প্রক্সি
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
ভীষণ ঢিলেঢালা বৃষ্টিভেজা অলস ভোর। মেঘের কোল ঘেঁষে বৃষ্টির অনর্গল খুনসুঁটি – নৃত্যে সবুজ প্রকৃতি যেন ভাসছে রঙিন ভালোবাসায়। চারপাশজুড়ে পিনপতন নীরবতা। কাঁচা ভোরের স্নিগ্ধ শীতল বাতাসে হৃদয়জুড়ে সুখের দোলা। বিশেষ বিশেষ কিছু সময়ে, যেমন বৃষ্টি দিনে, চাঁদনী রাতে, ঘুঘু ডাকা একলা দিনে, স্মৃতির অরণ্যে গহীন আঁধার কেটে থৈ থৈ আলোর জোয়ার উঠে। স্মৃতিরা মনের দেয়ালে পসরা সাজিয়ে বসে। স্মৃতির টুং টাং শব্দে কুসুমের আলস্য কেটে যায়। মন চনমনে হয়ে উঠে।
কুসুম জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। জানালার পর্দা ভেদ করে বাইরের আলো এসে এলিয়ে পড়েছে মেহগনি রঙের কাঠের মেঝেতে। কি অনাবিল মিষ্টি দৃশ্য! বৃষ্টির ছন্দ পিয়ানোর সুর হয়ে কানে বাজছে। সুরের তালে গাছের সবুজ পাতারা আদরে আদরে দুলছে। জানালার এপাশে কুসুম, ওপাশে ঝমঝম বৃষ্টিভেজা প্রকৃতি! আহা! প্রকৃতির কি মিষ্টি ঘ্রাণ! আবেগাপ্লুত কুসুম জানালার বাইরে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি ফোঁটাদের ছুঁয়ে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টি ফোঁটা কুসুমের কপালে অনন্ত ভেজা চুম্বন এঁকে দেয়! বৃষ্টির বুকে স্বর্গ সুখে কুসুম চোখ বুঁজে থাকে। কুসুমের চোখের পাতায় বৃষ্টির মিঠা জল, কপোল বেয়ে চুম্বনের বানভাসি প্লাবন, মনের গহীনে আঙুলে আঙুল রেখে বৃষ্টির এক্কাদোক্কা নৃত্য, কুসুম নিংড়ে নিংড়ে বৃষ্টি দিনের ভালোবাসা উপভোগ করছে।
এত সুন্দর একটি দিনের শুরুতে প্রাণভরে শ্বাস নিতে পারার জন্য কুসুম কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে সৃষ্টিকর্তার কাছে। জানালার সাথে সবসময় একটা নিবিড় সম্পর্ক অনুভব করে কুসুম। মানুষের ভেতর আর বাইরের গভীর সংযোগের সূত্রপাত শুরু হয় এই খোলা জানালার শিক ধরেই। বুকের গভীরে নীরবে মিশে থাকা যত অপ্রাপ্তি, হতাশারা মিশে যায় আকাশের নিঃসীম শূন্যতায়, আর আকাশ মুছে দেয় পরম আদরে বুকের যত ক্ষত।
জানালার ব্লাইনডস ফাঁক করে কুসুম বাইরের পৃথিবীর দিকে তাকায়। কি অনিন্দ্য সুন্দর খোলা আকাশ! নির্ভার মুক্ত জীবন। থমথমে মেঘের আড়ালে সূর্য ঢাকা পড়েছে। রাস্তার দু’পাশে মাথা উঁচিয়ে জ্বলে থাকা নিয়ন বাতিদের আলো নিভেনি তখনো। নিয়নের উজ্জ্বল আলো বৃষ্টি ফোঁটাদের আরো বেশি বর্ণময় করে তুলেছে। বৃষ্টি ফোঁটাদের বর্ণিল রুপের ছটায় ভাসতে ভাসতে কুসুম নস্টালজিয়ায় ডুবে যেতে থাকে।
