস্তান থেকে সে আমলের রোডেশিয়ায় (বর্তমানের জিম্বাবুয়ে) হিজরত করেছিলেন, সে কথা ভেবে চুলে সর্বদা জড়িয়ে রাখে পার্পোল বর্ণের স্কার্ফ। বর্তমানে ফজিলা জিম্বাবুয়েতে নিষিদ্ধ মিডিয়া ভয়েস অব আমেরিকার গুপ্ত সংবাদিক। একটু দূরে টুলে বসে মলিছা ব্লেয়ার কুরুশ কাঁটায় বুনে চলে সুয়েটার। যুক্তরাষ্ট্রের মেয়ে মলিছা ও আমি সপ্তাহ খানেক আগে একত্রে বর্ডার ক্রস করে জিম্বাবুয়েতে এসেছি। মলিছা বস্টনের একটি কাগজের আফ্রিকা কলামে ফিচার লিখে। সে যে স্টোরীর সন্ধানে হারারেতে এসেছে, তা গোপন রাখার জন্য ট্যুর কোম্পানির মনোগ্রাম আঁকা টিসার্ট পরে, উল বুনে, চুয়িঙগাম চিবিয়ে সর্বদা পর্যটক সেজে আছে। তার পাশে বসে প্রটেস্ট পয়েট বলে পরিচিত স্যাম মনরো ইরিনমোরের কোটা থেকে বিস্তর পট বের করে খুব গুছিয়ে জয়েন্ট তৈরী করেন। স্যাম সম্প্রতি ফ্রিডম অব এক্সপ্রেশনের উপর প্যারোডী করে বই লিখেছেন। আমি তার একটি কপি চাইলে তিনি নিচু হয়ে তার নেড়া মাথা দেখান। দিন চারেক আগে বুকক্যাফের পয়েট্রি স্ল্যামে তিনি বাছা একটি প্যারোডী পাঠ করার সময় জানুপিএফে’র সশস্ত্র সাঙঘাতরা তাকে পডিয়াম থেকে চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে গিয়ে আচ্ছাসে পেটায়। তিনি রলিং পেপারের প্রান্তে লালা লাগিয়ে তা রোল করতে করতে বলেন, ‘ইয়েস, উই হ্যাভ ফ্রিডম অব এক্সপ্রেশন, বাট ইউ সি হোয়াট হেপেন্ড আফটার আই এক্সপ্রেসড।’ আমি তার নেড়া মাথার দগদগে কাটা দাগে জিপারের মতো সূক্ষ সেলাই দেখি। মলিছা ফজিলাকে আজকের দিনের সংবাদের সামারি পড়ে শোনাতে বলে। ফজিলা কম্পিউটারের স্ক্রিন থেকে পড়ে,“ হিউম্যান রাইটস্ ওয়াচের বরাত থেকে জানা যাচ্ছে যে- এ অব্দি মুভমেন্ট ফর ডেমোক্রেটিক চেঞ্জ নামক বিরোধী দলের কর্মী ও নেতা মিলিয়ে হত্যা করা হয়েছে মোট পয়ষট্টি জন জিম্বাবুয়ানকে। হারারের ডক্টরস্ এ্যসোসিয়েশন সম্প্রতি তিন হাজার আহত মানুষদের চিকিৎসা করার সংবাদ জানাচ্ছে। গতকাল মহোনডরো এলাকার এক মহিলার হাত-পা কেটে ফেলে তার বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। মহিলার মৃত্যু হয় হাসপাতালে নেয়ার পথে। বহেরা জেলায় যেখানে মুভমেন্ট ফর ডেমোক্রেটিক চেঞ্জের নেতা মরগান চেংগারাইয়ের পৈতৃক বাড়ি, সেখানে তার গ্রামটি ঘিরে ফেলে তার চার তরুণী আত্মিয়াকে ট্রাকে তুলে নিয়ে করা হয়েছে গ্যাং রেপ।”

