প্রক্সি
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
ডাকাতিয়ার জলমগ্ন তীরের কোল ঘেঁষে বেদে বহরের নৌকাগুলো কেমন সার বেঁধে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে অবাক দাঁড়িয়ে আছে। তাদের এ স্থির অপেক্ষায় সকরুণ জিজ্ঞাসার এক ধূসর প্রাগৈতিহাসিক ছাপ বেদনার মতো স্পষ্ট ফুটে ওঠে প্রতিদিন। আঁকা বাঁকা রেখা ধরে ফুলে-ফুঁসে ওঠা নদীটার টলমলে যৌবনের মধ্যেও তাদের এ অবস্থান আশ্চর্যরকম সংকীর্ণ, পুরোদস্তুর মায়াহীন যেন। স্থবির এ চিত্রপটের মতো চারপাশের সবুজ অরণ্যানী, নদীর ধোঁয়াটে জল সবকিছুই রঙহীন, ঝাপসা অন্ধকার। তারপরও দিনের নিয়মে নির্বিষ ঢোঁড়া সাপের মতো সেখানে গুটিসুটি হয়ে সরল সন্ধ্যা নামে রোজ নির্ভয়ে সদর্পে গিরগিটির মতো বুকে হেঁটে।
বেদে মালা সর্দারের বহরের কোথাও টিমটিম করে কুপিবাতি জ্বলেনি তখনও অথচ নদীর অন্যধারে শহুরে বিজলি বাতির আলোকচ্ছটা ফানুসের মতো জ্বলজ্বল করে সেজে উঠছিল ধীরে ধীরে। জলের গায়ে রঙিন সে আলো যেভাবে ভাঙছিল অগুনতি অজস্র ধারায় সেখানে বেদে বহরের বাতিদানে সাঁঝবাতি জ্বালানোর নিত্য নিয়মে তেমন তাড়া থাকার কথা নয়। আলো ঝলমল ঐ উত্তর পাড়ের জনবসতির সাথে এ বেদে জীবনের ফারাক অনেক- সে আলোও তাই তাদের চোখে মায়ার বিভ্রান্তি হয়ে ধরা দেয় কেবল।
সারবাঁধা নৌকাগুলোর মতো বেদেদের জীবনও এখানে নিষ্প্রভ, একঘেঁয়ে স্বপ্নের গণ্ডিও খুব সীমিত। এ জীবনের কাছে যে বশ্যতা আছে তা সর্দারকন্যা সিতারার ভালো লাগে না মোটে। ওদিকে মেঘনা-ডাকাতিয়ার উত্তাল ঢেউ ভেঙে যারা নৌকা দাপিয়ে বেড়ায় সেখানে জলের সাথে একধরনের যুদ্ধ আছে, নৈমিত্তিক বোঝাপড়া আছে, বশ্যতা নয় কেবল বশ মানানোর অহর্নিশ সংগ্রাম আছে। যদিও জলের সে উন্মদ খেলায় কখনওবা ভাঙনের মর্মভেদী হাহাকার থাকে, নিঃস্ব হওয়ার প্রবল ভয় থাকে তবুও সিতারার মুগ্ধতা সে সংগ্রামী জীবন ও মানুষগুলোকে ঘিরে। সে জীবন কল্পনা করেই সিতারার ঘোর লেগে যায়।
নদীর ওপারের ঝিলিক দিয়ে ওঠা আলোর রোশনাই বেদেদের জীবনের অন্ধকারকে দূর করতে পারেনি কখনই, কোনোদিন। অপার্থিব সে জীবনের সাথে যে তাদের জীবন সমান্তরাল সে কথা অন্যদের মতো সিতারাও জানে। আর জানে বলেই সন্ধ্যা নামলে দূরবর্তী সে আলোর অনুসরণ করে চলে তার মুগ্ধময় দুটি চোখ। অন্য আর সব দিনের মতোই কেরোসিনের ছোট্ট কুপিবাতির আলো উসকে দিয়ে আকাশের দিকে উদাস তাকিয়ে ছিল সিতারা। তার বিস্ময়ভরা চোখের কোটরে দূর জেলেপল্লীর মিটমিটে আলো উদ্ভাসিত হবার আগেই আরও স্বপ্নবতী হয়ে ওঠে সে।