সময়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে সে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে গৃহ শিক্ষকের হাঁক! স্যার ডাকছেন তাকে সহজ পাঠ শিক্ষার আসরে। শীতলপাটি বিছিয়ে স্যার আয়েশ করে বাঁশের সরু কঞ্চি হাতে বসেছেন। অ তে অজগর, আ তে আম। কুসুম বড় হয়ে পরে অনেক ভেবেছে কেন যে সহজ পাঠের প্রথম ছবিটাই সাপের ছিল! শিক্ষকের পাশে বসে, অ তে অজগর পড়ার সময় কুসুমের বুক তিরতির করে ভয়ে কাঁপতো। ওর উজ্জ্বল মুখ ফ্যাকাসে হয়ে যেত অজগরের ছবি দেখে। কুসুম ছোটবেলা হতে খুবি ভীতু প্রকৃতির ছিল।
অজগরের ছবির দিকে তাকিয়ে ও চোখ বন্ধ করে প্রজাপতি আর ঘাসফড়িং এর ছবি কল্পনা করতো। ফলস্বরূপ, অ তে অজগর না বলে প্রজাপতি, ঘাসফড়িং বলে নিয়মিত স্যারের মার খেতো। স্যারের মার খাওয়ার পর ওর বুকে ভীষণ মেঘ জমতো। মেঘ যখন অঝোর বৃষ্টি হয়ে ঝরতো তখন দূরের বৃষ্টিভেজা মাঠের দক্ষিণ প্রান্ত হতে অশ্চর্য সুন্দর একতারার অদ্ভুত সুর ভেসে আসতো। সূরের মূর্চ্ছনায় কুসুম স্যারের হাতের সরু কঞ্চির মারের যন্ত্রণা ভুলে যেতো।
বর্ষাকালে কুসুম খোলা আকাশের নিচে ঘুড়ি উড়াতো। ও প্রাণপণে চেষ্টা করতো ওর ঘুড়ি উড়তে উড়তে মেঘেদের শরীর ছুঁয়ে দিক। মেঘেদের শরীর ছুঁয়ে দেয়ার জন্য কুসুম নেশাতুর হয়ে উঠতো। ঘুড়ি যখন জমিনে এসে মুখ থুবড়ে পড়তো, তখন কুসুম চোখ বন্ধ করে ঘুড়ির শরীর হতে মেঘের গন্ধ নিতো। কুসুমের বুকের ঝোপে তখন মেঘ ডেকে উঠতো। সঙ্গে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামতো। কুসুম সে বৃষ্টি জলে ঘাসফড়িং এর মতো লাফাতো, প্রজাপতির মতো উড়তো!
কুসুমের কানে হঠাৎ ভেসে আসে বাঁশঝাড় হতে পাখীর ডানা ঝাপ্টানোর শব্দ। ও আরো মনোযোগ দিয়ে কান পাতলো, ঠিক পথের পাঁচালীর দূর্গার মতো। দূর্গা যেমন করে কান পেতে ট্রেনের শব্দ শুনেছিলো, ঠিক তেমনি কুসুম কান পেতে পাখীর ছানার চিৎকার শুনছিলো। ও দৌড়ে বাঁশ ঝাড়ের কাছে যায়। গিয়ে দেখে থকথকে কাদা মাটির উপরে একটি শালিক ছানা জুবুথুবু হয়ে পড়ে আছে। পাশে মা শালিক ডানা ঝাপ্টাচ্ছে। কুসুমকে দেখে মা শালিক উড়ে যায়। কুসুম তাড়াতাড়ি ছানাটিকে ঘরে এনে শুকনো কাপড়ে মুড়ে হারিকেনের তাপে ওম দিতে শুরু করে। আস্তে আস্তে ছানাটির শরীরের কাঁপুনি কমে স্থির হতে শুরু করে। এই দৃশ্য দেখে কুসুমের আনন্দ দ্বিগুণ বেড়ে যায়! ও রোজ ছানাটিকে মুড়ি, চাল গুঁড়ো করে খেতে দিতো।
