ভবিতব্য

কেয়া চ্যাটার্জী
গল্প
Bengali
ভবিতব্য

– মা, মা, তাড়াতাড়ি খেতে দাও। অফিসে লেট হয়ে যাবে।

ধড়মড়িয়ে উঠলাম ঘুম থেকে। সকাল সাতটা। এলার্মটাও বাজেনি ছাই। বাথরুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে বেরোতেই টনক নড়ল, অফিস? মানে? কে যাবে অফিস? আমার স্বামী তো স্কুল টিচার আর শ্বশুর মশাই সেই কবে রিটায়ার করেছেন। নীচ তলায় এসে দেখি একজন বছর পঁচিশ-ছাব্বিশের যুবক সুট বুট পরে আমার সামনে দাঁড়িয়ে। আমাকে দেখে ভ্রূ কুঁচকে ব্যাগ গোছাতে গোছাতে বলল,

“কি গো মা, শরীর ঠিক আছে? এত বেলা হলো যে উঠতে। ব্রেকফাস্টটা অফিসে করে নেবো?”

আমি তখনও ভ্যাবাচ্যাকা ভাব কাটিয়ে উঠতে পারিনি। আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করলাম, “কে তুমি?” সামনের যুবকটি চোখ দুটো গোল গোল করে প্রায় চিৎকার করে বলে উঠল, “মা তোমার কি স্মৃতিশক্তি লোপ পেয়েছে? আমি ঋভু, তোমার ছেলে!” ছেলে? আমার ছেলে? এতবড় কবে হলো? এই তো কাল রাতেও আমার বুকের সঙ্গে সেঁধিয়ে শুয়েছিল, তখন বয়স ছিল তিন বছর চার মাস, এক রাতে এতবড় ছেলের মা হয়ে গেলাম কিভাবে? যুবকটি কিছুক্ষন অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে একটি বিরোক্তিসূচক শব্দ করে পকেট থেকে একটা রিমোট বের করে একটা বোতাম টিপতেই ঘরে প্রবেশ করলো একটি রোবট। তার পিকপিক শব্দে কান ঝালাপালা হওয়ার জোগাড়। বিরক্ত হয়ে ছেলেটিকে বললাম, “এটা কি, কি চায়?” ছেলেটি, যে কিনা, আমার ঋভু বলে নিজেকে দাবী করছে সে ততোধিক বিরক্ত হয়ে বলল, “আরে এটা তো জিনি। বাবার তৈরি করা রোবট। তুমি তোমার ফেভারিট কার্টুন ক্যারেক্টারের সাথে নাম মিলিয়ে রেখেছিলে জিনি। অবশ্য নিজের ছেলেকে ভুলে গেছ যখন তখন রোবটকে কিভাবে মনে রাখবে আর!” অভিমানে ভারী হয়ে গেল তার মুখ। দেখে বড্ড মায়া হলো। ঋভু রোবটটিকে ঘর গেরস্থালির সমস্ত কাজের লিস্টি দিয়ে অফিসে বেরিয়ে গেল। রোবটই রান্না করবে, ঘর মুছবে, বাজার করবে, কাপড় কেঁচে শুকোতে দেবে। শুধু তার মধ্যে সময় মতো নির্দেশটা input করতে হবে।

ব্যাপারটা বেশ খুঁটিয়ে দেখতে হবে। কি এমন ঘটলো এক রাতে? আমি বাড়িটাকে পুঙ্খানুপুঙ্খ দেখতে শুরু করলাম। হম, বাড়িটার ধাঁচ একই থাকলেও খোল মোচড় পাল্টেছে। কোথায় সেই লাল মেঝে আর নোনা ধরা দেওয়াল, আর পুরোনো ধাঁচের দরজা জানলা, সব কিছু পাল্টে একেবারে ঝাঁ চকচকে ব্যাপার। হাল ফ্যাশনের পাথর আর রঙে আমার সেই পুরোনো শ্বশুর ভিটে উধাও। দেওয়ালে ঝোলানো ফোটোগুলিতে, হ্যাঁ, হ্যাঁ, ওই তো আমি। একটু ভারী চেহারা, বার্ধক্যের ছাপ পড়া চেহারাটা তো আমারই মনে হচ্ছে। পাশাপাশি রয়েছে পুরোনো ছবিও, ঋভুর জন্মদিনের, প্রথম স্কুল যাওয়ার, অন্নপ্রাশনের ছবি, আমাদের বিয়ের, ঘুরতে যাওয়ার ছবি। একটি শোকেস ঠাসা আমার লেখা বই, পত্রিকা ও পুরস্কার। নাহ, এটা আমারই বাড়ী। আমার হয়তো সত্যিই বড়সড় স্মৃতি লোপ পেয়ে গেছে।