বেদে বহরের অন্য সকলের চেয়ে সিতারার চিন্তা-ভাবনা, ভাবনার বিচরণ, বিচরণের গণ্ডি সব কেমন যেন আলাদা। অদৃশ্য আচারে বন্দি এ ভাসমান জীবনের প্রতি তার খুব একটা মোহ নেই, তবে একখণ্ড মায়ার প্রাবল্য আছে। অথচ আশ্চর্য কারণে তার অদ্ভুত এক টান ও অনিঃশেষ মায়া পড়ে থাকে ওপারের অজানা জেলেপল্লীর দিকে। মেঘনা মোহনার খরস্রোত ভাঙা সংগ্রামী মানুষগুলোর আটপৌরে জীবন তাকে প্রচণ্ড সম্মোহিতের মতো নিয়ে যায় সেদিকে। আর ওপারের মানুষগুলো? তাদের কথা ভেবে ভেবেই মনের কোণে সাজিয়ে নেয় তার স্বপ্ন বোনার সাধ। আর এভাবেই ধীরে ধীরে একদিন বেদে নৌকা থেকে নিতাইপুরের একজন হয়ে যায় সিতারা।
নিতাইপুরের অচেনা এক ধীবরপল্লীকে ঘিরে সিতারার গল্পটা এভাবে শুরু হয়ে যায়। যেখানে দিনশেষে ধীর পায়ে সন্ধ্যা নামত প্রতিদিন কেরোসিনের কুপি বা হারিকেনের অনুত্তাপ আলোয়। সে আলোও অত ঝকমকে নয়; যতটা না দূর থেকে দেখে অনুমান করে রোমাঞ্চিত হওয়া যায়। কিন্তু, সেখানে জীবন বদলের প্রাণান্ত চেষ্টা আছে, গতরভাঙা খাটুনি আছে, আর আছে দিনভর সে খাটুনির কিঞ্চিৎ ন্যায্য-অন্যায্য দাম। নিষ্প্রাণ সে আলোর মাঝে সেকান্দরের মতো পরিশ্রমী এক মানুষের অফুরান উপস্থিতিও ঘটে। যাকে প্রতিদিন ছায়ার মতো অনুসরণ করে যায় তারই পিঠাপিঠি ভাই বদর। পরাণ, কামরানের মতো আরও কিছু কর্মঠ মানুষ সে চিত্রপট জুড়ে থাকে যারা সকলেই ধীবরকুলের সন্তান।
ইলিশ ধরা এদের প্রধানতম জীবিকা হলেও কেমন একটা বাণিজ্য আর বন্দরের গন্ধ ও চেহারা নিয়ে দিব্যি পাল্টে যাচ্ছে নিতাইপুর নামক পরিচিত ধীবরপল্লী। সেকান্দরদের এসবে মাথাব্যথা নেই। তারা প্রচণ্ড ভালোবাসা, আঁকড়ে ধরা বিশ্বাস কিংবা বেঁচে থাকার দায় থেকে পুরাতন জীবিকা নিয়েই পড়ে আছে। দিনানুদৈনিক চাহিদা মেটানোর জীবনচক্রেই তারা আপাত খুশি।
জীবনের আবর্তে নিতাইপুর থেকে অনেক দূরের মাছঘাটে এসে একদিন তার বা তাদের সাথে পরিচয় হয়ে যায় সিতারার মতো স্বপ্নবান এক মানবীর। সেখান থেকেই পরিচয় তবে কোনো ভাবের সরল আদান-প্রদান নয়। আলাপ ঘটে নিছক জীবিকার তাগিদে, আশা-নিরাশার নিতান্ত তুচ্ছ কিছু বয়ানে। একসময় সেটাই হয়ে ওঠে তাদের যুগলবন্দি জীবনের বেঁচে থাকার রসদ ও নতুন করে স্বপ্ন বুনে যাওয়ার অভিযান। তারপর একদিন অজান্তেই লেখা হয়ে যায় সিতারা ও সেকান্দরের ভিন্ন এক গল্প। স্বপ্ন বোনার গল্প, নতুন উচ্চাশার গল্প। বেদে নয় বেনে বৌ হয়ে থাকা এক সাধারণ মানবীর গল্প।
দুই.