সেইফহোমে বাস্তুহারা শিশু

রাজপথ থেকে উপুর্যপরি শ্লোগান ও টিয়ার গ্যাসের শেল ফাটার শব্দ ভেসে আসে। কোথায় যেন সাইরেন বাজিয়ে ছুটে যায় দমকলের একটি ট্রাক। পল হাতে ক্লারিওনেট তুলে নেন। তার বাদ্যে পাথরে আটকে পড়া স্রোতে বাসি ফুলের তোড়াটি কেবলই ঘুরপাক খায়। সাম মনরো জয়েন্ট ধরান। ধূম্রশলাকাটি হাতে হাতে ঘোরে। আমি ধোঁয়ার রিঙয়ের ভিতর দিয়ে দেখি পল রোমের বাদশাহ নিরোর মতো ক্রমাগত বাজিয়ে চলেছেন তার হাতের সোনালী বাদ্যযন্ত্রটি। মলিছা কষে দম দিয়ে কাসে। তারপর হতাশ মুখভঙ্গি করে ফজিলার দিকে কুরুশকাঁটা ঝাঁকিয়ে বলে,‘তুমি যা সামারি করেছো, বিবিসি, সিএনএন সবাই তা কভার করবে। আই অ্যাম অ্যা ফিচার রাইটার,আমার প্রয়োজন হিউম্যান ইন্টারেস্ট স্টোরী, আই ডোন্ট নো হোয়ার দ্যা হেল উইল আই ফাইন্ড ওয়ান’, বলেই বাচ্চরা যেরকম কাঙ্খিত খেলনা না পেলে খেপে যায়, সেরকম রেগে গিয়ে ‘শিট’ বলে ছুড়ে ফেলে উলের বল ও কাঁটা। পল ক্লরিওনেট রেখে ফ্লোর থেকে উলের বল তুলে তা প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে মলিছাকে বলেন,‘ওয়েল গার্ল, তোমার একটি অনুষ্ঠানে যাওয়া চাই, যা নিয়ে তুমি ফিচার স্টোরী করতে পারবে। ইজ দ্যাট রাইট?’ মলিছা ঘাড় কাত করে সায় দিলে তিনি বলেন,‘বুকক্যাফে আন্ডারগ্রাউন্ডে কিছু অনুষ্ঠান স্পনসর করছে। আজ বিকালে ভায়লেন্সে ঘরবাড়ি থেকে উৎখাত হওয়া বাচ্চাদের আর্ট প্রজেক্ট হচ্ছে, এগুলোতে খরচ আছে, মেয়ে- তুমি ডলারে কনট্রিবিউট্ করতে রাজি থাকলে আমি এখনই কানেক্ট করিয়ে দেবো।’

বাস্তুহারা শিশুদের অংকন

পলের হাতে গুনে গুনে বেশ কিছু মার্কিন ডলারের চাঁদা ধরিয়ে দিয়ে ঠিকানা হাতে আমি, ফজিলা ও মলিছা সাবধানে রাজপথে নামি। জবসন্স ভিলা বলে গেটে বন্দুকধারী সিকিউরিটি গার্ডওয়ালা চকমিলান ম্যানশনটিতে আগেও একবার এসেছি। হারারের বিখ্যাত শ্বেতাঙ্গ ফার্মার ডেভিড জবসন রাজনৈতিক পালাবদলে তার তেরো হাজার একরের খামার খুঁইয়ে দেশান্তরী হলে, ভারতীয় বংশোদ্ভূত বণিক লছমন কুমার খার অত্যন্ত অল্প পয়সায় জবসন সাহেবের মোটরকারের ডিলারশীপ সহ এ ভিলাটি ক্রয় করে নেন। হারারের বোদ্ধা মহলে খার দম্পতির সুনাম আছে। এ শহরে গ্রন্থমেলা হলে তারা লেখক বাবদে শুদ্র-ভদ্র বিবেচনা না করে, হাজার খানেক বই কিনে তা ঠেলাগাড়ি দিয়ে নানা লাইব্রেরীতে ডনেশন হিসাবে পাঠান। মাঝে সাঝে বুকক্যাফেতেও তাদের দেখা যায়, লছমন কুমারজী বসে আছেন তার শাড়ী পরা স্ত্রী ফাতেমা খারের সাথে। ফাতেমার কবি খ্যাতি আছে। তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা তিন। বইগুলোতে রেশমের বুকমার্কারের সাথে স্পষ্টাক্ষরে লেখা আছে- ফর প্রাইভেট সার্কোলেশন অনলি, অর্থাৎ পয়সা হলেই এ কিতাবগুলো কিনতে পাওয়া যায় না, তবে সমঝদার হিসাবে খানিক খ্যাতি থাকলে- ফাতেমা খার পাঠককে বাড়িতে ডেকে এনে, ব্র্যান্ডি ও চিজ-কিউবে আপ্যায়িত করে, সই করে মাগনা এক কপি দেবেনই। আমি এদের ভিলাতে আসি গেল দেয়ালীর দিন সন্ধ্যেবেলা। ফাতেমা অভ্যাগত সব কবি ও চিত্রকরদের ভোদকা মেশানো লাচ্ছি খাইয়ে, তাদের সাম্প্রতিক লেখাজোখা ও আঁকার খোঁজ-খবর নিচ্ছিলেন।

