করাচিতে নজরুল
করাচি বন্দরে এককালে গ্রিক-পারসিক-আরবীয় সওদাগরেরা নোঙ্গর করেছে; অনেক স্থাপত্য চিহ্ন আজো রয়ে গেছে; যা…..
বাংলাভাষার একটি পরিচিত শব্দ ‘ক্ষেত্র’। একজন পদার্থবিদ্যার ছাত্র ‘ক্ষেত্র’-এর অর্থ বুঝছে ‘energy field’। কৃষিবিজ্ঞানের ছাত্র বুঝছে ‘চাষের জমি’। অঙ্কের ছাত্র বুঝছে ‘রেখার মাধ্যমে প্রকাশিত গাণিতিক আকার’ (আয়তক্ষেত্র, বর্গক্ষেত্র)। চিকিৎসাবিজ্ঞান, বাণিজ্য বা ইতিহাসের ছাত্র হয়তো বুঝছেই না যে ‘ক্ষেত্র’-এর সাথে ‘ক্ষত’, ‘ক্ষতি’ ‘ক্ষেত’ বা ‘ক্ষত্রিয়’-এর কোনও সম্পর্ক আছে। আপনি-আমি তো ‘ক্ষেত্র’ মানে শুধু ‘এলাকা’-ই বুঝি!
এবার শব্দটির উৎসের দিকে তাকানো যাক। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ অনুযায়ী ‘ক্ষ’-এর অর্থ ‘ক্ষয়প্রাপ্ত হওয়া’। যাষ্কাচার্য্যের নিরুক্তে ‘ক্ষ’-এর অর্থ হিসেবে পাওয়া যায় –‘যা কর্তনের যোগ্য’। এবার দেখা গেল, নিজের নিজের জগতে ‘energy field’[i], ‘বীজগাণিতিক আকার’ থেকে শুরু করে ‘এলাকা’ বা ‘চাষের জমি’, -সকলেই ‘কর্তনযোগ্য’।[ii]
কিন্তু, এমন অজস্র শব্দের উৎস না বুঝে আলাদা আলাদা বিষয়ের ছাত্র আমরা এক-একজন এক-একটি অর্থ ধরে বসে থাকায় কেউ কারো কথা ঠিকঠাক বুঝতে পারি না। হয়তো সে’কারণেই আজকাল যে যার নিজের ‘field’-এর লোক ছাড়া সাধারণতঃ কাজের কথা বলি-ও না। এর ফলে আন্তঃবিষয়ক অধ্যয়ন বা ‘interdisciplinary study’-এর সম্ভাবনা ক্রমশঃ যে কমছে, -সে না হয় পণ্ডিতদের মাথাব্যথা। কিন্তু, আমার-আপনার আটপৌরে বোধের ‘ক্ষত = এলাকা’ সাথে ‘ক্ষেত্র-পরিবারে’র এতজন সদস্যকে অর্থের গোলমালে মেলাতে না পারার সার্বিক ‘ক্ষতি’ হল, মনের মধ্যে জন্মানো কিছু আজব ধারণা। -‘বই-এর কথায় বা জ্ঞানের কথায় জীবন চলে না’। লোকলজ্জার খাতিরে কথাটি সবাই মুখে হয়তো বলি না, কিন্তু যাপনের প্রকাশ তেমনই! এমনই বর্তমানের ব্যবস্থা-গুণে ‘লেখাপড়া’ বিষয়টির অর্জিত সংজ্ঞা হল, ‘যা জবরদস্তি গিলতে হয় এবং চাকরি নামক বাজারে ঠিক যতটা বিক্রয়যোগ্য –সে’টুকু বাদে বাদবাকি সমস্ত কিছু পাশ করামাত্র শিকেয় তুলতে হয়।’[iii] মাথায় থাকে না -পদার্থবিদ্যা, সাহিত্য, কৃষিবিজ্ঞান, অঙ্ক, চিকিৎসাবিজ্ঞান, ইতিহাস, –এরা ‘জীবন’-এরই অংশ বা মতান্তরে জীবন এদের নিয়েই গঠিত। ফলে, দেখতে দেখতে ‘শিক্ষিত’ থেকে কেবলমাত্র ‘সাক্ষরে’ পরিণত হই।
শব্দার্থের ‘বহুমাত্রিকতা’ বা ‘multidimensional/ multidisciplinary meaning of word’ -বিষয়টির সাথে আমরা তেমনভাবে পরিচিত নই। বর্তমানে আমাদের মুখের ‘বিশেষ্যপদ-কেন্দ্রিক’ ভাষা ‘একমাত্রিক’। এই ভাষায় একটি শব্দের সাধারণতঃ একটি-ই অর্থ হয়। একাধিক অর্থ হলেও তা পূর্বনির্ধারিত। তবে আধুনিক সময়েও কবিতায় অহরহ বহুমাত্রিক ভাষার ব্যবহার হয়। একটি উদাহরণ: ‘সন্ধ্যা নামল’ কথাটি বোঝাতে ব্যবহৃত ‘ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল’ –স্তবকে ‘ডানা’, ‘রৌদ্র’, ‘গন্ধ’ বা ‘চিল’ বিশেষ্যপদগুলির প্রচলিত অর্থে কোথাও ‘সন্ধ্যা’ খুঁজে না পাওয়া গেলেও স্তবকটি ‘সন্ধ্যা নামা’র ভাবার্থটি ধারণ করে।
কিন্তু, এ’ তো ‘ভাবে’র কথা। ইঁট-কাঠ-কম্পিউটার-চৈত্রসেলের ঘোর ‘বাস্তব’ জগতে ভাবের ভাবনায় স্ব-ভাব নষ্ট করা-ই বা কতটা বুদ্ধিমানের কাজ? আসলে হামেশাই ভুলে যাই যে, এমনকি হাজার টাকার মূল্যও ‘এক হাজার টাকার নোট’ –নামক ‘বস্তু’তে থাকে না, থাকে ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের পরিচালকের ‘I promise to pay the bearer the sum of one thousand rupees.’ –এই প্রতিশ্রুতিতে। কোনও বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্তে (যা -ও ‘বস্তু’ নয়, ‘বাস্তব-সম্মত’) এই প্রতিশ্রুতির ‘ভাব’ অপসারিত হলে ‘বস্তু’ হাজার টাকার নোট এক টুকরো কাগজে পরিণত হয়।
ভাববাদ ও বস্তুবাদের চিরন্তন দ্বন্দ্ব আপাতত মুলতুবি থাকুক। উল্লেখিত ‘বহুমাত্রিকতা’কে একটু সহজ ‘ভাবে’ বোঝার চেষ্টা করা যাক। পিতা. পুত্র, স্বামী, বন্ধু, শত্রু, সহযাত্রী, সহকর্মী, ক্রেতা –এই প্রতিটি শব্দের (বা পরিচয়ের) অর্থ সম্পূর্ণ আলাদা আলাদা। কিন্তু, ‘রামবাবু’ (বা রহিমবাবু) নামক কোনও এক বাস্তব মানুষের এই সবক’টি অস্তিত্ব (বা পরিচয়) থাকতেই পারে। ধরা যাক এই রামবাবু শ্যামবাবুর সহকর্মী। সুতরাং, শ্যামবাবুর কাছে এই রামবাবু মানে পিতা. পুত্র বা স্বামী কোনওটিই নয়। কিন্তু, নয় বলেই রামবাবুর বাদবাকি অস্তিত্বগুলি (বা পরিচয়গুলি) ভুল হয়ে যায় না। ‘রামবাবু = সহকর্মী’ –এই সিদ্ধান্তে শ্যামবাবুর ‘কাজ চলতে পারে’, কিন্তু অখণ্ড বা পূর্ণাঙ্গ রামবাবুকে জানতে হলে তার সব ক’টি অস্তিত্বকেই (বা পরিচয়কে) জানতে হয়। নইলে কিছু সময় পর শ্যামবাবুর মনে ‘রামবাবু শুধুমাত্র সহকর্মী, আর কিছুই নয়, তার বাদবাকি যাবতীয় পরিচয়গুলি বেকার, মূল্যহীন’ –গোছের একটি অলীক ধারণার জন্ম নেয়!… হাস্যকর শোনালেও, শব্দের অর্থ বোঝার ক্ষেত্রে আমাদের তেমন-ই দুর্দশা হয়েছে।
আমরা ‘ভদ্রলোক’ বা ‘ভদ্রমহিলা’ হিসেবে পরিচিত হতেই পছন্দ করি। এই ‘ভদ্র’ শব্দটিকে কাঁটাছেঁড়া করার আগে চলুন প্রাচীন মিশরের একটি ঝটিকা সফর সেরে ফেলা যাক। ‘সিন্ধু-সরস্বতী সভ্যতা’র[iv] গোড়া থেকেই প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার সাথে এদেশের সাংস্কৃতিক সংযোগের বিষয়টি (বহুচর্চিত না হলেও) যথেষ্ট-ই বিস্তারিত। লৌকিক শিল্পকলা, ভাষা, প্রান্তিক সংস্কৃতি, স্থাননাম, সিলমোহর প্রভৃতি বিষয়ে এই দুটি সভ্যতার অদ্ভুত সাদৃশ্য। দুটি সভ্যতা-ই গরু, সূর্য্য, নদী ও সর্পের উপাসক। এদেশের সূর্য্যমন্দিরের নাম ‘কোনারক’, ওদেশের সূর্য্যমন্দিরের নাম ‘করনাক’। লোথাল ও মহেঞ্জোদারোয় প্রাপ্ত টেরাকোটার ‘মমি’র সাথে মিশরীয় মমি-র সাদৃশ্য-ও লক্ষণীয় (অথচ, মমি-বিষয়টিরই এদেশে কোনওদিন চল ছিল না)। আবার বহুক্ষেত্রে মিশরীয় মমি প্রস্তুতিতে ভারতীয় মসলিন ব্যবহারের নিদর্শন পাওয়া যায়।[v] বাণিজ্যিক সংযুক্তির পাশাপাশি সাংস্কৃতিক ভাবেও সভ্যতাদুটি যে যুক্ত ছিল, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ থাকে না। বৈদিক যুগেও যে সংযোগ ছিন্ন হয় নি।[vi]
প্রাচীন মিশরীয়রা গণিতে ভগ্নাংশের ‘সীমিত’ ব্যবহার জানত। দেবী হরাসের চোখ বা ‘Eye of Horus’-এর মাধ্যমে তারা ভগ্নাংশ লিপিবদ্ধ করত।[vii] সেই সঙ্খ্যাতন্ত্র অনুসারে পূর্ণসঙ্খ্যা বা ১ এর সর্বনিম্ন বিভাজক ১/৬৪। বাকিগুলি হল ১/৩২, ১/১৬, ১/৮, ১/৪ ও ১/২। লক্ষণীয়, এই সঙ্খ্যাগুলি জুড়লে ‘৬৩/৬৪’ হয়, পূর্ণসঙ্খ্যাটি বা ১ ‘ফিরে’ পাওয়া যায় না। এদেশের সদ্য-প্রাচীন হিসাব পদ্ধতি[viii] অনুসারে বললে, ষোলআনা ঠিক পূর্ণ হয় না, একটু খামতি বা ‘অসম্পূর্ণতা’ থেকেই যায়। কিন্তু কেন? -সেই দর্শন আমরা কিছু পরে আলোচনা করব।
‘Eye of Horus’ পরে সূর্য্যদেবতা ‘রা’-এর চোখ হিসেবে পরিচিত হতে থাকে। এই চিহ্নটি প্রাচীন মিশরীয়দের জন্য ছিল সুস্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও রাজশক্তির প্রতীক। মিশরের মন্দির, পিরামিড, রাজপ্রাসাদ সহ বহু গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় এই মিশরীয় ‘অসম্পূর্ণতা’র প্রতীক দেখতে পাওয়া যায়।
আঠারো শতকের জার্মানীতে বিভিন্ন বিষয়ে সুপণ্ডিত মানুষ ‘ইলুমিন্যাটি’ (Illuminati) নামক এক রহস্যময়, বিতর্কিত সঙ্ঘ তৈরি করেন। ‘ইলুমিন্যাটি’ শব্দটির অর্থ ‘the enlightened ones’ বা ‘জ্ঞানের আলোক প্রাপ্ত’। প্রখ্যাত জার্মান কবি গ্যোথে-ও এর সদস্য ছিলেন। ক্যাথোলিক চার্চের কুসংস্কার ও রাজশক্তির অপব্যবহারের বিরোধিতা করা ছিল এই সঙ্ঘের লক্ষ্য। স্বাভাবিক ভাবেই চার্চ ও রাজশক্তি কিছুদিনের মধ্যেই সঙ্ঘটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। কিন্তু, তারপরও এই ‘আলোকপ্রাপ্ত’দের বিস্তার সারা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। কথিত আছে ফরাসী বিপ্লবেও নাকি এদের গুপ্ত, কিন্তু বিশেষ ভুমিকা ছিল। এদের গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক হল ‘সর্বজ্ঞ চোখ’ বা ‘All seeing eye’[ix] (যা আসলে ‘Eye of Horus’). –যা পরবর্তীকালে পাশ্চাত্যের নবজাগরণের ও আধুনিকতার প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত হতে থাকে।
আজও আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ‘মহান শিলমোহরে’র উল্টোপিঠে ও ১ ডলারের নোটে, বেলারুস, লিথুয়ানিয়া, পোল্যাণ্ড, চিলি, ইষ্টোনিয়া, ইউক্রেন, রাশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, ফ্রান্স, আর্জাণ্টিনা সহ বিভিন্ন দেশে কখনও জাতীয় প্রতীকে, কখনও বিশ্ববিদ্যালয়ের লোগোতে, মুদ্রায়, ক্যাথিড্রালের শীর্ষে এই নবজাগরণের বা আধুনিকতার প্রতীক ‘All seeing eye’-এর উপস্থিতি।
কিন্তু, প্রশ্ন হল -চার হাজার বছর পুরোনো এই মিশরীয় ‘অসম্পূর্ণতা’র চিহ্নকে সারা বিশ্বের ‘আধুনিকতার পিতৃপুরুষ’রা মাথায় তুলে রেখেছিলেন কেন? আর কেন-ই বা ‘ভদ্র’-এর মতো একটি নিরীহ শব্দ নিয়ে বলতে গিয়ে (অভদ্রের মতো) হাওড়ার গাড়ি হস্তিনাপুরে নিয়ে যাওয়া?
