বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নাৎসি জার্মানির জন্ম ও মৃত্যু

প্রিয়দর্শী চক্রবর্তী
রিভিউ, সংবাদ
Bengali
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নাৎসি জার্মানির জন্ম ও মৃত্যু

প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী শ্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সম্প্রতি একটি বই লিখেছেন। ‘নাৎসি জার্মানির জন্ম ও মৃত্যু’। প্রকাশক ‘ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেড’। ১০৭ পৃষ্ঠার পেপারব্যাক এই বইটির বিনিময় মূল্য ১০০ টাকা। তথ্যগুলো সবারই জানা। আর এ তথ্যও জানা, প্রকাশিত হওয়ার মাত্র দিন তিনেকের মধ্যেই নিঃশেষিত হয়েছে মুদ্রিত যাবতীয় কপি। প্রকাশক স্বয়ং বাজারের এই আশাতীত প্রতিক্রিয়ায় বাধ্য হয়েছেন নতুন করে ছাপিয়ে বাঁধাতে, পুজোর কয়েক দিনে কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-র স্টলগুলোতে অন্তত যাতে ক্রেতাদের চাহিদা মেটানো যায়।

 


তো চাহিদা আমারও ছিল। কলকাতায় সদ্যই ফিরেছি। আগে সংগ্রহ করা হয় নি। এলাকার নিকটবর্তী পার্টির স্টলটাকেই পাখির চোখে তাক করে রেখেছিলাম। শুনলাম, এবার পুলিশ-প্রশাসন না কি ‘নিরাপত্তা’র খাতিরে সকালবেলা বিকিকিনির অনুমতি দেন নি। বিস্মিত হই নি তেমন। বই পড়া, বই কেনা তো এ রাজ্যে ‘উন্নয়ন’ পরিপন্থী অমার্জিত অপরাধ অবশ্যই (বিশেষ কিছু সরকারী সাহিত্য বাদ দিয়ে)। সে যাই হোক। সূত্রানুযায়ী খবর ছিল স্টল বিকেল সাড়ে পাঁচটা থেকে সাড়ে দশটা-এগারোটা অব্দি খোলা থাকবে। বুদ্ধবাবুর বইটির চাহিদা আন্দাজ করেই সোয়া ছ-টা নাগাদ স্টলে হাজির হয়ে শুনি, বিকেল চারটেয় ঝাঁপি খোলা হয়েছে। মাত্র দেড় ঘন্টার মধ্যেই স্টকের যাবতীয় কপি নিঃশেষিত ! কি আর করবো। দু-একটি অন্যান্য বইপত্র কিনে এবং সঙ্গে আগামীকাল নতুন কপি আসার প্রবোধবাক্যটুকু শিরোধার্য করে গুটিগুটি বেরিয়ে এলাম। সবে কয়েক পা হেঁটেছি। দোকানেরই কর্তব্যরত এক পার্টিকর্মী পেছনে হেঁটে এসে কিছুটা দূরে আমাকে ধরলেন… “আপনি বুদ্ধদেববাবুর বইটা কিনতে চান ?” বললাম… “হ্যাঁ, অবশ্যই।” উত্তরে জানালেন… “আসুন আমার সঙ্গে।” ফিরে গেলাম স্টলে। গুপ্তধনের মতো লুকোনো সিন্দুক (বাঁশ-ত্রিপলে ঘেরা টেবিলের তলার অন্তরাল) থেকে বের করে আনলেন একটি কপি। দাম মিটিয়ে বিজয়ীর ভঙ্গিতে কাঁধের ঝোলায় ভরে ঘরমুখো হলাম।