সেকান্দরের সাথে সিতারার তখনও পরিচয় ঘটেনি। নিতাইপুর তখনও তার কাছে কেবল ভিন্ন এক গাঁ, দূরের এক নগর। এদিকে জন্ম থেকে সিতারা যে জীবনকে সত্য বলে জেনেছে সেখানে পরিবর্তন এসেছে অনেক। পুরাতন জীবিকা ভুলে গিয়ে বেদেরা এখন কম বেশি মাছ মেরেই সংসার চালিয়ে নেয়। তবে সবসময় চাহিদামাফিক যোগান দেয়া হয়তো সম্ভব হয় না। সে কারণে সিতারাকে মাঝে মাঝে হানা দিতে হয় মাছঘাটের দিকে ক্ষুন্নিবৃত্তি নিবারণের আশায়।
সিতারার চোখে রাতদিন ঘুম আসে না তখন। ডাহুকের ডানায় রোদ ছুঁয়ে যাওয়ার মতো তার স্বপ্নও ডানা মেলে দেশান্তরী হয়। মাছঘাটের কাছে নোঙর ফেলা বিশাল সওদাগরী ডিঙা তার চোখের পাতায় নেমে বসে উন্মুখ হয়ে সে তখন অপেক্ষা করে ধীবর সেকান্দর কিংবা অন্য কারও আগমনের আশায়। তীরের কাছে ভিড় করা অলস নাওয়ের পিঠ দেখে দেখে একসময় তার চোখ চকচক করে ওঠে। অনেক রাত পর্যন্ত জেগে জেগে সেসব নির্জীব কাঠের জীবনকে পাহারা দিয়ে অদ্ভুত এক আনন্দ ও পরিতৃপ্তির গন্ধ খুঁজে নেয় সিতারা।
সময় গড়িয়ে গেছে তার মতো করে। ডাকাতিয়ার জল-দিগন্ত ছুঁয়ে সূর্যও ডুবে গেছে কত শতবার। সিতারা এখন সেকান্দরের ঘরের মানুষ হয়েছে সেও অনেকদিন আগে। বেদেজীবন এখন আর তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে না। ওদিকে অনেকদিন বাদে মাছঘাটের কাছাকাছি নাও ভিড়িয়ে বেদে নৌকার সারি দেখে হঠাৎ সিতারার কথা মনে পড়ে যায় সেকান্দরের। ক্ষীণ আলোর মতো অনুজ্জ্বল জীবন ছিল তাদের। ছই নৌকার পিঠে তাদের সে জীর্ণ জীবন চাপলেও নিশ্চিন্ত নির্ভার জীবনের মতো কোথায় যেন একটা সুখের লেশ অদ্ভুতভাবে লেপটে ছিল সেখানে। এ হয়তো কোনো মুক্তির স্বাদ এমনটাই মনে হয় সেকান্দরের।
বেলা তেতে ওঠায় তাড়াতাড়ি নৌকা ঠেলে এগিয়ে যায় পরাণ। ঘাটের কাছে মাছ নিয়ে আসা নৌকাগুলোর প্রচণ্ড ভিড় দেখে শান্ত হয়ে অপেক্ষা করে সে। ততক্ষণে মেঘনার শীতল জলহাওয়ায় সেকান্দরসহ বাকীদের গা জুড়িয়ে উঠেছে অনেকখানি। সকাল থেকে টানা খেপ মেরে চরম ধকল গেছে শরীরে। ওদিকে তীরের গা ঘেঁষে সারি সারি গজার মাছের অলস কালো শরীরের মতো আগে থেকেই বিশ্রাম নিচ্ছিল বেশ কয়েকটা বড় বড় নাও। সকালের চালান বুঝিয়ে দিয়ে আবার নতুন খেপের প্রস্তুতির আশায় যার যার মতো লগি-বৈঠা ফেলে সাময়িক বিশ্রামে এদিক ওদিক চলে গেছে জেলের দল।
ঘাটে নৌকা ভিড়লেই থমথমে মুখে নেমে পড়ে সেকান্দর। পরাণ লগি ধরে গলুইয়ে বসে থাকে নির্বিকার। বদর আর কামরান খোলভর্তি বরফ দেয়া ইলিশের বন্দোবস্তে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। সকাল থেকে টানা খেপ মেরে সকলেই বেশ পরিশ্রান্ত, ক্লান্ত। অনেকদিন বাদে সেকান্দররা আজই দল বেঁধে মাছ মারতে গিয়েছিল মোহনার দিকে। প্রথমদিনের অভিযান; যদিও তেমন জুতমতো নয়। তবে কপাল ভালো হলে কয়েকবার জাল ফেললেই মাছ যা ওঠে তাতে মনের আশ মিটে যায় ষোল আনা। সেকান্দরের পুরানো ছেঁড়া জালে আজ অবশ্য সেই কপাল জুটেনি। জালে ওঠা ক্ষীণদেহী ইলিশের শীর্ণ দর্শনে ঠিক মুগ্ধ হতে পারছে না কেউ। আপাতত তাই নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে তাদের। অভিযোগ-অভিমান করে লাভইবা কী, জীবিকা বলে কথা।