‘ভদ্র’ শব্দের বর্তমানে প্রচলিত অর্থগুলি হল অমায়িক, নম্র, সুপ্রতিষ্ঠিত, ইত্যাদি। কিন্তু মনুসংহিতা অনুযায়ী ‘যে গোপনে পাপ করে ও প্রকাশ্যে তা প্রচ্ছন্ন রেখে পর-ধন গ্রহণ করে, সে হল ভদ্র।’[x] –কী মারাত্মক কথা! এই সংজ্ঞায় সঙ্খ্যাগরিষ্ঠ আধুনিক ‘ভদ্রলোক’দের আসল চরিত্র ফুটে উঠলেও ‘ভদ্র’ শব্দটির প্রতি এ যে ঘোর অন্যায়! এখন এই ‘গোপন পাপে’র রহস্য নিষ্পত্তি করতে তন্ত্রশাস্ত্রে পৌঁছে দেখা গেল সেখানে ‘ভদ্র’ শব্দের অর্থ –‘চৌষট্টি কলায় পারদর্শী দক্ষ বা ভৃগুগণ’। -এ’ কি বাৎসায়নের কামসূত্রে বর্ণিত ৬৪ কলা? (শাস্ত্রকাররা কি ভদ্রলোকদের বিড়ম্বনার শেষ রাখেন নি!) দেখা যাক, এই কলাসমূহে[xi] কী পাওয়া যায়;-
কণ্ঠসংঙ্গীত, যন্ত্রসংঙ্গীত, নৃত্যকলা, অঙ্কন বিদ্যা, সীমন্ত/ কেশসজ্জা রীতি, কালভেদে রুচিভেদে ঋতুভেদে ও অবস্থাভেদে শয্যা প্রস্তুত প্রণালী, গৃহসজ্জা রীতি, অঙ্গরাগ (make-up) বিদ্যা, গৃহ নির্মাণ, রঙ্গরচনা, সন্তরণ ও জলক্রীড়া, চিত্রযোগে অপরের দৌর্ভাগ্যিকরণ বিদ্যা, পুষ্পালঙ্কার প্রস্তুতি, সুগন্ধি প্রস্তুতি, বেশভুষা উদ্ভাবন, পরিচ্ছদ রচনা (tailoring), স্বর্ণকার বিদ্যা, আতিথেয়তা, জাদুবিদ্যা, হস্তলাঘব কর্মকুশলতা, রন্ধন, পানীয় ও মিষ্টান্নাদি প্রস্তুতি, তন্তুবায় বিদ্যা, সূচিশিল্প, বীণা-ডমরুক-বাদ্য, তন্ত্রবিদ্যা, প্রহেলিকা রচনা, কাব্য রচনা, ভাষাতত্ত্ব, শ্লোক পাঠ, নাটক-অভিনয়-দর্শনের সমালোচনা, কাব্যের লুপ্ত পঙ্ক্তির পুনরুদ্ধার ও অনুলেখন, পট্টিকাবেত্রবয়ন (তৃণ/বেত থেকে আসবাব রচনা), কুঁদনবিদ্যা (wood carving), তক্ষণ (carpentry), মণিভূমিকাকর্ম (jewel cutting/ polishing), রসায়ন ও ধাতু বিদ্যা, মৃৎশিল্প, উদ্যানপালন, পশুপালন, পক্ষীপালন, গাত্রমর্দন বিদ্যা, সংবাদ জ্ঞাপন ও প্রাপ্তি, সংকেতলিপি রচনা ও অর্থোদ্ধার (cryptography), অনুবাদ বিদ্যা, বাহন নির্মাণ ও পরিচর্য্যা, প্রতীকবিদ্যা, নানাবিধ যন্ত্রবিদ্যা, স্মৃতিশাস্ত্র বিদ্যা, পুস্তক পাঠ, পুস্তক রচনা, অভিধান ও বিশ্বকোষ বিদ্যা, ছন্দজ্ঞান ও বক্তৃতা বিদ্যা, ছদ্মবেশ বিদ্যা, দাবা ও পাশা খেলা, কুহক বা মোহিনী বিদ্যা, স্থলক্রীড়া বিদ্যা, ব্যায়ামবিদ্যা, রাজনীতি, যুদ্ধবিদ্যা, মুখাকৃতির বিচারে চরিত্রনির্ণয়বিদ্যা (physiognomy), বার্ণিক (নকলনবিশী) বিদ্যা, মৃত্তিকা-ভাষ্কর্য এবং গণিত।…
দেখা যাচ্ছে, ‘যৌনশাস্ত্র’ হিসেবে পরিচিত হলেও কামসূত্রের এই চৌষট্টি কলায় (যা কিনা ওই ‘Eye of Horus’ বা ‘৬৩/৬৪’-এর ৬৪) ‘কামোত্তেজক’ (aphrodisiac অর্থে) বিশেষ কিছু পাওয়া যাচ্ছে না। বরং এ’গুলি বিদ্যাচর্চার বিভিন্ন শাখা বা ‘faculty’। অখণ্ড-জ্ঞান (ভারতীয় দর্শনে যার উৎসকে ‘পরম ব্রহ্ম’ বলা হয়) সীমাহীন। কোনও বাস্তব মানুষের সীমিত ক্ষমতার দ্বারা সেই অখণ্ড জ্ঞানের অসীমতার সম্পূর্ণ নাগাল পাওয়া অসম্ভব। জ্ঞানপিপাসু মানুষ তাই অখণ্ড জ্ঞানের চর্চা ও অনুশীলনের জন্য সাধ্যমত তাকে ৬৪ খণ্ড/কলা/ বিদ্যা/ধারায় (৬৪টি ‘specialised faculty’-তে) ভাগ করেছিল। বর্তমানে যা আরও specialised হতে হতে ৬৪০ বা ৬৪০০টি উপধারায় পরিণত হয়েছে।
এই পদ্ধতি কোথায় শুরু হয়েছিল, প্রাচ্যে না পাশ্চাত্যে? –সেটি বড় প্রশ্ন নয়, জ্ঞানচর্চার এই দর্শনের অধিকার ও উত্তরাধিকার সমগ্র মানবজাতির। তবে অতীতে বাণিজ্যপণ্যের সাথে সাথে জ্ঞান ও দর্শনের আদান-প্রদান হয়েছিল বৈ কি। সেই কারণে সারা বিশ্ব জুড়ে বিদ্বান ও ‘ভদ্র’ মানুষদের তৈরি সঙ্ঘ, রাষ্ট্র বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘All seeing eye’ রূপে মানবসভ্যতার এই (গুরুত্বপূর্ণ) প্রারম্ভিক মাইলফলকটিকে সসম্মানে স্থান দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু, ‘All seeing eye’ বা ‘Eye of Horus’–এর সবক’টি ‘খণ্ড’ জুড়লে ‘৬৩/৬৪’ হয়, ‘অখণ্ড জ্ঞান’ বা পূর্ণসঙ্খ্যাটি ‘ফিরে’ পাওয়া যায় না কেন? –প্রশ্নটি দার্শনিক, কিন্তু যেহেতু ‘Eye of Horus’–এর সাথে সঙ্খ্যাতন্ত্রের একটি যোগ রয়েছে, তাই অঙ্কের ভাষায় উত্তরটি খোঁজার চেষ্টা করা যাক।
ঠিক যেমন ‘অখণ্ড জ্ঞানের চলমান ক্রিয়া’র স্বরূপ চিনতে তাকে ‘খণ্ড’ করতে হয়, তেমনই একটি ‘limitless continuous function’-কে অনুধাবন করতে তাকে ‘differentiate’ করতে হয়। ‘খণ্ড’-জ্ঞানচর্চায় প্রাপ্ত সিদ্ধান্ত[xii] বা ‘derivatives’-গুলিকে জুড়লেই বা ‘integrate’ করলেই সম্পূর্ণ বা ‘অখণ্ড জ্ঞানের’ সবটুকু ধরা যায় না। একটি স্থানু বা ধ্রুবক (constant) ফাঁক থেকেই যায়। ‘৬৩/৬৪’-এর অসম্পূর্ণতা আসলে জ্ঞানচর্চার সীমাবদ্ধতাকে চিহ্নিত করে। এর ফলে বোধের জগতে কি গোলমাল বাঁধে, তার একটি নমুনা নিচে দেওয়া হল;-
ফিজিক্স্ মাস্টার: |
…বিজ্ঞানীরা কয় -আমাগো মহাবিশ্বের জনম নাকি ১৩৭.৩ কোটি বচ্ছর আগের এক ‘বিগ ব্যাং’ থিইক্যা। এই ‘ব্যাং’-হইতে ছিষ্টি হওয়া দুইখান কণা উল্টামুখে আলোর ‘ব্যাগে’ দৌড় দিছিল। এই হিসাবে আমাগো মহাবিশ্বের ব্যাস হইল ২৭২.৬ কোটি আলোকবর্ষ। ‘আলোকবর্ষ’ জানস তো? –এক বচ্ছরে আলো যদ্দুর যায়।… যাউক গিয়া, এই দিকে ‘হাবলের টেলিস্কোপ’ দিয়া নাকি ৪৬৫ কোটি আলোকবর্ষ অবধি দেখন যায়। তা হইলে, টেলিস্কোপে অহন যা দেখি, -সে কি ছিষ্টির আগের মাল? -আর তাই যদি হয়, সে আছে ক্যামনে? আর না থাকে যদি, তারে দেখি ক্যামনে? আর দেখি যদি, তবে সেই ‘ব্যাং’ গেল কই?… প্যাঁচাল-খান এইখানেই, বুঝলি কিনা? |
ছাত্র: | (আতঙ্কিত) বুঝি নাই! আমি কিস্যু বুঝি নাই! |
ফিজিক্স্ মাষ্টার: | (স্বগতোক্তি) তরে আল্লায় বাঁচাইছে বাপ! |
এই সীমাবদ্ধতা জ্ঞানচর্চার পরাজয় নয়, -প্রকৃতির ‘limitless continuous function’-এর সামনে মাথা নোয়ানোর ‘স্থান’।…
খণ্ডবাদ মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে। তার সামাজিক জীবনও ‘group’ থেকে ‘individual’-এর দিকে ঝোঁকে। নিজেকে আবরণ বা ‘privacy’ দিয়ে ঢাকতে চায়। এই ‘privacy’–এর সূত্রপাত আবার ‘অসীমতার ভাব’ থেকে ‘de-prived’ হওয়ার থেকে। যে কারণে খণ্ডজ্ঞান পাওয়া মাত্র বাইবেলের আদম ও ইভ্ ‘privacy conscious’ হয়ে ওঠে।… কিন্তু, খণ্ড না করে অসীমতাকে ধরার আর কোনও উপায়-ও যে নেই! তাই ‘অখণ্ড কালের সক্রিয়তা’ (কাল+ঈ=কালী) থেকে সৃষ্ট মানুষের (বালক-সুলভ) বোধ তার রহস্যময় জন্মদাত্রী (অখণ্ড কালের) ‘অংরূ্পিণী’-কে ধরতে না পেরে আকুতি জানায়, -‘মা হয়ে বালকের কাছে উলঙ্গ ক্যামনে! বসন পরো মা’! অংরূপ–এর ‘রূপ’ বাদ দিলে পড়ে থাকে ‘অং’, অর্থাৎ ‘অ+ং’। ‘অ’-এর ক্রিয়াভিত্তিক অর্থ ‘অস্তিত্বন্’। ‘ং’-কে দেবনাগরী হরফে প্রকাশ করা হয় ‘বিন্দু’ বা ‘.’-এর মাধ্যমে। বিন্দুর সংজ্ঞা হল, ‘যার দৈর্ঘ্য প্রস্থ, উচ্চতা নেই তবু অস্তিত্ব আছে’, ভাষান্তরে ‘যে অস্তিত্ব অতিসূক্ষ্ম ও রহস্যময়’। (কৃতজ্ঞতা: বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ)… যে এই সূক্ষ্ম অস্তিত্বের ব্যাপকতা ধরতে পারে তার ‘বিন্দুতে সিন্ধু দর্শন’ হয়। আর মহা-কালী খণ্ড ভাবে ‘প্রকাশিত’ হলে সে ‘ভদ্র-কালী’ হয়।