জানি না, ক্রেতার ভিড়ে (অজস্র না হলেও নেহাত নগণ্যও নয়) হঠাৎ আমার প্রতি কেন তারা নরম হলেন ! হয়তো অতিরিক্ত বই ঘাঁটাঘাঁটি করে নজর কেড়েছিলাম। সে যাই হোক। তবে এ-টুকু বুঝলাম, ওরা নিজেদের বন্ধুবান্ধবদের জন্য তুলে রাখা গুটিকয় বইয়ের ভাঁড়ার থেকেই একটি তুলে আমাকে দিলেন। ধাক্কা খেলাম। একটা ইতিহাসনির্ভর বই নিয়ে এমন টানাটানি অবস্থা, তাও আবার এই বিজ্ঞাপন-নির্ভর হট্টমেলার বাংলাবাজারে ! প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বামমনস্ক পাঠকদের মধ্যে সর্বজনশ্রদ্ধেয় নিশ্চিত এবং ব্যক্তিমানুষটির প্রতি মতাদর্শজনিত দুর্বলতার হেতু তাঁর নতুন বই সংগ্রহ করে নেওয়ার আকাঙ্ক্ষাও মোটেই অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু লেখক হিসাবে এই প্রথম তো তাঁর আত্মপ্রকাশ নয়। আগেও তাঁর গ্রন্থ সংগ্রহ করেছি, এবং এই পুজোর মরশুমেই। তখন এমন টানাপোড়েন তো দেখি নি ! বুঝলাম, ‘পাবলিসিটি’ শব্দটার অর্থ শুধুই একমাত্রিক সদর্থক নয়। কখনো কখনো নঞর্থক মাত্রার সমালোচনায় বিদ্ধ করে দেওয়ার উদগ্র মনোবৃত্তি আদপে বইয়ের বিস্তৃত প্রচারে বিঘ্ন নয়, বরং অক্সিজেন জোগায়। ফেসবুকের মতো আন্তর্জালিক মাধ্যমে সাংবাদিক সুমন চট্টোপাধ্যায় উক্ত গ্রন্থ প্রকাশের তিন-চারদিনের মধ্যেই শোরগোল তুলে ফেলেছিলেন বইয়ের মধ্যে থেকে দুটি ক্ষেত্রের দৃষ্টান্ত তুলে ধরে ইতিহাসের পারম্পর্য গুলিয়ে দেওয়ার গুরুতর অভিযোগে। স্বভাবতই আলোচনা-প্রতি আলোচনা, তর্ক-বিতর্কে কয়েকদিন ফেসবুকীয় সংলাপের খরস্রোতে তুঙ্গে ভেসে ছিল ‘নাৎসি জার্মানির জন্ম ও মৃত্যু’। প্রশ্ন এতদূরও উঠেছিল, বিকৃত তথ্য পরিবেশনের দায় কার ? আদৌ বুদ্ধবাবু নিজে এই বই লিখেছেন তো ? ত্রুটি সংশোধনের জন্য কি পার্টির মধ্যে কেউ ছিলেন না ! ইত্যাদি ইত্যাদি। আগ্রহ তাই বেড়েছে পাঠকমহলে। যদিও প্রাতিষ্ঠানিক গণমাধ্যমগুলোর মধ্যে এই বই নিয়ে তেমন চর্চা চোখে পড়ে নি, এবং সেটাই স্বাভাবিক।

মাননীয় সুমনবাবু বোধহয় তাঁর রুটিরুজি সংবাদপত্রের চেয়েও ফেসবুকের মতো গণমাধ্যমের বর্তমান সময়ের শক্তি সম্পর্কে সম্যক অবগত। আক্রমণের জন্য তাই এই পথটাকেই তিনি বেছে নিয়েছিলেন। প্রতিক্রিয়ায় তাঁর লক্ষ্য যে পূরণ হয় নি, তা আমার আজকের অভিজ্ঞতায় স্পষ্ট। বরং অজান্তে তাঁর সমালোচনা অনুঘটক হয়ে তিনগুণ বাড়িয়েছে বইয়ের বিক্রি। বলা বাহুল্য, মাত্রই সন্ধেবেলায় কিনে এতটুকু সময়ের মধ্যে গোটা বই পড়ে ফেলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে শেষ পাতার কনক্লুসিভ লাইনটি চোখে পড়লো… ‘…যুদ্ধের এই ভয়াবহ অভিজ্ঞতা আজকের দিনে সকল রাজনৈতিক মতামত নির্বিশেষে ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার প্রয়োজন।’ এই ‘ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার’ গুরুদায়িত্বে অজান্তেই সুমনবাবু যে অবদান রেখেছেন, তার জন্য ধন্যবাদ তাঁর অবশ্যই প্রাপ্য। একদা আনন্দবাজারের ছায়াসঙ্গী, বর্তমানেও প্রাতিষ্ঠানিক বুর্জোয়াপন্থী সাংবাদিকতার অন্যতম ধারক যে রাজ্যজোড়া তুমুল গড্ডলিকার বিপ্রতীপে মার্কসবাদী সাহিত্যচর্চায় এমন উস্কানি দেবেন, অত্যাশ্চর্য বিষয়টি অকল্পনীয় হলেও ঘটেই গেছে ! বই সংগ্রহের অভিযানে সাফল্যের প্রত্যাবর্তনে বেকুব আমি তখন গাইছি নিজেরই বিস্ময়টুকু গুছিয়ে স্বাভাবিক করে নেওয়ার অছিলায়…