রান্না ঘর পেরিয়েই একটা ঘর। দরজা খুলতেই ঠান্ডা হাওয়ার ঝলক এসে লাগলো মুখে। উঁকি মেরে দেখলাম একটা বিশাল বড় কালো চেয়ারে বসে আছেন একজন ভদ্রলোক, কাঁচা পাকা চুল দাঁড়ি, গায়ে এই গরমেও কোট-প্যান্ট, হাতে দামী ঘড়ি আর চোখে চশমা। ভদ্রলোকের সামনে একটি দেওয়াল জোড়া টেলিভিশন, সেখানে একঝাঁক বিদেশি তরুণ-তরুণী বসে রয়েছেন। ভদ্রলোক কোনো একটি বিষয়ের ওপর লেকচার দিচ্ছেন। ভালো করে দেখে বুঝলাম ইনি আমার স্বামী। প্রায় তেইশ-চব্বিশ বছরের তফাতে লোকটা এতো বুড়ো হয়ে গেছে! এই তো সেদিন বিয়ে হলো। ঘরটির দেওয়াল জুড়ে মানুষটার ছবি। দেশী-বিদেশী সাইন্টিস্ট ও শিল্পপতিদের সাথে! দেখেও গর্বে ভরে যায় মনটা। ইসস, এতো এতো সুন্দর স্মৃতি কেউ ভুলে যায়? আমি একটা যাচ্ছে তাই!

ক্লাস শেষ হলো। ডায়াস থেকে নেমে পতিদেব কোট খুলতে খুলতে বললেন, “চীন, জাপান, আর মস্কোতে ইনস্টিটিউট আজ থেকে শুরু হলো, বুঝলে তো। সেই ভোর চারটে থেকে ক্লাস নিচ্ছি। কিছু খেতে দাও তো। এরপর ঘুমোবো। আবার দুপুর দুটো থেকে আয়ারল্যান্ডের স্টুডেন্টদের ব্যাচ।” মনিবের মুখ থেকে কথা খসার সাথে সাথেই জিনি ডাইনিং টেবিল সাজিয়ে দিল। আমি বোকার মতো জিজ্ঞেস করে ফেললাম, “ঘুমোবে? আর স্কুল?” আমার পরমেশ্বর খাওয়া থামিয়ে ভ্রূ কুঁচকে কিছুক্ষন আমায় নিরীক্ষণ করে বললেন, “তোমার ভোলা রোগ আছে জানি, এতো বাড়াবাড়ি রকমের হয়েছে জানতাম না তো? আজ কুড়ি বছর হলো স্কুল ছেড়েছি, ভুলে গেলে?” আমি আমতা আমতা করছি। সত্যিই তো ভুলে গেছি। কিন্তু আদৌ কি ভুলেছি। কাল রাতেও তো… চিন্তায় ছেদ ঘটলো, দেখলাম আরেকটি যন্ত্র এসে আমার নাকের ডগায় এক দিস্তা কাগজ এনে নামালো। আমার স্বামী একটু চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললেন, “ঠিক আছে গাড়িতে রেখে এসো।” ততক্ষণে জিনি তার রেকর্ড চালু করে দিয়েছে,

“madam, your son has informed you to get ready for the meeting with the psychiatrist in an hour.”