তাহলে কামসূত্র -গ্রন্থটির এমন পরিচিতি কেন!… -নিবন্ধের শুরুতেই ‘ক্ষেত্র’ শব্দের যে দুর্দশা বর্ণনা করা হয়েছে, ‘কাম’ শব্দের ক্ষেত্রেও তা-ই ঘটেছে (অর্থ সঙ্কোচন)। কথায় বা লেখায় হামেশাই ‘কাম-কাজ’, ‘কাম-ধাম’ শব্দগুলি ব্যবহার করলেও ‘কামশাস্ত্র’ শুনলেই কেন যে আমাদের মন একটি বিশেষ দিকেই ছোটে, –তা একমাত্র ফ্রয়েড-ই জানেন! ‘কাম’ শব্দের প্রকৃত অর্থ ‘কর্ম সম্পাদনের আগ্রহ/ইচ্ছা’ (স্মর্তব্য: কামনা, কাম্য, কামধেনু) ও ‘রতি’ {রত + ই (সক্রিয়ন)} শব্দের প্রকৃত অর্থ ‘কর্মে নিযুক্ত বা লিপ্ত হওয়া’। (স্মর্তব্য: আরতি, বিরতি, অবিরত, কর্মরত, ইত্যাদি শব্দগুলি।) অর্থ সঙ্কোচনের ফলে দুটি শব্দের অর্থ-ই শারীরিক যৌনতাকেন্দ্রিক হয়ে গিয়েছে।
কামসূত্রের প্রকৃত মর্মার্থ উদ্ধারের ব্যপারে আমাদের প্রধান মানসিক অন্তরায়গুলি হল ‘এতদিন ধরে শুনে/জেনে আসা বিদ্যে’ এবং শাস্ত্রটির সঙ্কুচিত (খণ্ডিত) বর্ণনার বিক্রয়যোগ্যতা বা ‘marketability’। সেই ১৮৮৩ সালে রিচার্ড ফ্রান্সিস বার্টন শাস্ত্রটির একটি ‘আক্ষরিক’ অনুবাদ সর্বপ্রথম প্রকাশ করেন। তারপর এতদিন ধরে সেই ‘অনুবাদের অনুবাদ’ ও সেই ‘দ্বি/তৃ বা অষ্ট-ধাপ’ অনুবাদগুলিতে ‘আপন মনের মাধুরী মিশায়ে’ সচিত্র সংস্করণ প্রকাশ ছাড়া কাজের কাজ কিছুই হয় নি। যদিও বার্টনসাহেবের অনুবাদটির সম্পূর্ণতা নিয়েও অনেক প্রশ্ন আছে।[xiii]
এই মুহূর্তের উচিত-প্রশ্ন হল -এতদিন ধরে যা শুনেছি বা জেনেছি, তার সবটাই ফেলে দেব? আর কামশাস্ত্র যদি শুধু জ্ঞানগম্যির কথা-ই কপচায়, তাহলে খাজুরাহো বা কোনারকের মন্দিরগাত্রে মিথুনমূর্তির ছড়াছড়ি কেন?
একটি কেজো উদাহরণ নেওয়া যাক। -ডাক্তার ও নার্স –দু’জনেই চিকিৎসাশাস্ত্রের ছাত্র/ ছাত্রী, কিন্তু, তাদের জ্ঞানের গভীরতা ও ব্যাপ্তির তফাৎ থাকে। সেই কারণে নার্স ‘চিকিৎসাশাস্ত্র’ বিষয়টির ‘নিম্ন অধিকারী’ ও ডাক্তার হল ‘উচ্চ অধিকারী’। (আমরা আজও কি এই ধারণা থেকে মুক্ত?) জ্ঞানচর্চায় ‘অধিকারী-ভেদে’ সূক্ষ্ম অভিজাততন্ত্রের গন্ধ থাকতে পারে, কিন্তু এই ধারণাটির যৌক্তিকতা সম্পূর্ণ উড়িয়ে দেওয়াও যায় না। মহাত্মা গান্ধী যে সাতটি মারাত্মক পাপ-কে চিহ্নিত করেছিলেন, তার মধ্যে একটি হল ‘knowledge without character’. অযোগ্যের হাতে জ্ঞানের ‘মালিকানা’ প্রাণঘাতীও হয়ে উঠতে পারে। অধিকারী-ভেদের মাধ্যমে জ্ঞানজগতের প্রবেশাধিকার নিয়ন্ত্রিত রাখা হয়েছিল। বহু শতাব্দী ধরে বেদ, উপনিষদ, মহাভারত, প্রভৃতি শুধুই শ্রুতিতে ছিল এই কারণেই।
খাজুরাহ, কোনারক, তথা এদেশের অসঙ্খ্য মন্দিরে মিথুনমূর্তির উপস্থিতি ‘অধিকারী-ভেদ’ ধারণার বাস্তব বহিঃপ্রকাশ। এই প্রাচীন ভারতীয় দর্শনটি খুবই সরল (কিন্তু গভীর), -নিম্ন অধিকারীদের জন্য মন্দিরের বহিরঙ্গ, আর দেবতা অবধি ‘পৌঁছুতে’ হলে (উচ্চ অধিকারী হতে গেলে) নিম্ন অধিকারী-সুলভ মানসিকতা অতিক্রম করতে হয়। মিথুনমূর্তি প্রসঙ্গে ‘প্রাচীন ভারতবর্ষের যৌনতার ঐতিহ্য মাত্র’ –গোছের চিন্তা আসলে খণ্ডজ্ঞানী আধুনিকতার মনপসন্দ্ ব্যাখ্যা।
নিম্ন অধিকারী-সুলভ মানসিকতা অতিক্রম করতে না পারার কারণে শাস্ত্র পড়লেও (বা শুনলেও) তার প্রকৃত অর্থ উদ্ধার হয় না। অধঃপতিত তান্ত্রিকরা জ্ঞানচর্চার বদলে বিকৃত যৌনাচার শুরু করে, অধঃপতিত (খর্বকায়) ব্রাহ্মণরা (বামুন বা বামনরা) জাত রক্ষার বদলে ‘কী করলে জাত যাবে’ –তা নিয়ে আগ্রহী হয়ে পড়ে, শিক্ষিত মানুষও সরীসৃপ-কে দুধ খাওয়াতে ছোটে…! অবশ্য, এ’সবকিছুর জন্য প্রাচীন সংস্কৃত বা বাংলাভাষার অর্থোদ্ধার করার সাধনী (tool), -‘ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধি’ (verb-based semantics) সময়ের সাথে হারিয়ে যাওয়াও একটি মূল কারণ।
প্রাচ্যের ও পাশ্চাত্যের আদি সৃষ্টিগুলিতে হামেশাই ‘জ্ঞান আরোহণ’ বা বিদ্যাচর্চার প্রক্রিয়াকে যৌনতার রূপক-এ (এবং উল্টোটাও) প্রকাশ করা হত।[xiv] ঘটনাচক্রে, ইংরেজি ‘intercourse’-শব্দটির আদি অর্থ হল ‘communication or exchange between individuals’ (যা কিনা জ্ঞানচর্চার একটি উৎকৃষ্ট মাধ্যম-ও বটে)। এই শব্দটি ‘sexual relations’ অর্থে সর্বপ্রথম লিপিবদ্ধ হয় ১৭৯৮ সালে। -সময়টা তাৎপর্য্যপূর্ণ। শিল্প-বিপ্লব তখন মধ্যগগনে। মানুষের জ্ঞানচর্চার উদ্দেশ্য ‘বিশুদ্ধ জ্ঞান’ থেকে ‘ফলিত জ্ঞানে’র দিকে অভিমুখ পরিবর্তনের সেই সময়ের এই ছোট্ট ঘটনার মাধ্যমে ভদ্র-দের ‘গোপন পাপ’ যেন এক মুহূর্তের জন্য ‘টুকি দিয়ে যায়’!
কিন্তু, সামান্য এক শব্দার্থের সঙ্কোচন বা পরিবর্তনের সাথে গোপন পাপের কী সম্পর্ক?… অখণ্ড-জ্ঞানকে খণ্ড করার পরের স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত ধাপ-টি হল তার ‘প্রয়োগ’ খুঁজতে যাওয়া। আর সেখানেই আসল উদ্দেশ্যের স্খলন শুরু। পর্বতের গা’ থেকে এক খণ্ড পাথর হাতে তোলা-মাত্র যখন অবচেতনেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি সেটি ‘ছুঁড়ে ফেলব’ নাকি ‘বাড়ি নিয়ে যাব’, তখন ‘পর্বতকে চেনার চেষ্টা’ বিষয়টি হারিয়ে যায়।
খণ্ডজ্ঞানের কুসন্তান হল খণ্ডবাদ, (-যা কিনা ভদ্র-দের সেই লুকোনো পাপ)। সে সবার আগে পৈতৃক সম্পত্তির চারপাশে পাঁচিল তুলে দেয়। জ্ঞানের খণ্ড বা ‘শাখা’গুলি (তাদের চর্চাকারীরা) একে-অপরকে ‘complementary’ না ভেবে ‘competitor’ ভাবতে শুরু করে। সেই পাঁচিল-ঘেরা মাটিতে হাঁটা দায়, প্রতিপদে শুনতে হয় -‘না বাছা, তুমি তো ভূগোলের লোক, ইতিহাসের জমিতে অনধিকার প্রবেশ করেছ কেন? বৈধ কাগজপত্র (ডিগ্রি) আছে?’ একে-অপরের সাথে তো বটেই, এমনকি একই বিষয়ের পৃথক ‘schools of thought’-এর মধ্যে তর্কের নামে অবিরত ঝগড়া চলতে থাকে! আধুনিকতার পিতৃপুরুষদের পরবর্তী ‘উদ্দেশ্যবিচ্যুত’ প্রজন্মের যাবতীয় অঙ্ক ‘differentiation’-এই আটকে যায়, ‘integrate’ করে আর ‘অখণ্ডতা’ ছুঁতে পারে না। কারণ, প্রয়োগবিদ্যা সাবালিকা হতে না হতেই বাণিজ্যের সাথে গান্ধর্ব বিবাহ সেরে ফেলে। অবশ্য বর্তমানের সাপেক্ষ মনে হয়, -সে বোধহয় জন্মের আগেই বাগদত্তা ছিল!