কয়েকদিন আগেই মাত্র সরকারি নিষেধাজ্ঞা শেষ হলো। সেকান্দররা তখন টুকটাক জাল ফেললেও জালের মেরামতিতেই মেতে ছিল দিনরাত। নিতাইপুরের মাঠ-ঘাট-জল-কাদাকে ঘিরে ধীরে ধীরে আরও নানান পেশার জন্ম হয়েছে এখন। ইলিশ ধরায় নিষেধ থাকলে বায়নার টাকা হাতে নিয়ে কেউবা জাল বুনে, কেউবা ডিঙা বানায়। বড় বড় মহাজনের কাঁচা পয়সার বদৌলতে আজকাল বড় বড় ট্রলার বানানোসহ দু’ একটা বরফকলও নাকি গড়ে উঠছে ফাঁকে ফাঁকে। আধুনিক যান্ত্রিক ঘর্ঘরানির সেসব আওয়াজে সেকান্দরদের একদম মন নেই।
আজকাল সিতারা অবশ্য সেকান্দরকে নতুন স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেছে। সেই ভেবে সে নিজেও আকাশসমান স্বপ্ন দেখে; হয়তো তার ভাষায় ‘কহর দরিয়া’র মতো। চাঁদ সওদাগরের মতো একদিন বড় একটা নাও নিয়ে সিতারাকে নিয়ে ভেসে যাচ্ছে দূরদেশে। আরও দেখে সব টাকা শোধ করেছে মহাজনেরÑ তার ভিটায় চলছে নতুন ঘরের চালা বাঁধার আয়োজন। এসব স্বপ্ন একসময় ঝাপসা হয়ে এলেও হেতেম ব্যাপারী বা রশিদ মণ্ডল আর কারো উপরই কোনো ভরসা নয়। এ ভাবনাটাই রাতদিন মাথায় ঘুরঘুর করছে তার।
সেকান্দর এগিয়ে গিয়ে হেতেম ব্যাপারীর আড়তের বাইরে গোঁজ ধরে বসে থাকে। সাদাসিধে চেহারার মস্ত ঘড়েল এক মহাজন হেতেম ব্যাপারী তবুও মেঘনার মাছঘাটে আনাগোনা করা সকল জেলের কাছে তিনি মস্ত ভরসারই একজন। সেকান্দরেরও আগাগোড়া ভরসা তার উপর। গোটা দু’-চার দশজন বড় আড়তদারের মধ্যে তার একারই যে জমজমাট কারবার রয়েছে একথা সকলেই জানে। জেলেদের কাছে তিনি হলেন বড় কর্তা চড়া সুদে দাদন দেয়াই যার কাজ। সুরমা লাগানো চোখে ধবধবে সাদা পাঞ্জাবী গায়ে তিনি যখন আড়তে গিয়ে বসেন চারদিকে আতরের খোশ গন্ধ লুটিয়ে পড়ে। তবে সে গন্ধ বেশিক্ষণ টিকে না। একসময় তা মিলিয়ে গিয়ে ইলিশ আর জেলেদের নোনা ঘামের গন্ধে ভুরভুর করে ওঠে চারদিক।
সেকান্দরকে আড়তের বাইরে একা বসে থাকতে দেখে মাছঘাটের চাতালের দিকে পিছু নেয় বদর আর কামরান। জীবনে করবার মতো আর কিছু তারা শিখেনি কোনোদিন। তবে মাছ মারার পূর্বপুরুষের নেশা আঁকড়ে ধরতে গিয়ে শিখে গেছে অন্যের উপর নির্ভরতা। ঘরের ক্ষুধার্ত মুখগুলোর পেটে অন্ন নেই, মাছ ধরার নিজের নৌকা নেই, কয়েকজন মিলে একবার অভিযানে নামার খাই-খোরাকি নেই পর্যন্ত; ব্যস, মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে চেয়ে নাও দাদন। এভাবেই চলছে হিসাব না বুঝা মানুষগুলোর নির্লোভ জ্যামিতিক জীবন যেখানে হিসাবনিকাশ বড় জটিল ও গোলমেলে।
তিন.
