ব্রহ্মপুত্র পুরাণ ও অন্যান্য

হোসনে আরা জাহান
কবিতা
ব্রহ্মপুত্র পুরাণ ও অন্যান্য

আমারো আইবো দিন

মনে আছে কী নাই তোমার যেসব কথার খই ফুটছিলো মুখে
যেন কালা মান্দালের বিষ অন্তরে মিশায়ে দেয় কী বিষম দুঃখে-
না হয় করছি মুখবিষ, শুইছি পাশ ফিইরা, রান্দি নাই ভাত
লেপ্টে গেছে কাজল না হয় ছড়ায়ে গেছে সিঁদুর-ভাঙাচোরা রাত
তোমার চোখেতে অন্য কেউ বসত বাড়ি সাজায়-এ জানার পর
থাকে কী অটুট সবকিছু, আগের মতন আর চাননি পসর!

জানে পুষ্কুনির চারিঘাট ভালো কইরা জানে এ কুলগাছটাও
জইমা আছে বিলাপ কতো, আন্ধার নামছে কতো চোখে কতো রাও
মনে আছে কী নাই তোমার সেসব সুন্দর দিন, অভাব উজায়া
ছিঁড়া নকশিকাঁথার সূতা বুনছিলো আমরার জীবন সাজায়া।

তোমার মন্দ স্বভাবগুলা আমি ভুলে যাইয়াম খোদার কসম
জাইনা থুইয়ো মনে মনে আমারো আইবো দিন-সুখের মশম।

 

বিশ্বাস

এ দেশের একতারায় যে সুরের তালাশ করি,
বাউলমনের দিনমান সাধনায়
সে সুর আজও বাজেনি ঠিক –

সাধুগণ ভুল সুরের ধ্যানে মজে আছেন এতকাল-
বেসুরো বিলাসে, আচমকা আবার কখনো কখনো একটু
সুরের আবহঝংকার আমাদের কেমন-করা মনেতে লাগে,
তখন আমরা চমৎকৃত হয়ে সবুজ নিশ্বাস উড়িয়ে দিই বাতাসে,
দিগন্তপ্রসারী সিঁদুরে সূর্যটাকে ভালোবেসে ফেলি আরও একটু।

সেও তো কম কথা নয়, বলো!

দেখে নিও, একদিন নিশ্চয় এই একতারা বেজে উঠবে
প্রত্যাশার বোলে-
বেহালা বাঁশি ডুগডুগি ঢোল খঞ্জনীর
সঙ্গে সেদিন এ লহরীর খুব সখ্য হবে-
সৃষ্টি হবে এক অমোঘ সংগীতের, প্রিয়তম।

 

ব্রহ্মপুত্র পুরাণ

এই আনন্দময় মানবসত্তার প্রায় অর্ধেকটা জুড়ে পাখিমন
পাতাটুনি কিংবা আলতা মুনিয়ার বেশে
উড়ে উড়ে চলে গেছে প্রিয় ব্রহ্মপুত্রের শান্ত জলের পাড় ধরে;
যেতে যেতে দেখেছি এ জল মিলেছে
দিগন্তপ্রসারী সন্ধ্যার আলো ছায়ায়;
রোদসী দুপুরে তপ্ত হাওয়া কিংবা
শিশিরভেজা রাতের সলমাপসরে।
কুলকুল জলের ছন্দ তখন ভর করেছে আমার পাখায়!
আমি উড়ে চলেছি আমার গণ্ডি পেরিয়ে
জলের বয়ে চলা পথ ধরে!
শুয়ে শুয়ে বয়ে যাওয়া দিহাঙের জল পেরিয়ে আমি
ধীরে ধীরে অগ্রগামী হয়েছি সিয়ংয়ের পাড় বেয়ে;
এরপরই হদিস মিলেছে জাঙপোর রুপালি জলের।
আমি এ জলও পেরিয়ে যাই অবলীলায়,
কেলাসের চূড়ায় গিয়ে বসি একলা একা।
আমার মুঠোয় তখন জড়ো হয়েছে পৃথিবীর সমস্ত ভালোলাগা;
আমি জানলাম সামনের বিস্তীর্ণ সরোবরে এ জলরাশি
হিমালয়ের পাঁজর ছুঁয়ে ছুঁয়ে বাঁচে।
তখনই এই মানবমন নিজের অজান্তেই খুঁজে বেড়ায়
আমার ফেলে আসা মায়ার বসত,
ব্রহ্মপুত্রের পাড়ঘেঁষা কাশফুল-জীবন।

 

গহীন তোমার

দিগন্তের ঐ সলমাচাঁদের হাসিটুকু
রাত গভীরে মিলুক এসে তোমার চোখে।
ঝিলকে উঠুক চাউনি তোমার
নিশ্বাসেতে উঠুক কেঁপে গহিন তোমার।

