তাঁর একাত্তর
‘যুদ্ধের সময় ব্যক্তিগত লোভ, আবেগ বড় শত্রু। অনেকেই যুদ্ধের ময়দান থেকে বা পলাতক অবস্থায় মাকে…..
শাকুর মজিদের নানা পরিচয়। পেশায় স্থপতি হলেও নাট্যকার, কথা সাহিত্যিক, আলোকচিত্রী, চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবেও তাঁর স্বতন্ত্র পরিচয় আছে। জন্ম ১৯৬৫ সালের ২২ নভেম্বর, সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার থানার মাথিউরা গ্রামে। পড়াশুনা- মাথিউরা উচ্চ বিদ্যালয়, ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়। দেয়াল-পত্রিকা ও স্কুল ম্যাগাজিনে কবিতা ও গল্প দিয়ে লেখালেখি শুরু। কুড়ি বছর বয়সে তাঁর লেখা নাটক প্রচার হয় সিলেট বেতারে। এর পর টেলিভিশন ও মঞ্চের জন্যে নাটক লিখেছেন। দেশ বিদেশ ঘুরে বানিয়েছেন তিন শতাধিক প্রামাণ্যচিত্র। ঘুরে বেড়ানো বড় শখ। তিরিশাধিক দেশ ভ্রমণ করেছেন। লিখেছেন ২১ টি ভ্রমণগ্রন্থ, ৭ টি আত্মজৈবনিক ও স্মৃতিগদ্য । এ ছাড়াও ছোটগল্প, নাটক, স্থাপত্য এবং আলোকচিত্রের উপর রয়েছে ৬ টি বই। শাকুর মজিদের পুরস্কারের ডালি বেশ সমৃদ্ধ । বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার (ভ্রমণ সাহিত্য) ২০১৭, আইএফআইসি ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার ২০১৬, সমরেশ বসু সাহিত্য পুরস্কার ২০১৫, রাগীব-রাবেয়া সাহিত্য পুরস্কার ২০১৩, সিলেট শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার (চলচ্চিত্র) ২০১৬ ছাড়াও টেলিভিশন নাটক রচনা ও পরিচালনার জন্য ২০০১ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে শ্রেষ্ঠ নাট্যকার ও পরিচালক হিসাবে বিভিন্ন সংগঠনের দেয়া প্রায় দেড় ডজন পুরস্কার তাঁর ডালিকে সমৃদ্ধ করেছে। ব্যাক্তিজীবনে শাকুর মজিদ একজন পেশাদার স্থপতি। স্ত্রী অধ্যাপক ডঃ হোসনে আরা জলী একজন লেখক ও গীতিকার। দুই পুত্র- ইশমাম ও ইবন।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: শাকুর ভাই, অভিনন্দন আপনাকে। তেপ্পান্ন পেরিয়ে চুয়ান্নতে পা দিচ্ছেন। কাল আপনার জন্মদিন। এর আগেরদিন আমরা আপনার জীবনের দিকে পেছন ফিরে তাকাই। শাকুর ভাই, তেপ্পান্ন বছর বেশ দীর্ঘ সময়, আপনি যদি আপনার সর্বশেষ স্মৃতির দিকে ফিরে তাকান, আপনার কী কী মনে পড়ে?
শাকুর মজিদ: আসলে এই পঞ্চাশোর্ধ বয়সে এসে আমার কাছে যেটা মনে হয়েছে, এই পৃথিবীতে এই পর্যন্ত যতগুলো মানুষের জন্ম হয়েছে, বলা হয়ে থাকে দুইশ কোটি বছর থেকে মানুষ বসবাস করছে, এরমধ্যে দশ হাজার বছরের মানুষের যে সভ্যতার ইতিহাস, সেটা আমরা জানি; এর আগের মানুষের কথা আমরা জানি না; আমার কাছে মনে হয়েছে, এই দশ হাজার বছরে যত প্রজন্মের মানুষ এ পর্যন্ত বসবাস করেছিল, আমি তাদের মধ্যে সবচে’ ভাগ্যবানদের দলের একজন। তার কারণ, আমার জন্ম ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে। মুক্তিযুদ্ধের সময় বয়স ছয় বছর। বাংলাদেশের জন্ম এবং বাংলাদেশের জন্ম-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ যতগুলো স্তর অতিক্রম করেছে, এর প্রত্যেকটার সাথে আমার সংশ্লিষ্টতা আছে। এবং এই জিনিসগুলো আমি দেখার সুযোগ পেয়েছি। এর বাইরে, ঊনিশ শতকের গোড়র দিকে যে শিল্প-বিপ্লবের সূচনা হয় পৃথিবীতে; যার পর থেকে পুরো পৃথিবীটা বদলে যেতে শুরু করে, এই বদলে যাওয়ার সর্বশেষ স্তরে এসেও আমি কিন্তু এই সভ্যতা দেখার সুযোগ পেয়েছি। এনালগ যুগের সর্বশেষ প্রযুক্তিটাও আমি দেখেছি, আবার ডিজিটাল যুগের সূচনাটাও আমার হাত দিয়ে হয়েছে। পৃথিবীতে কম্পিউটার যখন প্রথম আসে, তখন হয়তো আমার জন্ম হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে প্রথম প্রজন্মের যে কম্পিউটারটা এসেছিল, সেটা যেমন আমার দেখার সুযোগ হয়েছে, এই কম্পিউটারের যতগুলো বিবর্তন হয়েছে, সেটাও আমার দেখার সুযোগ হয়েছে। গ্রাহাম বেলের টেলিফোন আবিষ্কারের পর থেকে দীর্ঘ প্রায় দেড়শ বছর টেলিফোন প্রায় একই অবস্থায় ছিল, এর সর্বশেষ অবস্থাটা আমি দেখেছি, উপভোগ করেছি; আবার এই টেলিফোনের বিভাজিত বিবর্তিত যে রূপ এসেছে, তার সর্বশেষ প্রযুক্তিটাও আমি ব্যবহার করার সুযোগ পাচ্ছি। আমার জন্ম যদি এর থেকে আরো পঞ্চাশ বছর আগে হতো এবং এখন থেকে আরো পঞ্চাশ বছর আগে আমি মারা যেতাম, তাহলে এই প্রযুক্তির পরিবর্তনের ইতিহাসটা আমার জানা থাকত না। আবার এমন যদি হতো, আমার জন্ম সেই সময়ে না হয়ে এই সময়ে হতো, তাহলে আমি আগের পৃথিবীর যে রূপটা ছিল, সেটা আমার দেখা হতো না। সেই বিবেচনায় আমি মনে করি আমি খুব ভাগ্যবানদের দলে।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: শৈশবের সর্বশেষ কোন স্মৃতি আপনার মনে পড়ে?
শাকুর মজিদ: বারো বছরের আগের সময়টা পর্যন্ত সম্ভবত শৈশব বলে। টিন থেকে কৈশোরের সূচনা। থারটিনের আগে পর্যন্ত সবচে’ কঠিন যে স্মৃতিটা আমার মনে পড়ে, আমি প্রথম যেদিন আমার গ্রাম ছেড়ে ক্যাডেট কলেজের উদ্দেশে রওনা দিলাম; সেটা ছিল ১৯৭৮ সালের ২৩ জুন। ২৫ জুন ছিল আমার ক্যাডেট কলেজে ভর্তির দিন। আমার বাড়ি সিলেটের একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে, গ্রামে। সেখান থেকে চট্টগ্রাম যেতে আমার দুইদিন সময় লাগবে, সেই বিবেচনায় আগেভাগে আমার বাড়ি থেকে বেরোনো। আমি আমার গ্রামের বাড়ি থেকে বেরোলাম, আমাকে একটা গ্রান্ড ফেয়ার ওয়েল দেয়া হলো। গ্রামের প্রচুর মানুষ আমাকে দেখতে এসেছে, আত্মীয়-স্বজনরা আগের দিন এসেছে। আমাকে নৌকায় তুলে দেয়া হলো। আবার অনেক কান্নাকাটিও হচ্ছে। যেন আমি একেবারে চলে যাচ্ছি এরকম কিছু। তিন কিলোমিটার মতো নৌকা করে ব্যাগ-বোচকা নিয়ে এক জায়গায় গেলাম। তারপর একটা বাস আসল সেই বাসে করে সিলেটে গেলাম। সিলেটে সেদিন থাকলাম। রাতের ট্রেনে সিলেট থেকে চট্টগ্রাম গেলাম। আমার বাবা সঙ্গে ছিলেন। ওই যে গ্রাম ছাড়ার যে স্মৃতিটা, ওইটা আমাকে সব সময় খুব ভাবায়। আমার শৈশবের মনে রাখা মতো স্মৃতি। সেই গ্রামটা এখন আর সেই গ্রাম নেই। চট্টগ্রাম থেকে সিলেট যাওয়ার জন্য এখন আর কোনো বেগ পেতে হয় না। আমার বাড়ি থেকে সিলেটে পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মধ্যে চলে আসতে পারি। যে উঠান থেকে আমি বেরিয়েছিলাম, শীত-গ্রীষ্ম যে কোনো মৌসুমে এই উঠান থেকে আমি গাড়ি করে ঢাকার বাড়ি পর্যন্ত চলে আসতে পারি। গ্রামে আমার বাড়িটা ছিল দ্বীপের মতো একটা জায়গায়। বর্ষাকালে চারদিকে পানি থাকত। নৌকা ছাড়া বাড়ি থেকে কোথাও বেরোনো যেত না। সেই সময়টাও আমি পার হয়ে এসেছি। আমার শৈশবের স্মৃতি বলতে আমার গ্রামের যে স্মৃতিগুলো, সেটাই আমাকে সব সময় ভাবায়। আমার বেশিরভাগ লেখার মধ্যে এই গ্রামটাকে নিয়ে আসার চেষ্টা করি।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: এবং সেই গ্রামের পটভূমিতেও আপনি প্রচুর নাটক লিখেছেন। যেটা জানতে চাই শাকুর ভাই, আপনার পরিবার আপনাকে গ্রান্ড ফেয়ার ওয়েল আপনাকে দিল, আত্মীয়-স্বজনরা আগের দিন থেকে এসে থাকছে, অনেকে কান্নাকাটি করছে, এই সময়ে এটা আর ঘটে না।