এবার আসা যাক শব্দার্থের সঙ্কোচন/পরিবর্তন প্রসঙ্গে;- প্রয়োগবিদ্যা ও বাণিজ্যের উপযুক্ত বাসরঘর হল বস্তুবাদী মানসিকতা। -আর আমাদের মুখের ভাষা আমাদের চিন্তা-ভাবনা ও মানসিকতাকে গভীর ভাবে প্রভাবিত করে। কোনও একটি বিষয় ‘গুরুত্বপূর্ণ নয়’ বোঝাতে আমরা কী কী শব্দবন্ধ ব্যবহার করি, তা খেয়াল করা যাক, -‘এটা কোনও ব্যাপার না’, ‘বেকার’, ‘নগণ্য’, ‘এটা নিয়ে ভেবে লাভ নেই’, ‘it doesn’t matter’, ‘it’s no-thing’ বা ‘it’s non-sense’, ইত্যাদি।[xv] -এই শব্দগুচ্ছ আমাদের অবচেতন মনকে ক্রমাগত পাখি-পড়াতে থাকে – যা ব্যাপার বা ব্যবসাযোগ্য নয়, যার employment/ deployment হয় নি, যার হিসেব করা যায় না, যা profitable নয়, যা matter বা thing নয়, যাকে পঞ্চেন্দ্রিয়ের দ্বারা বোঝা যায় না, বা এককথায় যা বস্তু নয়, -তা গুরুত্বপূর্ণ নয়।
তাহলে, যা-কিছু মনে বা অনুভবে থাকে, -সেই প্রবৃত্তি, বিশ্বাস, স্বপ্ন, সংস্কৃতি, প্রেম, মাতৃত্ব, পিতৃত্ব, স্নেহ, শ্রদ্ধা, এমনকি মানসিক যৌনতা – সব গুরুত্বহীন? কোয়াণ্টাম-বিজ্ঞানী লোথার শ্যাফারের কথায়, নিউটন ও ডারউইনের অবদানের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেও বলা যায় যে প্রথমজনের ‘ঘোর বস্তুবাদী পদার্থবিজ্ঞান’ ও দ্বিতীয়জনের ‘আগ্রাসন ও স্বার্থপরতার জীববিদ্যা’ বস্তুবাদের একচেটিয়া রাজত্ব তৈরী করতে সাহায্য করেছিল। যদিও ওই সূত্রগুলির বহু সীমাবদ্ধতা পরবর্তীকালে উদ্ঘাটিত হয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ডারউইনের ‘The Origin of Species’ বইটিতে একবারের জন্যও ‘evolution’ শব্দটি খুঁজে পাওয়া না। আর ‘survival of the fittest’ –শব্দবন্ধটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন হারবার্ট স্পেনসার (১৮২০-১৯০৩) নামের এক রাজনৈতিক তত্ত্ববিদ। -ডারউইনের সূত্রের সাথে নিজের অর্থনীতির সূত্র মিলিয়ে।… আজও স্কুল-কলেজ-অফিসঘরে সর্বত্র ও সর্বক্ষণ যার অনুরণন শোনা যায়! কিন্তু কেন?
‘ভদ্রলোকের আধুনিকতা’ এইসব অস্বস্তিকর প্রশ্ন সুচতুরভাবে এড়িয়ে যায় বলেই বাণিজ্য তলে তলে ভাবজগতকেও নিজের উপগ্রহে পরিণত করার চেষ্টা চালাতে থাকে। হয়তো সে’কারণেই আজকাল আকছার এক ধরণের বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে, -‘অবাঞ্ছিত মাতৃত্বের হাত থেকে মুক্তি’! ভাবজগতের কোন অধঃপতনে ‘মাতৃত্বে’র মতো এক সার্বিক বিষয়কে ‘গর্ভধারণে’র মতো একটি নির্দিষ্ট জৈবিক প্রক্রিয়ার সাথে গুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা, -ভাবতে অবাক লাগে! আসলে যত বেশি আধুনিক হয়েছি, আমাদের কথা-বার্তায় কি ভাবনায় ‘solid character’, ‘concrete decision’, ইত্যাদি শব্দবন্ধের ব্যবহার বেড়েছে। কারণ আধুনিকতা ‘চিত্ত-তারল্য’ (বিশৃঙ্খলা বা ‘chaos’) বরদাস্ত করে না। এই যেমন, উন্মাদ বা ‘আউল’ (পূর্ববাংলার আঞ্চলিক শব্দ) ও বাউল ভাবের ঘরের মানুষ। আর একরৈখিক আধুনিকতা ‘আউল-বাউল’ শব্দবন্ধটির অর্থ (‘উ’-বর্ণদুটি লুপ্ত করে) ইতর গালাগালিতে পরিণত করেছে।
যাই হোক, প্রয়োগবিদ্যা ও বাণিজ্যের সন্তান পণ্যবাদের জন্ম হতে দেরি হয় নি। -তার জন্মমাত্রই তার রূপে গুণে মানুষ মুগ্ধ। সে জগতবাসীর ঘরের মাখন (মানসিক অর্জন, উপার্জিত ধন) চুরি করে ফাঁক করলেও মানুষ তাকে আশকারা-ই দেয়। মাঝেমাঝে (‘দাম-টা বড্ড বেশি’ –বলে) অনুযোগ জানাতে গেলে পণ্যবাদ হরেকরকম ‘লীলা’ দেখাতে শুরু করে। তার বাঁশীর সুরে (বিজ্ঞাপনের চটকদারিতে) পুরনারীদের ‘মাখনে’র পর চরিত্রটুকুও যায়।… ওদিকে জগতবাসীর ট্যাঁক ফাঁকা করা ‘নৈবেদ্য’য় ফুলে-ফেঁপে ওঠে (বাণিজ্যের জমিতে) ‘ধন-বর্দ্ধন’ পর্বত। বিপদে পড়লে সেই পর্বতকেই আবার রক্ষাকর্তা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।… এর-ই মধ্যে আদিম মানুষের সহজাত সাম্যভাবনা নতুন মোড়কে হাজির হয়। কিন্তু, খণ্ডবাদের ছোঁয়া ছিল তো, তাই অনেক স্বপ্ন দেখিয়ে ‘সকলের সমান অধিকারে’র কথা বললেও প্রয়োগের বেলায় সে ‘পণ্যের (বা অর্থের) মালিকানা নিয়ন্ত্রণ ও বন্টনে’ এসে আটকে যায়। প্রয়োগবিদ্যার প্রেমে মজতে সময় নেয় না! প্রচলিত ব্যবস্থা থেকে মুক্তি দিতে এসে কেবলমাত্র তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষে পরিণত হওয়ায় রাম-রাবণের ‘ঠান্ডা-যুদ্ধ’ শুরু হতেও সময় লাগে না।
অসীম প্রকৃতিকে জানার চিরন্তন প্রয়াসে আর অন্ধবিশ্বাসের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য অখণ্ডজ্ঞানের ‘facultisation’ ও আধুনিকতার উদ্ভাবন। কিন্তু, কোথাকার জল কোথায় গিয়ে দাঁড়াল! আধুনিকতার পিতৃপুরুষরা কিন্তু এই পরিণতি আন্দাজ করেছিলেন। আর করেছিলেন বলেই হয়তো দেখি গ্যোথের মহাকাব্যের নায়ক (ফাউস্ট্) জীবনে যথেষ্ট শিক্ষা ও পেশাগত সাফল্য পাওয়া সত্ত্বেও তৃপ্তি পায় না, কারণ তার মনে হত -তার (খণ্ড)জ্ঞানের সঞ্চয় ফুরিয়ে গেছে। সে শয়তানের এক দাসের সাথে নিজের ‘আত্মার বিনিময়’ করে ফেলে। একমাত্র প্রেমের স্পর্শে কিছুক্ষণ সে শান্তি পায় বটে, কিন্তু সে’ প্রেম দীর্ঘস্থায়ী হয় না। তার (মানস) সন্তানের অপমৃত্য ঘটে। তার জ্ঞানের তৃষ্ণা কোনওদিনই পূরণ হয় না।
‘কিন্তু, ছোটোখাটো কিছু গোলমাল বাদ দিলে, দিব্বি-ই তো আছি! আলুর ব্যাপারির আতলান্তিকের খবরে দরকার কী?’… সঙ্গত প্রশ্ন। কিন্তু, এই প্রশ্নটা ‘আমার নয়’, ‘আমার মধ্যে বসে থাকা’ খণ্ডজ্ঞানীর বা ‘ভদ্রে’র। (আমার আর্থ-সামাজিক অবস্থান যে স্তরেই হোক না কেন।) -আসলে এটা ঠিক ‘প্রশ্ন’ও নয়, খণ্ডবাদের শিকড়ে সামান্য টান পড়তেই ছিটকে আসা প্রতিক্রিয়া! সে ধর্ম ও রাজশক্তির প্রতি অন্ধবিশ্বাস দূর করতে এসেছিল, একসময় (আমাদের মনোজগতে) সে নিজেই রাজ করতে শুরু করে তার ধর্মের প্রচার ঘটিয়ে দিল! বিশ্বাসের আধারটা বদলেছে শুধু, অন্ধত্বটা থেকেই গেল। আধুনিকতার নামে আসলে খণ্ডবাদ এমন একটা পরিবেশে সৃষ্টি করেছে -যা সুখ, সমৃদ্ধি, ক্ষমতা, সবকিছুর প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু, প্রতিশ্রুতির আড়ালে তার নিজের হাতে (বা সময়ের নিয়মে) প্রথমেই একটি রোগের কারণ তৈরি করে। তারপর ‘অ্যানাস্থাসিয়া’ বানায়। প্রচার চালায় (whispering campaign), রোগভোগ-টাই স্বাভাবিক! ওষুধের-ও জোগান দেয়।[xvi] ফলে কাঁচের দরজার বাইরে থেকে দেখে মনে, -কই, রুগীর তো কোনও কষ্ট দেখছি না, সে তো আরামে ঘুমোচ্ছে!…
প্রথমে নগরায়ণ হল। তৈরি হল ‘কর্মসংস্কৃতি’। খণ্ডবাদের চোখে ব্যাপারটা স্বাভাবিক (এবং লোভনীয়)। মানুষ ছিন্নমূল হয়ে শহরে ছুটল রুজিরুটির সন্ধানে। এদিকে কর্মসংস্কৃতির সাথে তার মর্মসংস্কৃতি মেলে না। ফলে ‘personal’ ও ‘professional’ নামে জীবন দু’ভাগ হল। (‘multiple personality disorder’-টি হয়তো হল না!) ‘অ্যানাস্থাসিয়া’র প্রভাবে যারা সারা জীবন ঝিমিয়েই রইল, তারা কিছু টের পেল না। আর যে কয়েকজনের ঘোর কাটল, তাদের (ছিন্ন-মূল বা খণ্ড-সত্তার) ব্যথা উঠলে তার জন্য রইল শহুরে/ ভদ্রলোকি কিছু বিনোদনের ‘ওষুধ’ (বিভিন্ন মোড়কে পণ্যবাদ)। -অগত্যা, সে’ওষুধ গিলে কিছুক্ষণ মৃদুস্বরে ‘ওয়াক্ থ্যু’ করা (বা না করা)। তারপর, আবার যে কে সেই। দেখে মনে হয়, -‘এই তো নিয়ম, ভালই আছে, এত রোজগার, ইত্যাদি!’ রবীন্দ্রনাথের কথায়, ‘এ দৌড়য় বিনা কারণে; যেন তার নিজেই নিজের কাছ থেকে পালিয়ে যাবার একান্ত শখ।… পালাতে পালাতে একেবারে বুঁদ হয়ে যাবে, ঝিম হয়ে যাবে, ভোঁ হয়ে যাবে, তার পরে ‘না’ হয়ে যাবে, এই তার মৎলব।’…