ভাবলে না হয় আমার কথা খুব লুকিয়ে
পড়লো ঝরে জলের কণা ও চোখ থেকে
করবে হু হু বুকটা তোমার
হাহাকারে পরানপাখি কাঁদুক তোমার।

ইচ্ছেগুলো ভীষণ রকম ডানা মেলে
ধূসর প্রেমে মাতালো এই একলা আকাশ
তোমায় খোজেঁ দুচোখ আমার
বারোমাসে কদম ফোটে বুকে আমার।

 

ফুলের জীবন

গাছ, মানুষ কিংবা পাখির মতো; যতদূর জানি-
ফুলের জীবনেও তার নিজের কোনো হাত নেই
ফুল হয়ে জন্মাবার কিছুক্ষণ আগেও সে জানে না
কী রূপ কী শোভা কী গন্ধ সে বয়ে আনবে এ গ্রহে
জীবনজুড়ে কতটুকু সময় সে পাবে-

তবুও আমরা নিজের অজান্তেই
ক্লিওপেট্রাকে গোলাপের সঙ্গে তুলনা করি
আর ধুতুরা ফুলকে-
ফুলের তালিকায় রাখতেও ভুলে যাই।

 

মিহিসুখ

জমাট যন্ত্রণা যখন সময়ের উত্তাপে গলে
হৃদয়ে তৈরি হয় মিহিসুখের দ্যোতনা
এইসব গলিত বেদনার সাথে
ঝরে পড়ে কিছু মুহূর্ত, মহার্ঘ অনুভব,
নিগূঢ় প্রত্যাশার ক্যালকুলাস-
তখন দু’চোখে ফোটে কদম ঠিকই-
গহিনে জমতে থাকে বেদনার মতো সুখ।

 

ভাঙা ভাঙা মুহূর্ত

শিউলিশিশির জলরঙে সব আঁকে
শ্যাওলাসবুজ ছাদজুড়ে হুল্লোড়ে
কার জানালায় মিষ্টি রোদের ছল
কে বা ভীষণ স্বপ্ন আঁটে দোরে!

মেঘের ঠোটেঁ সলমাপসর আলোক
রুপোর জলেই ভিজছে শহরতলি
কাচের গ্লাসে নোনতা জলের ঢেউ
বুকের ভেতর ইমলিপাতার গলি।

সিঁদুরমনে পুড়ছে এমন কে আর
ভুল খেয়ালে আজও রাধার মতো!
শালতিসবুজ ভাসলো অবুঝ ঘাটে
শান্তি পাবে ফুটবে কদম যতো।

 

কল্পনাপ্রসূত

কোথায় যাওয়া যায় চলো দুইজনে মিলে ভাবি
যেখানে অলিগলি শহরে কাটবে চোরাবালি সময়-
শ্রেণিহীন সবুজ সমাজে মানুষ ও ঈশ্বর পরম বন্ধু
যেতে চাও এমন কোথাও?

কোথায় হারানো যায় পথ বসে আজ চলো ভাবি
মানবপ্রেম পাঁজরে নিয়ে আইনশৃংখলাবাহিনীর
যেখানে সশস্ত্র ঘোরাঘুরি, ব্যারাকে ব্যারাকে হয় কবিতাপাঠ-
আছে কি এমন পথের খোঁজ?

অবেলায় চলো দুইজনে আজ ভুগোলপাঠে বসি
যেখানে গোলাবারুদ আছে মানুষের যুক্তি ও চিন্তায়,
শিশুদের আধিপত্যে বিভোর প্রার্থনা হয় ফসলি মাঠে-
পেতে চাও এমন জীবন?

 

কোজাগরী প্রহর

এ যেন এক জাদুর শহর
কোজাগরী রাত নেমেছে
দু’চোখেতে ঘুম লেগেছে,
ঘুমঘুমিয়ে তারায় তারায়
হয়নি কথা; না হোক তবু,
শান্ত থাকুক এই পৃথিবী
এই গ্রহতেই সুপ্ত থাকুক
ধূলির কণা, আপনজনা।

সলমাজড়ি মিষ্টি আলোয়
চন্দ্রাহত চোখের পাতা
নিবিড় ঘ্রাণে ঘুমলিবধূ
নিষুপ্ত রয় অষ্টপ্রহর
শুয়ে শুয়ে রুপোর জলও
হাওয়ায় মাতে, মধ্যরাতে।

হোসনে আরা জাহান। কবি ও লেখক। জন্মেছেন ময়মনসিংহ জেলার ফুলপুরে ১৯৮৬ সালের ২৬ আগস্ট। শিক্ষাগত জীবনে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেছেন। পেশাগত জীবনে তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ‘অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড’-এ কর্মরত। তাঁর লেখা...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

যাযাবর

যাযাবর

যাযাবর যাযাবরদের ছোঁড়া কাঠে আগুনও অসংযত,ঝড় উঠে ইত্যবসরে কিছু লবণ দানাও জমা পড়েছে… উদ্বাস্তু রোমে…..