বৃত্ত

কুম্ভকর্ণ
ছোটগল্প, নারী
Bengali
বৃত্ত

সকাল সাতটা, যাদবপুর, কলকাতা।

গাড়িটা স্টার্ট দিলো সুমিত্রা, আজ নিয়ে দশ দিন হয়ে গ্যালো,তার কর্মজীবনের। ”পথের সাথী” অ্যাপের একমাত্রমহিলা চালক। মেয়ে বলে চাকরিটা পেতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিলো তাকে,পাড়ার ছোটন টা না থাকলে হয়তো সেবাতিল হয়ে যেত।

ছোট থেকেই ডানপিটে বলে সুমিত্রার বরাবরের বদনাম। ছেলেদের সাথে প্রথমে ক্রিকেট,মার্বেল,সাইকেল একটু বড়হতেই বাইকের রেস আর তারপর ঝিলের মাঠে চার চাকা শেখা।এর জন্য তাকে কম পিটুনি সহ্য করতে হয়নি।তারবাবার মারের চোটে ডান হাতের যে বুড়ো আঙ্গুলটা ভেঙ্গে গিয়েছিলো,সেটা আজও সোজা হয়নি।

সকালের প্রথম সাথীর সংকেত এলো মুঠো ফোনে।

বিপ্লব পাল,

লোকেশন-অরবিন্দ সেবা কেন্দ্র,তালতলা

সুমিত্রা যাদবপুর থানা র পাশ দিয়ে লোকেশনে পৌছল পাঁচ মিনিটে।

প্যাসেজ্ঞার দাড়িয়েই ছিলো। সুমিত্রা বুঝতে পারলো তার পথের সাথী হলেন স্বামী,স্ত্রী আর তাদের সদ্যোজাতসন্তান,গন্তব্য কসবা নিউ মার্কেট।যদিও ট্রেনিং এ বলেছিলো প্যাসেজ্ঞানদের কথা না শুনতে,তবু পিছনে বসে সদ্যহওয়া পিতা মাতার কথোপকথনে চলেছে সে সব কানে আ

-বিপ্লব,বাবা কি এখনও রেগে আছেন? মেয়েটির

বেশ আস্তে প্রশ্ন করলো।

বিপ্লব একটু করে থাকলো,তারপর বললো

-তুমি তো জানো মৌ বাবা অনেক আশা করেছিলেন নাতি হবে,কিন্তু সবই আমার কপাল..!

-এমন ভাবে কেন বলছো তুমি,এতো আমাদের সন্তান।সুমিত্রা লুকিং গ্লাসে দেখলো মিতা শিশুটাকে কাছে টেনেনিলো।

-মিতা সব বুঝি,কিন্তু কি করবো বলো।বেরানোর আগে দেখলাম মা বাবাকে কি সব বোঝাচ্ছেন।

-আর তোমার বোন কিছু বলছে না?মিতা প্রশ্নটা করলো।

বিপ্লব একটু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো

-বাবার আদুরে এখন বাবার দলে,কিছু স্বার্থ আছে হয়তো।

-সেই সব সম্পর্কই শুধু চাওয়া পাওয়ার,এই দ্যাখো তোমার বাবা নাতি চেয়েছিলেন,পেলেন না বলে ওঁনার এতমুক্তচিন্তা সব রসাতলে চলে গেলো।মিতা একটানা কথা গুলো বললো।

দু জনেই চুপ…কসবা নিউ মার্কেটও এসে গ্যালো খানিক ক্ষণ পর।

সুমিত্রা তার মায়ে মুখে শুনেছে তার জন্মের পর তার বাবা বেশ কয়েক মাস তার মুখ পর্যন্ত দ্যাখেনি।এই সব ভাবতেভাবতে পরের পথের সাথী চলে এলো।

নাম-অ্যানি বোস,লোকেশান-রুবি পার্ক!

এই সময়ে রুবি বাইপাসে একটু জ্যাম,তাই ডেসটিনাশনে যেতে একটু সময় লাগলো।গাড়িতে বসে সুমিত্রাদেখেঅ্যানি বোস দারুন উত্তেজিত।ক্যাবের ড্রাইভার একজন মহিলা জেনে সে নারী স্বাধীনতা নিয়ে একটা নাতিদীর্ঘ

একটা বক্তব্য পেশ করলো।সুমিত্রা এসব বিরক্ত লাগে তবু সে শুনে চললো।বক্ততায় ছেদ এলো অ্যানি ম্যাডামেরফোন।

-হ্যালো শেখর।তোমার ফোন সারাক্ষণ বিজি থাকে ক্যানো?