‘বুঝেছি কি বুঝি নাই বা সে তর্কে কাজ নাই
ভালো আমার লেগেছে যে, রইলো সে কথাই…’

ভালো যে লেগেছে, সন্দেহ নেই। চাইবো, বই নিয়ে এমন কাড়াকাড়ি চলুক আরো কিছুদিন। কারণ, পাঠক পছন্দের বই খুঁজে নেবেন যে কোনো মূল্যে — সেখানেই তো লেখকের উদ্দেশ্যের সার্থকতা।

পরিশেষে তবু বলে নেওয়া ভালো, ইতিমধ্যেই পড়েছি ‘প্রাককথন’, ১১ থেকে ১৬ নম্বর পাতা। অর্থাৎ যেখানে লেখক নাৎসি জার্মানির উত্থানের প্রেক্ষিত বিশ্লেষণে প্রাগৈতিহাসিক থেকে ভার্সাই সন্ধির যুগ পর্যন্ত সময়ের সারণীকে বেঁধেছেন মাত্র পাঁচ পাতায়। কারণ মুখ্য বক্তব্য শুরুই হয়েছে দ্বিতীয় পর্বে ‘কে এই হিটলার?’ থেকে। অস্বীকার করি না, সুমনবাবুর সমালোচনার অংশগুলো ইতিমধ্যেই চোখে পড়েছে। আর এটুকুও বুঝলাম সার, সমালোচনার তীর ঐ প্রাথমিক কয়েক পৃষ্ঠাতেই সীমাবদ্ধ। অবশিষ্ট অংশ নিয়ে বিশেষ ঘাঁটানোর প্রয়োজনবোধ করেন নি সমালোচক।

যাই হোক, যুক্তিরও হয়তো প্রতিযুক্তি থাকে। তথ্যগত ত্রুটি অমার্জনীয়। কিন্তু যদি সার্বিক ইতিহাসবোধে হোঁচট না খেয়ে লেখার স্বাচ্ছন্দ্যে রেনেসাঁসের মহিমাবর্ণনে কেউ ‘সভ্যতা’ বলতে ধরেন ‘আধুনিক সভ্যতা’ (যদিও ‘আধুনিক’ নামে নির্দিষ্ট কোনো শব্দের অনুপস্থিতি দৃশ্যমান) বা ফরাসি বিপ্লব ও তার বৈপ্লবিক পরিবর্তনের আভাসের বর্ণনায় যদি ফিরেও আসে ভৌগোলিক আবিষ্কারের ছায়া, তবে কতটা গুরুতর দোষে তা দুষ্ট তা নিয়ে সামান্য তর্ক তো তোলাই যায়। অন্তত যখন দেখি, গোটা অংশটুকুকে লেখক বুনেছেন এর ঠিক পরেই লেখা শিল্প বিপ্লবের প্রেক্ষিত হিসাবে। ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভোলিউশনের সামগ্রিক প্রেক্ষাপট কিন্তু চতুর্দশ থেকে অষ্টাদশ — চারশো বছর ধরেই আবর্তিত হয়েছে। অন্তত কাল পারম্পর্যের ইতিহাসচেতনা তাই-ই বলে। আর চাইলে তো ‘আধুনিকতা’ নিয়ে তর্কের তুফান তোলাই যায়। সবাই বলছেন, লিখছেন, রামমোহন রায় ভারতের ‘প্রথম আধুনিক মানুষ’। ষাঁড়ের মতো গুঁতিয়ে ঢুকে যদি প্রশ্ন তুলি, কেনই বা ধর্মসমন্বয়ের ঝুলি নিয়ে আকবরের ‘দীন-ই-ইলাহী’ আধুনিকতার সর্বোচ্চ তকমা পাবে না? মধ্যযুগে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যমান বেঁধে দিয়ে ‘বাজার নিয়ন্ত্রণ’-এর মতো সাহসী পদক্ষেপে আধুনিক অর্থনীতিকেও কৃতজ্ঞ রেখেছেন যে পুরুষ, সেই আলাউদ্দিন খিলজিই বা ‘আধুনিক’ নন কোন যুক্তিতে? চাইলে আরো পেছনে যাওয়া যায়… সমুদ্রগুপ্ত বা অশোক পর্যন্ত। ‘আধুনিক’ শব্দটাই আসলে অ্যাবস্ট্রাক্ট, উপলব্ধির বিষয়।

