সুমনদা ও মাসির কথা
সুমনদা বললেন,আমরা চারজন বন্ধু ভবরঞ্জন,অসীম,তারকেশ্বর ও আমি দীঘা বেড়াতে গেলাম কলকাতার ধর্মতলা থেকে বাস…..
মজিদুর রহমান সারারাত ঘুমোতে পারেননি।
অন্ধকার ঘরে চোখ বুজে পড়ে থেকেই ফজরের আযান কানে আসে। অন্যান্য ওয়াক্তের আযান ঢাকার কোলাহলের নীচে চাপা পড়ে। ফজরের ওয়াক্তেও সুনসান নিরবতা নেই, তবে যটুকু শব্দ থাকে তা ছাপিয়ে আযানের শব্দটাই শোনা যায়। মজিদুর রহমানের কাছে এটা শুধু ‘নামাজের জন্য এসো-নামাজের জন্য এসো, কল্যাণের জন্য এসো-কল্যাণের জন্য এসো’ মুয়াজ্জিনের এমন একটি আহ্বান নয়। এ আহ্বান তার দেহমনের এক প্রশান্তিদায়ক।
***
তিনি বিছানা ছেড়ে উঠলেন, আলো জালালেন।
ওয়াশরুমে গিয়ে ওযু করে এলেন। ফজরের নামাজ আদায় করে চেয়ারে বসে একটা কাগজ টেনে নিয়ে কিছু একটা লিখলেন। পাজামা পাঞ্জাবী পরে কাঁধে কাপড়ের ব্যাগটা ঝুলিয়ে নিলেন। আলনা থেকে খুঁজে বের করে নিলেন একটা লুঙ্গি, একটা গামছা এবং একটা গেঞ্জি। কব্জি থেকে হাত ঘড়িটা খুলে টেবিলে রাখলেন। মুঠোফোনটা ঘড়ির পাশে রাখলেন। অকারণেই বিছানায় গিয়ে বসলেন, সেখান থেকে উঠে সোফায় বসলেন তারপর উঠে দাঁড়িয়ে ঘরের চার দেয়ালে চোখ বোলালেন। বুকের কাছে হাতটা রেখে চেপে ধরলেন। অনেকদিন ধরে একটা ঠিকানা এখোনে লুকিয়ে রেখেছেন, আজ সে ঠিকানায় যাবেন। ঘরের বাতি নেভালেন। দরজা ভেতর থেকে লক করে বাইরে বেরিয়ে এলেন।
***
পূব আকাশটা তখন কেবল লালচে আভা ছড়াচ্ছে।
ঢাকার সকাল আরো আগেই হয়েছে। মজিদুর রহমান কতকাল পূব আকাশ লালচে দেখেননি তা তিনি বলতেও পারবেন না। আটতলা অ্যাপার্টমেন্টের চতুর্থতলায় তিনরুমের ফ্ল্যাট নামের কনডেম সেলে সকাল সন্ধ্যা বোঝার উপায় মসজিদের আযান আর দেয়াল গড়ির দেখানো সময়। চল্লিশবছর ঢাকা শহরে, তবে শুরুটা এখানে না। মিরপুরের কাজীপাড়ায় দু’কক্ষ বিশিষ্ট টিনসেডের বাসা দিয়ে শুরু। একডজন ভাড়া বাসা পাল্টিয়ে অবসরের আগে প্রতিজ্ঞা করে বসেন ‘টাকা পয়সাগুলো পেলে সব শেষ করে হলেও একটা ফ্ল্যাট কিনবেন’। স্ত্রী খুশি হলেও বড় মেয়েটা একদিন মন খারাপ করে সামনে এসে দাঁড়ায়।
বাবা, ফ্ল্যাট কেনার সিদ্ধান্ত কি চুড়ান্ত?
হুম।
ছোট উত্তরটা শুনেই মেয়েটা চলে যাচ্ছিল। মজিদুর রহমান হাতটা টেনে ধরেন
কেনরে মা?
না, সিদ্ধান্ত যখন চুড়ান্ত তখন…
তুই কিছু বলবি?