সেকান্দরসহ চারজনের দলটি বরাবরই হেতেম ব্যাপারী থেকে আগাম টাকা গুনে নিয়ে মাছ ধরতে যেত মেঘনায়। অভিযান শেষে যার যার মতো হিস্যাও বুঝিয়ে দিত কড়ায় গণ্ডায় বিনিময়ে পাওনা বুঝে নিলেও কোথায় যেন একটা ফাঁক থেকে যেত বরাবর। পাহাড়সমান মাছ নিয়ে ফিরলেও কিছুতেই যেন এ ঋণ থেকে মুক্তি মিলছিল না তাদের। এদের মধ্যে সেকান্দর গত আশ্বিনে তার নিজের ভিটি বন্ধক রেখেছিল মহাজনের কাছে। সাদা স্ট্যাম্পে টিপসই মেরে মহাজন জোর করে তা রেখে দিয়েছিল তার ডেরায়। কিন্তু, সে লেনদেন সম্পূর্ণ মিটে যাবার আগেই আজ সে নতুন বায়না নিয়ে হাজির হয়েছে। তার এ মনের কথা কেবল বদরই জানে। জাল বা নৌকা নয়, শেষবারের মতো আরও কিছু টাকা হাওলাত নিবে মহাজনের কাছ থেকে। জারুল কাঠের বিশাল একখানা নাওয়ের বায়না দিয়েছে তালেব্বর মণ্ডলের কাছে।
আগের খেপের এক কানাকড়িও শোধ দেয়া হয়নি মেয়েটার অসুখ হয়েছিল বলে। সিতারাই দিতে দেয়নি। তাই এ বায়না শোধের টাকা কীভাবে চাইবে তাই ভেবে থম ধরে বসে থাকে সেকান্দর। মরসুমের প্রথম চালানে তারা মোটে খুশি না হলেও মহাজনের মুখ ঝামটা খাওয়ার মতো একেবারে মন্দও কিছু নয়। সেকান্দরের এ নিশ্চুপ বসে থাকার ফাঁকেই আজ সব কাজ সেরে নিয়েছিল বদর আর কামরান। লেনদেন সব মিটিয়ে দিয়ে তার কাছে ফিরে আসে বদর।
সেকান্দর, চুপ হইয়া আছস ক্যান? কিছু কসনা যে?
কী কমু? ফোঁস করে ওঠে সেকান্দর।
ল যাই ঘাটের দিকে। মহাজন বইকালে আইতে কইছে। তহন না হয় পাওনা বুইজ্যা লমু।
বইকাল না; অহনই কিছু টাকা ল মহাজনের কাছ থেইকা। মাছ না মারলে খামু কী? এইবার তো এমনিতেই ম্যালা দিন মাছ মারন বন্ধ আছিল। সামনে একদিনও আর কামাই দিমু না। ঝড়ের মরসুমও সামনে।
তাইলেতো পরতিদিন খেপ দেওন লাগে সেকান্দর ভাই, পেছন থেকে বলে ওঠে কামরান।
লাগলে তাই দিমু। তারপরই হঠাৎ কথার বাঁক বদল করে সেকান্দর জানান দেয়, আমি একখান বড় নাও বানামু। তালেব্বরের কাছে কাইল বায়না দিছি। মহাজনের লগে আর নাই। মাছ ধরমু একা। তার সব টেকা শোধ দিয়া দিমু।
হ্যায় মনে হয় এই কথা খুব মানব? বলে ওঠে বদর।
না মানুক। যেমনেই হোক একটা বুঝ দিমু। আস্তে আস্তে বেবাক শোধ দিয়া দিমু তার। ঘরের তিন ছটাক ভিটি তো আগেই বন্ধক দিছিলাম তারে। তয় দাদন নিয়া আর না। এ বড় ফাঁকের কারবার।
তুই একা পারবি সেকান্দর? আমরা থাকমু না? দৃঢ়চেতা সেকান্দরের দিকে চেয়ে বলে ওঠে বদর। সেকান্দরের মুখের পেশী আরও টান টান হয়ে ওঠে সেখানে রক্তের তেজী বান ডেকে যায় তখন। জোরে হুংকার দিয়ে বলে ওঠে,