এবং সঙ্গে সঙ্গে কাগজগুলো নিয়ে রওনা দিল গাড়ির উদ্দেশ্যে। আমার দিকে পতিদেব কিছুক্ষন হাঁ করে তাকিয়ে থেকে কি বুঝলেন জানিনা, স্বভাবগত ঝড়ের বেগে রিভিশন দেওয়ার মতো কিছু পুরোনো কথা বলতে লাগলেন। আমি কিছু মেলাতে পারলাম, কিছু আমার এন্টেনা ধরতেই পারলো না। কি করে পারবে? আমি কি আদৌ ওই ঘটনা গুলো চাক্ষুস করেছি? কানের কাছে কাগজ বহুল যন্ত্রটি পিকপিক করেই যাচ্ছে। বিরক্ত হয়ে বললাম, ” ধুর বাবা, এটা কি করছে এখানে? বন্ধ করো।” আমার পতিদেবের হুঁশ ফিরল। তিনি একটি রিমোটের বোতাম টিপে যন্ত্রটি বন্ধ করলেন, “দুমাস আগে জিনিসটা আবিষ্কার করলাম। আমার মস্তিষ্কের সঙ্গে ওর কানেকশন রয়েছে, আমি যা ভাবি ও তাই লেখে। অবশ্য তোমার তো মনে থাকারই কথা নয়।” আমি ভাবার বৃথা চেষ্টা করলাম না। মনে মনে স্বস্তি পেলাম, যাক কেউ তো লোকটার মনের আর মুখের কথার মধ্যে তফাৎ করার জন্য আছে। আমি তো পাঁচ বছরেই ফেল করলাম। পাঁচ বছর নাকি পঁচিশ? নাকি আরো কিছু বছর পেরিয়ে গেছি আমি। লুপ্ত হয়ে গেছে মাথার ক্যানভাস থেকে?

ইতিমধ্যে সোফার ওপর আবির্ভাব হলো এক পুরুষ মূর্তির। ঘিয়ে জামার ওপর ব্রাউন সুট, লাল রঙের টাই, টাক মাথা, চোখে চশমা, মুখে এক গাল অভয়দানের হাসি। ঠিক তার পাশেই আবির্ভুত হলো সেই যুবকটি, অর্থাৎ ঋভু। সে আমাকে একটি চেয়ারে বসিয়ে সকাল থেকে ঘটে যাওয়া সমস্ত বৃত্তান্ত সবিস্তারে বলল এবং এটাও বলল যে আমার ভুলে যাওয়া স্বভাব চিরকালের। ডাক্তার আমায় কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করে খসখস করে প্রেসক্রিপসন লিখে বললেন, “পুরোনো দিনের ছবি আর ভিডিও গুলো দেখুন তো বসে বসে। খুব কাজে দেবে। আর অবশ্যই ওষুধগুলো সময় মতো খাবেন, নার্ভগুলো একটু রেস্ট পাবে।” ব্যাস,সঙ্গে সঙ্গে তিনি অন্তর্হিত হলেন। ছেলে উৎসাহিত হয়ে বলল, “আমি সন্ধ্যেবেলা এসে সব চালিয়ে দেবো। very good idea. জেসিকাও দেখবে।” আমি হতচকিত হয়ে বললাম, “জেসিকা কে?” আমার পতিদেব বসে বসে পাঁউরুটি আর ডিমের ওমলেট চিবোচ্ছিলেন, সেটি গলাদ্ধকরণ না করেই উত্তেজিত হয়ে বললেন, “তোমার ছেলের বউ। যে জার্মানিতে থাকে।” বলেই রেগেমেগে উঠে চলে গেলেন ঘুমোতে। আমি আবার প্রশ্ন করতে উদ্যত হচ্ছি, বেগতিক দেখে আমার ছেলেও গেল অদৃশ্য হয়ে। যাহ বাবা! এতো একেবারে গুপি-বাঘা কেস! এই আছে, এই নেই? স্বপ্ন দেখছি নাকি, সত্যিই ঘটছে এগুলো আমার সাথে? চিমটি কাটার প্রয়োজন হলো না। আমার একমাত্র সঙ্গী, ওই পিকপিকানো জিনি চলে এসেছে আমার কানের মাথা খেতে। সত্যি কি আজব এই দুনিয়া! মানুষ একাধারে নিঃসঙ্গ আবার ব্যস্ত। শান্তি খুঁজতে আর বনলতাদের আবির্ভাব হয়না হয়তো, যন্ত্রই যন্ত্রণার অবসান ঘটায়।

আমার এখন অখন্ড সময়। ছেলে অফিসে, স্বামী বিদেশি ছাত্র-ছাত্রী পড়িয়ে ঘুমাচ্ছেন, ঘরে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে যন্ত্রমানবী জিনি। তার ডিফল্ট ইনস্ট্রাকশন লিস্টে ঘর ঝাঁট দেওয়া আর মোছার নির্দেশ রয়েছে। মাঝে মাঝে এসে কি রান্না হবে সেই ডেটা ইনপুট করে নিয়ে যাচ্ছে। সে কাজ করছে। আমি বসে আছি আর এই কয়েক ঘন্টার কথা বার বার ভাবছি। মেলাতে পারছি না কিছুই। যন্ত্রণায় মাথা ছিঁড়ে আসছে। এতটাও কি ভোলা যায় একটা মানুষের পক্ষে?