শাকুর মজিদ: সেই মানবিকতা তো আমাদের মধ্যে কমে এসছে। শুনেছিলাম, আমার মা আমাকে বিদায় দেয়ার পর উঠানে লুটোপুটি করে কান্নাকাটি করছিল—ছেলে একেবারে বুঝি চলে গেছে। আর এখন উনি আমাকে ইমোতে ফোন করে দেখান, এই দ্যাখ গাছে এই এই সব্জিটা ফলছে।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: শাকুর ভাই, আমার কথা বলছিলাম আপনার শৈশবের স্মৃতি নিয়ে। আপনি বলছিলেন, সেই সময়কার মানবিকতা এখন আর পাওয়া যায় না।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: আবেগের ধরনেও পরিবর্তন এসেছে।
শাকুর মজিদ: ধরো, একটা খবর পাওয়ার জন্য আমাকে চিঠির অপেক্ষা করতে হতো। একটা চিঠি লিখে সেই চিঠির জবাব না পাওয়া পর্যন্ত একটা বিষয় আমি জানতে পারতাম না। তো চিঠির বিষয়টি উঠে গেছে। আমাদের জীবনযাপন পদ্ধতি অনেক দ্রুত হয়ে গেছে। এটাতে আমি মনে করি, আমাদের আয়ু অনেক বেড়ে গেছে। আয়ু বেড়ে গেছে এই অর্থে বলছি, বায়োগ্রাফিক্যাল যে এজ আমাদের আছে, একজন মানুষ দশ বছরে যে পরিমাণ কাজ করতে পারত, এখন কিন্তু সেই কাজ দুই তিন বছরে করে ফেলতে পারে। যে কাজটা করার জন্য আমার এক সপ্তাহের অপেক্ষা করতে হতো, সেই কাজটা আমি একদিনের মধ্যে করে ফেলতে পারছি। আমাদের কর্ম-ক্ষমতা বেড়ে গেছে প্রযুক্তির ব্যবহারে। এটাও কিন্তু আমি এখন উপভোগ করছি। আবার যখন এটা ছিল না, সেই সময়টাও আমি দেখে এসেছি। এবং সেটাও আমাকে উপভোগ করতে হয়েছে। এই যে পরিবর্তনের বিষয়টা, জাগতিক বিষয়আশয়ের পরিবর্তন, আবেগের পরিবর্তন, প্রযুক্তির পরিবর্তন–এই জিনিসটা আমি দেখেছি বুঝেছি এবং তিনটা প্রজন্মের পরিবর্তনের ব্যবধানের বিষয়টা আমি দেখেছি। এটা দেখতে গিয়ে আমার যেটা হয়েছে, এই সময়ের তরুণ প্রজন্মের যে কালচার, এটাতেও আমি মোটামুটি অভ্যস্ত। আবার আমি যে কালচারে বেড়ে উঠেছিলাম, এই প্রজন্ম যে সেটা পাচ্ছে না, এটা নিয়েও আমি খুব খুশি। আমি আমার প্রজন্মের সাথেও আছি। আবার একেবারে নতুন প্রজন্মের সাথেও আছি।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: তারমানে আপনি একজন আধুনিক মানুষ হিসেবে নিজেকে সব ময় নবায়ন করেছেন।
শাকুর মজিদ: আমি প্রতিটা সময় নবায়ন করার চেষ্টা করি। যখন যে প্রযুক্তিটা আমার কাছে এসেছে, আমি সেটাতেই আপগ্রেডেট হয়েছি।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: আপনাদের সময়ের মানুষদের মধ্যে এটা খুব কম পাওয়া যায়।
শাকুর মজিদ: আমরা এর সর্বশেষ প্রজন্ম। আমাদের থেকে যাদের দশ বছর বেশি বয়স, তারা এখানে খুব একটা অভ্যস্ত হয় নাই। যাদের পঞ্চাশ বা এর কাছাকাছি বয়স, তারা দুটোই পেয়েছে। প্রজন্মের বয়স তো পঁচিশ বছর হিসেবে করা হয়। প্রতি পঁচিশ বছরে একটা প্রজন্মের হিসাব ধরা হয়। সেই হিসেবে পঞ্চাশ যে পেয়ে গেছে, সে দুটো প্রজন্ম পেয়ে গেল ধরে নেয়া যায়। এবং এই দুটো প্রজন্মের সবটুকুরই সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার সুযোগ যে কয়জন পেয়েছে, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের দশ হাজার বছরের সভ্য মানুষদের, এই দলের আমি একজন।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: জনাব মরহুম আব্দুল মজিদ এবং ফরিদা খাতুনের বড় ছেলে আপনি। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে আপনি সবার বড়। বড়ছেলে নামে সম্প্রতি একটা নাটকও হয়েছে। বড়ছেলের চাপ কখনো অনুভব করেছেন?
শাকুর মজিদ: এটা অনেক বেশি করতে হয়েছে। বড়ছেলেরা সব সময় সুবিধাভোগী থাকে। সুবিধাভোগী এই অর্থে বলছি যে, বড়ছেলে হিসেবে আমার পরিবারের সবচে’ বেশি এটেনশন পেয়েছি আমার পিতামাতার। আমার পাঁচ ভাইবোনের আর কারো সুযোগ হয়নি, গ্রামের গণ্ডি পেরিয়ে ক্যাডেট কলেজের মতো একটা জায়গায় বা বাইরে এসে পড়াশোনা করার। প্রথম ছেলে হিসেবে আমার সে সুযোগ দেয়া হয়েছিল। সেটা আমি পেয়েছি। এই সুবিধাটা পাওয়ার পুরাটা আমি কাজে লাগাতে পারিনি এই কারণে, আমার বয়স যখন কুড়ি, মানে আমি ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে বুয়েটে ভর্তি হয়ে বসে আছি। এই সময়ে আমার বাবা আটচল্লিশ বছর বয়সে মারা যান। বাবার এই মৃত্যুটা কাণ্ডারি বিহীন নৌকায় পরিণত করে পরিবারটাকে। তখন একটা অপরিণত বয়সের ছেলে আমাকে সংসারের হাল ধরতে হয়েছিল।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: তখন আপনার বয়স কত?
শাকুর মজিদ: কুড়ি। ১৯৮৫ তে মারা গেছেন তিনি। আমার ১৯৬৫ তে জন্ম। তো বিশ বছর বয়সে আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র, তখন আমি পরিবারের সিদ্ধান্তদাতা। এবং আমার উপর নির্ভর করছে পরিবার। এই রকম একটা অবস্থা ছিল।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: তারপর আপনার ভাইবোন এবং মায়ের কী হলো। আমি জানি আপনার মা এখনো আছেন। আপনার সাথে মায়ের অসামান্য সম্পর্ক, যে সম্পর্ক এখন সচরাচর দেখা যায় না। এই যে প্রায় কাণ্ডারিহীন একটা নৌকার হাল ধরলেন, প্রাথমিকভাবে কী কষ্টগুলো গেছে?
শাকুর মজিদ: এটা নিয়ে বিস্তারিত লিখেছি। আমার একটা বই বেরুচ্ছে এবার। যার নাম হচ্ছে বুয়েটকাল। বুয়েটকালে আমি আমার এই সংগ্রামের গল্পগুলো লিখেছি। নীল স্যুটকেস নামে আরেকটা আত্মজৈবনিক উপন্যাস লিখছি, সেখানেও আছে।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: তবু ছোট্ট করে কিছু বলেন।
শাকুর মজিদ: উপার্জনের জন্য আমাকে খুব উঠে পড়ে লাগতে হয়েছিল। এবং এটা করতে গিয়ে, মেট্রিক ইন্টারমিডিয়েটে ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট করার পরেও বুয়েটে আমার পড়শোনার রেজাল্টটা অত ভালো আসে নাই। আমি একটা সিম্পল হায়ার সেকেন্ড ক্লাশ নিয়ে বেরিয়েছি বুয়েট থেকে। এইটুকু আমি হারিয়েছি। আর এরই মধ্যে আমার পরিবারটাকে সুচারুরূপে চালিয়ে যাবার জন্য যা যা কিছু করার করেছি। আমি টিউশনি করে অনেক টাকা কামাতাম। এরমধ্যে আমি পত্রপত্রিকায় লিখেও অনেক টাকা কামাতাম। এখন আমাকে কেউ টাকা দেয় না লেখার জন্য। কোনো পত্রিকা আমাকে বিল দেয় না লেখার জন্য। বহু বড় বড় পত্রিকা আছে, দৈনিক পত্রিকা, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক। গত দশ বছরে বোধহয় সব মিলিয়ে দশ হাজার টাকাও বিল পাই নি সব মিলিয়ে।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: বলেন কি! আপনি তো প্রতিষ্ঠিত লেখক।
শাকুর মজিদ: সেটা অন্য প্রসঙ্গ। পত্রিকাঅলারা যদি টাকা না দিতে চায়, মনে করে যে ওনার টাকার দরকার নাই, দিচ্ছে না; কিন্তু সেই সময়ে, ছাত্রাবস্থায় আমি মাসে চার-পাঁচ হাজার টাকা কামাতাম পত্রিকায় লিখে। ঢাকা শহরে এমন কোনো পত্রিকা ছিল না, যেখানে আমার লেখা ছাপে নাই এবং তারা আমাকে টাকা দেয় নাই। তাদের কাছে লেখা দেয়ার শর্তই থাকত–আপনারা টাকাটা কখন দিবেন? কোনো কোনো পত্রিকায় এমনও হতো–আপনারা ছাপান না ছাপান জানি না, আমার লেখা নেবেন টাকা দেবেন। অনুবাদের কাজ অনেক বেশি করতাম। টাইমস, নিউজউইক, রিডার্স ডাইজেস্ট, ফিল্ম ফেয়ার, স্টারডাস্ট, এসব আমাকে ধরিয়ে দিত, আমি অনুবাদ করে লেখা দিয়ে দিতাম। তারা আমাকে টাকা দিত। তারা আমাকে বলত, অমুকের ইন্টারভিউ করে দাও, আমি ইন্টারভিউ করে দিতাম। লেখা দিয়ে টাকা নিয়ে আসতাম। বেশী বড় পত্রিকা, যেমন বিচিত্রা, রোববার – এরা পরে দিতো, বাট পেতাম।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: আপনার কি মনে হয় না শাকুর ভাই, সেই সময়টা আপনাকে আসলে সারা জীবনের জন্য শক্তভাবে তৈরি করেছে?