আমাদের জবসন্স ভিলার রিসেপশন লাউঞ্জে খানিক্ষণ বসে থাকতে হয়। কক্ষটির দেয়াল ক্যাবিনেটে অনেকগুলো এ্যন্টিক মোটরকারের ছোট্ট ছোট্ট মডেল। আমি দেয়ালে ষোড়শ বর্ষীয়া প্রিন্সেস এলিজাবেথের তৈলচিত্রের দিকে তাকিয়ে ভাবি, বিলাতের বয়োবৃদ্ধা রানী ঠিক কত বছর আগে ষোড়শী রাজকুমারী ছিলেন? মলিছা এখানে আগে কখনো আসেনি, তাই ফজিলা তাকে ফিসফিসিয়ে বলে-জানুপিএফ দলের বেশ ক’জন মন্ত্রী-মিনিস্টারকে লছমন কুমার খারের নুতন গাড়ি গিফ্ট দেয়ার গল্প। তিনি অবশ্য বিরোধী দলের নির্বাচনী পোস্টার ছেপে দিয়ে আজকাল ভারসাম্য রক্ষা করছেন। একজন পরিচারিকা ট্রলিতে করে নিয়ে আসে দারুচিনি ও এলাচ দেয়া চায়ের সাথে কুড়মুড়ে চানাচুর। তার পেছন পেছন মহিসুরি সিল্কের লোকাট ঈভিনিং গাউন পরে কামরায় ঢুকেন ফাতেমা খার। তার শরীর থেকে চন্দনের সুগন্ধ ছড়ায়। তিনি অত্যন্ত ধীরে-সুস্থে হোল্ডারে সিগ্রেট ধরিয়ে, আমার সাথে আফগান বংশোদ্ভূত আমেরিকান লেখক খালিদ হোসেইনির কাইটরানার নামক বইয়ের বেস্টসেলার হাওয়ার প্রসংগ নিয়ে লম্বাচওড়া আলাপ জুড়ে দেন। মলিছা স্পষ্টত অধৈয্য হয়। স্ক্রীনে ছায়াছবি আসতে দেরি হলে দর্শকরা যে রকম অস্থির হয়ে পড়ে, চোখেমুখে এ রকম অভিব্যক্তি ফুটিয়ে সে বলে,‘উই আর হিয়ার ফর চিলড্রেনস আর্ট প্রজেক্ট।’ ফাতেমা উঠে পড়ে আমাদের নিয়ে ভিলার ভেতরের অঙ্গিনায় চলে আসেন। টেনিসকোর্টের মাঝ বরাবরে হেঁটে যেতে যেতে তিনি বলেন,“এখানে যে এসব হচ্ছে প্লিজ কাউকে বলবে না। নিশ্চয় জানো, জিম্বাবুয়ের গ্রামে গ্রামে বিস্তর ভায়োলেন্স হচ্ছে। গৃহচ্যুত হয়েছে বেশুমার মানুষ, তাদের কেউবা এসেছে শহরে, কেউবা চলে যাচ্ছে সীমান্তে দিকে। বেধড়ক মারধরে হাজার হাজার শিশু বিচ্ছিন্ন হয়েছে তাদের মা-বাবার কাছ থেকে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়েছে, তিন দিন আগে তাবৎ এইড্ এজেন্সির ত্রাণ কাজ বাতিল ঘোষণা করলে। আমরা এখানে বাচ্চাদের জন্য একটি সেইফ-হোম তৈরী করেছি। এ কাজগুলোও করতে হচ্ছে গোপনে। এ পরিস্থিতিতে আমাদের রাজনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই; তাই আজ আমি লছমনজিকে পাঠিয়েছি জাস্টিজ মিনিস্টার প্যাট্রিক চিনাউসার সাথে গল্ফ খেলতে।”