জ্ঞানের তিনটি স্তর, -‘মুক্ত চৈতন্য’, ‘শ্রী চৈতন্য’ ও ‘বদ্ধ চৈতন্য’। -অখণ্ড জ্ঞান, (আহরিত) খণ্ডজ্ঞান ও কার্য-কারণে সীমাবদ্ধ ব্যবহারিক খণ্ডজ্ঞান (programmed knowledge)। ব্যবস্থাগুণে আরও একটি ‘স্তর’ থাকে, যার নাম ‘পাঠ্যক্রম’। একটি সরল রেখাচিত্রের মাধ্যমে এদের কিছুটা বোঝার চেষ্টা করা যাক;-
জ্ঞানের উৎস ‘পরম ব্রহ্ম’, অভিমুখ-ও তাই। স্থান-কাল-পাত্রের অক্ষে সে ক্কচিৎ ধরা দেয় বটে, কত অক্ষে যে তার অধিষ্ঠান, -তা বলা কঠিন। মনোজগতে তার অধিষ্ঠান, বস্তুজগতের নিয়ম সে মানে না। -তার অক্ষ কখনও সত্য, কখনও কল্পনা!… যাই হো’ক, শ্রী-চৈতন্যর সাথে মুক্ত-চৈতন্যের ‘অক্ষে’র যোগ তো, তাই তার মধ্যে কিছুটা হলেও ‘মুক্তি’ খোঁজার প্রবণতা থাকে। এই প্রবণতা খণ্ডবাদের (বা তার পরম বন্ধু বাণিজ্যের) মতলবের পক্ষে বিপজ্জনক হতে পারে। কিন্তু বাতিল করাও ঝামেলা। তাই এক্ষেত্রে সে সুচতুর ভাবে ‘রাবড়ি-প্রযুক্তি’[xvii] চালাতে থাকে।
খণ্ডবাদের মূল কারবার বদ্ধ-চৈতন্য নিয়ে। আবার শুরু হয় ‘whispering campaign’, -বুঝলে ভাই, ‘অমুক’টা পড়ে বিশেষ লাভ নেই, ‘তমুক’ বিষয়ের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল, ইত্যাদি। -শিক্ষার ওপর দরজিগিরি চালিয়ে জন্ম থেকেই ‘কর্মসংস্কৃতি’ গেলানোর প্রচেষ্টা! তখন লীলা মজুমদারের গল্পে এক ছাত্র ভয়ের চোখে দেখে, –ক্লাসঘরে তার বন্ধুদের সঙ্খ্যা যত কমে, বাইরের মাঠে ছাগলের সঙ্খ্যা তত বাড়তে থাকে! সে সিদ্ধান্তে পৌছোয়, -মাষ্টারমশাই নিশ্চয় মানুষকে ছাগল বানানোর ম্যাজিক জানেন।
যাই হো’ক, এই ‘দরজিগিরি’র ফলে হতভাগ্য ‘ছাগলগুলি’র কী দশা হয়, –তা আরেকটু বিশদে দেখা যাক;-
‘…সে-ছেলের কখনো মানসিক পুষ্টি, চিত্তের প্রসার, চরিত্রের বলিষ্ঠতা লাভ হইতে পারে?… সে কি বয়ঃপ্রাপ্তিকালে নিজের বুদ্ধি খাটাইয়া কিছু বাহির করিতে পারে?… সে কি কেবল মুখস্থ করিতে, নকল করিতে এবং গোলামি করিতে শেখে না?… যেমন যেমন পড়িতেছি অমনি সঙ্গে সঙ্গে ভাবিতেছি না, ইহার অর্থ এই যে, স্তূপ উঁচা করিতেছি কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে নির্মাণ করিতেছি না। ইঁটসুরকি, কড়িবরগা, বালিচুন, যখন পর্বতপ্রমাণ উচ্চ হইয়া উঠিয়াছে এমন সময় বিশ্ববিদ্যালয় হইতে হুকুম আসিল একটা তেতালার ছাদ প্রস্তুত করো। অমনি আমরা সেই উপকরণ স্তূপের শিখরে চড়িয়া দুই বৎসর ধরিয়া পিটাইয়া তাহার উপরিভাগ কোনোমতে সমতল করিয়া দিলাম, কতকটা ছাদের মতো দেখিতে হইল। কিন্তু ইহাকে কি অট্টালিকা বলে?’… (‘শিক্ষার হেরফের’ -রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
মানুষ জন্মে তিন ধরণের অধিকার পায়। -তার পারিবারিক ও সামাজিক পরিচয়, তার পারিবারিক সম্পত্তি ও প্রাকৃতিক সম্পদ, এবং তার জন্মের আগের মুহূর্ত অবধি সমগ্র মানবজাতির অর্জিত যাবতীয় জ্ঞান। (এই জ্ঞানের অধিকার না থাকলে তাকে পশুশিকার, আগুন/ চাকা আবিষ্কার থেকে জীবন শুরু করতে হত!) এই অধিকারগুলির প্রতি পালনীয় কর্তব্যকে বলে ‘তর্পণ’। একটি বিশেষ দিনের বিশেষ সময়ে নদীতে দাঁড়িয়ে নদীর জল ছেটানো, –প্রকৃত তর্পণ নয়, তা একটি আচার মাত্র। যাই হোক, পরিবার ও সমাজের ভরণপোষণ হল পিতৃতর্পণ। পারিবারিক ও প্রাকৃতিক সম্পদের রক্ষা ও সমৃদ্ধিদান হল দেবতর্পণ। আর (শুধুমাত্র উপার্জন বা নিছক বিনোদনের মতলবে নয়) কৃতজ্ঞ চিত্তে জ্ঞানচর্চার ধারায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অংশগ্রহণ হল ঋষিতর্পণ।
‘কিন্তু, মনুসংহিতার মতো নানান কারণে বিতর্কিত গ্রন্থের কোথায় কে এক লাইন লিখে গিয়েছিল, -তার জন্য এত কিছু ভাবব কেন? –প্রচলিত ব্যাখ্যার সাথেও তো ঠিক মেলে না। আর যেখানে গ্রন্থটি আজ থেকে প্রায় দুই-আড়াই হাজার বছর আগে লেখা। তখন বসেই এতকিছু ভেবে ফেলেছিল, -এ যেন সেই ‘বেদ-পুরাণেই সব আছে’ –জাতীয় মৌলবাদী কথা!’
ভারতবর্ষের ইতিহাস ‘বৈদিক যুগ’কে মানে কিন্তু ‘বেদ’-কে মানতে চায় না। এদিকে ওই এক বেদ ছাড়া বৈদিক যুগের নুড়ি-পাথরও প্রত্নতাত্ত্বিকরা দিতে পারেন নি। সুতরাং, এদেশের প্রাচীন ইতিহাসের খোঁজে ‘হাতে রইল পেনসিল’, বারবার লেখা আর মোছা! এই বেদ-পুরাণ-রামায়ণ-মহাভারত নিয়ে ঝামেলা-ও কম নয়, -কেউ বলে ‘সব সত্য’, কেউ বলে ‘গাল-গপ্পো’। এক-একটি অলৌকিক কাহিনীর পঁচিশ পণ্ডিতের পঞ্চাশ ব্যখ্যা! ‘সত্য বনাম গল্প’ কাজিয়া দূরে সরালেও খটকা। -‘গণেশমাতা দূর্গা’ নাকি একই সাথে ‘শিবপ্রিয়া’ আবার ‘নারায়ণী’-ও![xviii]
কংসের গল্পই ভাবা যাক, -লোকটি আগেই জেনে ফেলল ভাগ্নের হাতে তার মরণ। বোন-ভগ্নীপতিকে গ্রেফতার করল, অতগুলো বাচ্চা মারল, তবুও ‘ভাগ্নে’র জন্ম আটকাতে পারল না! -এই কাহিনী ‘সত্য’ হলে কংসের, আর ‘কল্পনা’ হলে ব্যাসদেবের বুদ্ধি নিয়ে যে কোনও যুক্তিবান মানুষের-ই সন্দেহ জাগবে। – বোন আর ভগ্নীপতিকে দু’টো আলাদা ঘরে বন্দী রাখলেই তো ল্যাঠা চুকে যেত, কারাগারে কি প্রকোষ্ঠ কম পড়েছিল?
আসল রহস্য কী? –logical error নাকি lost in translation? একজন দোর্দণ্ডপ্রতাপ রাজা বা একজন মহান লেখক এমনধারা ভুল করবেন, -মানতে কষ্ট হয়। আবার যখন দেখি কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের বিষয় রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও আইন, অথচ তার নাম ‘অর্থশাস্ত্র’! এদিকে কৌটিল্যের ‘প্রমাণিত’ ঐতিহাসিক ভূমিকার কথা মাথায় রেখে তাঁর যুক্তির ভুল-এর কথা ভাবতেও সাহস হয় না। তাহলে? -প্রথমতঃ, অধিকাংশ প্রাচীন গ্রন্থ ‘কাব্য’-শৈলীতে রচিত। দ্বিতীয়তঃ, শুরুতে তারা শুধু ‘শ্রুতি’তে ছিল। এই শৈলীতে রচনার কয়েকটি শর্ত, –রচনাটিকে যতটা সম্ভব সংক্ষিপ্ত হতে হয়, শব্দচয়নে কাব্যভাব ও ছন্দ-ভাব বজায় রাখতে হয়, অলঙ্কার বা রূপক প্রয়োগ করতে হয়, ইত্যাদি। প্রাচীন গ্রন্থগুলির ক্ষেত্রে আবার এ’সবের সাথে ‘উচ্চ-নিম্ন অধিকারীভেদ’-এর বিষয়ও ছিল।
‘যে সর্বপ্রকার বিষয়ে বিরাজ করে এবং সর্ববিষয়ক বুদ্ধি প্রজ্ঞাপিত বা উন্মেষিত করে’[xix]-এর বদলে ‘সরস্বতী’-শব্দটি ব্যবহার করলে সব দিক-ই রক্ষা হয়। আবার একটি নদীমাতৃক ও নদীনির্ভর সভ্যতায় যেহেতু ‘সর্বপ্রকার বিষয়ে বিরাজ-’, ইত্যাদি ‘বৈশিষ্ট্য’ বা ‘ক্রিয়া’গুলি সভ্যতার (সরস্বতী-সিন্ধু সভ্যতার[xx]) মূল নদীটিরও মধ্যেও (ভাবে) বর্তমান, তাই তার নামও ‘স-রস-বতী’ বা ‘সরস্বতী’ হয়। অর্থাৎ, ‘আগে গুণবিচারী, পরে দর্শনধারী’। -যা কিনা প্রচলিত বিশেষ্যপদ-কেন্দ্রিক শব্দার্থবিধির সম্পূর্ণ বিপরীত পদ্ধতি।
শব্দার্থবিধি না চিনে প্রথমে যদি ‘ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল’ –স্তবকের শুধু আক্ষরিক অর্থটুকুই ধরি, আর তারপর ‘সুগন্ধী হিসেবে রৌদ্রের উপকার’ –গোছের টিকা রচনার প্রয়াস করি, -তাহলে তা শুধু ত্রুটিপূর্ণ-ই নয়, হাস্যকর-ও। যেমন, ‘কংস’ শব্দটি শুনলে একজন ‘ভোজবংশীয় রাজা’-ই মাথায় আসে। কাঁসার বা ‘কংস’ধাতুর থালায় খেয়েছি, তবু লক্ষ্য করি নি -এই ধাতুটি আসলে ‘একাধিক দুর্বল সত্ত্বার সংমিশ্রণে সৃষ্ট একটি সবল ও উজ্জ্বল সত্ত্বা’ (ব্যক্তি-বিশেষ নয়)। বৃহত্তর অর্থে একটি ‘শক্ত-সবল যৌথসমাজ’। -যার জন্মদাতা ‘উগ্র-সেন’। শব্দকল্পদ্রুম অভিধান অনুসারে ‘সেনা’ শব্দটি ‘সেন’ শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ! নিবন্ধের শুরুতে যেমন বলা হয়েছে, ‘ক্ষেত্র-ক্ষেত-ক্ষত্র-ক্ষত্রিয়’ –এই শব্দপরিবারের দিকে তাকালে আন্দাজ করা যায় এই ‘সেন’ বা ‘সেনা’র পূর্বপরিচয়। এদিকে দূর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘শ্রীমদ্ভাগবত’ অনুসারে কংস উগ্রসেনের ‘ক্ষেত্রজ’ (ক্ষেত্র হইতে জাত) সন্তান! –পুরো ব্যাপারটা কি তাহলে আজকের ভাষার ‘কৃষক অভ্যুত্থান’? -হতেই পারে! পালবংশের আগেও হয়তো এদেশের জনগণের তাদের রাজা বা নেতা নির্বাচন করেছিল।