-ও,তুমি সারাক্ষণ ওই মিটিং নিয়ে থাকো।শোনো না বাবু এবার দারুন রেজাল্ট করেছে।এই তো জাস্ট স্কুল থেকেবেরোলাম।পরের বছর ক্লাস টেন।ম্যাথস্ আর কেমিস্ট্রির আরো একটা মাষ্টার মশাই এর ব্যবস্থা করছি বুঝলে।

-কি বোলছো?বাজেট?ওটা আমি ম্যানেজ করে নেবো।তিন্নির নাচ আর গানের ক্লাসটা বন্ধ করে দেবো ভাবছি।

-শোনো শেখর,মেয়েকে নিয়ে অতো আদিক্ষেতা করো না তো।মেয়েদের অতো শখ,আহ্লাদ থাকতেনেই…হ্যালো..হ্যালো।

ফোনটা রেখেদিলো অ্যানি বোস।তারপর বিরক্ত ভাবে নিজে বললো

-মেয়েকে কিছু বলা যাবে না,বললেই ওনার মাথা গরম..। ভাই একটু সাইড করো তো আমি নেবে যাবো..।

অ্যানি নেমে যাবার পর সুমিত্রা বাইপাসের পাশে এক কাপ চা নিয়ে একটু বসলো।তার ক্যারাটে শেখার দারুন ইচ্ছাছিলো,তার বাবা প্রায় রাজি হয়ে গেছিলো,কিন্তু তার মায়ের আপত্তিতে শেখা হয়নি।পরে বুঝেছিলো ভাইকে দামিমাষ্টারমশাই এর দেবার জন্য তার মা রাজি হয়নি।মনটা ভারী হয়ে গ্যালো তার।চা টা ভীষণ তেতো লাগছে।কিছুক্ষণের মধ্যেই তার পরের সফর চালু হোলো।অ্যাপোলো হসপিটাল থেকে সে এক বৃদ্ধ ও এক মাঝ বয়সিমহিলাকে পিক আপ করেছে।

-সোনা তুই বুড়ো বলেছিস আমার রোগটার ব্যাপারে?কি বলছে সে?কবে আসবে?বৃদ্ধ জিজ্ঞাসা করলো।এই প্রশ্নটাসে একটু আগেও করেছে।মেয়েটি এবার বিরক্ত ভাবে বললো

-বাবা,ভাইকে সব বলেছি।সে টাকা পাঠিয়ে দিয়েছে তার এখন ইয়ার এন্ড সে এখন আসতে পারবে না।

বৃদ্ধ একটু চুপ করে গ্যালো।তারপর মুচকি হেসে বললো

-সেই,ওর মা মারা যাবার পরও একই যুক্তি ছিলো।অথচ ওর একটু শরীর খারাপ হলেই আমি অফিসে ছুটি নিতামআর তোর মা ারা রাত জাগতো।সেদিক থেকে দেখতে আমরা তোর জন্য কিছুই করিনি..অথচ আজ দ্যাখ..তুই নাথাকলে..।

মেয়েটি এক ধমকে বৃদ্ধ কে চুপ করিয়ে দিলো।সুমিত্রা শুধু ভাবলো,এই অচেনা মানুষ গুলো তারই মতন একই বৃত্তেরবাসিন্দা।তার ভাই বিয়ের পর আলাদা হয়েছে,তাদের কোনো খবরই রাখে না।তিন মাস আগে তার বাবার যখনসেরিব্রাল অ্যাটাকের পর ডান দিকটা পড়ে যায় সে গিয়েছিলো তার ভাই এর কাছে।ভাই তার হাতে পাঁচ হাজার টাকাতুলে দ্যায়..ব্যাস!সুমিত্রা সেই টাকায় হাত পর্যন্ত দ্যায় নি।ইচ্ছা আছে পরের ভাই ফোঁটায় পুরো টাকাটাই সে ফিরিয়েদেবে।

কুম্ভকর্ণ (ছদ্মনাম)। লেখক। জন্ম ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। পেশায় প্রকৌশলী।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