কিছুক্ষন পর জিনি এসে দাঁড়ালো সামনে। সে এখন আদেশ চাইছে, অন্তত আমার তো তাই মনে হলো। তার পিকপিক শব্দের রকম সকম ধীরে ধীরে বুঝতে পারছি। কি আশ্চর্য, আগে মেয়েরা শ্বশুর শাশুড়ির সাথে মানিয়ে নেওয়ার কথা ভাবতো, আর এখন রোবটের সাথে। জিনির দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে তাকে বসতে বললাম। সে বসলো। তার ক্লান্তি নেই, কাজ ফাঁকি দেওয়ার ঝঞ্ঝাট নেই, খাওয়া, চা, জলের বালাই নেই। শুধু সারাদিনে দু’ঘন্টা চার্জের ক্ষিদে। জিনি আমার দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে আছে আদেশের অপেক্ষায়। তার নীল চোখ, ঘন কালো চুল, গোলাপি নখ, ফর্সা চামড়া, শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সবই মানুষের মতো। শুধু তার ভিতরে বসানো আছে মেশিন ও জটলা পাকানো কিছু তার, সেসবের জোরেই সে দিবানিশি কর্মরত। এরকম আরো কতো জিনি আছে হয়তো এই যুগে! তাদের উপিস্থিতি হয়তো অন্ন কেড়েছে কিছু গীতা দি, বিমলা পিসি, সরমা মাসির। হয়তো কাজের ক্ষেত্র কমেছে, বেকারত্ব বেড়েছে, দেশ হয়ে উঠেছে অরাজকতার কেন্দ্র বিন্দু! এই মুহূর্তে আমার একান্ত আপন সই ওই যন্ত্রটি। মানববহুল জগতে যন্ত্র মানুষের সঙ্গী। কি আশ্চর্য্য না? তার দিকে তাকিয়ে বললাম, জিনি আমার তো কিছুই মনে নেই। আমার প্রশ্নের উত্তর কি তুমি দিতে পারবে? সে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ঘাড় নাড়ল। আমি বললাম, “এই যে ডাক্তার এলেন, কিভাবে এলেন? দরজা দিয়ে বা গাড়ি করে তো এলেন না। হঠাৎ আবির্ভুত হলেন। কি করে?” সে গড়গড় করে বলতে লাগল,

“ম্যাডাম, বর্তমানে সব মানুষের শরীরের সাথে লাগানো থাকে একটি খুবই ছোট চিপ। সেই চিপের মাধ্যমে আপনি বিনা সময় ব্যয় করে যেখানে খুশি, যখন খুশি চলে যেতে পারেন। শুধু ঠিকানাটি ইনপুট করতে হবে। এই যে ডাক্তার এলেন তাঁকে আপনার ছেলে আপনার ঠিকানাটি দিয়েছেন তাই তিনি যথা সময়ে আপনার ড্রয়িংরুমে এসে হাজির হয়েছেন।”

― আচ্ছা। আর জেসিকা কে?

― জেসিকা আপনার ভাবি পুত্রবধূ।

― আমার ছেলে জার্মানিতে গেছিল?

― না ম্যাডাম। ফেসবুকে ওদের আলাপ। তারপর ওই চিপের মাধ্যমেই ওদের মুখোমুখি আলাপ ও ডেটিং। ওরা প্রত্যেক উইকেন্ডে দেখা করে, ডিনার করে। তারপর আবার যে যার বাড়ি ফিরে যায়।

― মানে কোনো ভিসা, পাসপোর্টের দরকার নেই?

― না।

― এতে তো। ক্রাইম মাথা চারা দিয়ে উঠবে?