কুসুমদের বাড়ীর সামনে ছিলো বিশালাকৃতির কদমফুল গাছ। বর্ষাকালে কদম ফুলে ভরে উঠতো পুরো গাছটি! চরাচর কাঁপিয়ে যখন বৃষ্টি নামতো – বাতাস বইতো, তখন বৃষ্টি জলে কদম ফুল ভাসতো। কুসুম আঁজলা ভরে কদম ফুল কুড়াতো। কদম ফুলের পাপড়ি দিয়ে সহপাঠীদের সঙ্গে চড়ুইভাতি খেলায় মেতে উঠতো। পাপড়িগুলো দিয়ে রান্না করতো ভাত আর বাকি অংশ দিয়ে তরকারি। কুসুমের নিজ হাতে বানানো রান্নার জন্য মাটির তৈরি হাঁড়ি-পাতিল ছিলো। ঝুম বৃষ্টির দিনে ওরা পুতুল খেলতো। পুতুলের বিয়ে দিতো। কুসুম সবসময় ছেলে পুতুলের মা হতো। ওর বান্ধবী সুমনা হতো মেয়ে পুতুলের মা। বিয়ের পর সুমনার যত্নে বানানো পুতুলটি যখন কুসুমের কাছে চলে আসতো, তখন ও খুব খুশি হতো। কুসুম একদম চাইতো না তার পুতুলকে অন্যের হাতে তুলে দিতে। সেজন্য কুসুম সবসময় বুদ্ধি খাটিয়ে ছেলে পুতুলের মা সাজতো।
আহা! খাঁটি আলোয় মোড়ানো কুসুমের ফেলে আসা সহজ পাঠ, রঙিন ঘুড়ি, বৃষ্টিভেজা মাঠ, প্রজাপতি, ঘাসফড়িং, বর্ষাকাল, শালিক পাখীর ছানা, পুতুল- পুতুল খেলার শৈশবের দিনগুলি!
ষাটোর্ধ্ব কুসুম আক্তার খুবি সাদামাটা আবেগতাড়িত একজন নরম মনের মানুষ। ছোটবেলায় বৃষ্টির পানিতে কোন পিঁপড়া ভেসে যেতে দেখলেও কেঁদে বুক ভাসাতো। ঘরের কোণে বাস করা চড়ুই পাখীটাকে বৃষ্টিতে ভিজতে দেখলেও কষ্টে তার বুক ভারী হয়ে উঠতো। বৃষ্টিভেজা ডানা ভাঙা কবুতরের সেবায় কুপির আলোয় সারারাত নির্ঘুম কাটিয়েছে কুসুম।
ফেলে আসা জীবনের বৃষ্টিমুখর বর্ষাকালে যেমন প্রচুর আনন্দ ছিল তেমনি অনেক বেদনাও ছিলো। ছোটবেলার বৃষ্টি কিংবা বর্ষা ঋতু কৈশোরে উত্তীর্ণ হওয়ার পর নানান কারণে তেমন ভালো না লাগলেও জীবনের বড় বেলায় এসে বৃষ্টির দিন কুসুমের ভীষণ প্রিয় হয়ে উঠেছে। কারণ, বৃষ্টি নেমে এলেই যান্ত্রিক জীবনের নিয়মমাফিক কোলাহল থেকে কুসুমের মন ছুটি পায়। নিজের মত করে মনের ঘরে স্মৃতির জাবর কাটা যায়। বৃষ্টির বেগ যত ভারী হয় মনের দেয়ালে ঝুলানো জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া ছোটবেলার ঝাপ্সা স্মৃতিগুলো তত স্পষ্ট হয়ে উঠে।
বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরের ইট- কাঠের এই শহরে বৃষ্টি নামলেই কুসুমের ভাবনায় বৃষ্টি নামে তার সেই ফেলে আসা ছোট্ট সোনাঝরা গ্রামে। ছোটবেলার বৃষ্টি যেমন আনন্দের স্মৃতি হয়ে ওকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়, তেমনি কষ্টের স্মৃতিগুলোও ওকে নিভৃতে কাঁদিয়ে যায়।
আকাশ কালো করে মেঘ জমলেই কুসুম ভয় পেতো। ওর মনে হতো চারপাশে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। আলোর পৃথিবীটাকে তখন ওর চোখে ক্লান্ত, নিঃসঙ্গ দেখাতো। পরিচিত জনদের হতাশা, যন্ত্রণা, কুসুমের বুকে এসে বিঁধতো। একারণে বৃষ্টিকে শুধু আকাশের কান্না মনে হতো না, মনে হতো মানুষের হৃদয়ের কান্না।