আমি একা মানে, তোরার লগেইতো কাম। তোরা বেবাকতেই থাকবি আমার লগে। নাইলেতো জানে পানি থাকব না। আমার ছেঁড়া-ফাটা হইলেও বড় জাল আছে। বাকী একখান বড় নাও হইলেই সব কাম গুছাইয়া নিবার পারমু।
সেকান্দরদের এ আলোচনায় হেতেম ব্যাপারী উপস্থিত না হয়েও এক শক্তিশালী প্রতিপক্ষ হয়ে থেকে যায় অদৃশ্যে। সেকান্দরের মুখে বায়নার টাকার কথা শুনে একেবারে লাফিয়ে ওঠে লোকটা।
আমার থেইকা টাকা নেস আর মাছ দেস ওই কানা সর্দাররে?
কানা সর্দার মানে রশিদ মণ্ডল। মাছঘাটের বহু পুরাতন আড়তদার। সপ্তাহে গড় পড়তা ভালো দর দেয় অন্য যে কোনো মহাজনের চেয়ে। জেলেদের থেকে মণকে মণ মাছ নিলেও দর কাটা নিয়ে কোনো হাঙ্গামা হয় না। লেনদেনের সময়ও খুব একটা রা করে না মুখে।
হ্যায়তো গতবার ভালা দাম দিয়া ইলিশের বেবাক চালান একাই লুট করছিল। আমরা আর কী করমু তার কথার উপরে?
ক্যান, আগাম টাকা নেয়ার বেলায় হুঁশ আছিল না? তহনতো পিছনে লাইগা ছিলি আঠার মতো।
আর এরুম হইতো না।
এইবার মাছ আনলে দেখমুনে কথার কেমুন ঠিক থাকে।
সেকান্দর আর হেতেম ব্যাপারীর এ নিষ্ফল কথোপকথন মাছঘাটের হৈ হট্টগোলে মিশে যায় সেদিনের মতো। তবে তার কাছ থেকে কোনো আশার বাণী না পেয়ে সেকান্দরের মুখটা পাংশু বিবর্ণ হয়ে ওঠে।
চার.
মেঘনা-পদ্মা আর ডাকাতিয়ার সঙ্গমের জায়গাটা ‘কহর দরিয়া’র মতো ঠেকে সেকান্দরের কাছে। তা না হলে অমন বড় বড় লঞ্চ আর বাণিজ্যের বিশাল জাহাজ ভাসছে কেমন করে? ডিঙাবাহী চাঁদ সওদাগরের কিস্সাতো তার দাদীর মুখ থেকেই শুনেছে কতবার। সেসবের তুলনায় ইলিশের ভাসমান নৌকাগুলো তো একদম নস্যি।
সিতারার কানের মাকড়ি ও নাকফুল বেচে অবশেষে একদিন সেকান্দর তার নাও ভাসিয়েছে মেঘনায়। এ যে দীর্ঘদিনের লালিত কোনো স্বপ্ন নয়, বরং তার চেয়েও বেশি কিছু। রূপকথার আখ্যানের মতো এ ছিল সপ্তডিঙাবাহী কোনো সওদাগরের বাণিজ্য সুখযাপন। ‘কহর দরিয়া’র বুকে পাল তোলা কোনো সিন্ধুনাবিকের বাণিজ্য যাত্রার প্রস্তুতির মতো সুখ ও রোমাঞ্চ কল্পনা করে সেকান্দরের দিন কাটছিল তখন।
ইলিশযাপনের মধ্যে সেকান্দরের এখন দিনযাপনের স্বর্গসুখ। মেঘনার নধর গোলগাল মনোরম সব ইলিশ ধরে দিন কাটে তার। কাঁড়ি কাঁড়ি রূপালি সোনা, খোলভর্তি চাঁদি রঙের ঝকঝকে মোহর কিংবা মেঘনা তলের অমূল্য গুপ্তধন নিয়ে রাতদিন সুখের বেসাতি চলে তার। বদর, কামরান আর পরাণকে সাথে নিয়ে সেকান্দর যেন তার বেনিয়ার জাহাজ সাজিয়ে দাপিয়ে বেড়ায় জলে। মাঝে মাঝে তার নেশা ধরে গেলে নদীর অতলে ডুব দিয়ে নদী সেঁচার সাধও জেগে ওঠে। তখন আর ঠিক হুঁশ থাকে না, আরও জেদী হয়ে ওঠে মন। তারপর অবাধ্য ঢেউয়ের সাথে পাল্লা দিয়ে কখনও নাও বেয়ে অবিরাম চলে যায় মেঘনার আরও পেটের দিকে, একেবারে নতুন জেগে ওঠা চর ঈশানবালার কাছে।