শাকুর মজিদ: ওটার জন্য আসলে আমার আর্লি স্টাবলিশমেন্ট হয়ে যায়। উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি, আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আমার রুমমেটদের তুলনায় আমার সাচ্ছল্য অনেক বেশি ছিল। আমি তাদের থেকে অনেক বেশি আর্নার ছিলাম। আমাকেই আমারটা করতে হবে–এই বোধটা আমাকে সেই সময় তৈরি করে দেয়। কখনোই পরনির্ভশীলতার উপর বিশ্বাস করি নাই। আমাকে কেউ ফেবার করবে, এটা আমি কখনো চাই নাই। প্রার্থনাও করি নাই। আমার সব সময় মনে হয়েছে, আমাকেই আমারটা আর্ন করতে হবে।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: আপনার জীবন থেকে আমাদের এই সময়ের প্রজন্মেরা শিখতে পারে, যে, নিজে কীভাবে নিজেকে তৈরি করতে হয়।
শাকুর মজিদ: এবং এই শহরে আমাদের যাদের ক্ষমতাবান বা বিত্তবান বাবা-মামা-খালা-খালু-দুলাভাই আছেন, তাদের জীবনযাপন এক রকম। আর যাদের এটা থাকে না তাদের জীবনযাপন আরেক রকম। আমি কিন্তু প্রথম দলের না। আমি দ্বিতীয় দলের। আমাকে কেউ অযাচিত বা অকারনে উপকার করেছেন, ফেবার করেছেন, এরকম কোনো ঘটনা আমার স্মৃতিতে নাই। ইভেন আমি যদি কোথাও কোনো পুরস্কারও পেয়ে থাকি, এটাতেও আমি কখনো কারো কাছে ধর্না দিই না। সুপারিশের জন্য বলি না। আমার কাছে যদি কেউ কোনো সুপারিশের জন্য আসে, আমিও সেটা প্রত্যাখ্যান করি। আমি কাউকে বলি না যে, আমি তোমার জন্য অমুকের কাছে সুপারিশ করব।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: এটা অবশ্যই শিক্ষণীয় বিষয়। লেখকের যে মেরুদণ্ড থাকতে এটা তার প্রমাণ। শাকুর ভাই, বুয়েটে আসার আগে আপনি ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে পড়েছেন। ক্যাডেট কলেজ আপনার জীবনে কী অবদান রাখল?
শাকুর মজিদ: ক্যাডেট কলেজে ভর্তির সুযোগ পাওয়াটা ছিল আমার জীবনের জন্য একটা বড় বাঁকবদল। দুইটা বই লিখেছি এ নিয়ে। একটা ‘ক্লাশ সেভেন ১৯৭৮’ আরেকটা ‘ক্যাডেটের ডায়রি’। বিস্তারিত সেখানে আছে। তো ওখানে ভর্তি হওয়ার একমাত্র যোগ্যতা ছিল ভর্তি পরীক্ষায় পাশ করা। লিখিত, মৌখিক, স্বাস্থ্য–তিন রকমের পরীক্ষা হয়। এই পরীক্ষায় পাশ করার পরে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ৪টা ক্যাডেট কলেজের প্রতি ব্যাচে যে পঞ্চাশ জন ছাত্র যুক্ত হয়, তারমধ্যে আমিও একজন হয়ে যাই। এই যে পঞ্চাশজন মিলে একসাথে যুক্ত হলাম, তারা মিলে একটা পরিবার তৈরি হয়ে গেল। কে কোন পরিবার থেকে উঠে আসছে সেটা তখন আর প্রধান না। এই কলেজের শৃঙ্খলা, এই কলেজের নিয়মনীতি এটার উপর ভিত্তি করে আমাদের বেড়ে উঠতে হয়েছিল। ছয় বছর অতিক্রম করার সুযোগ তারাই পেত যারা এই কলেজের শৃঙ্খলার সাথে একাত্ম হয়ে থাকতে পারত। দশটা কারণ ছিল, এর যে কোনো একটি যদি কেউ ঘটাত, তাকে ক্যাডেট কলেজ থেকে বের করে দেয়া হতো। প্রথম কারণটা ছিল মিথ্যা কথা বলা। কাউকে মিথ্যা কথা বলার প্রমাণ পেলে তার জন্য জিরো টলারেন্স। কলেজ থেকে বেরিয়ে যাবে। তারপরে ছিল আদব কায়দার বিষয়টা। আদব-কায়দার বিষয়টা ছিল অনেক রকমের। যেমন আমার বন্ধুর সাথে সম্পর্কটা কী রকম হবে। আমার বড়র সাথে কী হবে। আমার ছোটর সাথে কী হবে। আমার শিক্ষকের সাথে কী হবে। আমাকে যারা সার্ভ করছে, সেই কমিউনিটির সাথে আমার সম্পর্ক কী হবে। এই শিক্ষাটা কিন্তু অনেক বড় শিক্ষা। এই শিক্ষাটাকে উপজীব্য করেই কিন্তু আমরা পরবর্তী জীবনে একটি জীবন কাটাই, যেখানে আমাদের এই ইন্টারপারসোনাল রিলেশনশিপটা ডেভেলপ করতে হয় বিভিন্ন মানুষের সাথে। এই শিক্ষাটা আমাকে ক্যাডেট কলেজ দিয়েছিল। এর বাইরে ছিল সময়ানুবর্তীতা, নিয়ম-শৃঙ্খলা, শরীরচর্চা এগুলো ছিল প্রধান বিষয়। পড়াশোনা করা এটা খুব গৌণ একটা বিষয় ছিল। কারণ, যে শৃঙ্খলিত নিয়মের মধ্যে আমাদের পড়াশোনা করতে হতো, তাতে সবাই ভালো ছাত্র। উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি, ১৯৮২ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় কুমিল্লা বোর্ডে প্রথম বিশজনের মধ্যে চোদ্দজন ছিলাম আমরা এক ক্লাশের ছাত্র। বাকীরা সবাই প্রথম বিভাগ। যে সবচেয়ে খারাপ, তারও দুইটায় লেটার মার্ক। সুতরাং ওখানে সবাই ভালো ছাত্র। মেধার গৌরব ওখানে করার সুযোগ নাই। গৌরব করতে হতো, যার অন্য কোনো গুণাবলী ছিল। সেই গুণাবলীগুলো আর্ন করার জন্য আমাদের যে সংগ্রাম, সেটাই আসলে পরবর্তী জীবনে আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছিল বাকি জীবনটা আমরা কীভাবে কাটাব।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: আপনার ক্যাডেট কলেজের বন্ধুদের থেকে কোন গুণাবলী আপনাকে আলাদা করেছে?
শাকুর মজিদ: অন্যদেরকে তেমন সংগ্রাম করতে হয় নাই। প্রথম সংগ্রাম করতে হয়েছিল শুদ্ধ বাংলায় কথা বলার জন্য। রেডিওর খবর ছাড়া আমি কোথাও প্রমিত বাংলা শুনি নাই। আমার শিক্ষকদের ভাষা ছিল সিলেটি ভাষা। উনারা সিলেটি প্রমিত উচ্চারণে আমাদেরকে গদ্য পড়ে শোনাতেন। সিলেটি উচ্চারণে আমাদের কোনো মহাপ্রাণ ধ্বনি নাই। আমরা ক আর খ-র পার্থক্য জানতাম না। চ আর ছ-র বিভাজন জানতাম না। গ আর ঘ জানতাম না। একটা গ আরেকটা বড় গ।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: হাহাহা। দুইটাই গ?
শাকুর মজিদ: দুইটাই গ। একটাকে বলতাম ব, আরেকটা বড় ব। লেখার সময় আমরা লিখতাম: বড় ব আ-কার বালো। এই হচ্ছে অবস্থা। আর ও-কারের ব্যবহার ছিল না। সব উ-কার। ‘তোমার’ বলে কিছু নাই। ‘তুমার’। এই জিনিসগুলোতে যেখানে আমার জিহ্বা অভ্যস্ত, আমার কণ্ঠ অভ্যস্ত, এই জিনিসগুলোতে আমাকে সেক্রিফাইস করতে হতো। বেশিরভাগ জিনিস আমি দেখে দেখে শিখতাম। দেখে দেখে শেখাটা হচ্ছে সবচে বড় শিক্ষা। শিক্ষা দুই-তিন রকমের হয়। পড়ে শিক্ষা, দেখে শিক্ষা আর ঠকে শিক্ষা। ঠকে শেখে বোকারা। অনেক দেরিতে শেখে। পড়ে শেখে মোটামুটি বুদ্ধিমানরা আর দেখে শেখে আরো একটু বুদ্ধিমানরা। আমি আরেকজনেরটা নকল করতাম। যে সবচে’ ভালো, তারটা নকল করতাম। খেলাধূলায় খুবই দুর্বল ছিলাম। কখনো মাঠে দোড়াই নাই। গ্রামে যখন ছিলাম, ফার্স্টবয় হিসাবে স্কুলের ক্লাশ-ক্যাপ্টেন ছিলাম; সুতরাং ক্লাশের টিম যখন ফুটবল খেলবে, তখন আমার কাজ ছিল লুঙ্গি টুঙ্গি গোছায়ে রাখা। ওরা খেলতে যাবে, আমি তাদের জিনিসপত্র গোছাব। টিচারের রুম থেকে বলটা নিয়ে আসব। হুইসেলটা নিয়ে আসব। এটা ছিল তখন আমার কাজ। কখনো আমাকে মাঠে নামতে দিত না। ফুটবলে এগারো জনের যে এগারো রকমের পজিশন আছে এটাই আমি জানতাম না। কখনো কেউ আদর করে নামালে গোলপোস্ট ছাড়া আমি সব জায়গায় খেলতাম, যেখানে বল সেখানে দৌড় দিতাম বল পাওয়ার জন্য। ওখান থেকে বল চলে গেল আরেক জায়গায়, আমি সেখানে দৌড় দিতাম। এই ছিল আমার খেলাধূলার অবস্থা। সেখান থেকে আমি কলেজ টিমের ভলিবল প্লেয়ার ছিলাম। কলেজ টিমের ফুটবলেও চান্স পেয়েছিলাম। ওখানে প্রথমবার যখন লং ডিসটেন্স রান হয়, ওটার নাম ক্রস কান্ট্রি রেস। পাহাড়ের উপর উঠে কে আগে যাবে। তিনটা গ্রুপ। গ্রুপে নব্বইজন। প্রথমবারে আশির পরে ছিল আমার অবস্থান। দ্বিতীয় বছরে আমি হলাম নাইন্থ। পরের বছরে থার্ড। ভলিবল খেলার সময় আমাদের ক্লাশ থেকে দু-তিনজনকে ডাকা হয়েছে, তারা ভলিবল খেলছে। আমি দূর থেকে দেখতাম ভলিবলে কোচিংটা কীভাবে দেয়া হচ্ছে। একটা দেয়ালের মধ্যে বল ছুড়ে বলটাকে রিসিভ করে আবার দেয়ালের মধ্যে দেয়া হচ্ছে।তাদের স্টেপিংটা শিখাচ্ছে কোচ। ছুটিতে বাড়ি গিয়ে আমি যতদিন ছিলাম, একটা ফুটবল নিয়ে সারাদিন প্রাকটিস করলাম ওভাবে। ফেরত আসলাম। আবার যখন ডাকা হলো, আমি লাইনে গিয়ে হাজির হলাম। আমাকে যখন বল উঠাতে দেয়া হলো, দেখা গেল আমি ভালো পারি। এবং এটা করতে করতে আমি যখন ক্লাশ টেনে পড়ি, তখনই আমি ভলিবলে কলেজ টিমের প্লেয়ার। কলেজ টিমে চান্স পাওয়া ক্যাডেট কলেজের জন্য বিশাল একটা ব্যাপার ছিল। সেখানে সবাই খেলোয়াড়। খেলাধূলা করাটা সেখানে সবার জন্য কম্পালসারি।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: খেলাধূলার ক্ষেত্রে আপনি লাড্ডু ছিলেন,পরে চেষ্টা করে দলে চান্স পাইলেন। উচ্চারণের ক্ষেত্রে কি এমন কোনো উদাহরণ আছে?