না তেমন কিছুনা।
তোর মা সারা জীবন স্বপ্ন দেখেছেন একটা বাড়ির।
মেয়েটা বাস্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলে
ওটাতো সব মেয়েরই স্বপ্ন থাকে।
তোর মায়ের কোন স্বপ্নই তো আর পূরণ করতে পারলাম না, এটা না হয় করেই ফেললাম। তাছাড়া একের পর এক বাসা পাল্টিয়ে আমি ক্লান্ত। এরপরেও যখন বাড়িওয়ালার ভাড়া বাড়ানোর কথা মনে হয় তখন রক্তচাপটা বেড়ে যায়।
সব ঠিক আছে বাবা, কিন্তু খেয়ে পরে বাঁচতে হবে। আমাদের মানে আমার কথা রুবির কথা সাহানের কথা তোমাকে ভাবতে হবে।
মজিদুর রহমানের হাসি হাসি মুখটা হঠাৎ করেই ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত বহতল ভবনের মতো হয়ে যায়। অস্ফুট কণ্ঠে বলে
ভাবতে ভাবতেই চল্লিশ বছর কাটালাম মা, আর ভাবতে ইচ্ছে করেনা। যা হবার তাই হবে।
***
ট্রেনস্টেশনে থামতেই নেমে পড়েন মজিদুর রহমান। এটা তার গাঁয়ের পাশের স্টেশন ভাবতেই পারছেন না। যখন গাঁ ছেড়ে গিয়েছিলেন তখন ট্রেন ছাড়া বিকল্প কিছু ছিলনা। এখন দিবা-নৈশ মিলিয়ে বরোটা কোচ। ট্রেন তিনটা, এরমধ্যে দুটোই আন্তঃনগর।
***
প্ল্যাটফর্ম থেকে বাইরে এসে মজিদুর রহমান খুঁজছেন তার গাঁয়ে যাওয়ার রাস্তাটা। প্ল্যাটফরমের বাইরে পশ্চিম দিকে সোজা আইলের মতো একটা রাস্তা ছিল, সেটাই তার গাঁ পর্যন্ত গেছে। এখন প্ল্যাটফরমের বাইরে এমন কোন রাস্তাই নেই। তিনি ট্রেন থেকে নামতেও ভুল করেননি। নিশ্চিত হওয়ার জন্য দু’একজনকে জিজ্ঞেসও করেছেন। মজিদুর রহমান এদিক ওদিক তাকিয়ে একটা ছেলেকে কাছে ডাকেন
বাবা, দিয়াবাড়ি গ্রামটা কোন দিকে?
ছেলেটা আপাদমস্তক তার দিকে তাকিয়ে দেখে, দশফুট চওড়া পাকা রাস্তাটা দেখিয়ে বলে
সোজা এটা দিয়ে চলে যান।
মজিদুর রহমান বোকা বনে যান। ছেলেটির কথা বিশ্বাস করতে পারছেন না। রাস্তায় সারি সারি ইজি বাইক রাখা আছে। একটার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করেন
আমি দিয়াবাড়ি গ্রামে যেতে চাই।
ইজি বাইক চালক ছেলেটি বলে
বসেন, আর দু’একজন হলেই চলে যাবো।
মজিদুর রহমান ইজি বাইকের আসনে গিয়ে বসলেন। তার ভেতরের অস্থিরতাটা কাটছেইনা। তিনি ইজিবাইক চালককে জিজ্ঞেস করলেন
এখানে একটা কাচা রাস্তা ছিলনা?
ছেলেটা অবাক হয়
কাচা রাস্তা!
হ্যাঁ, সরু আইলের মতো।
ইজি বাইক চালক ছেলেটি বিস্ময়ের সাথে মজিদুর রহমান এর দিকে তাকিয়ে থাকে।
আপনি কতদিন আগের কথা বলছেন?
এই ধর চল্লিশবছর।
আমার বয়স বাইশবছর,জ্ঞান হওয়ার পর থেকে ইট বিছানো রাস্তাই দেখেছি। পাকা হয়ে তাও প্রায় আটবছর আগে।
মজিদুর রহমান লজ্জিত হয়ে মাথা নিচু করে বসে থাকে। তিনি তো ভুলতেই বসেছিলেন যে মাঝখানে চল্লিশটা বছর চলে গেছে।
***
ইজি বাইক একটা বাজারের মতো জায়গায় নামিয়ে দিল। নামতেই চাইছিলেন না তিনি। আপত্তি করে বলেছিলেন
আমি তো দিয়াবাড়ি গ্রামে যাবো।
ওইতো দিয়াবাড়ি।
তিনি নেমে এদিক ওদিক দিয়াবাড়ি খুঁজতে লাগলেন। যেখানে নেমেছেন সেখানে ছোট একটা বাজারের মতোই। অনেকগুলো দোকানপাট। ব্রয়লার মুরগির দোকান থেকে গরুর মাংসের দোকার সবই আছে। মজিদুর রহমান একটা দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলেন
দিয়াবাড়ি গ্রামটা কোনদিকে?