সুইমিংপুলের পেছনবাগে যেখানে একসময় ভিলার কর্মচারীদের থাকার জন্য স্টাফ-কোয়ার্টার ছিল, সেখানে এ্যানি বিডওয়েল নামে বিলাতের এক ভলানটিয়ার সেইফ-হোমটির দেখভাল করেছেন। ফাতেমা আমাদের এ্যানির সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। এ্যানি মেরী নোয়েল বলে একটি খ্রিষ্টান মিশনারী সংস্থার সাথে যুক্ত আছেন। জিম্বাবুয়েতে তিনি এসেছেন মাত্র মাস তিনেক হলো। এর আগে সুদানের দারফুরে তিনি বাস্তুহারা শিশুদের সাথে কাজ করেছেন। আর্ট থেরাপিতে অত্যন্ত দক্ষ এ মহিলা তার বুকে ক্রুশ চিহ্ন এঁকে আমাদের ডলারে কন্ট্রিবিউট করার জন্য বারবার ধন্যবাদ জানান। তিনি বিনীতভাবে বলেন,‘খার ফ্যামিলি অনেক করেছে, কিন্তু আমাদের সকলের এ কাজে হাত লাগানো দরকার, ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড’, বলে তিনি আমাদের তার সংস্থার ব্যাংকের একাউন্ট নাম্বার লেখা কয়েকটি কার্ড দেন। তার অনুরোধ-আমরা যদি সদ্য বাস্তুহারা শিশুদের জন্য জানাশোনা বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে কিছু ডনেশন জোগাড় করে দিতে পারি। আমরা যখন এ্যানির সাথে কথা বলছিলাম, ঠিক তখন চৌদ্ধ-পনেরো বছরের কৃষ্ণাঙ্গি এক মেয়ে ছুটে এসে মলিছাকে জড়িয়ে ধরে বলে,‘আই অ্যাম সো গ্ল্যাড ইউ কেইম, কাম উইথ মি, আই উইল ড্যান্স ফর ইউ।’ মলিছা স্পষ্টত বিব্রত হয়। এ্যানি তাকে টেনে মলিছার আলিঙ্গন মুক্ত করে বলেন,‘ প্লিজ গো দেয়ার এন্ড ফিনিস ইয়োর ড্রয়িং।’ অনিচ্ছুক মেয়েটি ফিরে যেতে যেতে বারবার মলিছার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে। এ্যানি আমাদের জনান্তিকে বলেন, ‘মেয়েটি রেপ ভিকটিম। এর চিকিৎসার জন্য আামাদের প্রয়োজন একজন সাইক্রিয়াট্রিষ্ট।’

স্টাফ-কোয়ার্টারের সেইফ-হোমে ঢুকার আগে এ্যানি আমাদের আর্ট থেরাপির বিষয়টি বুঝিয়ে বলেন। মানসিক আঘাতে মানুষ যখন নির্বাক হয়ে যায়, কিংবা তাদের মনে আতঙ্ক এতোই প্রবল যে, তারা তাদের দুশ্চিন্তা বা উদ্বেগ নিয়ে কারো সাথে কথা বলতে চায় না, তখন তাদের ছবি এঁকে মনোভাব প্রকাশ করতে উৎসাহিত করা হয়। এক্ষেত্রে দক্ষ আঁকিয়ে হওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। মানসিক রোগের চিকিৎকরা হাল জামানায় এ পদ্ধতি দুনিয়া জুড়ে ব্যবহার করছেন। কিন্তু এ সেইফ-হোমে একটি সমস্যা দেখা দিয়েছে, এখানে সদ্য আগত কিছু বাচ্চা আতঙ্কে এমন নির্বাক হয়ে আছে যে, তারা ক্রেয়ন কিংবা রঙতুলি হাতে নিতেই চাচ্ছে না। এ্যানি আমাদের কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে নিজেদের শিশু সন্তান বা আত্মীয়দের বাচ্চার কথা ভাবতে বলেন। আমরা চোখ বন্ধ করলে, তিনি বিড়বিড় করে পাঠ করেন বাইবেলের স্তোত্র।