শাকুর মজিদ: উচ্চারণের উদাহরণ, আমার একটা বন্ধু খুব প্রমিত বাংলায় কথা বলত। উচ্চারণ খুব ভালো ছিল। কবিতা আবৃত্তি করত। বিতর্ক প্রতিযোগিতা করত। খুব ভালো লিখতেও পারত। ওর নাম আশরাফ। আমি ওর সাথে সই পাতাইলাম। সারাক্ষণ তার সাথে কথা বলতাম। তার সাথে ইচ্ছ করে কনভারসেশনে যাইতাম। তার মতো করে কথা বলার চেষ্টা করতাম। ওর কাছ থেকে আমার শেখাটা হয়ে যায়। তবে কলেজ স্টেজে আমি বাংলায় কোন বিতর্ক বা বক্তৃতা প্রতিযোগিতায় যাই নি। একবার গিয়েছিলাম ইংরেজি সেট স্পীচ এ। বিষয় ছিলো – দা রোল অব মাস মিডিয়া ইন বিল্ডিং এ ন্যাশন।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: এখন কই আছেন আশরাফ ভাই?
শাকুর মজিদ: ও আমেরিকাতে থাকে। খুব বড় একজন জিওটেক ইঞ্জিনিয়ার। বুয়েটেও পড়েছিল আমাদের সাথে, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিঙে। খুব ভলো ছাত্র।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: তো ক্যাডেট কলেজ, তারপর বুয়েট। বুয়েটে এসে পরিবারের দায়িত্ব নেন। প্রচুর লিখতে শুরু করলেন। আপনি যেটা বলছিলেন, লিখে অনেক টাকা আর্ন করতেন। প্রতি মাসে হাজার পাঁচেক টাকা আয় করতেন। লেখালেখিতে আপনার বন্ধু কে?
শাকুর মজিদ: এই যে কিছুক্ষণ আগে তোমার সাথে যে ছেলেটার কথা বলছিলাম, আশরাফ, ও একবার ছোটগল্প হিসাবে ‘হৈমন্তী’র সার্থকতা, এটার একটা ক্লাশ এসাইনমেন্ট স্যারের কাছে জমা দিল। আমারাও সবাই দিলাম। আমাদের মতো করে উচ্চ নম্বরের সিঁড়ি থেকে বা নোটবই থেকে লিখে জমা দিলাম। ও যেটা লিখেছে, ও তো উচ্চ নম্বরের সিঁড়ি থেকে লেখে নাই। ও লিখেছে রবীন্দ্রনাথের রবিরশ্মি থেকে কোটেশন দিয়ে। প্রমথনাথের লেখা থেকে কোটেশন দিয়ে। তার লেখাটা খুব প্রশংসিত হয়। সে এই এসাইমেন্টে ক্লাশ টেস্টে সব থেকে ভালো নম্বর পায়। ও আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল। আমার রুমমেটও ছিল। ওকে আমি বললাম যে, তোর খাতাটা আমি দেখি, তুই কী লিখেছিস। ও খাতাটা সরিয়ে নিল। ধরতে দিল না। বলল, পরে দেখিস। মানে আমাকে দিল না। তখন আমি দেখলাম তার টেবিলের উপর দুইটা বই আছে। রবিরশ্মি আর রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের বই। এই বইদুটো থেকে সে লিখেছে। পরের দিন আমি লাইব্রেরিতে চলে গেলাম। এই দুইটা বই আমি ইস্যু করে নিয়ে আসলাম। আমি রবিরশ্মি পড়া শুরু করলাম। রবীন্দ্রনাথের জীবনকথা পড়া শুরু করলাম। রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প নিয়ে কী লেখা আছে পড়লাম। ওই ঘটনা মূলত আমাকে সাহিত্যের প্রতি আকৃষ্ট করে ফেলে। আমি রবীন্দ্রনাথে আসক্ত হয়ে পড়ি। এরপর আমি একটা আর্টিকেল লিখে ফেলি। সেটা কলেজ ম্যাগাজিনে ছাপা হয়। রবীন্দ্রনাথের পেইন্টিং নিয়ে লিখি: ‘রঙতুলির রবীন্দ্রনাথ’। অনেকগুলো বই সংগ্রহ করে পড়া শুরু করি। রবীন্দ্রনাথ পড়া শুরু করি, বঙ্কিম পড়া শুরু করি, শরৎ পড়া শুরু করি। তখন শিখে ফেললাম, এইভাবে রেফারেন্স দিয়ে লিখেলে ভালো নম্বর পাওয়া যায়। ‘বিলাসী’ পড়তে গিয়ে আমি শরৎচন্দ্র পড়া শুরু করলাম। শরৎচন্দ্রের অনেকগুলো বই ছিল। শরৎচন্দ্রের নারী চরিত্র নিয়ে অনেকে পিএইচডি করেছে, তাদের বই ছিল। সেই বইগুলা পড়া শুরু করলাম। বইগুলো পড়তে গিয়ে যেসব চরিত্রের কথা আসল, তখন আমি এদের জানার জন্য মূল উপন্যাসটা পড়া শুরু করলাম। ক্যাডেট কলেজে থাকতেই শরৎচন্দ্র এবং রবীন্দ্রনাথের অনেকগুলো বই আমার পড়া হয়ে যায়। অনেকগুলো মানে আমি এখন সংখ্যা বলতে পারব না। ২০/৩০/৪০ টা হতে পারে।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: আপনার যে দুর্দান্ত স্বাদু গদ্য, চলচল ছলছল গদ্য–এই গদ্যে কি সেই সময়ের প্রভাব আছে?
শাকুর মজিদ: প্রভাবটা আমি ইচ্ছাকৃতভাবে কোথাও আনিনি। আমি কারো দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার চেষ্টা করিনি। আমি তাদের গদ্য বলার ধরনটা দেখেছি। দেখতে দেখতে আমি নিজে যেভাবে কথা বলি, যেভাবে আমার কথাটা প্রকাশ করতে চাই, সেভাবেই সহজ করে বলার চেষ্টা করেছি। কমপ্লেক্স সেনটেন্স লেখার চেষ্টা করি না। আমি সিম্পল সেনটেন্সে লিখি। দরকার হলে একটা সেনটেন্সকে ভেঙে তিন টুকরো করি। আমি দেখি যে, যারা অনেক জটিল করে লিখেন, তাদের লেখা পড়তে , বুঝতে আমার কষ্ট হয়। তবে শরৎচন্দ্রের ক্ষেত্রে সেটা ছিল না। শরৎচন্দ্রের প্রায় প্রত্যেকটা উপন্যাসে সূচনা এক প্যারাগ্রাফ।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: এক বাক্যের এক প্যারাগ্রাফ।
শাকুর মজিদ: এক বাক্যের এক প্যারাগ্রাফ। চারপাঁচ লাইনের। আমি যদি শরৎচন্দ্রকে অনুসরণ করতাম তাহলে তো ওই রকম লেখার চেষ্টা করতাম। সেটা তো আমি করি নাই। এটা করতে গিয়ে শরৎচন্দ্রের জীবনকে আমার পড়া হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের জীবনকে পড়া হয়েছে। বঙ্কিম- নজরুলের জীবন পড়া হয়েছে। এই চারপাঁচজনের জীবনকাহিনি আমাকে অনেক বেশি মুগ্ধ করেছে। লেখক হওয়ার জন্য তাদেরকে কী করতে হয়েছে-এটা পরবর্তীতে আমাকে কাজে লাগায়। আমি যখন ক্যাডেট কলেজ থেকে বেরিয়ে গ্রামে চলে গেলাম, বুয়েটে ভর্তি হয়ে দেড় বছর আমি গ্রামে বসে ছিলাম, ক্লাশ শুরু হচ্ছিল না। গ্রামে তখন আমার বন্ধুবান্ধবও খুব বেশি ছিল না। আমার সঙ্গী ছিল কিছু বই। বইগুলো পড়তে পড়তে আমার মনে হলো এই রকম তো নিজেও লিখতে পারি। আমি লিখি না কেন! এই থেকে আমার লেখার চেষ্টা করা। প্রথম দিকের যে বইগুলো আমি পড়েছি, আমি কিন্তু কখনোই লেখক হওয়ার প্রচেষ্টায় বইগুলো পড়ি নাই। পরবর্তীতে আমার মনে হয়েছিল আমিও পারি কি না দেখি । চেষ্টা করি।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: নিজের মৌলিক রচনার মতো প্রথম কী লিখলেন?