― টেকনোলজিতে সর্বদাই ফাঁক ফোকর আছে। সেসব ঠেকানোর জন্যও গবেষণা চলছে।

আমি উৎসাহিত হয়ে বললাম, “তার মানে মানুষ এখন গাড়ি বা মোটর যানবাহন ব্যবহার করে না?” সে তার যান্ত্রিক ভঙ্গীতে বলল, “না ম্যাডাম। যাও ব্যবহার হয়, খুব কম।” আমি কিছু না ভেবেই দৌড়ে গেলাম দরজার দিকে। সত্যি তো, এতক্ষন যে দিনের আলোই দেখিনি। পর্দা ঘেরা ঘরেই নিষ্কর্মার মতো বসে ছিলাম। যানবাহন নেই মানেই তো সেই ছোটবেলার মতো পরিবেশ। গাছ-পালা, পুকুর, ঠান্ডা বাতাস, স্নিগ্ধ দুপুর, বিকেলের খেলার মাঠ। যন্ত্র পৌঁছে দিচ্ছে গন্তব্যে নামমাত্র সময়ে, তাহলে হাতে পাওয়া যায় সূর্যাস্ত দেখার অবসর আর কাছের মানুষদের জন্য সময়। চোখ দুটো আনচান করে উঠল নীল আকাশ দেখার জন্য, সবুজ ঘাসে পা ফেলার জন্য। দরজা খুলতেই আমার সমস্ত কৌতুহলের অবসান ঘটল। একি! চারিদিকে যে শুধুই মুখোশধারী মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের চেনার কোনো উপায় নেই। গোটা মাথাটাই একটি ভারী ধাতব মুখোশ দিয়ে ঢাকা। আমার বাড়ির মাথার ওপর দিয়ে চলে গেছে উড়ালপুল। কালো গ্যাসের ধোঁয়ায় চোখ জ্বালা করছে, নিঃস্বাস নিতে পারছি না। হর্নের শব্দে কানের পর্দা ফেটে যাওয়ার জোগাড়। শরীর যেন ভীষণ খারাপ লাগতে শুরু করলো। কান চেপে সবে বসে পড়েছি দরজার সামনে, জিনি এলো উদ্ধারকারী হয়ে। ওই ধাতব মুখোশটি পরিয়ে দেওয়ার সাথে সাথে সমস্ত শব্দ থেমে গেল, নিঃস্বাস স্বাভাবিক হয়ে এলো, চোখ ঠান্ডা হলো, শরীর কিছুটা ধাতস্ত হলো। কিন্তু এই মুখোশের বাইরে বেরোলেই মৃত্যু অনিবার্য। জিনি দরজা বন্ধ করল। আমি মুখোশের আড়াল থেকে নিজেকে বের করে এনে বললাম, এসব কি? গাছ? পাখি? ঘাস? কোথায় সেসব?
জিনি এই প্রথম হেসে উঠল। তার হাসি যেন তাচ্ছিল্যকে প্রশ্রয় দিল। রোবট হাসতে পারে? আগে তো দেখিনি। ধমকের সুরে বললাম, “হাসছ যে?”

― আপনি ভুল করছেন। এ পৃথিবীর মাথার উপর উড়ালপুল, ঘরের ভেতর বনসাই এর জঙ্গল। গাছ নেই, পাখি নেই, আকাশ নেই, জল নেই, প্রাণ নেই। এ পৃথিবী মৃত। সম্পূর্ণ  মৃত ও যান্ত্রিক। এখানে প্রেম হিসেব কষে হয়, সম্পর্কও ভীষণ জটিল ক্যালকুলেশন। এখানে সারল্য নেই, ছুটি নেই, জলছবি নেই, ভুল নেই।

জিনি যেন অনেক দূর থেকে কথাগুলো বলছে। যেন আকাশবাণী হচ্ছে। পৃথিবী, আমার প্রিয় পৃথিবী, সাধের কোলকাতা ফুরিয়ে গেল? এক নিমেষে? এক রাতে? এ কোথায় এসে পড়লাম আমি? কোন কংক্রিটের বনাঞ্চলে? মাথাটা দপ দপ করছে। আর কিছুক্ষন ভাবলেই হয়তো মাথার রগগুলো ছিঁড়ে যেত যদি না এক মহিলার আগমন ঘটতো।

আমার চিন্তাভাবনায় ছেদ টেনে দরজাটা খুলে গেল। সন্ধ্যা নামছে। আধো অন্ধকারে মহিলার মুখ দেখা যাচ্ছে না। তার ব্যাকগ্রাউন্ডে পলিউসনের ক্যানভাস। গাউন পরিহিত, ছোট ছোট চুলের মহিলাটি এক আঙুল উঁচু হিল জুতো পরে আমার সামনে এসে দাঁড়াতেই চমকে উঠলাম। কে? এ কে? আমি?