কিন্তু প্রশ্ন হল, এই ভাবে ভাষাতত্ত্বের রাস্তায় ইতিহাস খুঁজতে যাওয়া কি আদৌ যুক্তিসঙ্গত? ইতিহাসকার নীহাররঞ্জন রায় (১৯০৩-১৯৮১) বা জার্মান নৃতত্ববিদ ইগন ফ্রিয়েরার ভন ইক্সস্টেড (Egon Freiherr von Eickstedt, 1892- 1965) -দের মতে ভাষাতত্ত্ব বাদ দিয়ে শুধু নৃতত্ত্বের মাধ্যমে ঐতিহাসিক জনতত্ত্ব (demographics)-এর সঠিক পরিচয় পাওয়া সম্ভব নয়। ‘দ্যা জার্নাল অফ্ আফ্রিকান হিস্ট্রি’ অনুসারেও আফ্রিকা মহাদেশে প্রাচীন ইতিহাস সন্ধানে অন্যতম প্রধান পন্থা ছিল ভাষাতত্ত্ব।[xxi]
যাই হোক, এই কংসের বিনাশ ঘটিয়ে (তার-ই জমিতে) ‘পুঁজিবাদে’র অবতার[xxii] (কার্ল মার্ক্সের কথায়) ‘কৃষ্ণ’ধনের রাজত্ব শুরু। যৌথসমাজের সেই আশঙ্কা আগে থেকেই ছিল। কৃষ্ণধনের সম্ভাব্য উৎসগুলিকে সে সবরকম ভাবে অবরুদ্ধ বা ‘restrict and restrain’ করার আপ্রাণ চেষ্টা করে। কিন্তু, একসময়ে এসে তার রক্ষীরা তন্দ্রা যায়, ‘iron curtain’ লুটিয়ে পড়ে। কৃষ্ণধনের ‘গোপনে বাড়া’র কথা জেনেও যৌথসমাজ তাকে ‘খতম’ করতে ব্যর্থ হয়। এরপর কৃষ্ণধনের গোকুল-লীলার কথা তো আগেই বলা হয়েছে। (‘কৃষ্ণ’ শব্দটি নিয়ে পরের কোনও নিবন্ধে বিস্তারে আালোচনা করা হবে।)
প্রতিটি চরিত্র বা নামপদের অর্থ ‘ক্রিয়াভিত্তিক পদ্ধতিতে’ নিরূপণ করলেই অলৌকিক কাহিনীর ভিতর থেকে লৌকিক ইতিহাস খুঁজে বা’র করা যায়। কিন্তু ‘চরিত্রে’ই আটকে যাওয়া-ই হল ‘lost in translation’–এর সূত্রপাত, আর সেই সাথে ‘নিম্ন অধিকারীত্বের’ উত্তরাধিকার বহন।
কাঁসা হো’ক বা যৌথসমাজ, -দু’জনেই ‘অম্ল’ সহ্য করতে পারে না। অম্ল = অম্ (অহম্) + ল (লালন)। অর্থাৎ, ‘অহম্বোধের (আমিত্বের) লালন যাহাতে’। আম-আদমির বোধ ‘কাঁচা’ থাকলে তার মধ্যে অম্ল-ভাব থাকে, বুদ্ধি ‘পাকলে’ অম্ল-ভাব দূর হয়। যে সারাজীবন এই অম্ল-ভাব বা আমিত্ব-বোধেই উড়ে চলে (ড়), সে হল ‘আমড়া’ (আমড়াগাছি = তোষামদ, ‘বার’-খাওয়ানো)। যে সারাজীবন আমিত্ব-বোধকে লালন (ল) করে চলে, সে হল ‘আমলা’ (আমলকি বা রাষ্ট্রের আমিত্ব রক্ষাকারী বিশেষ কর্মচারীবৃন্দ)। নিম্ন অধিকারীরা সন্তোষী পুজোর দিন টক (অম্ল) খায় না। -এই আচারটির গভীরের দর্শন হল, ‘আমিত্ব দূর না হলে মানসিক সন্তোষ আসে না’।
এবার মানুষের বস্তুবোধের ক্রমপর্যায়ের একটি উদাহরণ দেখা যাক,
১. এই শাড়িটি সুন্দর।
২. শাড়িটি আমার চাই।
৩. শাড়িটি আমি সযত্নে রাখব।
৪. শাড়িটা পরতে পরতে একঘেয়ে হয়ে গেছে।
অর্থাৎ,
১. মোহ বা ‘মিষ্টত্ব’ (‘মিষ্টি দেখতে’ বা ‘মিষ্টভাষী’ কথাগুলি স্মর্তব্য)।
২. অহম্বোধ বা ‘অম্লতা’।
৩. পোষণ (সংরক্ষণ) বা ‘লবণাক্ততা’ (লবণ বা নুনের সংরক্ষণ ক্ষমতা স্মর্তব্য)।
৪. বিরক্তি (বিতৃষ্ণা) বা ‘তিক্ততা’।
সুতরাং, মানসিক স্বাদগ্রহণের ক্রমপর্যায় হল -মিষ্ট, অম্ল, লবনাক্ত, তিক্ত। যা কিনা আমাদের জিভের স্বাদগ্রহণের ক্রমপর্য্যায়ের সাথে হুবহু মিলে যায়।
মনুসংহিতা একটি আইনগ্রন্থ। তার শূদ্রভাষ্য বা নারীভাষ্য নিয়ে আজকে অনেক প্রশ্ন জাগে ঠিক-ই, কিন্তু আইনের ক্ষেত্রে পাত্রের পাশাপাশি স্থান ও কাল-ও বিবেচিত হওয়া উচিত।[xxiii] লাইব্রেরীর দু-দশটি বই পোকায় কাটলে যেমন গোটা লাইব্রেরী বাতিল হয় না, তেমনই মনুসংহিতা ‘ভদ্র-ভাষ্য’টি মানবো কি মানবো না, -সেই সিদ্ধান্তে পৌছানোর আগে এমন ভাষ্যের কারণ, প্রেক্ষাপট এবং সর্বোপরি তার গভীরতা ও সত্যতার বিচার করা উচিত। আজকের প্রসঙ্গ ও গতকালের প্রাসঙ্গিকতা -আলাদা বিষয়। সেই রাস্তায় সবার আগে ‘পাপ’ বিষয়টি বোঝা যাক।
অসীমকে জানার সৎ ও মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে খণ্ডজ্ঞানের চর্চা শুরু হয় ঠিকই, কিন্তু জ্ঞানের প্রতিটি ধারা থেকে উপজাত (অধঃপতিত) প্রতিটি খণ্ডবাদ ‘একমাত্র আমিই সঠিক, একমাত্র আমিই শ্রেষ্ঠ, একমাত্র আমিই পথপ্রবক্তা’ জাতীয় মিথ্যাচার শুরু করে। গোঁড়া বামুন, কাঠমোল্লা, কট্টর কমিউনিষ্ট, মধ্যমেধার বিজ্ঞানী, দুঁদে আইনজ্ঞ, ক্ষুরধার বিজ্নেসগুরু, তুখোড় প্রযুক্তিবিদ্, হ্যানা-বাদী বা ত্যানা-বিদ্রা ঠিক যেমন দাবি করে। -এই হল সেই ‘গোপন পাপ’। যে পাপ থেকে ক্রমান্বয়ে (জ্ঞানতঃ বা অগোচরে) একের পর এক ক্ষতিকারক মৌলবাদ জন্মাতে থাকে। প্রথমে ‘বুড়ো মৌলবাদ’ বলে, ‘যা চলছে তা সম্পূর্ণ ঠিক, নতুন কিছু চলবে না।’ তখন প্রতিপক্ষ ‘খোকা মৌলবাদ’ বলে ‘যা চলছে তা সম্পূর্ণ ভুল, পুরোনো কিছু চলবে না।’ এবার খোকা যদি ‘জিতে’ও যায়, ক’দিন পরেই ‘নাতি মৌলবাদ’ হু্বহু এক কথা শোনায়। আর প্রতিবার এই ‘সম্পূর্ণ ঠিক’ – ‘সম্পূর্ণ ভুল’-এর চক্রে হারিয়ে যায় অনেক কিছুই।…
‘পাপ’, অর্থাৎ ‘পালকের পালয়িতা’ (সূত্র: বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ)। -আমারই শারীরিক বা মানসিক উৎপাদন যখন আমাকে শারীরিক বা মানসিক ভাবে পালন করতে শুরু করে, আমি তার উপরে সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে পড়ি। তখন কলুর বলদের মতো কেবল চক্রাকারে ঘুরতে থাকি, অগ্রসর হই না। ক্রমাগত ‘একই কর্মের পুনরাবৃত্তি’র ফলে ‘দক্ষ’ বা ‘expert’ হয়ে উঠি বটে, কিন্তু ‘শিবত্ব’ (স্বাভাবিক বিশুদ্ধতা[xxiv] বা natural perfection, – যা প্রকৃত জ্ঞানীর ধর্ম) থেকে বিচ্যুত হই। তখন আমার কর্মযজ্ঞে ‘সতীত্বে’র বা সততার অপমৃত্যু ঘটে। -‘পাপ’ হয়।
‘অতঃ কিম? –ঘোড়ার ডিম?’ অথবা ‘খাড়াইল-ডা কী?’…
খণ্ডবাদ শুরুতেই যে পাঁচিল তুলেছিল, সেই পাঁচিল-ঘেরা জমিতে যত বড় প্রাসাদ বানানো সম্ভব, সে ইতিমধ্যে বানিয়ে ফেলেছে (‘market economy’–এর ভাষায় যাকে ‘saturation point’ বলে)। শুরু হয়েছে ক্রমাগত ‘নতুন বোতলে পুরোনো মদ’ চালানোর প্রচেষ্টা। -আসলে ‘মদ’ সে একবার-ই তৈরি করেছিল, তারপর থেকে ‘বোতল’ বানিয়েছে শুধু। (প্রথমে CRT টিভি এল, তারপর একে একে LCD, LED, Plasma, HD, Curved, ইত্যাদি। বা প্রথমে ‘ক’-দল ক্ষমতায় আসে, তারপর ‘খ’-দল, এরপর একে একে গ, ঘ, ঙ, চ…। খণ্ডবাদ প্রতিবার বলে –‘আগেরটা ফালতু, এটাই সেরা।’ –কি হাস্যকর আত্ম-প্রবঞ্চনা! আর স্বীকার করতে লজ্জা নেই, –এতে আমরা সবাই সামিল। তবে বেলতলায় হাজারবার গেলেও যে উপায় মিলবে না, দুনিয়া সেটা ঠিক-ই টের পেয়েছে। খণ্ডবাদীরা বড়ো অর্থে উদ্দেশ্যচ্যুত হতে পারে, তাদের বুদ্ধিমত্তা যথেষ্ট-ই সচেতন। ধীরে ধীরে সে মন দিয়েছে (বা দিচ্ছে) অতীতের ভুল (বোধের ফাঁক ও কর্মের ফাঁকি) সংশোধনে। আবিষ্কারের নামে খণ্ডিত, সীমাবদ্ধ জায়গায় মাথা ঠোকার বদলে জ্ঞানের অখণ্ড উৎসের দিকে বা ‘crowdsourcing’-এ মনোনিবেশ করছে। ‘মোহিনীরূপে অমৃতহরণে’র পর তথ্যপ্রযুক্তি দুনিয়ার একাংশ বিদ্যা ও বাণিজ্যের এই শতাব্দীপ্রাচীন গঠবন্ধনকে অস্বীকার করে ‘Free and Open Source Movement’ শুরু হয়েছে। উত্তর খোঁজার চেষ্টায় জ্ঞানচর্চার বিভিন্ন শাখাগুলি একত্রিত হচ্ছে ‘Cognitive Science’ নাম নিয়ে।… এমনকি, (স্বভাবতঃ-ই বাণিজ্য-সেবক) আধুনিক ম্যানেজমেন্ট শাস্ত্রও (বিপদ বুঝে) প্রয়োগবাদী ‘Intelligence Quotient (IQ)’-এর বদলে ভাববাদী ‘Emotional Quotient (EQ)’-কে (অন্ততঃ কথায় হলেও) বেশি গুরুত্ব দিতে শুরু করেছে!