শাকুর মজিদ: প্রথম মৌলিক রচনা ছিল, ক্লাশ সেভেনে থাকতে । একটা দেয়াল পত্রিকায়। আমাদের এক বড়ভাই মারা গিয়েছিলেন, সুইমিংপুলে সাঁতার কাটতে গিয়ে, কবির ছিল তার নাম, তাকে নিয়ে চারপাঁচ লাইনের কবিতা লিখে টিচারের কাছে দিয়েছিলাম। পরে দেখলাম ওয়াল ম্যাগাজিনে যে সব কবিতা আছে সেখানে আমার কবিতাটাও আছে। তখন ক্লাশ সেভেনে পড়ি।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: তাহলে কবিতা দিয়ে শুরু?
শাকুর মজিদ: হ্যাঁ, কবিতা দিয়ে শুরু। এরপর থেকে ক্যাডেট কলেজে যতগুলো ম্যাগাজিন বোরোতো কোনোটাতে আমার কবিতা থাকত কোনোটাতে আমার গল্প থাকত। ইভেন ইংরেজিতেও আমি গল্প লিখেছি। ক্লাশ টেনে থাকার সময় ‘টেক্সি ড্রাইভার’ নামে গল্প লিখেছিলাম। ইংরেজিতে ‘মিরর’ নামে একটা পত্রিকা বেরোতো, মিররের জন্য নোটিশ এলো যে লেখা চাই, আমি ইংরেজিতে একটা গল্প লিখে পাঠালাম। সেটা ছাপা হলো। ‘প্রবাহ’ বেরোতো গদ্য নিয়ে আর ‘কবিতাপত্র’ ছিল কবিতার, তিনমাস পরপর এরকম তিনটা সংখ্যা বেরোতো। কবিতার একটা, গদ্যের একটা, ইংরেজির একটা। তিনটাতেই আমার লেখা যেত। প্রথম গল্প মুদ্রিত হয় ক্লাশ টেনে থাকার সময়। গল্পটার নাম ছিল ‘তখনো দাঁড়িয়ে’। কলেজ থেকে বেরিয়ে আমি নাটক লেখা শুরু করি। কলেজে একটা নাটক লিখেছিলাম। সেই নাটকটারও একটা কাহিনি আছে।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: নাটকে কেন আগ্রহী হলেন বা আপনাকে কেন নাটকটা লিখতে দেয়া হলো?
শাকুর মজিদ: লিখতে আমাকে দেয়া হয় নাই। আমাকে কেউ কিছু দেয় না। আমিই সব আর্ন করি। আমাকে দেবে কেন! লেখার কত লোক আছে! এটা কোনো এসাইনমেন্ট ছিল না। আই ডিসাইড টু রাইট। আমার মনে হয়েছিল এখানে অন্য নাট্যকারদের নাটক হয়, আমাদের একটা নাটক হইতেই পারে। রিডার্স ডাইজেস্ট এ পড়া একটা গল্প ‘হাফ অব মি হাফ অব ইউ’আমাকে মুগ্ধ করে। দেখলাম যে এই গল্পটাতে কোনো নারী চরিত্র নাই। পাঁচটা টোটাল চরিত্র। সবই পুরুষ।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: ক্যাডেট কলেজের জন্য যথেষ্ট। হাহাহা।
শাকুর মজিদ: আমার মনে হলো আমি এটার নাট্যরূপ দিয়ে ফেলি। আমি আমার মতো করে এটার নাট্যরূপ দিয়ে ফেললাম। ‘হাফ অব মি হাফ অব ইউ’ এর বাংলা নাম দিলাম ‘ফিফটি ফিফটি’। এটাও ইংরেজি নাম। কিন্তু ফিফটি ফিফটি অনেক সহজে বোঝা যায়। বাংলাতেও বোঝা যায়। এটা লিখে ড্রামার দায়িত্বে যে টিচারটা ছিলেন, তার কাছে নাটকটা দিলাম, যিনি আমাদেরকে ‘রক্তাক্ত প্রান্তর’ পড়াতেন। কিছুদিন পরে উনি নাটক পড়াতে এসে ঘোষণা দিয়ে বসলেন, এ বছর আমরা যে নাটকটা মঞ্চস্থ করব, এটা একজন ক্যাডেটের লেখা এবং সে তোমাদের ক্লাশে আছে। সবাই তাকায়। এ ওর দিকে। আমি তো বুঝে ফেলেছি আমার কথা বলা হচ্ছে। ক্লাশ শেষে উনি আমাকে ডাকলেন। বললেন, তোমার নাটকটা আমাদের কালচারাল সেক্রেটারির কাছে দিয়েছি। আনফর্চুন্যাটলি এই নাটকটা মঞ্চস্থ হয়নি।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: কেন?
শাকুর মজিদ: আমার যে বন্ধুটা এটার দায়িত্বে ছিল, সে বলল যে খাতাটা হারিয়ে ফেলেছে। ওটা তো খাতায় লেখা ছিল। কার্বন কপিও নাই। ফটোকপি নাই। হাতে লেখা। স্যার ওর কাছে দিছিল। ও হারিয়ে ফেলেছে।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: এটা কি সত্যি ছিল?
শাকুর মজিদ: ও আমাকে বলেছে। সত্যি কি না জানি না। পরে আবার ওর লেখা নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: এটা কি আপনার জন্য কোনো দাগা ছিল?
শাকুর মজিদ: হ্যাঁ, এটা দাগা ছিল। সারাক্ষণই আমার মনে থাকবে। আমার প্রথম নাটকের বই যখন প্রকাশ হয়, এটার ভূমিকতে এই গল্পটা আমি লিখেছি। এরপর ১৯৮৫ সালে আমার বাবা যখন মারা গেলেন, আমাদের গ্রামের কিছু মুরুব্বিদের ভুল পদক্ষেপ আর আমাদের একটা পারিবারিক ঘটনা আমাকে খুব আঘাত করে। এটার প্রতিবাদ জানানোর জন্য ভাবলাম যে নাটকের মাধ্যমে এর প্রতিবাদটা আমি করি। আমাদের পৈতৃক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। যার কোনো যৌক্তিকতা নাই। এই কাহিনিটাকে উপজীব্য করে একটা নাটক লিখলাম। তখন আমি গ্রামে থাকি। গ্রামে নাটকের একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে বেতার। টেলিভিশন তখনো আসে নাই। এবং মঞ্চায়নের কোনো ব্যবস্থা নাই। প্রতি শুক্রবার রাত দশটায় সিলেট বেতারে নাটক প্রচার হয়। খুব জনপ্রিয় ছিল সেই অনুষ্ঠান। এবং বেশিরভাগ জনপ্রিয় ছিল আঞ্চলিক ভাষার নাটকগুলো। গ্রামের লোকজন শুনত, তারা শুদ্ধ বাংলার নাটকে খুব একটা আগ্রহী না। তারা মুনীর চৌধুরীর নাটক বা আসকার ইবনে শাইখের নাটক বা নাজমুল আলমের নাটক তারা খায় না। তারা খায় বিদ্যুৎ করের নাটক। সিলেটের বিখ্যাত নাট্যকার, যেটা প্রযোজনা করে থাকেন শিবু ভট্টাচার্য। আমি নাটকটা একরাতের মধ্যে লিখে ফেললাম। রাতে শুরু করেছি। ভোররাতে ঘুমিয়েছি। ঘুম থেকে উঠে আবার লিখেছি। দুপুরের জোহরের আজানের সময় দেখলাম যে আমার নাটক লেখা শেষ। আমি দুপুরে খেয়ে খাতা নিয়ে বিকেল বেলা সিলেট চলে গেলাম। বন্ধুর বাসায় থেকে পরদিন সকালবেলা সিলেট বেতারে গিয়ে হাজির হলাম। নাটকের প্রযোজককে খুঁজলাম। কিন্তু রেডিও স্টেশনেতো আমাকে ঢুকতে দেয় না। আমি তো জানি না যে রেডিও স্টেশনে ঢোকার কিছু নিয়মকানুন আছে। অনুমতি লাগবে। গেটে আমাকে জিজ্ঞেস করে–কার কাছে যাবেন? আমি বললাম, শিবু ভট্টাচার্য। একমাত্র উনার নামই আমি জানি। ফোন করে জানল যে উনি আছেন। বলল, আপনার সাথে পরিচয় আছে? আমি বললাম, জ্বি আছে।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: হাহাহা।
শাকুর মজিদ: গেলাম। উনার রুম খুঁজলাম। দেখলাম উনি রুমে বসে আছেন। রিহার্সাল হচ্ছে। আরো লোকজন উনার কাছে। সামনে স্ক্রিপ্ট। আমি ‘মে আই কামিং স্যার’ বলে ঢুকলাম। তখন আমার বয়স ২০ বছর। ওই অবস্থায় কেউ মে আই কামিং স্যার বলে ঢুকলে তাকে ছাত্রই মনে করবে। আমি খাতা নিয়ে গেলাম–স্যার একটা নাটক। উনি পেজ উল্টে বললেন শাকুর মজিদ, উনি কোথায়? আমি বললাম, স্যার, আমি। উনি বললেন, ও আচ্ছা, ঠিক আছে। দেখব বলে উনি খাতাটা রেখে দিলেন। এই রকম তো কত লোক যায়। বললাম, স্যার কবে জানব? বললেন, যোগাযোগ কইরেন। কবে যোগাযোগ করব স্যার? বললেন, সপ্তাহখানেক পরে। পড়ি এটা, তারপর বলব। ওইদিন ছিল মঙ্গলবার। পরের মঙ্গলবার আমি গিয়ে হাজির। স্যার, এক সপ্তাহ পর আসতে বলছিলেন। উনি আমারে ধরে বললেন, আরে তোমারেই তো খুঁজছি আমি। তোমার তো নাটকের শিডিউল করে ফেলেছি । কিছু কারেকশন আছে। তিনি আমাকে ক্যান্টিনে নিয়ে গেলেন। সিঙ্গারা খাওয়ালেন। চা খাওয়ালেন। দুই তিনটা ডায়লগ বললেন যে, এগুলো হবে না। ছেলে আর বাপের মধ্যে কনভারসেশনের একটা জায়গা ছিল। ছেলে বাপকে খুব অপমান করে কথা বলে। মানে আমার যে টার্গেট, যাকে নিয়ে আমি নাটকটা লিখেছি, তার ছেলেই তার প্রতিবাদ করে। তো ছেলে বাপকে এভাবে বলতে পারবে না। আমাদের ভেটিঙের ব্যাপার আছে। এটা কাটো ওটা কাটো। এই করো ওই করো। এখানে অন্যকিছু লেখ। কারেকশন করে উনার কাছে দিয়ে আসলাম। তার কিছুদিন পরেই ‘রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যবহৃত’ ইনভিলাপে একটা চিঠি আসল আমার ঠিকানায়। তারমধ্যে একটা কন্টাক্ট ফরম, চুক্তিপত্র সাক্ষরের ব্যাপার ছিল। ওখানে আমাকে ৩৫০ টাকা রয়্যালিটি দেয়া হবে ওটার মানি রিসিট সাইন করে তাদের কাছে পাঠালে তারপর তারা চেকটা দেবে। এই কাণ্ডটা হয়ে গেল। আমি নাট্যকার হয়ে গেলাম। আমার বয়স তখন মাত্র কুড়ি বছর।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: অসামান্য! অসামান্য! এটা খুবই শিক্ষনীয় একটা ব্যাপার। নিজের প্রেরণায় পথ তৈরি করা….. তারমানে আপনি কবি এবং গল্পকার হওয়ার আগে নাট্যকার হয়ে গেলেন?