বলিরেখা দেখা দিয়েছে মুখে, চুলে পাক ধরেছে সামান্য, চেহারা প্রস্থে বেড়েছে আরো একটু, তবে চেহারায় আধুনিকতার ছাপ। এই চেহারা আমার। মানে ভবিষ্যৎ আমি-র। এই মুহূর্তে আমার ছেলে আর আমার স্বামীর সামনে দাঁড়িয়ে আছে দুজন আমি― ভবিষ্যৎ আমি আর বর্তমান আমি অথবা অতীত আমি। মানুষ দুটোকে দেখে বোঝাই যাচ্ছে তারা যারপরনাই হতচকিত ও কিংকর্তব্যবিমূঢ়। আমার ছেলে দুই মা-কে সামনে দেখে ভেবেই যাচ্ছে কে তার আসল মা। একজন মা পঞ্চাশোর্ধ আরেকজন তুলনামূলক কম বয়সী। সকালের তাড়াহুড়ো আর ব্যস্ততায় দুই কর্তা দেখেইনি যে, যে মানুষটা তাদের সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছে তার চেহারাটা একটু অন্যরকম লাগছে। মাথা নেড়ে ভাবলাম, নাঃ কর্তা মশায় আর পাল্টালো না। অতীতেও না, ভবিষ্যতেও না। ভুল পাল্টাতে হবে। “একদম ঠিক” বলে উঠলো ভবিষ্যৎ আমি। সবাই চমকে উঠে বলল, “কি ঠিক?” সে হেসে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “ওই যে ভাবলি, ভুল পাল্টাতে হবে। ওই ভুল পাল্টাতেই তো গেছিলাম অতীতে।” তার কথা শেষ হতে না হতেই পতিদেব গর্জে উঠে বললেন, “তুমি আমার টাইম ট্রাভেল মেশিন ব্যবহার করেছ?” ভবিষ্যৎ আমি ডোন্ট কেয়ার ভাব দেখিয়ে বলল, “হ্যাঁ, নয়তো কি? তুমি কষ্ট করে বানালে, দেখবো না কাজ করছে কিনা?” রক্তচক্ষু পতিদেবতা ফুঁসতে ফুঁসতে বলে উঠলেন, “তা কি দেখলে শুনি?” জিনির বানানো চায়ে চুমুক দিয়ে ভবিষ্যৎ আমি বলল, “দেখতেই তো পাচ্ছ। বেশ ভালোই কাজ করছে।”

এবার আমি, আরে মানে এই যে বর্তমান আমি (নাকি অতীত, কি জানি ছাই!) ব্যগ্র হয়ে বললাম, “তা কাজ তো করছে বুঝলাম কিন্তু আমায় এখানে আনা হলো কেন? আর কিভাবেই বা এলাম?” ভবিষ্যৎ আমি একটু চোখ বুজে কিছু একটা হিসেব করে নিয়ে বলল, “এখন দ্যাখ হলো গিয়ে ২০৪৪। আমি কাল মানে ১৫ই জুন, ২০৪৪ সালে ওই টাইম ট্রাভেল মেশিন টেস্ট করতে গিয়ে ওটা যখন হাতে পরি তখন একটা টাইম বা ডেট দিতে বলল। আমি মনের মতো একটা ডেট বসিয়ে দিতেই হুস করে এই গোটা বাড়িটা উধাও হয়ে অন্ধকার নেমে এলো। আমি নিজেকে পেলাম পাশের বাড়ির দিদির ছাদে। সেই যে থার্টি ফার্স্ট ডিসেম্বর পালিত হয়েছিল! জামাইবাবু কেমন সুন্দর বিরিয়ানি রান্না করেছিলেন মনে পরে? যাইহোক আবার ডেট দিলাম আবার হুস করে চলে গেলাম দুর্গাপূজার বিসর্জনের দিনটায়। ঋভু নাচ্ছিল। আমি একটু লুকিয়ে আবার ডেট দিতেই চলে এলাম ঘরে। মানে আমাদের শোবার ঘরে। দেখলাম ঋভু আমার আমার সঙ্গে সেঁধিয়ে ঘুমিয়ে রয়েছে আর আমি কপালে হাত দিয়ে ভবিষ্যতের কথা ভাবছি। আমার লেখালিখির ভবিষ্যৎ, ঋভুর ভবিষ্যৎ, আমার স্বামীর ভবিষ্যৎ। আমি বুঝলাম এই যন্ত্রটা থট রিডিংও করে। অন্তত নিজের অতীতের মনের কথা শুনতে পায়। আমার মাথাতেও দুস্টু বুদ্ধি খেলে গেল, আমিও একটা টেস্ট করলাম। ” সবাই সমস্বরে বলল, “কি?” ভবিষ্যৎ আমি এক চুমুকে চা শেষ করে বলল, “দেখলাম যে গুপি বাঘা কেস হয় কিনা। আমি টুক করে অতীত আমির হাতটা ধরে ডেট পাল্টে দিলাম। ব্যাস চলে এলাম এখানে।” ঋভু দিকে চোখ গোল গোল করে জিজ্ঞেস করলো, “আর আমি?”