কুসুমের মনের দেয়ালে ভেসে উঠে কাসেম চাচার মুখ। যিনি তাঁর আদরের মেয়ে আয়েশাকে কথা দিয়েছেন আগামী মাসে বেড়ীর মাছ বিক্রি করে একটা বাড়তি স্কুল ড্রেস সেলাই করে দিবেন। আয়েশা সপ্তাহে ছয়দিন একমাত্র স্কুল ড্রেস পরে স্কুল যায়। আয়েশার স্কুলে যাওয়ার ওই একটি মাত্র ড্রেস ছিলো। কাদা- মাটির রাস্তায় বৃষ্টিতে ভিজে বাড়ী ফিরে প্রতিদিন আয়েশা মাটির চুলোর উপরে প্লাস্টিকের দড়ি ঝুলিয়ে চুলার তাপে স্কুল ড্রেস শুকাতো, পরের দিন স্কুলে পরে যাওয়ার জন্য। বৃষ্টির দিনে মাটির চুলার উত্তাপও যেন নেতিয়ে থাকতো। পরিবারের রান্নার জন্য বৃষ্টির দিনে শুকনো লাকড়ি যোগাড় করতেই আয়েশার মায়ের কষ্ট হতো। বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে কোন কোন দিন লাকড়ির অভাবে ভালো করে স্কুল ড্রেসটা শুকাতে পারতো না বলে পরের দিন আধা শুকনো স্কুল ড্রেস পরেই আয়েশা স্কুলে যেত। আয়েশার স্কুলের ড্রেস কোড খুবি কড়া ছিল। একদিন স্কুল ড্রেস শুকায় নি বলে অন্য জামা পরে স্কুলে যাওয়ায় অংকের শিক্ষক আয়েশার ডান হাতের তালুতে জোড়া বেত দিয়ে মেরেছেন। বাবার অসহায়ত্বের কথা চিন্তা করে স্কুল শেষে বাড়ী ফিরে হাত লুকিয়ে রেখেছিল আয়েশা। বাবা যেন মেয়ের হাত দেখে তাঁর অক্ষমতার কথা ভেবে কষ্ট না পান।
কপালে হাত রেখে স্কুলের পড়া শেখা আয়েশার নিত্যকার অভ্যেস। হারিকেনের আলোয় টেবিলে বসে পড়ার সময় বাবা ঠিকি দেখে ফেলেছেন মেয়ের ধবধবে ফর্সা হাতে শিক্ষকের মারের চিহ্ন। নির্বাক বাবা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে তখুনি কথা দিয়েছেন আগামী মাসেই বাড়তি একটা স্কুল ড্রেস সেলাই করে দিবেন। কিন্তু বিধি বাম। মেয়ের জন্য বাড়তি স্কুল ড্রেস আর কেনা হলো না। এক সপ্তাহের টানা বর্ষণে কাসেম চাচার বেড়ী বাঁধ ভেঙে গত ছয় মাসের সঞ্চয়, সব মাছ বাইরের খোলা মাঠে চলে গেছে। অনেক চেষ্টা করেও বাঁধ রক্ষা করতে পারেন নি। কাসেম চাচার মাথায় হাত। কপালজুড়ে দুঃশ্চিন্তার বলিরেখা। পরিবারের প্রয়োজনীয় চাল, ডাল, তেল, নুনের চিন্তায় বোবা চোখে কাসেম চাচার অন্ধকারের দিকে অসহায়ের মত তাকিয়ে থাকার সে করুণ দৃশ্য আজো ভুলতে পারেনি কুসুম। এই শহরে বৃষ্টি নেমে এলেই কুসুমের দু’চোখের আয়নায় ভেসে উঠে কাসেম চাচার সেই অসহায় অন্ধকারাবৃত মুখ।