শাকুর মজিদ: এরমধ্যে কাহিনি আছে। নাটকটা প্রচার হলো ১৯৮৫ সালে ১৫ ডিসেম্বর। আর কবিতা এরমধ্যে লিখে সিলেটের পত্রিকায় ছাপানো শুরু হয়ে গেছে। প্রথম কবিতা লিখি ছদ্মনামে। আমি যে কবিতা লিখি এটা আমি কাউকে জানাইতে চাই না।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: প্রেমের কোনো ব্যাপার?
শাকুর মজিদ: না প্রেমের কোনো বিষয় না। আমার বাবা তখন অসুস্থ। তিনি দেখতে পেলেন যে আমার টেবিলে খালি বই, এটাসেটা, খাতা, পাণ্ডুলিপি। তিনি আমার মাকে ডাকলেন, ডেকে বললেন, তোমার ছেলে এসব করতেছে কেন, সে তো লেখক হয়ে যাবে। লেখকরা সংসারী হয় না। আমার ক্যান্সার। আমি দুইদিন পর মারা যাব। তাকে ফ্যামিলি দেখতে হবে। তাকে এইসব লেখালেখি করতে নিষেধ করো। মা এসে বললেন, তোমার বাবা নিষেধ করেছেন। তুমি এখন থেকে আর লিখতে পারবা না। ওই সময় আমার বাড়িতে পত্রিকা আসা শুরু হলো। সিলেটের পত্রিকাগুলো স্টল থেকে কিনে আনতাম। ওখান থেকে ঠিকানা দেখে দেখে লেখা পাঠাব সে জন্য। তো বাবা পেপার পড়বে। বুঝে ফেলবে। তাই আমি ছদ্মনামে লেখা শুরু করলাম। শান্তনু আশকার। এই ছদ্মনামে আমি কবিতা লেখা শুরু করি এবং এই নামে অনেক কবিতা ছাপা হয়। শান্তনু আশকার। শাকুর শব্দের বহুবচন হচ্ছে আশকার। আর শান্তনু কায়সার নামে একজন লিখতেন। উনার নামটা আমার খুব পছন্দ ছিল। এটাও উনার ছদ্মনাম। তো ওই নাম থেকে আমি শান্তনু আশকার হই। এই নামে প্রথম যে কবিতাটা ছাপা হয়, ওগুলোর সব আমার কছে আছে- ‘উড়িরচরের পঙক্তিমালা’। রেডিওতে একটা বর্ণনা শুনেছিলাম। ১৯৮৪ সালে উড়িরচরে একটা ঘূর্নিঝড়ে দশ ফুট উঁচু পানি এসেছিল। সবাইকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। ওখানে একটা লাইন আমি লিখেছিলাম: ‘মিঠা জলে খায়েস মেটেনি তাই নোনাজল টেনেছিলি বুকে’? এই কবিতাটা আমি যুগভেরী পত্রিকায় পাঠাই। সেটা ছাপা হয় সেই পত্রিকায়। এই ছিল সিলেটে আমার কবিতা ছাপা হওয়ার কাহিনি। আর প্রথম গদ্য ছাপা হয় ‘নজরুলের সাথে কিছুক্ষণ’। একটা কাল্পনিক সাক্ষাৎকার। আমি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা পড়ছিলাম। হঠাৎ করে নজরুল ইসলাম দেখি আমার কাছে চলে আসছেন। উনার সাথে আমার কী কী কনভারসেশন হলো, সেটা নিয়ে আমার সেই লেখাটা ছিল।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: আপনার সর্ব-সাম্প্রতিক যে কাব্যনাট্য, হাছনজনের রাজা, তারমধ্যে কিন্তু এরকম ব্যাপার আছে।
শাকুর মজিদ: হ্যাঁ, সেটা আছে। আমার প্রথম লেখা নজরুলের সাথে কিছুক্ষণ, ওটা এখনো আমার কাছে আছে। তুমি চাইলে পড়তে পারো।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: আপনার নাটকের আলাপে আসি। আপনার ভ্রমণ-সাহিত্য যতটা এপ্রিশিয়েট হয়েছে, মানে আমি মনে করি, নাটক অতটা হয় নাই। এর কারণ আপনি কী মনে করেন?
শাকুর মজিদ: তোমার কথাটা ঠিক না। ঠিক না এই অর্থে, আমি তিন মাধ্যমে নাটক লিখেছি। প্রথমে রেডিও। রেডিওতে দুটো নাটক লিখেছি। এবং সিলেট বেতারে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ সর্বাধিক পুনঃপ্রচারিত নাটক হলো আমার প্রথম নাটকটা। এখনো তারা আমাকে মনে করে। প্রথম যে টেলিভিশন নাটক লিখলাম, লন্ডনি কইন্যা, বাংলাদেশ টেলিভিশনের সর্বাধিক আলোচিত একক নাটক। এমনিতে ‘কোথাও কেউ নেই’ এর কথা বলা হয়ে থাকে, সেটা অন্য কারণে। সেটা ধারবাহিক নাটক ছিল। একক নাটক হিসেবে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ টেলিভিশনের সর্বাধিক আলোচিত নাটক ‘লন্ডনি কইন্যা’। ৯৯ সালে প্রচার হয়েছিল। এরপর আমি নাটক লিখেছি অল্প। নাটক এবং টেলিফিল্ম মিলিয়ে আটখানা লিখেছি। এই আটখানা নাটক টেলিফিল্ম লিখে ২০০০ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে আমি ২১টি পুরস্কার পাই শ্রেষ্ঠ নাট্যকার এবং শ্রেষ্ঠ পরিচালক হিসাবে। তুমি এই কথা বলছ, কারণ, যখন আমি নাটক লেখা শেষ করে দিয়েছি, তখন হয়তো তুমি শুরু করেছ। ২০০৫ এর পরে আমি টেলিভিশনে কোনো নাটক করি নাই। এখন থেকে তেরো বছর আগে আমার সর্বশেষ নাটক প্রচার হয়েছে। সুতরাং তুমি বলতেই পারো আপনার নাটক নিয়ে সেই আলোচনাটা কেন হচ্ছে না।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: মঞ্চে আপনি যে নাটক করেছেন, ওগুলি তো ভালো নাটক করেছেন।
শাকুর মজিদ: আমি টেলিভিশন থেকে মুখ ফিরিয়ে মঞ্চের দিকে গা দিলাম। ইউজুয়ালি সবাই মঞ্চ থেকে টেলিভিশনে আসে। অভিনেতা অভিনেত্রীরাও তাই। মঞ্চে হাত পাকায়া টেলিভিশনে আসে। টেলিভিশনটা আমার কাছে বিরক্তিকর মনে হওয়ার কারণে আমি টেলিভিশন ছেড়ে দিই। মঞ্চটাকে দেখলাম, ওখানে একটু জায়গা আছে শুদ্ধ শিল্প চর্চার করবার।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: আমার প্রশ্নটা ছিল যে আপনি এটা মনে করেন কি না? এখন ঢাকা শহরের যে দশজনকে যদি আমরা জিজ্ঞেস করি–হু ইজ শাকুর মজিদ? এদের মধ্যে দুইজন বলবে উনি একজন স্থপতি। তিনজন হয়তো বলবে, উনি একজন নাট্যকার। পাঁচজ কিন্তু বলবে উনি দুর্দান্ত একজন ভ্রমণ সাহিত্যিক।
শাকুর মজিদ: ওখানে আমার কাজ বেশি। তাছাড়া একটা পুরস্কার পেয়েছি ভ্রমণ সাহিত্যে। বাংলা একাডেমি পুরস্কার। আইএসএইচআই ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার যে বইয়ের জন্য দেয়া হলো, সেটাও একটা ভ্রমণ কাহিনি। সমরেশ বসু যে পুরস্কার আছে, এটাতেও ভ্রমণ সাহিত্যে আমাকে পুরস্কার দেয়া হয়। সিলেটের একটা বড় পুরস্কার আছে, সিলেটের একমাত্র পুরস্কার, যেখানে অর্থমূল্য দেয়া হয়, সেখানেও ভ্রমণ সাহিত্যে পুরস্কার পেয়েছি। আমার টোটাল বইয়ের সংখ্যা ৩৫/৩৬ টার মতো। তারমধ্যে ২১টাই ভ্রমণের। এবং আমি মনে করি, আমার ভ্রমণ কাহিনি, আমার আগে যারা ভ্রমণ সাহিত্যিক ছিলেন, তাদের থেকে আমি একটু আলাদা স্টাইল তৈরি করেছি।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: কোনো সন্দেহ নেই। আমি আপনার ভ্রমণ বই পড়েছি। আপনার সর্বশেষ চার খণ্ডের যে ভ্রমণ সমগ্র প্রকাশিত হলো, এটা আমি আমার বউকে উপহার দিয়েছি। সে এখন এটা নিয়ে ঘুমায়। আমার জন্য এটা খুব মসিবত। যাইহোক, আপনার ভ্রমণের বড় একটা দল আছে। যাদেরকে নিয়ে আপনি ঘোরেন। তাদের বেশিরভাগই আপনার ক্যাডেট এবং বুয়েটের বন্ধুবান্ধব। প্রায় সারা দুনিয়া আপনারা ঘুরে ফেলেছেন। এই দলটা নিয়ে যদি কিছু বলেন। আপনাদের কেমেস্ট্রিটা এত দুর্দান্ত কীভাবে তৈরি হলো?