চক্রবৎ পরিবর্তন্তে… -শুভলক্ষণ। কিন্তু, সেই আনন্দযজ্ঞে ‘আমি’ কোথাও আছি কি! -কী করব? এই বয়সে এসে earning ছেড়ে learning করতে বসব? আবার বই মাথায় তুলে ঘুরে বেরাব?
না, এই ‘মাথায় তোলা’ও খণ্ডবাদের এক ‘pseudo-benevolent’ উপরচালাকি। কোনও মহান বা বড় কিছুর মধ্যে বিরোধিতার বীজ দেখলেই খণ্ডবাদ প্রথমে তার প্রশংসা করে বা তাকে পুরস্কার-টুরস্কার দিয়ে নিজের দিকে টানতে চেষ্টা করে। -তা সম্ভব না হলে ‘পুজো করে বিসর্জন দেয়’ বা জনসংযোগ নষ্ট করে। শারীরিকভাবে ‘খুন’ করা অ-ভদ্রতার লক্ষণ, -ওতে ভাবমূর্তি খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা কিনা! সেই জন্যই ‘বিশ্বকবি’ ‘কবিগুরু’ ‘জাতীয় কবি’ –বলে পুজো করা আর গুটি কয়েক গান-কবিতার চর্বিতচর্বণ, -আমাদের রবীন্দ্রচর্চা সেখানেই শেষ হয়। বা এদেশের প্রায় প্রতিটি পুলিশ-থানায় গান্ধীজীর ছবি টাঙানো থাকে, কিন্তু সেখানে তাঁর অহিংসা বা সত্যের আদর্শ কতটা পালিত হয়, তা না বলাই ভাল।…
আমিও এই অভ্যেসের দাস, -সময়মতো জ্ঞানচর্চাকে মাথায় তুলে ধরেছিলাম, সময়মতো নামিয়েও রেখেছি। -শুধু বুকে নিই নি কোনওদিন। পুরাণে সরস্বতী কখনও ব্রহ্মার অনুগামী, কখনও নারায়ণের। অর্থাৎ, বিদ্যাধারার প্রবাহ কখনও জ্ঞানবাদের খাতে, কখনও পুঁজিবাদের। -এই দ্বিধা হয়তো আজও সম্পূর্ণ কাটে নি, তাই বলে অন্ততঃ ‘সেতুবন্ধনে কাঠবেড়ালীর ভূমিকা’ও কি পালন করতে পারি না? আর কতদিন পেটের ভাত জোটানোর আছিলায় চিন্তাজগতের ‘দুয়ার আমার বন্ধ করে’, পণ্যবাদের জমিতে প্রতিমুহূর্ত উঞ্ছবৃত্তি করব আর ভাবব, -আগে বদলাক, তারপর দেখা যাবে! এই আজন্মলালিত মানসিক স্থবিরতা জীব্বদশাতেই আমাকে অপাংক্তেয় করে দেবে না তো?…
রেফারেন্স:
[i] ইংরেজির ‘field’ শব্দটির ব্যবহার শুরু হয় ত্রয়োদশ শতাব্দীতে। শব্দটি তখন ‘battle-ground’ অর্থে ব্যবহৃত হত। ‘battle-ground’, –যেখানে অবিরাম ‘কর্তন’-ক্রিয়া চলে। (সূত্র: Online Etymology Dictionary)
[ii] যা কর্তনকে তাড়িত করে, তা হল ‘ক্ষত’। কর্তনক্রিয়ার (ক্ষ) দিশাগ্রস্ত বা purposeful (এ) তাড়ণ বা impulsion/ desire (ত্) রহে বা রক্ষিত হয় (র) যেখানে, –তা হল ‘ক্ষেত্র’। কর্তনকারীর ধর্ম, অর্থাৎ ‘মানুষের গতিবিধি কাটছাঁট করার মাধ্যমে শাসন করা, আবার যুদ্ধের সময় ছেদন করা’ –সেই হল ‘ক্ষত্রধর্ম’ বা ক্ষত্রিয়ের ধর্ম। কর্তনের (ক্ষ) সীমায়ন বা restriction (ম্) –এর আধার (আ) হল ‘ক্ষমা’। কর্তনের (ক্ষ) সীমায়িত বা limited/ non-infinite (ম) তারণ বা impulsion/ desire (ত্) –এর আধার (আ) হল ‘ক্ষমতা’।… (‘ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থ নিষ্কাশন পদ্ধতির জন্য কৃতজ্ঞতা: বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ – কলিম খান ও রবি চক্রবর্তী)
[iii] ‘…ছেলেরা যেদিন পরীক্ষাসমুদ্র উত্তীর্ণ হয় সেই দিন হইতে মা সরস্বতীর নিকট বিদায় গ্রহণ করে। জ্ঞান চর্চার যে কিরূপ অতুলনীয় আনন্দলাভ হইয়া থাকে তাহা সে কোনও কালে শিখে নাই।…’ –আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়।
[iv] আজও একদল পণ্ডিত সরস্বতী নদীর অস্তিত্বই স্বীকার করেন না, বলেন –এই নদী নাকি একটি বৈদিক কল্পনা মাত্র! কিন্তু, ১৯৮০ সালে আমেরিকার ল্যাণ্ডস্যাট ও ১৯৮৪ সালে ইণ্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশনের আই. আর. এস. ১ সি. উপগ্রহের তোলা ছবিতে সরস্বতী নদীখাত চিহ্নিত হয়। নদীটি হিমালয়ের বন্দরপুছ হিমবাহ থেকে উৎপন্ন হয়ে হরিয়ানার আদিবদরী, রাখিগিরহি (আলোচ্য সভ্যতার বৃহত্তম প্রত্নতাত্ত্বিক সাইট) হয়ে আরাবল্লির পশ্চিম দিক দিয়ে রাজস্থানের কালীবঙ্গান, পাকিস্তানের নওয়াকোট হয়ে কচ্ছের রণে এসে আরবসাগরে মিশেছিল। মোটামুটি ১৮০০-১১০০ খ্রী.পূ. –এর মধ্যে কোনও এক সময়ে ভূমিকম্পে আরাবল্লি ও হিমালয়ের plate-shifting হয়। এর ফলে নদীটিকে পুষ্টকারী জলধারাগুলি (যমুনা, সুপিন, রুপিন, টনস, ইত্যাদি) গতিপথ পরিবর্তনের কারণে নদীটি ক্রমশঃ শুকিয়ে যায়। থর মরুভূমির সৃষ্টি হয়। ১৯৯৮ সাল নাগাদ ভারত সরকার এই শুকনো নদীখাত বরাবর ২৪টি নলকূপ খোঁড়ে। ভাবা অ্যাটোমিক রিসার্চ সেন্টার এই নলকূপের জলের আইসোটোপিক পরীক্ষা করে জানায় –সেই জলের উৎস হিমালয় পর্বত। (সূত্র: ‘Current Science’ journal, Journal of Indian Society of Remote Sensing, ‘লুপ্ত সরস্বতী’ – ডঃ মণিরত্ন মুখোপাধ্যায়, ইত্যাদি।) আসলে এই আবিষ্কার-টি কিছুটা ‘দূর্ঘটনা’ ছিল। পোখরান অঞ্চলে পরমাণু বোমা পরীক্ষার আগে কিছু গোপণ সরকারী সমীক্ষা চলেছিল। সেই সময় প্রায় হঠাৎ-ই এটি আবিষ্কৃত হয়। সম্ভবতঃ মূল সমীক্ষার গোপণীয়তা ও তার পরপর-ই পোখরান বিস্ফোরণ, পাকিস্তানের পাল্টা বিস্ফোরণ, ৯৯-এ কার্গিল যুদ্ধ –নানান কারণে খবরটি তখন তেমন শিরোনাম পায় নি। যেহেতু সরস্বতী ছিল তার উপনদীগুলির ‘যোগফল’, তাই পরিবর্তিত ভূগোলে যমুনা সহ সরস্বতীর সেই উপনদীগুলি যেখানে (প্রয়াগ) গঙ্গার সাথে মিলেছে, -তাকেই ত্রিবেণী সঙ্গম বলা হল। যদিও আজকের রাজস্থানে সরস্বতী নদীর পুরোনো গতিপথের একটি অংশ দেখা যায়। মরে যাওয়া সরস্বতী নদীর গতিপথ খুঁজে পাওয়াটা সহজ ছিল না। ইসরো-র উপগ্রহ-চিত্রের মাধ্যমে হরিয়ানার তিন জেলায় সরস্বতী নদীর সম্ভাব্য গতিপথকে চিহ্নত করা হয়। এর পরেই সেখানে ড্রেজিং শুরু হয়। আদি বদরীতে মাটি খুঁড়তেই গ্যালন গ্যালন জল উঠতে থাকে। কুরুক্ষেত্র, যমুনানগর এবং কৈথাল জেলায় সরস্বতী নদীর যে গতিপথ উপগ্রহের মাধ্যমে চিহ্নিত করা গিয়েছিল, বর্তমানে তাকে পুনরুজ্জীবীত করার চেষ্টা চলছে। আইআইটি-র শিক্ষক-ছাত্র থেকে শুরু করে ২৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরস্বতী নদীর পুনরুজ্জীবনে কাজ করছেন।… ঘটনাচক্রে, তথাকথিত ‘সিন্ধু সভ্যতা’র আজ অবধি আবিষ্কৃত কম-বেশি ২৬০০ সংখ্যক সাইটের প্রায় ২০০০টির অবস্থান সরস্বতীর নদীখাত বরাবর। সুতরাং, প্রশ্ন উঠতেই পারে, -সিন্ধু সভ্যতা ঠিক কতটা শুধুমাত্র ‘সিন্ধু সভ্যতা’?