― আমি মানে?

― আমি তো ওদিকে একা পরে আছি। আমি তো ছোট।

আমিও ভীষণ চিন্তায় পড়লাম। সত্যিই তো। যে সময়টাকে আমি বর্তমান ভাবছিলাম, সেটায় তো আসলে আমি নেই। তার মানে ওখানেও সকাল হয়েছে। নিশ্চই সবাই খুঁজছে আমায়। আহারে, ছেলেটা ভীষণ কাঁদছে হয়তো। প্রচন্ড রাগ হলো নিজের ওপর। বুড়ো বয়সে কি এরকম ভীমরতি চাপবে নাকি আমার মাথায়?

এইবার পতিদেব মুখ খুললেন, “না না, সেদিকটা সেফ। অতীতে সময় থেমে গেছে। মানে ওখানে ওই মাঝরাত্রি হয়েই আছে। আর এখানে যে আছে সে আসল মানুষ না, সে আসলে ক্লোন। শরীরটা হাওয়ায় ভেসে আছে। তাকিয়ে দেখো তোমার পা মাটিতে ঠেকে নেই।”

আমি নীচে তাকিয়ে দেখলাম সত্যিই আমার পা মাটি থেকে এক আঙুল উঁচুতে আছে। আমি আসলে শূন্যে ভাসছি। এতক্ষন খেয়ালই করিনি। নাঃ অতীতে গিয়ে নিজেকেও পাল্টাতে হবে। তবে আদৌ যেতে পারবো তো অতীতে?

“সেটাই তো চাইছিলাম।”বলে উঠল ভবিষ্যৎ আমি। আমি ভ্রূ কুঁচকে বললাম, “মানে?” সে বলল, “ওই যে ভাবছিস না পাল্টাতে হবে। ওই পাল্টাতেই তো চেয়েছিলাম। হলো না তো। অতীতের কতো ভুল জমে জমে এই ভবিষ্যৎ তৈরি বলতো? অতীতটা পাল্টে গেলে কি সুন্দর জীবনটাই না পেতাম। তাই তো তোকে এখানে রেখে চলে গেলাম অতীতে। সেই দমিয়ে রাখা প্রেম করার ইচ্ছে, বন্ধুদের সাথে সময় কাটানোর লোভ, একটু নিজের মতো বেঁচে থাকার জীবন, কিছুই তো পাইনি। সেগুলো খুঁজতেই তো চলে গেলাম। কিন্তু পেলাম কই? অতীতে গিয়ে নিজেকে পাল্টানো যায়। নিজের সব কিছু পাল্টানো যায়না। নিজের আশে পাশের মানুষদের পাল্টানো যায় না। তারা একই রকমভাবে দূরেই থাকে।” ছলছল চোখে কথা বুজে আসে ভবিষ্যৎ আমি’র। ঘরে এই মুহূর্তে নিস্তব্ধতার চিৎকারে কান পাতা দায়। কিছু একটা যেন ভেঙে গেল, চিরতরে।