শাকুর মজিদ: কেমেস্ট্রি একদিনে তৈরি হয় না। এই দলটার সাথে আমার পরিচয়, আমি তখন বুয়েটে ফার্স্ট ইয়ারে। এবং তারা তখন থার্ড ইয়ারে। এই দলের একজন লোক আছেন, তার নাম কাজী মুহাম্মাদ আরিফ। উনি অত্যন্ত সংস্কৃতিবান একজন মানুষ। সংস্কৃতিসেবী। দুর্দান্ত কবিতা আবৃত্তি করেন। লেখেন ভালো। এক সময় তিনি কবিতা লিখতেন। গান লিখতেন। সামহাউ ফার্স্ট ইয়ারে উনি আমাকে পিক করে ফেললেন। উনার পিকিং-এর শিকার হয়ে আমার ক্লাশের বন্ধু বান্ধবদেরকে হারিয়ে ফেলি। রুমমেটের বাইরে আমার ক্লাশের কারো সাথে বন্ধুত্ব তৈরি হয় না। পড়াশোনার বাইরে বাকি যে সময়টা বুয়েটের, আমি তাদের সাথে কাটাই। সেই ১৯৮৬-৮৭ সাল থেকেই এটার সূচনা। একজন একজন করে তাদের পুরা দলের আমি বন্ধু হয়ে যাই। দেশের ভেতরে তারা যখন কোথাও বেড়াতে যাবে, আমিও তাদের অপরিহার্য একজন। আমাকে নিয়ে তারা যাবে বেড়াতে। কারো বিয়ে হবে চট্টগ্রামে, কারো বিয়ে হবে দিনাজপুরে, সঙ্গে আছি আমি। তারা পিকনিকে যাবে, আমি আছি সঙ্গী। তারা কোথাও এমনি বেড়াতে যাবে, সঙ্গী আছি আমি। এই করতে করতে ২০০১ সালে তারা চিন্তা করল বেড়াতে যাবে মিয়ানমার। শাকুর মজিদ কোথায়? এই দিয়ে শুরু। ২০০৩ সালে কাজী আরিফের একটা সেমিনার ছিল চিলি। চিলিতে যাবে সে সেমিনারে বক্তৃতা দিতে, সে তো আর একা যাবে না। সুতরাং সে তার একটা দল নিয়ে যাবে। এই দলের মধ্যে তার বন্ধুরা আছে। আমাকে ধরল অত্যন্ত জটিলভাবে। এমন করে ধরলে কেউ না করতে পারবে না। আমার কাছে প্রথমে পাসপোর্টটা চাইল। যাব এক জায়গায়। কোথায় যাবে- বলে না। প্রথমে পাসপোর্ট পাঠাইল ব্যাংককে। ব্যাংকক পাসপোর্ট পাঠায়ে সেখান থেকে ভিসা আসল চিলির। চিলির ভিসা আসার পর আমারে বলল অমুক তারিখ থেকে অমুক তারিখ পর্যন্ত ফ্রি থাকবি। তোরে পরে বলব। তারপর শুনি আমার টিকেট কাটা হয়ে গেছে।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: হাহাহা।
শাকুর মজিদ: তারপর তো আর না যাওয়ার কোনো উপায় নাই।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: আপনি হুমায়ূন আহমেদকে নিয়া, আমাদের জনপ্রিয় সাহিত্যিক, দুইটা বই লিখেছেন। একটা হলো ‘যে ছিল এক মুগ্ধকর’ আর ‘নুহাশপল্লীর এইসব দিনরাত্রি’। হুমায়ূন আহমেদের সাথে আপনার খুবই দুর্দান্ত এক ধরনের সম্পর্ক ছিল। শাকুর ভাই, আপনার প্রিয় ভ্রমণ লেখক কে বা কারা?
শাকুর মজিদ: এইটা তো খুব ডিফিকাল্ট। আমার তো ওরকম বেশি পড়া হয় নাই। আমি চান্স পেলেই ইবনে বতুতার ট্রাভেলগ পড়ি। বারবার পড়ি। রবীন্দ্রনাথের ইউরোপের চিঠি বা বিলাত যাত্রীর পত্র বা জাপানের কাহিনি এটা পড়ি। রবীন্দ্রনাথের ভ্রমণ কাহিনি তার একেবারেই ব্যক্তিগত রোজনামচার মতো জিনিস। এতে হয় কি, একটা সময়কে পাওয়া যায়।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: আপনি বলছিলেন এখন আর সেইভাবে প্রেমে পড়েন না। তাহলে কি আপনি বুড়ো হয়ে গেছেন?
শাকুর মজিদ: সেরকম প্রয়োজন হয় নাই। আর প্রেম মুগ্ধতা কখনো কখনো তো কারো কারো প্রতি আসে। তবে এটা বেশিদিন স্থায়ী হয় না।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: স্থায়িত্বেও উপর তো প্রেম নির্ভর করে না।
শাকুর মজিদ: আমাদের সময়ে প্রেমের চিন্তা ভাবনা যেরকম ছিল, এখনকার সময়ে আবার সেরকম না। এখনকার মানুষ নগদ কিছুর জন্য প্রেমের কথা চিন্তা করে।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: কিন্তু আপনি তো সব সময় নিজেকে নবায়ন করেছেন শাকুর ভাই। ফলে আপনি জীবনাচরণে নিজেকে নবায়ন করেছেন। আমাদের সময়ে আমরা প্রায়ই প্রেমে পড়ি। সেটা আবার এক সময় নাই হয়ে যায়। বোর্হেস বলেছিলেন – প্রেমের আয়ু সাতদিন। এখন সেটা বোধহয় আরো কইমা আসছে। আপনি কী মনে করেন?
শাকুর মজিদ: আমারো মনে হয় ওই রকমই।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: প্রতিদিন আপনি অফিসে আসেন, আড্ডাটাড্ডা দেন, সারাদিন কাজ করেন, প্রচুর কাজ করেন, প্রায়ই বের হয়ে যান; সম্প্রতি আপনি বোধহয় জাপান ঘুরে আসলেন–এই ব্যাপারগুলো কি প্লান করে হয় নাকি আসলে জীবনের মধ্যেই থাকে?
শাকুর মজিদ: আমার যে ট্রাভেলের দল আছে, মূলত তারাই এগুলো করে। আমি শুধু সঙ্গ দিই তাদেরকে। আমি নিজে থেকে ইনেশিটিভ নিয়ে বেড়াতে গেছি এরকম ঘটনা তেমন নাই। অন্যের ইনেশিটিভে আমি সঙ্গী হই মাত্র। পরবর্তীতে দেখা যায়, তাদের ভ্রমণ শেষ হয়ে যায়। আমার ভ্রমণটা থেকে যায়। ভ্রমণের ফিল্ম বানাই। ডকুমেন্টরি বানাই। ভ্রমণের বই করি। ভ্রমণের আলোকচিত্র প্রদর্শনী করি। প্রথম ভ্রমণের পরেই আমি কিন্তু ভ্রমণের আলোকচিত্র নিয়া একজিবিশন করেছিলাম। প্রথম বিদেশ ভ্রমণের ওপরে আমি একটা বই লিখেছিলাম। আমার মনে হয়েছিল যে, যে জিনিসটা আমি দেখলাম, যে জিনিসটা বুঝলাম, সেটা আরেকজনকে দেখাই। আরেকজনকে বোঝাই। এই জন্যই আমার ভ্রমণসঙ্গীদের ভ্রমণ শেষ হয়ে যায় আমারটা থাকে।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: আপনি খুব নিবিড় পাঠক শাকুর ভাই, আমরা জানি। এই যে তেপ্পান্ন বছর কাটাই দিলেন, কাল থেকে আপনার চুয়ান্নর পদযাত্রা শুরু হবে। এই তেপ্পান্ন বছরে আপনি যদি আপনার পেছনের জীবনের দিকে তাকান, কোনো অতৃপ্তি কোনো খেদেও কথা মনে হয়?
শাকুর মজিদ: না। কোনো খেদ নেই।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: শতভাগ যাপন করেছেন?
শাকুর মজিদ: শতভাগ যাপন করেছি। আনন্দের সাথে যাপন করেছি। সময়ের সর্বোচ্চ ব্যবহার করার চেষ্টা করেছি। আর বেঁচে থাকার মুহূর্তটাকে আমি উদযাপন করার মধ্যে বাঁচতে চাই। সামনেও। কারণ, পৃথিবীতে মানুষ মরে গেলে তার কোনোকিছুই আর থাকে না। আদরের পুত্রও পিতার মৃত্যুশোক কিছুদিনের মধ্যে ভুলে যায়। তো যে বেঁচে থাকবে, যতক্ষণ সে বেঁচে থাকবে ততক্ষণই তার জীবন। সে মরে যাওয়ার পর তার জীবন তার কাছে আর কিছু নাই।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: এই চিন্তা কাজ করে আপনার মধ্যে?
শাকুর মজিদ: হ্যাঁ কাজ করে। এই যেমন আমার হাছনজানের রাজা, এইখানে আমার একটা সংলাপ আছে। হাছন রাজা বলে যে,”…… তারপর পর্দা পড়ে খালি হয় ঘর, আবার পরে রাতে শুরু হলে নতুন আসর, তোমার লেবাসে নাচে অন্য নটবর”। সো প্রতিটা মানুষই আসলে এই পৃথিবীতে একটা রঙ্গমঞ্চের পাত্র। সে কিছুদিনের জন্য আসে, একটা চরিত্রে অভিনয় করে চলে যায়। চলে যাওয়ার পরে তার কস্টিউম পরে আরেকজন সেই চরিত্রে অভিনয় করে।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: শাকুর ভাই, এদেশের শিল্পে সাহিত্যে আপনি যে অবদান রেখেছেন, একজন সামান্য সাংবাদিক হিসেবে আমি মনে করি, সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ অবদান। এবং এদেশের মানুষ সব সময় আপানাকে মনে রাখবে। আপনি যখন থাকবেন না, তখন আপনাকে স্মরণ করা হবে, এটা কেমন দেখতে চান?