[v] তথ্যসূত্র: ‘Das alte Indien’ (Old India) by Peter von Bohlen (1796-1840), German Orientalist and Indologist
[vi] তথ্যসূত্র: ‘Empire of the Soul’ by Paul William Roberts
[vii] তথ্যসূত্র: ‘Taming the Infinite’ by Prof. Ian Stewart
[viii] পূর্ণসংখ্যাকে ১০ বা ১০০-এর পরিবর্তে ৬৪ ভাগে ভাগ করা ভারতে সুদীর্ঘ সময় ধরে প্রচলিত ‘টাকা-আনা-পয়সা’ হিসাবপদ্ধতির সমতুল্য। ১ টাকা = ১৬ আনা, ১ আনা = ৪ পয়সা, ১ টাকা = ৬৪ পয়সা। শুভঙ্করী গণিতে এখনও এই হিসাব পদ্ধতির উল্লেখ পাওয়া যায়।
[ix] জ্ঞানচর্চার সাথে সম্পর্কিত ‘Eye of Horus’-এর নাম পাশ্চাত্যে ‘All seeing eye’ হওয়ার কারণ সেই সময়ের বিদ্বানদের ক্যাথলিক চার্চের মধ্যযুগীয় ধ্যানধারণা-বিরোধী মানসিকতা। (উল্লেখ্য, শয়তান ইভ্-কে জ্ঞানবৃক্ষ চিনিয়ে বলেছিল, ‘…the day you eat from it your eyes will be opened…’ – Old Testament Bible, Genesis 3.5). বস্তুতঃ, দেবস্থানের নৈতিক অধঃপতন ঘটলে কোনও দেশের বিদ্বানরা-ই চুপ থাকেন নি। ভারতবর্ষেও যে কারণে ‘দেবগৃহে’র নাম একসময় ‘মন্দির’ হয়ে যায়। মন্দির (মন্দ + ই + র) = মন্দ বা গতিহীন/ অধঃপতিত (স্মর্তব্য: মন্দ-বায়ু, মন্দা-বাজার, শব্দগুলি) ভাবের সক্রিয়তা (ই) রহে বা রক্ষিত হয় (র) যেখানে।
[x] ‘উৎকোচকাশ্চৌপধিকা বঞ্চকাঃ কিতবাস্তথা। মঙ্গলাদেশবৃত্তাশ্চ ভদ্রাশ্চেক্ষণিকৈঃ সহ॥’ -মনুসংহিতা (৯.২৫৮)
[xi] কামসূত্রে (১.৩.১৬) লিপিবদ্ধ চতুষষ্টি-কলা:- ‘আকর-জ্ঞানম্। আকর্ষণ-ক্রীড়া। আলেখ্যম্। অভিধান-কোষ-ছন্দো-জ্ঞানম্। অক্ষর-মুষ্টিকা-কথনম্। বালক-ক্রীডনকানি। ভূষণ-য়োজনম্। চলিতকয়োগাঃ। চিত্রা য়োগাঃ। চিত্রশাকাপূপ-ভক্ষ্য-বিকার-ক্রিয়া। দশন-বসনাঙ্গরাগাঃ। দেশ-ভাষা-জ্ঞানম্। ধারণ-মাতৃকা। ধাতু-বাদঃ। দুর্বচকয়োগাঃ। দ্যূত-বিশেষঃ। গন্ধ-যুক্তিঃ। গীতম্। হস্ত-লাঘবম্। ইন্দ্রজালম্। কাব্য-সমস্যা-পূরণম্। কর্ণ-পত্ত্র-ভঙ্গাঃ। কৌচুমার-য়োগাঃ। কেশ-মার্জন-কৌশলম্। কেশ-শেখরাপীডয়োজনম্। ক্রিয়া-বিকল্পাঃ। মাল্য-গ্রন্থন-বিকল্পাঃ। মানসী-কাব্য-ক্রিয়া। মণি-ভূমিকা-কর্ম। মণি-রাগ-জ্ঞানম্। মেষ-কুক্কুট-লাবক-য়ুদ্ধ-বিধিঃ। ম্লেছিতক-বিকল্পাঃ। নাটকাখ্যায়িকা-দর্শনম্। নাট্যম্। নেপথ্য-যোগাঃ। নৃত্যম্। পানক-রসরাগাসব-য়োজনম্। পট্টিকা-বেত্রবাণ-বিকল্পাঃ। প্রহেলিকা। প্রতিমা। পুষ্প-শকটিকা-নিমিত্ত-জ্ঞানম্। পুষ্পাস্তরণম্। পুস্তক-বাচনম্। রূপ্য-রত্ন-পরীক্ষা। সম্পাট্যম্। শয়ন-রচনম্। শুক-সারিকা-প্রলাপনম্। সূচীবাপ-কর্ম। তক্ষণম্। তণ্ডুল-কুসুম-বলিবিকারাঃ। তর্কূ-কর্মাণি। উদক-ঘাতঃ। উদক-বাদ্যম্। উত্সাদনম্। বাদ্যম্। বাস্তু-বিদ্যা। বৈজয়িকীনাং বিদ্যানাং জ্ঞানম্। বৈনায়িকীনাং বিদ্যানাং জ্ঞানম্। বস্ত্র-গোপনানি। বীণা-ডম-রুক-সূত্র-ক্রীড়া। বিশেষক-ছেদ্যম্। বৃক্ষায়ুর্বেদ-য়োগাঃ। যন্ত্র-মাতৃকা॥’
[xii] সিদ্ধান্ত = চিন্তা/ ভাবনায় ‘সিদ্ধি’ লাভের ‘অন্তে’ যা আসে। ‘চটজলদি সিদ্ধান্ত’ আসলে মানসিক প্রতিবর্ত ক্রিয়া বা reflex action, সিদ্ধান্ত নয়।
[xiii] ‘… (Burton) managed to get a rough approximation of the text published in English in 1883, nasty bits and all…’ – Wendy Doniger (Professor of History of Religions, University of Chicago).
[xiv] ‘And Adam knew Eve his wife; and she conceived..’ (Old Testament Bible, Genesis 4.1). ‘শাস্ত্রযোনিত্বাৎ’ (ব্রহ্মসূত্র বেদান্ত দর্শন, ১.৩)। বাউলগানে হামেশাই ‘গুরু-বাক্য’ অর্থে লিঙ্গ ও ‘শিষ্যের কান’ অর্থে ভগ/ যোনি শব্দ ব্যবহার হয়। (সূত্র: ‘গভীর নির্জন পথ’ –সুধীর চক্রবর্তী)… এছাড়া (ঊমার যোনিতে প্রোথিত) শিবলিঙ্গ পূজার প্রচলন-ও স্মর্তব্য।
[xv] কৃতজ্ঞতা: ‘Infinite Potential: What Quantum Physics reveals about how we should live’ by Prof. Lothar Schafer
[xvi] কিন্তু, ‘… all the proposed remedies are different forms of the same illness that they aim to cure…’ – ‘Science, Order and Creativity’ by Prof. David Bohm and Prof. E. David Peat
[xvii] রাবড়ি-প্রযুক্তি: রাবড়ি তৈরির পদ্ধতি। দুধের পাত্র আগুনে বসিয়ে ওপর থেকে ক্রমাগত পাখার বাতাস মেরে যাওয়া। (‘রবীন্দ্রনাথ ঠিকই লিখেছেন, কিন্তু সে’কথায় তো আর জীবন চলে না।’ –গোছের কথাবার্তা।)
[xviii] ‘গনেশমাতা দূর্গা যা শিবরূপা শিবপ্রিয়া। নারায়ণী বিষ্ণুমায়া পূর্ণব্রহ্মস্বরূপিণী॥’ (ব্রহ্মবৈবর্ত্তপুরাণ, প্রকৃতি খণ্ডম, ১.১৩)
[xix] ‘মহদর্ণ সরস্বতী প্রচেতয়তি প্রজ্ঞাপয়তি কেতুনা কর্ম্মনা প্রজ্ঞয়া বেমানি চ সর্ব্বাণি প্রজ্ঞানান্যভি বিরাজতি॥’ (নিরুক্ত: ‘সরস্বতী’র শব্দার্থ প্রসঙ্গে।)
[xx] ঋগবেদের (আনুমানিক ১৫০০-১২০০ খ্রী.পূ.) প্রাথমিক অধ্যায়গুলি রচিত হয়েছিল সরস্বতী নদীতীরে। তাই বেদের শুরুর দিকে প্রায় প্রতিটি ছত্রে ‘মাতা’ সরস্বতীর আরাধনা। সরস্বতী ‘দেবত্বে’ উপণিত হয়। (‘যার দানে আমরা তুষ্ট হই’ বা নিরুক্ত মতে ‘যে ঐশ্বর্য এবং ঈপ্সিত বস্তুগুলি দান করেন’ = দেবতা। স্মর্তব্য: পিতৃদেব, মাতৃদেবী, পতিদেবতা, গণদেবতা, ইত্যাদি শব্দগুলি।) ভৌগলিক কারণে সরস্বতী নদীর ‘মৃত্যু’ ঘটলে সভ্যতাটি গাঙ্গেয় অঞ্চলে সরে আসে। ঋগ্বেদের মোটামুটি দশম অধ্যায়ের আগে তাই গঙ্গার উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায় না।… অনেকে বলেন, ঋগ্বেদে নাকি সিন্ধু নদীকেই সরস্বতী নদী নামে বর্ণনা করা হয়েছে! কিন্তু, ‘ইমং মে গঙ্গে যমুনে সরস্বতী শতুদ্রি স্তোমং সচেতা পুরুষ্যা। অসিক্ল্যা মরুদ্বুধে বিতস্তয়ার্জীকীয়ে শৃণুহ্যা সুষোময়া॥ তৃষ্টাময়া প্রথমং যাতবে সজুঃ মুসর্ত্বা রসয়া শ্বেত্যা ত্যা। ত্বং সিন্ধা কুভয়া গোমতীং ক্রুমুং মেহৎস্বা সরর্থং যা ভিরীয়সে॥’ (১০/৭৫/৫-৬) –এই শ্লোকদুটি পড়লেই বোঝা যায়, সেই বক্তব্য সম্পূর্ণ ভুল।
[xxi] ‘The work of historical and comparative linguists has long interested African historians… Once classified, linguists can then reconstruct earlier forms of present languages, thus providing direct evidence of words, their meanings and historical influences in the past. Finally, linguists seek to explain innovations that are revealed in their reconstructions by pointing to a combination of internal linguistic developments and different forms of contact that occurred among speakers of different languages.’ – The contributions of linguistics to the study of history in Africa, The Journal of African History (Cambridge University Press)
[xxii] ‘…the world still jogs on, solely through the self-chastisement of this modern penitent of Vishnu, the capitalist.’ (Karl Marx. Capital, Vol. – 1, Chapter – 24, Sec. – 3)… বিষ্ণু বা নারায়ণ প্রথমে জ্ঞানবাদী বা ‘গদাধারী’ ছিল। {গদ = ‘গামীর দাতা যাহাতে’ বা ‘যে শব্দ কথকের মনোভাব বহন করে’। গদগদ = জ্ঞানের কথায় মজে যাওয়া। গদাঘাত = যুক্তির আঘাত। ‘গদ’-এর চলমান বা যোগ্য (য) রূপ হল ‘গদ্য’।} পরে সেই ‘গদ’-এর ন-করণের (negation) ফলে সে পুঁজিবাদী বা ‘ন-গদ নারায়ণ’ হয়ে যায়। (বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ) সময়ের প্রয়োজন অনুসারে যার দশরকম manifestation. তার অনুগামী (স্ত্রী) ধনের দেবী, -যে আবার ‘বাণিজ্যে বাস করে’।… (এই আলোচনা চালিয়ে যাওয়া-ই যায়। কিন্তু, সেক্ষত্রে নিবন্ধটি obesity-এর শিকার হত।)
[xxiii] উদাহরণ: শরিয়তি আইনের বহুবিবাহ বা অতিসরল বিবাহ বিচ্ছেদ প্রথার যৌক্তিকতা নিয়ে আজকে প্রশ্ন উঠতেই পারে, কিন্তু ভোলা উচিত নয় যে, ইসলাম ধর্মের গোড়ার দিকে যুদ্ধ-বিগ্রহ লেগেই থাকত। হাজার হাজার নিহত/ নিরুদ্দেশ/ বন্দী যোদ্ধাদের পরিবারের আর্থিক, সামাজিক ও শারীরিক নিরাপত্তা এবং সম্মানের দায় কে নেবে, -তাদের সহযোদ্ধারা ছাড়া? (জীবনবীমা বা স্বল্পসঞ্চয় প্রকল্প তো ছিল না তখন!) একে মরুভূমির দেশ, তার ওপর অস্থির রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা, -বিবাহের মাধ্যমে পরিবার গঠন ছাড়া পথ কোথায়? আবার নিরুদ্দেশ/ বন্দীরা বেঁচে ফিরলে তখন সরল বিবাহ বিচ্ছেদ।… পরে এই আইনের বহু অপব্যবহার হয়েছে ঠিক-ই। আজকের প্রশ্ন ওঠাটাও ঠিক। কিন্তু, কোনওদিন-ই এটি প্রাসঙ্গিক ছিল না, -এই ধারণা ঠিক নয়।
[xxiv] ‘…শিবত্ব কী? মুনিগণের এই প্রশ্নের উত্তরে বায়ু কহিলেন –স্বাভাবিক বিশুদ্ধির নাম শিবতা।’ -শিবপুরাণ, বায়বীয় সংহিতা, চতুর্থ অধ্যায়, শ্লোক নং ২০। (কৃতজ্ঞতা: কলিম খান)
করাচি বন্দরে এককালে গ্রিক-পারসিক-আরবীয় সওদাগরেরা নোঙ্গর করেছে; অনেক স্থাপত্য চিহ্ন আজো রয়ে গেছে; যা…..
তিনি বললেন, ভাষা হল ওষ্ঠের উপর সুধার মতো। আর বললেন, কবিতা যথেষ্ট স্বাদু, কিন্তু…..
রূপকথা পড়েছেন ছোট বেলায় অনেকে একথা আর বলা সন্দেহমুলক, প্রযুক্তির ব্যবহার জন্মের পর থেকে এখন …..
একটি পরাধীন দেশ আর তার বাসিন্দাদের মনে স্বাধীনতার আকুতি আমরা দেখেছিলাম ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে। এর…..