আমার একদা বিবাহিত পুরুষটি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “এটা একটা বিশাল বড় ভুল। এভাবে টাইম ট্রাভেল মেশিন ব্যবহার করা যায়না। উচিতও না। এতে সময় পর্দার ঘনত্ব কমে আসবে। পৃথিবী বিপর্যস্ত হবে।”

ভবিষ্যৎ আমি মুচকি হেসে বলল, “আমি আদপে মানুষটাই ভুল। তাই তো এখনকার মানুষগুলোর মতো হুটহাট আবির্ভাব হইনা, পায়ে হেটে ঘুরি, বই লিখি, পিডিএফ তৈরি করিনা, একটু…।” সিঁড়ি বেয়ে সে চলে গেল উপরে। কি এক কষ্ট আমার কণ্ঠরোধ করলো। সত্যিই কি কিছু পাল্টানো যায় না? ভদ্রলোক সামনে এলেন, এসে আমার হাতে একটি পাতলা চিপ ধরিয়ে দিয়ে বললেন, “এটিকে ধ্বংস করতে হবে। এটি একটি সর্বনাশা জিনিস। তুমি ফিরে যাও আর একে ধ্বংস কিরে দাও। কারুর হাতে যেন না পরে সাবধান।” হঠাৎ ঋভু দৌঁড়ে এসে আমার হাত চেপে ধরে বলল, “যদি কিছু পাল্টাতে পারো মা, তবে এটুকু করো আমার জন্য, আমি রুদ্ধশ্বাসের জীবন বাঁচতে চাইনা। একটু স্বস্তির জীবনের খোঁজ দিও। টাকা রোজগার করতে করতে হাঁপিয়ে উঠেছি মা, হাঁপিয়ে উঠেছি।” আমি বুঝতে পারছি আমি ধীরে বিলীন হয়ে যাচ্ছি। ওই যন্ত্রের আবিষ্কারক সময় পাল্টে জিনিসটা আমার হাতে লাগিয়ে দিয়েছেন।

ধীরে আমার দৃশ্যপট পাল্টে গেল। চোখ খুলে দেখলাম, চারিদিক অন্ধকার, আমার সেই ছোট্ট ছেলেটা আমায় জড়িয়ে ঘুমিয়ে কাদা, মোবাইলের ঘড়িতে রাত সাড়ে তিনটে, আমার স্বামী তখনও ড্রইংরুমে কোনো এক কলিগের সঙ্গে নতুন সিলেবাস নিয়ে আলোচনারত। উঠে মুখে চোখে জল দিতে দিতে ভাবলাম পুরোটাই হয়তো স্বপ্ন। পুরোটাই মনের ভুল। ওরকম আজগুবি ব্যাপার হয় নাকি! এমনসময় হাত থেকে টুপ করে খসে পড়লো একটা কালো ধাতব বস্তু। তার সামনের অংশ পুরোটাই স্ক্রিন। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেল, এটিই সেই বস্তুটি যার জন্য এতো কিছু ঘটলো এবং এর আবিষ্কারক এটিকে ধ্বংস করার নির্দেশ দিয়েছেন। বাথরুমে গিয়ে জিনিসটা সঙ্গে সঙ্গে ফ্লাস আউট করে দিলাম। এতো জল ঢুকে বস্তুটি খারাপ হয়ে যাওয়াই উচিত। আর যদি না হয়, যদি ওয়াটারপ্রুফ হয়, তবে জলপথ পেরিয়ে পৌঁছে যাবে অন্য কারুর হাতে। তারপর সে যদি ব্যবহার করে ফেলে… তারপর কি হবে?

[প্রকাশকের নোট: অসম্পাদিত, পরবর্তীতে সম্পাদনা করা হবে]

কেয়া চ্যাটার্জী। গল্পকার। জন্ম ১৯৯০, বেড়ে ওঠা কলকাতায়। লেখাপড়া করেছেন ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে। প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত হলেও পরবর্তীকালে ব্যাক্তিগত ও সন্তানের কারণে স্কুলে শিক্ষকতা পেশা ছেড়ে মায়ের দায়িত্ব পালন করছেন। সন্তান দেখাশুনার পাশাপাশি চলছে লেখালিখির কাজও। মূলত বিভিন্ন...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..