একদিন দুধে হরলিক্স মিশিয়ে তৃপ্তি সহকারে খাবে এই স্বপ্ন দেখতে দেখতেই বড় হয়ে যায় সুবর্ণা। বর্ষাকালে অনবরত বৃষ্টি মানেই ঘরে অভাব, অনটন লেগে থাকা। সঞ্চিত খাবার ফুরিয়ে যাবার ভয়। সুবর্ণার মা রোজ-ই সুবর্ণার বাবার কাছে বায়না ধরে মেয়ের জন্য একটু গরুর দুধ যেন ঘরে রেখে যায়৷ নুন আনতে পান্তা ফুরোয় যে সংসারে সেখানে নিজের মেয়েকে দুধে হরলিক্স মিশিয়ে খাওয়ানোর ইচ্ছেটা অধরাই থেকে যায়। প্রত্যুষে গরুর দুধ সংগ্রহ করে গোয়ালঘর থেকেই সুবর্ণার বাবা সব টুকুন দুধ বাজারে বিক্রি করে দিতেন অন্নসংস্থানের জন্য।
ষোড়শীর নুপুরের ছন্দে এই শহরে বৃষ্টি নামলেই আজো কুসুমের বুক কেঁপে উঠে, সন্তানকে একটু দুধ খাওয়াতে না পারার কষ্টে নীল হয়ে যাওয়া সুবর্ণার মায়ের কথা ভেবে।
সভ্যতার চেয়ে ক্ষুধার বয়স বেশি। ক্ষুধার কষ্টের কাছে জগতের সব আনন্দ -শিহরণ ফ্যাকাসে হয়ে যায়। তীব্র বৃষ্টি মানুষের অভাব, ক্ষুধা নিভারণ করতে পারেনা বরং বাড়িয়ে দেয়। অলস মেঘলা দিনের বৃষ্টিভেজা বিকেলে পাড়ার দোকান থেকে ভেসে আসা চা – ডাল পুরির সুঘ্রাণে বিমোহিত কিশোরী রিপা মায়ের কাছে বায়না ধরেছে এক টাকার জন্য। সিঙাড়া কিনে খাবে। মা ধমক দিয়ে বলেছিলো, প্যানপ্যানানি থামা। গোলার ধান প্রায় শেষ। ভাত কোথা থেকে খাবি সে চিন্তা কর! হাতের নকশীকাঁথাটা শেষ কর তাড়াতাড়ি। দোকানে বিক্রি করে ঘরের দরকারী জিনিষপত্র কিনতে হবে।
রিপা খালি গলায় খুব ভাল গান করতো। বৃষ্টির দিনে পাশের ঘরে রিপার বান্ধবী ঝর্ণা যখন গানের ওস্তাদের কাছে বেসুরো গলায় সা -রে -গা -মা শিখতো, তখন রিপা নিজের ঘরের বারান্দায় বসে খালি গলায় আনমনে গান গাইতো আর নকশীকাঁথা – শীতল পাটি বুনে যেত।
রিপা ওর বাবা-ভাই-সহপাঠীদের সঙ্গে ফুটবল খেলতে পছন্দ করতো। কিন্তু ঘরের কাজ শেষ করে খেলার সময় পেতো না। টুপটাপ বৃষ্টির দিনে রিপার সমবয়সীরা যখন কাদামাটিতে লেপ্টে হা-ডু-ডু, কানামাছি খেলতো, তখন রিপা জানালার গ্রীল ধরে শূন্যে তাকিয়ে থাকতো। দায়িত্বের কাদাজলে নিমজ্জিত রিপা যেন রাতারাতি তার সহপাঠিদের থেকে বয়সে অনেক বড় হয়ে গেছে।
রিপা ছিল প্রচন্ড মেধাবী। খুব কাছে থেকে কুসুম দেখেছে, অভাব কিভাবে মানুষের জীবনের অসাধারণ জীবনীশক্তিকে কেড়ে নেয়, প্রতিভাদের গলা টিপে অকালে হত্যা করে। অভাব মানুষের জীবনের স্বাভাবিক গতিপথ পরিবর্তন করে দেয়। সৃজনশীল ব্যক্তিত্ব বিকাশে অভাব হিমালয়ের মত অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। অভাবের কারণে মানুষের চিন্তাশক্তি ঝিমিয়ে পড়ে। অভাব জীবনের সুবর্ণ সময়ের আনন্দগুলো কেড়ে নেয়। এককথায় অভাব জীবনকে দিশেহারা করে দেয়।