দোকানদার বিস্মিত হয় তার কথা শুনে।
এটাই তো দিয়াবাড়ি, মানে দিয়াবাড়ি মৌজার শুরু এখানেই।
গ্রামটা?
ওই তো বাড়ি ঘর দেখা যাচ্ছে ওটাই গ্রাম।
এখানে তো সব দালানকোঠা!
বুড়ো মত একজন মানুষ এগিয়ে এলেন
আপনি কোনে যাবেন? কার কাছে?
আর একজন জিজ্ঞেস করে
এর আগে আসেননি?
কারো প্রশ্নই মাথায় ঢুকছেনা মজিদুর রহমানের মাথায়। তিনি বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করলেন
এখানে একটা পাকুড় গাছ ছিলনা? অনেকেই মুখ চাওয়া চাওয়ি করলেও বৃদ্ধ মাথা নাড়ে-
ছেল ছেল, একটা মস্ত বড় পাকুড়ের গাছ ছেল। শরিকরা মারামারি কইরে খুনাখুনি হইল তারপর সব বেচা বিক্রি। কে কোন মুহে গেল তা কিডা বলতি পারবে।
একটা পুকুরও ছিল, অনেক বড় পুকুর।
সিডা কিনে নিয়ে বাড়ি কইরেছে রেলের কর্মচারিরা। তা তুমি বাপু কোনে যাবা? কার কাছে?
মজিদুর রহমান কোন উত্তর দেয়না, বৃদ্ধকে আবার প্রশ্ন করে
গ্রামে এখন আর কাচা বাড়ি ঘর নেই? সবতো দেখি দালান।
নাই বাপু, বেবাক পাকা বাড়ি ঘর। ছাওয়াল পাওয়াল শিক্ষিত হয়েছে, চাকরি করতিছে। তারাই সব তুলিছে।
মজিদুর রহমান আর কোন প্রশ্ন করেনা কাউকে। অদূরেই একটা রিকসা দাঁড়ানো ছিল। হাতের ইশারায় সেটার চালককে ডাকেন। চালক রিকসা নিয়ে কাছে এলো। তিনি অবাক হয়ে দেখলেন রিকসাটাও আর প্যাডেল মেরে চালাতে হয়না। সেটাও ব্যাটারি চালিত।
স্টেশনে যাবে?
চলেন।
মজিদুর রহমান রিকসায় উঠে বসলেন। পেছন থেকে বৃদ্ধ ডেকে বললেন
কে বাপু গাঁয়ে যাবানা? এস্টেশনে যাচ্ছে যে…?
মজিদুর রহমান অস্ফুট কণ্ঠে বলেন
মনে হয় ভুল ঠিকানায় এসেছি…
***
মজিদুর রহমান রিকসায় বসে আছেন।
রাস্তার দুপাশে ধানক্ষেত খোঁজেন। সেখানে এখন শুধুই দোকানপাট, বাড়ি ঘর। তিনি কোন ডোবায় মাছ ধরেছেন সেটার চিহ্নও পেলেন না। তিনি ভুল স্টেশনে নেমেছেন। দিয়াবাড়ি নামে একটাই গ্রাম আছে এমন নাও হতে পারে। যেখানে নেমেছেন, যেখানে কাউকে খুঁজতে গেলেন কোনটাই তার চেনা না। তার সামনে চেনা ঠিকানাটা হচ্ছে ব্যস্ত ঘিঞ্জি শহরের একটা ফ্ল্যাট। বাসা নম্বর সি-৪০৩। ওখানেই এখন ফিরে যাবেন। পেছন ফিরে তাকাতেও আর ইচ্ছে হলোনা…
সুমনদা বললেন,আমরা চারজন বন্ধু ভবরঞ্জন,অসীম,তারকেশ্বর ও আমি দীঘা বেড়াতে গেলাম কলকাতার ধর্মতলা থেকে বাস…..
গোয়েন্দা সুমন বাবু শুধু গোয়েন্দা নন। তিনি একাধারে বিজ্ঞানী,গোয়েন্দা বিচক্ষণ ব্যক্তি।তিনি বিভিন্ন বিষয়ে আপডেট সংবাদ…..
মফিজ সাহেব বসে আছেন। অভি মনে মনে ভাবে হয়তো তিনি বড় ধরনের কোনো সমস্যার…..
অসীম ও মাসির কথা সুমনদা বললেন,আমরা চারজন বন্ধু চিনু, ভব,অসীম,তারকেশ্বর ও আমি দীঘা বেড়াতে গেলাম…..