অবশেষে আমরা একটি কামরার জানালার পাশে এসে দাঁড়াই। ঘরের মেঝেতে বসে আছে পনেরো-ষোলটি বাচ্চা ছেলেমেয়ে। তারা আমাদের দিকে তাকায়। তাদের দৃষ্টি তীব্র, এবং তাতে ফুটে এমন এক গভীর অভিব্যক্তি, যা আমাদের হৃৎপিন্ডের নরোম মাসোলে কাঁটার মতো ফুটে। গতকাল বাচ্চাগুলোকে সেইফ-হোমে আনা হয়েছে। এদের অনেকেই রাতে বিছানায় না শুয়ে ফ্লোরে বসে কাটিয়েছে। একটি বাচ্চা কোলে নিয়ে বসে আছে ছোট্ট একটি তিফিল শিশুকে। সেইফ-হোমে এ মুহূর্তে আইসব্রেকার হিসাবে প্রয়োজন খেলাধূলার সামগ্রী, যাতে শিশুরা তাদের তুষার-তুহিন নীরবতা ভেঙ্গে খানিক সক্রিয় হতে পারে। মলিছা তাদের সাথে কথাবার্তা বলতে চাইলে এ্যানি বুকে ক্রুশ এঁকে বলে,‘নট ইয়েট, লেটস জাস্ট প্রে ফর দ্যা চিলড্রেন।’

পাশের কামরাতে আমরা বেশ ক’টি ছেলেমেয়েকে মেঝেতে পোস্টার-পেপার বিছিয়ে রঙ-তুলি দিয়ে ছবি আঁকতে দেখি। এ কামরার বাচ্চাগুলো সেইফ-হোমে আছে সপ্তাহ দুয়েক। তারা ইতোমধ্যে ভিন্ন পরিবেশের সাথে খানিক খাপ খাইয়ে নিয়েছে। এদের কারো কারো মা-বাবা রাজনৈতিক মতাদর্শের জন্য কারাগারে আছেন, কারো কারো পিতামাতা একেবারেই নিখোঁজ। একটি বাচ্চা তার পিতা-মাতাকে জোর করে ট্রাকে উঠানোর ছবি আঁকছে, সে চিত্রে একটি হাতকড়া জুড়ে দিতে গেলে বারবার তার রেখা এলোমেলো হয়। সে সুন্দরভাবে সুশারে বিষয়টি এঁকে উঠতে পারছে না বলে বিরক্ত হয়ে ছুড়ে ফেলে তুলি। এ্যানি তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে যান। ঠিক তখনই পাশের কামরা থেকে শ্লোগান উঠে,  ‘পামসেরী নি জানুপিএফ, অর্থাৎ জানুপিএফ এগিয়ে চলো’। আমরা বিষয়টি কি তা দেখার জন্য অন্য কামরায় আসলে দেখি, যে কিশোরীটি একটু আগে মলিছাকে জড়িয়ে ধরেছিল, সে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ক্রমাগত জানুপিএফ পার্টির স্বপক্ষে শ্লোগান দিচ্ছে। আমাদের দেখতে পেয়ে সে তারস্বরে শ্লোগান দেয়, ‘মুগাবে ভুচা আমবা ভুচতংগা নাকিছিংগাপেরী অর্থাৎ রবার্ট মুগাবে ক্ষমতায় থাকবেন চিরকাল।’ শ্লোগান দিতে দিতে মেয়েটি ছুটে এসে মলিছাকে জড়িয়ে ধরে বলে,‘কাম অন, লেটস সাউট শ্লোগান টুগেদার।’ এ্যানি এসে আবার মেয়েটিকে ছড়িয়ে নিতে গেলে সে মলিছাকে চোখ টিপে বলে,‘নেকস্ট টাইম ইউ ব্রিং সাম লিপস্টিক এন্ড মেকাপ ফর মি, আই উইল ড্যান্স।’ এ্যানি বিড় বিড় করে বলেন,‘ও ডিয়ার, পুওর গার্ল, আই হ্যাভ টু ফাইন্ড স্লিপিং পিল ফর ইউ।’