শেষ বিকালের দিকে হঠাৎ আঁধি নেমে আসলে সেকান্দররা সেদিন ঈশানবালার চরের কাছেই নোঙর ফেলে। ঝড়ের মরসুম, শঙ্কাও লাগে বেশ। নিতাইপুরের কাছে এবার মেঘনার ভাঙন অন্যবারের চেয়েও প্রবল। ওদিকটায় ভেঙে ভেঙে নতুন চর জাগছে ঈশানবালার কাছে, সাথে জেগে উঠছে অবারিত এক স্বপ্নকুসুমও। তবে তার চেয়েও বড় কথা হলো সারাদিনে শরীরের সবটুকু ঘাম ঝরিয়েও খুব একটা ইলিশ ওঠেনি জালে। এখান থেকে নিতাইপুর জেলেপল্লী অনেক দূর। তাই ফিরে যাবার চিন্তা বাদ দিয়ে সেখানেই রাত কাটানোর পণ করে তারা। এদিকে সন্ধ্যার পর শোঁ শোঁ আওয়াজে বাতাস বইছে অবিরাম। চরে নৌকা ভিড়ালেও ঝড়ের আশঙ্কায় এখন ঢিপঢিপ করছে সেকান্দরের বুক।
ঈশানবালার দিকে দলা পাকানো মেঘের কালো শামিয়ানা দেখে ক্ষণে ক্ষণে মোচড় দিয়ে উঠছিল সিতারার বুক। সে জানে সেকান্দরের নেশা ধরে গেলে সে মাঝে মাঝে নাও বেয়ে ওদিকেই যায়। এদিকে ঝড়ের আভাস পেয়ে আগে থেকেই মাছ ধরার নৌকাগুলো ভিড়ছিল একে একে। অস্বাভাবিক ভয়ার্ত মুখ নিয়ে ফিরছিল জেলেরা। ফিরে আসা নৌকাগুলোর বুক থেকে শুনতে পাওয়া গভীর দীর্ঘশ্বাসের শঙ্কিত শব্দ আর্তনাদে বিবর্ণ করে তোলে তাকে। সবাইকে জিজ্ঞাসা করেও খোঁজ মেলেনি সেকান্দরের, বদর কিংবা পরাণের।
পৃথিবী কাঁপিয়ে ঝড়ের তাণ্ডব শুরু হয়ে যায় সন্ধ্যার কিছু পরে। একটি ছোট্ট কুঁড়ের কোণে নির্ঘুম শঙ্কিত বুকে মেয়ে শুকতারাকে আঁকড়ে ধরে সারারাত অপেক্ষায় কাটিয়ে দেয় সিতারা। মোহনার কাছে তটরেখার শেষবিন্দু যেখানে সেখান থেকে মাত্র কয়েক হাত দূরেই ছিল তার বসত। মাঝরাতে কেয়ামতের দুন্দুভি হাঁক বাজিয়ে যখন প্রলয় নেমে আসে মেঘনার তীরে; সেকান্দর-সিতারার শেষ আশ্রয়ের নরম মাটির বসত টালমাটাল ঢেউয়ের মন্থনে দুলে দুলে ওঠে বারবার। ভাঙনের শেষ ছোবলে সর্বস্বান্ত হয়ে ওঠে নিতাইপুরের ধীবরপল্লীর ঘরগুলো। শুকতারাকে হারিয়ে আরও সঙ্গীন হয়ে ওঠে সিতারার জীবন। এদিকে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া সেকান্দরের জন্য অপেক্ষা কয়েকদিন, কয়েক মাস থেকে অবশেষে বছরের হিসাবে গিয়ে ঠেকে সিতারার।