শাকুর মজিদ: সেটা বলা কঠিন হবে। এই পৃথিবীতে আমার জন্ম হওয়ার কারণে পৃথিবীর কোনো না কোনো মানুষ উপকৃত হয়েছে, প্রকৃতির কিছু আমার দ্বারা লাভবান হয়েছে, মানুষের ভেতরে কোনো একটা বোধ জাগানোতে আমি কোনো একটা কাজ করেছি, এই রকম একটা কন্ট্রিবিউশন যদি আমার থেকে যায়, এটা যদি মানুষ মনে করে, তাহলে মনে করব যে আমার জীবনটা সার্থক ছিল।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: আপনার দুই পুত্রের জন্য কী বলবেন? তাদেরকে কোনো আদেশ কোনো উপদেশ দিতে চান?
শাকুর মজিদ: না, তাদেরকে আমি ছিপ ধরিয়ে দেব। বড়শি বাওয়ার ছিপ। মাছ মেরে খাবে তারা। তাদের জন্য মাছ কিনে রেখে যাব না।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: আপনি এখনো প্রচুর পড়েন আমরা জানি। এই সময় নতুন যারা লিখছে, তাদেরকে আপনার কিছু বলার আছে?
শাকুর মজিদ: পড়তে হবে। লেখক ওভার দ্য নাইট তৈরি হয় না। একদিনে হয় না, এক বছরে হয় না। আর চেষ্টা করে কেউ লেখক হতে পারবে না। লেখাটা তার ভেতরে থাকতে হবে। কেউ যদি তার ভেতরে লেখা না আসে আর সে আরেকজনের মতো লেখক হতে চায়, সে একটা বয়সের পরে আর পারবে না। যদি খুব শৈশবকাল থেকে সে চেষ্টা করে, তাহলে তার পক্ষে সম্ভব। একটা বয়সের পরে নতুন লেখক হওয়ার সুযোগ থাকে না। পঁচিশের আগে আমরা বুঝে ফেলতে পারি কে লেখক হবে কে লেখক হবে না। তার বই হয়তো প্রকাশ হয় নাই, বই তার পঞ্চান্ন বছর বয়েসেও প্রথম প্রকাশ হতে পারে, বই প্রকাশ হওয়া লেখকের পরিচিতির কোনো নিয়ামক না। সে কোন ভাষায় তার কথাগুলো প্রকাশ করে এটাই হচ্ছে তার সত্তা। লেখক হতে হলে প্রথমে লেখার ব্যাকরণটা জানতে হবে। কীভাবে লেখাটা লিখতে হবে। তারপর তার ভেতরে চিন্তা করার অসীম ক্ষমতা থাকতে হবে, এই চিন্তা সে প্রকাশ করবে। আর দেখবে যে অন্য লেখকরা কীভাবে এটা প্রকাশ করেছে। আমাদের স্থাপত্য যখন শেখানো হয়, প্রথমদিকে কতগুলো বিখ্যাত আর্কিটেকচারাল প্রোজেক্টকে কপি করে আঁকতে বলা হয়, ওইগুলোর মতো করে আঁকো। ওই বিল্ডিং এর মতো করে একটা বিল্ডিং আঁকো। তারপরে বলা হতো- ওটা ফেলে দিয়ে তুমি নিজে করো। যেমন গান যারা শিখে, প্রথমে তারা অন্যদের গাওয়া ভালো গানগুলো তোলে। এগুলো শেখা হয়ে গেলে তারপর তারা নিজের গান তোলে। লেখকও এই রকম। প্রথমদিকে অন্যের লেখা তাকে খুব বেশি পড়তে হবে। ভালো লেখাগুলো পড়তে হবে। পড়ে দেখতে হবে যে কোন লেখক কীভাবে লিখছেন। তারপর নিজের একটা স্টাইল ডেভেলপ করতে পারে।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: শাকুর ভাই, প্রায় শেষ দিকে আমরা। আমার ছোট্ট একটা প্রশ্ন: আপনার যেসব ফেসবুক পোস্ট দেখি, সেখানে রাজনীতির প্রায় কিছুই থাকেই না। আপনি কি রাজনীতি সচেতন না?
শাকুর মজিদ: থাকে তো। তোমার হয়তো চোখে পড়ে নাই। থাকে, তবে খুব সরাসরি কিছু থাকে না।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: আমি সেইটেই বলতে চাচ্ছি। সরাসরি থাকে না। রাজনীতি আপনি সচেতনভাবে এভয়েড করে চলেন?
শাকুর মজিদ: সচেতনভাবে আমি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে এভয়েড করে চলি। আমি পড়াশোনা করেছি ক্যাডেট কলেজে। সেখানে রাজনীতির কিছু ছিল না। তারপর এলাম বুয়েটে। সেখানে ছোঁয়াটা শুরু হয়েছে। ছিয়াশি সাল থেকে এই পর্যন্ত রাজনৈতিক যতগুলো কর্মকাণ্ড বাংলাদেশে হয়েছে, প্রত্যেকটা আমি দেখেছি। আমার চোখের সামনে হয়েছে। আমার কেন জানি মনে হয়েছে, অনুসরণ করার মতো একজন নেতাকেও আমি খুঁজে পাই না; যার মতালম্বী আমি হব। তাদের মেনিফেশটোতে যে আদর্শের কথা বলা থাকে, তাদের কাজের মধ্যে সেটার প্রতিফলন আমি দেখি না। সে কারণে আমি কোনো রাজনৈতিক দলকে আপাতত সমর্থন করতে পারছি না। উদাহরণ দিয়ে বলতে পারি, বড় বড় দলগুলো যারা গণতন্ত্রের কথা বলে থাকেন, তাদের নিজেদের দলের মধ্যেই যখন আমি গণতন্ত্র দেখি না, তখন তাদের গণতন্ত্রের কথায় আমি হাঁটতে পারি না। এখনো পর্যন্ত কোনো রাজনৈতিক দলের মদদপুষ্ট না হয়েও আমি আমার জীবন চালাতে পারছি। বাকি জীবনটাও যদি চালাতে পারি তাহলে ভালো।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: শাকুর ভাই, একটা জিনিস আমরা স্কিপ করে গেছি। সেই প্রসঙ্গটা আসে নাই। সাংবাদিকতা দিয়ে আপনি একভাবে ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন। প্রচুর লিখেছেন। বাংলাবাজার পত্রিকায় আপনি ফুলটাইম সাংবাদিক হিসাবে কাজ করেছেন।
শাকুর মজিদ: তখন আমি বুয়েটের ছাত্র। ছাত্র অবস্থায় আমি ফুলটাইম চাকরি করেছি।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: শুধুমাত্র ফুলটাইম কাজ করার জন্যই না, আপনার একটা চোখ সব সময় সাংবাদিকতার দিকে থাকেই। আমাদের দেশের সাংবাদিকতাকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করেন বা বিবেচনা করেন? এখন কি আসলে সাংবাদিকতা আমরা করতে পারছি?
শাকুর মজিদ: আমি যখন সাংবাদিকত করি, আমি তখন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন সাংবাদিকতা বিভাগ খুলেছে। ওই সাংবাদিকতা বিভাগের মাস্টার্স করা ছেলেরা এপ্রেন্টিস করতে আসত। আমার টেবিলে প্রথমে দুইজনকে দিয়ে দেয়া হয়েছিল। তারা সাংবাদিকতায় পড়াশোনা করেছে অথচ একজন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রের ডেস্কে সে শিখবে। আমি খুব ভয়ে ভয়ে থাকতাম। আমি তো কিছু শিখি নাই। না শিখেই আমি স্টাফ রাইটার হিসাবে তখন চাকরি করি। সাংবাদিক। তো সাংবাদিকতা কী অবস্থায় আছে এটা আমি খুব ভালো বলতে পারব না। কিন্তু আমি দেখি যে, সাংবাদিকরা যখন কোনো একটা দলের পক্ষ নিয়ে তার দৃষ্টিভঙ্গিটা প্রকাশ করেন, তখন আমি মনে করি যে সে আসলে তার চরিত্র থেকে বিচ্যুত। সে মূল ঘটনাটাকে আরেকজনের চোখ দিয়ে দেখছে। তার চোখ দিয়ে না। এটা অধিকাংশ বড় সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে এটা হয়ে থাকে। যখন আমি টেলিভিশনে একটা ঘটনার বিশ্লেষণ দুই সাংবাদিককে দুইভাবে করতে দেখি তখন আমার মনে হয়, এটা যদি সাংবাদিকের দেখা বিশ্লেষণ হয়ে থাকে, তাহলে পুরো ঘটনার একটা বিশ্লেষণ হবে। দুই দৃষ্টিকোণ থেকে দুই রকমের ব্যাখ্যা তার আসবে না। তো আমার মনে হয়, বেশিরভাগ সাংবাদিকই রাজনৈতিক দলের করুণাপুষ্ট। এবং তারা সব সময়ই ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে থেকে তাদের সুবিধা ভোগ করার চেষ্টা করে থাকেন। এটা এরশাদের আমল থেকে দেখেছি। এখনো আছে।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: শাকুর ভাই, অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। আমাকে যে সসময়টা দিলেন, সে জন্য আমি খুবই কৃতজ্ঞ। আপনাকে জন্মদিনের আগাম শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।
শাকুর মজিদ: শিমুল, তোমাকে আমি পছন্দ করি। তোমার সাথে কথা বলে আমার খুব ভালো লাগল। তুমি খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আমার থেকে অনেক কথা বের করে নিয়েছ। ধন্যবাদ।
‘যুদ্ধের সময় ব্যক্তিগত লোভ, আবেগ বড় শত্রু। অনেকেই যুদ্ধের ময়দান থেকে বা পলাতক অবস্থায় মাকে…..
দাউদ হায়দার একজন বাংলাদেশী বাঙালি কবি, লেখক ও সাংবাদিক। তিননি ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ থেকে নির্বাসনের…..
রবিঠাকুরের কথা লিখবো আমি তোমায় নিয়ে কথা ভাবতে আমার শরীর জুড়ে কাঁটা। শুনবে তুমি কেন…..
প্রিজন ভ্যানে বসা পাশের আসামি চোখ গোল গোল করে বলে, দাদা আপনার সাহস তো কম…..