তাছাড়া বুদ্ধবাবু নিজেই ‘ভূমিকা’য় স্বীকার করে নিয়েছেন… ‘ইতিহাসগ্রন্থ রচনা করার অ্যাকাডেমিক অধিকার আমার নেই।’ তাই প্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাসবিদের নিয়মনিষ্ঠ ব্যাখ্যা তাঁর কাছে আশা করার প্রশ্ন সেখানেই থেমে যায়। বরং মাঠময়দানের রাজনৈতিক বক্তৃতার আবেগটুকু ধরতে ধরাবাঁধা ছকের বাইরে যাওয়াই শ্রেয়। সময়ের অভিঘাতে সংবেদনশীল রাজনীতিবিদের বোধের উত্তাপটুকু ছেঁকে নেওয়া অনেক বেশি জরুরি আপাতদৃষ্টিতে দু-একটি ছোটখাটো ভ্রান্তির ঊর্ধ্বে। দীর্ঘ অসুস্থতা আর বয়সের ভার সত্ত্বেও ফ্যাসিবাদের মৌলিক অতীতটুকু তুলে ধরতে বর্তমান সময়ের ঘোলাজলে তিনি যে উদ্যোগী হয়েছেন, তাকেই বরণ করে নেওয়া বরং যুক্তিসঙ্গত। আর, বোধ করি, বুর্জোয়া শিবিরের ভয়টা এখানেই।

সম্পূর্ণ বইটি পড়ার আগে সার্বিক বিষয়বস্তু নিয়ে অতিরিক্ত কোনো ময়নাতদন্তেই আপাতত যেতে চাইছি না। আপাতত পড়বো ছুটির অবকাশে। প্রয়োজন বোধ করলে নিশ্চয়ই ফিরে আসবো ইতিহাসের সম্মান রক্ষার্থে। যতটুকু বললাম, সম্পূর্ণতই তা বইটি হাতে নেওয়ার তাৎক্ষণিক অভিজ্ঞতা প্রসূত।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

স্থির করে দাও কম্পমান জল : গালিবের প্রজ্ঞার সুরাপাত্র হাতে কবি কাকন রেজা

স্থির করে দাও কম্পমান জল : গালিবের প্রজ্ঞার সুরাপাত্র হাতে কবি কাকন রেজা

  রুমী, খৈয়াম, হাফিজের কয়েক শতাব্দী পর এলেন গালিব। মির্জা গালিব। এত দিতে সুরাপাত্র ও…..

ফ্রিউইন্স-এর প্রথম চিত্রপ্রদর্শনী

ফ্রিউইন্স-এর প্রথম চিত্রপ্রদর্শনী

সম্প্রতি ফ্রিউইন্স আয়োজিত কুড়ি জন বিশিষ্ট চিত্রশিল্পীর প্রায় অর্ধশত ছবির প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিল গড়িয়ার মহামায়াতলার…..