ডাকাতিয়ার ওপারের নিতাইপুর এখন নতুন পত্তনী নগর তবে বিচ্ছিন্ন কিছু জেলেবসতি আছে ক্ষীণ প্রদীপের মতো। পূর্বের সে জনপদ ঘিরে সরগরম অবস্থা আগের চেয়েও ঢের বেড়েছে। রাতের বুক চিরে ঝলমলে লঞ্চ যখন সাইরেন বাজিয়ে অচিন নগরে পাড়ি দেয় সিতারার প্রাচীন আশা জেগে ওঠে আরেকবার। নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া ধীবরপল্লীর স্থলে নতুন জেগে ওঠা জনপদের উজ্জ্বল আলো অনুসরণ করে সিতারার আশ্চর্য নির্বাক চোখ দুটো আকাশের গায়ে গিয়ে থমকে দাঁড়ায়। আকাশ দেখে দেখে একসময় তার চোখ ক্ষয়ে আসে। কিন্তু, ক্ষয়ে আসা সে চোখ চাঁদ সওদাগরের মতো ডিঙাবাহী কোনো আদমকেই খুঁজে ফিরে নেয় আবার।
এই বুঝি মেঘনার বুক থেকে ফিরল সেকান্দরের নাও? সিতারার ঝাপসা চোখের তারায় দীর্ঘ ছায়া ফেলা আবছা কোনো অবয়ব তখন হয়তো নোঙর ফেলে বেদে বহরের কাছে কোথাও। ছই নৌকার ভেতর থেকে কম্পিত হাতে পর্দা সরিয়ে চারদিকে উঁকি দিয়ে দেখে …….না, কোথাও কেউ নেই। আগের মতোই ছলাৎ ছলাৎ শব্দে ঢেউ ভাঙে ডাকাতিয়া।
বেদে বহরের জৌলুসহীন নৌকায় জীবন সাজিয়ে ভাবলেশহীন সিতারা অনাদিকাল এভাবে নিশ্চুপ বসে থাকে। কীসের অপেক্ষায় অধীর হয়ে বসে থাকে কে জানে? সন্ধ্যার অন্ধকার আসমানে নীরবে আজও কী যেন খুঁজে বেড়ায় সে। তবে কি হারিয়ে যাওয়া প্রাচীন কোনো ইতিহাস খোঁজে সে? নাকি খোঁজে মুছে যাওয়া আদমের সুঠাম কোনো সুরত, যে কিনা তাকে সোহাগ সুখে বিবশ করে দিত রাতদিন নিতাইপুরের ধীবরপল্লীতে। নাকি আসলে খুঁজে বেড়ায় মেঘনার জলে নিভে যাওয়া তার ছলকে ওঠা বাসনার বিসর্জিত প্রতিদান?
মাঝে মাঝে গন্তব্যে যাওয়া লঞ্চের তারস্বরে বেজে যাওয়া সাইরেনের আওয়াজে সিতারার অসার নিস্তব্ধতা কাটে। দিনযাপনের ধারাবাহিকতায় সাময়িক ছেদ পড়ে তখন, স্বপ্ন ভাবনার পরম্পরায় বিচ্ছেদ ঘটে হঠাৎ। তখন হয়তো অজান্তেই চোখ নামিয়ে আনে আকাশ থেকে। ওপার জনপদের জ্বলজ্বলে আলো থেকে নিজের জীবনের আলো আবার খুঁজে নিতে চায় হয়তো। কিন্তু, সে আলোও বেশিক্ষণ থির হতে চায় না। স্বপ্নভাঙা জীবনের মতো ডাকাতিয়ার বুকে ছলকে ওঠা মৃদু ঢেউয়ের তোড়ে কখন যে তা ভেঙে চূর্ণ হয়ে পড়ে সিতারা তা জানে না।
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নভেম্বর চলছে। অনির সাথে আজ দেখা হবে তা জানাই ছিল। এই তো ক’দিন আগেই দেখা…..
বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..
এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..