সেইফ-হোম ছেড়ে ভিলাতে ফেরার পথে ফাতেমা আমাদের জানান যে, তারা এখনো মেয়েটির পিতা-মাতার কোন সন্ধান বের করতে পারেননি। মেয়েটিকে জানুপিএফ সমর্থক মিলিশিয়ারা তাদের ক্যাম্পে আঁটকে রেখে তাদের স্বপক্ষে দিনের পর দিন শ্লোগান দিতে বাধ্য করে। মেয়েটি সেইফ-হোমে এসে বেশ কিছু ছবি এঁকেছে, তা থেকে মনে হয়, হোমরাচোমরা গোছের কারো সাথে তাকে সাজগোজ করিয়ে নাচতেও বাধ্য করা হয়।

বিদায় নেয়ার আগে আমরা জানতে চাই, ভিলাতে ইন্টারনেটের সংযোগ আছে কিনা। ফাতেমা আমাদের ছোট্ট একটি কামরাতে নিয়ে আসেন। কক্ষটির শেলফে রাখা অনেক ক্যাসেট ও এলপি রেকর্ড। বিটলস ও রোলিং স্টোনের রেকর্ডগুলোর পাশে ফ্রেমে বাঁধানো সোনালী চুলের দু’টি ব্লন্ড মেয়ের ছবি। ফাতেমা জানান,‘হোয়াইট ফার্মার ডেভিড জবসনের মেয়ে দুটি এ কামরায় গান শুনে সময় কাটাতো। আমরা ভিলাটি কিনেছি বটে, কিন্তু তাদের ফেলে যাওয়া ডেকোর কিছু বদলাইনি।’ আমি ও ফজিলা দুটি পুরানো মডেলের কম্পিউটার অন করি,আমাদের স্টোরী ডিসপ্যাচ করার জন্য। আমাদের পাশে মলিছা খিন্ন মুখে বসে থাকে। এক পর্যায়ে ফাতেমা কামরা থেকে বেরিয়ে গেলে সে বলে,‘ডার্ন, আই ডিডন্ট ইভেন টক উইথ দ্যা কিডস, হাউ অ্যাম আই গোনা পুট টুগেদার অ্যা স্টোরী?’ তার চোখমুখের এক্সপ্রেশন দেখে মনে হয়, জুতমতো ফিচার স্টোরীর মালমশলা না পাওয়ার দুঃখে এখনই সে উল ও কুরুশকাাঁটার খেলনা ছুড়ে ফেলে ফ্লোরে পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসবে।

মঈনুস সুলতানের জন্ম সিলেট জেলার ফুলবাড়ি গ্রামে। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভারসিটি অব ম্যাাসাচুসেটস থেকে আন্তর্জাতিক শিক্ষা বিষয়ে ডক্টরেট করেন। বছর পাঁচেক কাজ করেন লাওসে-একটি উন্নয়ন সংস্থার কান্ট্রি রিপ্রেজেনটেটিভ হিসাবে। খণ্ডকালীন অধ্যাপক ছিলেন ইউনিভারসিটি অব ম্যাসাচুসেটস্ এবং স্কুল অব হিউম্যান সার্ভিসেস এর। কন্সালটেন্ট...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

রে এলাম সিঙ্গিগ্রাম, কবি কাশীরামদাসের জন্মস্থান।

রে এলাম সিঙ্গিগ্রাম, কবি কাশীরামদাসের জন্মস্থান।

কবি কাশীরামদাসের জন্মস্থান পূর্ববর্ধমান জেলার সিঙ্গিগ্রামে বেড়াতে গেলাম।তাঁর জন্মভিটের ভগ্নাবশেষ দেখলাম।আমি,মিহির,রিমি,সোমা,রজত সকলে গ্রাম ঘুুুুরলাম। চারদিকে…..

শিশিরবিন্দু

শিশিরবিন্দু

ভ্রমণবিলাসী চারজন বেরিয়ে পরলাম ভ্রমণে। আমিও গেলাম।প্রথমে ওরা গেল মুকুটমণিপুর। সপ্তাহান্তে পিকনিক বা একদিনে ছুটিতে…..