শহুরে বৃষ্টিকে কুসুমের কাছে মাঝেমধ্যে কিছুটা কৃপণ এবং ছন্দহীন মনে হয়। ফেলে আসা শৈশবের বৃষ্টি ছন্দময়, অকৃপণ ছিলো। হিসেব করে ঝরতো না। অকৃপণভাবে রাতদিন আকাশ ভেঙে ঝুপ ঝুপ ঝরে যেত প্রকৃতির বুকে। মুষলধারে বৃষ্টি শেষে বাড়ীর আঙিনায় জমে থাকা পানিতে রিপার বান্ধবীরা যখন রঙিন কাগজের নৌকা ভাসানোর আনন্দে মত্ত হোত, তখন রিপা ব্যস্ত সময় কাটাতো বৃষ্টিভেজা হাঁস-মুরগীর বাচ্চাগুলোকে শুকনো খড়ের ওমে পরম আদরে ঘুম পাড়ানোর কাজে। পোষা কুকুরটা বৃষ্টির রাতে বাড়ী না ফিরলে রিপা তার অপেক্ষায় বসে থাকতো।
মানুষ অভ্যাসের দাস। ছোটবেলা থেকেই দায়িত্বের সাথে বসতি গড়ে তোলায় ঘরে-বাইরে সর্বত্র সবকিছুর ব্যাপারে খুব অল্প বয়সেই রিপাকে দায়িত্বশীল হয়ে উঠতে দেখেছে কুসুম।কোন আড্ডা, গল্পে রিপাকে তেমন দেখাই যেতো না। কঠিন বাস্তবতার সাথে বেড়ে উঠা রিপা ছিল কুসুমের গ্রামের বাস্তববাদী এক শান্ত কিশোরী।
যান্ত্রিক এই ঝলমলে শহরে তাগড়া বেগে বৃষ্টি নেমে এলেই কুসুমের মনের আয়নায় ভেসে উঠে রিপার পিপাসার্ত নীরব চোখ-মুখ।
মনে পড়ে, কুসুমের খুব করে মনে পড়ে রহিমা খালার মুখ। ঘরে- বাইরে সারাক্ষণ কাজ করতেন ভেজা কাপড়ে। কাজ না করে কোন উপায় ছিল না। ভেজা কাপড়ে থাকতে থাকতে উনার শ্বাসকষ্ট দেখা দিয়েছিল। রাতে ঘুমাতে পারতেন না শ্বাসকষ্টে। কুসুমের সাথে দেখা হলে বলতেন, ‘নিঃশ্বাস ফেলে টেনে নিতে খুব কস্ট হয়রে মা।’
কাদাজলে হেঁটে সংসারের সব কাজ করতে করতে উনার পায়ের আঙুলের মাঝখানে ঘা হয়ে যেত। চোখের পানি-নাকের পানি একসাথে করে সন্তানদের জন্য রান্না করতেন তিনি।
কয়েকদিন ধরেই এই শহরে সময় – অসময়ে বেশ বৃষ্টি হচ্ছে। মেঘের চোখে যতটা জল স্মৃতি হাতড়ানো নস্টালজিক কুসুম আক্তারের চোখে আজ ফেলে আসা স্বজন-পড়শীদের কথা মনে পড়ে যেন তারও বেশী জল জমেছে। জানালার পাশে দীর্ঘক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে থাকা কুসুম বাইরের বৃষ্টি ফোঁটার মত তার চোখ থেকে ঝরে পড়া স্মৃতির আঘাতে ঝাপ্সা হয়ে আসা চশমার কাঁচ মুছে দূরের আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।
সেখানে স্পষ্ট দেখতে পায় কাসেম চাচা, আয়েশা, সুবর্ণা ও তার বাবা- মা, রিপা, রহিমা খালার জীবন্ত মুখচ্ছবি। দৃশ্যগুলো ভেজা রাসপ্রিন্ট যেন। চোখের সামনে থেকে যেতে চায় না। যায় না।
কুসুমের বাসার সামনের পিচ ঢালা মসৃণ পথ ভেসে যাচ্ছে বৃষ্টিজলে, আর কুসুমের হৃদয় পুড়ে যাচ্ছে অনেক বছর আগের ফেলে আসা সাদা-কালো স্মৃতির উত্তাপে।
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নভেম্বর চলছে। অনির সাথে আজ দেখা হবে তা জানাই ছিল। এই তো ক’দিন আগেই দেখা…..
বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..
এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..